শেষ অধ্যায়ে তুমি পর্ব -০২+৩

#শেষ_অধ্যায়ে_তুমি
লেখিকা: #নুরুন্নাহার_তিথি
#পর্ব-২

হঠাৎ একদিন তূর বাড়ির মধ্যেই মাথা ঘুরে পড়ে যায়। ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলে ডাক্তার দুই হাত মুঠি বদ্ধ করে বলে,

ডাক্তার: আসলে কি বলবো মিস্টার শফিক,, আপনার মেয়ের যে সিমটমস গুলো আমাকে বললেন আর আমি প্রাথামিক ভাবে দেখে যা বুঝলাম আমি মিস তূরকে কিছু মেডিকেল টেস্ট করতে দিয়েছি। যেমন: এমআরআই, সিটি স্ক্যান, ব্লাড টেস্ট, ইউরিন টেস্ট ইত্যাদি এগুলা সব করাবেন।
ডাক্তারের কথা শুনে তূরের বাবা “মিস্টার শফিক মাহমুদ” ও তূরের মা “মিসেস রাহেলা মাহমুদ” অনেকটা ভয় পেয়ে যায়। তূরের বাবা ভয় পাওয়া গলায় ডাক্তারকে বলে,

তূরের বাবা: ডাক্তার আমার মেয়ের কি খুব সিরিয়াস অবস্থা? মানে কি হয়েছে একটু খুলে বলবেন?
তূরের বাবার কথা শুনে ডাক্তার বলে,

ডাক্তার: দেখুন আমি নিজেও একজন বাবা। প্রত্যেক বাবা-মা তাদের সন্তানকে অনেক ভালোবাসে। আপনার মেয়ের কিছু সিমটমস কিন্তু মানসিকভাবে আঘাত পাওয়া কে ইঙ্গিত করে। তাই আমি আপনাকে সাজেস্ট করব আপনারা একজন সাইকিয়াট্রিস্ট এর কাছেও অ্যাপোয়েন্টমেন্ট নিন। আর সাথে যে টেস্ট গুলো আমি দিলাম সেগুলো করিয়ে রিপোর্টগুলো নিয়ে আসুন। আমি যা ভাবছি তা আমি রিপোর্ট না দেখে বলতে পারি না। মাফ করবেন আমি এর থেকে বেশি কিছু বলতে পারব না এখন।

ডাক্তারের সাথে কথা বলার পর তূরের বাবা-মা তূরের টেস্ট গুলা করিয়ে নিয়ে বাসায় যায়, কালকে রিপোর্ট নিয়ে ডাক্তার কে দেখাবে সাথে একজন ভালো সাইকিয়াট্রিস্ট এর খবর তারা নিবে।

পরের দিন সন্ধ্যার সময় রিপোর্ট নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাবে তাই সকালের দিকে তূরের বাবার বন্ধুর ভাই সাইকিয়াট্রিস্ট তার কাছে যায়।
_________

সাইকিয়াট্রিস্ট তূরকে হিপনোটাইজ করে অনেক কিছু জানতে পারে এবং সেগুলো তূরের বাবা-মায়ের কাছে বলে। তূরের বাবা-মা এসব শুনে খুব দুঃখ পায়। তাদের মেয়ে যে এতদিন নিজের মনের মধ্যেই গুমড়ে মরেছে তা তারা বুঝতে পারেনি। সাইকিয়াট্রিস্ট কথা অনুযায়ী তূরকে একা থাকতে দেয়া যাবেনা। সব সময় উনাকে সঙ্গ দেয়ার জন্য কাউকে থাকতে হবে, হাসাতে হবে, বেড়াতে নিয়ে যেতে হবে, কোনো কিছু নিয়ে চিন্তা করতে দেয়া যাবে না, মেডিটেশন করতে হবে অল্প অল্প করে সময় নিয়ে, সর্বোপরি তূরকে হাসিখুশি রাখতে হবে নাহলে তূর মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলতে পারে। কিন্তু উনাকে কিছুটা সময় স্পেসও দিতে হবে,
নাহলে কিন্তু উনি আরো ডিপ্রেশনে চলে যেতে পারে তাই তাকে কিছুটা স্পেস দেয়াটাও জরুরি। কিছু মেডিসিন দিচ্ছি যেগুলো রাতে নিতে হবে খাবার পরে এগুলা মানসিক ভাবে উনাকে কিছুটা হালকা রাখবে আর বাকি সব ডিপেন্ড করে আমি যা যা বললাম সেগুলো মেইনটেন করলে।

প্রায় বিকালের দিকে সাইকিয়াট্রিস্ট ওখান থেকে বাসায় ফিরে তূরের মা ও তূর। তূরের বাবা হাসপাতালে চলে গেছে রিপোর্ট নিয়ে ডাক্তারের কাছে দেখাবে তাই।

________
রাত প্রায় দশটার দিকে তূরের বাবা বিষন্ন ও ভারাক্রান্ত মনে বাড়ি ফেরে। তুরের মা স্বামীর এই বিষন্ন চেহারা দেখে বুকটা ধক করে ওঠে তার। তার ভাবনা এই যে, কোন খারাপ খবর এলো না তো আবার?
তড়িঘড়ি করে এক গ্লাস পানি নিয়ে তূরের মা স্বামীর কাছে যায়। পানির গ্লাস এগিয়ে দিয়ে জিজ্ঞাসা করে,

তূরের মা: কি হয়েছে তোমাকে এরকম দেখাচ্ছে কেন? কোনো খারাপ খবর না তো আবার?

স্ত্রীর কথা শুনে তূরের বাবা মনে মনে ভাবে, কি বলবো আমি যেখানে আমি নিজেই বিশ্বাস তরতে পারছি না সেখানে রাহেলা শুনলে কি করবে? তাও সত্যিটা তো বলতেই হবে,,, এটা ভেবে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে স্ত্রীর দিকে তাকায় শফিক মাহমুদ। কোন জল্পনা-কল্পনা ছাড়াই এক নিঃশ্বাসে বলে দেয়,

তূরের বাবা: রাহেলা আমাদের মেয়ে তূরের ব্রেন টিউমার।
তূরের মা কথাটা শুনে স্তব্ধ হয়ে যায়। কি শুনলো সে এটা!! স্ত্রীর মনের ভাব বুঝতে পেরে শফিক মাহমুদ আবার বলা শুরু করে,

তূরের বাবা: সাইকিয়াট্রিস্টের কথাগুলো ডাক্তারকে বলার পরে ডাক্তার কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে তূরের রিপোর্ট গুলো দেখে। রিপোর্ট দেখার পরে ডাক্তারের কথাগুলো ছিল এমন,,,,,,,,,

☆☆☆
চোখের থেকে চশমা খুলে বলে,
ডাক্তার: দেখুন মিস্টার শফিক আমি আগেই কিছুটা সন্দেহ করেছিলাম। আর সাইকিয়াট্রিস্ট তো বলেছে আপনার মেয়ে মানসিক অবসাদে ভুগছে। আর আপনার কথাগুলো শুনে বুঝলাম। আপনার মেয়ের বহু বছর যাবত নিজের মধ্যে একটু একটু করে মানসিক অবসাদটা জন্ম নিয়েছে। আর এক মাস আগে তার সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনা থেকে সে প্রচন্ডরকম স্ট্রেস নিয়ে ফেলেছে। আপনার ভাষ্যমতে আপনার মেয়ে সেন্সলেস হয়ে গিয়েছিল।
সাধারণত মানসিক অবসাদ গ্রস্থ মানুষ ব্রেন টিউমারে বেশি ভুগে অন্যসব সাধারণ মানুষের তুলনায়।
রিপোর্ট দেখে যা বুঝলাম দুইটা খবর আছে এই সিচুয়েশনে একটা ভালো খবর আর একটা খারাপ খবর।
ভালো খবরটা হচ্ছে উনার ব্রেন টিউমার Grade-1 স্টেজে আছে তাই সার্জারির মাধ্যমে অপসারণ করা সম্ভব।
খারাপ খবরটা হচ্ছে উনার হিমোগ্লোবিন লেভেল অনেক কম 5 mg/L যেখানে থাকা দরকার (12-16) mg/L. And you know it’s too much risky for brain tumor surgery. She has to increase blood haemoglobin level unless this surgery will be life risk for her.
আমাদের বায়োপসি করতে হবে। টিউমার এর সাইজ 2 cm এর কাছাকাছি। সার্জারিটা এক মাসের মধ্যে করতে পারলে ভালো হয়। উনার হিমোগ্লোবিন লেভেলটা অন্ততপক্ষে 10 mg/L থাকতে হবে আর উনি এমনিতেই অনেক দুর্বল।

_______
ডাক্তারের সাথে হওয়া সব কথোপকথন স্ত্রীকে বলে থামলেন শফিক মাহমুদ। তূরের মাতো কান্না করেই যাচ্ছে। উনার কান্নার মাঝে তাদের ঘরে এলো ছোট মেয়ে “নাফিহা”। নাফিহা প্রথমে মায়ের কান্নার কারণ ধরতে না পারলেও পরে যখন মা কান্নারত অবস্থায় সব বলল তখন নাফিহা মাকে কি বলবে সে নিজেকে সামলাতে পারছে না, কষ্টে তার বুক ফেটে কান্না আসছে। তার বড় বোন তাকে শাসন করলেও যথেষ্ট ভালোবাসে কেয়ার করে যা শাসনের আড়ালে সে লুকাতে চায়।

নাফিহা মায়ের রুম থেকে বের হয়ে মেঝো বোনের কাছে যায়। মেজো বোন “নীরা”কে গিয়ে জড়িয়ে ধরে চুপ করে থাকে।

আচমকা নাফিহার নীরাকে জড়িয়ে ধরায় নীরা হকচকিয়ে উঠে। এরকম আচমকা জড়িয়ে ধরার অভ্যাস তো তার বড় বোন তূরের। নাফিহা আচমকা জড়িয়ে ধরে না।

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে নাফিহা বলে,
নাফিহা: নীরাপু….
নীরা: হুম, বল।
নাফিহা বলতে নিয়েও ফুঁপিয়ে ওঠে। নাফিহার ফুঁপিয়ে কান্না দেখে নীরা আবার হকচকিয়ে যায়।

নাফিহা: তূর আপুর ব্রেইন টিউমার।
এটা বলে নীরাকে ধরে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে।

নীরাতো নাফিহার কথা শুনে হতবাক। কি বললো এটা নাফিহা? তার বড় বোনটার ব্রেন টিউমার!! বিকেলে শুনলো মানসিক অবসাদে ভুগছে আর এখন শুনছে ব্রেইন টিউমার!!

নীরা তূরের থেকে বছর দুয়েকের ছোট হলেও মাঝে মাঝে বাচ্চামো করা তূরের কাছে নীরা তার বড় বোন হয়ে যায়। কিন্তু তূর তার ছোট দুই বোনকে আগলে রাখে। নীরা আর কিছু ভাবতে পারে না।

_______
তূর বারান্দায় দাঁড়িয়ে গ্রিলের উপর হাত রেখে আকাশ পানে তাকিয়ে আছে গুনগুন করে গান গাইছে,
🥀🥀
“মাঝে মাঝে তব দেখা পাই,
চিরদিন কেন পাই না।
ক্ষণিক আলোকে আঁখির পলকে,
তোমায় যবে পাই দেখিতে।
ওহে ক্ষণিক আলোকে আঁখির পলকে,
তোমায় যবে পাই দেখিতে।
ওহে হারাই হারাই সদা হয় ভয়,
হারাই হারাই সদা হয় ভয়,
হারাইয়া ফেলি চঁকিতে,
আশ না মিটিতে হারাইয়া,
পলক না পড়িতে হারাইয়া,
হৃদয় না জুড়াতে হারাইয়া,
ফেলি চকিতে,
মাঝে মাঝে তব দেখা পাই,
চিরদিন কেন পাই না..
মাঝে মাঝে তব দেখা পাই,
চিরদিন কেন পাই না..
‘ওহে কী করিলে বলো পাইবো তোমারে
রাখিব আঁখিতে আঁখিতে।
ওহে কী করিলে বলো পাইবো তোমারে
রাখিব আঁখিতে আঁখিতে।’ ”
🥀🥀
গানটা গাইছে আর চোখ গড়িয়ে পানি পড়ছে তূরের। এই গানটা যেন ওর জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। মনে হয় প্রতিটা লাইন ওকে ভেবে লেখা।
সত্যি একতরফা ভালোবাসা অনেক কষ্টের হয় আর সেটা যদি দশ বছরের হয় তাহলে তো দ্বিগুণ কষ্টের।

তূরের গান গাওয়ার মাঝে নিঃশব্দে নীরা ও নাফিহা পিছোনে এসে দাঁড়ায়।
নীরার মনে এখন মিহালের জন্য একরাঁশ ঘৃণা জন্ম নিয়েছে। নীরা তূরকে অনেকবার বলেছিলো, মিহালকে ভূলে যেতে কিন্তু তূর পারেনি। নীরা তূরকে মাঝেমাঝে মিহালকে কিছু সময়ের জন্য ভুলার জন্য সেলিব্রিটি ক্রাশ খেতে দেখতো কিন্তু ওগুলো শুধু ক্রাশ ছিলো। মাঝে মাঝে নীরার মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলে তূরকে রাত জেগে কান্না করে বালিশ ভিজাতে দেখতো। কিন্তু সকাল হলে সকল কষ্ট ধামাচাপা দিয়ে এক স্বাভাবিক তূরকে দেখতো নীরা। আর আজকে সেই বোন চুপচাপ যেন একটা কাঠের পুতুল যার ভিতরটা এখন খোকলা হয়ে গেছে।

_______
রাফি একমাস যাবত ইনায়াকে প্রায় ইগনোর করে যাচ্ছে। রাফি ও ইনায়া একে অপরকে ভালবাসে এমনকি তাদের পরিবারও তাদের বিয়েতে রাজি। রাফি ও ইনায়া একই ইয়ারে পড়ে তা সত্বেও পরিবার রাজি। রাফির পরিবার খুব ভালো সে তার ভাই বোনের মধ্যে সবার ছোট এবং পরিবার ওয়েল সেটেল্ড। আমেরিকা যাবার আগে ওদের আকদ হবে এবং মাস্টার্স করে ফেরার পরে ওদের আনুষ্ঠানিকভাবে রেজিস্ট্রি হবে।

একমাস যাবত রাফির ইগনোরেন্স ইনায়া নিতে পারছেনা। তাই সে গতকাল রাফিকে মেসেজ করে বলেছে “চন্দ্রিমা উদ্যানে” যেন তার সাথে দেখা করে।

ইনায়া আসার আগে রাফি চন্দ্রিমা উদ্যানে লেকের পাশে বসে সিগারেট টানছে আর ধোঁয়া গুলো আকাশে উরাচ্ছে। ইনায়া রাফির কিছুটা কাছাকাছি এসে রাফিকে সিগারেট টানতে দেখে।

ইনায়া: এসবের মানে কি রাফি? তুমি এসব কেন করছো? আমাকে ইগনোর কেন করছো? আমি তো জানতাম তুমি সিগারেট আমার সামনে খাওনা! ফেলে দাও কিন্তু আজকে তুমি এখনও ফেলছো না! এর কারণ কি রাফি কেন এগুলো ইগনোর করছো আমায়?

রাফি ইনায়ার কথাগুলো শান্তভাবে শুনলো। এরপর জবাব দেয়,
রাফি: কই আমি তো কিছু করছি না! আমি আবার কি করলাম তোমার সাথে? আমি বিজি তাই তোমার সাথে কথা বলার সময় পাচ্ছিনা দেটস ইট।
ইনায়া: রাফি, তুমি কি তূরের ব্যাপারটা নিয়ে এখনো আমার উপর রাগ করে আছো। দেখো ওইসময় আমার কিছু করার ছিলো না। আমরা তো জানতাম বলো যে, মিহাল তানজিনাকে ভালোবাসে।

এবার রাফি নিজের রাগ সংবরণ করতে পারে না। দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
রাফি: হ্যাঁ, আমরা জানতাম! সাথে এটাও জানতাম তানজিনা মিহালকে ভালোবাসে না। তুমি তানজিনার বেস্টফ্রেন্ড হয়ে এটাও জানতে তানজিনা কোনদিনই মিহালকে ভালোবাসবে না। তানজিনা নিজের ক্যারিয়ার পড়াশোনা এসব ভালো বুঝে। এটা বলতে পারো তুমি আমাকে যে তানজিনা কি তাহলে কখনো বিয়ে করতো না? এর উত্তর হবে হ্যাঁ করতো কিন্তু মিহালের মত জীবনসঙ্গীকে করতো না। তানজিনার জন্য হয়তো মিহাল পারফেক্ট কিন্তু মিহালের জন্য তানজিনা পারফেক্ট না। মিহালের কোনো কিছুতে তানজিনার
কিছু যায় আসে না।

ইনায়া: —–
রাফি: তুমিই তো বলেছিলে ইনু যে তানজিনা মিহালের ফিলিংস জানে কিন্তু এতে ওর কিছু যায় আসে না! তাহলে ঐদিন তুমি কেন মিহালের কথায় সায় দিলে? কেন মিহাল কে বললে না তানজিনা মিহালের ফিলিংস জেনেও এসবে তোয়াক্কা করে না।

শেষের কথাগুলো রাফি অনেকটা চিল্লিয়ে বলল। ইনায়া তো রাফির কথা শুনে বাকরুদ্ধ। ইনায়া এখন বুঝতে পারছে মিহালের কথায় সায় দিয়ে ঠিক করে নি। ওই সময় তার মিহালের ভালবাসাটাকে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছিল আর ভেবেছিল তার বেস্টফ্রেন্ড একটা ভালো ছেলেকে লাইফ পার্টনার হিসাবে পাবে।

রাফি আবার বলা শুরু করে,
রাফি: জানো ইনু? কালকে আমরা সবাই মিলে হোয়াটসঅ্যাপে গ্রুপ কল করিছিলাম তূরকে তখন তূরের বোন নীরা ফোন রিসিভ করে আর বলে,,,

কথাটা বলতে গিয়ে রাফির গলা কেঁপে উঠছে। ইনায়া উৎসুক চোখে উৎকণ্ঠতা নিয়ে তাকিয়ে আছে।

রাফি: তূরের নাকি ব্রেইন টিউমার সাথে ও মেন্টাল কন্ডিশন খারাপ । ডাক্তার বলেছে সার্জারি করতে হবে কিন্তু ওর ফিজিক্যাল এন্ড মেনটাল কন্ডিশন খুব উইক তাই রিস্ক আছে।

রাফির কথা শুনে ইনায়া হতবাক। ইনায়া মনে মনে ভাবছে, সে কি করলো এটা? সে তো জানতো তূর মিহাল কে কতটা ভালোবাসে এমনকি ততটা মিহালও তানজিনাকে ভালোবাসে না।

ইনায়া নিজের করা কাজে অনুতপ্ত। সে এই একমাসে এটা বুঝেছে ইগনোরেন্স কেমন লাগে! তূর কিভাবে দশ বছর এটা সহ্য করেছে।
#শেষ_অধ্যায়ে_তুমি
লেখিকা: #নুরুন্নাহার_তিথি
#পর্ব-৩ (বোনাস)

( নিচের মন্তব্যের লেখা গুলো প্লিজ পড়বেন)

রাফির কথায় ইনায়ার ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসে।

রাফি: ইনু, তূর আমার নিজের বোন না হলেও বোনের থেকে কম না। আমার ছোট বোনের শখ ছিল অনেক আর তূর সেই জায়গাটা নিজের অজান্তে নিয়ে নিছে।
এটুকু বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রাফি। ইনায়া রাফির চোখে তাকিয়ে আছে যেখানে বোন হারানোর কষ্টরা ধরা দিচ্ছে। রাফি আবার বলা শুরু করে,

রাফি: তুমি তোমার বান্ধবীর ভালো চেয়েছ। এদিকে আমি আমার বোনের মতো বান্ধবীর ভালো চাই। এখানে তুমি দোষি না আবার একেবারে নির্দোষও না। মিহাল তানজিনাকে ভালোবাসে কিন্তু এর গভিরতা কতটা আমরা জানিনা শুধু এইটুকু জানি মিহালের আত্মসম্মানবোধ প্রচুর। এই আত্মসম্মানবোধে কেউ আঘাত করলে সে অনেক রেগে যায় আর তখন রাগ কন্ট্রোল করতে পারে না।

ইনায়া: মিহাল তখন নিজের মানুষদের কেই কষ্ট দিয়ে ফেলে।
রাফি: তোমার মনে আছে তুমি আমাকে একটা কথা বলেছিলে দুই বছর আগে!!
ইনায়া: কি?
রাফি বাঁকা হেসে বলে,
রাফি: তানজিনা নাকি কলেজে একবার মিহালের থেকে ফিজিক্সে আট নাম্বার কম পেয়েছিলো স্যারের ভুলের কারণে। তখন..

ইনায়া রাফিকে বলতে না দিয়ে নিজেই বলে,
ইনায়া: তখন তানজিনা স্যারের সাথে তর্ক জুড়ে দেয় যে কেনো মিহালকে দুই নাম্বার বেশি দিলো আর তার দুইটা প্রশ্নে নাম্বার দিলো না? পরে স্যার নিজের ভুল বুঝতে পেরে ঠিক করে দিয়েছিলো। তখন তানজিনা ও মিহালের নাম্বার সমান সমান।
এই কান্ডে আমি, তূর ও ইতি অবাক হয়ে তানজিনার তর্ক করা দেখছিলাম। মিহাল তখন মূর্তির মত স্যারের আরেক পাশে দাঁড়িয়েছিল।

ইনায়ার কথা শুনে রাফি বাঁকা হেসে মনে মনে বলে,,,
” ইনু তুমি তো জানো না ওই ঘটনা মিহালের আত্নসম্মানবোধে লেগেছিল।”

ওইদিনের মতো তারা দুইজন সব মিটমাট করে যাওয়ার আগে ইনায়াকে রাফি বলে যাতে মিহাল ও তানজিনা কাউকেই তূরে অসুস্থতার কথা না জানায় আর ইনায়াও সম্মতি দিয়ে চলে যায়। দুইদিন পরে তূরের বাসায় সবাই যাবে তূরকে দেখতে।

________

তূরের বাসায় সবাই তূরের পাশে বসে আছে। সবাই ওর দিকে তাকিয়ে আছে।
তূরকে প্রথমে বাবা-মা রিপোর্ট দেখাতে চায় নি কিন্তু তূরের ভাবলেশহীন ভাবে চোখের দিকে তাকিয়ে থাকা দেখে বাধ্য হয় তূরের বাবা তুরকে রিপোর্ট দেখাতে। ডাক্তারকে রিপোর্ট দেখানোর চার দিন হয়ে গেছে।
তূরের এই চুপচাপ সবার মাঝে বসে থাকাটা কারোই ভালো লাগছে না। প্রথমে জারিন মুখ খুললো,
জারিন: কি অবস্থা করছিস নিজের? এভাবে ভেঙে পড়লে হবে? তোর সার্জারি টা যে রিস্কি তা তো জানিস।

ফাইজা: বায়োপসি তো কালকে করবে। তূর প্লিজ সার্জারির আগে তোকে ফিট হতে হবে। মিহালের কথা কতো ভাববি? বিয়ে করে তো সে সুখেই আছে।
ফাইজার এই কথাটা শুনে ওর অর্ক ও রাফি একে অপরের দিকে তাকিয়ে বাঁকা হাসলো।

তাওহিদ: একটা অবুঝ ছেলের পেছনে তুই এতো গুলা বছর নষ্ট করলি। যে তোকে এভাবে ভেঙে দিলো।

তাওহীদের কথা শুনে লিরা বলে,
লিরা: আঙ্কেল আন্টির কথাটাও একটু ভাব। উনারা এই বৃদ্ধ বয়সে মেয়েকে এভাবে দেখে কিভাবে আছে সেটা ভাব।

মজার ছলে নাদিয়া বলে,
নাদিয়া: দেখ তূর জলদি জলদি সুস্থ হয়ে যা আমার বিয়েতে কিন্তু তোকে থাকতে হবে। নাহলে আমার জামাইকে আমি ছেকা দিবো! হুহ!

নাদিয়ার কথা শুনে সবাই হেসে ফেলে তূর নিজেও মলিন হাসে।

রুমের একপাশে ইনায়া চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে তূরকে দেখছে। মেয়েটার অবস্থা দেখে মায়া হচ্ছে।
যে তূর পুরো ফ্রেন্ডসার্কেল মাতিয়ে রাখতো সেই তূর এতো চুপচাপ! তূরের বাচ্চামো দুষ্টামি দেখে কেউ বলতে পারতো না তূর মনের মাঝে এত দুঃখ পুষে রেখেছে।

আর এদিকে রণক! এক মাস আগে নিজের মনে করা প্রশ্নটা আজ উত্তর দিয়ে দিল ওর নিজেরই মন। রণক ভাবে,
রণক: আমি তূর কে কি ভালোবেসেছি আমি জানি না। কিন্তু তূরের ভালোবাসা মাপতে পারবো না। মিহাল তুমি আনলাকি ছিলে যে এতো ভালোবাসে সেই মানুষটাকে অবহেলায় হারালে।
কথাটা ভেবে মনে মনে দীর্ঘশ্বাস নেয়।

এভাবে কিছুক্ষণ কথা বলার পর অর্ক রাফিকে চোখ দিয়ে ইশারা করে কিছু। ইশারা বুঝে রাফি ইনায়ার কাছে যায়,
রাফি: ইনু, তুমি এভাবে দাঁড়িয়ে আছো কেন এক কোণে? চলো একটু ছাদে যাই।
রাফির কথা শুনে ইনায়া মাথা হেলিয়ে সম্মতি দিয়ে ছাদে চলে যায়।
রাফি যাবার পর অর্ক তূরকে বলে,
অর্ক: তূর শোনতো একটু।

অর্কর ডাকে তূর অর্কর দিকে তাকায়। তারপর বলে,
তূর: বল।
অর্ক: এখানে না একটু বারান্দায় আয়।

তূর অর্কের কথামতো বারান্দায় যায় ওর সাথে। বারান্দায় যাবার পর অর্ক বলে,
অর্ক: কথাটা তোর জানা উচিত। তানজিনার ছবি আমি আমার মামাতো বোনকে দেখিয়েছি। আমার মামাতো বোন সরোয়ার্দি মেডিকেলের নার্স। তাকে বলেছিলাম তানজিনার ব্যাপারে খোঁজ খবর নিতে।

অর্কের কথা গুলো তূর ভাবলেশহীন ভাবে শুনছে।তূরের এই ভাবলেশহীনতা অর্কর চোখে ধরা পরে তা দেখে অর্ক মুচকি হাসে কারণ সে জানে এখন সে যা বলবে তা শুনে তূর কিছু একটা রিয়াক্ট করবেই। এমনও হতে পারে কথাটা শোনার পর তূর অনেকটাই মানসিক ভাবে খুশি হয়!!

কারণ যে মেয়ে দশ বছর যাবত কষ্টে কেঁদেও সূর্যের আলোয় হাসিখুশি তার জন্য এই কথাটা কিছুটা প্রভাব তো ফেলবেই। শুধু ঐ একটা জোরালো ধাক্কা তূরকে গুঁড়িয়ে দিয়েছে। সুইসাইড তূর কখনো করবে না কারন তূর নিজের বাবা-মা ও পরিবারের প্রতি দায়িত্ব থেকে নিজের ইচ্ছায় পালাবে না যদি মহান আল্লাহ তায়ালা তাকে মৃত্যুর পথে না ডাকে তো।

ভনিতা ছেড়ে অর্ক বলে,
অর্ক: সরোয়র্দি মেডিকেলে একজন বিদেশ থেকে পিএইচডি ডিগ্রি ধারি ডাক্তার এসেছে তিন মাস আগে। সেই ডাক্তার সরোয়ার্দি মেডিকেল থেকে এমবিবিএস শেষ করে জার্মানিতে যায়। সে “ডক্টর আরিফ জুবায়ের” অনেক ভালো নামকরা হার্ট সার্জন। তাঁর আন্ডারে ইন্টার্ন ডক্টার হিসেবে কাজ করছে তানজিনা। ডক্টর আরিফ সুদর্শনও বটে।

কথাটা বলেই সরাসরি তূরের দিকে ঘুরে তাকায়।
তূর অর্কর কথায় কিছু বুঝতে পারছে না কিন্তু কিছু যে ইঙ্গিত দিচ্ছে তা বোঝা যাচ্ছে। তূর এবার অর্কর চোখের দিকে তাকায়।

“সাইকোলজি বলে মানুষের চোখ কখনো মিথ্যা বলে না।”

তূরের চোখে জানার আগ্রহ দেখা যাচ্ছে। এবার অর্ক সরাসরি মূল কথায় আসে,
অর্ক: ওই ডাক্টার তানজিনা কে পছন্দ করে। আর তানজিনাও কাজের ছলে বা কিছু না কিছু করে সব সময় তার সাথে সাথেই থাকে।

এবার তূর বুঝে যায় অর্ক কি বলতে চাচ্ছিল এতক্ষণ ধরে। তূর স্বগোউক্তি করে বলে,

” মাকড়সা তার আপনা জালেই ফাঁসে।”
তূর বাঁকা হেসে আকাশ পানে তাকায়।

_________

দেখতে দেখতে এসে যায় সার্জারির সময়। তূরের সার্জারির তিন দিন আগে তূরের কথা মতো আসফি মিহালকে তূরের অসুস্থতার কথা বলে এবং বলে তিনদিন পর তূরের সার্জারি। ইনায়াকে বলা হয় তানজিনাকে জানাতে।

ইনায়া তানজিনাকে জানানোর পর তানজিনা খুব দুঃখ পায় তূরের জন্য। সার্জারির আগে তানজিনা তূরকে এক পলক দেখতেও পারবেনা কারণ তানজিনা এখন বান্দরবন গেছে মেডিকেল ক্যাম্পিং এর জন্য। সে যেহেতু ডক্টর আরিফ জুবায়েরের আন্ডারে ইন্টার্ন তাই সেখান থেকে ক্যাম্পিং শেষ হবার আগে ফিরতে পারবে না। পনেরো দিনের মেডিকেল ক্যাম্পিং মাত্র সাত দিন হলো। এই মেডিকেল ক্যাম্পিংয়ে যদি তানজিনা ভালো করতে পারে তাহলে সে ডক্টর আরিফ জুবায়েরের সাথে সার্জারিতে অ্যাসিস্ট করতে পারবে। এতোদিন সার্জারিতে অ্যাসিস্ট করতোনা কারণ ডক্টর আরিফ জুবায়েরের কাউকে সার্জারিতে নিতো না হাসপাতালের অন্যান্য ডাক্তারদের নিতো আর তাদের সিনিয়র ইন্টার্নদের নিতো।

তূরের অসুস্থতার কথা শুনে মিহাল ও তার বাবা-মা হাসপাতালে আসে। মিহাল ভাবতেও পারেনি তূরকে কখনো এই অবস্থায় দেখবে। মিহালের বাবা-মা তূরকে অনেক ভালোবাসে এমনকি তূরের বাবা-মা এর সাথেও ভালো সম্পর্ক। তারা তো তূরকেই পুত্রবধূ করতে চেয়েছিলো।

হাসপাতালেই মিহালের জীবনের মোড় ঘুরে যায়।

চলবে,

রিডিং❤।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here