#শত_ ডানার_ প্রজাপতি
#urme prema (sajiana monir )
পার্ট : ২৮
লাইব্রেরী তে বসে আছি সামনে শেফা রেগে বসে । শেফার কটকট অগ্নি দৃষ্টি স্পষ্ট বলছে ।যে কোনো মুহূর্তে সে আমাকে খুন করে ফেলতে পারে । আমি সবটা বুঝেও না বুঝার ভান করে আছি । শেফা টেবিলে বারি দিয়ে বললেন ,
– “মানে তুই নিজেকে কি ভাবিস ? বলতো ? ”
আমি আমতাআমতা উত্তর দেই ,
– “কি আর ভাববো ,আর পাঁচটা মানুষের মত সাধারণ মানুষ । ”
– “তুই কি আমার সাথে ইয়ার্কি করছিস? বুঝতে পারছিস না আমি কি বুঝাতে চাইছি ?”
আমি ভাবলেশহীন ভাবে উত্তর দিলাম ,
– “না তো ! একদম বুঝতে পারছি না । ”
শেফার চওড়া উত্তর ,
– “হুর !! ডোন্ট ট্রায় টু বি স্মার্ট ,তোকে স্যুট করে না !
আমি তোকে হারে হারে চিনি । তুই এমন কি করে করতে পারিস ? আমি কি তোর কিছু হই না ? অগ্নি ভইয়া তোর বর । তুই এই কথা আমার থেকে লুকালি কি করে? ”
আমি বইয়ের দিকে মুখ দিয়ে বলি,
– “এতে বলার মত কি আছে ? উনি আমাকে চুক্তির বিয়ে করেছে । যার মেয়াদ একবছর । মেয়াদ শেষ হলে সম্পর্ক শেষ । আর তাছাড়া আমাদের মাঝে আর আট দশটা স্বাভাবিক হাসবেন্ড ওয়াইফের সম্পর্ক নেই । অগ্নি এখনো তার প্রথম ভালোবাসা কে ভালোবাসে । ”
শেফা অবাক চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলে ,
– “কাল রাতে তুই কি উনার অবস্থা দেখিস নি ? তোকে সামান্য কয়েক ঘন্টা না দেখে কেমন পাগল পাগল হয়ে গিয়েছিলো । উনার চোখে ভয় কি তুই দেখিস নি ? এর পরও কি তোর মনে হয় যে অগ্নি ভাইয়া তোকে ভালোবাসে না ? ”
আমি তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলি ,
– “ঐটা উনার ভালোবাসা না উনার মোহ ছিলো ।অগ্নি আমার মোহ তে পরেছে প্রেমেতে নয় ।
প্রিয়জন আর প্রয়োজনের মাঝে অনেক তফাৎ । আমি উনার শুধুই প্রয়োজন ,প্রিয়জন নই । উনার মনের ঘরে এখনো উনার প্রথম ভালোবাসা বসত করে । ”
শেফা কিছু বলতে নিলে আমি থামিয়ে দেই । শেফাও আর কথা বাড়ায় না ।
শেফা আর আমি খুব মন দিয়ে সামনে এক্সামের প্রস্তুতি নিচ্ছি । শেফা ফিন্যান্সে বেশ অভিজ্ঞ । তার থেকে কয়েকটা অঙ্ক বুঝে নিচ্ছি । এমন সময়ই কেউ বিচ্ছিরি ভাবে আমার চুল টানে । পিছনে তাকিয়ে দেখি রবিন দাড়িয়ে । মুখে খুব বাজে হাসি । এবার উনি ফাইনাল ইয়ারে । আমাকে খুব বিরক্ত করে । বিচ্ছিরি বিচ্ছিরি ভাষা ইউজ করে । ভার্সিটি তে ভর্তি হবার পর থেকে উনার যন্ত্রনায় অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছি । এমনটা শুধু আমার না আরো অনেক মেয়েদের সাথেই করে ।
উনার কথায় কোনো উত্তর দেই না । নিজের সব রাগ চেপে ধরে মাতা নিচের দিকে দিয়ে নিজের কাজ করতে লাগি । রবিন আমার কোনো জবাব না পেয়ে । আমার সামনা সামনি বসে । আমি তখনো নিরব । হুট করে আমার সামনের থেকে আমার বই টেনে নিয়ে নিচে ফেলে দেয় । আমি এবার রেগে উত্তর দেই ,
– “কি চাই আপনার ? এমন অসভ্যতামী করছেন কেন ? ”
উনি আমার কথায় বিচ্ছিরি হাসি দিয়ে বলে ,
– “রাগলে যা লাগে না ! একদম আইটেম বোম । মনে হচ্ছে এখনি ফেটে যাবে । ”
কথাগুলো বাজে দিকে ইঙ্গিত দিচ্ছে । মুখে ভাবভঙ্গিমা দেখে পুরো গাঁ ঘিনঘিন করে উঠে । উনার বাজে নজর আমার পুরো শরীরের দিকে ঘুরঘুর করছে । আমি উড়না নিয়ে নিজের শরীর ভালো ভাবে ঢেকে নেই । চোখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে ঘিনঘিন গলায় বলি,
– “ছিঃ কি চাহনি ।মেয়েদের সামান্যতম হলেও সম্মান দিতে শিখুন । বাড়িতে কি মা বোন নেই ? ”
– “আমি বললেই মা বোনের কথা তাই না ? আর অগ্নির সাথে যখনতখন রাতবেরাতে ঘুরে বেড়াস ? তখন ? তখন কোথায় যায় তোর এই আদর্শ? এক রাতের রেট কত ? কত দেয় অগ্নি তোকে? দেখছি তো আজকাল অগ্নিকে খুব ভালো সার্ভিস দিচ্ছিস!
তো মান্থলি প্রেমেন্ট করে ? নাকি এভরি ডে ? ”
অগ্নির সাথে উনার পূর্ব শত্রুতা আছে । অগ্নির বিরোধী দল । রবিনের কথায় আমার শরীরের লোমলোম জ্বলে যাচ্ছে । মাথা থেকে রাগে আগুন বের হচ্ছে । আমি উনার কাছে যেয়ে নিজের শরীরের সব জোড় দিয়ে ঠাস করে এক থাপ্পড় মারি । এক থাপ্পড়ে আমার রাগ ক্ষান্ত হচ্ছে না ।এখনো রাগে ফুসফাস করছি । চিৎকার করে বলি,
– “ছোট বেলা যদি তোর মা তোকে এভাবে থাপ্পড়টা দিতো না?
তাহলে আজ এসব অসভ্যতা করতি না । তোর পারিবারিক শিক্ষার অভাব । ”
রবিন রাগে ফুসতে লাগে । আমার কথা শেষ করে আমি যেতে নেই । এমন সময়ই পিছন থেকে আমার উড়না টেনে নেয় রবিন । আমি লজ্জায় নিজের দুহাতে শরীর ডাকতে ব্যস্ত হয়ে পড়ি । রবিন বিচ্ছিরি ভাবে ইঙ্গিত করে বলে ,
– “তোদের মত মেয়েদের চেনা আছে । গোপনে টাকার জন্য সব ছেলেদের কাছেই যাস আর প্রকাশ্য সবার সামনে ন্যাকামি করিস ।শুধু কি অগ্নি কে মজা দিলেই হবে ? মাঝেমধ্যে আমাদের কাছেও আসিস । টাকা দিয়ে লালে লাল করে দিবো । ”
আমি মাথা নিচু করে দাড়িয়ে আছি । শরীর বরফের ন্যায় শক্ত হয়ে গেছে । শেফা আমাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে লাগে । পুরো লাইব্রেরীর এতো গুলো মানুষের সামনে রবিন আমার উড়না টেনে নিয়েছে অথচ সবাই চুপ । কেউ টু শব্দ পর্যন্ত করছে না । সবাই দর্শক হয়ে সবটা দেখছে । কেই কোনো রকম প্রতিবাদ জানাচ্ছে না ।
সমাজের এমন চিত্র দেখে মনে হচ্ছে কেন নারী হয়ে জন্ম নিয়েছি ? নারী হয়ে জন্মানোই দুনিয়ার সবচেয়ে বড় পাপ । এই সমাজে নারীর কোনো মূল্য নেই । নারী তাদের কাছে খেলার বস্তু । মাংসের ধলা মাত্র ।
রবিন আমার উড়না নিজের গলায় পেঁচিয়ে নেয় । সবার সামনে আমাকে শাসিয়ে নিজের চ্যালাদের নিয়ে চলে যায় । আমি মাথা নিচু করে কান্না করছি । জীবনে কোনো দিন আমি এতোটা অসহায়ত্ব বোধ করিনি । এতোটা অপমান বোধ করিনি । আমার বুক চিড়ে কান্না আসছে । এই মুহূর্তে মরে যেতে ইচ্ছে করছে ।
শেফা আমাকে চেয়ারে বসায় । তাড়াতাড়ি করে নিজের ব্যাগ থেকে স্কার্ফ বের করে আমার শরীরে জড়িয়ে দেয় । আমার আশে পাশের কোনো কিছুর কোনো খেয়াল নেই । আমি একাধারে কান্না করে যাচ্ছি ।
মাথা নিচু করে নিজের চোখে পানি জড়াচ্ছি । শেফা ব্যাগ থেকে ফোন বের করে কাকে যেন ফোন করতে করতে বাহিরে চলে যায় ।
কিছুসময় পর অগ্নি কোথা থেকে যেন ছুটে আসে । কিছুক্ষণ আমাকে দেখে থমকিয়ে যায় । এরপর আস্তে আস্তে একপা একপা করে এসে আমার সামনে ফ্লোরে হাটু গেরে বসে । অগ্নি তখনো বড়বড় শ্বাস নিচ্ছিলো । মনে হচ্ছে পুরোটা পথ ছুটে এসেছে । আমি একবারের জন্য অগ্নির দিকে তাকাচ্ছি না । মাথা নিচু করে আছি । কিন্তু অগ্নি গভীর করে আমার দিকে তাকিয়ে । অগ্নির চোখে মুখে অস্থিরতা । চেহারাই বলেছে আমার এই অবস্থা অগ্নিকে কতটা দিশেহারা করে দিয়েছে ।অগ্নি আমার হাতে হাত রেখে কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন ,
– “হুর কি হয়েছে ? কে কি করেছে আমাকে বলো !
কি হয়েছে তোমার এমন অবস্থা কেন? ”
আমি কোনো জবাব দিলাম না । মাথা নিচু করে পাথর হয়ে বসে নিজের চোখের জল ফেলছি । অগ্নি আমার কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখে । আবার জিগ্যেস করেন ,
– “হুর আমার ভয় হচ্ছে ! কি হয়েছে বলো । হুররররররর! ”
শেষের ডাকটা চিৎকার করে বললেন । আমি ঠাস করে সবার সামনে উনার গালে এক চড় দেই । এরপর অন্যগালে আর একটা । অগ্নি চুপ ! থম লাগা চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে । আমি অগ্নির পাঞ্জাবীর দুই সাইডের কলার ধরে নিজের কাছে টেনে আনি ।আমার ভিতরের সব কষ্ট যন্ত্রনা রাগ ক্ষোভ সব চোখের জলের রুপ নেয় । আমার বুকের ভিতরের হাহারার গুলো ভয়ংকর রুপ ধারণ করে । আমি চিৎকার করে কান্না করতে করতে বলি,
– “করে দিয়েছেন আমার জীবন নরক । এবার খুশি ? ধন্যবাদ আমাকে রাস্তার পতিতা বানানোর জন্য । সবার সামনে আমাকে ছোট করার জন্য । আমার মান সম্মান আত্মমর্যাদা সব কিছু ধোলায় মিশিয়ে দিয়েছেন । আমার বেঁচে থাকার সব কারণ শেষ করে দিয়েছেন । আজ যা যা হয়েছে সব আপনার জন্য । সবার কাছে আমি আপনার রেষ্ট্রি রক্ষিতা । তাই তো আমার একরাতের রেট জিগ্যেস করছে !
সবার সামনে আমার গাঁয়ের উড়না টেনে নিয়ে গেছে ।
আপনি আমাকে শেষ করে দিয়েছেন অগ্নি । আমাকে জীবন্ত লাশ করে দিয়েছেন । আপনি খুব সুন্দর প্রতিশোধ নিয়েছেন আমার থেকে । আমাকে নিস্ব করে ভেঙে চুরমার করে দিয়েছেন । ”
আমি মাটিতে অগ্নির পায়ের সামনে বসে চিৎকার করে কান্না করতে লাগি । অগ্নি আমার কথা শুনে থরথর করে কাঁপছে । চোখ লাল বর্ন ধারন করেছে । কপালের রগগুলো ফুলে আছে । হাত শক্ত করে মুঠি বদ্ধ করে নেয় । চিৎকার করে সবার উদ্দেশ্য বললেন,
– “এ করেছে এসব ? ”
সবাই চুপ । অগ্নি কোনো উত্তর না পেয়ে সজোরে টেবিলে লাথি দেয় । টেবিল দূরে ছিটকে পড়ে । অগ্নি দ্বিগুণ রেগে চিৎকারে বলেন ,
– “কি তামাশা হচ্ছে ? আমি তামাশা করছি ? কেউ কথা বলছে না কেন ? আমি জিগ্যেস করেছি কে করেছে এসব ? ”
অগ্নি প্রত্যেকটা প্রচন্ড রেগে বলছে । অগ্নির ধমকে দেয়াল গুলোও কেঁপে উঠছে । কেউ কোনো কথা বলার সাহস পাচ্ছে না । ভয়ে থর থর করে কাঁপছে । শেফা ভয়ে ভয়ে সামনে এসে অগ্নিকে সব বলে অগ্নি সব শুনে আরো বেশ রেগে যায় । আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে লাগে । আমি চাইলেও ছাড়াতে পারবোনা । ছাড়ানোর চেষ্টা ও করছি না ।মুখে কিছু না বললেও অগ্নির এই ভয়ংকর লাল চোখ আমাকে ঠিক শাসিয়ে দিচ্ছে।অগ্নিকে আমি এর আগেও অনেক বার রেগে যেতে দেখেছি । কিন্তু এতোটা ভয়ংকর রূপ এই প্রথম দেখলাম ।আজ অগ্নির মাথায় খুন উঠে আছে ।
যেতে যেতে কাউকে ফোন করে কিছু আনতে বলে । ফোনে কথা বলার সময় উনার শরীর রাগে থরথর করে কাঁপছিলো । প্রত্যেকটা কথায় ভয়ংকর রাগী গর্জন ছিলো ।
ভার্সিটির আমগাছ তলায় রবিন আর তার চ্যালারা আড্ডা দিচ্ছিলো । অগ্নি রবিনের গলায় আমার পেঁচানো উড়নাটা নিজের হাতে পেঁচিয়ে রবিনকে টেনে নিচে ফেলে । মুখে এলোপাথাড়ি ঘুষি মারে । হাতের মোটা রড দিয়ে এলোমেলো ভাবে রবিনকে মারতে লাগে ।প্রত্যেকটা মার জয়েন্টে জয়েন্টে দিচ্ছে ।অগ্নির এই রাগের সামনে কেউ এক পা ও ভয়ে বাড়াচ্ছে না । রবিন আশেপাশে সাহায্য চাইছে কিন্তু কেউ আসছে না । রবিন ছুটে পালাতে চাইলে অগ্নি পিছন থেকে ছুটে ছুটে মারতে লাগে । কেউ অগ্নিকে থামাতে পারছে না ।যে যাচ্ছে সবাইকে ঝাড়ি দিয়ে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে । এই মুহূর্তে অগ্নির ক্রোধের কেউ সম্মখীন হতে চাইছেনা ।
রবিন রক্তাক্ত শরীর নিয়েই পালাতে চাইছে কিন্তু অগ্নি সেই সুযোগ দিচ্ছে না । এক সময় রড ফেলে দিয়ে লাথি দিতে দিতে বলে ,
– “বাই**** তোর এতো কারেন্ট ? তোর সব কারেন্ট আজ বের করবো । এমন অবস্থা করবো নিজেকে পুরুষ বলে দাবী করতে পারবি না ।
কুত্তা** ,শুয়া** জানোয়ার,তোর সাহস কি করে হয় হুরের শরীরে হাত দেওয়া ! ওর উড়না টেনে আনার ? বা**** এত বড় কলিজা আমার বউয়ের দিকে হাত বাড়িয়েছিস !
তোর বুক চিড়ে কলিজা বের করে খাবো । ”
আবার এলোপাথাড়ি লাথি দিতে লাগলো । মাঠের আশেপাশে দাড়িয়ে থাকা সবাই ভয়ে চুপসে আছে ।অগ্নির বন্ধুরা কেউ তাকে ধরে রাখতে পারছে না । অগ্নি রবিনকে মারতে মারতে আমার পায়ের সামনে ফেলে ।
রেগে চিৎকার করে বললেন,
– “পা ধরে ক্ষমা চা । ”
রবিন রক্তাক্ত কাঁপা কাঁপা হাত বাড়াতেই অগ্নির আমার ধমক ,
– “কুইক !!! ”
রবিন আমার পা ছুঁতেই অগ্নি আবার রবিনকে টেনে তুলে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন ,
– “থাপ্পড় দেও !”
আমি চুপ করে দাড়িয়ে আছি । অগ্নি ঝাঁঝালো কন্ঠে বললেন,
– “আমি বলেছি থাপ্পড় দিতে । ”
আমি সজোরে রবিনকে কয়েক্টা থাপ্পড় দিলাম । অগ্নি রবিন কে ছেড়ে দেয় । রবিন মাটিতে লুটে পরে । অগ্নি আমার হাত টেনে নিজের কাছে দাড় করিয়ে চিৎকার করে সবার উদ্দেশ্যে বললেন ,
– “হুর ,আতেফ খাঁন অগ্নির স্ত্রী । ওর দিকে কেউ বাজে নজরে তাকালে চোখ উঠিয়ে ফেলবো । এমন অবস্থা করবো লাশও কেউ চিনতে পারবে না । ”
রবিনের হাতে পাড়া দিয়ে বলল,
– “বাস্টার্ড ! এরপর হুরের দিকে চোখ তুলে তাকালে এমন অবস্থা করবো যে তোর বাড়ির লোক তোকে দাফন করার জন্য খুঁজে পাবে না । ”
ভার্সিটির সবাই এখনো থম মেরে দাড়িয়ে আছে ।
আমার শরীরে ভালো করে স্কার্ফ জড়িয়ে নিজের সাথে করে নিয়ে যায় । আমি অগ্নির দিকে অপলক চোখে তাকিয়ে ।
#শত_ ডানার_ প্রজাপতি
#urme prema (sajiana monir )
পার্ট : ২৯
আজকের এই মারামারির ঘটনা পুরো ভার্সিটি তে ছড়িয়ে গেছে । এখন পুরো ভার্সিটি জানে হামিয়া হুর আতেফ খাঁন অগ্নির স্ত্রী ।
আমার মনে শুধু একটা প্রশ্ন জাগছে । অগ্নি এমন টা কেন করলো ? কেন অগ্নির নামের সাথে আমার নামটাও জড়িয়ে নিলো ? বাসায় এসে সারাদিন নিজেকে ঘর বন্ধী করে রাখি । খাওয়া দাওয়া ঘুম সব ত্যাগ করেছি । বারবার রবিনের সেই নোংরা কথা গুলো মাথায় ঘুরঘুর করছে । চোখ বন্ধ করতেই ,উড়না টেনে নেওয়ার দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে উঠছে । লজ্জা অপমানবোধ গলা চেপে ধরছে । যা শ্বাস নেওয়া দুষ্কর করে দিচ্ছে । চোখ দিয়ে অনবরত চোখের পানি ঝড়ে যাচ্ছে । এতো গুলো মানুষের সামনে এভাবে জালিল হওয়ার অপমানবোধ আমাকে কুড়েকুড়ে খাচ্ছে।ভিতর থেকে বারবার বলছে ,’হুর তুই অপবিত্র ! রবিনের নোংরা দৃষ্টি , স্পর্শ তোকে অপবিত্র করে দিয়েছে । ‘
এসব মনে করতেই বুক চিড়ে হু হু করে কান্না চলে আসে ।
ভার্সিটি থেকে এসেছি সেই দুপুরে । এখন সন্ধ্যা পেড়িয়ে রাত । আমার কোনো হুশ জ্ঞান নেই। অগ্নি আমাকে বাসায় রুম পর্যন্ত পৌছিয়ে। কপালে চুমু দিয়ে বেরিয়ে পরে । এখনো ফিরেনি । পুরোটা সময় রেগে আগুন ছিলো ।
রাত পর্যন্ত কয়েকবার আপু আর মা এসেছিলেন ।ডেকে গেছে ।কিন্তু আমি কোনো প্রকার উত্তর দেইনি !
আজ কোনো কিছুই ভালো লাগছে না । সবকিছু বিষাক্ত লাগছে ।
কেউ রুমের দরজা খুলে । ঘুটঘুটে অন্ধকার রুমে আলোর লম্বা দাগ পরে। আমি রুমের এক কোনায় হাত পা ঘুচিয়ে কান্না করছি ।কেউ একজন আমার সামনে এসে বসে । আমার দিকে হাত বাড়াতেই আমি ছিটকে দূরে সরে যাই । কিন্তু সামনের মানুষটা আমাকে জোর করে নিজের বুকে টেনে নেয় ।এ বুক আমার অচেনা নয় । খুব পরিচীত । হ্যা আমি অগ্নির বুকে আছি ।
অগ্নি নিজের বুকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে । মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বললেন ,
– “হুসসসস ,একদম কান্না করবেনা । এভাবে কান্না করছো কেন ? কিছু হয়নি । আমি আছি তো ! ”
আমি বুকে মাথা ঠেকিয়ে কান্না করতে করতে উত্তর দেই ,
– “আমি অপবিত্র হয়ে গেছি অগ্নি ! রবিনের স্পর্শ আমাকে অপবিত্র করে দিয়েছে । ”
– “উহু হুর একদম না ,কারো অপবিত্র স্পর্শ আমার হুরকে অপবিত্র করতে পারবেনা । ”
আমি ভাবলিশহীন চোখে অগ্নির দিকে তাকিয়ে বলি,
– “আমি তো অপবিত্রই অগ্নি । সবার সামনে আমার উড়না টেনে খুলেছে আমাকে অপমান করেছে । পতিতা বলেছে । এর চেয়ে অপমানের আর কি হতে পারে ?
এর চেয়ে তো আমার মৃত্যু ভালো ছিল ।
আজ যা যা হয়েছে সবকিছুর জন্য আপনি দায়ী ! ”
অগ্নি বিষ্ময়কর চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন ,
– “এতে আমার কি দোষ? আমি কি করেছি? ”
– “সব আপনারই দোষ ! আপনি সব করেছেন । আজ আমার সাথে যা কিছু হয়েছে সবকিছুর জন্য আপনি দায়ী । আপনি এসব কিছু করেছেন ।ডিরেক্টলি হোক বা ইনডিরেক্টলি আমার সাথে আজ পর্যন্ত যা কিছু হয়েছে সব কিছুর জন্য আপনি দায়ী । কেবল মাত্র আপনার জন্যই আমার জীবন আজ এমন ছেলেখেলা হয়ে গেছে ।সব কিছু এমন উলট পালট করে দিয়েছে । আমাকে শেষ করে দিয়েছেন । আমার মান সম্মান মন সব নষ্ট করে দিয়েছেন । আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল ছিলো আপনাকে ভালোবাসা । আপনাকে বিয়ে করা । আপনার কথা শুনিনি বলে আমার থেকে এভাবে প্রতিশোধ নিলেন ? আমার জীবন শেষ করে দিলেন? আ…আমার …..”
আর বলতে পারলাম না ভিতরে সব ভেঙে কান্না আসছে । আমিও আর নিজেকে আটকালাম না । আমি চিৎকার করে কান্না করতে লাগলাম । আমি ফ্লোরে পড়ে চিৎকার করে কান্না করছি । এতো দিনের সব চাপা কষ্ট যন্ত্রণা সব বুক ফাটা চিৎকারের বেরিয়ে আসে । আমি ফ্লোরে গড়িয়ে কান্না করছি । অগ্নি আমার দিকে পাথর চোখে তাকিয়ে আছে । অগ্নি চোখ থেকে পানি ঝড়ছে । আমার সব যন্ত্রণা যেন উনি অনুভব করছে । আমার প্রত্যেকটা কষ্টে অগ্নির চোখে জল । এই অনুভূতি কিসের জন্য ? আমার জন্য ?
অগ্নি এক পা আমার দিকে এগিয়ে আসে ,আমাকে সামলানোর জন্য । কিন্তু আজ আমার অগ্নিকে খুব অসহ্য লাগছে । একদম বিষের ন্যায় বিষাক্ত । আমি মাটিতে শুয়েই চিৎকার করে বলি,
– “আমাকে একদম স্পর্শ করবেন না । একদম না । আপনার স্পর্শ আমার কাছে বিষের মত লাগে । মনে হয় কেউ আমার গলা চেপে ধরে আছে ।
আমার আপনার এই হুটহাট দয়ার কোনো প্রয়োজন নেই । ইদানীং আপনার এই হুটহাট দয়া খুব অসহ্য লাগে । খুবই অসহ্য। যতবার আপনি আমার কাছে আসেন ততবারই বিষাক্ত অনুভূতি জেগে উঠে । ”
অগ্নি আমার কাছে এসে আমাকে মাটি থেকে তুলে নিজের কোলে টেনে বসায় । অগ্নি থেকে ছাড়া পাবার জন্য আমি আমার সর্বস্র চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি । কিন্তু বিশেষ কোনো লাভ হয় না । অগ্নি পিছন থেকে আমার ঘাড়ে মুখ ডুবিয়ে শব্দহীন ভাবে নিজের চোখের জল ঝরাচ্ছে । অগ্নির ঘনঘন গরম নিশ্বাস আমার ঘাড়ে পড়ছে । পিঠ ভিজে যাচ্ছে । অগ্নি কোনো কথা বলছে না একাধারে চোখের জল ফেলে যাচ্ছে ।
আমি চিৎকার করে বলি ,
– “ছাড়ুন আমাকে ! ”
অগ্নি আমার ঘাড়ে মুখ ডুবিয়ে মাথা নাড়িয়ে “না বোধক “উত্তর দিলেন । আমি ক্রুদ্ধ গলায় বলি ,
– “আমাকে ছাড়ুন আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে । অসয্য লাগছে খুব । ”
উনি ভেজালো গলায় উত্তর দেয় ,
– “না আমি ছাড়বো না । তোমাকে আমার প্রতিটা নিশ্বাসে প্রয়োজন । খুব করে প্রয়োজন । ”
– “হুম আমি তো শুধু আপনার প্রয়োজন হয়েই রয়ে গেলাম । কখনো প্রিয়জন হয়েছি ? না কখনো হবো ! ”
অগ্নি পিছনে আগের মত মুখ ডুবিয়ে বিষ্মিত গলায় উত্তর দিলেন ,
– “তুমি কি আমার চোখের ভাষা বুঝো না হুর ? তোমার কি মনে হয় তুমি আমার শুধুই প্রয়োজন ? প্রিয়জন নয় কি ?
যদি তাই না হতে তাহলে আমি কেন সবার সামনে তোমাকে নিজের বলে দাবী করেছি ? কেন পুরো ভার্সিটির সামনে বলেছি তুমি আমার স্ত্রী ? ”
– “এগুলো বলে আপনি কি আমার উপর খুব দয়া করেছেন ?
আপনি ভাবছেন এসব বলে আপনি খুব মহৎ কোনো কাজ করেছেন ? আমি বলেছিলাম আপনাকে এসব বলতে ? ”
– “হুর তুমি এভাবে কথা পেঁচাচ্ছো কেন ? নেগেটিভলি নিচ্ছ কেন ? আমি মোটেও এসব মিনিং করিনি । আমি জাস্ট বলেছি আমার নিজের কাজের জন্য গিল্টি ফিল হচ্ছিলো আমি এমন টা আরো আগে করলে কেউ তোমার দিকে চোখ তুলে তাকাতো না ।”
– “আমি কথা পেঁচাচ্ছি ? আমি? আপনি
ডাবল মিনিং কথা বলছেন । এতেও আমার দোষ ?
আর আপনি যুক্তিবাদী লোক । আমি শুধু আপনার যুক্তিতে আপনাকে বুঝাচ্ছি ।
আর আপনার গিল্টি ফিল করার কোনো প্রয়োজন নেই । আমি সারাজীবন আপনার জীবনে থাকবো না । যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দূরে চলে যাবো । অনেক দূর । ”
আমার কথায় হয়তো অগ্নি রেগে গেছে । বড় বড় রাগী শ্বাস ফেলছে । আমাকে হুট করে টেনে নিজের দিকে ঘুরায় । ঝাঁকুনি দিয়ে ঝাঁঝালো গলায় বললো ,
– “এই মেয়ে কি চাও তুমি ? কি চাও?
আমি শান্ত ভাবে বোঝাচ্ছি কথা কানে যাচ্ছে না ? তুমি কি ভেবেছো তুমি যেতে চাইলেই আমি নাচতে নাচতে তোমাকে যেতে দিবো ? হুম ?
না একদম না । তুমি আমার বিয়ে করা বউ তোমার উপর আমার অধিকার আছে । আর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এই অধিকার থাকবে ।
আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন আমাদের মাঝে স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক তৈরি হয়েছে । তুমি পূর্নরূপে আমার স্ত্রী । ”
– “ওও বুঝতে পেরেছি । আপনি আমার উপর দয়া করছেন তাই না ?
সেই রাতে আমার কাছে আসায় আপনার গিল্টি ফিল হচ্ছে । তাই তো ?
আমার চাইনা আপনার দয়া । ছোট থেকে এই পর্যন্ত সবার দয়ায় বড় হয়েছি আমি আর কোনো রকম দয়া চাই না । সেই রাত আমি আমার স্মৃতি থেকে মুছে ফেলেছি । আপনি মুছে ফেলুন । ”
অগ্নি আমার বাহু ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে বললেন ,
– “স্মৃতি থেকে সেই রাত মুছে ফেলেছো মানে ? কি মুছেছো ? পেরেছো মুছতে? আমি তো পারবো না ! কোনো দিন মুছতে চাই । চোখ বন্ধ করলে চোখের সামনে সেই রাত ভেসে উঠে । তোমার করা পাগলামোর কথা মনে পড়লে এখনো পুরো শরীরে শিহরণ জাগে। তোমার সেই এলোমেলো চুল ,মাতাল চাহনির কথা মনে পড়লে এখনো বুকটা ধুকধুক করে । তোমার সেই উষ্ণ নিশ্বাস আমি এখনো অনুভব করি।সেই অনুভূতির কথা মনে করে এখনো গাঁয়ে কাটা দিয়ে উঠে ।
আর বলছো সেই রাত ভুলে যেতে ? আমি তো ভুলতে চাই না । সেই রাত আমার জীবনের সবচেয়ে মধুর রাত । যা সারাজীবনের জন্য মনে দাগ কেটে গেছে । তুমি পারবে কি সেই রাত ভুল তে ? ”
আমি অগ্নির কথায় কোনো জবাব দিলাম না । চুপ করে থাকলাম । কি জবাব দিবো । সেই রাত তো আমি কোনো দিন ভুলতে পারবো না । সেই রাত আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ রাত । যতই অগ্নির সাথে রেগে বলি আমি সেই রাত ভুলে গেছি ।কিন্তু সত্যি তো এটাই যে আমি পারবো না ভুলতে অগ্নির সেই স্পর্শ ,সেই আদুরে চোখের চাহনি । ভয়ংকর আদর । অগ্নির প্রত্যেকটা স্পর্শ আমার আত্মার সাথে মিশে গেছে । আমি চাইলেও কোন দিন তা ভুলতে পারবো না ।
অগ্নির কোনো প্রশ্নের আমার কাছে কোনো উত্তর নেই । আর কিছুক্ষন উনার সাথে থাকলে আমি আবার অগ্নির প্রতি দুর্বল হয়ে পড়বো ।কোনো সাড়াশব্দ না করে আমি সামনের দিকে পা বাড়াই । দু কদম পা বাড়াতেই পিছন থেকে অগ্নি আমার হাত টেনে ধরে । আমি পিছন দিকে ফিরে দেখি অগ্নি হাঁটু গেড়ে মাথা নিচু করে বসে আছে । আমি গম্ভির কন্ঠে বললাম,
– “অগ্নি আমার হাতটা ছাড়ুন ,আমার বিষণ অসহ্য লাগছে । ”
অগ্নি মাথা নিচু করেই শীতল গলায় বললেন ,
– “লাভ ইউ সুন্দরী ! আই লাভ ইউ!! ”
উনার কথাটা কানের মাঝে সজোরে বারি খায় । কানের পর্দা এখনো থমথম করে বাজছে । অগ্নি ভুল বলছে ? নাকি আমি ভুল শুনছি ? যা বলছে তা কি আদৌ সম্ভব ?
আমার পুরো শরীরে শীতল হাওয়া বইছে । আমার হাত পা থরথর করে কাঁপছে । বড় বড় চোখ করে অগ্নির দিকে তাকিয়ে আছি । অগ্নি আমার দিকে মাথা তুলে তাকায় । চোখ গুলো টলটল করছে। এই চোখে মিথ্যার কোনো ছায়া নেই । সত্যতা ছলছল করে প্রকাশ পাচ্ছে । কিন্তু এই সত্যকে গ্রহণ করার মত সাহস শক্তি আমার মাঝে নেই । মনে একরাশ অভিমান ইগো ভড় করে ।সেদিন উনার করা সেই খারাপ ব্যবহার মনে পড়ে যায় । সেদিন অগ্নি আমাকে অস্বীকার করেছিলো ।নিজের থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছিলো । আজ অগ্নির কাছে আসাটা মন থেকে স্বীকার করতে পারছি না ।
আমি অগ্নি থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে বলি ,
– “আমার কিছু সময়ের প্রয়োজন । আপনার এসব কথা আমাকে ম্যান্টলি টর্চার করছে।আমি আপনার কাছাকাছি থাকলে আমাদের মধ্যেকার দূরত্ব আরো বাড়বে ।রিফ্রেশমেন্টের জন্য আমার কিছু সময়ের প্রয়োজন । আমি কিছুদিনের জন্য আপনার থেকে মুক্তি চাই ।পুরোপুরিভাবে ! ”
উনি আমার জবাবে থম মেরে আগের ভঙ্গিতেই বসে আছে । হয়তো আমার থেকে এমন কিছু আশা করেনি ।উনার চোখে তীব্র যন্ত্রণা প্রকাশ পাচ্ছে । আমি তাড়াতাড়ি চোখ সরিয়ে নেই । এই চোখের মায়ায় আমি পড়তে চাইনা । এই মুহূর্তে তো একদমই না !
আমি বারান্দায় দাড়িয়ে আছি । গভীর রাত । চারদিকে নিস্তব্ধতা । কোনো শব্দের আনাগোনা নেই । আকাশে বৃত্তের ন্যায় বিরাট চাঁদ । চাঁদকে ঘিরে মিটমিট তারা জ্বলছে । চাঁদের চাঁদনীতে পুরো শহর আলোকিত । আমি আনমনে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছি । মন আজ গভীর করে বিষন্নতায় ডেকে আছে ।
বার বার মনে একই প্রশ্ন জাগছে । অগ্নি আমার প্রস্তাবে রাজি হবে কি ? যেতে দিবে তার থেকে দূরে ?
হ্ঠাৎ ই কারো পায়ের শব্দ কানে আসে । নিশ্চিত অগ্নি ! অগ্নি ছাড়া অন্যকেউ হতেই পারে না ।
আমি পিছনে ফিরে তাকিয়ে দেখি অগ্নি দাড়িয়ে । হাতে খাবারের প্লেট । চোখ ফুলে লাল হয়ে আছে । কান্না করেছে কি ? কিন্তু কেন ?
অগ্নি আমার হাত টেনে বারান্দার চেয়ারে বসায় । আর অগ্নি আমার সামনা সামনি বসে আমার দিকে গভীর চোখে তাকিয়ে । আমি চোখ নামিয়ে ফেলি । অগ্নি মুখের সামনে খাবার ধরতেই আমি আমতা আমতা করে বলি,
– “আমি খাবোনা । খিদে নেই ! ”
– “সারাদিন কিছু মুখে দেওনি । জিদ না করে খেয়ে নেও । ”
আমি মুখ ঘুরিয়ে নেই।অগ্নি বড় একটা নিশ্বাস নিয়ে বললেন ,
– “বাড়িতে যেতে চাও না ? ”
আমি মাথা হ্যা বোধক নাড়াই । অগ্নি সুক্ষ্ম চোখে তাকিয়ে বললেন ,
– “তাহলে আমার সব কথা মানতে হবে ! আমি যা বলবো তা করতে হবে । ”
– “কি করতে হবে ? ”
আমি ছোট মুখ করে প্রশ্ন করি । অগ্নি আমার মুখের সামনে খাবার তুলে উত্তর দেয় ,
– “আপাদতো খাবারটা শেষ করো । ”
আমি বাঁকা চোখে অগ্নির দিকে তাকিয়ে খাবার মুখে তুলি । খাবার চাবাতে চাবাতে বলি ,
– “আমাকে সত্যি সত্যি যেতে দিবেন ? ”
অগ্নি মাথা নিচু করে মলিন গলায় উত্তর দেয় ,
– “অন্যায় যেহেতু আমি করেছি মাশুল তো আমাকেই দিতে হবে । ”
আমি অগ্নির উদাসীন চোখে তাকিয়ে আছি । এই চোখে তীব্রতর কষ্ট যন্ত্রণা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে ।
#শত_ ডানার_ প্রজাপতি
#urme prema (sajiana monir )
পার্ট : ৩০
চাঁদের চাঁদনী বড় কাচের দেয়াল ভেদ করে পুরো ঘর আলোকিত করছে । আমি বিছানায় গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছি । চোখে ঘুমের ছিটেফোঁটাও নেই । চোখ জোড়া খিচে বন্ধ করে রেখেছি । সোজাসুজি ভাবে বললে ঘুমের ভাণ করে আছি । অগ্নি আমার পাশেই বসে । মূলত অগ্নি পাশে আছে বলেই এমনটা করা । আমি চোখ বন্ধ রেখেই বলতে পারছি অগ্নি আমার দিকে গভীর চোখে তাকিয়ে আছে ।
নাকে সিগারেটের তীক্ষ্ণ গন্ধ আসছে । আমি পিটপিট চোখে তাকিয়ে দেখি অগ্নি পাশের চেয়ারে বসে আছে । পা জোড়া সেন্টার টেবিলের উপর উঠানো । হাতের সিগারেটটা জলজল করে জ্বলছে । চোখ দুটো ভয়ংকর লাল হয়ে আছে । আর দৃষ্টিটাও আমার দিকে । সবটা বুঝতে আমার খুব একটা কষ্ট হলো না । কারন চাঁদের উজ্জ্বল আলো আমাদের দুজনকেই ঘিরে আছে । অগ্নির মাতাল চাহনিটাও আমার চোখ এড়ায় না ।এই চোখে কি আছে ? রাগ? নেশা ? প্রেম? না তীক্ষ্ণত্ব কোনো চাওয়া ?
আমি সেদিকে আর তাকালাম না আমার চোখ জোড়া খিচে বন্ধ করে নেই । গাঁয়ের কম্বলটা শক্ত করে আঁকড়ে ধরি । বেশ কিছুক্ষণ কেটে যায় । আচমকা টের পাই অগ্নি আমার দিকে এগিয়ে আসছে । ভয়ে আমি বালিশের কোনা খামচে ধরি । কপালটাও সামান্য কুঁচকে যায়। আচ্ছা অগ্নি আমার দিকে এগিয়ে আসছে কেন? আমাকে মারবে কি ?
যদি অগ্নি সজ্ঞানে অগ্নি কখনো এমনটা করবে না । কিন্তু এখনতো নেশারঝোঁকে আছে । যদি এমন কিছু করে দেয় এমনি তেই আমার উপর যা রেগে আছে ।
মনে ভয় খচখচ করছে । মনে মনে নিজের মনকে বুঝ দিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করছি ।
হ্ঠাৎ ই অগ্নির বরফ শীতল হাত আমার গালে স্পর্শ পাই । আমার দু গালে অগ্নির দু হাতের বৃদ্ধাঙ্গুল দিয়ে আঁকিঝুঁকি করছে । প্রত্যেকটা স্পর্শ খুব আদুরে । হঠাৎই অগ্নি কপালে খুব আলতো চুমু খেলেন । আমি কেঁপে উঠি । আমার পুরো শরীর কাটা দিয়ে উঠেছে । এই কনকনে শীতের মাঝেও গাল গরম হয়ে গেছে । কান থেকে গরম ধোঁয়া বের হচ্ছে।হার্ট খুব স্পীডে চলাচল করছে । উনার স্পর্শ গুলো এমন কেন? তড়িদগতি সম্পন্ন !
অগ্নি আমার ঘাড়ে চুলের মাঝেই নিজের মুখ ডুবায় । আমি তখনো চোখ মুখ খিচে বন্ধ করে আছি । উনার শরীর থেকে তীব্র মদের গন্ধ আসছে ।মদের গন্ধ আমার খুব অসহ্য লাগে । আমি কোনো রকম নিজেকে কন্ট্রোল করে রাখছি ।অগ্নি আমার ঘাড়ে বেশ কয়েকবার নিজের শীতল খশখশ করা ঠোঁটের স্পর্শ দেয় । আমি আমার কাঁপাকাঁপা হাত পা নিয়ে কোনো রকম চোখ বন্ধ করে আছি । অগ্নি আমার কানের লতিতে নিজের ঠোঁট ছুঁয়িয়ে আলতো স্বরে বলে ,
– “আমি জানি তুমি এখনো জেগে সুন্দরী ! নিজেকে এভাবে কষ্ট না দিয়ে চোখ খুলো । ”
আমি উনার কথায় সাথে সাথে চোখ খুলে আড়চোখে অগ্নির দিকে তাকাই । অগ্নি তখনো আমার ঘাড়ে মুখ ডুবিয়ে আছে । আমি সিলিং এর দিকে তাকিয়ে আমতা আমতা করে বলি ,
– “আমার কাছে কেন এসেছেন । ”
অগ্নির মাতাল স্বর ,
– “অনেকক্ষণ তো চেষ্টা করলাম তোমার থেকে নিজেকে দূরে রাখার। কিন্তু পারলাম কই ? তুমিই তো কাছে টেনে আনলে ! ”
– “আমি কি করে কাছে টেনে আনলাম ? আমি কি আপনাকে ডেকেছি ? না আপনার হাত টেনে এনেছি ? ”
উনি হাল্কা শব্দ করে হেসে উত্তরে বললেন,
– “ডাকার জন্য কি এই দুটো উপায় ই ? আর অন্য কোনো উপায় নেই ? ”
আমি হ্যবলার মত অগ্নির কথায় থম মেরে আছি । অগ্নি আমার ঘাড় থেকে মুখ তুলে আমার দিকে ঝুঁকে ভারী গলায় উত্তর দেয় ,
– “ডাকার জন্য আরো কত উপায় আছে ! এই যে তুমি এলোমেলো চুলে বাঁকিয়ে আমার সামনে এমন আবেদনময়ী ভঙিতে শুয়ে আছো । মুখের উপর চাঁদের নুর পড়ছে । তোমার চাঁদেরকণা মুখটায় এক মোহনীয় মায়ায় ভরে আছে ।
তা কি আমাকে আকৃষ্ট করার জন্য যথেষ্ট নয় ? আমার বুকে আগুন জ্বালানো ,কন্ট্রোলেস করার জন্য যথেষ্ট নয় কি ? ”
আমি অগ্নির থেকে চোখ সড়িয়ে নেই । অন্যদিকে তাকিয়ে বলি,
– “আপনি এখন সজ্ঞানে নেই । নেশার ঘোরে আছেন । ”
অগ্নি আমার মুখ টেনে নিজের দিকে ঘুরিয়ে অস্থির কন্ঠে বললেন ,
– “একদম ঠিক বলেছো । আমি সত্যি নিজের মধ্যে নেই । আমি নেশায় পড়েছি! কিন্তু তা মদের না তোমার নেশায় পড়েছি । বুকে ঝড় উঠেছে । ভয়ংকর ঝড় । এই ঝড় শুধু তুমিই থামাতে পারো ! ”
আমি অগ্নির দিকে ভীতু দৃষ্টি তে তাকাই । কি বলতে চাইছে অগ্নি ?
অগ্নি হয়তো আমার দ্বিধাদ্বন্দ্ব বুঝতে পেরেছে । এক টুকরো হেসে বললেন,
– “ভয় নেই সুন্দরী আমি এমন কিছু চাইবো না যা আমাদের দূরত্বের কারন হবে !
কিন্তু যা চাইবো তা আমাকে দিতেই হবে । তুমি দিতে বাধ্য !
আমার আজ রাতের জন্য তোমাকে চাই । ”
অগ্নির কথায় আমি বড়বড় চোখ করে তাকাই । অগ্নি বললেন ,
– “এই না না তুমি যা ভাবছো তা নয় । আমি আজ সারারাত তোমাকে নিজের বুকের মাঝে আগলে রাখতে চাই মন জুড়িয়ে তোমাকে দেখতে চাই । কাল বাড়ি যাবে জানিনা আবার তুমি কবে ফিরবে । কবে আবার এতোটা কাছ থেকে তোমাকে দেখবো !
তাই আজ সারারাত তোমাকে দেখে পাড় করতে চাই ।”
আমি অগ্নির চোখে এই মুহূর্তে পাগলামো দেখছি । এই অগ্নি অন্য এক অগ্নি । এক অগোছালো অস্থির অগ্নি । যার চোখে তীব্র চাওয়া আকাঙ্ক্ষা !
আমি অগ্নির চোখের মায়া এড়াতে পারিনা । অগ্নিকে কিছুটা জায়গা খালি করে দিয়ে পাশেই শুয়ে পড়ি । অগ্নিও দেরী না করে লাফ দিয়ে বিছানায় উঠে । আমাকে টেনে বুকে নিয়ে নেয় । অগ্নির মুখে এই মুহূর্তে বিশ্বজয়ের হাসি !
____________________________
সকালে ঘুম ভাঙতেই অগ্নি কে পাশে দেখতে পাই না । নিচেও নেই ।
আপু আজ বাড়িতে যাচ্ছে ।প্রেগন্যান্সিতে মন একদম বাচ্চাদের মত হয়ে যায় । মায়ের কাছে থাকতে ভালো লাগে ।তাই আপু কিছুদিনের জন্য বাড়িতে যাচ্ছে । আমিও ঝোপ বুঝে কোপ মারি। আপুর সাথে বাড়িতে যাওয়ার কথা বলি । মা ও নিষেধ করেন না । আর অগ্নিও সকাল থেকে লাপাত্তা । আমি সকালের নাস্তা শেষে রুমে এসে প্যাকিং করছি । এমন সময়ই অগ্নির আগমন ঘটে ।কয়েক সেকেন্ড আমার দিকে আর প্যাকিং করা ব্যাগের দিকে রাগী দৃষ্টি তে তাকিয়ে থাকে । পাশে থাকা ফুলদানি টা মাটিতে আছাড় মেরে ওয়াশরুমে চলে যায় । আমি অগ্নির কান্ডে হা করব তাকিয়ে আছি । এমন হুটহাট রেগে যাওয়ার কারণ আমার মাথায় খেলছেনা।আমি তো কাল রাতেই বলেছিলাম আমি আজ বাড়িতে যাবো । তাহলে এমন রিয়েক্টের কারণ কি ? আর রেগে গেলে কি ঘরের জিনিস ভাঙা আবশ্যক ? এই লোকের এই একটা জিনিস আমার প্রচন্ড বিরক্ত হই । রেগে গেলে হয়তো নিজের ক্ষতি করবে ,না হয় ঘরের জিনিস ভাংচুর করবে !
আমি উনার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘ এক নিশ্বাস ছাড়ি । আমি যখন রেডি হচ্ছিলাম অগ্নি পুরোটা সময় আমার দিকে তাকিয়ে ছিলেন । কোনো সাড়াশব্দ ছাড়া । চোখ দুটো রক্তলাল ছিলো ।আমার সাথে টু শব্দ পর্যন্ত করে না । ভাইয়া অগ্নিকে আমাদের মামা বাড়ীতে পৌছিয়ে দেওয়ার কথা বললে । অগ্নি রেগে উত্তর দেয় । উনি আমাদের দিয়ে আসতে পারবে না । উনার সময় নেই । বলেই রাগে ফুসতে ফুসতে উপরে চলে যায় । উনার ব্যবহারে আপু আর ভাইয়া বেশ অবাক হয় । ভাইয়া আমাদের বাড়িতে পৌছিয়ে দেয় ।
বাড়ি তে সবার সাথে দেখা করি ।
মামা মামি আমাদের দেখে খুব খুশি হয়ে যায় ।সবাই একসাথে দুপুরে লাঞ্চ করি ।
লাঞ্চ শেষ করে দুপুরের পর বিছানায় গাঁ এলিয়ে দেই। এতো দিন পর নিজের নিজের ঘর নিজের বিছানায় শুয়ে বেশ শান্তি লাগছে । কেমন যেন মুক্ত মুক্ত লাগছে । কিছুক্ষনের মাঝেই ঘুমের দেশে তলিয়ে যাই । মাগরিবের আযানে ঘুম ভাঙে । নামায পড়ে কফির মগটা হাতে নিতেই ফোনটা বেজে উঠে ।ফোনের সাথে সাথে মনের ঘন্টিটা ও বেজে উঠে । অগ্নি ফোন করেছে কি ? উৎসাহ নিয়ে তাড়াতাড়ি ফোনটা হাতে নেই । ফোনের দিকে তাকিয়ে দেখি শেফার নাম ভাসছে । মনটা ছোট হয়ে যায় । শেফার সাথে কথা বলে জানতে পারি । রবিনকে ভার্সিটি থেকে টিসি দেওয়া হয়েছে । আর অগ্নিকে এক সাপ্তাহের জন্য সাসপেন্ড । খোলা চোখে অগ্নি যদিও কোনো দোষ করে নি । কিন্তু মারামারি আর ভার্সিটির রুলস ব্রেক করার কারনে এমনটা করেছেন । যদি অগ্নিকে কিছু না বলা হয় তাহলে অন্যান্য স্টুডেন্ট তা খারাপ নজরে নিবে । আর তাছাড়া অগ্নি ভার্সিটির রাজনীতিতে জড়িত যদি এমনটা না করে তবে সবাই ভাববে ক্ষমতার জোরে এসব করেছেন ।পরবর্তীতে ভার্সিটি তে বাজে পরিবেশ সৃষ্টি করবেন । অগ্নি নিজের থেকেই মাথা পেতে পানিশমেন্ট নিয়েছেন ।
সেদিন অগ্নি আর ফোন দেয় না । সারারাত কেটে যায় কোনো খোঁজ নেয় না ।
_________________________________
আজ দুদিন হয়ে গেছে । অগ্নির কোনো খোঁজ নেয় নি । এই দুদিনে রাগ অভিমান আরো মাথায় চড়ে বসেছে । এই তার ভালোবাসা ? এই ?
দুদিনে না ফোন করেছে ,না কোনো খোঁজ নিয়েছে !
অসভ্য লোক একটা । কাছে থাকলেই যত ভালোবাসা কেয়ার হ্যান ত্যান !
এই দুদিনে মা কম হলেও শতবার ফোন করেছে । আর শেফা তো সারাদিনই ফোনের উপর ফোন করছে । কি করছি ? খেয়েছি নাকি? এটা ওটা জিগ্যেস করছে । যেন আমার প্রেমিক বা স্বামী । শেফার এমন হুটহাট টাকা খরচ করে ফোন দেওয়া আর সারাদিন কথা বলা । আমাকে বেশ ভাবাচ্ছে ! মেয়েটার কি হলো ? মেয়েটার জেন্ডার- টেন্ডার চেঞ্জ করেছে কি ?
ইয়াক ! যাতা ভেবে যাচ্ছি । আই হেইট মাই মাইন্ড ।
কাল আইসক্রিম খেয়ে গলা বসে গিয়েছিলো । মামা মামী আপু কত খেয়াল রেখেছে । শেফা আর মা তো কিছুক্ষণ পর পর ফোন দিয়ে খবর নিয়েছে ।
সবাই আমার কতো খেয়াল রাখে । আর এক উনি যার আমার থাকা না থাকায় কোনো কিছু আসে যায়না । মনে একরাশ অভিমান বুকে জমাট বাঁধে !
সকাল দশটার দিকে শেফা ফোন দেয় ।বিকালে বের হতে চাইছে । বাড়ি থেকে বিয়ে ঠিক করেছে । আজ বিকালে ছেলের সাথে দেখা করবে । আমি প্রথমে না করে দেই । কিন্তু পরে শেফার রিকোয়েস্টে আর না করতে পারি না । যাওয়ার জন্য রাজি হই । বাড়িতে বন্ধী থাকতে থাকতে হাপিয়ে গিয়েছি । বাহিরে বের হলে মন কিছুটা হাল্কা হবে ।
আর অগ্নির ভূত ও ঘাড় থেকে নামবে !
#শত_ ডানার_ প্রজাপতি
#urme prema (sajiana monir )
পার্ট : ৩১
(বড় করে লিখতে যেয়ে লেট হয়ে গেছে স্যরি)
ডিসেম্বর মাস কনকনে শীত। ছোট দিন । পাঁচটা বাজতেই বেলা ডুবে । এখন ঘড়িতে চারটা বাজতে চলছে । দিনের আলো আস্তে আস্তে ফুরিয়ে আসছে । সূর্যটা পশ্চিমা আকাশে হেলে আছে । আমি আয়নার সামনে দাড়িয়ে চুল ব্রাশ করছি । এইতো শেফা এলো বলে ।
নিজেকে হাসি খুশি রাখতে সামান্য সেজেছি । পড়নে ডায়মন্ড জর্জেটের কলারওয়ালা কালো গ্রাউন । সামনের দিকে গোল্ডেন শো বাটন । চোখে গাঢ় করে কাজল ।ঠোঁটে হাল্কা গোলাপি লিপস্টিক । গলায় অগ্নির দেওয়া সেই চেইনযুক্ত লকেট । হাতে সিম্পল স্টোনের চুড়ি । চুল গুলো ছেড়েই রেখেছি । এমন সময়ই শেফার আগমন ঘটে । সব সময়ের মত আমাকে দেখেই জড়িয়ে ধরে বললো,
– “হায় মেরি জান! পুরো আগুন লাগছে । আজ তো উনি দেখেই হার্ট এটাক করবে । ”
শেফার কথায় ভ্রু কুঁচকিয়ে বলি ,
– “এই উনি টা কে ? ”
শেফা আমতা আমতা করে বললেন ,
– “কে আবার ,আমার হবু বর । তুই যে ভাবে সাজগোজ করেছিস না ।তোর দিকেই তাকিয়ে থাকবে আমাকে আর দেখবে কই ? ”
– “হয়েছে তোর আজগুবিকথা ? এবার বের হই ? ”
– “হুম চল চল । এমনিতেই অনেক লেট হয়ে গেছে । ”
দুজন রেস্টুরেন্টের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম । কিছুক্ষনের মাঝেই বড় এক রেস্টুরেন্টের সামনে অটো থামে । ভাড়া মিটিয়ে । দুজন ভিতরে যাবার জন্য পা বাড়ালাম । কাচের ভারী দরজা খুলতেই চোখ কপালে । অনেক বড় রেস্টুরেন্ট । ওয়েটার আমাদের উপরে বসতে বললেন । আগের থেকেই নাকি আমাদের জন্য উপরে রফটপে টেবিল বুক করে রেখেছেন । চিকন কাঠের সিড়ি বেয়ে উপরে উঠি । পরিবেশ দেখে চোখ মুগ্ধতায় জুড়িয়ে যায় । অসম্ভর সুন্দর করে সাজানো । উপরের সিলিং কাচের । আর সেই কাচের উপরে লতাপাতা বেয়ে উঠেছে । মাঝে মাঝে ফুল। অসম্ভব সুন্দর লাইটিং । চারদিকে বাহারি রকমের গাছ । ফুলে ফুলে ভরা । মাঝেই ছোট এক ঝর্না । মনে হচ্ছে বাহিরের দেশে কোনো রেস্টুরেন্টে বসে আছি । খুব ইউনিক ভাবে সাজিয়েছে । এখানে খুব একটা মানুষজন নেই । দু একটা টেবিলে রয়েছে । আমি আর শেফা বুক করা টেবিলে বসে পড়ি ।ভিআইপি ভাবে সাজানো ।
খেয়াল করে দেখি ঠিক একই ভাবে আরেকটা টেবিল সাজানো ।কিন্তু কিছুটা পরিবর্তন । ঐ টেবিলে ক্যান্ডল আর কালো গোলাপের একটা বুকে রাখা । কালো গোলাপ সহজে পাওয়া যায় না । খুব এক্সপেন্সিভ হয় ।
কালো গোলাপ দেখেই অরন্যের স্মৃতি মনে পড়ে । একবার ফোনে অর্রন্যকে বলেছিলাম আমার কালো গোলাপ দেখার খুব শখ । সেদিন অর্রন্য বলেছিলো যেদিন আমার সাথে প্রথম ডেট করবে সেদিন আমার জন্য কালো গোলাপের বুকে নিয়ে আসবে । আনমনেই এসব ভেবে মুখে তাচ্ছিল্যের হাসি চলে আসে । মানুষ কত টা ছলনাকারী হয় । আমার জীবনের সবচেয়ে বড় আঘাত অরন্যের থেকে পাওয়া । অর্রন্যের জন্যে আজও আমার সব শখ স্বপ্ন বিষের ন্যায় মনে হয় । নিজের প্রতি রাগ ঘৃণা হয় ।
সামনের টেবিলটা নিশ্চয় কেউ তার ভালোবাসার মানুষের জন্যে এতোটা সুন্দর করে সাজিয়েছে ।
আমি ফোন হাতে নিয়ে ঘাটাঘাটি করছি । অগ্নি না ফোন করেছে , না কোনো মেসেজ দিয়েছে । প্রচন্ড রাগ হচ্ছে । এমন কেন উনি ? এখন নিজের উপর আরো বেশি রাগ হচ্ছে । উনার থেকে কেন এতোটা আশা করছি । আমি নিজেই তো অগ্নি থেকে দূরে থাকতে চেয়েছি । মুক্তি চেয়েছি । কিন্তু এখন কেন আমার এতোটা কষ্ট হচ্ছে ? কেন অগ্নির জন্য প্রত্যেকটা সেকেন্ডে কষ্ট পাচ্ছি ? যখন অগ্নির সাথে ছিলাম তখন তার কাছে আসা আমাকে কষ্ট দিয়েছে । আর এখন অগ্নির থেকে দূরে আছি । ওর দূরে থাকাটা আমাকে কষ্ট দিচ্ছে । না মেনে নিতে পারছি না নিজের থেকে দূরে সরিয়ে দিতে পারছি । এই কেমন দোটানায় পড়েছি ?
এসব ভাবতে ভাবতে ফোনটা টেবিলে আছাড় দিয়ে রাখি । সজোরে ফোন রাখায় শেফা কিছুটা কেঁপে উঠে । আমার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে ,
– “কি হয়েছে এমন রেগে আছিস কেন? ”
– “কিছুনা এমনিই ভালো লাগছে না । তোর হবু বর কত দূর ? ”
শেফা সিড়ির দিকে তাকিয়ে উৎসাহী স্বরে বললেন ,
– “ওই যে এসে গেছে !”
আমি সিড়ির দিকে তাকিয়ে বড়সড় বিষম খাই । তানবীর ভাই ? শেফার হবুবর তানবীর ভাই? অগ্নির সবচেয়ে কাছের বন্ধু । কেন বোন দুনিয়ায় কি ছেলের অভাব ছিলো ? বেছে বেছে উনাকেই বিয়ে করার জন্য পেলো ?
তাদের কি আগের থেকেই সম্পর্ক ছিলো? নাকি বাড়ি থেকেই বিয়েটা হচ্ছে ।
আমি শেফার দিকে বিষ্মকর চোখে তাকিয়ে আছি । শেফার হয়তো আমার চাহনি তে আমার মনের কথা বুঝেছে । আমার দিকে দাঁত বের করে ভিতু হাসি দেয় ।আমি চোখ ঘুরিয়ে সামনের দিকে তাকাতেই আসমান থেকে পরি । তানবীর ভাইয়ার পিছনে অগ্নি । পুরো হিরোদের মত এন্ট্রি নিয়েছে। আমাদের দিকেই আসছে । মুহূর্তেই চোখে মুখে খুশির জোয়ার উঠে । মনে সমুদ্রের বিশাল ঢেউ খেলছে । কিন্তু খুব বেশিক্ষণ এই ঢেউ খেলতে দিলাম না । মুখ ভার করে রাখলাম । মন তেতো অভিমানে ভার হয়ে যায় । দুদিন আমার কোনো খোঁজ খবর নেয়নি ।একটা ফোন পর্যন্ত করেনি । আমি কেন উনার দিকে তাকাবো ? না উনার দিকে তাকাবো! না কোনো কথা বলবো ।
আমি অপরিচীতদের মতই থাকবো । উনি উনার বন্ধুর সাথে এসেছে । আর আমি আমার বান্ধবীর সাথে । আমি উনাকে চিনি না । হুহ !
অগ্নি ঠিক আমার সামনা সামনি বসেছে । খুব স্টাইল নিয়ে । আড়চোখে উনার দিকে তাকাই । পড়নে কালো জেকেট ভিতরে কালো টিশার্ট । হাতে ঘড়ি । চুলগুলো জেল দিয়ে ব্রাশ করা । উনাকে কালোতে যা লাগছে না । একদম চকলেট বয় । চোখে লেগে থাকার মত সুন্দর লাগছে ।
দুদিন ধরে বউ বাড়ি থেকে চলে এসেছে কোথায় দেবদাশ হয়ে থাকবে তা না । উনি এই দুদিনে আরো হিরো হয়েছে । বদ লোক একটা । আমি নিজের চোখকে কন্ট্রোল করে অন্যদিকে তাকাই । এই লোকের দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকলে ঘোরে চলে যাই । আমি চোখ ফিরিয়ে সামনের দিকে তাকাই । তানবীর ভাই আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলে ,
– “কেমন আছেন ভাবী জি ? ”
– “জি ভাইয়া ভালো । আপনি কেমন আছেন? ”
– “জি ভাবী ভালো আছি । খুব অপেক্ষা করায়নি তো ! ”
– “না না ভাইয়া । আমরা এইতো মাত্রই এসেছি । ”
আমি আবার আড়চোখে অগ্নির দিকে তাকাই অগ্নি চেয়ারে হেলান দিয়ে আরামে বসে আছে । ঠোঁটে মিষ্টি হাসি মাখানো । চোখ দুটো আমার দিকে নেশাগ্রস্থ ভাবে তাকিয়ে । উফফ এই চাহনি আমার বুকে তীরের মত লাগছে । আমি ঢোক গিলে চোখ ঘুরিয়ে ফেলি । তানবীর ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে জিগ্যেস করি ,
– “তো ভাইয়া কি ভাবে আমার বান্ধবীর সাথে পরিচয় ? ”
তানভীর ভাইয়া অভাক চোখে তাকিয়ে বললেন,
– “কি ভাবী আপনার বান্ধবী আপনাকে কিছু জানায়নি?
আমরা তো রিলেশন ছিলাম । তার পর বাড়িতে বিয়ের জন্য জানাই । আর সবাই মেনে নেয় । ”
আমি ড্যাবড্যাব চোখে একবার তানবীর ভাইয়ার দিকে তাকাই আরেকবার শেফার দিকে । এই মেয়ে এতো বজ্জাত কেন? এতো কিছু হলো আমাকে জানায় নি ! এই তার বন্ধুত্ব ?
শেফা আমার রাগী দৃষ্টি দেখে । আমতা আমতা করে বলে ,
– “দোস্ত না রাগ করছিস কেন! আমি তো সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলাম । ”
আমি দাঁতে দাঁত চেপে বলি ,
-“আনফরচুনেটলি! শক খেয়ে বসে আছি ! ”
শেফা ভোলাভালা চেহারা করে বললেন,
– “দেখ আমার কোনো দোষ নেই । আমি তোকে আগেই বলেছিলাম আমি এক ছেলের সাথে রিলেশনে আছি । ওই যে বলেছিলাম না সাইকো । উনিই সেই সাইকো । ভাবলাম এতো পাগলের মত ভালোবাসে বিয়েই করে নেই । ”
তানবীর ভাইয়া শেফার কথায় হা করে তাকিয়ে আছে । অগ্নি টেবিলের উপর হাত রেখে । ছোট চোখ করে আমার দিকে তাকিয়ে । শেফাকে বলে ,
– “তোমার বান্ধবী আবার ভালোবাসা খুব একটা বুঝে না । তাকে বুঝিয়ে লাভ নেই ”
– “হ্যা আপনি তো ভালোবাসায় পিএইচডি করেছেন তাই না? ”
– “হুম করেছি তো ? তোমার মত তো না অবুঝ ! ”
আমাদের দুজনের ঝগড়া দেখে তানবীর ভাইয়া করুন স্বরে অগ্নির দিকে তাকিয়ে বললেন ,
– “ভাই তোরা আমার এতো সুন্দর ডেটটা কে যুদ্ধক্ষেত্র কেন বানাচ্ছিস ? ”
আমি আর অগ্নি দুজন চুপ হয়ে যাই । আমি অন্যদিকে ফিরে তাকাই । অগ্নি আমাকে উদ্দেশ্যে করে বললেন,
– “চলো ওই টেবিলে ! ”
আমি রেগে উত্তর দেই,
– “কেন? আমি কেন যাবো? আপনি ঝগড়া করেছেন আপনি যান ।”
অগ্নি আমার দিকে ঝুকে নিচু গলায় বললেন,
– “সত্যি! তোমার কমনসেন্সের অভাব । ওরা ডেটে এসেছে একটু তো এদের প্রাইভেসি দেও ।”
আমি আর কথা বাড়াই না । সত্যি তো ডেটে এসেছেন । একটু তাদের একা ছেড়ে দেওয়া উচিত । একান্ত কিছু মুহূর্তের জন্য । যেহেতু শেফা আগের থেকে তানবীর ভাইয়ার চেনাজানা তাহলে শুধু আমাকে নিয়ে আসার কি দরকার ছিলো । মাথায় ডুকছে না ।
অগ্নির আমাকে উনার সাথে যেতে বলে আমি উনাকে ফলো করি । উনি পাশের সেই সাজানো টেবিলটায় । ওয়েটার এসে ক্যান্ডল গুলো জ্বালিয়ে দেয় । আমি চাপা স্বরে অগ্নিকে বলি,
– “অন্যকারো বুক করা টেবিলে বেসেছেন কেন ? দেখছেন ডেকোরেশন করা । হয়তো কাউকে সারপ্রাইজ দিবে । উঠুন অন্য টেবিলে চলুন । ”
আমি উঠে যেতে নেই । অগ্নি তার আগেই আমার হাত টেনে বসিয়ে দেয় । আমি ছোট ছোট চোখ করে তাকিয়ে আছি । অগ্নি আমার দিকে মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে বললেন ,
– “উঠতে হবে না । আমিই এই টেবিল বুক করেছি । ”
– “কার জন্য ? পাত্রী খুঁজছেন? নিশ্চয় পাত্রী খুঁজছেন !
আমি চলে এসেছি দুদিন হলো না এর মাঝে পাত্রী খোঁজা শুরু করে দিয়েছেন ? বাহ ! এই আপনার ভালোবাসা ? আপ্নি..
আমি আর বলতে পারলাম না তার আগেই উনার ধমক পড়ে । আমি চুপ হয়ে যাই । উনি রেগে বললেন,
– “এতো বাজে বকবক করো কেন তুমি ? আমার পুরো কথা না শুনেই নিজের আকাশকুসুম কাহিনী বানিয়ে ফেলছো । আমি কি একবার ও বলেছি আমি এসব অন্যকারো জন্য করেছি? কেন তোমার মাথায় কি নিজের নাম আসে না ? মাথামোটা মেয়ে ! মুড নষ্ট করার জন্য তুমি গ্রেড । ”
আমি হা হয়ে আছি । এসব কিছু আমার জন্য ? আমার ? মুহূর্তেই মন খুশিতে ভরে গেল । আমি খুশি হয়ে উল্লাসিত স্বরে বলি ,
– “এসব আমার জন্য ? ”
– “তো আমার কি আর চার- পাঁচটা বউ আছে? যে তাদের জন্য এসব করবো? ”
– “কথার সোজাসুজি উত্তর দিতে পারেন না? শুধু রাগ করেন । কাল বাড়ি থেকে আসার সময় ও রাগ দেখিয়েছেন । দুদিন এবারের জন্য ফোন দেননি । যোগাযোগ করেন নি । তো আমি তো এসব বলবোই ”
– “তুমি রাগিয়ে দেও কেন? আর আমাকে ছেড়ে আসার জন্য যে ভাবে উতলা হয়ে আছিলে রেগে তো যাবোই । সারারাত আমার বুকে ঘুমিয়েও তোমার জেদ বিন্দু মাত্র কমেনি সকালেই ড্যাং ড্যাং করে ব্যাগ গুছিয়ে বাড়িতে চলে এসেছো ।আমি রাগ করবো না ? চাটবো ? ”
– “আর দুদিন ফোন করলেন না যে ?”
মুখ ফুলিয়ে উত্তর দিলেন ,
– “আমি তোমার সাথে রেগে ছিলাম । ”
– “তাহলে আজ রাগ কি করে টাই টাই ফুস হলো ? ”
উনি রেগে উত্তর দেয় ,
– “আমি তো আর তোমার মত নির্দয় না । পারছিলাম না তোমাকে না দেখে থাকতে । পাগল হয়ে যাচ্ছিলাম । তাই এসেছি আজ না দেখলে নির্ঘাত মরে যেতাম ! ”
আমি উনার কথায় কিটকিটে হেসে দেই।আমার হাসিতে উনি আরো রেগে নাক ফুলাতে লাগে । আমি খুব কষ্টে ঠোঁট চেপে হাসি আটকাই । অগ্নি প্রত্যেকটা কথা বাচ্চাদের মত ঠোঁট ফুলিয়ে করছিলো । বাচ্চারা যেমন খেলনা হারিয়ে ফেলে অভিযোগ করে অগ্নিও তেমনটাই করছিলেন ।অগ্নির এই বাচ্চা রূপ প্রথমবার দেখলাম । ইচ্ছে করছে উনার লাল নাকটা একটু টেনে দেই । কিন্তু তা এখন করা যাবেনা । আমি তো অগ্নির উপর রেগে আছি । তা তো উনাকে বুঝাতে হবে । তাই মুখে সাথে সাথে ভারী ভারী ভাব আনলাম ।
চলবে …..❤️