শ্রাবণ_তোমার_আকাশে পর্ব ১৫

#শ্রাবণ_তোমার_আকাশে
#লেখনীতে: ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব____১৫

ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠতেই বেলা নিজেকে আবিষ্কার করলো শাইনির বুকে। ওকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাচ্ছে। চোখেমুখে প্রশান্তির ছাপ। বেলা নড়তে গিয়ে দেখলো ওর ওপর পা তুলে শাইনি আরামসে ঘুমাচ্ছে। উঠার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলো সে। ভোর ছয়টা বাজে। একটু আগেই নামাজ পড়ে শুয়েছে বেলা। এত ভোরে কেউ উঠেনি হয়তো। আর বিছানা থেকে নামতে হলে শাইনির ঘুম ভাঙাতে হবে। বেলার ইচ্ছা করলো না ওকে ঘুম থেকে উঠাতে। তাই ঘাপটি মেরে আবার শুয়ে পড়লো। ঘুমের ঘোরে শাইনি আবার ওকে বুকে জড়িয়ে নিলো। ওর হার্টবিটের প্রতিটি শব্দের সাথে কেঁপে কেঁপে উঠছে বেলা। অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে, ভালো লাগছে। মুহূর্তটাকে এখানেই থামিয়ে দিতে ইচ্ছা করছে। পর্দার ফাঁক দিয়ে নরম আলো এসে পড়ছে শাইনির মুখের ওপর। বেলা হাত দিয়ে আড়াল করে দিলো। তারপর মুচকি হাসলো। লোকটা পাগলই বটে!

সারাটাক্ষন শাইনির ঘুমন্ত মুখটার দিকে চেয়ে থেকেই কাটিয়ে দিলো বেলা। বারান্দায় থেকে ফুলের সুবাস ভেসে আসছে। একটু নড়লো বেলা। ধীরে ধীরে চোখ খুলে তাকালো শাইনি। ঘুমের কারণে চোখমুখ ফুলে আছে। দেখতে অদ্ভুত লাগছে। বেলা লজ্জায় চোখ বন্ধ করে নিলো। ইশ, কি লজ্জাজনক পরিস্থিতি! শাইনি ওর এই অবস্থা দেখে হু হা করে হাসতে লাগলো। বলল, ‘এত লজ্জা তোমার? আগে তো দেখিনি।’
বেলা বলল, ‘মোটেও না। ছাড়ুন আমাকে।’
-ধরে রেখেছি নাকি যে ছাড়বো?
-তো কি করছেন?
-কোথায় কি করলাম?
বেলা বিরক্ত গলায় বলল, ‘ওফ সরুন তো, আপনি এত ভারী কেন? ইশ হাতটা আমার ভেঙ্গে গেলো!’
বেলা শাইনিকে ঠেলে সরিয়ে উঠে বসলো। তারপর ওড়না জড়িয়ে চুলগুলো হাতখোঁপা করতে করতে নামতে নিলে পেছন থেকে ওর হাত ধরে ফেললো শাইনি। বেলা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো।
-কী হয়েছে?
-কোথায় যাচ্ছো?
-সাতটা বাজে। উঠতে হবে না?
-না।
বেলা ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘কেন?’
-কারণ আমাদের বাসার মানুষ এত সকালে ঘুম থেকে উঠে না।
-মানে?
-সবাই নয়টার পরে উঠে। ওদের কাছে সকাল সাতটা মানে ভোর।
বেলা অবাক হয়ে বলল, ‘আপনার আব্বুও?’
-না। আব্বু তো আটটায় অফিসে চলে যায়।
-আপনি আপনার মায়ের কথা বলছেন?
-হুম।
-ওহ! শিলা স্কুলে যায় না?
-ওর তো ডে শিফট। বারোটা থেকে ক্লাস শুরু।
-কীসে পড়ে ও?
-এবার নাইনে। সি হ্যাজ দ্যা ফায়ার..
-তাই?
-হুম।
-ওহ, আর আপনি?
-আগ্নেয়গিরি…

বেলা পা গুটিয়ে বসে পড়ে। কেউ যখন ওঠেই না তাহলে এখন বেরুবার দরকার নেই। খানিকক্ষণ পরে গিয়ে ও না হয় নাস্তা তৈরি করে ফেলবে। তাহলে নাজনীন বেগমের একটু হেল্প হবে। শাইনি হঠাৎ সোজা হয়ে বসে হাত পিঠের দিকে নেওয়ার চেষ্টা করতে লাগলো। বোধহয় পিঠ চুলকাচ্ছে। কিন্তু কিছুতেই নাগাল পেলো না। বেলা বলল, ‘আমি হেল্প করব?’
-করবে?
-হুম।
-তোমার যা লজ্জা, আবার আসছো আমার পিঠ চুলকাতে।
-এত কথা বলেন আপনি, মাঝে মধ্যে সেলাই করে দিতে ইচ্ছা করে।
-আচ্ছা দাও।
শাইনি টি-শার্ট একটানে খুলে ফেলে। বেলা ইতস্তত করে মুখ ঘুরিয়ে ওর পিঠ চুলকাতে সাহায্য করলো। একবারও তাকালো না। শাইনি ব্যস্ত কন্ঠে বলতে লাগলো,
-ইশ, এখানে না আরেকটু উপরে…এদিকটায়, হুম.. না ডানপাশে! ওফ শিট কী হলো আমার..দেখো তো বউ!’
বেলা শাইনির পিঠ দেখে অবাক হয়ে বলল, ‘আপনার পিঠ তো লাল হয়ে আছে, র‍্যাশ উঠেছে..!’
-ওফ শিট। আর বাঁঁচবো না আমি!
-এসব কেন বলছেন?
-দেখছো না রোগের এফেক্ট ছড়িয়ে পড়ছে। তুমি জানো এটাও রোগের আরেকটা লক্ষণ।
-আপনাকে কে বললো?
-আমি জানি।
-সবকিছু বেশি জানেন আপনি!
-ওফ জ্বলছে পিঠ! ড্রয়ারে দেখো তো মলম টলম কিছু একটা পাও কি-না?

বেলা প্রচন্ড মন খারাপ নিয়ে ড্রয়ার খুঁজে একটা মলম নিয়ে এলো। ওটা লাগিয়ে দিতে দিতে শাইনির অসহায় মুখখানা দেখে ওর বুকের ভেতর মুচড়ে উঠছিল! তোলপাড় শুরু হয়ে গেলো ওর মনের ভেতর। কতটা কষ্ট পাচ্ছে শাইনি ভেবেই ওর চোখ দিয়ে কয়েক ফোঁটা জল চলে এলো। খুব যত্ন করে মলম লাগানো শেষ করেই ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো বেলা। শাইনি পেছনে ফিরে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘কেঁদো না প্লিজ!’
-আপনার খুব কষ্ট হচ্ছে তাই-না?
-একদমই না।
-মিথ্যা বলবেন না।
শাইনি ওর কান্না থামাতে হাসতে হাসতে বলল, ‘কষ্ট হচ্ছে বুঝি?’
বেলা কান্নামাখা গলায় বলল, ‘হওয়াটাই কি স্বাভাবিক নয়?’
-না। অস্বাভাবিক।
-যেমন?
-তুমি তো আমাকে পছন্দ বা ভালোবাসো না। শুধু আমার জোরাজুরিতে তুমি আমার কাছে আছো। তাহলে কেন তুমি আমার কষ্টে কাঁদবে? তোমার তো খুশি হওয়ার কথা। তাই না? উলটো আমার কষ্টে তুমি নিজে কষ্ট পাচ্ছো৷ তাহলে এটা কি অস্বাভাবিক নয়?
বেলা ঢোক গিলে ভেজা গলায় বলল, ‘মানুষের কষ্ট দেখলে বরাবরই আমার খারাপ লাগে। এখানে অন্যকিছু ভাবার প্রয়োজন নেই।’
-আই সোয়্যার বেলা বউ। যেদিন তুমি মুখ ফুটে নিজে আমাকে জানাবে যে তুমি আমায় ভালোবাসো, সেদিন মরে গেলেও আমার কোনো আফসোস থাকবে না। তবে এর আগ অবধি তোমার মতো মিষ্টি বউকে কোত্থাও যেতে দেবো না। আটকে রাখবো।
বেলা চোখ উঠিয়ে বলল, ‘কোনোদিন এমন সময় না আসুক।’
-সময়কে যে আসতেই হবে!
-কেন আসবে?
-কেননা, ইতোমধ্যেই তুমি আমার ওপর দুর্বলতা অনুভব করছো। তাই সত্যটা স্বীকার করতে ভয় পাচ্ছো। সময় এসে তা প্রমাণ করে যাবে। শুধু অপেক্ষার প্রহর গুণার পালা।
-জি না, এমন হবে না।
-হতেই হবে।

শাইনি বেলার হাতটা ওর মাথায় রেখে বলল, ‘সত্যি করে বলো আমার জন্য কষ্ট হচ্ছে না?’
বেলা হাতটা নামিয়ে নিতে চেয়েও পারলো না। শাইনির সকাল সকাল এই অদ্ভুত কথাবার্তা শোনার পর ওর ভীষণ রাগ হচ্ছে। কিন্তু সত্যটা অস্বীকারও করতে পারবে না। সত্যই শাইনির জন্য কষ্ট হচ্ছে। মাথা নিচু করে বেলা উত্তর দিল, ‘হুম হচ্ছে।’

শাইনি গম্ভীর কন্ঠে বলল, ‘এটা তোমার শাস্তি বুঝলে?’
বেলা অবাক হয়ে বলল, ‘কীসের শাস্তি?’
শাইনি ধরা গলায় বলল, ‘আমার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করা এবং আমাকে ছেড়ে যাওয়ার চিন্তা করেছিলে যেদিন, সেদিনই মনে মনে ঠিক করেছিলাম তুমি আমাকে ভালোবাসতে একদিন ঠিকই বাধ্য হবে, আমি বাধ্য করাবো। তুমি আমার সুখে সুখী হবে, আমার কষ্টে কষ্ট পাবে। আমার জন্য কাঁদবে। জানো, তোমার চোখের জলের প্রতিটি ফোঁটা অমূল্য রত্ন আমার কাছে। এখন দেখো, আমার কাছাকাছি থাকতে থাকতে, আমাকে বুঝতে গিয়ে, অনুভব করতে গিয়ে তুমি একটু হলেও আমার জন্য চিন্তা করো, কাঁদো আর তোমার অপ্রিয় হলেও সত্যটা এই যে, তুমি আমাকে মনের কোণে জায়গা দিয়েছো, এক অর্থে ভালোবেসে ফেলেছো। এটা আমার স্বার্থকতা, আমার ভালোবাসার জয়। এখন তোমাকে ছাড়া আমার আর চাওয়া-পাওয়া নেই। যতদিনই বাঁচি না কেন তুমি আমারই থাকবে। যেদিন থাকবো না সেদিন বুঝতে পারবে ভালোবাসা দূরে চলে গেলে ঠিক কতোটা কষ্ট লাগে!’
শাইনির কথা শুনে বেলার মনে ঠিক কী অনুভূতি হচ্ছিলো বলে বোঝানো দায়। লোকটা নিষ্ঠুর, হ্যাঁ নিষ্ঠুর সে! বেলা অভিমানী গলায় বলল, ‘আপনি খুব খারাপ!’
-জানি আমি।
-কিচ্ছু জানেন না আপনি। শুধু ইমোশন নিয়ে খেলতে জানেন।
শাইনি এবার আবদার করলো, ‘আমাকে একটু ভালোবাসো না! রাতের মতো কপালে আদর দাও না!’
-পাহাড়ে গিয়ে তো এমন করেননি? বাসায় ফেরার পর থেকেই আপনার যত উদ্ভট আবদার ছিঃ!
-তখন সময় অন্য ছিল। এখন অন্যরকম। দাও না…
শাইনি বেলাকে বিছানা থেকে নামতে দিলো না। ওড়নার কোণা টেনে ধরে আঙুল প্যাঁচাতে প্যাঁচাতে বাচ্চাদের মতো করে বলল, ‘নইলে আজ ছাড়ব না।’
-দিব না।
-তাহলে আমি দিই?
বেলা আঁতকে উঠে বলল, ‘নো ওয়ে। আপনার পিঠের চুলকানো কমেছে?’
-হুম। এসব কথা ছাড়ো..
বলেই এগিয়ে এসে বেলার ঠোঁটে চুমু খেলো। আচমকা বেলা হতভম্ব হয়ে গেলো। লজ্জায় হাত-পা কাঁপতে লাগলো, কোনোমতে সেখান থেকে উঠে দৌড়ে দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে গেলো। হার্টবিট ছুটছে একশো মাইল স্পিডে। শাইনিটা এত বেহায়া..আজ আর ওর সামনেই পড়তে পারবে না সে। ইশ কি লজ্জা!!

শাইনি বেলাকে লজ্জা পেতে পালিয়ে যেতে দেখে স্বগোতক্তি করলো, ’প্রেমে পড়া ভীষণ সহজ, তবে প্রেম থেকে বেরিয়ে আসা মৃত্যু যন্ত্রণার ন্যায় কঠিন। একদিন তুমিও বুঝবে!’

চলবে…ইনশাআল্লাহ!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here