#শালুক_ফুলের_লাজ_নাই (২১)
ধ্রুবর ভীষণ ব্যস্ত সময় যাচ্ছে। এতো ব্যস্ততার মধ্যে ও শরতকালের স্নিগ্ধতার মতো মন মেজাজ সবসময় তার ফুরফুরে থাকে। দিনের শুরু হয় প্রিয় মানুষের মুখ দেখে আবার দিনের শেষ ও হয় প্রিয় মানুষের মুখ দেখে। ভোর রাতে উঠে আবার নিজের পড়াশোনা করে কিছুক্ষণ। প্রচুর ধকল যায় ধ্রুবর উপর দিয়ে।
শালুকের সাথে তার সম্পর্ক এখন অনেকটা প্রেমিক প্রেমিকার সম্পর্কের মতো। শালুক আজকাল ধ্রুবকে ভীষণ মিস করে। প্রতিদিন ধ্রুব বের হওয়ার সময় হাজার বার বলে যেতে হয় যে খুব শীঘ্রই সে ফিরে আসবে।
সারাক্ষণ একে অন্যকে টেক্সট করে। শালুক নিজেকে দেখে নিজে অবাক হয় ধ্রুব তার সাথে এরকম ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে যাবে,সে ধ্রুবর জন্য এতো বেশি উতলা হবে তা কি কখনো শালুকের ভাবনাতে ছিলো!
অথচ আজকাল এই মানুষটা বাসায় ফিরতে একদন্ড দেরি হলে শালুকের কেমন হাঁসফাঁস লাগে।মনে হয় অক্সিজেনের যেনো ভীষণ অভাব।
সকালে বের হবার সময় ধ্রুব প্রতিদিন টুপ করে একটা আলতো করে চুমু খেয়ে যায় শালুককে।তারপর আর পিছনে না তাকিয়ে হনহন করে বের হয়ে যায় সিঁড়ি দিয়ে।
নিচে গিয়ে একবার তাকিয়ে হাত নাড়িয়ে বিদায় দেয়।
সারাদিন শালুকের কেমন উৎকন্ঠা নিয়ে কাটে।মাঝেমাঝে ভীষণ মন খারাপ হয় শালুকের। বাড়ির জন্য কান্না পায়,সবার কথা ভীষণ মনে পড়ে।
আজকে শুক্রবার। আগামীকাল থেকে শালুকের স্কুলে টেস্ট এক্সাম শুরু হবে।
ধ্রুব আজকে বাসায় আছে।সকালে দুজন মিলে নাশতা বানিয়ে নিলো।ধ্রুবর থেকে শালুক টুকটাক কাজ করা শিখেছে।শালুকের ভীষণ খারাপ লাগে সব কাজ ধ্রুব একা করে বলে।তাই শালুকের জোরাজুরিতে ধ্রুব টুকটাক হেল্প নেয় শালুকের।
ধ্রুব রুটি বানিয়ে দিলো,শালুক তাওয়ায় করে রুটি সেঁকে নিলো।এরপর শালুক পেঁয়াজ মরিচ কেটে দিলো ধ্রুব ডিম ভেজে নিলো।চা ধ্রুব নিজে বানায়।শালুক একদিন চা বানাতে গিয়ে প্রায় এক কাপের মতো চা পাতা ব্যবহার করেছে।
সবসময় যেখানে রান্নাঘরের চৌহদ্দির মধ্যে যায় নি একটা মেয়ে,তার জন্য রান্নাবান্নার কাজ ভীষণ কঠিন।
এরপর ধ্রুব দেখিয়ে দিয়েছে শালুককে।কিন্তু লজ্জায় শালুক আর চেষ্টা করে নি।
নাশতা করতে গিয়ে শালুকের আজ আবারও বাড়ির কথা মনে পড়ে গেলো। কতোদিন হয়ে গেছে মা বাবাকে দেখে না।
শালুকের নিরব কান্না ধ্রুব খেয়াল করলো। কিন্তু কিছু বললো না।
খাওয়ার পর ধ্রুব বের হলো কিছু কেনাকাটা করার জন্য। নামাজ পড়ে বাহিরে থেকে খাবার নিয়ে ফিরবে বাসায় দুপুরে।শালুককে পড়তে বলে গেলো। আজকে বিকেলের ট্রেনে দুজন গ্রামে যাবে।
শালুক বই নিয়ে বসলো। মোটামুটি প্রস্তুতি ভালো শালুকের এবার।কারো হেল্প না পেলেও অন্তত ৩.৫০ এর উপরে পাবে এবার এসএসসিতে শালুক সেই ভরসা আছে নিজের উপর।
শালুক বাংলা নৈর্ব্যক্তিক পড়ছে।শালুকের ভীষণ ইচ্ছে করছে আগামীকাল গ্রামে গেলে বাড়িতে যেতে।কিন্তু ধ্রুবকে বলতে পারছে না।
শালুক জানে ধ্রুব কিছুতেই বাড়িতে যাবে না,শালুককেও বাড়িতে যেতে দিবে না।
এতো কাছাকাছি গিয়েও আপন কাউকে দেখবে না মনে পড়লেই শালুকের নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে যেনো।
পাশের ফ্ল্যাটে খুব চিৎকার, চেঁচামেচি শুরু হয়ে গেছে ইতোমধ্যে। শালুক খেয়াল করেছে প্রায় দিনেই ওই ফ্ল্যাটে ভীষণ ঝগড়া হয়।এরপর মারের শব্দ শোনা যায়,শোনা যায় নারী কণ্ঠের চিৎকার, বাচ্চার কান্না,পুরুষের রাগী কন্ঠস্বর।
শুধু শুক্রবার হতো না এরকম।কিন্তু আজকে তাও হচ্ছে। বাচ্চার কান্না আজকে খুব জোরে শোনা যাচ্ছে। শালুকের কেমন জানি কষ্ট হতে থাকলো।নিধির কথা মনে পড়ে গেলো। এই বাচ্চাটা হয়তো নিধির বয়সী।
আহারে,নিধি থাকে সবার কোলে কোলে,চোখের তারায়।আর এই বাচ্চাটাকে আদর করার জন্য মনে হয় কেউ-ই নেই।
হঠাৎ করেই কাঁচের কোনো কিছু পড়ে ভেঙ্গে যাবার শব্দ হলো। তার একমুহূর্ত পর বাচ্চাটার কান্না আরো জোরে শোনা গেলো। শালুক আর বসে থাকতে পারলো না। ঠিক করলো আজকে ধ্রুব আসলে বলবে ব্যাপারটা তাকে।ধ্রুবকে এখনো জানায় নি শালুক প্রতিবেশী ফ্ল্যাটে কি হয় এসব।
ছোট বাচ্চাটার কান্না কেউ থামাচ্ছে না।শালুক আর না পেরে বের হলো ফ্ল্যাট থেকে। কিছুটা ভয় ভয় লাগছে শালুকের।
এই প্রথম শালুক একা বাসা থেকে বের হয়েছে। যার সাথে কখনো কথা হয় নি তার কাছে যাচ্ছে।
দরজায় নক হতে ভেতরে মারার শব্দ,নারী কন্ঠের গোঙানির শব্দ থেমে গেলো। বাচ্চার কান্না থামলো না।ঘেমে নেয়ে একাকার হয়ে একজন বছর ৩৪-৩৫ এর লোক এসে দরজা খুলে দিলো। শালুককে দেখে কিছুটা চমকালো লোকটা।
তারপর বাজখাঁই গলায় জিজ্ঞেস করলো, “কি চাই?কে আপনি? ”
শালুক ঢোক গিলে বললো, “আমি আপনাদের পাশের ফ্ল্যাটে থাকি।”
লোকটা আবারও জিজ্ঞেস করলো , “এখানে কি তাহলে? যান আপনার বাসায়।”
শালুক এবার অবাক হলো। লোকটা এভাবে কথা বলছে কেনো তার সাথে?
কাঁপা কাঁপা গলায় শালুক বললো, “একটা বাচ্চার কান্না শুনলাম,এখনো তো কাঁদছে বাচ্চাটা।তাই এসেছি। ”
লোকটা ভীষণ রুক্ষভাবে বললো, “দূর বেডি,যান এখান থেকে।আমার মাইয়া কানতাছে আমি বুঝমু।আপনার এতো সমস্যা ক্যান?বেশি পন্ডিতি দেখাইতে আসবেন না বলে দিলাম।মায়ের চাইতে মাসির দরদ বেশি যেনো।”
শালুকের ভীষণ রাগ হলো। এতোক্ষণে হওয়া ভয়টা কেটে গেলো।শালুক শুনতে পেলো ভেতরে মহিলাটা মেয়েকে মানানোর চেষ্টা করছে।
ধমকে উঠে শালুক বললো, “ভদ্রভাবে কথা বলুন,নিজের আচরণ সংযত রাখুন।আপনি প্রতিদিনই বাসায় মারধোর করেন সবটাই শুনতে পাই আমি।বাসায় একটা ছোট বাচ্চা রেখে আপনার লজ্জা লাগে না এরকম করতে?”
তেড়ে এসে লোকটা বললো, “তোর বাপের কি তাতে?আমার বাসায় আমি যা খুশি তা করমু।”
শালুক হেসে বললো,”আপনার যেমন যা খুশি তা করার অধিকার আছে,আমার ও পুলিশে কমপ্লেইন করার অধিকার আছে। আবারও যদি এরকম শুনি আমি সোজা পুলিশে খবর দিবো।১৪ শিকের ভাত খাবেন যখন বুঝবেন যে নারী নির্যাতনের আসল মজা।”
লোকটা হা করে রইলো শালুকের কথা শুনে।শালুক আর দাঁড়ালো না। নিজেদের বাসায় চলে গেলো। বাসায় যাওয়ার পর শালুক টের পেলো তার সারা শরীর কাঁপছে থরথর করে। জীবনে এই প্রথম সে এরকম করে কারো সাথে বলেছে।
গোসল করে নামাজ পড়ে নিলো শালুক। ধ্রুব এলো কিছুক্ষণ পর। খাবার নিয়ে এলো ধ্রুব।শালুকের মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “কি হয়েছে তোর? ”
শালুক চুপ করে রইলো। শালুকের বিমর্ষ চেহারা ধ্রুবকে ভীষণ পীড়া দিতে লাগলো। চিবুক তুলে ধরে জিজ্ঞেস করলো, “আমাকে বলবি না,কি হয়েছে বল?”
শালুক মাথা নিচু করে বললো, “পাশের ফ্ল্যাটে যারা থাকে,ওই লোকটা তার স্ত্রীকে ভীষণ মারধোর করে। ওদের বাসায় ছোট একটা বাচ্চা ও আছে মনে হয় জানেন।আজকে বাচ্চাটার ভীষণ কান্নার শব্দ পেয়ে আমি গিয়েছিলাম আপনার কথা অমান্য করে। লোকটা ভীষণ চামারের মতো ব্যবহার করেছিলো আমার সাথে। আমি ও তাকে পুলিশে দেয়ার ভয় দেখিয়ে এসেছি, বলেছি আবারও এরকম মারধোরের শব্দ পেলে পুলিশে কল দিবো।”
ধ্রুব বিস্ফোরিত নয়নে তাকিয়ে রইলো শালুকের দিকে।তারপর বললো, “আমার বোকাফুল তো অনেক বড় হয়ে গেছে দেখছি।তবে তোর একা ওখানে যাওয়া উচিত হয় নি শালুক।উচিত ছিলো বাড়িওয়ালা কে ডেকে নিয়ে যাওয়া।লোকটা যদি তোকে একা পেয়ে আরো খারাপ ব্যবহার করতো?”
শালুক কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললো, “কোনো একদিন যদি আপনি ও ওই লোকের মতো ব্যবহার করেন আমার সাথে?আমি তাহলে মরেই যাবো হয়তো। চেনা মানুষের অচেনা রুপ বড়ই কষ্ট দেয়।”
ধ্রুব শালুককে কাছে টেনে নিয়ে জড়িয়ে ধরে শালুকের মাথা নিজের বুকের উপর এনে রাখলো।তারপর বললো, “গাছের বুকে ফুল যেমন নিরাপদে থাকে শালুক,আমার বুকে তুই ও তেমনি নিরাপদে থাকবি শালুক।তোকে বউ করেছি নিজের রাজ্যের রানী করে রাখার জন্য। তোকে যদি কষ্ট দিই তবে সেটা হবে আমার নিজেকে কষ্ট দেওয়া,নিজের সত্ত্বাকে কষ্ট দেওয়া। নিজেকে নিজে কষ্ট দিয়ে আমি কিভাবে বাঁচবো বল?”
শালুক জবাব দিতে পারলো না। খাবার পর ধ্রুব শালুকের ব্যাগ গুছিয়ে নিলো। তারপর বাসার সব ময়লা বাহিরে ঝুড়িতে রেখে চুলা,লাইট,ফ্যান,টয়লেটের ট্যাপ সবকিছু ভালো করে দেখে দুজন বের হলো।
ট্রেনের টিকিট কাটা আছে ধ্রুবর। শালুককে নিয়ে বের হলো কমলাপুর রেলস্টেশনের উদ্দেশ্যে।
দুই ঘন্টা পর জ্যাম পেরিয়ে দুজনে কমলাপুর পৌঁছায়। ট্রেন এলো বিকেল ৫.৩০ এ।শালুক বসলো জানালার পাশে। বুক কেমন ভারী হয়ে আছে শালুকের।ধ্রুব বলেছে শালুককে দিয়ে এসে সে চলে আসবে।ধ্রুবর একটা মেয়ে ফ্রেন্ডের বাসায় থেকে শালুক পরীক্ষা দিবে।একে তো বাবা মা’কে দেখবে না,তার উপর ধ্রুব ও চলে আসবে।উপায় নেই ধ্রুবর ও।নিজের চাকরি,তিনটি টিউশনি এতো দিন মিস দিতে পারবে না সে।
সব মিলিয়ে শালুকের খুব খারাপ লাগছে।
বাতাসে শালুকের চুল উড়ে আসছে ধ্রুবর মুখে। ব্যাগ থেকে একটা পাঞ্চক্লিপ বের করে ধ্রুব শালুকের চুলে লাগিয়ে দিলো। শালুকের কাঁধ সমান চুল এখন ৫-৬ ইঞ্চি লম্বা হয়েছে।
শালুক ধ্রুবর হাত ধরে বসে আছে।
একটা স্টেশনে ট্রেন থামতেই বাদাম নিয়ে এলো এক লোক।ধ্রুব বাদাম কিনে নিলো।তারপর বাদাম ভেঙে নিজে ও খেতে লাগলো, শালুককে ও খাওয়ালো।
ঝিকঝিক শব্দে ট্রেন চলছে।শালুক একটা চাদর জড়িয়ে নিয়েছে গায়ে ধ্রুবর গায়ে একটা হুডি।
শীত পড়তে শুরু করেছে।সূর্যাস্ত দেখতে দেখতে শালুক যেতে লাগলো।
আকাশের বুকে কেমন করে সূর্য হারিয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। শালুক আচমকা ধ্রুবকে বললো, “এই সূর্যের মতো করে যদি আমি পারতাম আপনার বুকের ভেতর হারিয়ে যেতে।”
ধ্রুবর ভীষণ অবাক লাগলো শালুকের কথা শুনে। শালুকের মাথা টেনে নিয়ে নিজের কাঁধের উপর রাখলো।তারপর বললো, “আমি প্রমিস করেছি না শালুক।আল্লাহ যতোদিন বাঁচিয়ে রাখে দুজনে এক সাথে থাকবো।”
আরেক স্টেশনে নেমে ধ্রুব রাতের খাবার জন্য বিরিয়ানি নিয়ে এলো।দুজনে খেয়ে শালুক ধ্রুবর কাঁধের উপর মাথা রেখেই ঘুমিয়ে পড়লো।
রাত সাড়ে এগারোটায় ধ্রুবরা ট্রেন থেকে নামলো। তারপর রিকশায় উঠে বসলো। শালুকের দুই চোখে রাজ্যের ঘুম নেমেছে। রিকশা কোথায় যাচ্ছে শালুকের হুঁশ নেই।তার মাথায় ঘুরছে ধ্রুব তাকে দিয়ে এসেই আবারও বাস ধরে চলে যাবে।যেটুকু সময় ধ্রুব আছে তার বুক দখল করে রাখবে শালুক।
ঘুম থেকে জেগে শালুক চমকালো তখন যখন দেখলো সে দাঁড়িয়ে আছে নিজেদের বাড়ির সামনে।
হতভম্ব হয়ে শালুক চিৎকার করে উঠলো। ততক্ষণে বাড়ির সদর দরজা খুলে দিয়েছে মতির মা।তারপর ভুত দেখার মতো চমকে সে ও চিৎকার করে উঠলো।
কান্নাকাটির রোল পড়ে গেলো হঠাৎ করেই। নিচে চেঁচামেচি শুনে আদনান এসে রুমের বাহিরে দাঁড়ালো।বুকের ভেতর আবারও অনুভূতির এক ঝড় উঠলো। শালুকের পাশে ধ্রুব দাঁড়িয়ে আছে। দুজনকে কেমন সুন্দর লাগছে দেখতে।
ওই ধ্রুবর জায়গায় তো তার দাঁড়িয়ে থাকার কথা ছিলো।
ধ্রুব দাদার সামনে গিয়ে বললো, “দাদা,শালুকের টেস্ট পরীক্ষা আগামীকাল থেকে। আমি চাইলেই পারতাম শালুকের অন্যত্র থাকার ব্যবস্থা করতে। কিন্তু তাতে শালুকের ভীষণ কষ্ট হতো। এত কাছাকাছি থেকেও পরিবারের কাউকে সে দেখবে না এই অভিমান,এই যন্ত্রণা আমার ছোট্ট শালুক সহ্য করতে পারতো না। আমি চাই নি শালুক কষ্ট পাক।আমাকে না বললেও আমি বুঝতে পারি তার বুকের ভেতর কেমন ছটফট করে বাড়িতে আসার জন্য।
যে ক’টা দিন ওর পরীক্ষা ও বাড়িতেই থাকবে।আমি আপনার উপর ভরসা করে শালুককে রেখে যাচ্ছি। সেদিন আপনার কথা আমি রেখেছি আজ আপনি আমার অনুরোধ রাখবেন আশা করছি। আমার শালুকের যেনো কোনো ক্ষতি না হয়।আমি যেভাবে তাকে রেখে যাচ্ছি আপনি সেভাবে আমার আমানত আবারও আমার হাতে তুলে দিবেন।
শালুকের যদি বিন্দু পরিমাণ কোনো সমস্যা হয় তবে মনে রাখবেন দাদা এই ধ্রুবর চাইতে নিষ্ঠুর এই পৃথিবীতে আর কেউ হবে না।আজ শালুক এই বাড়ির মেয়ে না।এই বাড়ির মেয়েকে আমি রেখে যাচ্ছি না।আজ আমি রেখে যাচ্ছি আমার স্ত্রীকে, আমার অর্ধাঙ্গিনীকে।”
কারো সাথে কোনো কথা না বলে শালুকের সামনে দাঁড়িয়ে বললো, “আমি যাচ্ছি, যখনই কোনো সমস্যা হবে,মন খারাপ হবে,কোনো কিছু প্রয়োজন হবে আমাকে বলবে।আমি যেখানেই থাকি না কেনো তোমার সব সমস্যার সমাধান করে দিবো।মনে রেখ শালুক,এই পৃথিবীতে তোমার অনেক আপনজন থাকতে পারে কিন্তু আমার আর কেউ নেই তুমি ছাড়া। তুমি ছাড়া আমার জীবন একেবারে শূন্য। আমার জন্য হলেও সাবধানে থেকো,নিজের খেয়াল রেখো।
ঠিকমতো খাবার খেও,আসি আমি। ”
কেউ কোনো অনুরোধ করতে পারলো না ধ্রুবকে।ধ্রুব চলে গেলো।
#শালুক_ফুলের_লাজ_নাই (২২)
ধ্রুব চলে যাওয়ার পর শালুক টলমল পায়ে মায়ের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। হাসনা বেগমের শীর্ণকায় দেহের দিকে তাকিয়ে শালুক বুঝতে পারলো তার মা ভালো নেই।ঝাঁপিয়ে পড়লো মায়ের বুকে শালুক। তারপর হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো।
মা মেয়ের কান্নার শব্দে কেঁপে উঠলো পুরো বাড়ি। সবাই কাঁদছে।
কতোদিন পর মেয়ে বাবার বাড়ি এসেছে। আনন্দ, বেদনায় কাঁদছে প্রতিটি মানুষ।
দুতলায় দাঁড়িয়ে আদনান ও কাঁদছে আজ।তবে সে শালুক এতো দিন পরে বাড়িতে আসায় কাঁদছে না,সে কাঁদছে শালুকের বিয়ে ধ্রুবর সাথে হয়ে যাওয়ায়,শালুককে নিজের করতে না পারায়।ব্যর্থতা তাকে বারবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে,”দেখ,তুই পারিস নি শালুককে জয় করতে। বাজি জিতে গেছে ধ্রুব।সব কিছুতে তুই ব্যর্থ আদনান। ”
আদনান রুমে গিয়ে নিজের চুল নিজে টেনে ধরলো। অসহ্য লাগছে তার সবকিছু। এতো দিন শালুক ছিলো না নিজেকে সে সামলে রাখতে পেরেছে। কিন্তু এখন শালুক তার সামনে থাকবে,সেই শালুক যার উপর এখন আর আদনানের কোনো অধিকার নেই।যার দিকে তাকিয়ে আদনান কথা বলতে ও পারবে না কেননা সে এখন বড় ভাসুর হয়ে গেছে শালুকের।
কেনো এরকম হয়ে গেলো?
আদনান কিভাবে সহ্য করবে এবার?
শালুকের দাদা বললেন,”শালুক অনেকটা পথ জার্নি করে এসেছে, ওকে ঘুমাতে যেতে দাও।সকালে পরীক্ষা দিতে হবে ওর।পরীক্ষা দিয়ে আসলে তারপর সবাই মন ভরে কথা বলিও।”
আদিবা বেগম বললেন, “খেয়ে নে শালুক,আয়।”
শালুক আস্তে করে বললো, “ট্রেনে খেয়েছি চাচী।এখন আর খাবো না।”
বিছানায় পিঠ লাগাতে লাগাতে ১ টা বেজে গেছে। শালুক আজ শাপলার সাথে শুয়েছে।
বিছানায় শুয়ে এক বোন অন্য বোনের গলা জড়িয়ে ধরে আছে কম্বল মুড়ি দিয়ে।
দুজনে নিঃশব্দে কাঁদছে শুয়ে শুয়ে।
শালুকের ফোন বেজে উঠলো সেই সময়।
শালুক ফোন হাতে নিয়ে দেখে ধ্রুবর কল এসেছে। শোয়া থেকে উঠে বসে গলা খাঁকারি দিয়ে গলা পরিষ্কার করে নিলো শালুক।
তারপর কল রিসিভ করে হ্যালো বললো।
ওপাশ থেকে ধ্রুব বললো, “কান্নাকাটির দরকার নেই শালুক।সবাইকে তো পাচ্ছো দেখতে। এতো কাঁদতে হবে না এবার।
তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ো।সবার সাথে দিনভরে কথা বলিও।এখন ঘুমিয়ে যাও।সকালে পরীক্ষা দিতে যাবার আগে একবার বইতে চোখ বুলিয়ে নিবে।সকালে আর নতুন করে কিছু পড়তে হবে না।জাস্ট চোখ বুলিয়ে যাবে একবার।অতিরিক্ত চাপ নিতে হবে না।পরীক্ষা মানে নিজেকে যাচাই করা।অন্যের থেকে দেখে লিখলে সেখানে নিজেকে তুমি যাচাই করবে কিভাবে?
কারো থেকে দেখার দরকার নেই শালুক।নিজে যা পারবে তাই দিবে।তাতে করে তোমার কোন কোন টপিকে সমস্যা আছে আমার তা খুঁজে পেতে সুবিধা হবে।ফাইনালের জন্য আমরা সেই দুর্বল টপিকে আরো ভালো করে প্রস্তুতি নিতে পারবো। ”
শালুক জিজ্ঞেস করলো, “আপনি এখন কোথায়?চলে যাচ্ছেন সত্যি?”
ধ্রুব হেসে বললো, “আমার তো বাবার বাড়ি নেই শালুক। আমার এই পৃথিবীতে শালুক ছাড়া দ্বিতীয় কোনো ঠিকানা নেই।শালুকের সংসার পাহারা দিতে যাচ্ছি আমি।আমার জন্য চিন্তা করো না।বাড়িতে গেছো সবার সাথে হাসিখুশি থাকো,এনজয় করো।তোমার যে ভীষণ মন খারাপ হয়ে থাকে বাড়িতে যাবার জন্য তা তুমি না বললেও আমি বুঝি শালুক।এখন খুশি তো?”
শালুক আস্তে করে বললো, “আপনি থাকলে আমার খুশির ষোলকলা পূর্ণ হতো। আপনাকে ছাড়া খালি খালি লাগছে সব।”
ধ্রুব হেসে বললো, “ঘুমাও শালুক।রাখছি।”
শাপলা শুয়ে শুয়ে দুজনের কথা শুনতে লাগলো। শালুক শুতেই শাপলা জিজ্ঞেস করলো, “ধ্রুব ভাই কেমন রে শালুক?খুব রাগী না?তোকে কি খুব বকাঝকা করে? ”
শুনে শালুকের ভীষণ হাসি পেলো। তারপর বললো, “ধ্রুব ভাই ভীষণ কোমল মনের আপা।কিভাবে করলে আমি ভালো থাকবো, খুশি থাকবো এই চিন্তা ছাড়া তার মাথায় দ্বিতীয় কোনো চিন্তা নেই।আমাকে ভীষণ ভালোবাসেন উনি।”
শাপলা জিজ্ঞেস করলো, “তুই বাসিস না?”
লজ্জা পেয়ে শালুক মাথা নামিয়ে নিলো।তারপর বললো, “বাসি আপা,আমি ও ধ্রুব ভাইকে ভীষণ রকম ভালোবেসে ফেলেছি।ওনার মধ্যে হয়তো এক ধরনের ক্ষমতা আছে আপা।ওনার সাথে কেউ মিশলে সে তাকে ভালো না বেসে থাকতে পারবে না।উনি নিজ গুণে আমার মন জয় করে নিয়েছেন। ”
শাপলার ভীষণ ভালো লাগলো শুনে।খুশি ও হলো কিন্তু তবুও বুকের ভেতর একটা হতাশার দীর্ঘশ্বাস শুনতে পেলো শাপলা। সে ও তো ধ্রুব ভাইকে ভালোবাসতো।
পরমুহূর্তে শাপলার ভীষণ লজ্জা লাগলো এই কথা মনে হতেই।ধ্রুব ভাই এখন তার ছোট বোনের স্বামী। তাকে নিয়ে এসব ভাবা ও পাপ।তাছাড়া তার ভালোবাসা শুধু সে নিজে জানতো।আর কেউ না।ভাগ্যিস কখনো ধ্রুব ভাইকে বা শালুকের কাছে সে বলে নি। যদি বলতো তবে আজ বোনের সামনে দাঁড়াতে পারতো না।
তার ছোট বোনটা ভালো আছে এটাই তো অনেক।বেহায়া মন কেনো অন্য কিছু চিন্তা করছে।
হঠাৎ করে মনে হতেই শাপলা বললো, “তুই না বললি ধ্রুব ভাই কোন মেয়েকে ভালোবাসে?”
শালুক হেসে ফেললো এবার শব্দ করেই।তারপর বললো, “হ্যাঁ আপা।ধ্রুব ভাই এক কেশবতীকে ভালোবাসতো।তবে মজার ব্যাপার কি জানিস?সেই কেশবতী অন্য কেউ না,আমি ছিলাম।অথচ আমি এতোটাই গাধা যে বুঝতেই পারি নি।”
শালুক খিলখিল করে হাসতে লাগলো। শাপলা মুগ্ধ হয়ে শালুকের হাসি দেখতে লাগলো। কতোদিন পর বোনকে এভাবে হাসতে দেখছে শাপলা!
বোনের মুখের এই হাসিটার জন্য এরকম হাজার ও এক তরফা ভালোবাসা শাপলা ভুলে যেতে পারে।
ভীষণ ভালো লাগলো শাপলার।
দরজার বাহিরে দাঁড়িয়ে আদনান ও শুনতে পেলো শালুকের সেই প্রাণচঞ্চল হাসি।যেই হাসিতে আফিম মেশানো থাকে,যেই হাসি আদনানকে মাতাল করে তোলে।
এভাবেই তো হাসতো শালুক আগে।যখন আদনান আমেরিকায় ছিলো।
এই হাসি শুনেই তো আদনান কুপোকাত হয়ে যেতো। আজ কতোদিন পর আবারও শালুকের সেই হাসি শুনছে।অথচ আজ শালুক অন্য কারো জন্য হাসছে।
পারছে না আদনান সহ্য করতে। দ্রুত পায়ে নিজের রুমে চলে গেলো আদনান। এখানে দাঁড়িয়ে শালুকের হাসি শুনলে তার পুরোপুরি নেশা লেগে যাবে।পাগল হয়ে যাবে সে।
শাপলা বললো, “মজার কথা তো তোকে বলা হলো না শালুক।আশা তো চলে গেছে আদনান ভাইকে ছেড়ে। বলে দিয়েছে বিয়ে করবে না আদনান ভাইকে।”
আদনানের নাম শুনতেই শালুকের হাসি থেমে গেলো। মুঝ থমথমে হয়ে গেলো। কঠোর স্বরে বললো, “বেশ করেছে আশা।দুই থাপ্পড় দিয়ে যায় নি যে এটাই তো বেশি। ”
শাপলা হেসে বললো, “তুই তো ছিলি না।কি একটা অবস্থা। সবাই মিলে ওদের বিয়ের তারিখ ফাইনাল করছে সেই মুহুর্তে আশা এসে বললো সে কিছুতেই আদনান ভাইকে বিয়ে করবে না।আদনান ভাই একটা স্বার্থপর মানুষ। নিজের কাজিনের সাথে সে এরকম ব্যবহার করেছে।সব মিলিয়ে আদনান ভাইয়ের মুখে চুনকালি মেখে আশা চলে গেছে। ”
শালুকের ভীষণ আনন্দ হলো এসব শুনে।বললো, “উচিত শিক্ষা হয়েছে আপা।আমি খুব খুশি হয়েছি।”
শাপলা বললো, “এবার ঘুমাতে হবে শালুক,সকালে উঠতে হবে কিন্তু।”
দুজনেই একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে গেলো।
সকালে অভ্যাসমতো শালুকের ফজরের সময় ঘুম ভেঙে গেলো। শাপলাকে ডেকে তুলে দিয়ে শালুক নামাজ পড়ে নিলো।শাপলা অবাক হলো ভীষণ।
শালুক নামাজ শেষ করে আসতেই শাপলা হাসতে হাসতে বললো, “কুম্ভকর্ণের ঘুম এতো পাতলা হলো কিভাবে রে শালুক?হাতি দিয়ে টেনে ও তোকে ঘুম থেকে তোলা যেতো না আর সে তুই কি-না সাত সকালে উঠে আমাকে তুলছিস!”
শালুক হেসে বললো, “অভ্যাস আপা।ধ্রুব ভাই আমার এই অভ্যাস করে দিয়েছে। ধ্রুব ভাই তো উঠে ভোররাতে। নিজের পড়া শেষ করে, টুকটাক রান্নার কাজ এগিয়ে রাখে।আজান হলে আমাকে ডেকে তোলে।তারপর নাশতা বানায়।খুব সকালে বের হয়ে যেতে হয় তার।আবার বাসায় ফেরে অনেক রাত করে। এরপর আবার রান্না করে। ”
শাপলা হেসে বললো, “ইশ,কি শান্তি রে। বরের হাতের রান্না খাচ্ছিস প্রতিদিন। যেখানে সব মেয়েরা নাকের জল,চোখের জল এক করে রান্না করে। ”
শালুক হেসে বললো, “কি জানি আপা।তবে আমার মনে হয় কোনো কাজই কঠিন নয় মানুষের চেষ্টার কাছে।আমার তো ভীষণ খারাপ লাগে ধ্রুব ভাই একা কাজ করে বলে। আমার ইচ্ছে করে তার সব কাজ আমি করে দিই সে একটু বিশ্রাম নিক।”
শাপলা মুগ্ধ হলো শুনে।একে অন্যকে ভীষণ ভালোবাসে বলেই তাদের এরকম অনুভূতি একের অন্যের প্রতি।
দুই বোন নিচে নেমে গেলো।রান্নাঘরে নাশতার তোড়জোড় শুরু হয়ে গেছে। শালুক সেদিকে যেতে নিতেই ফরিদা বেগম তাকে বুকে টেনে নিলেন।তারপর বললেন,”ধ্রুব তো আমাকে মা বলে মানে না শালুক,আমি ওর সাথে এক সময় অন্যায় ব্যবহার করেছি তার শাস্তি আজ ও পাচ্ছি।তুই একটু আমাকে মা বলিস।”
শালুকের ভীষণ লজ্জা লাগলো শুনে।এই মানুষটা তার শাশুড়ী ভাবতেই কেমন লাগছে তার।
ফরিদা বেগম হেসে ফেললেন শালুকের লজ্জা দেখে।তারপর বললেন,”না রে,তুই চাচী বলিস।তোর মুখের চাচী ডাকটাই ভালো লাগে আমার। তোর চুল তো ভালোই বড় হয়েছে শালুক।”
শালুক হেসে বললো, “তোমাদের ছেলে না ধ্রুব ভাই।সে ও তোমাদের মতো রাতে ধরে চুলে তেল দিয়ে দেয় সকালে চুলে হেয়ার প্যাক লাগিয়ে দেয়।তোমাদের মতো করে আমার চুলের পিছনে লেগে থাকে চাচী।”
আদিবা বেগম হেসে বললেন,”স্বামী কে ভাই ডাকতে নেই রে শালুক।”
শালুক বললো, “তবে কি বলবো।আমার লজ্জা লাগে যে।”
হাসনা বেগম মেয়ের জন্য দুধ চা এনে মেয়েকে চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে বললেন,”তুই সত্যি ভালো আছিস তো মা?ধ্রুব যেমন ছেলে আমার বিশ্বাস সে তোর গায়ে আঁচড় লাগতে দিবে না।তবুও তুই কি ওকে মেনে নিতে পেরেছিস?
সুখে আছিস তো দুজনে?”
শালুকের চোখ ছলছল হয়ে গেলো। মায়ের বুকে মাথা রেখে বললো, “ধ্রুব ভাই আমাকে ভীষণ যত্নে রাখে মা।আমি নিজেও নিজের এতো খেয়াল রাখতে পারি না ধ্রুব ভাই যেভাবে আমার খেয়াল রাখে।আমি খুব ভালো আছি মা।শুধু তোমাদের সবাইকে ভীষণ মনে পড়ে। ”
হাসনা বেগম হেসে বললেন, “পাগল। তোর যদি অন্য কোথাও বিয়ে হতো তখনও তো তোকে আমাদের ছেড়ে থাকতে হতো। মেয়েদের জীবন এরকমই মা।আজীবন বাবা মায়ের কাছে তারা থাকতে পারে না। যখনই বিয়ে দিতাম তোকে,আমাদের ছাড়াই তো থাকতে হতো। ”
শালুক মা’কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। তারপর বললো, “মা,যে কয়দিন বাড়িতে আছি তুমি আমাকে কিছু রান্না শিখিয়ে দিবা।যেসব ধ্রুব ভাইয়ের প্রিয় ভীষণ। আমার খুব লজ্জা লাগে।সব কাজ ধ্রুব ভাই করে বাসায়।আমার কাজ শুধু খাওয়া আর পড়া।আমাকে কোনো কাজ করতে দেয় না উনি।আমার ইচ্ছে করে ওনার জন্য কিছু রান্না করতে।”
হাসিনা বেগমের কেমন যেনো আনন্দ লাগলো শুনে।মেয়ে তার স্বামীর জন্য ভাবছে এটাই তাকে আনন্দ দিচ্ছে।বিয়েটা যেভাবেই হোক,দুজন যে দু’জনকে নিয়ে সুখে আছে এর চাইতে আনন্দের আর কি হতে পারে!
শালুক একবার সব টপিকে চোখ বুলিয়ে গেলো।তারপর আলমারি থেকে তার স্কুল ড্রেস বের করলো। এখনো কি সুন্দর ভাঁজ করে রাখা।শালুক জানে এই কাজ শাপলা করেছে।ধ্রুবকে কল দিয়ে জানালো সে স্কুলে যাচ্ছে।
স্কুলে যাবার আগে শালুক একবার শান্তকে দেখতে গেলো। শান্ত এখনো ঘুম থেকে উঠে নি।রাতে ও ঘুমে ছিলো বলে শালুকের সাথে দেখা করতে পারে নি।
শান্তর গালে একটা চুমু দিয়ে শালুক চলে গেলো পরীক্ষা দিতে।
স্কুলে গিয়ে বন্ধবীদের সাথে সে কি গলাগলি শালুকের। সবার সাথে শালুকের ভালো সম্পর্ক ছিলো।
কতোদিন পর সব চেনা মুখকে দেখছে শালুক।আনন্দে কান্না করে দিয়েছে সবাই।
যথাসময়ে পরীক্ষা শুরু হলো। প্রশ্ন হাতে পেয়ে শালুক চমকে গেলো। সবই তার কমন এসেছে। অনেক দিন পর শালুকের কেমন জানি পরীক্ষা দিতে নির্ভয় লাগছে।মনে মনে ধ্রুবকে অসংখ্য ধন্যবাদ জানালো শালুক।
এই প্রথম শালুক ফুল মার্কস আনসার করেছে পরীক্ষায়।
পরীক্ষা শেষ করে সবার সাথে কথা বলতে বলতে শালুকের কিছুক্ষণ দেরি হলো। তারপর বাসার জন্য বের হয়ে আসতেই দেখলো পথে আদনান দাঁড়িয়ে আছে।
বিরক্তিতে, ঘৃণায় শালুকের ভ্রু কুঁচকে গেলো। আদনান কেনো এসেছে এখানে!
#শালুক_ফুলের_লাজ_নাই (২৩)
শালুক নিজের ফাইলপত্র সব শক্ত করে ধরে কোনো দিকে না তাকিয়ে হাটতে লাগলো সামনের দিকে।কিছুটা সামনে এগুতেই আদনান পিছু নিলো তার।
শালুক দ্রুত পায়ে হাটতে লাগলো কিন্তু আদনানের সাথে পেরে উঠলো না।
আদনান এগিয়ে এসে শালুকের পাশাপাশি হাটতে হাটতে জিজ্ঞেস করলো, “কেমন আছিস?”
শালুক জবাব দিলো না। আদনান আবারও জিজ্ঞেস করলো কেমন আছিস।
শালুক হাটার গতি আরো বাড়িয়ে দিলো।আদনানের এবার রাগ উঠে গেলো। শালুকের হাত টেনে ধরে বললো, “ভাব দেখাচ্ছিস আমাকে?কথা বলছি কানে যাচ্ছে না? ”
শালুক টান দিয়ে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বললো, “কি সমস্যা আপনার? রাস্তাঘাটে মেয়ে দেখলে কি মাথা ঠিক থাকে না?ইভটিজিং করতে চলে আসেন?”
আদনানের ভীষণ হাসি পেলো। হেসে দিয়ে বললো, আমাকে তুই চিনতে পারছিস না মনে হয়? এরকম করছিস কেনো?আমার উপর রেগে আছিস?”
শালুক বললো, “আপনি আমার কেউ হন?আপনাকে আমি চিনি?আপনার উপর রাগ করার প্রশ্ন আসছে কেনো তাহলে? ”
আদনান শালুককে নিজের দিকে ফিরিয়ে নিয়ে বললো, “আমার ভুল হয়ে গেছে শালুক,এরকম কিছু হবে আমি কখনো ভাবি নি।আমি তোকে কিছুতেই হারাতে চাই নি শালুক।কেউ না জানুক আমার মন জানে আমি তোকে কতটা ভালোবাসি। ”
শালুকের ভীষণ ঘেন্না লাগলো শুনে।কেমন সারা শরীর ঘিনঘিন করে উঠেছে ওর আদনানের মুখে ভালোবাসার কথা শুনে।
রাস্তার উপর একদলা থুথু ছুঁড়ে ফেলে বললো, “আপনি আর ভালোবাসা! দুটোই বিপরীতমুখী। আপনার সাথে অন্তত ভালোবাসা শব্দ যায় না।আপনি একটা মারাত্মক লেভেলের অসভ্য,ইতর স্বভাবের লোক।”
আদনান ব্যথিত চোখে তাকিয়ে বললো, “সবাই আমাকে ভুল বুঝুক আমার কোনো কষ্ট নেই তাতে কিন্তু তুই আমাকে ভুল বুঝিস না।আমার কথাটা শোন আগে।তারপর বুঝবি আমি কেনো এরকম করতে বাধ্য হয়েছি।”
শালুকের বিরক্ত লাগলো। ভেবেছে বাড়িতে গিয়ে ধ্রুবকে কল দিয়েই জানাবে তার পরীক্ষা ভীষণ ভালো হয়েছে কিন্তু এখন আদনান যা শুরু করেছে তাড়াতাড়ি বাড়িতে যাবার উপায় নেই।
আদনান শালুকের হাত টেনে ধরে বললো, “তোর এই হাতটা আমার হাতে রাখতে চেয়েছি আজীবন আমি।কিন্তু ভাগ্য আমার সহায় ছিলো না।তোকে আমি কতটা চাই শালুক তুই জানিস না।কেউ বুঝবে না সেটা। ”
শালুক হাটা শুরু করলো।
আদনান মন খারাপ করে শালুকের পিছু নিলো। সুযোগ খুঁজে রাস্তায় কাউকে না পেয়ে শালুকের হাত টেনে ধরে পিছনে ফিরিয়ে কোমর চেপে ধরে বললো, “একটা বার আমার কথা শোন শালুক,তারপর আমার সাথে এরকম রাগ করিস।ধ্রুবর কারণেই আমাকে এসব করতে হয়েছে। আমি বাধ্য হয়ে এরকম কাজ করেছি।”
শালুকের হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে গেলো আদনানের এই অসভ্যতা দেখে।কষে একটা থা/প্পড় বসালো আদনানের বাম গালে।তারপর ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দিয়ে বললো, “আর কোনো দিন আমার সামনে আসার ও চেষ্টা করবি না তুই।আমার চরিত্রে তুই দাগ লাগানোর চেষ্টা করেছিস।আমাকে সবার কাছে চরিত্রহীনা প্রমাণ করার চেষ্টা করেছিস।আল্লাহ সহায় ছিলো বলে আমার আল্লাহ আমার সম্মান রক্ষা করেছে।কোনো দিন যদি আবারও আমার সাথে কথা বলার ও চেষ্টা করিস,আজ এক গালে থা/প্পড় মে/রেছি আমি,পরের বার আর আমার হাতের থাপ্পড় না।তোকে শায়েস্তা করার জন্য আমার হাজব্যান্ড ধ্রুবই যথেষ্ট। তোর মতো নর্দমার কীট কে সে খুব ভালো করে শায়েস্তা করতে জানে।আর ধ্রুবর নামে একটা কথা ও বলার চেষ্টা করবি না।ওর নাম উচ্চারণ করার যোগ্যতা ও তোর নেই।”
শালুক আর থামলো না। দৌড়ে বাড়ির দিকে গেলো। আদনান ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো সেখানে হতবিহ্বল হয়ে। শালুক তাকে থাপ্পড় দিয়েছে?
তাকে তুই করে কথা বলেছে?
সব কেমন অবিশ্বাস্য লাগছে আদনানের কাছে।
এই কি সেই শালুক!
নরম,কোমলপ্রাণ সেই শালুক কোথায় আজ?এ তো স্বয়ং বিধ্বংসী নারী।এই কোমল হাত কাউকে এভাবে আঘাত করতে পারে তা কখনো ভেবেছে আদনান?
ধ্রুবর জন্য আজ শালুকের হাতে থাপ্পড় ও খেতে হলো আদনানের।
মাথা ভোঁভোঁ করে ঘুরতে লাগলো আদনানের।
শালুক বাড়িতে এসে হাঁপাতে লাগলো। বাকিটা পথ আর সে দৌড় বন্ধ করে নি।আদিবা বেগম এক গ্লাস পানি দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “কি হয়েছে তোর,এতো হাঁপাচ্ছিস কেনো?”
শালুক পানি খেয়ে বললো, “কিছু না চাচী।দ্রুত পায়ে হেটে এসেছি তো তাই।”
আদিবা বেগম আর কিছু না জিজ্ঞেস করে বললেন,”যা কাপড় পালটে আয় আমি ভাত বাড়ছি।”
শালুক নিজের রুমে চলে গেলো। ড্রেস চেঞ্জ করে গোসল করে নিলো।গোসল করতে গিয়ে শালুকের মনে হলো তার সারা শরীর আদনানের ছোঁয়ায় অপবিত্র হয়ে গেছে যেনো।
বাথরুমের ঝর্ণার পানির সাথে গড়িয়ে পড়লো শালুকের চোখের কয়েক ফোঁটা অশ্রুজল।
শালুক জানে সারা পৃথিবীর সাবান দিয়ে ধুয়ে ও এই ছোঁয়া মুছতে পারবে না।ধ্রুবর ভালোবাসার ছোঁয়া পেলেই এই অপবিত্র ছোঁয়া বিলীন হয়ে যাবে দেহ থেকে।
হঠাৎ করেই শালুকের মন খারাপ হয়ে গেলো। ধ্রুবকে ভীষণ মনে পড়তে লাগলো। কি করছে এখন ধ্রুব?শালুকের কথা কি তার মনে পড়ছে?
সে ও কি শালুকের মতো বিরহে পুড়ছে?
গোসল করে শালুক একটা হলুদ জামা পরে নিলো। ধ্রুব গতকাল নামাজ পড়তে বের হয়ে শালুকের জন্য অনেক কিছু কিনে দিয়েছে।শালুক এখনো সবগুলো ব্যগ খুলেও দেখে নি।জামাকাপড়ের ব্যাগ খুলতেই দেখলো উপরে এই জামাট।শালুক জানে এটাও ধ্রুব গতকাল কিনে এনেছে। ব্যাগ দুটো খুললে আরো অনেক কিছু দেখা যাবে।শালুক ঠিক করলো এগুলো এখন খুলবে না।রাতে একা একা সব খুলে দেখবে।
হলুদ সাদা জামা পরে শালুক নিচে নামতেই আদনানের মুখোমুখি হলো।পাশ কাটিয়ে শালুক চলে গেলো। আদনান পিছনে ফিরে তাকালো আবারও শালুকের দিকে।শালুক আগের চাইতে বেশ সুন্দরী হয়েছে। গায়ের রঙ আরো উজ্জ্বল হয়েছে।
ভেজা চুলগুলো বেয়ে পানি পড়ছে।কি সুন্দর সেই দৃশ্য!
ধ্রুবর কপালের কথা ভেবে আদনানের আরো ঈর্ষা হলো। প্রতিদিন ধ্রুব শালুকের এই চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্য দেখে।জ্বলেপুড়ে ছাই হয়ে যায় নিশ্চয় ধ্রুব তখন।আদনান নিজেই তো এই সামান্য একটুতে দগ্ধ হয়ে যাচ্ছে। তাহলে ধ্রুব কি করে!
শালুক তো তার স্ত্রী। পরমুহূর্তে লজ্জা পেলো আদনান। নিজেকে নিজে সামলে নিজের রুমে চলে গেলো।
খেতে বসে শালুক ধ্রুবকে কল দিলো।ধ্রুব ও তখন খেতে বসেছে। শালুক জিজ্ঞেস করলো, “কি দিয়ে খাচ্ছেন আপনি? ”
ধ্রুব সামনে রাখা ডাল আর সবজির দিকে তাকিয়ে বললো, “আমার প্রিয় তরকারি দিয়েই খাচ্ছি শালুক।তুমি? ”
শালুক বললো, ” ইলিশ মাছের ডিম, কষা মাংস,ডাল।আপনার কথা ভীষণ মনে পড়ছে।কষা মাংস না আপনার ভীষণ প্রিয়। এই খাবারটা আমার খেতে ইচ্ছে করছে না আপনাকে ছাড়া। ”
ধ্রুব হাসলো। ধ্রুবর হাসির শব্দ হয় না।ঠোঁট টিপে কি সুন্দর করে হাসে সে।তবুও শালুক বুঝতে পারলো ধ্রুব হাসছে।
ধ্রুব বললো, “তুমি আমার অর্ধাঙ্গিনী না শালুক। আমার ৫০% তুমি।তুমি খেলেই আমার মন ভরে যাবে।সব কিছুতে পেট ভরতে হয় না।মন ভরলেই মানুষ যে সুখ পায় সেই সুখ পেট ভরে খেলেও পাওয়া যায় না।এই যে তুমি আমার কথা ভাবছো,খেতে গিয়ে আমাকে মনে করছো এর চাইতে সুখের কথা আমার জন্য দ্বিতীয় কিছু নেই শালুক।”
শালুক মলিন হাসলো। তারপর বললো, “আমার পরীক্ষা ভীষণ ভালো হয়েছে জানেন।একটা ওয়ার্ড ও কারো থেকে দেখে লিখতে হয় নি।সবই কমন এসেছে। ”
ধ্রুব খুশি হয়ে গেলো শুনে।শুকরিয়া আদায় করে বললো,”আল্লাহ চায় তো,যেনো তোর সব পরীক্ষা এরকম ভালো হয়।”
শালুক বলল,”আপনি যে হঠাৎ করেই আমাকে তুমি করে বলছেন বুঝতে পারছেন?”
ধ্রুব হেসে ফেললো। সে ইচ্ছে করেই শালুককে তুমি করে বলছে।রাতে সবার সামনে শালুককে তুই করে বললে সবাই ভাবতো হয়তো ওরা এখনো কেউ কাউকে ওভাবে মেনে নেয় নি।একবার তুমি বলার পর আর তুই বলতে ইচ্ছে করছে না।
ধ্রুব কল কেটে দিলো। শালুক খেয়ে শাপলার কাছে গেলো। তারপর শাপলার কাছে আদনানের ব্যাপারটা শেয়ার করলো।
শাপলা অবাক হলো আদনানের এই বহুরূপ দেখে।এই লোকটা কি পাগল না-কি?
এই আশাকে বিয়ে করতে চাচ্ছে আবার শালুককে বলছে ভালোবাসে।
মাথা কি এলোমেলো হয়ে গেলো না-কি আশাকে হারিয়ে?
শাপলা ঠিক করলো এসব ধ্রুব ভাইকে জানাবে সে শালুকের অজান্তে। নয়তো আদনান পরে যদি আরো সমস্যা করে!
চলবে….
রাজিয়া রহমান
চলবে…..
রাজিয়া রহমান
চলবে…….
রাজিয়া রহমান