শিশির ভেজা রোদ্দুর পর্ব -৫৩+৫৪

#শিশির_ভেজা_রোদ্দুর
#Part_53
#Writer_NOVA

সকালবেলা সারা ছাদে এদিক থেকে ঐদিকে পায়চারি করছি। গতরাতে যা শুনেছি তাতে আমার রাতের ঘুম হারাম হয়ে গেছে। সকালবেলা থেকে মাথাব্যথা উঠে গেছে। তাতেও আমার এখন ভ্রুক্ষেপ নেই। মাথাব্যথার থেকে বেশি টেনশন আমাকে ঘিরে ধরেছে। কাপের বদলে কড়া লিকারের এক মগ চা খেয়েছি। কপালে এক হাত দিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে আছি। কি করবো, কি হবে, কোথায় যাবো? কিছু বুঝতে পারছি না।

— বউ!

— ও ভাবী কি করো?

দুই পুঁচকের সুর পেয়ে নিজের কপালে জোরে একটা চাপর মারলাম। এমনি আমি টেনশনে শেষ। এই দুটো এসেছে আমাকে আরো জ্বালাতে। চোখ দুটো ছোট ছোট করে ওদের দিকে তাকালাম। দুজন মুখে শয়তানি হাসি রেখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।

— এই তোরা এখানে কি করিস? সকালে ওঠে পড়াশোনা না করে ছাদে কি তোদের?

— তুমি কাকে বলো ভাবী? তুমি নিজেও তো পড়াশোনা না করে ছাদে ঘুরছো। আমাদের বলো কেন?

— এই সিফাত একদম মুখে মুখে কথা বলবি না। নয়তো অনেক খারাপ হয়ে যাবে কিন্তু।

আমাকে রাগতে দেখে ইফাত মিষ্টি সুরে বললো,
— রাগো কেন বউ? সামনে বার্ষিক পরীক্ষা বলে কি আমরা তোমাকে আগের মতো ডিস্টার্ব করি বলো তো? তুমি জানো আব্বু কি বলছে?

— যা বলার বলছে। এখন আমার সামনে থেকে যা তো। তোদের সাথে ফালতু পেচাল পারার সময় নেই আমার। মাথা টেনশনে ফেটে যাচ্ছে আমার। এর মধ্যে এরা এসেছে ঢং-এর পেচাল নিয়ে।

— বউ শুনো না। আব্বু কি বলছে একটু শুনো?

মুখটাকে বাংলা পাঁচের মতো করে ইফাতের দিকে তাকালাম। তারপর কাঠ কাঠ গলায় বললাম,

— হুম বল।

আমি অনুমতি দেওয়ায় ইফাত খুশি হয়ে গেলো। আমার সামনে এসে খুশিতে গদগদ হয়ে বললো,

—আব্বু বলছে বার্ষিক পরীক্ষায় আমি যদি প্রথম হই তাহলে তোমার সাথে আমাকে বিয়ে দিয়ে দিবে। তুমি আমার বউ হয়ে যাবে। নুবা শুধু ইফাতের।

— আমার নাম নোভা নট নুবা🤦‍♀️।

— কি হলো বউ?

— ইফাত এদিকে আয়।

— পাপ্পি দিবা?

আমি রেগে বললাম,
— তুই আগে এদিকে আয়।

— না, তুমি মারবা।

— ঐ কোণার থেকে ইটটা নিয়ে আয়। তারপর জোরে একটা আমার মাথায় বারি দে। আমি মইরা যাই। ভাই আমি বাঁইচা আছি কেন? আমারে মাইরা ফালা।এতো ঝামেলা ভালো লাগে না।

— তুমি এসব কি বলো বউ🥺?

— আরেকবার বউ বললে আমার মাথায় আমি নিজেই ইট দিয়ে বারি দিবো। আমি আর বেঁচে থাকতে চাই না। এত জ্বালা ভালো লাগে না আমার।

সিফাত মুখ আটকিয়ে হেসে বললো,
— তুমি মরে গেলে আমার ভাইয়ের কি হবে ভাবী?

— ভালো চাইলে চোখের সামনে থেকে সর তো। আমার এত জ্বালাযন্ত্রণা ভালো লাগে না। আমাকে একটু শান্তি দে তো তোরা। আমি হাতজোড় করছি একটু শান্তি দে।

ইফাত আমার সামনে এসে চোখ দুটো টলমল করে বললো,

— এসব কথা বলো না। আমি তোমাকে অনেক ভালবাসি। তুমি ছাড়া আমি বাঁচমু না।

— তোর ভালুপাসার গুষ্টি কিলাই। দূর হো সামনে থেকে। নয়তো তোদের মেরে আমি জেল খাটবো।

সিফাত মুখটাকে সিরিয়াস ভঙ্গি করে বললো,
— কি হয়েছে বলো তো ভাবী? তোমাকে আজ অনেক টেনশনে মনে হচ্ছে।

— কিছু হয়নি। তোর আম্মুর শরীর কেমন? হসপিটাল থেকে আসছে?

— আম্মু ভালো আছে ভাবী। আম্মু আর বাবু দুজনেই ভালো আছে। তাই ১৫ দিন পর যেতে বলছে।

— আলহামদুলিল্লাহ।

ইফাত নাক টেনে চোখের কোণে আসা পানি মুছে কাঁদো কাঁদো ফেস করে বললো,

— তোমার কি হইছে বউ? বলো না তোমার কি হইছে? তোমারে কেউ কিছু বললে আমাকে বলো। আমি তার খবর নিয়ে ফেলবো।

— হইছে থাম তুই। দুই আনার মানুষ বারো আনার ডায়লগ দিতে হবে না। এখন দয়া করে আমার সামনে থেকে একটু যা। আমাকে একা থাকতে দে।

সিফাত কনুই দিয়ে ইফাতকে খোঁচা মেরে ফিসফিস করে বললো,

— ভাবীর মুড ভালো না ভাইয়া। চলো এখান থেকে চলে যাই। নয়তো ধাওয়া দিবে। তুমি তো খাবেই সাথে আমাকেও খাওয়াবা।

ইফাত জোর গলায় বললো,
— আমার বউকে ছেড়ে আমি কোথাও যাবো না।

আমি কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করলাম,
— সত্যি তুই এখন যাবি না?

— না যাবো না।

— ভালো করে জিজ্ঞেস করছি যাবি কিনা বল?

— যাবো না।

— তুই যাবি না তোর ঘাড়েসুদ্ধ যাবে। তুই শুধু একটু দাঁড়া।

আমি এদিক সেদিক তাকিয়ে ছাদের কোণা থেকে একটা ইট নিয়ে ওদের পেছন ধাওয়া করতেই সিফাত, ইফাতকে টেনে দরজা দিকে দৌড়ালো। আমি একবার ইটের দিকে তাকিয়ে মৃদু করে আমার কপালে দুটো বারি দিলাম। ঠাটিয়ে দুটো দিয়ে যদি নিজের পোড়া কপালটাকে পুরোপুরি ভেঙে ফেলতে পারতাম তাহলে বোধহয় একটু শান্তি পেতাম।

💖💖💖

দুপুরে…..

খাবার টেবিলে গোল হয়ে সবাই বসে আছি। এনাজ, তায়াং ভাইয়া, তন্বী আমি একপাশে বসেছি। আরেকপাশে দাদী, খালামণি বসেছে। এনাজ জোহরের নামাজের পর এখানে চলে এসেছে। আমি খাবার না খেয়ে প্লেটে আঁকিবুঁকি করছি। আসলে খাবার আমার গলা দিয়ে নামছে না। খালামণি তা খেয়াল করে বললো,

— কি রে তোর কি হয়েছে? তুই খাচ্ছিস না কেন?

আমি কিছুটা থতমত খেয়ে বললাম,
— কই খালামণি? আমি তো খাচ্ছি। তুমি খেয়াল করোনি।

— দেখছি তো কি খাচ্ছিস!

দাদী গ্লাসে পানি ঢেলে কিছুটা পানি খেয়ে বললো,
— নাতনী বিয়ের চিন্তায় খাওয়া ভুলে গেছে। আরে চিন্তা করো না সতিন তার ব্যবস্থা করে ফেলছি।

আমি চমকে তার দিকে তাকাতেই আমার সাথে সাথে তন্বী, তায়াং ভাইয়া ও এনাজও তাকালো। তন্বী ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,

— কি বলছো তুমি দাদী?

— ওহ তুই তো কিছু জানিসই না তনিমা। দাঁড়া আমি সবাইকে বলছি।

এনাজ আমার দিকে বিস্মিত চোখে তাকালো। আমি জোর করে মুখে হাসি টেনে নিচের দিকে নজর দিলাম। তায়াং ভাইয়া বললো,

— কি এমন কথা গো ডার্লিং?

— বলছি, বলছি।

এনাজ চোখে, মুখে বিস্ময়ভাব রেখে দাদীকে বললো,
— মনে হচ্ছে খুব সিরায়াস কথা।

— অনেকটা তাই গো আমার দুই নাম্বার জামাই।

আমি ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে চুপ করে রইলাম। দাদী কথাটা বলার পর যে কি হবে তা আল্লাহ মালুম। আমার হাত-পা কাঁপা-কাঁপি শুরু হয়ে গেছে। একবার তায়াং ভাইয়ার মুখের দিকে আরেকবার এনাজের মুখের দিকে তাকালাম। দাদী কিছু সময় থেমে বললো,

— তানভীরের সাথে আমি নোভার বিয়ে দিতে চাই। বাঁচবো আর কয়দিন। তাই বড় নাতীর বিয়েটা তাড়াতাড়ি দিবো। যাতে তোদের ঘরের ছেলে-মেয়ে দেখেই মরতে পারি।

আমি তায়াং ভাইয়া ও এনাজের রিয়েকশন দেখার জন্য তাদের দিকে তাকালাম। দুজনের মুখ নিমিষেই রাগে লালবর্ণ ধারণ করলো। আমি জানতাম এমন কিছুই হবে। গতকাল রাতে তো আমি এই কথা শুনেই কোমায় যেতে যেতে ফিরে এসেছি। গতকাল রাতে তাদের ডাকতে গিয়ে আমি রুমের সামনে গিয়ে আমার ও তায়াং ভাইয়ার বিয়ের কথা বলতে শুনেছি। কিন্তু এখন কি হবে? দাদী আবার বললেন,

— নোভার বাবা-মায়ের সাথে সকালে কথা বলা আমার শেষ। তারা দু-একদিনের মধ্যে আসবে। তারা আসলে ঘরোয়াভাবে এই সপ্তাহেই দুজনকে বিয়ের সুতোয় বেঁধে দিবো। তারপর না হয় নোভার পড়ালেখা শেষে বড় করে অনুষ্ঠান করে উঠিয়ে আনবো।

তায়াং ভাইয়া জোরে চেয়ার টেনে উঠে বেসিনের কাছে চলে গেল। হাত ধুয়ে এক মিনিটও দেরী করলো না। নিজের রুমে চলে গেল। এনাজও খাবার ছেড়ে উঠে গেলো। হাত ধুয়ে গটগট পায়ে বাসার বাইরে চলে গেল। দাদী, খালামণি একে অপরের দিকে তাকিয়ে দুজনের যাওয়ার পানে অবাকভাবে তাকিয়ে রইলো।
দাদী বললো,

— কি হলো তানভীরের মা?

— আমিও তো বুঝলাম না মা।

তন্বী বিস্মিত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আর আমি এক দৃষ্টিতে সামনের পানির জগের দিকে তাকিয়ে রইলাম। এমনটাই হওয়ার ছিলো। একটু পর ভাইয়ার রুম থেকে ভাংচুরের শব্দ আসবে। আর আমার ওপর দিয়ে একটা বিশাল ঝড় যাবে।তন্বী আমাকে খোঁচা মেরে মিনমিন করে বললো,

— কি হচ্ছে এসব নোভাপু?

আমি ওর দিকে মলিন চোখে তাকিয়ে বড় করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম। মাথা আমার ভনভন করে ঘুরছে। চোখ মুখে অন্ধকার দেখছি। আমি বোধহয় এই যাত্রায় পটল তুলবো। এরপরের কাহিনিগুলো এত দ্রুত ঘটলো যে আমি পুরো স্তম্ভ হয়ে রইলাম। চোখের পলকে একেকটা ঘটনা ঘটতে লাগলো। বিয়েটা হলে চারটা জীবন নষ্ট। আমি তো তা হতে দিতে পারি না। কিন্তু বিয়েটা আটকাবো কি করে? এখন নিজের ওপর রাগ হচ্ছে। কেন যে গতকাল বিয়ের জন্য লাফালাম। নিজের কপাল নিজেই পুড়েছি। এখন ভালোই ভালোই বিয়ে ভাঙতে পারলেই আমি বাঁচি।
#শিশির_ভেজা_রোদ্দুর
#Part_54
#Writer_NOVA

সকালবেলা ঘুমের থেকে উঠে ড্রয়িংরুমে আম্মু,আব্বু, ইভাকে দেখে আমার মাথা খারাপ হয়ে গেলো।জল বহুদূর গরিয়ে গেছে। এখন কিছু না করলে আমার কপাল চাপড়াতে হবে। আম্মু আমাকে তার পাশে বসিয়ে বললো,

— কেমন আছিস?

— অনেক ভালো। তোমরা কেমন আছো?

— আলহামদুলিল্লাহ ভালো।

— যাও ফ্রেশ হয়ে আসো। এই ইভু গিয়ে বোরখা খুলে হাত-মুখ ধুয়ে নে।

আব্বু আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,
— কেমন আছিস মা?

— আলহামদুলিল্লাহ ভালো। তুমি কেমন আছো আব্বু?

— আল্লাহর রহমতে আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। মাত্র ঘুমের থেকে উঠলি?

— হ্যাঁ, একটু আগে। তোমরা বসো আমি আসছি। যাও সবাই আগে ফ্রেশ হয়ে নাও।

আম্মু-আব্বু ভেতরের রুমে চলে গেল। ইভা শয়তানি হাসি দিয়ে আমাকে বললো,

— ও মোটু, তোমার বলে বিয়ে।

— ঐ তোকে কে বললো?

— তোমার বিয়ে দিতে আমরা আসলাম। আর তুমি বলো আমাকে কে বললো? তায়াং ভাইয়ার সাথে তোমাকে মানাবে কি করে? যদি মতো তায়াং ভাইয়ার সাথে বিয়ে হয় তাহলে এনাজ ভাইয়ার কি হবে?

এনাজের কথা ইভা জানে। আমি কখনো আমার কোন কথা ওর কাছে লুকোই না। ও মাঝে মাঝে আমায় বড় বোনের মতো সবকিছুতে সাপোর্ট করে,সমস্যার সমাধান খুঁজে দেই। তাই ওর সাথে সব কথা শেয়ার করি।আমি মুখটাকে শুকনো করে ধপ করে সোফায় বসে পরলাম। তারপর ইভার দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললাম,

— কিচ্ছু জানি না। আমার কপালে এবার দুঃখ আছে। নিজের কপাল নিজে ফাটাইছি। এবার জোড়াও আমার লাগাতে হবে। কি যে করবো নিজেও জানি না।

— দাদীতো তাড়াহুড়ো শুরু করছে। আগামীকাল রাতেই নাকি কাজি ডেকে তোমাদের বিয়ে দিয়ে দিবে।

আমি চোখ কপালে তুলে চেচিয়ে বললাম,
— বলিস কি?

— সত্যি বলছি। তুমি কিছু জানো না? দাদীর তো তোমাকে অনেক পছন্দ। তাই তায়াং ভাইয়ার বউ করতে চাইছে।

— আমার মাথায় পানি ঢাল ইভা।আমি আজ নেই। আব্বু-আম্মু রাজী হয়েছে বিয়েতে?

— আব্বু প্রথমে রাজী ছিলো না আত্মীয়ের মধ্যে বিয়ে দিতে।কিন্তু আম্মু বলে তায়াং-এর মতো ছেলে হয় না। তাই রাজী হতে বাধ্য হয়েছে। তবে এখনো ততটা রাজী নয়। খালু তো গতকাল থেকে কলের ওপর কল। খালু তো ভীষণ খুশি তোমাকে তার ছেলের বউ করতে পারবে বলে।

— আমার বোধহয় এবার পিংক কালার বিষ খেতে হবে। দেখি আম্মুর সাথে কথা বলে।

আমি দ্রুত সোফা থেকে উঠে আম্মুর রুমের দিকে দৌড়ালাম। আব্বু ওয়াসরুমে গেছে। আম্মু বোরখা খুলে মাথা নিচ করে বসে আছে। আমি ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে বললাম,

— এসব কি শুনছি আম্মু?

— কোনসব?

— তায়াং ভাইয়ার সাথে নাকি আমার বিয়ে ঠিক করছো তোমরা?

— তোর আব্বু তো ততটা রাজী না। এখন আসছি দেখি কি হয়?

— তোমরা এসব ভাবো কি করে হ্যাঁ? তায়াং ভাইয়াকে আমি নিজের ভাইয়ের চোখে দেখি। তার সাথে আমার বিয়ে কিভাবে সম্ভব? ভাইয়াও আমাকে বোনের চোখে দেখে। এই সিম্পল বিষয়টা, তোমরা বুঝতে পারছো না কেন?

— ওর সাথে বিয়েতো তোর জায়েজ আছে।

— থাকুক জায়েজ। এমন হতো আমি তায়াং ভাইয়াকে পছন্দ করি কিংবা তায়াং ভাইয়া আমাকে পছন্দ করে তাহলে বিষয়টা অন্যরকম। কিন্তু তেমনটা তো নয়।

— আগেই চিল্লাস না। আসছি যখন দেখি কি হয়?

— দেখি কি হয় বললে তো হবে না। এই বিয়ে কিছুতেই হবে না। আমি তায়াং ভাইয়াকে বিয়ে করবো না। উনি শুধু আমার ভাই। তাকে আমি কখনও অন্য চোখে দেখিনি আর দেখবোও না।

— কেন তায়াং ছেলে হিসেবে কোন দিক দিয়ে খারাপ?

— এখানে ভালো বা খারাপের প্রশ্ন উঠছে কেন?

— তাহলে তুই এসব কথা বলিস কেন? আল্লাহ যদি ওর সাথে তোর বিয়ে লিখে রাখে তাহলে কি তুই কিছু করতে পারবি? ভাগ্যে থাকলে তো বিয়ে হবেই।

— উদ্ভট কথাবার্তা বলে একদম মাথা গরম করবা না। এই বিয়ে হবে না মানে হবে না। আর কোন কথা নেই।

কথাগুলো বলে রাগী চোখে আম্মুর দিকে একবার তাকিয়ে দ্রুত রুমে চলে গেলাম। টেনশনে আমার মাথা ফেটে যাচ্ছে। যেচে নিজের বিপদ ডেকে আনলাম। কেন যে ঐ দাদীকে বিয়ের কথা বললাম। আমার মজা করে বলা যে নয় নাম্বার বিপদ সংকেতে রূপ নিবে তা জানলে জীবনে বিয়ের কথা উচ্চারণও করতাম না।

💖💖💖

দুপুরে…..

খাবার খাওয়ার পর সবাই যার যার রুমে বিশ্রাম নিচ্ছে। গতকালের পর থেকে তায়াং ভাইয়ার সাথে আমার কোন কথা হয়নি। তাই গুটি গুটি পায়ে ওর রুমের দিকে রওনা দিলাম। ওর রুমের সামনে যেতেই দেখলাম ভাইয়া উপুর হয়ে শুয়ে আছে। আমার আজ ভেতরে ঢোকার সাহস হচ্ছে না। দোয়া-দরুদ পড়ে বুকে ফুঁ দিলাম। তারপর আস্তে করে দরজায় দুটো টোকা দিয়ে বললাম,

— ভাইয়া আসবো?

অপরদিক থেকে কোন শব্দ এলো না। শুনতে পাইনি ভেবে আরেকবার জোরে টোকা দিয়ে চেচিয়ে বললাম,

— ভাইয়া আসবো?

— হুম আয়।

ওর আওয়াজ কেমন জানি গম্ভীর লাগছে। আমার ভেতরে ঢুকতে ইচ্ছে করছে না। মনে হচ্ছে ভেতরে ঢুকলেই তায়াং ভাইয়া আমাকে মেরে ফেলবে। পাঠাটা যাদের সাথে চেচামেচি করলে লাভ হবে তাদের সাথে করে না। সব ঝাল আমার ওপর মেটায়। এটা এখন নয় সবসময় করে। আমি ওড়নার আগা মোচড়াতে মোচড়াতে ভেতরে ঢুকলাম।ওর পাশে দাঁড়িয়ে বললাম,

— ভাইয়া, তুই কিছু বলছিস না কেন? তোর সাথে আমার বিয়ে কনফার্ম করে ফেলছে। আর তুই চুপচাপ হাত গুটিয়ে বসে আছিস। এটা কি ঠিক বল?

ভাইয়া রাগী চোখে আমার দিকে তাকিয়ে এক ঝাটকায় আমার হাত ধরে ওর পাশে বসিয়ে দিলো। তারপর দাঁতে দাঁত চেপে বললো,

— তোর কি মনে হচ্ছে আমি হাত-পা গুটিয়ে বসে আছি?

— তাই তো দেখতে পাচ্ছি।

— তোকে প্রথমে দুই গালে দুটো চটকনা (চড়) দিবো। তারপর বাকি সব।

আমি চট জলদী আমার দুই গালে দুই হাতে চেপে ধরলাম। একে দিয়ে বিশ্বাস নেই। দিয়েও বসতে পারে। মুখটাকে কাঁদো কাঁদো ফেস করে বললাম,

— আমি কি করছি?

— এক থাপ্পড়ে সামনের পাটির দাত ফেলে দিবো শয়তান ছেমড়ি। আবার বলিস তুই কি করছিস?

— কি করছি তাতো বলবি?

— দাদীকে বিয়ের কথা বলছিস কেন? জামাই চাই, জামাই চাই বলে আন্দোলন কে করছিলো?

—😶😶

— এখন চুপ কেন? আমি গতকাল রাতে দাদীর রুমে গিয়ে দাদীর সাথে কথা বলছি। উনি তো রীতিমতো আমাকে ইমোশনাল ব্লাকমেইল আরম্ভ করেছিলো। তাই রেগে বের হয়ে গেছি।

— কি বলছে দাদী?

—আমি বলছি তোকে আমি নিজের বোনের চোখে দেখি। তোকে বিয়ে করতে পারবো না। উনি বলে তোর সাথে আমার বিয়ে জায়েজ আছে। বিয়ের আগে তোকে বোন ভাবছি বিয়ের পর বউ ভাবলেই চলবে। তোকে বিয়ে করা আমার পক্ষে সম্ভব নয় তা তুই ভালো করেই জানিস।

— আমারও সম্ভব নয়।

— এনাজ, নূর দুজনেই আমাকে ভুল বুঝছে। একজনও কল পিক করছে না। এসব কিছু হয়েছে তোর জন্য। তুই দাদীর মাথায় বিয়ের ভূত চাপিয়েছিস।

— আমি কি জানতাম উনি সামান্য বিষয়কে এতটা সিরিয়াস করে ফেলবে?

— এখন এই বিয়ে ভাঙার দায়িত্ব তোর। তুই কিভাবে ভাঙবি, কি করে ভাঙবি আমি কিছু জানি না। আমি শুধু জানি তুই বিয়ে ভাঙবি। যদি বাই চান্স তোর সাথে আমার বিয়ে হয়ে যায় তাহলে এই বাসায় আগুন লেগে যাবে। ভালো চাইলে বিয়ে ভাঙিস। নয়তো তোর কপালে কি আছে তুই নিজেও জানিস না।

— তুই খালামণি কিংবা দাদীকে নূর আপির কথা বলে দে। তাহলেই সমস্যার সমাধান হয়ে যায়।

— তুই এনাজের কথা কেন বলিস না?

— তোর বিষয় আর আমার বিষয় এক না। এনাজ যদি আব্বুকে প্রস্তাব দিতো তাহলে আমি সব বলে দিতাম। কিন্তু ও তো কিছু বলেনি। তুই সবাইকে নূর আপির কথা বলে দে।

— বলতে গিয়েছিলাম। কেউ আমার কথা শুনতে চাইনি।

— আজাইরা কথা বলিস না তো।

—আম্মুকে বলছি কিন্তু সে বলে তোর আব্বুকে বল। আব্বুকে কল দিয়েছি সে বলে তোমার বিয়ে নিয়ে টেনশনে আছি। কোন কথা শুনবো না। তোমার দাদী যাকে পছন্দ করেছে তাকে বিয়ে করে নাও। তুই তো জানিস আমি আব্বুকে একটু ভয় পাই। দাদীকে বলতে গেলে ইমোশনাল ব্লাকমেইল শুরু করে দিলো।

— তুই একটু কষ্ট করে দাদীকে বলে দেখ।

— দাদী আমার কথা শুনতে নারাজ। দেখ উনার এমনি হাই প্রেশার। যদি বেশি চাপ দেই তাহলে স্ট্রোক করে বসতে পারে। তখন আমার বাপ আমাকে তায্যপুত্র করবে। ঝামেলা তুই লাগিয়েছিস, তুই সব ঠিক করবি। আমি কোন হেল্প করবো না। সব নষ্টের গোড়া তুই।

— দেখ পাঠা রাগ উঠাইস না। তোর এমন গা সারা কথাবার্তায় আমার শরীর জ্বলছে।

— তোকে দেখেও আমার গা জ্বলছে। ভালো চাইলে বিয়ে ভেঙে দে।

— তুই না এতো রাগী, তাহলে বিয়ে ভাঙিস না কেন?

— দেখ, সব জায়গায় রাগ দেখানো যায় না। আমি এখন রাগ দেখালে দাদী স্ট্রোক করবে। তখন আরেক ভেজাল হবে।

— হু তা করবি কেন? পারিস তো শুধু আমার সাথে। যত রাগ সব আমার ওপর।

— কথা না বলে বিয়ে ভাঙার প্ল্যান কর। আমি তোকে একটুও সাহায্য করবো না। নিজে একা একা পাকনামি করছিস। এখন একা একা সব ঠিক করবি। এটাই তোর শাস্তি।

ওর কথা শুনে আমার মাথায় চিনচিন করে রাগ উঠে গেলো। রেগে সাপের মতো ফোঁস করে বললাম,

— ভাঙবো না বিয়ে। আমি তোকেই বিয়ে করবো। দেখি তুই কি করতে পারিস? আর বিয়ে কি করে ভাঙিস তাও দেখবো।

— এমনটা হলে কেয়ামত ঘটিয়ে ফেলবো আমি।

— কচু করবি। ধ্যাত, মুডটাই নষ্ট!

জোরে জোরে পা ফেলে রুম থেকে বেড়িয়ে গেলাম। এই পঠার কথা শুনে আমার রাগ উঠছে। সব আমার ওপর চাপিয়ে দিয়ে নিজে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সবই আমার কপাল।

💖💖💖

বিকেলে…..

টেবিলের ওপর ছোট একটা চিরকুটে লেখা ছিলো,”ছাদে এসো।” আমার মন বললো এটা এনাজের কাজ। তাই দ্রুত চলে এলাম।সিঁড়ি থেকে ছাদে পা দিতেই একটা হাত এসে টেনে আমাকে দেয়ালের আড়ালে নিয়ে গেলো। আমি ভয় পেয়ে চিৎকার করতে গেলে মুখ চেপে ধরলো।পারফিউমের ঘ্রাণটা পরিচিত লাগছে। পিটপিট করে চোখ খুলে এনাজকে দেখে পিলে চমকে উঠলো। চোখ দুটো রক্তবর্ণ করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। চোখ, মুখ ফুলে লালচে হয়ে আছে। রাগী কন্ঠে বললো,

— আমাকে মেরে ফেলার চিন্তা-ভাবনায় আছো?

— উম উম উম!

— কি শুরু করছো তোমরা ভাই-বোন মিলে? আগামীকাল তোমাদের বিয়ে টিডি পোকা! চিন্তা করছো আমার মনের অবস্থা এখন কিরকম? আমি কি অবস্থায় আছি তা একমাত্র আমি জানি।তোমরা কেউ আমার দিকটা একবারো ভেবে দেখলে না। এই তোমাদের বন্ধুত্ব, এই তোমাদের ভালোবাসা!

আমি চোখের ইশরায় তার হাতের দিকে দেখিয়ে দিলাম। যার মানে হলো,”মুখের থেকে হাতটা সরান।” উনি প্রথমে বুঝতে পারলেন না। চোখ, মুখ কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,

— কি?

আমি আবারো তার হাত দেখিয়ে দিলাম। উনি এবার বুঝতে পেরে হাত সরিয়ে ফেললো। তবে আরেক হাত দিয়ে আমার দুই হাত দেয়ালের সাথে চেপে ধরলো। আমি একটু থেমে থেমে বেশ কয়েকবার নিঃশ্বাস নিয়ে বললাম,

— আপনার বন্ধুকে কিছু না বলে আমার সাথে খেচাখেচি করছেন কেন? আমি তো বিয়ে ভাঙার জন্য উঠে-পরে লাগছি। কিন্তু ওর তো কোন রিয়েকশন নেই।

— বিশ্বাস করো বিয়েটা যদি তায়াং-এর সাথে ঠিক না হয়ে অন্য কারো সাথে হতো তাহলে আমি তোমাকে তুলে নিয়ে যেতাম। কিন্তু তায়াং হওয়ায় কিছু করতেও পারছি না।

— বোকার মতো কথা বলেন না। তুলে নিয়ে গেলেই যে সব সমস্যার সমাধান হবে তা কে বললো আপনাকে। রাগের মাথায় কিছু করা ঠিক হবে না। ঠান্ডা মাথায় কাজ করতে হবে।

— কি করবো আমি বলো? আমার মাথা কাজ করছে না। গতকাল যখন শুনলাম তোমার সাথে তায়াং-এর বিয়ে তখন ইচ্ছে হচ্ছিলো নিজেকে শেষ করে দেই।

— চুপ করেন। খালি উল্টোপাল্টা কথাবার্তা। আরেকবার মরার কথা বললে আমিই জানে মেরে ফেলবো।

— আমি জানি তুমি বিশ্বাস করতাছো না। তবে তুমি মিলিয়ে নিয়ো তুমি বিয়েতে কবুল বলবা সাথে সাথে আমি বিষ খাবো। একদিক দিয়ে তোমার বিয়ে হবে আরেকদিক দিয়ে আমার লাশ বের হবে।

— আপনি কিন্তু এবার বেশি বলছেন এনজিও সংস্থা।

— তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচতে পারবো না। বিশ্বাস করো তোমাকে না পেলে আমি মরে যাবো।

হাত ছেড়ে দিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। কাঁধে মুখ গুঁজে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদতে লাগলো। তার কান্নার শব্দে আমি স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। একটা ছেলে সামান্য কারণে কাঁদে না তা আমি জানি। আর এনাজকে এই প্রথম কান্না করতে দেখলাম।কতটা ভালোবাসলে কেউ এভাবে কাঁদতে পারে তা আমার জানা নেই। তবে এতটুকু বুঝতে পারছি, সে আমাকে হারিয়ে ফেলার ভয়ে কাঁদছে। কান্না কন্ঠেই বললো,

— সব ঠিক করে দাও টিডি পোকা। আমার শুধু তোমাকে চাই। তুমি ছাড়া আমার জীবন আবার মরুভূমির মতো খা খা করবে। রংহীন জীবন নিয়ে আমি বাঁচতে পারবো না। আমার শুধু তোমাকেই লাগবে। আর কিছু চাই না আমি। আমার প্রথম ভালোবাসা হারিয়ে ফেলার পরও আমার এতটা নিঃস্ব লাগেনি যতটা এখন লাগছে।সবে তো আমি সবকিছু গুছিয়ে নিচ্ছিলাম। ভেবেছি এই মাসটা গেলে সব গুছিয়ে তোমার বাবা-মায়ের কাছে বিয়ের প্রস্তাব দিবো। কিন্তু সব এলোমেলো কেন হয়ে গেলো?

আমি তার কোন প্রশ্নের উত্তর দিতে পারছি না। আমার সারা শরীর ঠান্ডা হয়ে আসছে। মাথাও কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। হাত দুটো আলতো করে তার পিঠে রেখে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললাম,

— ইন শা আল্লাহ সব ঠিক হয়ে যাবে। আপনি প্লিজ একটু শান্ত হোন। এতটুকু কথা কান খুলে শুনে রাখুন, আমি যদি আপনার না হই তাহলে আর কারো হবো না। আমি শুধু আপনারি।

— তোমাকে ছাড়া আমি থাকতে পারবো না। তুমি এখন আমার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। আমার তোমাকেই লাগবে।

— আপনি শান্ত হোন আমি দেখছি। প্লিজ কান্না করবেন না। আমার অনেক খারাপ লাগছে।

এনাজ আমাকে ছেড়ে চোখ মুছে অন্য দিকে তাকিয়ে রইলো। তার চোখ এখনো টলমল করছে। নাক টেনে চোখের পানি মুছে আমার দিকে ঘুরে বললো,

— যা করার দ্রুত করো। তায়াং-এর সাথে বিয়েটা না হলে আমি অন্য কিছু করতাম। কিন্তু যেখানে আমার জানে জিগার বন্ধু আছে সেখানে আমি তোমাদের পারিবারিক বিষয়ে নাক গোলাতে চাইছি না। তবুও যদি আমার কোন হেল্প দরকার হয় তাহলে অবশ্যই আমি তোমাদের পাশে আছি। আরেকটা কথা, আমাকে যদি বাঁচাতে চাও তাহলে এই বিয়ে ভাঙো। নয়তো জামাই নিয়ে আমার মরামুখটা একবারের জন্য দেখে এসো।

— আবারো বেশি কথা😡।

— সত্যি মরে যাবো আমি। তোমাকে না পেলে আমি বেঁচে থাকবো না।

চোখের পানি মুছতে মুছতে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে গেলো। আমি মূর্তির মতো সেখানেই ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইলাম। নিজের ওপর রাগ হচ্ছে। দেয়ালের সাথে নিজের মাথাটাকে ধরাম করে এক বারি মারলাম। রাগে সারা শরীর থরথর করে কাঁপছে। বেশি পাকনামি করতে গিয়েছি এখন তার ফল ভোগ করছি।

#চলবে
#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here