#শেষ_চৈত্র [০৪]
বিয়ের একদিন যেতে না যেতেই আমার বর আমাকে শাশুড়ীর সাথে থাকার বন্দোবস্ত করে গেলো। মাথার রক্ত কতটা টগবগে গরম হলে মানুষ এমন কান্ড করতে পারে?
আমি সবকিছু শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিলাম। এদিকে আমার শাশুড়ীর মুখটা একদম ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। নিশ্চিত আমাকে ধমকাতে চাচ্ছেন, কিন্তু নতুন বলে বিষয়টা হজম করার চেষ্টা করছেন । কিন্তু তিনি যে ছাড় দেওয়ার মানুষ না, তা মুখ দেখলেই স্পষ্ট ধারণা নেওয়া যায়।
তিনিও বিরক্তিকর ভাব নিয়ে বের হয়ে গেলেন।
আমি একা একা কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম। তারপর আমার শাশুড়ীর বিছানার উপর বসলাম।
আজকেই আমার বাড়িতে চলে যেতে ইচ্ছে করছে, কিন্তু আজকে আমাকে কেউ নিতে আসবে না, কালকে এখানে ছোটখাটো আয়োজন হবে, আর ফেরযাত্রা হবে।
শাশুড়ীর রুমেই কিছুক্ষণ একা একা পায়চারি করলাম। তারপর আমি ধিরে ধিরে রুম থেকে বের হলাম।
বের হয়ে কিছুদূর যেতেই দেখতে পেলাম একটা চার বয়সী বাচ্চার আঙুল ধরে একজন মহিলা দাঁড়িয়ে আছে। বয়স্কও বলা যায়না আবার জোয়ানও বলা যায়না। আমার ননদের মতো বয়স। আমাকে দেখেই বলে উঠলো,
‘ কি বউ কই যাইতাছিলা?
আমি অদ্ভুতভাবে মিলিয়ে ফেললাম এই কন্ঠস্বরটা। কালকে যে আমাকে বলছিলো অমিত আগে একটা বিয়ে করছিলো, উনিই সেই ব্যক্তি। আমি মুচকি হেসে বললাম,
‘ অই আম্মার কাছে আইছিলাম। আপনি কই যান?
উনি আমার কাছে এসে একটু ফিসফিস করে বললো,
‘ তোমারেই দেখতে আইলাম। তা অমিতের আচার আচরণ কেমন দেখলা?
এমনি পেছন থেকে আমার ননদ দ্রুতবেগে আগাতে আগাতে বললো,
‘ রত্না নয়া বউয়ের লগে এতো ফুসুরফাসুর করবা না। তাইলে কইলাম ভাইয়ে তোমারে ঠাডাইয়া একটা মাইরা দিবো।
রত্না নামের এই মহিলাটা এটা শুনেই আমার দিকে চোখ রাগান্বিত করে তাকালো, অপমানবোধও স্পষ্ট। তারপর ঘটঘট আওয়াজ তুলে বাচ্চাটাকে নিয়ে চলে গেলো। হয়তো ভাবছে আমি উনার সম্পর্কে কিছু বলেছি। কিন্তু আমি উনাকে মাত্রই স্বচক্ষে দেখলাম। উফফ! অমিতের বোনের জন্য কিছু প্রশ্ন করার মোক্ষম সুযোগ হাতছাড়া হয়ে গেলো। নাহলে অমিতের ব্যপারে কিছু জিজ্ঞেস করা যেতো। আসলেই ঘটনা কি!
এদিকে যাওয়ার জন্য কোনো ঘর খুঁজে পাচ্ছিনা। অমিতের ভয়ে কেউ আমার আশেপাশে ভিড়তেও ভয় পাচ্ছে। রাতে যেখানে ছিলাম সেখানে যাওয়াটাকেও এখন সঠিক মনে হচ্ছে না। ওটা তো অমিতের ঘর, আর অমিত তো ইনডিরেক্টলি আমাকে ওখানে থাকতে নিষেধই করে দিলো।
এদিকে ওদিকে শুধু উঁকি মারছিলাম, কয়েকজন আমাকে দূর থেকে নজর করছিলো কিন্তু সামনে আসতে সাহস করলোনা।
এমনো হতে পারে অমিত সবাইকে সরাসরি মানা করে দিয়েছে আমার সাথে কথা বলতে। উনার কোনো গোপনীয়তা যেন ফাঁস না হয়।
কিন্তু আমি যেভাবেই হোক জেনে ছাড়বো, আমাকে যতটা অবুঝ ভাবছে আমি ততটাও অবুঝ না। উনার রহস্য উদঘাটন না করে আমি থামবোনা।
উপায়ন্তর না দেখে শাশুড়ীর রুমেই এসে বসলাম আবার। খাবারের সময় গিয়ে খেলাম।
সারাদিনে অমিত আর এই ঘরে আসেনি।
দুপুরের দিকে শুনছিলাম উনার বোনকে বলছে, চৈতি খেয়েছে?
উনার বোন জবাব দিয়েছিলো, জ্বী খাইছে।
রাত হলো। আমি এখনো ওইঘরে যাইনি। শাশুড়ীর সাথেই আছি। রাতের বেলা অমিত কি মনে করে যেন এলো। আমার শাশুড়ী তখন রান্নাঘরে। এসে দরজা থেকেই জোরালো গম্ভীর স্বরে বললো,
‘ আম্মার সাথে বেয়াদবি করবেনা। কিছু করলে ভালো হবে না বলে দিলাম।
তারপর আমার জবাব পাওয়ার আগেই হনহনিয়ে চলে গেলো।
কতো অদ্ভুত মানুষরে! বিজলীর মতো আসে,
বাজ এর মতো কিছু বলে, তারপর সাথে সাথেই উধাও হয়ে যায়।
রাত ১০ টার দিকে আমার শাশুড়ী এসে পানের বাটা নিয়ে বসলেন পান বানাতে বানাতে বললেন,
‘ দেহো আমি পানের লগে কোনডা কোনডা কট্টুক কইরা খাই। বানাইয়া দিতে কইলে পারতে হইবো।
আমি মাথা নাড়িয়ে আগ্রহের সহিতই দেখলাম। পান সাজানো অবশ্য ব্যাপার না।
পান সাজানোর পর ভাঁজ করে উনি মুখে পুরলেন। তারপর গালের এপাশ ওপাশ নিয়ে চিবুতে চিবুতে আমাকে বললেন,
‘ হুনো জামাইরা হয়ছে বউয়ের রতন। এই রতন অমূইল্য । জামাইয়ের পাওয়ের তলেও শান্তি বুজ্জো?
আমি মাথা দুলিয়ে সায় দিলাম।
এর পরেই উনি ধাঁচের সাথে বলে উঠলেন,
‘ তাইলে জামাইরে কষ্ট দিলা কেরে? হে চেইতা তোমারে আমার লগে থাকতে কইলো কেরে?
আমি ঢোক গিলে বললাম,
‘ আমার কোনো দোষ নাই আম্মা। উনারই তো মেজাজ চড়া। কিতা করে কিতা না! হুদাই আমারে দোষ দিয়া এনে দিয়া গেলো। আরেকটা বিয়ার কথা গোপন কইরা আমারে যে বিয়া করছে, হেই দোষ দেহেনা। আমি কইছি বইলাই ক্ষেইপা গেছে।
আমার কথায় উনি চোখ লাল করে তাকালেন। জোর গলায় বলে উঠলেন,
‘ ও মাগো। হের লাইজ্ঞাই তো কই অমিতে এরম করলো কেরে? হেতো এক থাপ্পড়েই সোজা বানাইয়া
ফালানোর কথা। কিন্তু এতো চরম বেয়াদব মাইয়া। যা-তা কইয়া ফালায়।
আমি উনার কথা শুনে কেঁদে ফেললাম। কাঁদতে কাঁদতে বললাম,
‘ এই বাড়ির হগল লোক এক কিসিমের।
আমার শাশুড়ী রাগে আরো কিছু বলতে গিয়েও আমার কান্না দেখে থেমে গেলো। মনে হয় বাকি রাগটা জমিয়ে রেখেছে অমিতকে বলার জন্য। আমি কিছু না বলে চুপচাপ পেছন ঘুরে শুয়ে পড়লাম। আজকে ঘুম আসছেনা, ভয় করছে। উনার সাথে জবাব দেওয়াটা আমার উচিত হয়নি। আসলেই বেয়াদবি করে ফেলছি নাতো?। কিন্তু অযথা আমাকে দোষ দিবে কেন? আমি তো কিছু করি নাই। অমিত বিয়ে করছে এটা আমি বললেই আমি বেয়াদব? ওরা গোপন করছে কেন তাইলে? বলেকয়েই সমন্ধ পাকা করতে পারতো!
পরেরদিন সকালে যখন আমার শাশুড়ী ঘুম থেকে উঠলো তখন বলতে পারি। উঠে নামাজ পড়ছে। আমিও সাথে সাথে নিজ ইচ্ছেয় উঠে পড়ছি।
নামাজ পড়ে কিছুক্ষণ জায়নামাজে বসে জিকির করলো। তারপর আমাকে কিছু না বলে রান্নাঘরের দিকে চলে অগ্রসর হলো।
এদিকে আমিও পেছন পেছন গেলাম। যেভাবেই হোক উনাকে রাতের বিষয়টা ভুলাতে হবে, অমিতকে বললে যদি আমার উপর ক্ষেপে যায়?
এমনি আমাকে ওয়ার্নিং দিয়ে গিয়েছিলো, যেন বেয়াদবি না করি! এরপরও আমি বেয়াদবি করেছি শুনলে ছুড়ি দিয়ে জিহ্বাটাই কেটে ফেলবে।
সব কাজ আমি আগ বাড়িয়ে করতে লাগলাম, দেখি মন জয় করা যায় কিনা। কিন্তু উনি একবারও আমার দিকে তাকায়না, কথাও বলতে চায়না। আমি জোর করে করে এটা সেটা করছি। এমন করতে করতে রান্না প্রায় শেষের দিকে।
আমি নিজে থেকে একটা একটা করে গোছাচ্ছিলাম। তখনি দরজা দিয়ে দূর থেকে দেখলাম অমিত ব্রাশ হাতে নিয়ে বের হচ্ছে। আমার শাশুড়ীও এটা দেখলো ধিরে ধিরে আমাকে রেখে চলে গেলো।
আমার বুক ধড়ফড় করছে,নিশ্চিত অমিতকে বলতে চাচ্ছে। আমি তরকারির কাঠি হাতে নিয়েই পা টিপে টিপে একটু এগিয়ে গিয়ে কান পাতলাম।
যা ভাবছিলাম তাই হলো।
আমার শাশুড়ী বলতেছে,
‘ অমিত বউ এইডা সুবিধার না। আমার লগে রাইতে রাখতে পারুম না। যেসব কথা কয়! কার লগে কেমনে কথা কওন লাগে জানেইনা যেরুম। বেয়াদব!
অমিত কি জবাব দেয় এটা যেন আমি শুনতে চাচ্ছিনা, জানি নিশ্চয়ই খুব খারাপ জবাব দিবে। এরপর আমার সাথে কি হয় আল্লাহ জানে!
কিন্তু আমার চিন্তা বদলে দিয়ে অমিত বললো,
‘ আম্মা তুমি কি বুঝোনা? চৈতি এখনো ছোট। ওর কি এতকিছু বুঝার বয়স হয়েছে? একটু ছাড় দিয়ে চলবেনা? এইটাও আমাকে বলে দিতে হবে? আর শুধু শুধু ও তোমার সাথে বেয়াদবি করবে কেন?
আমার শাশুড়ী চুপ করে রইলো। আমি কাঠি হাতে হাসিমুখে সরে আসলাম। আবার কাজে মন দিলাম। অমিতকে খুব ভালো লাগছে এখন।
আমার শাশুড়ী বুঝতে পারেনি আমি যে উনার পেছন পেছন গিয়েছিলাম। তিনি মুখ ভার করে রান্নাঘরে প্রবেশ করলেন।
আমি উনার দিকে তাকিয়ে আস্তে আস্তে চলে বের হয়ে গেলাম। অমিতের উপর একটা আস্থা পাইছি।
আমি খুশিতে ভুলেই গেলাম ওইঘরে নিজে থেকে আর না যাওয়ার শপথ নিয়েছিলাম। সব ভুলে উনার রুমে চলে গেলাম।
ফ্রেশ হয়ে অমিত আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মুখ মুছতেছে। আমাকে দেখে বললো,
‘ আজকে তুমি রান্না করছো?
আমি মাথা নেড়ে বললাম,
‘ হু আম্মার লগে।
তারপর অমিত গামছাটা দড়িতে নাড়তে নাড়তে বললো,
‘ আম্মার সাথে সাথে থাকবে, দেখবে কয়দিনে সব শিখে গেছো।
আমি পূর্বের খুশির চোটে আধিখ্যেতা করে বলে ফেললাম,
‘ আমি তো থাহি, কিন্তু আম্মা জানি কিরম ত্যাড়ামি করে। ভালো করে কথা কয়না।
অমিত রাগী চেহেরায় আমার দিকে ফিরে ধমকের সাথে বললো,
‘ আম্মা ত্যাড়া আচরণ করে মানে? আম্মা ত্যাড়া আচরণ করে মানে কি হ্যাঁ? কোনো কারণ ছাড়া করে? এমন কিছু করো কেন যাতে উনি এমন করবে? আম্মা যাই করুক তার নামে কোনো অভিযোগ তুলবেনা। তুললে তোমার উপর আমার হাত উঠবে।
বলেই রাগে গড়গড় করতে করতে বেড়িয়ে গেলো। ব্যাপারটা কি হলো বুঝলাম না।
ওখানে আম্মাকে ধমক দিয়ে বুঝে চলতে বললো, এদিকে আমাকে ধমকে বললো এমন কিছু যাতে না করি, যাতে উনি রাগ করেন! উনি আসলে অভিযোগ করার সুযোগ কাউকেই দিবেনা? আমাকে মায়ের নামে কিছু বলতে দিবেনা, মা’কে আমার নামে বলতে দিবেনা?
খেয়াল করে দেখলাম উনার এই ব্যপারটা ভয়ংকর রকম সুন্দর !
একপাক্ষিক নন কোনোদিকেই, প্রশয় দেননা সেটার।
দুদিকেই সমানতালে সম্মান বজায় রাখতে চান।
চলবে….
লেখাঃ #তাজরীন_খন্দকার