সঞ্চারিণী
আফনান লারা
১০.
ফেরদৌস হাসানের কথা শুনে শাওন কিছু সময়ের জন্য থম হয়ে ছিলো।
-‘মেধার মতন ভীতুর ডিম একটা মেয়ের বাবা কিনা দায়িত্ববান পুলিশ অফিসার?বিশ্বাস করতে কষ্টে হচ্ছে তাও করতে হলো।কারণ উনি তো মিথ্যে বলবেননা।
পুলিশ অফিসারদের মেয়ে হবে সাহসী,কাজে পটু।যাই হোক আমার কি।সব গিয়াস স্যার জানেন।’
রকি গাল ঘঁষতে ঘঁষতে ডাক্তারকে ইশারা করলো
শাওন সেটা খেয়াল করেনি।সে মেধার বাবার কথা ভাবছে।ডাক্তার এগিয়ে এসে বললেন,’সরি স্যার।আপনাকে এখন উনাকে প্রশ্ন জিজ্ঞেস করা বন্ধ করতে হবে।পেশেন্টের অবস্থা এখনও ঠিক হয়নি।এভাবে চাপ প্রয়োগ করলে হিতের বিপরীত হবে।উনি আরও অসুস্থ হয়ে পড়তে পারেন।আমরা কোনো রিস্ক নিতে চাইনা’
শাওন রকির দিকে তাকিয়ে বললো,’আমি এখন যাচ্ছি।আবার আসবো।যদি পালিয়েছো তো তুমি যে গর্তেই ঢুকে থাকোনা কেন শাওন তোমার কান টেনে বের করে আনবে মাথায় রেখো।’
কথাটা বলে শাওন চোখ রাঙিয়ে চলে গেলো।রকি ও চলে যাবার পরেই বেড থেকে নেমে জানালায় হাত রেখে তাকিয়ে রইলো শাওন একেবারে হসপিটাল থেকে চলে যাওয়া অবধি।তারপর চেয়ারে বসে ফোন বের করে কাকে যেন ফোন করলো।কি সব বুঝিয়ে দিলো ওপারের মানুষটাকে।
শাওনের গাড়ী ঠিক করেছে তার পাঠানো লোক।সেটা এখন এদিকেই আসছে।মিনিট পাঁচেকেই পৌঁছে যাবে।কড়া রোদের নিচে দাঁড়িয়ে আছে সে।মাথায় ঘুরছে নেক্সটে কি চাল চালা যায় তার ভাবনা।
——-
মেধা গেস্ট রুমটা দেখতে এসেছে।আশার বাবার সঙ্গে তারও কথা বলা উচিত।এটা গিয়াস রহিম মনে করেছেন তাই ওকে আর নিতুকে পাঠিয়েছেন এখানে।
মেধা উনাকে পানি আর ঔষুধ এগিয়ে দিয় উনার পাশে বসলো চুপচাপ।নিতুর দিকে তাকিয়ে আশার বাবা বললেন,’আমার মেয়েটা একদম তোমার মতন দেখতে ছিলো।নাক চিকন ‘
মেধা মাথা ঘুরিয়ে বললো,’আপনার মেয়েকে আপনারই সামনে কখনও মারতো রেদোয়ান?’
-‘নাহ।তবে রেদোয়ানের একটা ভাই আছেনা?? ‘
-‘হুম।চেনেন আপনি?কি করেছে সে?’
—-
শাওন এখন রেদোয়ানের বাড়িতে এসে নুহাশের সাথে কথা বলছে রকিকে নিয়ে।
-‘বুঝলে নুহাশ।রকিকে দেখে আমার একবারও বেকুব মনে হলোনা।তাও সে বেকুব হওয়ার নাটক করেই চলেছে।কি প্রমাণ করতে চাইছে সে?’
-‘কি বলো শাওন!ওকে দেখে খাইষ্টা একটা লাগে।ও চতুর হতেই পারেনা’
-‘ইয়েস।ও চতুর।হসপিটালে রোগীরা শেভ করার মনমানসিকতা খুঁজে পায়না আর তার মুখ ক্লিনলি শেভড্ ছিল।তাছাড়া ড্রেস আপ,পারফিউম,ফোনে এলার্ম লাগিয়ে রাখা এসব একজন অসুস্থ মানুষ কেন করবে?এলার্ম বাজলো ঠিক সেসময়ে যখন আমি কেবিন থেকে বাহিরে পা রাখলাম।ওর মাথায় পরিকল্পনা ঘুরছে।সেটা কি আমাদের জানতে হবে।তার জন্য ওকে হসপিটালের বাহিরে নিয়ে আসতে হবে।ওর উপর কড়া নজর রাখো।’
রায়হান ফোন রেখে এগিয়ে এসে বললো,’শাওন এখানে একটা ল্যাম্প পোস্ট আছে।দেখেছিলে?’
-‘হুম।কেন?’
-‘ওটাতে সিসি ক্যামেরা লাগানো আছে।আজকেই দেখলাম’
নুহাশ হাত ভাঁজ করে ঠোঁট উল্টে বললো,’তাতে বেশি লাভ হবেনা।ওটা দিয়ে শুধু গেস্ট হাউজই দেখা যাবে।রেদোয়ানের বাসার পেছনের সাইডটাই নজরে আসবে শুধু’
-‘নুহাশ আর রায়হান চলো আমার সঙ্গে।সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখা উচিত।একটু হলেও ক্লু পাবো।মনে রাখতে হবে অনু পরিমাণ কোনো কিছুকেও আমরা নজরের বাহিরে রাখবোনা।তাছাড়া আশার বাবার থেকে আরও কিছু জানতে হবে।রেকোর্ডের প্রয়োজন আছে।উনাকে দেখে মনে হয় না এরপরে আর ভালোভাবে কোনো কিছুর উত্তর দিতে পারবেন’
তাই এই বুদ্ধি সেঁটে তিনজনে গেলো সিসি ক্যামেরার ফুটেজ যেই অফিসে পাওয়া যাবে সেখানে।আশার বাবার কাশি উঠেছে বলে নিতু পানি নিতে গেছে।মেধা পকেটে হাত ঢুকিয়ে এদিক ওদিক দেখছে সামনের জানালাটা দিয়ে।আশার বাবা স্পষ্ট কথা বলতে পারেননা।শুধু কাশি আসে তার।
পানি খেয়ে যদি ভালোমতন কিছু বলতে পারে তাতেই বা মন্দ কি।ঐ শাওনরে বুঝিয়ে দিতে হবে আমিও অনেক ইনফরমেশন বের করতে পারি।দরকার হলে ইমোশনালি বুঝাবো।’
——-
-‘আরে ভাই এটা তো আজকের ফুটেজ মনে হয়।আমাদেরকে কয়েকদিন আগের ফুটেজ দেখাও।আমি শুধু শুধু এতক্ষণ মনযোগ দিয়ে দেখতেছিলাম’
-“ওয়েট আ মিনিট নুহাশ।দূরে একটা লোককে দেখতে পাচ্ছো?পাঁচ মিনিট হলো আমরা ভিডিও দেখছি সে ঐ জায়গা থেকে এক বিন্দু ও নড়েনি।এরকম নির্জন এরিয়াতে তার কি কাজ?ভাই একটু সামনে আনুন তো’
কর্মকর্তা শাওনের কথা মতন জুম করলো তারপর দু মিনিট এগিয়ে আনলো ভিডিওটা।আজকের সকাল এগারোটা দুই বাজে তখন।
লোকটা এবার গেস্ট হাউজের কাছাকাছি এসে বাউন্ডারিতে হাত লাগিয়েছে।রায়হান, নুহাশ আর শাওন নড়েচড়ে দাঁড়ালো।লোকটার পরনে হলুদ রঙের পোশাক।মুখটার কিছুই দেখা যায়না।
লোকটা এবার বাউন্ডারি টপকে ভেতরে ঢুকে গেলো।এত দূর থেকে আর কিছু দেখা গেলোনা।সে কি করলো না করলো।ল্যাম্প পোস্ট টা এমন জায়গায় যে বাউন্ডারির ভেতরে কি হচ্ছে তা বোঝা যায়না।
-‘নুহাশ খেয়াল করেছো?সে বাউন্ডারিতে যাওয়ার আগে তার হাতে একটা কালো সাইড ব্যাগ ছিল।বাট সে বেরিয়ে আসার পর সেটা ছিলনা’
-‘রাইট!!’
শাওন কপালে হাত দিয়ে কি মনে করে দ্রুত গতিতে ছুটলো রেদোয়ানের বাড়ির দিকে।রায়হান শাওনকে ছুটতে দেখে বললো,’কি হতে পারে?ও মাই গড!বোমা নয় তো?’
নুহাশ চোখ বড় করে বললো,’নিতু আর মেধা গেস্ট হাউজে!!না এটা হতে পারেনা’
শাওন ছুটে রেদোয়ানের বাড়িতে ঢুকে গেস্ট হাউজ অবধি এসে আর যেতে পারলোনা।বোমা ফেটে গেছে ততক্ষণে।চোখের সামনে দাউ দাউ করে গোটা গেস্ট হাউজে আগুন জ্বলছে।নুহাশ হাঁপাতে হাঁপাতে এসে আগুন দেখে চিৎকার করে আগুনের দিকে যাওয়া ধরতেই রয়হান ওর বুকে জড়িয়ে ধরে আটকে ফেললো।নুহাশ চিৎকার করতে করতে বলছে,’আমার নিতুকে বাঁচাতে হবে।আমার হাত ছাড়ো রায়হান।হাত ছাড়ো ফর গড সেক!!”
নিতু পানির বোতল হাতে রেদোয়ানের বাড়ির ভেতর থেকে ছুটে এদিকে নুহাশের কাছাকাছি এসে হাত থেকে বোতল ছেড়ে দিয়ে বললো,’মেধা!!!’
শাওন নিতুর মুখে মেধার কথা শুনে ছুটে গেলো আগুনের দিকে।আগুনে আছে তার মানে এরপর কি করা উচিত তা ভাবার সময় নেই।আগুন থেকে বাঁচানো দরকার।আগুনে কাউকে পুড়তে দেখলে একটা সেকেন্ড নষ্ট করা মানে তাকে পুড়তে দেখা।একজন মানুষ হয়ে আরেকজনকে পুড়তে দেখা যেখানে আপনার হাতে আছে তাকে বাঁচানোর উপায়।
এই ভুলটা বছর খানেক আগে হয়েছিল আর কখনও হতে দেওয়া যাবেনা।
দরজায় আগুন। গেস্ট হাউজটা ভেঙ্গে পড়ছে ধীরে ধীরে।শাওন ঢুকতে গিয়েও পারলোনা।চোখের সামনে একটা ঘটনা ভাসছে শুধু।দম ফেলে কোট খুলে মাথায় চাপিয়ে দরজা টপকে ভেতরে গেলো সে।আগুন ছাড়া চোখের সামনে কিছুই দেখছেনা। ‘সব ভেঙ্গে চুরমার হয়ে আছে।মনে হয় এই বুঝি সম্পূর্ণ দালান ভেঙ্গে পড়বে।ছাদ খসে পড়ছে।শাওনের মাথার উপর থেকে কোটটা ছিঁটকে পড়ে গেলো আগুনের মধ্যে।
ওর মাথা ঘুরে উঠলো।হঠাৎ টের পেলো কেউ একজন ওর হাত মুঠো করে ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে ওকে দালানের বাহিরে।পেছনে তাকিয়ে মেধাকে দেখতে পেলো সে।
মেধা ওকে নিয়ে বাসা থেকে বের করিয়ে এনে নিজের চুলে লাগা আগুন হাত দিয়ে নিভিয়ে রেগে রেগে বললো,’আপনার মাথা ঠিক আছে তো?আগুনের ভিতরে গিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন কেন?মরার শখ জেগেছে?’
-‘তুমি!’
মেধা এবার শাওনের চুলে লাগা আগুন নিভাতে গিয়ে হেসে ফেললো।তার চুল লম্বা বলে পোড়া চুল কেটে ফেলা যাবে কিন্তু শাওনের চুল তো ছোট।ওকে কিরকম লাগছে হাসা ছাড়া উপায় নেই। ওকে এই চুল আবার বড় হওয়া অবধি সবার হাসিঠাট্টা শুনে যেতে হবে।
হাসি দমিয়ে সে বললো,’ আমি এই বাসাতে ছিলাম না।আমি তো রেদোয়ানের পুল দেখতে গিয়েছিলাম।এসে দেখি সব শেষ।আর আপনি বাসার ভেতরে এত এত আগুনের মাঝে দাঁড়িয়ে “তেরে বিনা মুজে নেহি জিনা” সিন করছিলেন?’
শাওন মূর্তির মতন দাঁড়িয়ে আছে।মেধা শাওনের হাত ছেড়ে দিয়ে গেস্ট হাউজের দিকে তাকিয়ে বললো,’পানি দিয়ে আর লাভ আছে??আশার বাবার হাঁড় ও তো পাওয়া যাবেনা’
শাওন কথা বলতে পারছেনা।কিছু সময়ের জন্য ঘোরের মাঝে ডুবে গিয়েছিলো সে।রশ্নিকে তো এরকম একটা ঘটনায় হারিয়ে ফেলেছিল।ভাবলো আজ তার চোখের সামনে ঠিক একই ঘটনা ঘটতে চলেছে।
চলবে♥