সঞ্চারিণী পর্ব -০৯

সঞ্চারিণী
আফনান লারা

৯.
মেধার জ্ঞান ফিরেছে নিতু যখন পানির ছিঁটা দিলো ঠিক তখনই।চোখ মেলে সবার আগে শাওনকে দেখে চিৎকার করে সাথে সাথে দূরে সরে গেছে সে।শাওন বিরক্ত নিয়ে তাকিয়ে আছে এখনও।
মেধা ভয়ার্ত চোখে চেয়ে বললো,’এই লোকটা ভূত’

ওর কথা শুনে রায়হান তাচ্ছিল্য করে হেসে বললো,’ভূত বলতে কিছুই হয়না মেধা।’

মেধার দৃষ্টি শাওনের দিকে।তার বোতামগুলো লাগানো।শাওনের সঙ্গে যে ভূত আছে তা আর যেচে কাউকে প্রমাণ করে দিতে হবেনা ওর সামনে।মেধা বেশ বুঝেছে হয় শাওন নিজেই ভূত আর নয়ত ওর সঙ্গে ভূতের হাঁটাচলা আছে।এই ভেবে ভয়ে গলা শুকিয়ে গেছে ওর। গলায় হাত দিয়ে মেধা বললো,’পানি এট্টু খাব নিতু আপু’

নিতু ছুটে চলে গেলো পানি আনতে।শাওন গেছে রেদোয়ানের রুম দেখতে।সেদিনের হাতুড়ি আর অন্য সব জিনিসপাতি দিয়ে তাহলে আশাকে টর্চার করতো রেদোয়ান।হয়ত সে আশাকে মেরেছে।কিন্তু তাকে মারলো কে?
রুমে বড় করে একটি ছবি টাঙানো।ছবিতে সোফায় আশা বসে আছে আর তার পেছনে রেদোয়ান দাঁড়িয়ে আছে।রেদোয়ানের মুখে হাসি।অথচ আশার মুখটা যেন তার বিপরীত ভঙ্গিতে ফুটে আছে।তার মুখে হাসির ছিঁটেফোঁটাও নেই।এত ঐশ্বর্যের মালিক হয়েও তাদের সংসার আজ ভেঙ্গে চুরমার হয়ে আছে।একটা মানুষ নেই যে তাদের পরিবারের একজন।’
——-
-‘শাওন এদিকে আসো’

শাওন রেদোয়ানের রুম থেকে বেরিয়ে নিচে নামলো নুহাশের ডাকে।নুহাশকে দেখে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো ও এত জলদি এসে পড়েছে কেন।রেদোয়ানের ভাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করেনি সে।
নুহাশ বললো,’সে নিয়ে আর কি বলবো বলো!ঐ ছেলে এত নাটক করছে।আমার মাথা আর একটু জন্য খারাপ হয়ে যেতো।এটা তুমি ছাড়া সলভ্ হবেনা।বাবা আমার এত ধৈর্য্য নেই।’

-“কেন?কি সমস্যা তার?ডায়রিয়া সারে নাই?’

-“সে রোবটের মতন শুধু কাঁপে।আমার প্রশ্নের জবাব দেয়না।আরও কত নাটক।তার নাটক দেখে আমার গায়ের পশম খাড়া হচ্ছিল আবার নেতিয়ে পড়ছিলো।মনে হয় যাত্রা পালায় অভিনয় করে।বাপরে কি নাটক যদি তুমি একবার দেখতে।এমন ভাবে নাটক করছিলো আমি বাদে বাকি সবাই ওকে বিশ্বাস করেছে।’

-‘ঠাস করে চড় মেরে দিতা।আপনা আপনি বকরবকর শুরু করে দেবে’

-‘আমি গলা টিপে ধরছিলাম।ডাক্তার এসে বললো,’কুল ডাউন।অসুস্থতার কারণে হয়ত প্যানিক করছে অল্পতেই’

শাওন কোট ঠিক করে বললো,’আচ্ছা আমি তাহলে গিয়ে একটু ডিটার্জেন্ট দিয়ে ধুয়ে আসি ওরে।দেখি রঙ ওঠে কিনা’
—-
মেধা চোরের মতন বসে ছিল সোফায়।শাওন যাওয়ার সময় থেমে গিয়ে বললো,’তুমি ও চলো আমার সাথে।মেয়ে দেখলে হয়ত তার মুখ দিয়ে ফরফর করে কথা বের হবে’

মেধা কুশন টেনে জড়িয়ে ধরে বললো,’না আমি যাবোনা।আপনার সঙ্গে ভূত আছে’

-‘তুমি যাবেনা তোমার আব্বু যাবে’

কথা শেষ করতে না করতেই শাওন দেখলো একজন পুলিশ অফিসারকে।ফোন দেখতে দেখতে ভেতরে ঢুকেছেন তিনি।
নাম ফেরদৌস হাসান।শার্টে লেখা আছে।কিন্তু চিনলোনা সে।তাও সালাম দিয়ে এগিয়ে গেলো।ভাবলো কেস দেখতে এসেছে হয়ত।উনার কাছে আসতেই উনি বললেন,’চলো যেখানে যাওয়ার সেখান থেকে ঘুরে আসি’

শাওন মেধার দিকে একবার তাকিয়ে চলে গেলো উনার সাথে।মেধা সেসময়ে সোফার পেছনে লুকাচ্ছিলো যাওয়ার ভয়ে।পুলিশ অফিসারকে আর দেখলোনা সে।মাথা তুলে শাওনকে চলে যেতে দেখে স্বস্তি পেলো।শাওনের থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলতে হবে।নাহলে ওর সাথে থাকা ভূতের আত্নীয় স্বজন এসে আমাকে কব্জা করবে।’

মেধা উঠে দাঁড়িয়ে রান্নাঘরের দিকে গেলো দেখবে বলে।গিয়েই দেখলো নুহাশ নিতুর মুখ ধরেছে কিস করবে বলে ঠিক সেসময়ে মেধা ঢুকে পড়েছিল।সঙ্গে সঙ্গে চোখে হাত দিয়ে অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে সে বললো,’সরি।আমি জানতাম না।কিছু দেখিনি’

নুহাশ আর নিতু দুপাশে সরে দাঁরিয়ে পড়েছে।নুহাশ হালকা কেশে রায়হানের নাম করে জায়গা ছেড়ে পালিয়েছে আপাতত।নিতু মাথা চুলকোচ্ছে।
——
ফেরদৌস হাসান তার গাড়ীতে শাওনকে বসতে বললেন।ড্রাইভার আছে সামনে।তারা দুজনেই পেছনে বসলো।
শাওন ভদ্র ভাবে বসে আছে।তার পাশেই একজন ভদ্রলোক।দেহ চওড়া।বলিষ্ঠ দেহের মানুষটা।
দেখে মনে হয় অনেক পুরোনো অফিসার।চেনা চেনা লাগে তাও অচেনা।

মৌনব্রত ভেঙ্গে ফেরদৌস হাসানই মুখ খুললেন।বললেন,’-‘আচ্ছা! তোমার বাবার নাম কি?’

শাওন সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলো।-‘আবু শামীম ‘যেন আগে থেকেই উত্তর রেডি রেখেছিলো।

-‘ম্যাজিস্ট্রেট আবু শামীম?’

-‘জ্বী।চিনেন আমার বাবাকে?’

-“হ্যাঁ চিনি।আমার এক ক্লাস সিনিয়র ছিলেন তাও হাই স্কুলে থাকাকালীন।ভাবছো মনে রেখেছি কি করে?তোমার দাদা আমার বাবার বন্ধু ছিলেন।সেই সূত্রে আলাপ হতো।উনি আমায় দেখলেই চিনবেন।বছর বাদেই যেকোনো অনুষ্ঠানে আমাদের দেখা হতো।কত ভালো মানুষ তোমার বাবা।লাস্ট ইয়ার বসে একসাথে গোলাপ জাম খেয়েছিলাম।তুমি ছিলেনা।নাহলে দেখতাম। মনে হয় তোমার আম্মু ছিল।ওহ হো!তোমরা ভাই বোন কজন?’

-“আমরা ভাইবোন তিনজন।আমার আপু বড়।তারপর আমি।এরপর আমার ছোটবোন’

-‘ওহহ।তোমার আপুর বিয়ে হয়েছে?’

-“হবে।শীঘ্রই।আপনি তো আসবেনই।বাবা আপনাকে ঠিক দাওয়াত করবে।যথা সময়ে কার্ড পেয়ে যাবেন’
—–
সাভারের একটা হসপিটালে আছে রেদোয়ানের ফুফাতো ভাই রকি।কেবিনে শাওন আর মিস্টার ফেরদৌস এক সাথেই ঢুকলো।রকি তখন স্যুপ খাচ্ছিল।শাওনকে দেখে নড়েচড়ে বসেছে সে।শাওন ঠাণ্ডা মাথায় টুল একটা টেনে ওর কাছে বসলো।ফেরদৌস হাসান দূরে একটা সোফায় বসেছেন।

-‘তো বলো তুমি রেদোয়ানের বাসায় লাস্ট কবে গিয়েছিলে?’

রকি শাওনের প্রশ্নে চোখ বড় করে তাকিয়ে সরে গিয়ে বললো,’আমার মাথা ঘুরছে।আমি কিছু মনে করতে পারছিনা।না না আমি সব ভুলে যাচ্ছি আমার শরীর খারাপ করছে।ওহহহ!!মরে যাবো’

শাওন টুল ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে হাত ভাঁজ করে রকির নাটক দেখছে।ফেরদৌস হাসান বাঁকা হাসি দিয়ে শাওনের দিকে তাকালেন, শাওন কি করে দেখার জন্য।
শাওন মাথা ঘুরিয়ে আড়মোড় ভেঙ্গে দুহাত দিয়ে দুইগালে দুইটা চড় মেরে দিলো রকির।তাও আবার একসাথে।রকির মনে হলো ওর কানের পর্দা ফেটে গেছে।চোখ গোল হয়ে গেছে।এবার মনে হয় সত্যি সত্যি ওর মাথা ঘুরাচ্ছে। চোখ একবার খুলছে আর একবার বন্ধ করছে সে।
ফেরদৌস হাসান হাসি দমিয়ে রাখলেন।শাওনকে দেখে বোঝা যায়না তার হাত এরকম দ্রুত চলে।
শাওন রকির কান মুঠো করে ধরতেই ফেরদৌস হাসান নড়েচড়ে বসে বললেন,’রিমান্ড নিছিলা নাকি কখনও?’

-‘কখনও বলছেন কি স্যার।আমার কথা না শুনলেই হাত দিয়ে কাজ চালাই।দুগালে একসাথে থাপ্পড় মারলে দেখবেন সত্যি কথা বলে দেবে।কানের পর্দা ফাটানোর ভয় একেবারে দরজার মুখ পর্যন্ত নিয়ে গিয়ে দেখিয়ে আবার ব্যাক আনিয়ে দেবে’

ফেরদৌস হাসান খিলখিল করে হেসে ফেললেন এবার।হাসি আর আটকে রাখতে পারলেননা।

শাওন রকির কানে চাপ দিয়ে বললো,’শুধু বলো লাস্ট কবে গিয়েছিলে?’

-‘ততততত’

-‘তততো?’

-‘তিন মাস আগে।’

শাওন কান ছেড়ে দিয়ে টুল টেনে বসলো আবার তারপর বললো,’ওহ তিন মাস আগে?’

-‘হ্যাঁ’

শাওন আরেকটা চড় মেরে দিলো।রকি রেগে বললো,’এবার মারলে কেন?’

-‘বুঝতেছিনা।এতক্ষণ নাটক করছিলে।এখন নাটক করছোনা তার প্রমাণ কি?প্রথমত রেদোয়ান আর তার স্ত্রী আশার মার্ডারের দিন তোমার ডায়রিয়া হলো।হসপিটালে ভর্তি হলে।ফাইন!!কিন্তু এতদিন পরেও অসুস্থ হওয়ার নাটক করছিলে কেন তা বুঝলাম না।নুহাশ আসলো তার সামনে একই নাটক করলে।আমি জানতে চাই, কেন করলে??’

-‘এখন যদি বলি তাহলে সেটা বিশ্বাস করবে?’

শাওন পায়ের উপর পা তুলে বসে বললো,’হ্যাঁ বলো’

-“দু মাস আগে গেছিলাম’

এবার মাথায় চড় খেয়ে বসে আছে রকি।শাওনকে পারছেনা কাঁচা চিবিয়ে খেয়ে ফেলছে।লাল হয়ে গেছে তার চোখ।অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,’এবার কেন মারলে?’

-‘প্রথমে তিন মাস বলছো কেন?’

ফেরদৌস হাসান হাসতে হাসতে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,’শাওন আমি আজ যাই।দেখতে এলাম কেমন চলছে কেসটা।আর হ্যাঁ তোমার কথাই রইলো।মেধার আব্বুই আসলো তোমার সঙ্গে ‘
চলবে♥

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here