#শ্রাবণের_শেষ_সন্ধ্যা
#২২তম_পর্ব
শান্তের কথাটা যেনো নবনীতার বুকে শীতল পরশ বুলিয়ে যায়। এক উষ্ণ ওম ছুয়ে যায় মনের ব্যালকানিতে। হুট করেই শান্তের হাতের দিকে নজর যায় নবনীতার। খানিকটা অস্থির হয়ে বলে,
“আপনি ব্যাথা কিভাবে পেলেন? হাত তো ফুলে ঢোল হয়ে গিয়েছে। রক্ত ও জমে গিয়েছে।“
নবনীতার প্রশ্নে নড়ে চড়ে উঠে শান্ত। খানিকটা অপ্রস্তুতও হয়ে পড়ে সে। কপালে ঘাম জমতে লাগে হালকা। তার মনেই ছিলো না তার হাত ফুলে নীল হয়ে গিয়েছে। জোর পূর্বক হাসি টেনে বলে,
“এ কিছু না, হয়তো কোথাও ব্যাথা ট্যাথা পেয়েছিলাম। মনে আসছে না।“
“মিথ্যে কথা বলছেন কেনো?”
নবনীতার প্রশ্নে মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে যায় শান্তের। মনে ভয়ের সূক্ষ্ণ রেখা ভেসে উঠে, ধরা পড়ে যাবার ভয়। নিজেকে যথেষ্ট স্বাভাবিক রেখে হাসি মুখে বলে,
“মিথ্যে বলবো কেনো? আমার সত্যি ই মনে নেই। আর এটা খুব সামান্য চোট, পেইন কিলার নিলেই ঠিক হয়ে যাবে।“
নবনীতা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে শান্তের দিকে। শান্ত সেই দৃষ্টি এড়িয়ে নবনীতাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে, কাঁধ রাখে থুতনি। তারপর আবেগঘন কন্ঠে বলে,
“আমার জন্য বুঝি তোমার চিন্তা হচ্ছে?”
“চিন্তা হওয়াটা কি অস্বাভাবিক?”
“মোটেই না, বরং আমার ভালো লাগছে। এই অনুভূতিটা নতুন। জানো নবনীতা, আমি বাবাকে দেখি নি। মায়ের মাঝে বাবাকে পেয়েছি। আমার মা কোমল মমতাময়ী নন, বরং একজন কঠিন নারী। আমি যখন চোট পেতাম, তিনি কখনোই আমাকে আদর করে মাথায় হাত বুলিয়ে দেন নি। উলটো মলম, হেক্সাসল, ডেটল দিয়ে বলতেন “পরিষ্কার করে নাও। নিজের ক্ষত নিজে ভরতে শেখো। নয়তো এক সময় যখন কাউকে পাশে পাবে না, ক্ষততে পঁচন ধরবে।“ আজ প্রথম আমার জন্য কাউকে ব্যস্ত হতে দেখেছি। ভালো লেগেছে।“
নবনীতা চুপ করে শান্তের কথা শুনতে লাগলো। লোকটাকে আজকাল ভালো লাগে, তার কথা, তার যত্ন, তার রাগ, তার সাথে ঝগড়া, তার স্পর্শ সব কিছু ভালো লাগে নবনীতার। কোথাও না কোথাও একটা টান অনুভব হয়। এক অনন্য নেশা, যা ধীরে ধীরে তার রক্তে মিশছে। এই লাল-নীল অনুভূতিগুলো মনে দোলা দেয়। মনের অজান্তেই মনের এক কোনায় নিজের ঘর বানিয়ে নিয়েছে লোকটা। অনিচ্ছা স্বত্তেও মনের একাংশ দখল দিয়েছে তাকে। এটাকে কি বলে ভালোবাসা? জানা নেই নবনীতার। তবে এটুকু জানে, শান্তকে ছাড়া এক মূহুর্ত ও কল্পনা করা দূর্বিসহ তার জন্য। শান্ত যেনো এক মায়ার জাল, যে জালে ধীরে ধীরে জড়াচ্ছে নবনীতা। অদ্ভুত ব্যাপার, তার কোনো দ্বিধা নেই, সে এই জালেই সারাটা জীবন আটকে থাকতে চায়। সারাটাজীবন___________
রাত ২টা,
নবনীতা ঘুমে কাঁদা, তার ঠিক পাশেই বালিশে হেলান দিয়ে বসে আছে শান্ত। কোলে ল্যাপটপ কিন্তু নবনীতার ঘুমন্ত মুখের দিকে চেয়ে আছে সে। স্নিগ্ধ মুখটাকে দেখতেই ইচ্ছে করে শুধু। এবার চোখ সরিয়ে হাতের দিকে নজর দেয়, মলম লাগিয়ে দিয়েছে নবনীতা। মেয়েটার কোমল স্পর্শ হাতে লেগে আছে ভাবতেই মুখে হাসির প্রলেপ গাঢ় হয়ে যায়। বাহাতে নবনীতার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়, তারপর তার সাপের মত লম্বা চুলগুলোর সাথে খেলতে থাকে। হাসিটা আগের ন্যায় রেখে ধীর স্বরে বলে,
“সে হাত তোমাকে ছুতে চেয়েছে, সেই হাত আমি ভেঙ্গে দিয়েছি শ্যামলী। যে লোলুপ দৃষ্টি তোমাকে ছুতে চেয়েছে সেই দৃষ্টি এখন ঝাপসা। আমি কখনোই তোমাকে ছেড়ে যাবো না শ্যামলী। শুধু ভয় হয়, আমার ভেতরের এই রুপটা তোমার সহ্য হবে তো?”
শান্তের হাসি যেনো গায়েব হয়ে যায়, ললাটে চিন্তার রেখা ভাসে। ভ্রু যুগল একত্রিত হয়ে আসে। ভয় হয়, তবে সেই ভয় বেশিক্ষণ টিকসই হলো না। ফোনটা অমানুষের মতো বাজতে লাগলো। যা শান্তের চিন্তাকে চূর্ণবিচূর্ণ করে ফেললো। একেই অসময়ে ফোন উপরে স্ক্রিনে নামটা দেখতেই মাথার ভেতরে সুপ্ত লাল আগুনটা ধপ করে জ্বলে উঠলো। চোয়াল শক্ত করে রুঢ় কন্ঠে বললো,
“কিছু বলবি নীলয়? এতো রাতে হঠাৎ আমাকে স্মরণ হলো?”
শান্তের কন্ঠ শুনে নীলয় হাসলো, তারপর বললো,
“ডিসটার্ব করলাম নাকি? আসলে এতো রাত হয়েছে মনে ছিলো না।“
“তোর যদি বলার কিছু না থাকে তাহলে ফোনটা রাখছি।“
“খুব ব্যাস্ত নাকি?”
নীলয়ের ঠেস দিয়ে বিদ্রুপের স্বরে বলা কথাগুলো গায়ে আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে শান্তের। নীলয়ের সাথে কথা বলতে ঘৃণা হচ্ছে তার। এতো জগন্য তার ভাই, এটা ভাবলেই গা গুলিয়ে আসে। তবুও দাঁতে দাঁত পিষে কথা বলতে হচ্ছে। শান্ত রাগ সংযত রেখে শীতল কন্ঠে বলে,
“ফোন কেনো করেছিস?”
“তোমার সাথে দেখা করতে চাই।“
“কেনো?”
“সেদিন শপিং মলের সত্যিটা জানতে চাই।“
নীলয়ের কথায় বাকা হাসি হাসে শান্ত। তারপর বলে,
“আগামীকাল সন্ধ্যা ৭টা, গুলসানে চলে আসিস। আমি ওখানেই থাকবো”
বলেই ফোনটা কেটে দেয় শান্ত। এখন আর লুকোচুরি নেই। সত্য তার চোখের সামনে। তাই নীলয়কে বলতেও দ্বিধা নেই। ফোনটা রেখে বিছানায় যায়। নবনীতা তখন ও ঘুম। শান্ত মুচকি হেসে বলে,
“নীলয় নামক কাঁটাটাও এবার সরে যাবে।“
বলেই জড়িয়ে ধরে নবনীতাকে। নবনীতা আলিঙ্গনে নিলে সব কষ্ট, সব ক্লান্তি যেনো ছু হয়ে যায়। এক অজানা শান্তি হৃদয়কে শীতলতা দেয়। সকল চিন্তার সমাপ্তি ঘটে যেনো এই নারীর স্পর্শে। হয়তো একারণেই সে এতোটা ভালোবাসে তার শ্যামলীকে।
_________________________________________________________________________
সন্ধ্যা ৭টা,
স্থানঃ গুলশান ক্লাব
আলাদা রুমে সামনা সামনি বসে আছে নীলয় এবং শান্ত। নীলয়ের চোখ জোড়া লাল হয়ে আছে। হয়তো রাতে ঘুম হয় নি। শান্ত আয়েশ করে চেয়ারে বসে জুসের গ্লাসে চুমুক দিচ্ছে এবং ঘড়ির দিকে আড়চোখে নজর রাখছে। নয়টার আগে বাসায় পৌছানো হয়তো সম্ভব হবে না আজ। নবনীতাকে বলে আসে নি সে। মেয়েটি হয়তো অপেক্ষা করবে। নবনীতার কথা ভাবতেই ঠোটে হাসি ফুটে ওঠে শান্তের। হাসিটা নজর এড়ালো না নীলয়ের। সে শকুনের মতো চেয়ে আছে শান্তের দিকে। শান্তের প্রসন্ন মুখটা দেখে মেজাজ খারাপ হচ্ছে। কিন্তু শান্তের সামনে সে একটা চুনোপুটি মাত্র। শান্ত চাইলেই তাকে পা দিয়ে মাটিতে মিশিয়ে ফেলতে পারে। শুধু তাদের সম্পর্কের কথা চিন্তা করে চুপ করে বসে আছে। জুসের গ্লাসটা রেখে শান্ত খানিকটা নড়ে চড়ে বসে। হাতদুটো এক করে বলে,
“মুখে কুলুপ এটেছিস নাকি? তাড়াতাড়ি বল, কি জানতে চাস? আমি বাসায় যাবো নবনীতা আমার অপেক্ষা করছে”
নবনীতার কথা শুনতেই লাল চোখে সরু দৃষ্টিতে তাকায় নীলয়, তীক্ষ্ণ স্বরে বলে,
“সেদিন মলে নবনীতার সাথে কি হয়েছিলো?”
“আজ এতো কাল বাদে তা জানার জন্য উঠে পড়ে লেগেছিস কেনো?”
“সেই উত্তর আমি তোমাকে দেওয়ার কোনো প্রয়োজনীয়তা বোধ করছি না।”
“আমি ও আমার স্ত্রীর সম্পর্কে কোনো কথা বলার প্রয়োজনীয়তা বোধ করছি না নীলয়। আর তোর কি খেয়ে কাজ নেই? শুনলাম, জব সুইচ করছিস। ঢাকায় জব পেয়েছিস, তা নতুন জবটা ভালো করে কর না। কেনো অন্যের সংসারে মুখ দিচ্ছিস”
শান্তের খোটা মেরে বলা কথা শুনে চোয়াল শক্ত হয়ে আসে নীলয়ের। ক্রোধ চাপা কন্ঠে বলে,
“খুব দেখি সংসার সংসার বড়াই করছো, শান্ত ভাই। তবে জানো তো খালি কলসি বাজে বেশি। আমার তো মনে হয় তুমি আমাকে জ্বালানোর জন্য এগুলো করছো। এসব রঙ্গ ছাড়ো, খোলশা করে বলো তো সেদিন আসলে কি হয়েছিলো? কেনো নবনীতার শাড়ি ছেড়া ছিলো? কেনো ওর শরীরে আঘাতের চিহ্ন ছিলো? কেনো তার অবস্থা বিধ্বস্ত ছিলো?”
শান্ত মিনিটক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
“তুই যে কারণে নবনীতাকে ভুল বুঝে, সন্দেহ করে একা ছেড়ে গিয়েছিলি তেমন কিছু নবনীতার সাথে হয় নি। মজার ব্যাপার, নবনীতা এতোটাই স্ট্রং যে সে নিজের এক চুল ক্ষতিও হতে দেয় নি।“
কথাটা বলে শান্ত বাঁকা হাসি হাসে, সেই হাসিতে ছিলো বিদ্রুপ, ছিলো নীলয়ের প্রতি তাচ্ছিল্য। নীলয় স্তদ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে, তার কান যেনো বাজছে। শান্তের কথাটা বুকে তীরের মতো বিধছে। নীলয়ের আহত দৃষ্টি দেখে শান্ত হাসে, তারপর বলে,
“সেদিন অনেক কিছু হতে পারতো, হয়তো নবনীতার ইজ্জতহানি হতে পারতো, নবনীতা কলুষিত হতে পারতো; অনেক কিছুই হতে পারতো। কিন্তু হয় নি, হয় নি। নবনীতা যখন সেদিন সিড়ি থেকে নামছিলো, একটা পশু তার পিছু নিয়েছিলো। পিছু নেবার কারণ আলাদা ছিলো কিন্তু তার নারী লালসা তাকে উদ্গ্রীব করছিলো আমার শ্যামলীকে নষ্ট করার জন্য। আমরা তো তখন শপিং এ ব্যাস্ত ছিলাম। নবনীতার কিছু হলেও আমরা টের পেতাম না। সে যখন নবনীতার উপর হামলা করে তখন নবনীতা নিজেকে ছাড়াতে চায়। তাদের মাঝে ধস্তাধস্তি হয়। নবনীতার শাড়ি ছিড়ে যায়। যেহেতু সেটা সিড়িঘর ছিলো তাই এক পর্যায়ে নবনীতা তার কাছ থেকে নিজেকে বাঁচাতে তাকে ধাক্কা দেয়। আর সেই পশুটা সিড়ি থেকে ব্যালেন্স হারিয়ে পড়ে যায়। ঘটনায় নবনীতার মনে হয় লোকটি হয়তো মারা গেছে। তাই সে ছুটে গ্যারেজের দিকে যায়। আকর্ষিক ঘটনায় এতোটাই ভয় পায় নবনীতা সে গ্যারেজের কাছে এসে জ্ঞান হারায়। ওই লোকটা মাথায় চোট পায়, যখন তার জ্ঞান ফিরে তখন সে একটু ভয় পায় কারণ আমরা নবনীতাকে খুজছিলাম। তাই সে অন্য দিক থেকে বেরিয়ে যায়। এটাই কাহিনী।“
“তাহলে নবনীতার কেনো কিছু মনে নেই?”
“ডিসোসিয়েটিভ এমনেশিয়া ডিসওর্ডার। যখন মানুষ কোনো ঘটনা খুব বেশি ভয় পায় বা ট্রমাটাইজ হয় তখন সেই ঘটনাটা মস্তিস্ক মুছে ফেলে, আমার মনে হয় নবনীতার এই সমস্যাটা হয়েছিলো।“
নীলয় মাথানত করে বসে রইলো। তার চোখ ছলছল করছে। নিজের কৃত কার্যে লজ্জিত সে, কিভাবে পারলো সে নিজের নীতুকে অবিশ্বাস করতে। মেয়েটি কতবার বলেছিলো, “নীলয় আমাকে বিশ্বাস করো”। নীলয়কে দেখে আফসোস ও হচ্ছে না শান্ত এর। এই আঘাতটা তার প্রাপ্য ছিলো। শান্ত ইচ্ছে করে নীলয়কে সত্যিটা জানিয়েছে। আজ সত্যিটার বদলে যদি নীলয়কে ইচ্ছেমতো সে মারতো তবে হয়তো নীলয়ের উপর ঝাল তোলা হতো কিন্তু নীলয়কে ভাঙ্গা যেতো না। আজ নীলয় ভেতর থেকে চূর্নবিচূর্ণ। শান্ত উঠে যেতে নিলে নীলয় বলে উঠে,
“ওই লোকটা এখন কোথায়?”
“আইসিউ তে, তোর কি মনে হয় আমি ওই হারামীকে ছেড়ে দিবো? আর শুনবি না ওকে নবনীতার পিছু নিতে কে বলেছিলো?”
“কে??”
“নীতি………
চলবে
[পরবর্তী পর্ব আগামীকাল রাতে দিবো। কার্টেসি ব্যাতীত কপি করবেন না।]
মুশফিকা রহমান মৈথি