#শালিক_পাখির_অভিমান
#পর্ব_২৮
#অধির_রায়
বাবা হারানোর কষ্ট একমাত্র সেই ব্যক্তি জানেন যে বাবা হারিয়েছেন৷ আমার চারদিক অন্ধকার। একটু আলোর সন্ধান পাওয়ার জন্য ম’রি’য়া হয়ে উঠেছি৷ বুকের মাঝে বাবার জন্য তীব্র ব্যথা অনুভব করছি৷ আজ দুই মাস হয়ে গেলে তবুও বাবার স্মৃতি ভুলতে পারিনি৷ কবে কলেজের মাটিতে পা রেখেছি জানা নেই। কলেজে যাওয়া বন্ধ। ছোঁয়া, নীরা, অর্পি সেদিন বাড়িতে এসেছিল। অনেক বুঝিয়েও আমার মনটা হালকা করতে পারেনি৷ আঁখি বন্ধ করলেই বাবার হাসি মাখা মুখ খানা ভেসে উঠে৷ দু’হাত মেলে বুকে ডাকে৷ চোখের জল ফুরিয়ে এসেছে৷ বাকহারা মানুষের মতো বাবার সাথে একটি কথা বলার জন্য ছটফট করি৷ পথ চেয়ে বসে থাকি বাবা আসবে। আমার সাথে অভিমান করে চলে গেলেন৷ আমার সাথে কথা বলার প্রয়োজনবোধ মনে করল না৷ শরীফ চৌধুরী কাঁধে হাত রেখে বলল,
“তোমার বাবার জায়গা কখনও পূরণ করতে পারব না৷ আল্লাহ উনাকে জান্নাত দান করবেন। তোমার বাবার আত্মার মাগফিরাতের জন্য তোমাকে শক্ত হতে হবে৷ এতিমখানায় বাচ্চাদের পোষাক দিতে চেয়েছিলে তুমি৷ সব কিছু ঠিকঠাক আছে কি’না দেখে নাও৷”
শরীফ চৌধুরীর কথা কান অব্ধি স্পষ্টভাবে পৌঁছাল না৷ মমটা পড়ে আছে আনন্দপুরে৷ ইহান আমার হাত ধরে গাড়িতে বসিয়ে দেন৷ আপন গতিতে গাড়ি চলছে এতিমখানার উদ্দেশ্যে৷ এতিমখানার উন্নয়নের জন্য কিছু টাকা, একশো কুরআন শরীফ, বাচ্চাদের জন্য পাঞ্জাবি পায়জামার কাপড়, সাথে পাঞ্জাবি বানানোর টাকা দিয়ে বাড়িতে ফিরলাম৷ ক্লান্ত দেহে বাড়িতে ফিরতেই ঘুমিয়ে পড়ি৷
শীত বসন্ত চোখের পলকে যেতে থাকল৷ বসন্তের সৌন্দর্য আমার মনকে ভরিয়ে দিতে পারেনি৷ পারেনি কবিদের কন্ঠে কবিতার সুর তুলতে। সকালের সোনালী রোদে দাঁড়িয়ে বাসের জন্য অপেক্ষা করছি৷ নিজের মনকে কিছুটা শান্ত করতে পেরেছি৷ পৃথিবীতে যার জন্ম আছে তার মৃত্যু অবধারিত। ছোঁয়া, নীরা, অর্পি গম্ভীর হয়ে বসে আছে ক্লাস রুমে। আমাকে দেখে ম্লান হাসার চেষ্টা করল। ক্লাস শেষে চিরপরিচিত ক্যাফেডিয়ামে গেলাম৷ ছোঁয়া উষ্ণ ধোঁয়া উঠানো চায়ের কাপে চুমু দিয়ে বলল,
“আজ ক্যাফেডিয়ামের প্রাণ ফিরে পাওয়া গেল৷ একদিন চিরপরিচিত ক্যাফেডিয়াম শুধু স্মৃতি হিসেবে মনে গেঁথে রয়ে যাবে৷ আড্ডা দেওয়া হবে না৷”
অর্পি আফসোস নিয় বলল,
“আমাদের পরীক্ষার পর ভার্সিটির কোচিং শুরু করব৷ চারজনের চার ভার্সিটিতে চান্স হলে আর দেখা হবে না৷ আমি তোদের খুব মিস করব৷ তোদের ছাড়া ক্লাস করব কিভাবে? ”
নীরার এসব দিকে তেমন টান নেই৷ নীরা উষ্ণ ধোঁয়া উঠানোর চা খেয়ে ব্যস্ত৷ দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বললাম,
“জীবন কখনও থেমে থাকে না৷ আমাদের জীবন অনেক বাঁধা আসে৷ সে বাঁধা পার হতে হলে আপনজনকে হারাতে হয়৷”
অর্পি চায়ের কাপে চুমু দিয়ে বলল,
“এসব আমার ভালো লাগে না৷ তোদের ছাড়া আমি এক পা চলতে পারব না৷ আমি তোদের খুব ভালোবেসে ফেলেছি৷ আমি কিছুতেই এ বন্ধন ভাঙতে পারব না৷”
নীরা চোখের চশমা ঠিক করতে করতে বলল,
“আমাদের দেখা না হলেও ফোনে কথা হবে৷ মম বলেন জীবনে সব সময় এগিয়ে যেতে৷ পিছনে কি আছে সেদিকে না তাকাতে।”
অর্পি নীরাকে কিছু বলার আগেই ছোঁয়া বলল,
“আজ তুই ভালো কথা বলছিস৷ আমাদের পিছনে ফিরে তাকানো উচিত নয়৷ সামনে মোভ করতে হবে৷ আমি তোর কথাকে সাপোর্ট করলাম৷”
অর্পি নিজেকে আটকিয়ে রাখতে পারল না৷ রাগী কন্ঠে বলল,
“তোদের দাদীমা টাইপের কথা শুনলে আমার মাথা গরম হয়ে হয়ে যায়৷ এসব কথা বলা থেকে বিরতি নে৷ আমি আর একবার এসব কথা শুননে আমার থেকে খারাপ কেউ হবে না৷”
আমি অর্পির দিকে চোখ তুলে তাকালাম৷ শ্যামবর্ণ মায়াবী চেয়াহায় চিন্তার ভাজ পড়েছে৷ কপালে বিন্দু বিন্দু ঘামের ফোঁটা। মেয়েটা বন্ধুত্ব বলতে পা*গ*ল৷ বন্ধুর জন্য হাজারটা খু’ন করতেও পিছপা হবে না৷ আমি অর্পির হাতে হাত রেখে বললাম,
“সব সময় এমন করলে হয়না৷ নিজের মাথা খাটিয়ে একবার ভেবে দেখ৷ আমাদের জীবন তো কলেজ জীবনেই থেমে থাকবে না৷ আমরা সাফল্যের সর্বোচ্চ চূড়ায় পৌঁছাতে হবে৷ রাগ করিস না। বাস্তবতাকে মেনে নেওয়ার চেষ্টা কর৷”
অর্পি আর কারো কথা শুনল না৷ পাশে থাকা বেঞ্চে সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে লা’থি দেয়৷ মেঘের মতো গর্জন করতে করতে বাড়িতে চলে গেল৷ পিছন থেকে অনেক ডাকাডাকি করলাম। কথাগুলো কান অব্ধি পৌঁছালেও কোন রেসপন্স করল না৷ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাড়িতে চলে আসলাম।
“শ্রুতি ভাবী মিষ্টি মধুর স্বরে বলল,
” চলো শালিক শপিং করতে যাব৷ আমার একা একা শপিংমলে যেতে ভালো লাগছে না।”
আমি চারিদিকে তাকিয়ে বুঝার চেষ্টা করলাম৷ মায়া ফুপি, আফসানা চৌধুরী সিরিয়াল দেখতে ব্যস্ত৷ ইমন ভাইয়া শার্টের হাতা হোল্ড করতে করতে নিচে আসলেন। আমি ইমন ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে বললাম,
“ভাবী আপনি ইমন ভাইয়ার সাথে শপিংমলে যান৷ আমি মাত্রই কলেজ থেকে ফিরলাম৷ আমি খুব ক্লান্ত। আপনার সাথে যেতে পারব না৷”
ইমন ভাইয়া চোখে কালো চমশা পড়তে পড়তে বলল,
“শালিক তুমি শ্রুতির সাথে শপিংমলে যাও৷ আমার অনেক কাজ আছে৷ আমি শ্রুতির সাথে যেতে পারব না৷ আমার ইম্পর্ট্যান্ট মিটিং আছে৷”
ইমন ভাইয়া ভাব ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে উনার মাঝে কোন পরিবর্তন নেই৷ আজও অন্য মেয়ের সাথে দেখা করতে যাচ্ছে৷ আমার দৃষ্টি ক্ষুণ্ণ হয়ে আসল৷ আমার চাহনি বুঝতে পেরেন ইমন ভাইয়া ।হালকা হাসার চেষ্টা করে বলল,
“শালিক আজ আমি অন্য কোথাও যাচ্ছি না৷ অফিসের কাজে যাচ্ছি৷ বিশ্বাস না হলে বাবাকে ফোন করে জেনে নিও৷”
ইমন ভাইয়ার কথা তবুও বিশ্বাস করতে পারলাম না৷ এক আকাশ হতাশা নিয়ে শ্রুতি ভাবীর সাথে শপিংমলে গেলাম৷ শ্রুতি ভাবীর মাঝে তেমন কোন চাহিদা নেই৷ যা কিনছেন সব আমার জন্য৷ মিহি কন্ঠে শ্রুতি ভাবীকে প্রশ্ন করলাম,
“ভাবী এসবের মানে কি? আপনি আমার জন্য এতো কিছু কিনছেন কেন?”
শ্রুতি ভাবী ক্ষিপ্ত দৃষ্টি মেলে তাকান৷ গর্জন কন্ঠে বলল,
“আমি অতিরিক্ত কথা শুনতে পছন্দ করিনা৷ এসব কিছু তোমার জন্য কিনছি৷ আমি নিজের ইচ্ছায় সব কিনছি৷ বাঁধা দেওয়ার তুমি কেউ না?”
আমি কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলাম৷ এখনো সেই অ*’হং’*কা*র বাজায় রেখেছেন। ভাবীর ভ’*য়া’*ন*’ক দৃষ্টির সাথে আমি বরাবর পরিচিত৷ কেউ মন থেকে কিছু দিতে চাইলে মানা করতে নেই৷ আমাকে কিনে দিচ্ছে এতো আমার খুশী হওয়ার কথা৷ কি ন্তু আমি খুশি হতে পারছি না৷ আমার জন্য দামী দামী শাড়ি। শাড়ির থাকে ম্যাচিং করে ইমিটেশনের গহনা৷ সবকিছু আমার খুব পছন্দ হয়েছে৷
নিভু নিভু আঁধারে বিছানার এক পাশে শুয়ে আছি৷ ইহান আমাকে পিছন থেকে হালকা করে জড়িয়ে ধরে বলল,
“শালিক তুমি কান্না করছো কেন? কি হয়েছে তোমার? আমি তোমার চোখের জল আর সহ্য করতে পারব না৷”
কান্না করার জন্য একটা শূন্য বুক খুঁজছিলাম৷ ইহানের স্পর্শ পেয়ে ইহানকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দিলাম৷ ইহান আমাকে বুকের সাথে মিশিয়ে নিলেন৷ আমি উনার বুকে মাথা গুঁজে কান্না করে দিলাম৷ পরম আদরে কেশে বিলি দিতে থাকেন৷ মিহি কোমল কন্ঠে বলল,
“শাকিল তুমি প্রতিরাতে কান্না করো কেন? এর ফলে তোমার বাবা কষ্ট পাচ্ছেন৷ তোমার এক ফোঁটা জল উনার কবরের আজাব বাড়িয়ে দিচ্ছেন৷ প্লিজ আর কান্না করো না৷ এবার চোখের জল মুছে ফেলো৷”
“আমার তো একটাই কষ্ট, বাবার শেষ দিনগুলোতে পাশে থাকতে পারলাম না৷ বাবার সাথে কথা বলতে পারলাম না। আমার সাথে কথা বলার জন্য ছটফট করেছেন৷ আমি তোমার বাবাকে তৃপ্তি করে দেখতে পারলাম না৷”
বুকের মাঝে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে বলল,
“আল্লাহ পাক চান তুমি হাশরের ময়দানে তোমার বাবার সাথে দেখা করো। তোমার বাবার সাথে প্রাণ খুলে কথা বল৷ সেজন্য আল্লাহ তায়ালা তোমাকে কথা বলার সুযোগ দেননি৷”
“আমি কিছু জানতে চাইনা৷ আমি মাতৃত্বের স্বাদ পেতে চাই৷ আমি মা হবো৷ আমার সন্তানকে ডাক্তার বানাবো৷”
আমার কথায় ইহান ঘাবড়ে যায়। তিনি কখনো এমন কিছু আশা করেননি৷ আমার কথা শুনে ইহান আকাশ থেকে পড়ল। বিচলিত কন্ঠে বলল,
“শালিক তুমি ঠিক আছো? এমন সময় তুমি মা হলে তোমার লেখাপড়ার ক্ষতি হবে৷”
“আমার লেখাপড়ার কোন ক্ষতি হবে না৷ আমি এখন কনসিভ হলে সমস্যা নেই। আমার পরীক্ষা বাকী মাত্র ৬ মাস৷ তখন আমি অনায়াসে পরীক্ষা দিতে পারব৷ এতো আমার লেখাপড়ার উপর চাপ পড়বে না৷ ভার্সিটির পরীক্ষার আগেই আমার ডেলিভারি হয়ে যাবে৷”
আমার অদ্ভুত যুক্তি শুনে ইাহানের কাশি উঠে। কাশতে কাশতে বলল,
“তোমার অদ্ভুত যুক্তির সাথে আমি একমত নয়৷ আমি তোমাকে এখনই মাতৃত্বের স্বাদ দিতে পারব না৷ আমাকে তুমি ক্ষমা করো৷”
আমি শার্টের কলার চেপে বললাম,
“আপনি বাবা হতে অক্ষম! আপনি আমার কাছে আসতে চাননা কেন? আমার চাহিদা আমার মিটে গেছে৷ আমি কালো বলে আমাকে দূরে ঠেলে দিতে ইচ্ছা করছে৷”
আমার অবাধ্য চু’লগুলো কানের কাছে গুছে দিয়ে বলল,
“ভালোবাসা চেহারা দেখে হয়না৷ আমি তোমার রুপে প্রেমে পড়িনি৷ তোমার ব্যক্তিত্বের আর বিচক্ষণ বুদ্ধির প্রেমে পড়েছি৷”
আমি অন্যদিকে ঘুরলাম৷ রাগ নিয়ে বললাম,
“আমি জানতাম আপনি আমার সন্তানকে ডাক্তার বানাতে চাননা৷ আমি মরিচীকার পিছনে এতোদিন ঘুরছি৷ আমার ভুল হয়েছে৷ আমাকে ক্ষমা করে দেন৷”
পিছন থেকে আমাকে আলতো করে জড়িয়ে ধরে বলল,
“শালিক তুমি বুঝার চেষ্টা করো৷ তোমার দেহের যে কন্ডিশন সে অবস্থায় তুমি এমন চিন্তা বাদ দাও৷”
“উনাকে ছাড়ানোর চেষ্টা করলাম। ইহানের শক্তির সাথে পেরে উঠতে পারলাম না৷ নিজের ব্যর্থতা স্বীকার করে নিলাম। আমাকে পটানোর অনেক চেষ্টা করলেন৷ আমি উনার কথায় কোন রেসপন্স করিনি৷ ব্যর্থ হয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়েন৷
চলবে…..
মাথা ব্যথা নিয়ে টাইপিং করছি৷ আপনারা কি শালিকের সিদ্ধান্তের সাথে একমত? শালিকের কোল জোড়ে আসবে কি নতুন প্রজন্ম? বানান ভুলগুলো মার্জনীয় দৃষ্টিতে দেখবেন৷