শেষটাও সুন্দর হয় পর্ব -১০+শেষ

#শেষটাও_সুন্দর_হয়
#গোধূলি_লগ্নে_দুজনে
#আমিনা_আফরোজ
#পর্ব:-১০

সকাল দশটা। আমার ছোট্ট ঘরের বিছানায় শুয়ে আছি আমি। সূর্যের সোনালী কিরনে চারিদিক আলোকিত হয়ে ওঠেছে এখন। বাবা – মা আর অথৈ পাশের ঘরে। নিদ্র ভাইয়া ওঠেছে তিয়ান ভাইদের বাসায়। তিয়ান ভাই তো তার ছোট বেলার বন্ধুকে পেয়ে মহা খুশি। তিয়ান ভাইয়ের সাথে আমিও আজ বেজায় খুশি। মি.ট্রেনওয়ালাকে দিন চারেক নিজের চোখের সামনে দেখতে পারবো তো। এই আমার কাছে অনেক। কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই শ্রান্তিতে বুজে আসলো চোখের পাতা। আর কিছু ভাববার অবকাশ পেলাম না আমি। ধীরে ধীরে ঢোলে পড়লাম ঘুমের রাজ্যে।

ঘুম থেকে ওঠতে ওঠতে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলো। ঘড়িতে তখন সাড়ে চারটা বাজে । সেই যে দশটার দিকে ঘুমিয়ে ছিলাম কেবল ওঠলাম। টেবিলে রাখা ফোনটা হাতে নিয়ে অন করে দেখি ৩৬ টা মিসকল আর গোটা বিশেক মেসেজ যার সবগুলোই নিদ্র ভাইয়ের নম্বর থেকে এসেছে। এমনিতেই এতগুলো মিসকল দেখে আমার অজ্ঞান হবার যোগাড় তার ওপর আবার হুমকি ভরা মেসেজ। তাই আর দেরি না করে ঝটপট কল দিলাম নিদ্র ভাইয়ের নম্বরে। নিদ্র ভাই আমার কল কেটে নিজে কল ব্যাক করাতে মুচকি হেসে কল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে ধমকের সুরে কেউ বলে উঠলো,

–” এই মেয়ে এই , কত বার কল দিয়েছি দেখো তো? কোন পাত্তা নেই। কই ছিলে সারাদিন হ্যা? জানো সারাদিন কতটা ছটফট করেছি আমি? আর তুমি…..

নিদ্র ভাইকে একধারে বকবক করতে দেখে এবার আমি নিজেই ওনাকে থামিয়ে দিলাম নয়তো ওনি বকবক করতেই থাকবেন। নিদ্র ভাইকে থামিয়ে আমি বললাম,

–” আরে আরে একা একা নিজেই বকবক করে যাচ্ছেন ,আমাকেও তো কিছু বলার সুযোগ দিবেন নাকি আমার কথা না শুনেই আমাকে দন্ড দিবেন?”

আমার কথা শুনে এবার যেন খানিকটা দমলেন নিদ্র ভাই। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,

–” বলো কি বলবে? তবে আগেই বলে দিচ্ছি ফালতু অযুহাত দিবে তো শাস্তি ভোগ করবে। তাই বুঝে শুনে কথা বলো।”

নিদ্র ভাইয়ের কথা শুনে আমি ভয়ে ভয়ে বললাম,

–” আসলে নিদ্র ভাই হয়েছে কি……..

–” তুই আবার আমাকে ভাই বলে ডাকছিস? সেদিনের শাস্তিটা বোধহয় ভুলে গেছিস, দাঁড়া আজ হচ্ছে তোর।”

–” সরি সরি সরি। ভুলে মুখ ফসকে বেরিয়ে গেছে তো। আর এমন ভুল হবে না। প্রমিস।”

–” তোকে কেন যেন আমার বিশ্বাস হচ্ছে না। আচ্ছা ঠিক আছে এইবারই শেষ। এমন ভুল আর একবার হলে কিন্তু আমি তোকে ছাড়বো না এই বলে দিচ্ছি।”

–” হ্যা হ্যা একদম। আমি তোমার সকল শর্তে রাজি।”

–” বাব্বাহ আজ হঠাৎ সূর্য কোন দিকে ওঠেছে বলোতো?”

–” কেন গো? সূর্য প্রতিদিন যে দিকে ওঠে, আজও সেই দিকেই ওঠেছে। আজ কি এমন স্পেলাল দিন যে সূর্যিমামা হঠাৎ পশ্চিম দিক থেকে ওঠতে যাবে?”

–” আজ তো স্পেশাল দিনই বটে। তুমি আজ বিনা ওজরে আমার শর্তে রাজি হলে তাই ভাবলাম আজ বোধহয় সূর্যিমামা তার দিক ভুল করে ওঠেছে।”

–” এই সব সময় আমাকে নিয়ে এমন কথা বলবে না বলছি। কি এমন করেছি আমি হু? তোমার শর্তে রাজি হয়েছি। এখন যদি আমি তোমার শর্তে রাজি না হতাম তখন তুমি কি বলতে জানো?”

–” কি বলতাম?”

–” বলতে বিয়ের একমাস গড়াতে না গড়াতেই তুমি আমার অবাধ্য হয়ে গেছো , বাকি জীবন তো পড়েই রইলো।”

–” এইটা অবশ্য তুমি ঠিক বলেছো?”

–” আমি সব সময় সঠিক কথাই বলি জনাব। আপনারা ছেলেরা হলেন এক আজব জিনিস, কখন যে কি নিয়ে রিয়েক্ট করেন তা নিজেরাই জানেন না।”

–” হয়েছে,হয়েছে এখন আর বকবক করতে হবে না। তাড়াতাড়ি তিয়ানদের বাসায় মোড়ে চলে এসো।”

–” ঠিক আছে আপনি মিনিট ত্রিরিশ এর মতো অপেক্ষা করুন,আমি আসছি।”

–“আরে এখান থেকে এখানে আসতে ত্রিশ মিনিট সময় লাগে নাকি?”

–” উফফ আমি এত অধৈর্য কেন? একটু সবুর করতে শিখুন তো। জানেন না ,সবুরে মেওয়া ফলে।”

কথাটা বলেই কলটা কেটে দিলাম। তারপর কাপড় নিয়ে চলে গেলাম ফ্রেশ হতে।

এদিকে পাশের কামরায় বসে আছেন আশরাফ মাহমুদ আর অরুনিমা মাহমুদ। নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছেন তারা। আলোচনার মূল বিষয়বস্তু নিদ্র ও অদ্রি। আশরাফ মাহমুদ ওনার স্ত্রীর উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন,

–” ছেলে মেয়ে দুটো বড্ড ছেলেমানুষ। এই ছেলেমানুষির কারনে কোন ভুল সিদ্ধান্ত না নিয়ে ফেলে।”

অরুনিমা মাহমুদ তখন উলের সোয়েটার বুনেছিলেন। স্বামীর কথা শুনে তিনি বলে উঠলেন,

–” এজন্যই আমি বলেছিলাম দুটোকে বিয়ে দিয়ে দাও। তাহলেই তো আর চিন্তা থাকতো না। নিদ্র তো আমাদের হাতে গড়া ছেলে, কি এমন ক্ষতি হতো এখন বিয়েটা সেরে ফেললে।”

স্ত্রীর এমন বোকা বোকা কথায় বেশ বিরক্ত হলেন আশরাফ মাহমুদ। বিরক্তি ভরা কন্ঠে বলে উঠলেন,

–” আহ অরু তুমি দেখি এখনো সেই অবুঝটাই রয়ে গেলে। বলি ওদের দুজনের কি পড়াশোনা শেষ হয়েছে? দুজনেই ওঠতি বয়সের ছেলে-মেয়ে। এখন যদি ওদের বিয়ে পড়িয়ে দেই ,তবে ওদের পড়াশুনা উচ্ছন্নে যাবে। যা আমি কিছুতেই হতে দিবো না। বুঝেছো?”

–” কচু হতো। তুমিও তো আমাকে ছাত্র অবস্থাতেই বিয়ে করেছিলে, কই আমাদের পড়াশোনার তো কোন ক্ষতি হয়নি তাহলে ওদের হবে কেন?”

–” আমি আর নিদ্র এক হলো নাকি? মোটেই না। শোনো তুমি কিন্তু আমার মেয়েটাকে আজে বাজে পরামর্শ দিবে না,এই আমি বলে রাখলাম।”

–“আমার বয়েই গেছে তোমার মেয়েকে আজেবাজে বুদ্ধি দিতে। যতসব।”

কথাটা বলেই অরুনিমা মাহমুদ চলে গেলেন রান্নাঘরের দিকে আর আশরাফ মাহমুদ স্ত্রীর কথাগুলো আমলে না নিয়ে গোধুলির রক্তিম আকাশপানে তাকালেন।

তিয়ানদের ফুলের বাগানের একপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছি আমি আর নিদ্র ভাই। বিকেলের এই সময়টা প্রকৃতি বড় নিশ্চুপ হয়ে থাকে। প্রকৃতির সাথে সাথে আমরাও নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। তিয়ান ভাইয়ের বাড়ির দুরুত্ব আমাদের বাড়ি থেকে মিনিট দশেকের পথ। সাদা দোতলা বাড়ির সম্মুখ প্রান্তেই রয়েছে ফুলের বাগান। ফুলের বাগানের পাশেই রয়েছে একটি দোলনা। আজ অবশ্য তিয়ান ভাইদের বাসায় কেউ নেই। তিয়ান ভাইয়েরা সবাই পিঠার দাওয়াতে গিয়েছেন। বিশাল এই তে বাড়িতে শুধু একা রয়ে গেছেন নিদ্র ভাই যদিও এটা ছিল নিদ্রা ও তুহিন ভাই দুজনের মিলিত পরিকল্পনা।

আমি আর নিদ্র ভাই এগিয়ে গিয়ে ফুল দিয়ে সাজানো সেই দোলনায় বসলাম। চারিদিকে ততক্ষণে কুয়াশার শুভ্র চাদর পড়তে শুরু করেছে। সূর্যি মামাও ধীরে ধীরে ঢলে পড়ছে পশ্চিম আকাশের কোলে। সারাদিনের শ্রান্ত পাখিরাও ফিরে চলেছে তাদের গৃহকোনে,যেখানে তার জন্যও অপেক্ষা করছে তার প্রিয়তম। আমি নিদ্র ভাইয়ের কাঁধে মাথা রেখে নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম রক্তিম সূর্য মামার পানে।আর নিদ্র ভাই আমার হাত তার হাতের মুঠোয় নিয়ে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে।
আচমকা নিদ্র ভাই আমার কানে ফিসফিসিয়ে বলে উঠলেন,

” কোন এক গোধূলি বেলার
স্নিগ্ধ হাওয়ায়
তোমায় নিয়ে হারিয়ে যাবো
দূর পাহাড়ের অচিন দেশে
যেথায় মোদের কেউ পাবে না খুঁজে”
~আমিনা আফরোজ
#শেষটাও_সুন্দর_হয়
#নতুন_পথ_চলা
#আমিনা_আফরোজ
#অন্তিম পর্ব

বছর ঘুরিয়ে আবারো এসেছে ফেব্রুয়ারি মাস। শীত,গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ আর হেমন্ত ঋতুর রূপ বদলে কেটে গেছে মাঝের তিনটি বছর। আজ ফেব্রুয়ারির দশ তারিখ। আজকের দিনটিতেই নিদ্র ভাইয়ের সাথে প্রথম দেখা হয়েছিল আমার। নিয়তির পরিহাসে সেই আজকের দিনটিতেই বিয়ে হচ্ছে আমাদের। হ্যা আজ আমার আর নিদ্র ভাইয়ের বিয়ে। গত তিনটে বছর বহু চড়াই উৎরাই পেরিয়ে আজকের এই শুভ দিনটির আগমন ঘটেছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে আমাদের বিয়ে উপলক্ষে নিদ্র ভাইয়েরাও চলে এসেছেন তাদের আদি বাড়িতে। একই পাড়ায় বর কনের বাড়ি বোধহয় এই প্রথম। একারনেই পুরো পাড়াটা বোধহয় হৈ হুল্লোড়ে মেতেছে।

সেই তিন বছর আগে শেষ দেখা হয়েছিল আমাদের। এরপর বাবা- মা আর সোনা মা , সোনা বাবাই এর কঠোর নির্দেশে আর দেখা হয় নি । তবে দেখা না হলেও নিঝুম রাতের দ্বিপ্রহরে ঠিকই ফোনে কথা হতো আমাদের যা চলতো রাতের শেষ প্রহর অব্দি। তারপর আবারো দুজনে ফিরে যেতাম দৈনন্দিন রুটিনে। আমাদের এই নৈশ ফোনালাপনের কথাটা থাকত খুব সঙ্গপনে। এভাবেই কেটেছে দিনগুলি। এখন আমি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছি। আমার এই অর্জনটাও হয়েছে নিদ্র ভাইয়ের জন্য। এদিকে নিদ্র ভাই পড়াশোনা শেষে চাকরিতে যোগ দিয়েছে সবে। তাই সোনা মা আর দেরি না করে আমার বাবা-মার সাথে কথা বলে বিয়ের দিন তারিখ ঠিক করে ফেলেছেন।

আজ সকাল থেকেই দুই বাড়িতেই বেশ তোড়জোড় শুরু হয়েছে। আত্মীয়-স্বজনদের ভারে জমজমাট হয়ে উঠেছে দুই বাড়ির পরিবেশ। ছোট্ট ছোট্ট ছেলেমেয়েদের কলরবে মুখরিত বাড়িটি দুখানা। রান্না-বান্নার আয়োজনে ত্রুটি নেই কোন বাড়িতে। সকলেই যে তার কাজ নিষ্ঠাভরে পালন করছে। পাড়ার কুকুরগুলো খাবারের অন্বেশনে ঘুরে বেড়াচ্ছে বাড়ির আনাচে-কানাচে। ছেলে – মেয়েরা সবাই মিলে ফুল দিয়ে গেট সাজিয়েছে। তাদের মধ্যে জনা কয়েকজন আবার ফুলের তোড়া হাতে নিয়ে বরকে বরন করার জন্য অপেক্ষা করছে।

এদিকে আমি আমার ঘরের পাটিতে বসে রয়েছি এখন। বিয়ের দিন নাকি পাটিতে বসতে হয় ,তাই আমার নানি জোর করে আমাকে পাটিতে বসিয়ে দিয়েছে। সেই সাথে হাতে ধরিয়ে দিয়েছে হলুদের মুচি। বিয়ে উপলক্ষে অহনারাও এসেছে আমাদের বাড়ি। সেই সাথে এসেছে নেহা আপু ও ওনার হাজবেন্ড আর সৌরভ। সৌরভের সাথে অহনার বিয়ের কথাবার্তা চলছে সবে। আল্লাহ চাইলে হয়তো খুব তাড়াতাড়ি ওদের চার হাত এক করে দিবেন।

ঘন্টাখানেক পর আমাকে সবাই মিলে গোসল করানোর জন্য নিয়ে গেল। তারপর গোসল করানো শেষে আবারো পাটিতে বসিয়ে দিলো আমাকে। এবার আমার পাটির আশে পাশে আর কেউ নেই। সবাই আমাকে রেখে যে যার কাজে মশগুল হয়ে পড়েছে। আনুমানিক দুটোর পরে নিদ্র ভাই ঘোড়ায় চেপে উপস্থিত হলেন আমাদের বাড়ির দোরগড়ায়। ছোট থেকেই ওনার শখ ছিল ওনি নাকি ঘোড়ায় চড়ে আমাকে বিয়ে করতে আসবেন আর আমাকেও নাকি সেই ঘোড়ায় চড়িয়ে ওনার বাড়ি নিয়ে যাবেন। সে আরো অনেক ইচ্ছে আছে ওনার যা বলে শেষ করানো যাবে না। বিয়ে পড়াবো পড়াবো করেও মাগরিবের আগে আর বিয়ে পড়ানো হলো না। ওনার সাথে ঘোড়ায় চেপে যখন ওনাদের বাড়ির দোরগোড়ায় পৌঁছালাম তখন ঘড়ির কাঁটা সাড়ে আটের ঘরে। শীতে উত্তরের হিমেল হাওয়ায় আমার অবস্থা তখন নাজুক। আমার অবস্থা দেখে সোনা মা আমাকে বরন করে দ্রুত ঘরে নিয়ে গেলেন।

শীতের চাঁদনী রাত গভির থেকে গভীর হতে লাগল। একে একে বাড়ির সমস্ত বাতি নিভে গেলেও নিদ্র ভাইয়ের ঘরে তখনো টিমটিম করে জ্বলছিল মোমবাতির আলো। পুরো ঘরটি ফুলের গন্ধে ভরপুর। আমাকে বেশ কিছুক্ষণ আগে ঘরে বসিয়ে রেখে গেলেও নিদ্র ভাই হবে ঘরে এলেন। এতক্ষন অব্দি বেচারা বন্ধুদের কব্জায় বন্দি ছিল। নিদ্র ভাই গুটি গুটি পায়ে আমার দিকে এগিয়ে এসে আমার সামনে বসলেন। তারপর আমার ঘোমটা খুলে আমার চিবুক ধরে বললেন,

–” মাশআল্লাহ তোমাকে আজ অপূর্ব লাগবে।”

নিঝুম রাতে নিদ্র ভাইয়ের পুরুষালী কন্ঠস্বর শুনে আমি লজ্জ্বায় মাথা নিচু করে রইলাম। নিদ্র ভাই আমাকে লজ্জা পেতে দেখে মুচকি হেসে দাঁড়িয়ে বললেন,

–” নে এভাবে বসে না থেকে এবার আমার সালাম কর দেখি। প্রথম বিয়েতে তো সালাম টালাম করিস নি ,তাই আমিও কোন দোয়া দিতে পারি নি তোকে । তাই এবার আর কোন মাফ নেই। ওঠ ওঠ বলছি।”

নিদ্র ভাইয়ের এমন অগোছালো ছাড়া ছাড়া কথা শুনে আমি তো অবাক। কি সব বলছেন ওনি। সবসময় হেঁয়ালি করা যেন ওনার স্বভাব হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে নিদ্র ভাই আবারো তাড়া দিয়ে বলে ওঠলেন,

–” কি রে এভাবে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছিস কেন? আয় বলছি?”

কি আর করার। নিদ্র ভাইয়ের ওপর কোন কথা বলার সাহস নেই আমার তাই ওনার কথামতো দাড়াতেই নিদ্র ভাই তড়িৎ গতিতে আমি কোলে নিলেন। আমি কিছু সময় স্তব্ধ হয়ে ছিলাম বটে তবে সম্বিত ফিরতে হাত – পা ছোটাছুটি করে বলতে লাগলাম,

–” কি করছেন কি আপনি? বলি মাথাটা কি একেবারেই গেছে আপনার? নাকি রাত বিরেতে ভুতে ধরেছে আপনাকে?”

–” ভুতেই ধরেছে বুঝলি। তাই আগেই সাবধান করে দিচ্ছি এরপর আর একবার হাত-পা ছুড়ে তিরিং বিরাং করে লাফাবি তো তোকে ঠাস করে মাটিতে ফেলে দিবো।”

–” আমাদের বিয়ের রাতে আমাকে এমন হুমকি দিতে পারলেন আমায়। ”

–” হুমকি দিতে আবার দিন,ক্ষন, মাস দেখা লাগে নাকি।”

–” লাগেই তো। সাধে কি আর আমি আপনাকে নিষ্ঠুর বলি বলুন?”

–” সে তোর ইচ্ছে। তুই তোর বরকে নিষ্ঠুর বলবি না অন্য কিছু বলবি সে তুই নিজে জানিস।”

আমি আর নিদ্র ভাইয়ের সাথে কথা না বাড়িয়ে চুপ করে রইলাম। কথা বাড়িয়েও তো আর আমি জিততে পারবো না তার থেকে বরং চুপ করে থাকাই ভালো। প্রায় মিনিট পাঁচেকের মাথায় নিদ্র ভাই আমাকে নিয়ে বেলকুনিতে এসে দাঁড়ালেন। বেলকুনির ফ্লোর জুড়ে রয়েছে গোলাপের পাপড়ি আর ছোট্ট ছোট্ট মোমবাতি। বেলকুনির শেষ মাথায় একটা দোলনাও রয়েছে। দোলনাটাও আজ ফুল দিয়ে নিজ হাতে সাজিয়েছেন নিদ্র ভাই। নিদ্র ভাই আমাকে ওনার কোল থেকে নামিয়ে দিয়ে হাত ধরে বললেন,

–” শেহজাদি আপনার এই অধম প্রজার হাত ধরে এগিয়ে চলুন আপনার সিংহাসনের দিকে যা একান্ত আপনার জন্য সজ্জিত করেছে আপনার এই অধম প্রজা।”

নিদ্র ভাইয়ের কাছ থেকে পাওয়া সারপ্রাইজটা আমার কাছে রিতিমত স্বপ্ন ছিল। আমাদের প্রথম বিয়ের রাতে ওনাকে আমার মনের কথাগুলো বলেছিলাম যা ওনি মনে রেখেছিলেন । আমি হেসে ওনার হাত ধরে এগিয়ে গেলাম দোলনার দিকে।

আকাশে আজ মস্ত বড় চাঁদ উঠেছে। চাঁদের আলো ছড়িয়ে পড়েছে বেলকুনির আনাচে কানাচে। বাহিরেও বসেছে চাঁদের হাট। চারিদিক ছেয়ে আছে কুয়াশার শুভ্র চাদরে। নিদ্র ভাই আমার হাতে হাত রেখে বললেন,

–” আজকের রাতটা খুব সুন্দর তাই না এলোকেশী।”

–” শুধু আজকের রাত নয় আজকের দিনটাও সুন্দর ক্যাবলাকান্ত মশাই।”

–” উহু শুধু আজকের রাত সুন্দর। দেখো আকাশে আজ চাঁদ উঠেছে। চাঁদের রুপালি আলোয় থৈ থৈ করছে চারিদিক। ”

–” আজকের রাত এই জন্য যে আজকের রাতে আমি আপনাকে প্রথম দেখেছিলাম। মনে আছে সেই রাতে কথা?”

–” হুম বেশ মনে আছে। দক্ষিনা হাওয়ার এমনি চাঁদনী রাতে ট্রেনের দরজায় তোমায় প্রথম দেখেছিলাম এলোকেশি। ”

–” আমিও দেখেছিলাম এক ঝাঁকড়া চুল ওয়ালা ক্যাবলাকান্তকে। তারপর তার সাথে পরিচয় আর সেই পরিচয় থেকে আজ বিয়ে।”

–” হুম আমি কিন্তু তোমাকে দেওয়া কথা রেখেছি এলোকেশি।”

–” কোন কথা বলুন তো?”

–” ছোট বেলায় বলেছিলাম আমি আমার সম্পদ আমার করেই ছাড়বো। দেখো আজ আমার চাঁদ আমার পাশে। তবে আর একটা জিনিস ফিরিয়ে দেবার আছে কিন্তু……

–” কি?”

নিদ্র ভাই ধীরে ধীরে এগিয়ে এলেন আমার দিকে তারপর আমার গালে জোরে কামড় দিয়ে হাসতে হাসতে বললেন,

–” এইটাই তোমার পাওনা ছিল এলোকেশি। বলেছিলাম না সময় হলে ফিরিয়ে দিবো , ফেরত দিয়ে দিলাম তোমাকে।”

–” ইস আপনি আসলেই নিষ্ঠুর।”

–” উহু আমি নিষ্ঠুর নই আমি তোমার সেই ট্রেনওয়ালা ক্যাবলাকান্ত এলোকেশি যে তোমার শেষ সময়ের সঙ্গী হয়ে থাকবে।”

নিদ্র ভাইয়ের কথা শুনে আমি ওনার কাঁধে মাথা রেখে আড় চোখে একবার আকাশের দিকে। দেখলাম চাঁদটা আমাদের দেখে লজ্জায় মুখ লুকিয়েছে সাদা মেঘের আড়ালে। তাই আমিও হেসে নিদ্র ভাইয়ের বুকে মুখ লুকালাম। এভাবেই যেন শেষটাও সুন্দর হয় আমাদের। রাতের রুপোলি চাঁদ হেলে পড়ছে পুব আকাশের দিকে। একটু পরে আকাশের বুক চিরে উদয় হবে নতুন ভোরের। সেই সাথে শুরো হবে আমাদের নতুন করে পথচলা।

সমাপ্ত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here