শ্রাবণ_তোমার_আকাশে পর্ব ৩০

#শ্রাবণ_তোমার_আকাশে
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব___৩০

শ্রাবণ মাস। চারদিকে রোদ্দুরের ঘনঘটা। খুব সকালেই সূর্য তার উত্তাপে ঝাঁঝিয়ে দিচ্ছে পুরো শহরকে৷ ভ্যাপসা গরমে জীবন হয়ে উঠেছে দুর্বিষহ। অশান্ত এই প্রকৃতিকে শান্ত করার জন্য বৃষ্টি প্রয়োজন। কিন্তু আকাশে মেঘের ছিঁটেফোঁটাও নেই। শুক্রবারের অলস দুপুর। গরমে অতিষ্ঠ হয়ে রাস্তার ধারে ঘুরে বেড়াচ্ছে কিছু অভুক্ত কুকুর। ঘর্মাক্ত শরীরে ছাদে হাঁটাহাঁটি সেরে নিচে নামলো বেলা এবং শিলা। তখনই মায়ের কাছ থেকে জানতে পারলো আরাফাতকে কাল রাতে কে বা কারা জানি আক্রমণ করেছে। বেধড়ক পিটিয়ে হাত ভেঙে দিয়েছে আরাফাতের। এখন সে হসপিটালে ভর্তি। খবর শুনে বেলা খুব চমকালো, কারণ ওরা দেশে ফিরছে বছরও পুরো হয়নি। আরাফাত খুব ভালো ছেলে এবং ভালো একজন ডাক্তার। ওর প্রতি কার এত রাগ থাকতে পারে যে মেরে হাত-ই ভেঙে দিলো! খুব মন খারাপ লাগলো ওর। বিষন্ন মন নিয়ে গোসল দেওয়ার উদ্দেশ্যে ঢুকলো বাথরুমে । শিলা বেসিন থেকে হাতমুখ ধুয়ে এসে নিজের ফোনটা নিয়ে বসলো। নোটিফিকেশনে জমে আছে অপঠিত কিছু ম্যাসেজ। সিন করতেই ভেসে ওঠলো, ‘হাই শিলুবুড়ি। কী করছিস?’

শাইনির ম্যাসেজ দেখে খুব একটা চমকালো না শিলা। দক্ষ আঙুল চালালো কী-বোর্ড টাইপিংয়ে। লিখলো, ‘কিছু না। চারদিন ম্যাসেজ দাওনি কেন? আমি ওয়েট করছিলাম তোমার ম্যাসেজের জন্য!’

শাইনি লিখল, ‘আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। একটু বিজি ছিলাম তাই ম্যাসেজ দেওয়া হয়নি!’

‘ওহ আচ্ছা, আজ শরীর কেমন আছে তোমার?’

‘আমার বউ কোথায়?’

‘ভাবি শাওয়ারে!’

‘অসময়ে শাওয়ার নিতে গেল কেন?’

‘হ্যাঁ, আজ অনেক গরম পড়েছে। ছাদে হাঁটাহাঁটি করে আরও গরম লাগছিলো।’

‘ওহ। সেকী এখন রুমে নেই?’

‘না।’

‘আচ্ছা, তুই যে আমাকে ওর সব খবরাখবর দিস, তা টের পায়নি তো ও?’

‘নাহ।’

‘গ্রেট জব।’

শাইনি তারপর লিখলো, ‘একটা সিক্রেট বলি? কাউকে বলবি না।’

শিলা ভ্রু কুঁচকে লিখল, ‘এভাবে বলছো কেন? আমি কী সবাইকে সব বলে বেড়াই ভাইয়া?’

‘তা নয়। তবুও আজকের ব্যাপারটা টপ সিক্রেট রাখবি, এটলিস্ট আমার বউয়ের কাছ থেকে। ওকে? আর ফোন দিচ্ছি রিসিভ কর। ফোনেই সব বলছি!’

আপাতত ম্যাসেজ টাইপিংয়ে ইতি টেনে শাইনি বোনকে ফোন লাগালো। শিলা ফোন ধরে কিছুক্ষণ ভাইয়ের সাথে কথাবার্তা বলে ওর খোঁজখবর নিলো। শাইনি বলল, ‘এবার আসল কথায় আসা যাক?’

‘হুম।’

‘আমি ওই আরাফাত না টারাফাত ওকে আচ্ছামত ধোলাই দিয়ে হাত ভেঙে দিয়েছি।’

শিলা চমকে উঠলো। বিস্ময়ে হতবাক হয়ে বলল, ‘আরাফাত ভাইয়ার? ভাবির ফুপাতো ভাইয়ের?’

‘হ্যাঁ।’

শিলা চমকিত গলায় বলল, এরকম কেন করলে? ওনি কী করেছিল?’

শাইনি ভারী গলায় হুমকি দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল, ‘তোর ভাবি ওই উজবুক ডাক্তারকে বিয়ে করবে বলছিল। ভাব, যার জন্য এত কষ্ট করলাম সে আমাকে এই কথা বলে, রাগ হবে না আমার?’

শিলা হেসে বলল, ‘ওটা তো ভাবি তোমার ওপর রেগে বলেছিলো। তুমি দ্বিতীয় বিয়ের কথা বলেছিলে কেন? তুমি আরেকটা বিয়ে করলে ভাবি কেন করতে পারবে না? আর ভাবি অন্য কাউকে বিয়ে করবেও না। তুমি কাজটা ঠিক করোনি।’

শাইনি গম্ভীর গলায় বলল, ‘ওই আরাফাতকে আমার একটুও পছন্দ না।’

‘এত্ত জেলাস হওয়ার কী আছে ভাইয়া? ভাবি জাস্ট মজা করেছে। ক্ষমা চেয়ে নিও আরাফাত ভাইয়াটার কাছে। তোমার ট্রিটমেন্টের সময় ওনি অনেক পরামর্শ দিয়ে হেল্প করেছে।”

শাইনি কাঠ কাঠ গলায় বলল, ‘ইন ফিউচারে এসব মজা কর‍তে না করবি বেলা বউকে। তাহলে ধকল কিন্তু ওর ওপর দিয়ে যাবে না, যাবে বিপরীত ব্যক্তিটির ওপর দিয়ে।’

শিলা গোমড়া গলায় বলল, ‘সম্পর্কের মাঝে তৃতীয় ব্যক্তি আনতে নেই। তোমরা নিজেরাই নিজেদের ভেতর তৃতীয় ব্যক্তির স্থান দিয়েছো, ঝামেলা করছো নিজেদের মধ্যে। অথচ লোকটার এখানে কোনো ভূমিকাই নেই। নির্দোষ একটা ছেলের হাত ভেঙে দিলে। দ্বিতীয় বিয়ের কথা বলে ক্ষেপানো ঠিক হয়নি তোমার!”

শাইনি ক্ষেপাটে গলায় আস্তে করে বলল, ‘বেলা বউ একটা বোকা। আমি দ্বিতীয় বিয়ে বলতে ওকে বিয়ে করার কথা বুঝিয়েছি, সেইমতো সব ঠিকঠাকও করে ফেলেছি। আর ও বুঝেছে আমি বুঝি অন্য কাউকে বিয়ে করার কথা বলেছি। ভাব, সে কতোটা নির্বোধ।’

শিলা বলল, ‘তোমরা দু’জনেই নির্বোধ।’

‘যাইহোক, আরেকটা সারপ্রাইজ আছে।’

‘কী?’

‘আমি এই মুহূর্তে কোথায় আছি বলতো?’

‘কোথায়?’

‘দেশে। আমার নিজের বাড়িতে, নিজের ঘরে, নিজের প্রিয় বিছানাটায় আয়েশ করে শুয়ে আছি!’

শিলা বিস্ময়ের সপ্তম আকাশে পোঁছালো যেন। চোখ বড় বড় করে জিজ্ঞেস করলো, ‘সত্যি?’

‘হুম। আসছি সন্ধ্যায়, বিয়ে করতে।’

শিলা অবাক হয়ে বলল, ‘কোথায়? কাকে বিয়ে?’

‘আমার শ্বশুরবাড়িতে, আমার প্রথম বউকে দ্বিতীয়বার বিয়ে করে, নিজের জীবনে পদার্পণ করাতে চাই।’

শিলা বলল, ‘কাউকে না জানিয়েই?’

শাইনি বাঁকা হেসে বলল, ‘সব অ্যারেঞ্জ করে ফেলেছি বোকা, আমার বউটা বাদে আর সবাই সবকিছু জানে।’

এমন সময় বেলা ঘরে চলে এলো। ভেজা চুল মুছতে মুছতে দেখলো শিলা কানে ফোন নিয়ে কারো সাথে কথা বলছে। ওকে দেখে শিলা বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়লো৷ শাইনির সাথে এখন কথা বললে বেলা সব বুঝে যাবে, প্ল্যান ভেস্তে যাবে যেটা হতে দেওয়া যাবে না। শিলা ফোনটা কানে লাগিয়েই হাসার চেষ্টা করে বলল, ‘ভাবি, শাওয়ার নেওয়া শেষ? আমি যাবো?’

বেলা সন্দেহ নিয়ে বলল, ‘এভাবে কথা বলছো কেন? হ্যাঁ, আমার শাওয়ার নেওয়া শেষ। তুমিও ফ্রেশ হয়ে নাও!’

ফোনের ওপাড় থেকে শাইনি সবটাই শুনতে পেলো। যা বোঝার বুঝে গেল, শিলার সাথে এখন কথা বলা যাবে না। তাই সে ফোনটা রেখে দিলো। সন্ধ্যা হওয়ার অপেক্ষা শুধু!

…………….

দুপুরের খাবারদাবারের পর্ব শেষ করে নিজের ঘরে বসে বেলা শাইনির ফোনের অপেক্ষা করছিলো। কিন্তু ওই নাম্বার সুইচড অফ। চিন্তিত বেলা ভাবলো, হয়তো ওর ওপর রাগ করে ফোন বন্ধ করে বসে আছে। গোমড়ামুখ নিয়ে বিছানায় শুয়ে আকাশপাতাল চিন্তা করতে কর‍তে একসময় চোখ লেগে এলো ওর! ঘুম ভাঙলো সীমা বেগমের কর্কশ গলায় ডাকে।
ধড়ফড়িয়ে উঠলো বেলা। ঘর অন্ধকার। জানালার ধারের পর্দাগুলো সরানো থাকায় বাইরে দৃষ্টি পড়তেই দেখলো দূরের সুউচ্চ ভবনগুলো আলোকিত হয়ে আছে। তার মানে এখন সন্ধ্যে। বেলা চুলগুলো হাতখোঁপা করতে করতে দরজার দিকে এগিয়ে গেলো। দরজা খুলতেই সীমা বেগম একটু রেগেই বললেন, ‘কখন থেকে ডাকছি তোকে? দরজা বন্ধ করে না ঘুমালে হয় না? চল আমার সাথে এক্ষুনি।’

বেলাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই সীমা বেগম ওর মাথায় ভালো করে ওড়ানাটা প্যাঁচিয়ে দিলেন। তারপর ওর হাত টেনে ধরে নিয়ে চললেন ড্রইংরুমের দিকে।।বেলা কিছুই বুঝে উঠতে পারলো না। তবে কিছু একটা হয়েছে তা বেশ আন্দাজ করতে পারলো। মায়ের পিছু পিছু ড্রইংরুমে গিয়ে ওর চক্ষু ছানাবড়া। আলম সাহেব হাস্যোজ্জ্বল মুখে বসে আছেন ড্রইংরুমে। নাইমুদ্দীন সাহেব, আলম সাহেব, শিলা ছাড়াও কিছু মহিলা, কয়েকজন লোক আর একজন হুজুর বসে আছেন সোফায়। আলম সাহেব বেলার দিকে তাকিয়ে সৌজন্যেমূলক হাসি দিলেন কিন্তু কিছু জিজ্ঞেস করলেন না। বিস্মিত হলো ও। বেলাকে দেখতে পেয়ে উঠে এসে নিয়ে গেলো শিলা। ও শুধু অবাক হয়ে সবকিছু দেখে যাচ্ছিলো। বাবা কী ওর আবার বিয়ে দেওয়ার পায়তারা করছে নাকি? কিন্তু আলম সাহেবই বা এখানে কেন? ওনাকে হাসিখুশি দেখাচ্ছে। বেলার বিয়ে দেওয়ার কথা থাকলে তিনি তা মানতে পারতেন না নিশ্চয়ই। আর ওনি দেশে ফিরলেন কবে? আর শাইনি ই বা কোথায়? আলম সাহেব বোধহয় ওর মনোভাব বুঝতে পেরেছিলেন, তিনি সহাস্যে ইশারা করে বোঝালেন ওকে, যে শাইনি এসেছে। বেলার হৃদযন্ত্র নামক অঙ্গটি কম্পিত হতে লাগলো ভূমিকম্পের ন্যায়। শাইনি এসেছে, সত্যিই এসেছে! কিন্তু কোথায় সে? বেলার সামনে নেই কেন? এত লুকোচুরি কেন করছে? সেই যে এক শরৎে হাসপাতালের আই সি ইউনিটে লোকটাকে সচক্ষে দেখেছিলো, তারপর তো আর ওদের দেখাই হয়নি। বছর ঘুরে আবার শ্রাবণ এসেছে। আর এই শ্রাবণেই যে ওর দেখা পাবে ঘূর্ণাক্ষরেও কল্পনা করতে পারেনি বেলা। ওর নয়ন দুটো অশ্রুসিক্ত হয়ে পড়লো।

এসব ভাবতে ভাবতে বেলা অন্য একটা জগতে ঢুকে পড়েছিলো যেন। কিন্তু হুজুরের কন্ঠস্বর শুনতে পেয়ে ওর ঘোর কাটে। যাকে ও এতক্ষণ হুজুর ভাবছিলো সে আসলে কাজি৷ আর এখানে তিনি বিয়ে পড়াতে এসেছেন। শাইনির আর বেলার নাম বলতে বলতে কাজি বিয়ে পড়ানো শুরু করলো। বেলার চোখ তখন জলে ভেজা। বিয়ে পড়ানোর এক পর্যায়ে, বিয়েতে রাজি থাকলে বেলাকে কবুল বলতে বলা হলো। ঘোরের মধ্যে থেকেই ও একবার বাবার দিকে তারপর আলম সাহেবের দিকে তাকালেন। ওনি মাথা নাড়িয়ে সায় জানাতেই বেলা ‘তিন কবুল’ বলে ফেললো। তারপর রেজিস্ট্রার পেপারেও সাইন করে দিলো।

বিবাহ সংক্রান্ত সকল ফর্মালিটি শেষ হতেই কাজিসহ মেহমানরা মিষ্টিমুখ করে বেলাদের বাসা থেকে বিদায় নিলেন। বেলা তখনো নিজের ঘরে অপেক্ষায়, কখন শাইনির দেখা পাবে। লোকটা ওর অন্তরালে কেন? সামনে এসেও দেখা দিচ্ছে না। নিষ্ঠুর কেন লোকটা? বিয়ের সময়ও ওকে দেখা দেয়নি। সে কী জানে না, বেলার তৃষ্ণার্ত চোখদুটো ওকে পাগলের মতো খুঁজে চলেছে বাড়ির আনাচেকানাচে?

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here