#শিমুল_ফুল
#৪৩
#জাকিয়া_সুলতানা_ঝুমুর
শিমুল চোখ বন্ধ করে ব্রিজের গায়ে হেলে দাঁড়ায়।সে কি ভাবছে এসব?ম/রে যাবে!ম/রে গেলে তার পুষ্পটা কই যাবে?শিমুলকে হারিয়ে পা/গল হয়ে যাবে না?পা/গল মেয়ে আরো উল্টাপাল্টা কিছু করলেও অবাক হওয়া যাবে না।যাকে নিয়ে এতো আয়োজন সেই যদি ছন্নছাড়া পা/গল রূপ ধারণ তাহলে কিভাবে হবে?আর সবচেয়ে বড়ো কথা এমন কিছু করলে শিমুল প্রেমিক হিসেবে ব্যর্থ হয়ে যাবে না?তার বাবা জিতে যাবে না?ধুর পা/গলের মতো কি সব ভাবছে!সে ম/রবে কেন?সে তো বাঁচতে চায় হাজার বছর পুষ্পর মিষ্টি মুখের দিকে তাকিয়ে হাসতে চায়।অনেকদিন পরে আঙুলের ভাজে সিগারেট ধরে।অর্থ সংকটে পড়ার পরে এই বাড়তি খরচটা আপনা-আপনিই কমে গেছে কি দরকার একটা সিগারেট খেয়ে ষোল টাকা আগুনে পো/ড়াবার!নিজের দিকে তাকালে এখন শিমুলের অবাক লাগে কতো বদলে গেছে সে?সিগারেট খেয়ে মুখে চকলেট দিয়ে বাসার পথে হাটে।
রোকসানা বিছানায় শুয়ে কাঁদছে।তার মেয়ে আর মেয়ে জামাইটা না খেয়েই চলে গেলো।বুকটা এতো পু/ড়ছে!হঠাৎ করে শিমুল গার্মেন্টসে কাজ করে শুনে মাথা ঠিক ছিলো না বিধায় কয়েকটা কটু কথা না হয় পুষ্পকে বলে ফেলেছে।এখন বুঝতে পারছে এমন করে বলা ঠিক হয়নি।আর কেউ না জানুক তারা তো জানে শিমুল কেমন ঘরের ছেলে!বসে বসে খেলেও তার বাবার সম্পদ কমবে না আর সে কিনা গার্মেন্টসে কাজ করছে!কার জন্য করছে তাদের মেয়ের জন্যই তো।পুষ্পকে ভালো রাখতেই তো ছেলেটা নিজের আত্মসম্মান বাজি রেখে সব করছে।কিন্তু উনারা রা/গের মাথায় যা তা বলে দুজনকে অপমান করলেন।মিজান এই নিয়ে অনেকবার পুষ্পর মোবাইলে ফোন দেয় কিন্তু বারবার বন্ধ বলে।উনারা মনে করে হয়তো মোবাইল বন্ধ করে রেখেছে কিন্তু কেউ জানতে পারলো না পুষ্পরা ফোনটা বিক্রি করেই মুন্নীকে দেখতে এসেছিলো।মেয়ের শশুড় বাড়ি বিধায় রোকসানা শব্দ করে কাঁদছে না।মিজান স্তব্ধ হয়ে পাশে বসে আছে।রোকসানাকে সান্ত্বনা দেয়ার ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না।মেয়ের এই অবস্থায় তারও যে খারাপ লাগছে।
শুক্রবার রাতে পুষ্পর শরীর খা/রাপ করে।শিমুল ফার্মেসী থেকে ওষুধ এনে দেয়।সকালে শিমুল আর পুষ্পকে রান্না করতে জাগায় না।কাজে যাওয়ার সময় হলে রাতের থাকা খাবারগুলো গরম করে নিজে না খেয়ে রেখে দেয়।যে খাবারটা আছে এতে পুষ্প সকালে আর দুপুরে খেতে পারবে। এখন যদি শিমুল খায় তাহলে পুষ্প দুপুরে খেতে পাবেনা।আর পুষ্প এই অসুস্থ শরীর নিয়ে রান্নাও করবেনা খাবেওনা।তার মনের ভাব সে দোকান থেকে কিছু একটা খেয়ে নিবে।যাওয়ার আগে পুষ্পকে জাগিয়ে দিয়ে যায়।শিমুল দোকান থেকে বন,কলা আর চা খেয়ে কাজে যায়।তার কপালে কি আছে শিমুলের জানা নেই।মিরাজ সাহেব কি তাকে কাজ থেকে বাদ দিয়ে দেবে?ভাবতে ভাবতে শিমুল কাজ করে।ম্যানেজারের কাছে শুনে মিরাজ স্যার আসেনি।শিমুলের মনে কু ডাকে।যদি বাদ দিয়ে দেয়?তাহলে আরেকটা কাজ কই থেকে যোগার করবে?এতো লেখাপড়া করে কি লাভ হলো?একটুও কাজে লাগছেনা।দুপুরে লাঞ্চ আওয়ারে সবাই খাবার খাচ্ছে।শিমুল চুপচাপ টুলে বসে আছে।পেটে এতো ক্ষুধা লেগেছে যে মাথা ঝিমঝিম করছে।এতো বড়ো দিন বন কলা খেয়ে থাকা যায়?শিমুল পেটে ব্যাথা অনুভব করে।তার ভাত খেতে এতো ইচ্ছে করছে মনে হচ্ছে এক বসায় এক গামলা ভাত খেয়ে ফেলতে পারবে।সে মানিব্যাগ বের করে কতো টাকা আছে দেখে,অল্প টাকা আছে।তারপর ধীর পায়ে উঠে রাস্তার পাশে সস্তা একটা হোটেলে ঢুকে।হোটেলে গরুর মাংসের ঘ্রাণে ম ম করছে।শিমুলের মন চায় গরুর মাংস দিয়ে ভাত খেতে,গরুর মাংস যে তার খুব প্রিয়।কিন্তু পকেটে টাকা কম,মাংস খেলে টাকা বেশী লাগবে বাসায় পুষ্পটা একা তাকে ছাড়া মাংস খাওয়ার প্রশ্নই আসে না।চোখ বন্ধ করে নিজের ইচ্ছাকে মাটিচাপা দিয়ে ডিম তরকারি,ডাল আর ভাত নেয়।টেবিলে খাবার আসলে গ্রোগ্রাসে গিলতে থাকে।ক্ষুধায় তাড়াহুড়ো করে খেতে গিয়ে গলায় খাবার আটকে কাশি চলে আসে।সামনে থেকে কেউ একজন পানির গ্লাস এগিয়ে দেয়।শিমুল পানি খায়।সামনের লোকটা বলে,
“এতো তাড়া কিসের শিমুল?আস্তে খাও।”
শিমুল হাতের গ্লাস টেবিলে রেখে অবাক হয়ে সামনের মানুষটার দিকে তাকিয়ে থাকে।তার প্রাক্তন ভার্সিটির প্রিন্সিপাল সালাম হক।শিমুল ভালো ছাত্র ছিলো বিধায় ভার্সিটিতে তার কদর ছিলো আলাদা।সালাম হক শিমুলকে সবসময় অন্যচোখে দেখতেন।বাবার থেকে কোনো অংশে কম ভালোবাসেন না এই স্যার।কিন্তু শিমুলের জানামতে স্যারের টাকার অভাব নেই তাহলে এই সস্তা হোটেলে স্যার কি করছে?সে সালাম হককে এই স্থানে আশা করেনি।অবিশ্বাস্য গলায় বললো,
“স্যার!আপনি?”
সালাম হক হাসে।শিমুলের দিকে তাকিয়ে বলে,
“খাওয়া শেষ করো মাই বয়।খাওয়ার মাঝে কথা বলা ভালো কাজ নয়।”
শিমুল অপ্রস্তুত ভাবে ডিমের কুসুম মুখে দেয়।সালাম হক চোখ ভুলিয়ে হোটেলটা দেখে,এখনো প্রায় সময়ই তিনি এই হোটেলে খাবার খেতে চলে আসে।শিমুলের অবস্থা দেখে,কাপড়-চোপড়ের নমুনা দেখে তার অভিজ্ঞ চোখ পরিস্থিতি বেশ টের পাচ্ছেন।নিজের অতীতের সুন্দর সময়ের কথা মনে পড়ে যায়।তার স্ত্রী সাহিদাকে নিয়ে ঢাকায় আসার পরে কি কষ্টে দুজন দিন কাটিয়েছে।একটা রড ফ্যাক্টোরীতে কাজ করে দিন কাটিয়েছে।প্রায়ই এই হোটেলে ভাত খেতো তাই তো এখনো মাঝেমধ্যে এখানে খেতে আসে।সালাম হকের মনে হয় দামী দামী রেস্টুরেন্টে খেয়েও এমন শান্তি লাগে না যতোটা এই হোটেলে খেয়ে লাগে।ভার্সিটিতে পড়ে পাশ করার পরে তখনকার স্যাররা তাকে ভার্সিটিতেই চাকরি দেয়।সেই থেকে সালাম হকের দিন ঘুরে।আজ সে এই ভার্সিটির প্রিন্সিপাল।কতো টাকা,বাড়ি,গাড়ি হয়েছে কিন্তু অতীতের কথা মনে হলেই বুকে চিনচিন করে ব্যা/থা করে উঠে।শিমুল খাওয়া শেষ করে।তার কেন জানি স্যারের দিকে তাকাতে ল/জ্জা লাগছে।সালাম হক ওয়েটারকে ডেকে দধি অর্ডার করে।দধি আসলে খেতে খেতে বলে,
“বুঝলে শিমুল।এটা হলো আমার প্রিয় হোটেল।এই হোটেলের ডাল,আলুর ভর্তা,শুটকির ভর্তা,সবজি সব আমার প্রিয় খাবার।”
স্যারের কথায় কি বলা যায় শিমুল খুঁজে পায় না।প্রতিউত্তরে একটু হাসার চেষ্টা করে।সালাম হক নিজেই বলে,
“তুমি এখানে যে?”
শিমুল দ্বীধায় পরে যায়।গার্মেন্টসের কথা বলা উচিৎ কিনা বুঝতে পারছেনা।মাথা চুলকে বললো,
“স্যার!কাজ করি।”
সালাম হক শিমুলের মনের ভাব বুঝতে পারেন।তিনি খুব স্বাভাবিক ভাবেই বললেন,
“কোন গার্মেন্টসে?”
শিমুল থমকায়।লজ্জায় মাটির নিচে ঢুকে যেতে ইচ্ছে করছে।স্যার বুঝে গেছে!এই স্যারই শিমুলকে লেকচারার হিসেবে ভার্সিটিতে জয়েন করার কথা বলেছিলো তখন শওকত হাওলাদারের কথায় সব ছেড়েছুড়ে চলে গিয়েছিলো।সে মাথা নিচু করে টেবিলে থাকা সস্তা টিস্যু পেকেটের দিকে তাকিয়ে থাকে।সালাম হক শিমুলের লজ্জা মাখা মুখ দেখে বললো,
“সামনের গলির পরে যে রড ফ্যাক্টরি টা আছেনা?আগে আমি ওটায় কাজ করতাম।যা টাকা পেতাম তা দিয়ে নিজের পড়া চালাতাম আর তোমাদের ম্যাডামকে নিয়ে থাকতাম।”
স্যারের বলা কথাগুলো শুনে শিমুল অবাক হয়ে তাকায়।স্যারের বর্তমানে যা অবস্থা কেউ কখনো কল্পনাও করতে পারবেনা স্যার রড ফ্যাক্টরিতে কাজ করেছে।শিমুলও ভাবতো না যদি না স্যার নিজের মুখে না বলতেন।শিমুল আস্তে করে বললো,
“সামনের গার্মেন্টসে।”
সালাম হক বললো,
“তুমি লজ্জা পাচ্ছ নাকি?আরে লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই।হোচট না খেলে জায়গা চিনবে কিভাবে?এই যে সময়টা কাটাচ্ছো একসময় গিয়ে মনে হবে জীবনের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ সময় এটা।এই সময়টা থেকে অনেক কিছু শিখার আছে।জীবনে প্রতিটা পদে পদে এই সময়টার কথা মনে হবে আর তুমি শক্তি পাবে।”
স্যারের কথায় শিমুল সহজ হয়।অল্পবিস্তর কথা স্যারকে খুলে বলে।দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
“অনেক চাকরির জন্য চেষ্টা করেছি এখনো করছি।কিন্তু হচ্ছে না।”
সালাম হক বলেন,
“এখনি ভে/ঙে পড়ছো যে!শক্ত থাকবে দেখবে বি/পদ আসলেও মোকাবিলা করতে কোনো।সমস্যা হবে না।আর এতোদিন হলো,আমাকে একবার স্মরণ করতে।”
শিমুল অকপটে বলে,
“লজ্জায় আপনার কাছে যাইনি।লেকচারার হওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন আর আমি ফিরিয়ে দিয়েছিলাম।”
“লজ্জায় কি জীবন চলছে?নিশ্চয়ই চলছে না।পুরুষদের লজ্জা থাকতে নেই।সমস্যা ঠিক জায়গায় গিয়ে তুলে ধরতে হয় তা না হলে সমাধানের আশা করা বোকামী।”
শিমুল মুগ্ধ চোখে সালাম হকের দিকে তাকিয়ে থাকে।আগেও তিনি শিমুলকে এভাবে বুঝাতেন এখনো বুজাচ্ছেন।সালাম হক মাথা নেড়ে বললো,
“বিকেলে ভার্সিটিতে যাবে।ঠিক আছে।”
শিমুল মাথা নেড়ে সায় দেয়।সালাম হক উঠে দাঁড়ায়।মুচকি হেসে বলে,
“শিমুল তুমি যেভাবে ভাত খেলে তোমাকে দেখে আমার মনে হলো আমি যুবক বয়সের আমাকেই দেখছি।বিকেলে দেখা হচ্ছে তাহলে।”
আস্তে করে উনি বেরিয়ে যায় যাওয়ার আগে বিল দিতে ভুলে না।শিমুল না করলে বাচ্চাদের যেভাবে তার বাবা চোখ রাঙিয়ে না করে ঠিক সেভাবেই না করে।
গার্মেন্টসে ঢুকতে একটু লেট হয়ে যায়।দারোয়ানকে অনেক বুঝিয়ে বেরিয়েছিলো।এখন গিয়ে দেখে মিরাজ সাহেব দারোয়ানকে বকাঝকা করছে।শিমুলকে দেখে ইচ্ছামতো কথা শুনায়।এক পর্যায়ে বলে আর কাজে আসতে হবে না।আসলে সেদিন শিমুল উনার কথার উপর কথা বলেছে আবার বউ নিয়ে নাকের ডগা দিয়ে চলে এসেছে এটা উনার গায়ে লেগেছে।তাইতো শিমুলকে তাড়াতে চাইছে।শিমুল মাথা ধরে যায়।আস্তে করে বেরিয়ে আসে।মনে মনে রাজ্যের যতো বিশ্রী গালি আছে সব উগরে মিরাজের উপরে দেয়।সালাম হকের আদেশ অনুযায়ী হাটতে হাটতে ভার্সিটিতে যায়।সালাম হক যেন শিমুলের অপেক্ষায়ই ছিলো।আসার সাথে সাথে বললো,
“শিমুল!ইংরেজীতে মাস্টার্স করেছো না?”
উনার মনোভাব শিমুল বুঝতে পারে না।বোকার মতো মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলে।
“ইংরেজি পড়াতে পারবেনা?পারবে তো।আমার স্টুডেন্ট আমি জানি না!”
শিমুল এবার উনার কথার মানে বুঝতে পারে।সারা শরীরে এক অজানা উত্তেজনা ছেঁয়ে যায়।চোখের পলক কয়েকবার ফেলে বলল,
“স্যার!”
সালাম হক শিমুলের দিকে না তাকিয়ে ফাইল হাতে নিয়ে বলে,
“শনিবার থেকে জয়েনিং।”
শিমুল অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে থাকে।তারপর খুশীতে সালাম হককে জড়িয়ে ধরে ফেলে ।পরমূহূর্তেই মনে হয় জড়িয়ে ধরাটা বেশী করে ফেলেছে।উনাকে ছেড়ে বলে,
“স্যার।সরি।আসলে…”
শিমুল আর কিছু বলতে পারেনা তার গলা কেঁপে উঠে।সালাম হক কাধে হাত রেখে বললো,
“সমস্যা নেই।যাও বাসায় যাও।”
বাসায় আসার বাকিটা পথ শিমুল পারেনা উঁড়ে উঁড়ে চলে আসে।গলিতে এসে এক প্রকার দৌড়ে বাসায় গিয়ে ঢুকে।পুষ্প কিছু বুঝে উঠার আগেই শিমুল পুরুষালি গলায় চিৎকার করে উঠে।পুষ্প ভ/য় পেয়ে যায়।শিমুলের চিৎকারে তার হাত পা কাঁপে।শিমুল এসবে তোয়াক্কা করে না।পুষ্পকে পাজকোলা নিয়ে ঘুরতে ঘুরতে বলে,
“বউরে,চাকরি তো হয়ে গেছে রে বউ।”
চলবে…..
❝আমার লিখা গল্পটা অনেকের কাছে বানোয়াট মনে হতে পারে।আসলে আমরা যারা এই অবস্থানে যাই না তারা কখনো এমন পরিস্থিতির খবরও জানি না।।হ্যাঁ যারা বলেন বানো/য়াট তারা এদিকে এসে শুনেন,যা রটে তার কিছু হলেও ঘটে।❞