শালুক ফুলের লাজ নাই পর্ব -৩৩+৩৪+৩৫

#শালুক_ফুলের_লাজ_নাই (৩৩)

সকাল হতেই শালুকের মনে হলো এর চাইতে লজ্জাজনক সময় তার জন্য আর আসে নি।এতোগুলো মানুষের সামনে গিয়ে এই লোক গরম পানি করে এনেছে।
লজ্জায় শালুকের ইচ্ছে করলো মাটির সাথে মিশে যেতে।

ধ্রুব শালুকের দিকে তাকিয়ে বললো, “উঠবা?নাকি আমি ও আসবো কম্বলের নিচে?”

শালুক ধড়মড়িয়ে বিছানায় উঠে বসলো। তারপর বললো, “আপনি এরকম কেনো?লজ্জা নেই আপনার একটুও?”

ধ্রুব হেসে বললো, “শালুক ফুলের লাজ নাই,রাইতে শালুক ফোটে লো,রাইতে শালুক ফোটে।
যার সাথে যার ভালোবাসা সেই তো মজা লোটে লো,বকুল ফুল বকুল ফুল সোনা দিয়া হাত ক্যানে বান্ধাইলি?”

লজ্জায় শালুক ধ্রুবর বুকে আছড়ে পড়লো। ধ্রুবর বুক মুখ ঘষতে ঘষতে বললো, “আমার বুঝি লাজ নাই?”

ধ্রুব হেসে বললো, “আমার শালুক তো লজ্জাবতী। কে বলে তার লাজ নেই।লজ্জাবতী বলেই তো আমার ইচ্ছে করছে তাকে আবারও লজ্জা দিতে।”

শালুক ধ্রুবর কাছ থেকে সরে বললো, “দূর বদলোক,সবসময় শুধু এসব বলে। আপনি কিভাবে পারলেন পানি গরম করে আনতে বলেন তো?”

ধ্রুব হেসে বললো, “হিটার নিয়ে এসেছি বোকা ফুলের জন্য। যাতে সে আমাকে কোনো রকম অযুহাত দেখাতে না পারে।হিটার দিয়েই পানি গরম করেছি।কাউকে বলতে হয় নি নিচে গিয়ে। ”

শালুক বললো, “ছি!আমি তো আরো লজ্জায় শেষ। ভাবলাম আপনি নিচে গিয়ে এনেছেন। তাহলে তো আমি আজকে এই রুম থেকে বের হতেই পারতাম না।”

শালুক গোসল করে কলাপাতা রঙের একটা শাড়ি পরে নিলো।এই শাড়িটি ধ্রুব গতবার বাড়িতে আসার সময় শালুকের জন্য কিনে দিয়েছিলো ব্যাগে,সাথে ম্যাচিং করে চুড়ি।শাড়ি ছাড়াও নতুন তিনটি ড্রেস,দুই জোড়া জুতা,হেয়ার ব্যান্ড,পাঞ্চ ক্লিপ এসব কিনে দিয়েছিলো। শালুক ঠিক করেছে সব পরবে ধ্রুবর সামনে।

ধ্রুবকে দিলো চুড়ি পরিয়ে দেওয়ার জন্য। একটা একটা করে যত্ন করে ধ্রুব শালুককে চুড়ি পরিয়ে দিলো।চুড়ি পরানোর দায়িত্ব ধ্রুব ভীষণ মনোযোগ দিয়ে করে। যেনো একটু এদিক সেদিক হলেই মহাবিপদ ঘটে যাবে।

শালুক বললো, “আমরা কখন যাবো?”

ধ্রুব জিজ্ঞেস করলো, “কোথায়?ঢাকায়?”

শালুক হেসে বললো, “না,মেজো চাচীর সাথে দেখা করতে।ওনাকে আমার দেখার খুব শখ।”

ধ্রুবর দুই চোখ টলমল করতে লাগলো। তার কি কম ইচ্ছে মায়ের সাথে দেখা করার?মায়ের চেহারাটা কেমন যেনো এখন অস্পষ্ট লাগছে।
মা কি এখন আগের মতো আছে?সেই লম্বা,ঘন চুল কি আছে?
এখনো কি আগের মতো গান গায় মা?
কতোগুলো বছর হয়ে গেছে ধ্রুব কাউকে মন ভরে মা বলে ডাকতে পারে নি?

শালুক ধ্রুবর মুখোমুখি বসে বললো, “আমি জানি আপনি ভীষণ কষ্ট পাচ্ছেন।কিন্তু একবার ভেবে দেখেন আজ যদি চাচীর কিছু হয়ে যায়, আপনি তাকে শেষ বার দেখতে না পারেন সারাজীবন এই আক্ষেপ আর মিটাতে পারবেন?
কার কখন মরণ চলে আসে,কে বলতে পারে। ওনার যদি কিছু হয়ে যায়, ওনার ও তো কষ্ট থেকে যাবে শেষ বারের মতো ছেলের মুখখানা দেখতে পান নি বলে। ”

ধ্রুব শালুককে জড়িয়ে ধরে বললো, “আমার সাথে কেনো এমন হলো শালুক? আমি কি অপরাধ করেছি?বাবা মা থেকেও আমার অনাথের মতো বড় হতে হয়েছে।পরিবারের সবাইকে নিয়ে একসাথে থাকার স্বপ্ন তো আমার ও ছিলো, তবে আমি কেনো আমার এতো বড় পরিবার থাকার পরেও বড় হলাম একা?কেনো আমার দুঃসময়ে কাউকে পাই নি আমি?
ভীষণ জ্বরের সময় একটা দরদী হাতের স্পর্শ তো আমি ও পেতে চেয়েছি কেনো পাই নি আমি?
আমার বুকের ভেতর যদি কাউকে দেখাতে পারতাম তবে দেখতে পেতে এই বুকে কেমন পো/ড়া, ক্ষ/ত-বিক্ষ/ত হয়ে আছে। ”

শালুক ভেজা চোখে তাকিয়ে বললো, “আমি আমার ভালোবাসা দিয়ে আপনার মনের সব ব্যথা দূর করে দিবো।আপনি এভাবে ভে/ঙে পড়বেন না প্লিজ।আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ খুব সুন্দর করে তুলবো। ”

মতির মা দরজায় নক করে বললো, “নাশতা খাইতে আসেন তাত্তাড়ি,সবাই বইসা রইছে। ”

চোখ মুছে শালুক উঠে দাঁড়ালো। ধ্রুব পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বললো, “তুই কখনো আমার জীবন থেকে হারিয়ে যাস না শালুক। তবে আমার এই জীবনে বেঁচে থাকার শেষ অবলম্বন ও হারিয়ে যাবে।”

শালুক ফিসফিস করে বললো, “পাগল না-কি, ৪ টা বাচ্চার আম্মু হওয়ার যে স্বপ্ন দেখছি তা পূর্ণ না করে কোথাও যাচ্ছি না আমি।”

ধ্রুব চোখ বড় করে তাকিয়ে রইলো। শালুক আর দাঁড়ালো না। ছুটে যেতে যেতে তার মনে হলো আসলেও শালুক ফুলের লাজ নাই।নয়তো কিভাবে সে চারটা বাচ্চার কথা বলতে পারলো এরকম অনায়াসে?

খাবার টেবিলে আজকে সবাই একসাথে বসেছে।ধ্রুবরা বাবা ছেলে পাশাপাশি বসেছে।আদিবা বেগমের বুকের ভেতর কেমন করে কেঁপে উঠলো হঠাৎ করেই। আদনান না জানি কেমন আছে!
এই পর্যন্ত চার বার কল দিয়েছে আদনান। তাও ২-৩ মিনিট কথা বলতো।আজ ছেলেটা থাকলে তো সে ও বসতো তার বাবার পাশে।
সন্তান যতোই খারাপ হোক,যতোই অন্যায় করুক,মায়েরা বহুদিন সেই ক্ষোভ পুষে রাখতে পারে কি?
তিনি তো পারছেন না।এই যে এখন হুট করে মনে পড়ে গেলো ছেলের কথা।
নিজেকে নিজে জিজ্ঞেস করলেন,”কেনো ছেলেটা এসব অপরাধ করেছে?তার অপরাধের শাস্তি তো তাকে কেউ দেয় ও নি।কি দরকার ছিলো এসব করার?”

হাসনা বেগম গরুর মাংস মেরিনেট করতে করতে বললেন,”ভাবী,খাসির মাংসটা ভিজিয়ে ফেলুন।মতির মা’কে বলুন বেশি করে পেঁয়াজ কাটতে।”

আদিবা বেগম কিছুই বুঝতে পারলেন না।হাসনা বেগম তাড়া দিয়ে বললেন,”ভাবী,দুপুরে জামাই এসে খাবে কিন্তু,এখনো চিংড়ি ভাজা হয় নি।”

হুঁশ এলো আদিবা বেগমের। আজকে আফিফা আসবে,দাদীর অসুস্থতার কথা শোনার পর মেয়েটা অস্থির হয়ে গেছে। পরমুহূর্তে মনে পড়লো আজকে জহির ও আসবে।সবাই থাকবে আজকে বাসায় শুধু আদনান থাকবে না।

নাশতা খাওয়া শেষ করে ধ্রুব বললো, “আমি আর শালুক যাচ্ছি। ”

কোথায় যাচ্ছে কেউ জিজ্ঞেস করলো না। সবার মনের ভেতর ভয় কাজ করছে।কে জানে মা ছেলের মিলনদৃশ্য কেমন হবে!

বাজারে গিয়ে ধ্রুব অনেক কিছু নিলো মায়ের জন্য। ফলমূল, মিষ্টি, বিস্কুট চানাচুর অনেক কিছু। একটা সিএনজি ভর্তি করে ফেললো। শালুকের বুকের ভেতর ঢিপঢিপ করছে অজানা আতংকে।

দীপালিদের বাড়ির সামনে এসে সিএনজি থামলো। গেইটের দারোয়ান এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলো, “কাকে চাই?”

ধ্রুব বললো, “আমি ধ্রুব।”

সাথে সাথে লোকটা ব্যস্ত হয়ে গেইট খুলে দিলো। ডাক দিয়ে বললো, “কর্তাবাবু,দেইখা যান কে আসছে বাড়িতে!”

সাদা ধুতি পরা একজন বৃদ্ধ লোক এগিয়ে এসে বললো, “তোমরা কারা?”

ধ্রুব বললো, “আমার স্ত্রী শালুক, আর আমি ধ্রুব।”

লোকটা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। দুই পা এগিয়ে এসেও আবার থেমে গেলো। তার দুই চোখ টলমল করছে। নাতিকে জড়িয়ে ধরতে চেয়েও আর ধরলেন না।নাতি কিছু মনে করে যদি এই ভয়ে।
কাঁপা কাঁপা গলায় বললো, “আসো,আমার সাথে আসো।”

দোতলার সবচেয়ে শেষের রুমের সামনে দাঁড়িয়ে বললেন, “যাও ভেতরে যাও।আমি নিচে আছি। ”

লোকটা চলে গেলো। ধ্রুব খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো বাহিরে।তারপর দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করলো। বিছানার সাথে লেগে থাকা মানুষটাকে দেখে মুহুর্তেই ধ্রুবর মাথা ঘুরতে লাগলো।
এ যেনো কোনো মানুষ নয়।শুকনো পাটকাঠি,কঙ্কালের মতো হয়ে গেছেন।সারা দেহে তার এক ছটাক মাংস ও হবে না।থাকার মধ্যে আছে শুধু জ্বলজ্বলে দুই চোখ আর লম্বা, জট ধরা চুল।

ধ্রুবর দিকে তাকিয়ে নিজে নিজে বললেন, “ধ্রুব এসেছিস?”

ধ্রুবর গলা ধরে এলো। কথা বলতে পারলো না। হাতছানি দিয়ে কাছে ডাকলেন দীপালি ধ্রুবকে।ধ্রুব এগিয়ে যেতেই পাশে বসালেন।ধ্রুবর হাত খানা শক্ত করে ধরে বললেন, “আমার বাপধন, আমার মানিক তুই।আমার সাত রাজার ধন।আমাকে মাফ করে দিস বাবা।তোর সুন্দর জীবন আমি নষ্ট করে দিয়েছি।বেঁচে থেকেও তোকে মায়ের আদর দিতে পারি নি। ”

ধ্রুব জিজ্ঞেস করলো, “আপনার এই অবস্থা কেনো?ডাক্তার দেখিয়েছেন আপনি? ”

দীপালি হেসে বললো, “এই যে আমার সব রোগের ঔষধ, আমার ডাক্তার আজ আমার সামনে বসে আছে। এখন আমি একেবারে সেরে যাবো বাবা।তোর মুখখানা দেখার জন্য আমি অস্থির হয়ে ছিলাম।এবার আর কোনো য/ন্ত্রণা থাকবে না আমার দেহে।
ওই কে দাঁড়িয়ে আছে? ”

ধ্রুব বললো, “আমার স্ত্রী, শালুক। ”

দীপালি কাছে ডেকে বললো, “কোন শালুক বাবা?আমাদের শালুক?আমার সেই ছোট্ট রসগোল্লার মতো সেই শালুক? ”

ধ্রুব হেসে বললো, “হ্যাঁ, সেই শালুক। ”

দীপালি শালুকের হাত ধরে বললো, “মা’গো, কেমন আছো তুমি? আমি তোমার শাশুড়ী হতাম।এখন আমি তোমার কেউ না মা।আমাকে তুমি চিনবে না।আমি চিনি তোমাকে।তোমার তুলতুলে নরম শরীরটা আমার এখনো মনে আছে।তোমাকে আমি বলতাম মোমের পুতুল তুমি আমার।
এখনো তুমি তেমনই আছো।”

শালুক কিছু বলতে পারলো না। তার কান্না পাচ্ছে ভীষণ ওনাকে এই অবস্থায় দেখে।

ধ্রুব বললো, “আপনার বাচ্চারা কোথায়?”

দীপালি অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকে বললো, “আমার তো এই একটাই বাচ্চা বাবা,সেটা তুই।”

ধ্রুব লজ্জা পেয়ে বললো, “আমি শুনেছি আপনার বাবা মা আপনাকে আবার বিয়ে দিয়েছিলেন।”

দীপালি করুণ হেসে বললো, “না তো,এরকম কিছুই হয় নি। তোমাদের বাড়ি থেকে আসার পর পরই আমাকে গৃহবন্দী করে ফেলে।তারপর আমি অসুস্থ হয়ে যাই,আজও সেই অসুস্থতা বয়ে বেড়াচ্ছি। আমি তো একজনকে ভালোবেসেছি বাবা,তাকে ছেড়ে এসেছি বলে কি অন্য কারো হয়ে যাবো না-কি? আমার ভালোবাসা তেমন ছিলো না। ”
ধ্রুব কেঁদে দিয়ে বললো, “কেনো এরকম হলো বলেন আপনি?আপনি ও কষ্ট পেয়েছেন এখানে থেকে,আমি ও কষ্ট পেয়েছি আপনাদের ভালোবাসা হারিয়ে আমার বাবা তো উন্মাদের মতো হয়ে গেছিলেন।”

দীপালি হেসে বললো, “দোষ আমাদের ছিলো বাবা।ভালোবাসার টানে দুজনে নিজেদের ধর্মকে অসম্মান করেছি।হিন্দু হয়ে মুসলিম ছেলেকে বিয়ে করেছি,সে ও মুসলিম হয়ে হিন্দু মেয়েকে বউয়ের স্বীকৃতি দিয়েছে। উপরওয়ালা কি এমনি এমনি ছেড়ে দিবে না-কি?
তোমার ধর্মে যেমন এই বিয়ের অনুমতি নেই আমার ধর্মে ও নেই।তবুও আমরা হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে করে ফেলেছি।দুজনের মধ্যে এ ও কথা ছিলো কেউ কারো ধর্ম অসম্মান করবো না।নিজ নিজ ধর্ম পালন করবো।

বলো বাবা,এই অনাচারের শাস্তি কি সৃষ্টিকর্তা দিবেন না আমাকে?বিশেষ করে আমি নিজেই চাপ দিয়েছি তোমার বাবাকে।এখানে কারো কোনো দোষ নেই বাবা।আমাদের ভাগ্যে এই ছিলো। ”

ধ্রুব কেঁদে বললো, “আমার যে জীবনটা এলোমেলো হয়ে গেলো তাতে!”

দীপালি হেসে বললেন,”সেটাই তো আমার আর তোমার বাবার জন্য সবচেয়ে বড় শাস্তি সৃষ্টিকর্তার তরফ থেকে।”

অনেকক্ষণ সবাই চুপ করে ছিলো। কারো কোনো কথা নেই।দীপালি ধ্রুবর হাত চেপে ধরে শুয়ে রইলো চোখ বন্ধ করে। তারপর অনেকখানি সময় কেটে যাবার পর বললো, “এবার তোমরা যাও বাবা।মন ভরে দেখে নিয়েছি তোমাকে।”

ধ্রুব চুপ করে থেকে বললো, “আমি আপনাকে অনেক ভালোবাসি মা।আমি আপনাকে আর বাবাকে ভীষণ ভালোবাসি।একটা বার যদি আমি আপনাদের দুজনকে একই সাথে কাছে পেতাম মা,দুজনকে একই সাথে দেখতে পারতাম তবে আমার সব কষ্ট চলে যেতো। ”

দীপালি চোখ মুছে বললো, “যাও ধ্রুব, চলে যাও তুমি। আমার নার্স আসার সময় হয়েছে এখন।”

ধ্রুব শালুককে নিয়ে বের হয়ে এলো। একটু এগিয়ে শালুক থমকে দাঁড়ালো। তারপর বললো, “আমরা ওনাকে ঢাকায় নিয়ে যাবো।ওখানে ওনাকে ডাক্তার দেখাবো।উনি সুস্থ হয়ে যাবেন চিকিৎসা করালে।টাকা পয়সার জন্য আপনি ভাববেন না।বাড়ি থেকে যেসব গহনা পেয়েছি তাতে প্রচুর টাকা পাওয়া যাবে বিক্রি করে। আপনার কাছে রিকুয়েস্ট রইলো প্লিজ আমাকে না বলবেন না।এতো দিন পরে আপনি আপনার মা’কে ফিরে পেয়েছেন আমি তাকে এভাবে থাকতে দেখতে পারবো না। আপনি ছাড়া তার আর কেউ নেই এখন”

ধ্রুব বললো, “তাই হবে শালুক। ”

ধ্রুবর নানা নিচে বসে রইলেন সিড়ির পাশে।ধ্রুব এসে তাকে বললো, “আমি মা’কে ঢাকায় নিয়ে যেতে চাই।ওনার চিকিৎসা করানোর জন্য। ”

তিনি বললেন, “তোমার মা,তোমার অধিকার আছে। নিয়ে যাও।আমার মেয়েটা বেঁচে থাকুক তবুও।”

ধ্রুব চলে এলো শালুককে নিয়ে। রিকশায় বসে শালুককে বললো, “ঢাকায় গিয়ে আগে বাসা চেঞ্জ করতে হবে শালুক।তারপর মা’কে নিয়ে যাবো।”

শালুকের ভীষণ ভালো লাগলো। এতো বছর পর মা বলে ডাকতে পেরেছে ধ্রুব,এটাই তার সবচেয়ে খুশির কারণ।

বাসায় গিয়ে দেখলো সবাই বসে আছে ধ্রুবদের জন্য। ধ্রুব সবকিছু বললো সবাইকে।বাবার কাঁধে হাত রেখে বললো, “আপনি চিন্তা করবেন না বাবা।আমি আছি আমার মা’কে দেখার জন্য। আপনি আমার এক মায়ের জন্য চিন্তা করতে গিয়ে অন্য মা’কে কষ্ট দিবেন না বাবা।”

ফরিদার দিকে তাকিয়ে বললো, “উনি ও তো আমার মা।ওনাকে আর কখনো কষ্ট দিবেন না বাবা।এক মা’কে হারাতে হারাতে পেয়েছি, আপনার অবহেলার জন্য ওনাকে যেনো হারাতে না হয়।আমি তো নিজেকে সামলাতে পেরেছি,আমার ভাইবোন এখনো ছোট। ওরা ওনার কষ্ট সহ্য করতে পারবে না বাবা।”

ফরিদা কেঁদে ফেললো। আফিফারা এসেছে কিছুক্ষণ আগে।হাতমুখ ধুয়ে নিচে নেমে আসতেই দেখলো সবাই বসে আছে। জহির ও আছে সাথে। আফিফা এক নজর তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিলো।মিথ্যা মায়া বাড়িয়ে লাভ হবে কি?
বহুদিন পর আজ আবারও সবাই একই সাথে খেতে বসলো। আনন্দ, বেদনা সবার বুকের মধ্যে রয়েছে তবুও সবাই খুশি আজ একত্রিত হতে পেরে।
#শালুক_ফুলের_লাজ_নাই (৩৪)

দীর্ঘদিন পর আফিফা বাড়িতে এসেছে। তার জীবনটা সবচেয়ে বেশি এলোমেলো। কিছুতেই সে সংসারী হতে পারছে না শত চেষ্টা করে ও।
ননদেরা এলে আফিফার সব এলোমেলো লাগে।কিছুক্ষণ পর পর নাশতা, খাবারের নানা আইটেম এসব আফিফা ঠিক মতো করতে পারে না।
আর যখনই কোনো ভুল হয় দুই ননদের মুখ কালো হয়ে যায়।
আর সেই সাথে সাথে আফিফার হাজব্যান্ড এর মুখও আষাঢ় মাসের আকাশের মতো কালো হয়ে যায়।

দুপুরে খাবার পর আফিফা,শাপলা, শালুক মিলে শাপলার রুমে বসে আড্ডা দিচ্ছিলো।শাপলা আফিফার চুলে তেল দিতে দিতে বললো, “আপা,তোমার সংসার কেমন কাটছে?কিভাবে অবসর কাটাও তুমি? কলেজে যাও? ”

আফিফা হেসে বললো, “আমার আর পড়ালেখা। কাজ করতে করতে নিজের নিশ্বাস নেওয়ার সময় ও হয়ে উঠে না।সেই কবে চুলে তেল দিয়েছি নিজেও জানি না।”

শালুক অবাক হলো শুনে।সে তো তার বাসায় করার মতো কোনো কাজ খুঁজে পায় না।অথচ আফিফা আপা কি বলে এসব!
অবাক হয়ে শালুক জিজ্ঞেস করলো, “কিসের কাজ আপা এতো তোমার? ”

আফিফা হেসে বললো, “সবসময় আমার দুই ননদ এই বাসায় থাকে নিজেদের স্বামীদের নিয়ে।ধর একজন এলো তো আরেকজন যাবার সময় হলো। দুজনেরই বাচ্চাকাচ্চা আছে।মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ ৭ দিন তারা নিজের শ্বশুর বাড়ি থাকে।
দুই বোন যখন একসাথে হয় তখন তো মনে হয় যেনো দুনিয়ার খবর থাকে না ওদের।বাচ্চাদের একবার একটা চাই,সব কিছু আমাকেই করতে হয়।কারো বাচ্চা শুধু চিকেন খায় কারো বাচ্চা আবার ফিশ ফ্রাই খায়।আবার বাচ্চারা নিজেদের হাতে খাবার ও খায় না,আমাকে খাইয়ে দিতে হয়।
বাচ্চারা যদি বলে নিজের হাতে খাবে ওদের মায়েরা রেগে যায়।নিজের হাতে খেলে ওরা না-কি খাবার কম খায় সেজন্য আমাকে খাইয়ে দিতে হবে।
কিন্তু বিশ্বাস কর,খাবার মুখে নিয়ে ওরা সারা দুনিয়া ঘুরে আসে কিন্তু মুখের খাবার গিলে না।ঘন্টার পর ঘন্টা লাগে ওদের খাওয়াতে গেলে।
বাড়িতে কাজের মহিলা ছিলো ওদের,বিয়ের পর পরেই আমার বড় ননদ ওই মহিলাকে কাজ থেকে ছাড়িয়ে দিয়েছেন।সকালে তোর ভাইয়া দোকানে চলে যাবে তো আমাকে সেই হিসেবে খুব ভোরে উঠে নাশতা বানাতে হয়।রুটি,ডিম,সবজি,দুধ চা করার পর করতে হয় বাচ্চাদের জন্য নাশতা। এরপর ভাত রান্না করা লাগে,ভাতের সাথে নিম্নে ৪ আইটেম যদি না করি সেদিন ওনাদের সে কি রাগ।
সাথেসাথে ভাইকে কল দিয়ে জানায় তারা আসায় আমি অখুশি, এজন্য ঠিক মতো রান্না করি না তাদের জন্য।
আর এরপর ওনার কল আসে,সেই কল আমার জন্য কি যে আতংকের তা আমি জানি শুধু।গম্ভীর হয়ে বলেন,আমার বোনেরা আমি যতোদিন বেঁচে আছি এই বাড়িতে থাকবে,তোমাকে ওদের ইচ্ছেমতো চলতে হবে।যে যা চায় সব করতে হবে। আর যদি না পারো তবে তোমার বাবা মাকে বলে দাও এসে যাতে তোমাকে নিয়ে যায়।আমার এরকম স্ত্রী চাই না।
অথচ ওনার মুখ থেকে আমি কখনো একটা ভালোবাসার কথা শুনি নি। ”

শালুক হতভম্ব হয়ে বললো, “কি বলো আপা এসব!আমার কিছুই মাথায় ঢুকছে না।স্বামীরা এরকম হয় স্ত্রীর সাথে? ”

আফিফা বললো, “সবাই তো ধ্রুব না রে শালুক, সবাই তো আর বউকে ভালোবাসতে জানে না পাগলের মতো। ”

শালুকের ভীষণ কষ্ট হলো আফিফার জন্য।

আফিফা বললো, “ভেবেছিলাম বিয়ের পর স্বামীর ভালোবাসা পেয়ে জহির ভাইকে সহজেই ভুলে যেতে পারবো কিন্তু এখন দেখছি উল্টো হয়ে গেছে ব্যাপারটা। আমি আরো বেশি মনে করতে থাকি তাকে।সবসময় মনে হয় ওনার জায়গায় জহির ভাই থাকলে আমার সাথে এরকম কিছুতেই করতো না।
আমি জানি আমি পাপ করছি স্বামীর সাথে পর পুরুষের তুলনা করে। কিন্তু আমার বেহায়া মনটা যে মানে না শালুক। আমি কি করতাম তোরা বল!
বাবা মা’কে ও এসব জানাতে ইচ্ছে করে না।একে তো আদনান ভাইকে নিয়ে দুজনের মনে কষ্ট এখন যদি আমার এসব কথা শুনে তবে দুজনেই ভেঙে পড়বে।
ওনারা পয়সাওয়ালা জামাই চেয়েছে আমার জন্য, কিন্তু একটা ভালো মানুষ চায় নি।
সবচেয়ে কষ্টের কথা কি জানিস,ওনার বোনদের সেবা যত্ন করার জন্য উনি আমাকে আমার বাপের বাড়ি আসতে দেয় না।পুরুষ মানুষ এটা বুঝে যে তার বোন তাদের বাড়ি সবসময় আসবে,তবে এটা কেনো বুঝে না তার স্ত্রী ও কারো মেয়ে,কারো বোন।তার ও ইচ্ছে করে তার বাপের বাড়ি যেতে!”

শালুক কোনো জবাব দিতে পারলো না। আল্লাহ তাকে কি পরিমাণ সুখে রেখেছে হঠাৎ করেই শালুক তা টের পেলো।

বিকেল হতেই আফিফার হাজব্যান্ড আফিফাকে রেডি হবার জন্য তাড়া দিতে লাগলো। এখনই চলে যাবে তারা।তার ছোট বোন এসেছে বাসায়।

শুনে আফিফা স্তব্ধ হয়ে গেলো। আস্তে করে বললো, “আপা তো এক সপ্তাহ আগে গিয়েছে এই বাড়ি থেকে,আমি আজ কতো মাস পরে এসেছি বাড়িতে? আপনার কি একটু ও মায়া দয়া,বিবেক নেই?
দুপুরে এলাম আর এখনই আপনি চলে যাবার জন্য বলছেন।”

তেড়ে এসে আফিফার চোয়াল চেপে ধরে আফিফার হাজব্যান্ড সজিব বললো, ” খুব সাহস বেড়েছে মনে হয় তোমার বাবার বাড়ি এসে?আমার বোনের সাথে তুলনা করতে চাইছো কোন সাহসে?আমি এখন বলছি তো তুমি এখনই চলে যাবে।তুমি কোনো ডাক্তার না যে তোমাকে এখানে থাকতে হবে।আর যদি তবুও থাকতে চাও তবে মনে রেখ,এখানেই সম্পর্ক শেষ তোমার সাথে।”

ধ্রুব আফিফার রুমের দিকে আসছিলো বিকেলে সবাই মিলে বাহিরে ফুচকা খেতে যাবে এই কথা বলার জন্য।শালুক কেঁদে কেঁদে আফিফার কষ্টের কথা বলেছে ধ্রুবকে।শুনে ধ্রুবর নিজের ও কেমন দমবন্ধকর অনুভূতি হয়েছে। বাহিরে থেকে আফিফার স্বামীর এসব কথা শুনে চমকে গেলো ধ্রুব। কপালের রগ দপদপ করতে লাগলো রাগে তার।তারমানে এই লোকটা সবসময় আফিফার সাথে এরকম দুর্ব্যবহার করে!

আফিফার চাপা কান্নার শব্দ শুনে ধ্রুবর রাগ আকাশ ছুঁলো।
দরজায় নক করে বজ্রকঠিন স্বরে বললো, “আফিফা,আফিফা দরজা খোল তো।শালুক বললো, সবাই মিলে বাহিরে যাবে,তোর একটা ব্লু কালার হিজাব দিতে বলেছে শালুক।”

আফিফা তাৎক্ষণিক চোখ মুছে নিজেকে সামলে দরজা খুললো। তারপর হিজাব দিতেই ধ্রুব হেসে বললো, “তুই আর ভাইয়া ও রেডি হয়ে নে।আজ আমরা সবাই মিলে বাহিরে বের হবো।একটা পিকনিক পিকনিক আমেজ আসবে।”

আফিফা বললো, “তোরা যা ধ্রুব,আমি চলে যাবো এখন।”

ধ্রুব বললো, “মানে কি?দুপুরে এলি আর এখনই যাবি কেনো?ভাইয়া কই?”

সজিব দুই হাত ভাঁজ করে বুকের উপর রেখে গম্ভীর হয়ে বসে রইলো। ধ্রুব এগিয়ে গিয়ে বললো, “আফিফা কি বলছে ভাইয়া,যেতে চাইছে কেনো ও?কতোদিন পর এলো বাড়িতে, সবাই একসাথ হয়েছি আমরা। আজ থাকুন না আপনারা। ”

সজিব বললো, “না ধ্রুব,থাকা যাবে না।আমার বোন এসেছে। ওকে যেতে হবে।”

ধ্রুব হেসে বললো, “ভাইয়া,আফিফা ও কিন্তু আমার বোন।আপনার বোন এসেছে ভালো কথা,আজকের রাতটা থেকে আগামীকাল যান আপনারা। ”

সজিব বিরক্ত হয়ে বললো, “আমার দুই বোন বেড়াতে এসেছে, আফিফা এখানে থাকলে ওরা কিভাবে থাকবে?ওদের জন্য রান্নাবান্নার ব্যাপার আছে। ”

ধ্রুব অবাক হয়ে বললো, “আপনার বোনদের জন্য রান্না করতে হবে বলে আপনি আমার বোনকে নিয়ে যেতে চাচ্ছেন?আপনার বোনদের এক রাত রান্না করে খেতে কষ্ট হবে,তো আমার বোনের কি কষ্ট হবে না ওনাদের জন্য রান্না করতে? ”

সজিব হতভম্ব হয়ে গেলো ধ্রুবর কথা শুনে।কিছু বলার আগে ধ্রুব বললো, “সজিব ভাই,দরজার বাহিরে থেকেই আপনার কথা আমি শুনেছি। আফিফা অনেক মাস পরে বাড়িতে এসেছে। ও মিনিমাম এক সপ্তাহ বেড়াবে এখানে।আপনার যদি থাকতে অসুবিধা মনে হয় তবে আপনি যেতে পারেন, এক সপ্তাহ পর এসে ওকে নিয়ে যাবেন।”

সজিব রেগে বললো, “তোমার কথা মতো হবে না-কি? তুমি কে সিদ্ধান্ত নেওয়ার?আমার অনুমতি ছাড়া আমার স্ত্রী এখানে এক মুহূর্ত ও থাকতে পারবে না ইসলামের আইনানুযায়ী তা জানো তুমি? ”

ধ্রুব বললো, “বেশ তো,নিয়ে যান তাহলে। কিন্তু ইসলামের আইনানুযায়ী কিন্তু আফিফার উপর ও এরকম কোনো ফরজ নিয়ম নেই যে আপনার বোনদের রেঁধে বেড়ে খাওয়াতে হবে।আফিফা যাবে কিন্তু ও আপনার বোনদের জন্য কোনো কাজ করবে না।”

সজিব হতভম্ব হয়ে গেলো ধ্রুবর কথা শুনে। আফিফা ধ্রুবকে ধাক্কা দিয়ে বের করে দিতে চাইলো রুম থেকে।ধ্রুব আফিফাকে ধমক দিয়ে বললো, “খুব বড় হয়ে গেছিস মনে হয় তুই?আমরা কি সবাই ম/রে গেছি না-কি? নাকি আমাদের কাঁধে তুই বোঝা হয়ে ছিলি যে বিয়ে দিয়ে ঝামেলামুক্ত হয়েছি আমরা। সব শুনেছি আমি,সব জানি।আপনি আফিফাকে এতো দুর্বল ভাবছেন কোন সাহসে? আদনান ভাই নেই, আমি আছি।আমার বোনের সাথে কথা বলতে সাবধানে, ভেবে কথা বলবেন।ওকে একেবারে বাবার বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়ার ধমক তো সবসময় দেন।
আপনি কি ভেবেছেন আমরা এতোটাই অসহায় যে নিজের বোনকে রাখতে পারবো না?
বিয়ে করে বউ নিয়েছেন, নিজের অর্ধাঙ্গিনী নিয়েছেন। তাকে কাজের মহিলার মতো ট্রিট করবেন না।তাকে যদি ভাবেন সে আপনার বাড়ির কাজের মহিলা, তবে তার থেকে তেমন ব্যবহারই পাবেন।তাজে যদি ভাবেন আপনার মনের রানী,তবে দেখবেন আপনাকে ও সে রাজার মতো সম্মান করছে।
নারীরা কাদামাটির দলার মতো, ভালোবাসা দিয়ে তাকে যেকোনো রূপ দেওয়া যায়।
যখন তখন তাকে হুমকি দিয়ে, ধমকি দিয়ে কথা বলার মধ্যে পুরুষত্ব লুকিয়ে থাকে না।পুরুষত্ব থাকে নিজের ভালোবাসা, নিজের বুদ্ধি দিয়ে তার মন জয় করে কিভাবে দুজনে সুখী হওয়া যায় সেই কাজ করার মধ্যে।
আপনার কি একবার ও মনে হয় না আপনার স্ত্রী ও একটা মেয়ে,আপনার যেমন ভালো লাগে আপনার বোনদের কাছে পেলে, ওর বাড়ির মানুষের ও তেমন ভালো লাগে ওকে কাছে পেলে।
মানছি আপনার বাসায় মা নেই,তাই আফিফার দায়িত্ব বেশি। কিন্তু দায়িত্ব মানে কি এই যে বিয়ের পর নতুন নতুন অবস্থায় দুই তিন বার বাবার বাড়ি আসার পর আর তাকে এই বাড়িতে আসতে না দেওয়া?
সপ্তাহের বৃহস্পতিবার বিকেলে আপনি ওকে একবার নিয়ে এসে শুক্রবার বিকেলে নিয়ে চলে যান।একটা দিন আপনার দুই বোন ম্যানেজ করে নিতে পারবে।তাতে আফিফার ও মন খুশি থাকবে।বিশ্বাস করেন,ও নিজে থেকেই তখন আপনার, আপনার বোনদের ভালোবাসবে।
এভাবে সংসার হয় সজিব ভাই,কিন্তু সেই সংসারে সুখ আসে না।একই বিছানায় থেকেও দুজনের মনে যোজন যোজন দূরত্ব থাকে।দিনে হাজার হাজার টাকা আয় করার মধ্যে কোনো সুখ নেই সজিব ভাই,সুখ আছে বাসায় ফিরে একটা বেলি ফুলের মালা স্ত্রীর খোঁপায় গুঁজে দিলে যেই স্বর্গীয় হাসি দেখতে পাওয়া যায় তার মধ্যে। সুখ থাকে বাসায় ফিরতে দেরি হলে স্ত্রীর চিন্তিত মুখখানা দেখার মধ্যে। ”

সজিব চুপ হয়ে বসে রইলো। ধ্রুব হিজাব নিয়ে চলে গেলো। সবাই মিলে রেডি হয়ে বের হবার সময় দেখলো আফিফা আর সজিব ও রেডি হয়ে নিচে বসে আছে। আফিফার দুই চোখ ভেজা কিন্তু মুখে হাসি।
ধ্রুবকে দেখে আফিফা জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠে বললো, “দুনিয়ার সব বোন যাতে তোর মতো একটা ভাই পায়,সব স্ত্রী যাতে তোর মতো স্বামী পায়।বিশ্বাস কর ভাই,তাহলে আর কোনো নারী স্বামী নিয়ে অসুখী হবে না,স্বামীকে নিয়ে বুকে চাপা কষ্ট জমিয়ে রাখবে না।”

রিকশায় সজিব বললো, “আমি ধ্রুব ভাইয়ের সাথে বসতে চাই।”

শাপলা, শালুক,আফিফা এক রিকশায় বসলো। সজিব ধ্রুবর পাশে বসে ধ্রুবর হাত ধরে বললো, “সবসময় আশেপাশের সবাই বলতো,বিয়ের পর বউকে কঠিন শাসনের মধ্যে রাখবি।উঠতে বসতে ধমক দিবি।মহিলাদের টাইটের মধ্যে রাখা লাগে নয়তো তাদের পাখনা গজায়।স্বামীদের মূল্য দেয় না।
আমার মা ছাড়া সংসার। আত্মীয় স্বজন সবাই বিয়ের আগে বলে দিয়েছিলো,বউ আসলে আর আমার বোনদের সহ্য করতে পারবে না।আমার বোনদের হিংসা করবে।বিশ্বাস করো ধ্রুব আমার তখন খুব খারাপ লাগতো। সবার বুদ্ধি,যুক্তি শুনে আমি বুঝলাম যে আমি যদি সবসময় গম্ভীর হয়ে থাকি,আফিফাকে রাগারাগিতে রাখি তবে আফিফা সোজা থাকবে।আমার বোনদের হিংসা করবে না।যখন তখন ওদের নামে নালিশ জানাবে না।
সেই ভাবনা থেকে আমি সবসময় ওর সাথে একটা গাম্ভীর্য নিয়ে কথা বলি,কিছু হলেই ধমকাতে থাকি।আমার বোনদের দোষ দেখেও আফিফাকে শাসাই,আমি জানি আমার বোনদের দোষ আছে কিন্তু তবুও ওদের কিছু বলি না।
আফিফা ও ভয়ে সবসময় চুপ থাকে।কিন্তু সবকিছুর পরেও আমি বুঝতাম আফিফার সব ঠিক থাকলেও আমার সাথে ওর মনের মিল নেই।আমি বাসায় আসলে আফিফার চোখমুখ শুকিয়ে যায়।আমি যেনো ওর কাছে মূর্তিমান আতংক।
তবুও আমি ভাবতাম থাকুক এভাবে,তবুও যদি আমার বোনদের হিংসা না করে তাহলেই হলো।
আমি আসলে স্ত্রী ও বোনদের মধ্যে ব্যালেন্স করতে পারি নি। এখন মনে হচ্ছে আমি আমার এসব ব্যাপারে আগেই সতর্ক হওয়া উচিত ছিলো, মানুষের কথা না ধরে নিজের বুদ্ধিকে কাজে লাগানো উচিত ছিলো।

আজ তোমার কথা শুনে বুঝলাম তুমি ভুল কিছু বলো নি।আফিফার মন খারাপের কারণ আমি কখনো জানতে চাই নি।আফিফা কখনো আমার সাথে হেসে কথা বলে নি, আমি ও বলি নি। আমাদের সম্পর্কটা আসলেই কেমন ম্যাড়ম্যাড়ে।
আমার উচিত ছিলো আফিফার মন বুঝতে চাওয়া।”

ধ্রুব হেসে বললো, “আমার কথায় কষ্ট পেয়ে থাকলে ক্ষমা করে দিবেন আমাকে।আপনার যেমন আপনার বোনের মন খারাপ সহ্য হয় না ভাই,আমার বোনের মন খারাপ ও আমাকে তেমন যন্ত্রণা দেয়।স্ত্রী আর বোন দুজনের জায়গা আলাদা। দুজনকেই প্রায়োরিটি দিতে হবে।কিন্ত একজনের জন্য অন্যজনকে আঘাত দেওয়া কোনো কাজের কথা না।এটুকু ভরসা করুন,আফিফা যৌথ পরিবারে বড় হয়েছে। ছোট থেকেই দেখে এসেছে সবাই মিলেমিশে থাকতে হয় কিভাবে।অন্তত আফিফার পক্ষ থেকে এরকম ব্যবহার আপনি পাবেন না যা আপনার বোনদের জন্য কষ্টের হয়।এটুকু আমি লিখে দিতে পারি। ”

সজিব বললো, “তুমি দয়া করে এসব আমার শ্বশুর শাশুড়িকে বলিও না।ওনারা জানলে ভীষণ কষ্ট পাবেন।আমি আমার ভুল বুঝতে পেরেছি।”

সবাই মিলে ফুচকার দোকানে এলো। আফিফা বারবার শালুককে জড়িয়ে ধরে বলছে,”খবরদার শালুক,আমার ভাইকে কষ্ট দিবি না।আজ ধ্রুবর জন্য তোর দুলাভাইয়ের চোখের পর্দা সরে গেছে। এই প্রথম সে আমাকে ভালোবাসি বলে জড়িয়ে ধরেছে।আমার তো খুশিতে ম/রে যেতে ইচ্ছে করছে এখন।”

শাপলা, শালুক দুজনেই হাসতে লাগলো শুনে।নয়না বললো, “তোরা এতো হাসছিস কেনো?”

আফিফা নয়নাকে জড়িয়ে ধরে বললো, “আজ আমি খুব খুশি আপা।”
#শালুক_ফুলের_লাজ_নাই (৩৫)

ধ্রুবরা ঢাকায় ফিরে এলো ১২ দিন হয়েছে। ইতোমধ্যে শালুক নিয়মিত কলেজে যাওয়া শুরু করেছে। ধ্রুব আগের মতো সকালে উঠে রান্না করে, শালুক কলেজ থেকে ফিরে বিকেলে রাতের রান্না করে।
দুজন মিলে নির্ঝঞ্ঝাট সংসার চালায়।
কারো প্রতি কারো কোনো অভিযোগ নেই,কেউ কাউকে নিয়ে আক্ষেপ প্রকাশ করে না।

ধ্রুব একটা দুই রুমের বাসা খুঁজতে লাগলো মা’কে নিয়ে আসার জন্য।বাসা পেতে প্রায় ৬-৭ দিন লেগে গেলো। তারপর একদিন শুক্রবারে বাসা চেঞ্জ করে ফেললো।
নতুন বাসাটায় দুটো বেড রুম,একটা ডাইনিং রুম,দুটো ওয়াশরুম,একটা কিচেন রুম।মায়ের রুমটা ধ্রুব নিজ হাতে সাজালো।একটা নতুন খাট,আরামদায়ক বিছানা, দেয়ালে কিছু পেইন্টিং।জানালায় সাদা আর নীলের পর্দা।রুমে একটা টিভি আনলো মায়ের জন্য। একটা রকিং চেয়ার রাখলো বারান্দায় মায়ের জন্য।
এটাচড বাথরুম দেওয়া রুমটা মায়ের জন্য রাখলো।

ঠিক করলো, খুব দ্রুত একটা এসি কিনে নিবে মায়ের রুমের জন্য।মায়ের যাতে কোনো কষ্ট না হয়।

সব শালুকের ভীষণ ভালো লাগছে।চাচীকে নিয়ে এলে শালুকের আর একা একা লাগবে না ধ্রুব না আসা পর্যন্ত এটাই শালুকের জন্য আনন্দদায়ক। ধ্রুব অফিস থেকে ছুটি চাইলো,কিন্তু ছুটি পেলো না।১ মাস কেটে গেলো এভাবেই কিন্তু ধ্রুব ছুটি পেলো না অফিস থেকে।

রাতে বিষণ্ণ মুখে ধ্রুবকে বসে থাকতে দেখে শালুক আদুরে বেড়ালের মতো ধ্রুবর কোলে গিয়ে বসে পড়লো ধ্রুবর গলা জড়িয়ে ধরে। ধ্রুব শালুকের লম্বা চুলে নিজের নাক ডুবিয়ে দিলো।গালের খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি দিয়ে শালুকের গালে মৃদু ঘষতে লাগলো। শালুক বললো, “ছুটি হয় নি এখনো? কবে যাবো আমরা চাচী কে নিয়ে আসতে?”

ধ্রুব মন খারাপ করে বললো, “না,ছুটি দিচ্ছে না তো।নতুন চাকরি এখনই এতো ছুটি দিবে না না-কি। কি করবো বলো তো?”

শালুক কি বলবে বুঝতে পারলো না। শেষে বললো, “ছুটি লাগবে না,চলেন আমরা গিয়ে নিয়ে আসি চাচীকে?”

ধ্রুব হেসে বললো, “পাগল, চাকরি চলে গেলে তোকে নিয়ে সংসার চালাবো কিভাবে?খাবি কি তখন? ”

শালুক ধ্রুবর ঘাড়ে একটা কামড় দিয়ে বললো, “ভালোবাসা খাবো।”

ধ্রুব হেসে ফেললো শালুকের কথা শুনে। শালুকের চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো, “পড়া শেষ হয় নি কিন্তু তোর এখনো। ফিন্যান্স যেই অংকটা করতে দিয়েছি করেছিস?”

শালুক মুখ ভেংচি কেটে বললো, “এরকম একটা রোমান্টিক সময়ে আপনার পড়ালেখার কথা না আনলে কি শান্তি লাগে না? কোথায় একটু রোমান্স করার মুড নিয়ে বসেছি আপনার কাছে আর আপনি বলছেন পড়ার কথা? ”

ধ্রুব কোলে করে শালুককে চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে বললো, “হ্যাঁ বলছি,যাও এবার পড়া শেষ করো।এখন পড়ার সময় তোমার। ”

শালুকের রাগ হলো খুব।মুখ ভেংচি দিয়ে পড়ায় মনোযোগ দিলো।ধ্রুব মুচকি হাসতে লাগলো। এই তার শালুক,তার স্ত্রী শালুক। কেমন যেনো কলিজা ছিড়ে যাবার মতো অনুভূতি হচ্ছে তার। যদি শালুককে না পেতো ধ্রুব,তাহলে কি করতো সে?

এসব ভাবতে ভাবতে ধ্রুব খাবার গরম করতে গেলো। খাবার গরম করতে গিয়ে ধ্রুবর মনে হলো, আসার সময় নানাবাড়ির ফোন নাম্বার নিয়ে আসা উচিত ছিলো। তাহলে যোগাযোগ করতে পারতো।
এসব ভাবতে ভাবতেই ধ্রুব সব গরম করে নিলো।তারপর শালুকের পড়া বুঝে নিয়ে খেতে বসলো দুজনে।

বাকি রাত ধ্রুবর খুব ছটফটিয়ে কাটলো। ধ্রুবর ছটফটানি লক্ষ্য করে শালুক উঠে বসলো বিছানায়। রুমের লাইট অন করে দিয়ে ধ্রুবকে পানি এনে দিলো।তারপর জিজ্ঞেস করলো, “কি হয়েছে আপনার? ”

ধ্রুবর চোখমুখ শুকিয়ে গেছে, চেহারা কেমন বিবর্ণ।ধরা গলায় ধ্রুব বললো, “আমার ভালো লাগছে না শালুক।কেমন যেনো লাগছে।বারবার ছোট বেলার সব স্মৃতি ভেসে আসছে চোখের সামনে। স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি মা আমাকে ঘুম পাড়ানি গান শোনাচ্ছে যেনো। পুকুর ঘাটে নিয়ে সাবান দিয়ে আমাকে গোসল করিয়ে দিচ্ছে।”

শালুক বললো, “আপনি কেনো সবসময় এসব কথা ভাবেন বলেন তো?কষ্টের স্মৃতি মনে করলে কষ্ট বাড়বে,কমবে না।”

ধ্রুব হেসে বললো, “আমার সুখ তো আমার পাশেই আছে শালুক, সে পাশে থাকলে এই কষ্ট সহ্য করা কোনো ব্যাপার না। তবুও আজ কেনো এমন লাগছে জানি না।”

বাকি রাত আর দুজন ঘুমালো না।সকাল হতেই ধ্রুব বললো, “শালুক,চলো বাড়িতে যাই।”

শালুক অবাক হয়ে গেলো ধ্রুবর কথা শুনে। তারপর আনন্দে চিৎকার করে বললো, “আমি তো এক পায়ে খাঁড়া। ”

দুজনে ব্যাগ গুছিয়ে নিয়ে সকাল ১০ টার বাসে উঠলো।ভাগ্য বিরূপ হলো,পথে বাস নষ্ট হয়ে গেলো। ধ্রুবর কেমন অসহ্য লাগতে লাগলো। বুকের ভেতর চিনচিনে ব্যথা জানান দিচ্ছে কিছু একটা হয়েছে কোনো আপন কারো।
অস্থির হয়ে ধ্রুব পায়চারি করতে লাগলো। শালুক অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো ধ্রুবর দিকে।
কি হয়েছে এই মানুষটার?এতো অস্থির কেনো আজ সে?

বাস ঠিক হতে প্রায় আড়াই ঘন্টা লেগে গেলো। ১০ টার বাসে উঠে বাড়ি পৌঁছাতে পৌঁছাতে সন্ধ্যা ৬ টা বেজে গেলো।
সারা বাড়ি কেমন নিরব হয়ে আছে আজ।বাহিরে থেকেই ধ্রুবর কলিজা মোচড় দিয়ে উঠলো। বাগানের মধ্যে দাঁড়িয়ে ধ্রুব বললো, “আমি ভেতরে যাবো না শালুক,তুমি যাও।আমার মন বলছে খারাপ কিছু ঘটেছে। ”

শালুক নিজেও ভেবে পাচ্ছে না ধ্রুবর এই অস্বাভাবিক আচরণ করার মানে কি!
ধ্রুবর হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলো ভেতরে। সবাই ড্রয়িং রুমে বসে আছে,আদনানের মা আর শালুকের মা কাঁদছে।

ধ্রুব ভেতরে প্রবেশ করতেই হাসনা বেগম ছুটে এসে ধ্রুবকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলো। শালুক কিছু বুঝতে পারছে না। এগিয়ে গিয়ে বড় চাচীর পাশে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো, “কি হয়েছে বড় চাচী?”

আদিবা বেগম চোখের পানি মুছে বললেন,”দেরি হয়ে গেছে রে মা।অনেক দেরি হয়ে গেছে। দীপালি চলে গেছে ফাঁকি দিয়ে। ”

শালুকের হাত থেকে ব্যাগটা পড়ে গেলো। ধ্রুব ফ্লোরে বসে বললো, “কি হয়েছে চাচী?আমাকে বলো আগে?আমার যে অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে বুকে চাচী।”

হাসনা বেগম ধ্রুবর পাশে লেপটে বসে বললেন,”ও বাবা,সেই পাষাণী যে চলে গেলো এই দুনিয়া থেকে। তোর যে তাকে ঢাকায় নিয়ে যেতে হবে না আর।তার চিকিৎসা করার ঝামেলা আর নেই রে বাবা।সে যে চলে গেছে কাল রাতেই।”

ধ্রুবর মনে হলো সারা পৃথিবী বুঝি কাঁপছে চোখের সামনে। সব কেমন ঝাপসা লাগছে।অস্ফুটস্বরে ধ্রুব শালুককে ডাকলো। শালুক ছুটে এলো ধ্রুবর কাছে।শালুকের কোলেই ধ্রুব জ্ঞান হারিয়ে পড়ে গেলো।

চোখ খুলে তাকালো অনেক ক্ষণ পরে।রুমে তখন কেউ নেই ধ্রুবর বাবা ছাড়া। ধ্রুবকে শুইয়ে রাখা হয়েছে জহিরের রুমে। ধ্রুব শোয়া থেকে উঠে বসলো। বাবা ছেলে দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে রইলো অপলক।

কেউ কাঁদলো না,কেউ কোনো শব্দ করলো না।কেঁদে গেলো দুজনের হৃদয়, চোখের অশ্রুপাত হলো না,রক্তপাত হলো অন্তরে অন্তরে।

ধ্রুব বললো, “বাবা,মায়ের সাথে আর কি দেখা হবে না এই জনমে?আমার যে তাকে সেই মাউথ অর্গান বাজিয়ে শোনানো বাকি আছে এখনো।
সেই যে ঘুম পাড়ানি গান,যেই গান গেয়ে মা আমাকে ঘুম পাড়াতো, কথা ছিলো তো আমার মুখের সেই গান শুনে এক সময় মা ঘুমাবে।আজ কেনো মা সেই গান না শুনেই ঘুমিয়ে গেলো বাবা?
মা চলে যাওয়ার পর আমার একা ঘুম আসতো না যখন তখন আমি একা একা শুয়ে গাইতাম,তোমায় ছাড়া, ঘুম আসে না মা।
বাবা,এরপর এতো বছর কেটে গেলো, আমি আর মা’কে জড়িয়ে ধরে ঘুমাতে পারি নি। খুব ইচ্ছে ছিলো মা’কে জড়িয়ে ধরে আবারও ঘুমাবো।সেই রাতে মা আমাকে আর শালুককে ঘুম পাড়ানি গান শুনাবে।হলো না তো বাবা,কিছুই হলো না আমার। আমি পারলাম না বাবা মা’কে সুস্থ করার জন্য একটু চেষ্টা করতে।”

সেলিম সাহেব কিছু বলতে পারলেন না। রাতে ধ্রুব গেলো দীপালিদের বাড়িতে। দীপালির বাবা যেনো ধ্রুবর অপেক্ষায় ছিলো। ধ্রুবকে দেখে বের হয়ে এলেন বাহিরে।তারপর ধ্রুবর হাত চেপে ধরে বললেন,”আমার মা তো স্বর্গে চলে গেলো। মা’য়ের প্রাণটা বুঝি তোমাকে একবার চোখের দেখা দেখার জন্য আটকে ছিলো দাদাভাই। সেদিন তুমি চলে যাবার পর মায়ের শরীর আরো খারাপ হতে লাগলো। আমায় ডেকে নিয়ে দিব্যি দিলো যাতে করে তোমাকে কিছু না জানানো হয়।
আমার উপরেই বুঝি অভিমান করে চলে গেলো আমার মা।আমার মায়ের বড় অভিমান ছিলো আমার উপরে। আমার চোখের সামনেই তো আমার সোনার প্রতিমা দিন দিন কংকাল হতে লাগলো। অথচ আমি কিছু করতে পারলাম না।না পারলাম তার চিকিৎসার জন্য শহরে নিতে।আমাকে যে ভয় দেখিয়ে বল তো, জোর করলে নিজের প্রাণ নিজে দিবে।
তোমার জন্য একটা বাক্স রেখে গেছে। ভেতরে আসো।”

ধ্রুব বললো, “না ভেতরে যাবো না। আপনি বাক্স এনে দিন,আমি চলে যাবো।”

বাড়িতে সবাই উদগ্রীব হয়ে বসে আছে ধ্রুবর জন্য। শালুক নিরবে চোখ মুছে নিচ্ছে একটু পর পর। শালুকের ইচ্ছে করছে ছুটে গিয়ে ধ্রুবকে খুঁজে আনতে।কোথায় গেলো ধ্রুব!কেনো এখনো ফিরছে না বাড়িতে!
চিন্তিত বাড়ির প্রতিটি মানুষ। আফিফা,নয়না এসে চলে এসেছে বাবার বাড়ি ধ্রুবর মায়ের মৃত্যু সংবাদ শুনে।
বসার ঘরে সবার মধ্যে অস্থিরতা।

ধ্রুব বাড়িতে এলো রাত এগারোটা নাগাদ।হাতে একটা কাঠের চৌকোনা বাক্স।শালুকের হাতে বাক্সটা দিয়ে বললো,”আমার মা আমার জন্য শেষ স্মৃতি চিহ্ন রেখে গেছে শালুক। ”

সবার সামনে ধ্রুব বাক্স খুললো।ছোট একটা চিরকুট ভেতরে।

মুক্তোর মতো হাতের লিখা,তবে লাইনগুলো আঁকাবাঁকা। ধ্রুব বুঝলো ভীষণ কষ্ট হয়েছে মায়ের এই চিঠি লিখতে। ধ্রুব পড়তে লাগলো,
“আমার নাড়িছেঁড়া ধন!
কতো বছর পর আজ তোমায় দেখলাম।ভালো করে নয়ন ভরে দেখে নিয়েছি আজ।ভেবেছিলাম পরাণ জুড়িয়েছে এবার তোমায় দেখে।কিন্তু তুমি চলে যাবার পর বুঝলাম তোমায় দেখার তেষ্টা আমার এক মহাসাগরের সমান,সেখানে এই টুকু দেখায় কিছুই হয় নি।
ভেবেছিলাম এই জনমে হয়তো ঈশ্বর আমার ডাক শুনবে না,পাপের শাস্তি হিসেবে তোমাকে শেষ বার আর দেখাবে না।কিন্তু ঈশ্বর এই অভাগীর প্রতি অতটা ও নিষ্ঠুর হন নি।তাই হয়তো একবার দেখিয়েছেন। আজ তোমায় দেখার পর এই প্রথম বারের মতো মনে হলো আমি আর বেশি দিন নেই।

আমার প্রতি তোমার অনেক অভিমান আছে জানি।যাবার আগে তোমাকে কিছু দিয়ে যাবার ভীষণ ইচ্ছে ছিলো। এই বাক্সটার উপরের এই কাঠের পাটাতন হালকা চাপ দিলেই খুলে যাবে।নিচে তোমার জন্য আমার পক্ষ থেকে একটা ছোট উপহার রেখে যাচ্ছি। গ্রহণ করো যদি আমাকে ক্ষমা করে থাকো,যদি না গ্রহণ করো তবে জানবো আমাকে মা বলে মানতে পারছো না।আর হয়তো শেষ দেখা হবে না।সেলিম সাহেবকে বলে দিও,এই হতভাগিনী তাকে মন থেকে ভালবেসেছিলো কোনো এক দিন।ভালো থেকো সবাইকে নিয়ে। ”

উপরের পাটাতন খুলে ধ্রুব ভেতরে একটা খম পেলো।খামের ভেতর একটা চেক বই,একটা ইস্যু করা চেকের পাতা আর এক টুকরো কাগজ পেলো।৫০ লক্ষ টাকার একটা চেক। কাগজে লিখা, “এই টাকার মালিক ধ্রুব।আমার নামে কেনা জমি বিক্রির এই টাকার মালিক আমার একমাত্র ছেলে ধ্রুব।”

ধ্রুব ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো সবার দিকে।তারপর চিৎকার করে কেঁদে বললো, “এই সব কিছু তোমরা নিয়ে যাও,আমার মা’কে এনে দাও আর একটা বার।আমি একটু মন ভরে মা বলে ডাকি।আমার এখনো মা বলে ডাকার তৃষ্ণা মেটে নি।আমার মা কই?
কেনো বারবার আমাকে এভাবে ফাঁকি দিয়ে যায় আমার মা?
আমি একবার তাকে হারিয়ে নিজেকে সামলে নিতে পেরেছি।এখন আবারও তাকে পেয়ে যে আজীবনের জন্য হারালাম,আর কিসের বিনিময়ে তাকে পাবো আমি?”
সেলিম সাহেবের দুই পা জড়িয়ে ধরে বললো, “আমার মা’কে এনে দাও বাবা।একটা বারের জন্য এনে দাও।আমি আর একটা বার তাকে মা বলতে চাই।আমার আর কিছু চাই না।একবার মা’কে ডাকতে চাই।”

শালুক তাকিয়ে দেখতে লাগলো ইস্পাত-দৃঢ় একটা হৃদয় কেমন ক্ষত-বিক্ষত আজ!
পাষাণ হৃদয়ে মা’য়ের জন্য কতো লুকানো ভালোবাসা!
শত আঘাতে না কাঁদা মানুষটার দুই চোখে কত জল!

চলবে……

রাজিয়া রহমান
চলবে…….

রাজিয়া রহমান
চলবে…..

রাজিয়া রহমান

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here