সন্ধ্যালয়ের প্রণয় পর্ব -১৬+১৭

#সন্ধ্যালয়ের_প্রণয়
#আফসানা_মিমি
| ষোল তম পর্ব |
❌[কোনোভাবেই কপি করা যাবে না]❌

অন্ধকারে একজন মেয়ের কান্না আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। মেয়েটি আর্তনাদ করে বলছে,
” ছেড়ে দাও। আমি এই বিয়ে মানি না। আমি কখনোই নিলয়কে স্বামী হিসেবে গ্রহণ করব না।”
মেয়েটির কথার প্রতিধ্বনি দেয়ালে প্রতিফলিত হচ্ছে। কিন্তু আফসোস দেয়ালের ঐপারে মেয়েটির কথা কেউ শুনতে পাচ্ছেনা।
কাঁদতে কাঁদতে মেয়েটির চোখের পানি ফুরিয়ে গিয়েছে। সে ধীরে দুর্বল পায়ে উঠে দাঁড়ায়। অন্ধকারে দেয়াল হাতরে দরজার কাছটায় এসে দরজার হাতল ঘোরায়। দরজা অপরপাশ থেকে তালাবদ্ধ। দরজার হাতল বারবার ঘুরিয়েও লাভ হলো না। মেয়েটি শরীরের সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ করে দরজায় কড়াঘাত করে তাতেও কোন ফলাফল পেল না। সে পূর্বের ন্যায় আর্তনাদ করতে লাগলো।
” মিস্টার নিলয় নীলাভ আমাকে ছেড়ে দিন বলছি। আমার জন্য সে অপেক্ষা করছে কি করেছেন আপনি তাকে? গতবারের মতো এবার ওকে মেরে ফেলেছেন? গতবার তো ভাগ্যের জোর ছিল বলে সে বেঁচে গিয়েছিল। এবার তার সাথে আপনি কি করেছেন? কোন ক্ষতি করবেন না। তাকে ছাড়া আমি ম’রে যাব।”

চিৎকার করতে করতে মেয়েটি সেখানেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে রইলো। সময় অতিবাহিত হতে থাকে, রজনী আরো গভীর হতে থাকে। কিন্তু কেউ মেয়েটিকে দেখতে আসে না। মেয়েটি এভাবে অচেতন অবস্থায় পড়ে থাকে মাটিতে।

মধ্যে রজনী। পৃথিবীর সকলে যখন ঘুমে মগ্ন তখন একজন লোক টলমল শরীরে হেঁটে একটি দরজার সামনে দাঁড়ায়। সারা শরীরে তার র’ক্তে’র ছিটাফোটা বিদ্যমান। পকেট থেকে চাবি বে করে তালা খুলে লোকটি প্রবেশ করে। দেয়াল হাতড়ে সুইচবোর্ডে চাপ দিতেই পুরো ঘর আলোকিত হয়ে পড়ে। লোকটি দেখতে পায়, তার আদরের সন্ধ্যাবতী মাটিতে পড়ে আছে। লোকটি সেই অবস্থায় সন্ধ্যার পাশে বসে পড়ে। সন্ধ্যার শুকনো মুখের উপর থেকে এলোমেলো চুলগুলো সরিয়ে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়। তার ঠান্ডা হাত দ্বারা সন্ধ্যার গাল স্পর্শ করতেই সন্ধ্যা কেঁপে উঠে। লোকটি বাঁকা হেসে বলে,

” দেখো সন্ধ্যাবতী, এই নিলয় নীলাভকে তুমি অনেক অপছন্দ করো। অথচ দেখো! এখন তুমি তাঁর কাছে।অতি কাছে। বউ হয়ে সারাজীবন এই নিলয়ের কাছেই থাকবে।”
নিলয় দুর্বল শরীরে উঠে দাঁড়ায়। পেশিবহুল শরীর থেকে একটানে শার্ট খুলে ফেলে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে পিটের অংশ দেখতে চেষ্টা করে সে। তিন স্থানে গভীরভাবে কেঁটে গিয়েছে। নিলয় তা দেখে তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলে,
” মনের ক্ষতটা যদি কেউ দেখতে পারতো তাহলে বুঝতো কেমন কষ্ট হচ্ছে। বাহ্যিক এই আঘাত তো ক্ষণিকের জন্য অভ্যন্তরীণ আঘাত খুবই গভীর। আমকে এবং আমার পরিবারকে যতটা কষ্ট দিয়েছ তার চেয়ে বেশি আমি তোমাকে কষ্ট দিব মিস ঐরাবতী। আগামীকাল থেকে তোমার দুঃখের দিন শুরু।”

নিলয় আর ক্ষতস্থানে পট্টি লাগাল না। সেই অবস্থায়ই দেয়াল ঘেঁষে বসে এক দৃষ্টিতে সন্ধ্যার দিকে তাকিয়ে থাকে।
—————–

সরকার বাড়িতে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। সন্ধ্যার মায়ের মৃত্যুর আজ এক সপ্তাহ পূর্ণ হয়েছে। আরিফ সরকারের হাঁপানি রোগ বেড়ে গিয়েছে তিনি যেন এই পৃথিবীতে থেকেও নেই। নিলয়ের মা রেহানা একা হতে সব সামলাচ্ছেন। প্রভাতের সময়ে ফারুক সরকার এবং তার স্ত্রী সরকার বাড়িতে এসে উপস্থিত হয়। দুজনের চোখেই খুশির ঝিলিক যেন তারা একটা মোক্ষম সময়ের অপেক্ষায় ছিল এতদিন আর সেই সুযোগ আজ পেয়েছে। রেহেনা সকালের নাস্তা বানাচ্ছিল। সকাল সকাল ফারুককে দেখতে পেয়ে অবাক হয়ে যায়। কিছু মাস পূর্বেই ফারুক সরকারকে আরিফ সরকার রিহাবে পাঠান। অতিরিক্ত মদ্যপান থেকে ছেলেকে দূরে সরিয়ে রাখতেই এই ব্যবস্থা। ফারুক এসে রেহানার উদ্দেশ্যে বলে,

” ভাবি, সরকার বাড়ি তো এবার ধ্বংসের পথে। বাবা তোমার ছেলেকে ভরসা করে কোম্পানির দায়িত্ব দিয়েছিল। আমাকেও ভরসা করেনি। এখন কী হলো! কোম্পানি তো শেষ।”
” এভাবে বলছো কেন ফারুক? শেষ থেকে শুরু করা যায়। বাড়ির এমন অবস্থায় এসব কথা বললে নয় কী? বাবা ও তো অসুস্থ। নিলয় সন্ধ্যা বাড়ি ফিরুক সব সমস্যার সমাধান হবে।”

” পুলিশের ভয়ে তোমার ছেলে আর সন্ধ্যা পলাতক। তারা আর ফিরবে না। এবার আমি এসেছি, সরকার বাড়ির সব দায়িত্ব আমি কাঁধে নিলাম।”

ফারুকের কথা শেষ হতে আরিফ সরকারের কন্ঠস্বর শোনা যায়। তিনি সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এসে ছেলেকে বলেন,
” আমি এখনো বেঁচে আছি ফারুক। এই সরকার বাড়ির সকল সিদ্ধান্ত এ আরিফ সরকার নেবে। কাকে কোন দায়িত্ব দেওয়া হবে তা এই আরিফ সরকার বলবে। তোমার এত চিন্তা করতে হবে না।”

” কিন্তু বাবা কারখানায় না গেলে তো আরো নিচে নামবে।”
” সে চিন্তা তোমার করতে হবে না। সব আমি করব।”

ফারুক সরকার ক্ষেপে যায়। বাবার সামনে উঁচু আওয়াজে কথা বলে সে।

” বাবা তুমি আমাকে সবকিছু থেকে বঞ্চিত করছো। আমি কিন্তু এবার আমার সম্পত্তির ভাগ চাইবো।”

আরিফ সরকার গর্জে উঠেন তার ছেলের এমন অধঃপতন দেখে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন।
” ফারুক!”
আরিফ সরকারের চিৎকারে সরকার বাড়ির কেঁপে উঠেছে। সাথে সরকার বাড়ির মানুষজনকেঁপে ওঠে। ফারুক বাবার রাগ সম্পর্কে অবগত আপাতত সে চুপ থাকাই শ্রেয় মনে করে। তাই নিজের স্ত্রীকে সাথে নিয়ে চলে যায় নিজ কক্ষে।
রেহানার চোখে জল ছেড়ে বাবার উদ্দেশ্যে বলেন,

” আমাদের সুখের পরিবার কি থেকে কি হয়ে গেল। আগের মত কি আর হবে না?”

” জানিনা বউমা। তবে আমার সন্ধ্যার জন্য খুব চিন্তা হচ্ছে না জানি মেয়েটা এখন কি অবস্থায় আছে।”

আরিফ সরকার এবং রেহানার কথোপকথনের মাঝে নীরব সরকারের চিৎকার করে কান্না করার আওয়াজ তাদের কানে ভেসে আসে। গত এক সপ্তাহ ধরে নীরব নিজের ঘর বন্দী করে রেখেছে। কারো সাথে কথা বলে না কারো খবর নেয় না। শুধুমাত্র সুমি বলে কিছুক্ষণ পর পর আর্তনাদ করে উঠে। এভাবেই চলছে নীরবের প্রভাত রজনী।

————————-

ভোর সকাল আশপাশে পাখিদের কিচিরমিচিরের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে শহর থেকে অনেক দূরে অবস্থিত কোন জঙ্গলে আছে তারা। পাখির আওয়াজেই সন্ধাবতী চোখ খুলে তাকায়। বুঝতে চেষ্টা করে সে এখন কোথায় আছে। অবশেষে মনে পড়ে সে এখন বিবাহিত এবং তাকে জোর করে এখানে নিয়ে আসা হয়েছে।

সারারাত জমিনে শুয়ে থাকার কারণে সন্ধ্যার সারা শরীর ব্যথা হয়ে গিয়েছে। শরীরের অসহনীয় যন্ত্রণায় কুঁকড়ে উঠে আহ করে আওয়াজ করে উঠে সে।
চোখ তুলে আশপাশ দৃষ্টিপাত করে সম্মুখেই শার্ট বিহীন নিলয়কে দেখতে পায় সে। নিলয় দেয়ালে হেলান দিয়ে হাঁটুতে এক হাত ঝুলিয়ে ঘুমিয়ে আছে। সন্ধ্যা খেয়াল করে ঝুলে থাকা হাতে র’ক্ত শুকিয়ে আছে। সন্ধ্যা ভয় পেয়ে যায়। সে ভাবে, নিলয়ের কিছু হয়নি তো? বেঁচে আছে কী?
সন্ধ্যা দুর্বল পায়ে নিলয়ের দিকে এগিয়ে যায়। নিলয়ের কাছে এসে দাঁড়াতেই সে থমকে যায়। নিলয়ের পিঠে গভীর ক্ষত যা থেকে র’ক্ত গড়িয়ে সারা পিফ ছড়িয়ে গিয়েছে। র’ক্ত শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে
সন্ধ্যা কাঁপা হাতে নিলয়ের ক্ষতস্থানে হাত ছুঁয়ে দেয়। এতে নিলয়সজাগ হয়ে যায়। সন্ধ্যার চোখে মুখে দুঃখের আভাস পেয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে। সন্ধ্যার চুলের মুঠি ধরে একদম কাছে টেনে হিসহিসিয়ে বলে,

“কী দেখতে এসেছিলে। বেঁচে আছি কিনা? এই দেখো, আমি বেঁচে আছি। তোমার আঘাতে মরিনি।”

” আমাকে ছেড়ে দিন, অসভ্য দুর্লয়।”

“এ জীবন থাকতে কখনোই না।”

” কেন করছেন এমন? কী পাচ্ছেন আমাকে বন্দি করে?”

” প্রশ্নটা তো আমার করা উচিত। কী পেলে আমাদের এত বড়ো ক্ষতি করে? তোমার একটা ভুলের জন্য তোমার জন্মদাত্রী মা আজ আমাদের মধ্যে নেই। এখনো তোমার আফসোস হচ্ছে না? ভালোবাসায় এতটাই অন্ধ হয়ে গেছো তুমি?”

” আমার মাকে আমি মারিনি। আমার মাকে আপনি হত্যা করেছেন।”

” হাসালে সন্ধ্যাবতী! সব সময়ের মতো নিজের দোষটা আমার ঘাড়ে চাপালে!”

সন্ধ্যা নিলয়ের কাছ থেকে ছাড়া পাওয়ার জন্য ছটফট করে থাক। নিলয় এতে করে সন্ধ্যার চুলের মুঠ আরো শক্ত করে ধরে নিজের কাছে টেনে আনে বলে,

” নড়াচড়া করে লাভ হবে না। এই নিলের বন্ধন থেকে কখনো মুক্তি পাবে না। আজ থেকে তোমার দুঃখের দিন শুরু। আমার পতন চেয়েছিলে কিন্তু দেখো আজ আমি ঠিক আছি। তোমার এবার কি হবে সন্ধ্যা?

“আপনার মন বলতে কিছু আছে?”

” আমরা দায়িত্বের পিছনে ছুটতে ছুটতে বক্ষস্থানের বাম পাশটায় ছোট হৃদয়ের কথা ভুলে যাই। ভুলে যাই সেখানে কাউকে স্থান দিতে পারি, কাউকে আপন করতে পারি। আমি সেই স্থান তোমাকে দিয়েছিলাম কিন্তু তুমি আমাকে নিঃস্ব করে দিলে।”

সন্ধ্যা নীলার কথা শুনে কাঁদতে থাকে। ব্যথাতুর স্বরে বলে,
” আমাকে ছেড়ে দিন নিলয়। আমার মনেপ্রাণে অন্য কারো বাস। আপনার অর্ধাঙ্গিনী হওয়ার চেয়ে যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যু শ্রেয়।”

নিলয় আরো রেগে যায়। সন্ধ্যাকে ছেড়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ায়।
” মৃত্যুর যন্ত্রণা তে কত কঠিন তা তুমি জানো না সন্ধ্যাবতী। আমার মনে যে আঘাত দিয়েছো সেই ক্ষত সারিয়ে নাও। তারপর ছাড়া পাওয়ার চিন্তা করবে।”

নিলয় কথা বলা শেষ করে চলে যায়। পিছনে রেখেযায় অশ্রুসজল চোখে তাকিয়ে থাকা সন্ধ্যাবতীকে।

——————

সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়ে এসেছে। সন্ধ্যা সেই অবস্থায় একটি ঘরে আবদ্ধ রয়েছে। তিন বেলা অনাহারে থাকায় শরীর বেশ দুর্বল হয়ে পড়েছে তার। ক্ষুধার তাড়নায় সন্ধ্যা পুরো ঘর তছনছ করে ফেলেছে কিন্তু খাবার পায়নি। অবশেষে সন্ধ্যা বিছানায় বসে পড়ে। মুখ ঢেকে কাঁদতে থাকে।
এমন সময় নিলয় দরজা খুলে ঘরে প্রবেশ করে, সন্ধ্যাকে কান্না করতে দেখে কোন কথা বলে না হাত থেকে খাবারের প্যাকেট বিছানার উপর রেখে চলে যায় ওয়াশরুমে।

নিলয়ের হাতে এবং পিঠে ব্যান্ডেজ করা। ব্যান্ডেজ এর উপরে র’ক্তে’র ছোপছোপ দাগ ভেসে উঠেছে। সন্ধ্যা কিছু বলেনা। এক দৃষ্টিতে খাবারের দিকে তাকিয়ে থাকে। এদিকে নিলয় সন্ধ্যার ভাবগতি সবই পর্যবেক্ষণ করছিল। হাত পা ধুয়ে এসে খাবার প্যাকেট খুলে নিজে খাওয়া শুরু করে দেয়। সন্ধ্যা লজ্জায় কিছু বলছে না। নিলয় বাঁকা চোখে সন্ধ্যা সন্ধাকে দেখছে শুধু। অবশেষে নিলয় এক লোকমা খাবার সন্ধ্যার মুখের সামনে ধরে।

” ভাঙবে তবু মচকাবে না। ক্ষুধার তাড়নায় মরে যাচ্ছো কিন্তু খাবার খাচ্ছো না। খাবার খেয়ে নাও, নয়তো আমার সাথে পাঙ্গা নিবে কীভাবে? শক্তি তো থাকতে হবে তাই না?”

সন্ধ্যা কোন কথা না বলে নিলয়ের হাতে খাবার খেয়ে নেয়। নিলয় উঠে দাঁড়ায়। পকেট থেকে মুঠোফোন বের করে সময় দেখে নেয় এরপর সন্ধ্যার উদ্দেশ্যে বলে,

” পালাতে চেষ্টা করো না সন্ধ্যাবতী। সফল হবে না। আমি এখন যাচ্ছি আবারো ফিরে আসবো। অনেক প্রশ্নের উত্তর চাইবো। তৈরি হয়ে নাও।”

নিলয় চলে যায়। সন্ধ্যা ভাবতে থাকে অতীতের সেই দিনগুলোর কথা।

অতীত……

চলবে…….#সন্ধ্যালয়ের_প্রণয়
#আফসানা_মিমি
| সতেরো তম পর্ব |
❌[কোনোভাবেই কপি করা যাবে না]❌

প্রভাতীর লগনে প্রকৃতির পরিবর্তনে হারিয়ে যাচ্ছে দুজন। মাথার উপর ঝাঁক ঝাঁক বেঁধে পাখিরা নিজ গৃহে থেকে খাবারের সন্ধানে যাচ্ছে কিন্তু দুই মানব মানবীর বিন্দু মাত্র ইচ্ছে নেই নিজের কর্মস্থলে ফিরে যেতে।
শহরের সেই পুকুরের পাড়ে পা ভিজিয়ে বসে আছে নিলয় এবং সন্ধ্যাবতী। সন্ধ্যার মন বিষন্নতায় ঘিরে আছে। সারারাত দুজন একসাথে এই পুকুর পাড়ে বসে। নিলয় সন্ধ্যাকে কোন সেই ঘটনার পর আর কোন প্রশ্ন করেনি। সে জানে সন্ধ্যা নিজ থেকেই তাকে সব বলবে। অবশেষে সেই সময় আসে। সূর্যোদয়ের সাথে সাথে সন্ধ্যার ভয়ও কেটে যায়। দূর আকাশের নীলিমায় তাকিয়ে সন্ধ্যা মনের অবক্তব্য প্রকাশ করে।

” আপনি জানেন রাব্বি বেঁচে আছে?”
” মরলে তো বেঁচে থাকবে?”
সন্ধ্যা বিরক্ত হয়। তার পাশে বসে থাকা অসভ্য দুর্লয় সবসময়ই পাল্টা প্রশ্ন করে। সন্ধ্যার ইচ্ছে করে তখন তাকে গলা টিপে ধরতে। কিন্তু নেহাতই বড়ো ভাই এবং সবচেয়ে কাছের বন্ধু নয়তো সন্ধ্যার ভাবনার কাজ করে ফেলতে দু-দণ্ড সময় ব্যয় করতো না।
” ত্যাড়াবাঁকা কথা বললেই নয় কী?”
নিলয় হাসে। সন্ধ্যা তাকে লক্ষ্য করে ভেবে মনে প্রশান্তি অনুভব করে।
” সেদিন রাব্বির কিছু হয়নি। যেই লোককে আমি তুমি এবং সবাই দেখেছিল সে অন্যকেউ ছিল। সারামুখে র’ক্ত ছিল বিধায় আমরা কেউ চিনতে পারিনি।”
” রাব্বি কেন এমন করেছিল?”
” সেটা তুমিই জানো।”

সন্ধ্যা ক্ষেপে গিয়ে নিলয়ের পিঠে দুরুম করে কিল বসিয়ে দেয়।
” আমি কীভাবে জানবো। আমি তো আপনার সাথেই ছিলাম। বলুন না!”
” এত জানার আগ্রহ ভালো না সন্ধ্যাবতী।”
সন্ধ্যা কিছুটা অভিমানী হয়ে অন্যদিকে ফিরে বসে। নিলয়ের কাছে মুহূর্তটা অসাধারণ লাগছে। সন্ধ্যাকে এখন কোথাও লুকিয়ে রাখতে ইচ্ছে করছে।
নিলয় সন্ধ্যাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে এনে বলে,
” আপনজনের সাথে অভিমান করা যায় মিস ঐরাবতী। আমি কী আপনার আপনজনের কাতারে পড়ি?”
” না।”

সন্ধ্যা দুষ্টুমি ভরা হেসে মুখ ফিরিয়ে বসে রয়। নিলয় হাতের বন্ধনীতে দৃষ্টিপাত করে সময় দেখে নেয়। বসা থেকে দাঁড়িয়ে সন্ধ্যার উদ্দেশ্যে বলে,
” এই মুহূর্তে বাড়ি ফেরা সম্ভব না সন্ধ্যা। চলো অফিসে যাই। আজ রাফসানদের সাথে জরুরী কাজ আছে।”

সন্ধ্যা তাই করে।
—————————–
কাল পরিবর্তনের সাথে সাথে নিলয়ের কোম্পানীরও পরিবর্তন ঘটে। সন্ধ্যা নিজ পরিশ্রম এবং সাফল্যতায় নিলয়ের বরাবরের পদ পায়। প্রায় একমাস আগে আরিফ সরকার অফিসিয়ালিভাবে সন্ধ্যাকে কোম্পানির দায়িত্ব দেন যতটুকু দায়িত্ব নিলয়কে দেওয়া হয়েছিল। আজকাল সন্ধ্যা নিজের মরজিতে চলাফেলা করে। নিলয়ের সাথে কথা বলার সময়টুকু তার নেই।
ঘড়িতে সময় নয়টা বাজে পঁয়তাল্লিশ মিনিট। নিলয় এখনো বিছানায় শুয়ে। চোখ থেকে ঘুম সরছেই না। রেহানা ছেলের নড়চড় না দেখে চিন্তায় পড়ে গেলেন। ঘরে এসে ছেলের কপোলে হাত রেখে পর্যবেক্ষণ করেও হতাশ হলেন। জ্বর নেই তবে এত সকাল অব্দি ঘুমানোর কারণ কী? ছেলের পাশে বসে কিছুক্ষণ মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন।
” মা! বাবা কী কাজে কখনো অবহেলা করেছে?”
রেহেনা বেগম নিঃশব্দে হাসেন। ছেলের মাথায় আরেকটু গভীরভাবে হাত বুলিয়ে বলেন,
” তোর বাবার কাজ আগে ছিল। তিনি কাজের প্রতি অনেক দৃঢ়তার সাথে পালন করতেন ঠিক তোমার মতো।”
” আমি বাবার মতো হতে পারিনি মা! এই দেখো, আজ প্রথম আমি আমার কাজকে অবহেলা করেছি।”
” তোর কী শরীর খারাপ?”
” না তবে বল পাচ্ছি না।”
“তৈরি হয়ে নে।”

রেহেনা চলে যায়। ছেলের হতাশায় নিজেও চিন্তিত হয়।
অফিসে পৌঁছে নিলয় সন্ধ্যাকে রাফসানের সহিত খোশগল্প করতে দেখতে পায়। হাতের বন্ধনীতে তখন সময় দেখে নেয় সে। এই সকালে রাফসানকে এখানে দেখে নিলয় ভ্রু যুগল কুঁচকে নেয়। সন্ধ্যা এতোটাই রাফসানের প্রতি মশগুল যে নিলয়ের আগমনের আভাসও পায়নি। নিলয়ের রাগ হয় নিজের কেবিনে প্রবেশ করে একটু জোরেই দরজা আটকে দেয়।

পাঁচ মিনিট পর সন্ধ্যা দুই মগ কফি হাতে নিলয়ের কেবিনে প্রবেশ করে। নিলয় তখন কম্পিউটারে কি যেন দিখছিল। সন্ধ্যার আগমনে তার মনোযোগ কম্পিউটার থেকে বিন্দু পরিমাণ সরেনি।
” আজ এতো দেরি করলেন যে?”
নিলয় নিশ্চুপ হয়ে ল্যাপটপের কিবোর্ডে কিছু একটা চেপে যাচ্ছে। নিলয়ের পক্ষ থেকে কোন প্রত্যুত্তর না পেয়ে সে আবারও বলে,
” মিস্টার রাফসান আপনার সাথে দেখা করবে বলে অপেক্ষা করছে। শুনছেন! কফি এনেছি।”

” আমি এখন ব্যস্ত। কফি টেবিলের উপর রেখে যেখান থেকে এসেছেন আবার সেখানে ফিরে যান। এমন যেন না হয়, আপনি এখানে থাকলে আমি খারাপ কিছু করে বসি।”

সন্ধ্যার ঠায় দাঁড়িয়ে রয়। নিলয়ের রাগের কারণ সে বুঝতে পারছে না। মনে কিছুটা সাহস সঞ্চয় করে সন্ধ্যা নিলয়ের কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়ালে নিলয় কাঁধে হাত রাখতেই নিলয় চেয়ার ঘুরিয়ে সন্ধ্যার হাত ধরে নিজের কোলে এনে বসায়। সন্ধ্যার হাত শক্ত করে ধরায় সে খুব ব্যথা পায়। সন্ধ্যার চোখে পানি চলে আসে। সন্ধ্যা কিছুটা আর্তনাদ করে বলে,
” আঘাত করছেন কেন? আমি কি করেছি?”

” আপনি খুব ভালো করে জানেন। আমার রাগের আপনার ধারণা আছে মিস ঐরাবতী। আমার রাগ হলে আমি কাউকে মানি না। আপন পর কেউ আমার সামনে কিছুই না। তবুও কোন সাহসে আপনি আমার কাছাকাছি আসার চেষ্টা করছেন? আপনি কি বুঝতে পারছেন না! আমি অনেক রেগে আছি। একবারও কি জিজ্ঞেস করেছেন কেন আমার এই অবস্থা?”

” আপনার মনের ভেতর কী ঢুকে বসে আছি? আমি দাদার কাছে বিচার দিব। আপনি একটু বেশি বেশি করছেন।”

” যার কাছে ইচ্ছা তার কাছে নালিশ কর। আমি কাউকে ভয় পাই না। নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মেরো না সন্ধ্যাবতী! আমি ভালোর ভালো, খারাপের খারাপ।”
সন্ধ্যার চোখে জল চিকচিক করছে, ঠোঁটগুলো তিরতির করে কাঁপছে, কপালের ভ্রু যুগলের মাঝে সুক্ষ্ম ভাঁজ ফুটে উঠেছে। নিলয় রাগ কমে আসে। সন্ধ্যার জলের টুইটুম্বর হয়ে যাওয়া আখিদ্বয়ের গভীরে ডুব দেয় সে। নিলয়ির কি হয় নিজেও জানে না। সে একটু নিচে হয়ে সন্ধ্যার চোখে অধর ছুঁয়ে দেয়।

এদিকে সন্ধ্যাবতী নিস্তব্ধ বনে যায়। নিলয়ের পক্ষ থেকে এমন কিছু আসে কখনো করে নি সে।
নিলয় সন্ধ্যাকে ছেড়ে দেয়। টেবিলের উপরে রাখা কফির কাপে চুমুক এঁকে বলে,

” আমার আপনজনকে নিজের আশেপাশে রাখতে বেশি স্বাচ্ছন্দ বোধ করি।”

সন্ধ্যা কোন প্রত্যুত্তর করে না। নিলয়ের কেবিন থেকে কিছু না বলেই বের হয়ে যায়। সে এখন একটি ঘোরের মধ্যে রয়েছে। মনে হচ্ছে জীবনে নতুন কিছু আগমন ঘটতে চলছে।
————

সুমি নীরবের সামনে বসে আছে। নীরবের কঠোর আদেশ পালনে নাকজ করছে সে। সুমির শত অনুরোধ নীরবের কাঠিন্য মন গলাতে পারেনি। অবশেষে সুমি নীরবের উদ্দেশ্যে বলে,

” তোমার সাথে দেখা হওয়ার পর থেকে ওয়াদা করেছিলাম, সুখে, দুঃখে জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তোমার পাশে থাকব।”
” তো ওয়াদা পূরণ করো।”
” তোমার কষ্ট হচ্ছে না নীরব? আপনজনদের বিরুদ্ধে এমন ঘৃণিত কাজ করতে?”

নীরব সরকার মুখ ফিরিয়ে নেয়। হুইলচেয়ার ঘুরিয়ে জানালার পাশে গিয়ে বলে,
” তারা আমার সাথে এর চেয়েও জঘন্য কাজ করেছে সুমি। আজ আমার অপারগতা বলে তুমিও মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছ? সামান্য কাজই তো দিয়েছি। তোমায় শুধুমাত্র এই কাগজগুলো তাদের কাছে পৌঁছে দিতে বলেছি। তুমি সেখানে যাবে আর আসবে। তোমার সাথে একজন অ্যাসিস্ট্যান্ট থাকবে। আমি এ কাজটা সন্ধ্যাকে দিতে পারতাম কিন্তু সে একজন জ
যুবতী মেয়ে একা সেখানে গেলে বিপদ হতে পারে।”

প্রিয়তম স্বামীর কথা শুনে সুমির তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে। চোখের পানি মুছে কাতার স্বরে বলে,

” তোমার কাছে মেয়ে প্রিয়, স্ত্রী নয়। তা আবারও তুমি প্রমাণ করলে নীরব। আসছি, নিজের খেয়াল রেখো।”

সুমি চলে যেতেই নিরব গভীর নিঃশ্বাস ফেলে
হাতের মুঠে রাখা একটা লকেট বের করে সেখানে সুমির ছবির উপর হাত বুলায়, বিড়বিড় করে বলে,

” পরিস্থিতি আমাকে কঠোর হতে বাধ্য করেছে সুমি। আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি। কিন্তু যখন আমার পঙ্গুত্ব জীবনের কথা মনে হয় ততবারই মনে হয় তোমার পাশে আমাকে মানায় না। এজন্যই তো খারাপ ব্যবহার করি। তোমাকে কষ্ট দেই।”
————

দুপুর থেকে নিলয় সন্ধ্যার তলব করে যাচ্ছে কিন্তু সন্ধ্যার কোন খোঁজ খবর নেই। নিলয় সন্ধ্যার কাছে ক্ষমা চাইবে। নিজের ইমোশনালকে কন্ট্রোল করা উচিত ছিল তার। নিলয় ভাবছে সন্ধ্যা হয়তো সকালের ব্যবহারটা মেনে নিতে পারছে না। নিলয়ের মনে ভয়ের বাসা বাঁধে। সন্ধ্যা যদি তাকে ভুল বুঝে! যদি দূরে সরে যায়! নিলয় তো তা সইতে পারবে না।

নিলয় অফিস থেকে বের হবে এমন সময় কিছু পুলিশ এবং কিছু স্যুটবুট পরিহিত লোক অফিসের প্রবেশ করে। নিলয় কিছু বলবে তার আগেই পিছন থেকে একজন মেয়ের শক্ত স্বর শোনা যায়। সে বলছে,

“আপনারা যেই অপরাধীর খোঁজ করছেন সে আপনাদের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে। মিস্টার নিলয় নীলাভ। এই লোক ই সরকার কোম্পানির সকল টাকা আত্মসাৎ করেছে। ”

নিলয় অবিশ্বাস্য চোখে মেয়েটির দিকে তাকায়। এরপর পুলিশদের কিছু বলবে তার আগেই নিলয়ের হাতে হাতকড়া পরিয়ে দেয় একজন পুলিশ। এরপর সেখান থেকে টেনে নিয়ে যায় অফিসের বাহিরে।

চলবে……….

[আসসালামু আলাইকুম। কেমন আছেন সবাই? অনেকদিন পর গল্প দিলাম। সবার টাইমলাইনে গেলে রেসপন্স করবেন প্লিজ।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here