সাপলুডুর সমাপ্তিতে পর্ব ৩+৪

#সাপলুডুর_সমাপ্তিতে
তন্বী ইসলাম

০৩

“আমি বিয়ে করেছি তনু, শশুরবাড়িতে আছি এখন… তাই চাইলেও কথা বলতে পারবো না। প্লিজ ভুল বুঝো না আমায়……

এবারে রাগ টা আমার দ্বিগুণ পরিমাণে বেড়ে গেলো। আমি সিরিয়াস হয়ে তাকে একটা প্রশ্ন করলাম, সে কিনা আমার সাথে মজা করছে।
আমি কিছুটা মেজাজ দেখিয়ে বললাম..
“এই ধরনের মজা কিন্তু আমার একদমই ভালো লাগছে না। আপনি কোথায় আছেন বলুন, কেন কথা বলতে চাইছেন না আমার সাথে? কি এত ব্যস্ততা আপনার?
“আমি মজা করছি না তনু, সত্যিই আমি বিয়ে করেছি। তবে নিজের ইচ্ছেতে নয়, এক প্রকার বাধ্য হয়েই আমাকে বিয়েটা করতে হয়েছে।

আমি নিজ যায়গায় জমে গেলাম এবার। এটা কি বলছে সে? হাতগুলো কাঁপছে আমার, এই বুঝি ফোনটা হাত থেকে ফসকে মাটিতে পরে যাবে। ওপাশ থেকে উনি বলতে লাগলেন..
“হ্যালো.. হ্যালো.. কি হলো তনু!
আমি সম্ভিতে ফিরে এসে কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম
“আপনি সত্যিই বিয়ে করেছেন?
” বললাম তো, বাধ্য হয়ে আমাকে বিয়েটা করতে হয়েছে।

এবার আর ঠিক থাকতে পারলাম না, ফোনটা অটোমেটিক ভাবেই পরে গেলো নিচে। আমিও ধপাস করে বসে পরলাম মাটিতে। এটা কি বললেন উনি? চোখের বাধ ভেঙ্গে পানি বেরোতে চাইতে, বুকফাঁটা আর্তনাদ বুকের পাজর ভেদ করে আসছে৷ গলা ফাটিয়ে গগনবিদারী চিৎকার করতে ইচ্ছে করছে খুব, কিন্তু এর কোনোটাই যে করা যাবেনা। বাড়িতে মা বাবা আছে, আরো অনেকেই আছে, তাই চাইলেও নিজের কষ্ট টা নিজের মতো করে প্রকাশ করতে পারবো না।

আমার চোখ বেয়ে নিঃশব্দে পানি পরছে। ফোনটার দিকে তাকালাম এবার, ততক্ষণে ওপাশ থেকে কলটা কেটে দেওয়া হয়েছে। আমি অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে ফোনটা হাতে নিলাম। এরপর চুপিসারে রুমে ঢুকে চলে গেলাম আমার বিছানাটায়। উপুড় হয়ে শুয়ে বালিশে মুখ গুজে খুবই সতর্কতার সাথে কাঁদছি আমি।

সেদিন সারাদিন আর ঘর থেকে বেরোলাম না, কিছু খেতেও ইচ্ছে করেনি, তবে দুপুরে মায়ের অনেক জোরাজুরিতে খেতে হলো আমাকে। বিকেলের দিকে জানলাটার পাশে বসে একধ্যানে বাইরে তাকিয়ে রইলাম। মা আমাকে প্রশ্ন করলো আমার কিছু হয়েছে কিনা। আমি শুধু মাথা নাড়িয়ে জানান দিলাম, কিছুই হয় নি আমার। সন্ধ্যের পর সেই চিরচেনা নাম্বারটা থেকে কল এলো। তখনও মোবাইলটা আমার হাতেই। আমি অতি আগ্রহে কলটা রিসিভ করলাম এই আশায় যে সে বুঝি এক্ষুনি বলবে, আমি বিয়ে করিনি তনু, তোমার সাথে মজা করছিলাম শুধু। বিয়ে তো আমি শুধু তোমাকেই করবো।

সবকিছুকে ভুল প্রমানিত করে দিয়ে উনি বললেন
“আমাকে মাফ করে দিও তনু।
আমি শুধু নিঃশব্দে শুনলাম। উনি আবারও বললেন
“আমার বাবা হজ্জ্বে যাচ্ছেন। আর উনার ইচ্ছে হজ্জে যাবার আগেই আমাকে বিয়ে করিয়ে তারপর যাবেন। তাই বাবার ইচ্ছেটা পূরণ করতে নিজের ভালোবাসাকে বিসর্জন দিতে হলো আমাকে।
আমি এবারে নির্জীব গলায় বললাম
“আপনার বউ বোধহয় অনেক সুন্দরী।
সে হেসে বললো
“সে আমার মায়ের বোনের মেয়ে, মানে আমার খালাতো বোন। তবে তোমার কথা সত্য, সে সত্যিই অনেক সুন্দরী আর অনেক ভদ্র একটা মেয়ে।

আমি চোখ বুঝলাম। হতাশ গলায় বললাম
“খালাতো বোনকে বিয়ে করেছেন, ভালোই তো।
“আমার মায়ের অনেক দিনের ইচ্ছে ছিলো, তাকে আমার বউ করে আনবে, আমার বাবাও রাজী ছিলো।
“ওহ!
“আচ্ছা এখন রাখছি।

আমি কোনো বাধা দিলাম না। যে আমার নয়, তাকে জোর করে কথা বলানোর তো কোনো মানেই নেই। মনকে অনেক বুঝ দিলাম, বুকে পাথর চাপা দেওয়ারও চেষ্টা করলাম। কিন্তু কোনো লাভই হচ্ছে না। কিছুতেও ভুলতে পারছি না তাকে। বার বার ইচ্ছে করে, তার কন্ঠটা একবার শুনতে। এ কন্ঠে যেনো আমার প্রাণ মিশে আছে। দুদিন পর নিজ থেকে কল করলাম, সে রিসিভ করে বললো
“এভাবে যখন তখন কল করো না প্লিজ। আমি এখন বিবাহিত।

আমি মৃদু হেসে বললাম
“আমি ভুলে গেছিলাম আপনি বিবাহিত।
“এখন থেকে মনে রাখার চেষ্টা করো, তা নাহলে আমার নতুন সংসারে সমস্যা হতে পারে।

আমি আর কোনো কথা না বাড়িয়ে ছোট্র করে বললাম
“ভালো থাকবেন।

সেদিনের পর আমি উনাকে আর একবারও কল করিনি, কিন্তু ভুলতেও পারিনি তাকে। মানুষ বলতো, প্রথম ভালোবাসা নাকি কখনোই ভুলা যায় না, আজ সেটা আমার কাছে পরিষ্কার। প্রতি রাতেই আমাকে কাঁদতে হয়। চেষ্টা করি না কাঁদার, তবে তার কথা মনে হলেই আমার কান্না পায়। প্রচুর কান্না পায়। কত রাত যে নির্ঘুম কাটিয়েছি, কত রাত যে বালিশ ভিজিয়েছি, তা আমারও অজানা।

ইদানিং একটা নাম্বার থেকে প্রায়ই ভালোবাসার মেসেজ আসে, প্রায়ই কল আসে। রিসিভ করলে কথা বলে না। হ্যালো হ্যালো বলে নিজ থেকে বিরক্ত হয়েই কেটে দেই। এটা এখন নিত্যদিনের ঘটনা। আমি গুরুত্ব দেই না তেমন।

এর মাঝে জানতে পারি মেসেজ দেওয়া আর কল করা ছেলেটা আমাদের পাশের এলাকারই। নাম সজল। ওর বাবা সরকারি চাকুরিজীবী লোক, এলাকার প্রতাপশালীদের মধ্যে অন্যতম। বর্তমানে ডিগ্রি তে পড়ছে সে। ছেলেটা নাকি আমাকে খুব ভালোবাসে। বিয়ে করতে চায়। আমি এড়িয়ে যাই ব্যাপারটা। আমার কোচিং এর সামনে প্রায় প্রতিদিনই ঘুরঘুর করে সে, কিছুটা গুন্ডা টাইপের দেখতে, চেহারাও তেমন ভালো না। বান্ধবীরা আমাকে বার বার সতর্ক করে, যেনো এ ছেলের প্রেমে না পড়ি। একেতো দেখতে সুন্দর না, তার উপর গুন্ডা গুন্ডা টাইপ। আমি ওদের আশ্বাস দেই, আর যাইহোক এ ছেলের প্রেমে আমি পরবো না। যেখানে প্রথম ভালোবাসাটাকেই এখনো ভুলতে পারলাম না, সেখানে নতুন করে প্রেমে পরার কোনো মানেই হয় না।

সেদিন বেহায়ার মতো ফায়াজ নামের সেই ছেলেটার নাম্বারে কল করেছি, যে আমার মনে ভালোবাসার রঙ লাগিয়েছিলো। কন্ঠটা শুনতে ইচ্ছে করছিলো খুব।

একবার রিং হতেই ওপাশ থেকে রিসিভ হলো। আমি ভেজা গলায় সালাম দিলাম। উনি সালামের উত্তর দিয়ে বললেন
“কেমন আছো?
“ভালো। আপনি?
“আলহামদুলিল্লাহ। তা কি খবর তোমার?
আমি ধীর হয়ে বললাম
“আমার আর খবর।
“এভাবে কেন বলছো?
আমি কথা ঘুরিয়ে বললাম
“আপনার ওয়াইফ কেমন আছে?
“খুব ভালো আছে সে। তোমার লেখাপড়া কেমন চলছে?
আমি মৃদু হেসে বললাম
“ভালোই।
সে আবারও বললো
“ভালো করে লেখাপড়াটা করো, সামনে এসএস সি, রেজাল্টটা তো ভালো করতে হবে। তা নাহলে ভালো কোনো কলেজে চান্স পাবে না।

আমি উত্তর দিলাম না তার কথার। সে আবারও ব্যস্ততার অজুহাত দেখিয়ে কল টা কেটে দিলো। মনে জিদ চাপলো সেদিন, এভাবে নিজেকে বার বার ছোট করার কোনো মানেই হয় না। ভালোবাসাটাকে নাহয় মনের মধ্যেই পুষে রাখবো, তাও বেহায়ার মতো আর কল করবো না তাকে।

এসএসসি এক্সাম শেষ অনেক আগেই। এবার ফল প্রকাশের পালা। রেজাল্টের দিন অনেক দুশ্চিন্তার মধ্যে ছিলাম। অবশেষে দুশ্চিন্তার অবসান ঘটিয়ে ফল হাতে পেলাম। খারাপ না, মুটামুটি ভালোই হয়েছে রেজাল্ট। আমার বাবা মা খুশি, আত্মীয়স্বজনেরাও খুশি, তবে আমার শিক্ষকেরা আমার রেজাল্টে তেমন খুশি হতে পারেনি। আমার কাছ থেকে তাদের এক্সপেকটেশন আরো বেশি ছিলো। যাই হোক, আমাদের বাড়ির কাছাকাছিই একটা কলেজে ভর্তি হলাম। প্রথম বারের মতো কলেজে যাওয়ার অনুভুতিটাই অন্যরকম, তার উপর সব বন্ধবীরা মিলেই এ কলেজে ভর্তি হয়েছি। কলেজে আসা যাওয়া, পড়ালেখা, বান্ধবীদের সাথে সময় কাটানো, সব মিলিয়ে দিন ভালোই যাচ্ছিলো।

সেদিন এক বান্ধবী আমাকে আলাদা করে বাকিদের কাছ থেকে কিছুটা দূরে ডেকে নেয়। ব্যাপারটায় কিছুটা অবাক হই আমি। সে আমাকে চুপিসারে বলে
“একটা কথা বলার ছিলো তোকে।
আমি তীক্ষ্ণ চোখে তাকালাম তার দিকে। বললাম
“কি কথা?
“সজল ভাইয়াকে নিয়ে কিছু কথা।
“কোন সজল?
“ওই যে তোকে পছন্দ করে।

আমি কয়েক সেকেন্ড নিরব থেকে বললাম…
“ওহ। বল কি বলবি..
সে কিছুটা সময় এদিক ওদিক তাকিয়ে হাতের আঙ্গুলগুলো বার বার চাপতে থাকে। এরপর নিরীহ গলায় বলে
“সে তোকে অনেক ভালোবাসে রে।
“তো আমি কি করবো?
“তুই ওকে গ্রহণ করে নে।
আমি হাসলাম। বললাম
“তুই আমার বন্ধবী হয়ে উনার জন্য বলছিস যে? কি হলো হঠাৎ?
“সজল ভাইয়া গতকাল আমাকে কল দিয়েছিলো, সে সত্যিই তোকে অনেক ভালোবাসে।

আমি সাফ সাফ বলে দিলাম
“সে ভালোবাসে বলে যে আমাকেও ভালোবাসতে হবে এমন কোনো কথা নেই। আমি উনাকে ভালোবাসতে পারবো না বলে দিস।

আমি চলে এলাম সেখান থেকে। বান্ধবীটা আমাকে প্রায়ই সজলের কথা এটা ওটা বলতো। আমি এ কান দিয়ে শুনে ও কান দিয়ে বের করে দিতাম। ইন্টার মিডিয়েট প্রথম বর্ষ শেষ করে দ্বিতীয় বর্ষের মাঝামাঝি আছি। নতুন করে কোনো সম্পর্কে যাই নি তখনো। এর মাঝে সজলের ভালোবাসার দাবী তো আছেই। সব কিছুকে অগ্রাহ্য করে আমি সামনের দিমে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টায় আছি।

সেদিন বিকেলে ফোনে গান শুনছিলাম। এখন আর আম্মুর ফোন নয়, নিজেরই একটা ফোন আছে। আমার আব্বু একটা বাটন ফোন কিনে দিয়েছে আমায়। গান শোনার এক ফাঁকে কলটা বেজে উঠলো। আমি অবাক হলাম নাম্বারটা দেখে, এটা সেই সজলের নাম্বার। তবে এই নাম্বার তো উনার জানার কথা নয়, নতুন ফোন নিয়েছি। আমার ফ্যামিলির লোক আর বান্ধবীরা ছাড়া এ নাম্বার আর কেউ জানে না।

না চাইতেও আমি কল রিসিভ করলাম। ওপাশ থেকে কিছু বলার আগেই আমি বিস্ময় নিয়ে বললাম
“আপনি আমার এই নাম্বার পেলেন কোথায়?
সে হেসে বললো
“যাকে ভালোবাসি, তার নাম্বার পাওয়াটা তেমন কঠিন কোনো কাজ নয়।
উনার কথায় আমি বেশ বিরক্ত হলাম। দাঁতে দাঁত খিঁচিয়ে বললাম
“ফোন কেন করেছেন?
“তোমার সাথে কথা বলবো তাই।
“আমার সময় নেই।

ফোন কেটে দিলাম আমি। আবারও কল এলো, রিসিভ করলাম না। বার বার কল বাজতেই থাকলো। এক পর্যায়ে বিরক্ত হয়েই রিসিভ করলাম। ঝাঝ দেখিয়ে বললাম
“সমস্যাটা কি আপনার? কেন এভাবে বিরক্ত করছেন আমাকে?
” বিরক্ত না করলে যে আমাকে ভালোবাসবে না।
আমি অবাক হলাম, বললাম
“আমি আপনাকে ভালোবাসতে পারবো না। দয়া করে আমাকে বিরক্ত করবেন না প্লিজ।।

সে হেসে বললো
” যতদিন আমাকে তুমি ভালো না বাসবে, ততদিন তোমাকে এইভাবে বিরক্ত করেই যাবো।

এক প্রকার বাধ্য হয়েই আমি কলটা কেটে দিলাম।
সাথে ফোনটাও অফ করে দিলাম সাথে সাথেই।

দিন যাচ্ছে, আমার লেখাপড়া, কলেজ সব ঠিকঠাক ভাবেই চলছে। সাথে সেই সজলের ভালোবাসার দাবী নিয়ে বার বার ফোন করা তো আছেই। ইদানিং ওর ইমোশনাল কথাগুলো প্রায়ই আমাকে দুর্বল করে দেয়। আমি কি করবো না করবো দ্বিধাদ্বন্দে ভোগী।

সেদিন যখন সে আবারও কল দিলো আমি বললাম
“আমার বাজে একটা অতীত আছে, আপনি জানতে চান?
“অবশ্যই।
” জানার পর কি আমার প্রতি আপনার এই ভালোবাসা থাকবে?
“আগে বলো শুনি।

আমি একবার আকাশের দিকে তাকালাম। একটা দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে বলতে লাগলাম আমার সাথে ঘটে যাওয়া সেই হৃদয়বিদারক ঘটনা। সে শুনছে খুবই মনোযোগের সাথে।

আমার বলা কথা শেষ হলে কিছুটা সময় চুপ থেকে বললাম..
“কিহ, এবারেও কি বলবেন আপনি আমাকে ভালোবাসেন?
আমাকে অবাক করে দিয়ে সে হুহু করে হেসে উঠলো। হাসিটা বেশ খারাপ লাগলো আমার কাছে, ভাবলাম বোধহয় তাচ্ছিল্যের হাসি হাসছে। আমি বললাম
“জানতাম, এটা শোনার পর আপনার প্রতিক্রিয়া এমনটাই হবে।

সে এবার নরম গলায় বললো
“এভাবে বলছো কেন, আমি এমনটা মীন করে হাসিনি।
” তাহলে?
“তুমি কি ভাবছো এই সাধারণ একটা ঘটনা তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা কমিয়ে দিবে?
আমি শুনতে লাগলাম উনার কথা, ভাবতে থাকলাম, কি বলতে চায় উনি?

সে বললো
“এটা তো মাত্র সিম্পল একটা রিলেশন। আল্লাহ না করুক, তোমার যদি কয়েকটা বিয়েও হয়, এবং একটা বিয়েও না টিকে… এবং সে সময়েও যদি তুমি আমার কাছে ফিরে আসো.. আমি কখনোই তোমাকে ফেরাবো না। আমার ভালোবাসার দরজা সর্বদায় তোমার জন্য খোলা থাকবে।

চলবে……#সাপলুডুর_সমাপ্তিতে
তন্বী ইসলাম

০৪

সে বললো
“এটা তো মাত্র সিম্পল একটা রিলেশন। আল্লাহ না করুক, তোমার যদি কয়েকটা বিয়েও হয়, এবং একটা বিয়েও না টিকে… এবং সে সময়েও যদি তুমি আমার কাছে ফিরে আসো.. আমি কখনোই তোমাকে ফেরাবো না। আমার ভালোবাসার দরজা সর্বদায় তোমার জন্য খোলা থাকবে।

উনার কথা শুনে আমার কপালে খানিক ভাজ পরলো। কেন যানি কথাটা আমার মনে ধরলো না, এ দুনিয়াতে এমন মানুষ আছে বলে আমার মনে হয় না। কখন কার কাছে যেনো শুনেছিলাম, “খালি কলসি, বাজে বেশ”। এক্ষেত্রেও এমন হবে না তো?
আমি স্বাভাবিক গলায় বললাম
“আমার প্রতি আপনার এতো ভালোবাসা?
“বিশ্বাস হয় না?
“কিছুক্ষণ আগেও হয়েছিলো, কিন্তু আপনার এই কথা শুনার পর সেটা কিছুটা ফিকে হয়ে গেছে। এ জগতে এমন প্রেমিক মানুষ আছে বলে আমার মনে হয় না।
সে দৃঢ়ভাবে বললো
“আমি সত্যিই তোমাকে অনেক ভালোবাসি তনু।
আমি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললাম…
“বাসলেই ভালো।

সেদিন আর কথা বলতে ইচ্ছে হলো না। কেন যেনো মনে হলো এ ভালোবাসা সত্য নয়। তাও মুখের উপর কিছু বললাম না, ব্যস্ততা দেখিয়ে ফোন রেখে দিলাম। তার প্রতি যতটুকু নরম হয়েছিলাম, সে কথাটা শোনার ঠিক ততটাই কঠিন হয়ে গেলাম। হুট করে কাউকে আর বিশ্বাস করা যাবে না।

সেদিনের পর থেকে ইগ্নোর করতে থাকলাম। ফোন দিলেও রিসিভ করতাম না, বার বার কল করতে করতে এক সময় সেই কল করা বন্ধ করে দিতো। একদিন কলেজে যাবার পথে সেই সজল নামের ছেলেটিকে দেখলাম রাস্তার পাশে বাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। প্রথমে তাকে ইগ্নোর করে চলে যেতে চাইলেও পরে আর ইগ্নোর করতে পারলাম না, যখন দেখলাম সে বার বার হাতের ঘড়িটার দিকে চোখ বুলাচ্ছে। আমি রাস্তার পাশে একটা গাছের আড়ালে দাঁড়াতেই আমার বান্ধবী অবাক হয়ে বললো
“কি রে, এখানে দাঁড়ালি যে?
আমি ওকে আঙ্গুলের ইশারা করে সজলকে দেখালাম।

কয়েক মিনিটের মধ্যেই একটা বোরকা পরিহিত মেয়ে এসে উঠলো তার বাইকে। মেয়েটা আমার চাইতে বয়সে কিছুটা হলেও বড় হবে তা বুঝাই যাচ্ছে। আমি আমার বান্ধবীর দিকে তাকিয়ে বললাম
“কিরে, তুই তো বলেছিলি ও আমাকে প্রচুর ভালোবাসে। তাহলে এটা কি?
সে আমতা-আমতা করে বললো
“হয়তো ওর বোন হবে কিংবা আত্মীয়।
“কিন্তু ওদের হাবভাবে আমার তো তা মনে হচ্ছে না!

আমার বান্ধবীর কপালে ভাজ পরলো। সে শক্ত গলায় বললো
“দাঁড়া, আমি দেখছি।
সে হনহন করে চলে গেলো সজলের দিকে। সজল তখন বাইকে স্টার্ট দিতে যাবে ঠিক তখনই আমার বান্ধবীটা বলে উঠলো
“আরে সজল ভাইয়া যে।
সজল কিছুটা ঘাবড়ে গিয়ে তাকালো ওর দিকে। এরপর বাইকে বসা সেই মেয়েটার দিকে একবার তাকিয়ে আবারও দৃষ্টি ফেরালো ওর দিকে। বললো
“আরে পাপিয়া যে।
পাপিয়া মৃদু হেসে বললো
” কোথাও যাচ্ছেন নাকি? এই আপুটা কে? আপনার বোন?

বাইকে বসা মেয়েটা বোরকা পরা থাকলেও তার মুখমণ্ডল খোলা ছিলো। তার মুখের অভিব্যক্তি দেখেই বুঝা গেলো কথাটায় সে বেশ রেগে গেছে। সে সজলকে উদ্দেশ্য করে বললো
“এই মেয়েটা কে?
সজল প্রথমে বলতে কিছুটা দ্বিধা করলেও পরে বললো
“তুমি চিনবে না তাকে। আমার ছোটবোনের মতো।
এরপর আবার পাপিয়ার দিকে তাকিয়ে বললো
“কিছু বলবে?
“জানতে চাইছিলাম উনি আপনার কি কি হয়।
“আমার গার্লফ্রেন্ড।
পাপিয়া অবাক হয়ে বললো
“কিন্তু আপনি তো তনু কে পছন্দ করতেন যতটুকু আমি জানি। ইনফ্যাক্ট আপনি নিজেই আমাকে বলেছিলেন।

ওদের কাছ থেকে আমার দূরত্ব বেশি ছিলো না, তাই ওদের সমস্ত কথাবার্তা আমার স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। যদিও এই মুহূর্তে পাপিয়াকে থামানো উচিৎ ছিলো আমার, গার্লফ্রেন্ড সামনে আছে তাই। কিন্তু সত্যটা আমারও জানতে ইচ্ছে করছিলো খুব। তাই একমনে কথা গুলো শুনতে লাগলাম দাঁড়িয়ে।

পাপিয়া যখন সজলকে প্রশ্নটা করলো তার উত্তরে সজল বেশ ক্ষেপে গেলো। ক্ষিপ্ত কন্ঠে সে বলে উঠলো..
“আমার গার্লফ্রেন্ডের সামনে কি আমাকে অপমান করার জন্য আসছো তুমি?
“অপমান কেন করবো, আমিতো জাস্ট জানতে চাইছি।
“তাহলে শুনো, তোমার বান্ধবী এমন কোনো স্বর্ণের টুকরো নয় যে তার জন্য আমি বছরের পর বছর অপেক্ষা করবো।

কথাটা শোনার পর আর এক মুহূর্তও সেখানে দাড়ালো না পাপিয়া। হনহন করে চলে এলো আমার কাছে। সজলও তখন একবার আমার দিকে তাকালো, আমি চোখ ফিরিয়ে নিলাম সাথে সাথেই।

বিকেলে সজলের নাম্বার থেকে আমার ফোনে কল এলো। আমি রিসিভ করতেই সে ক্ষিপ্ত হয়ে বলে উঠলো
“তোমার বান্ধবীকে দিয়ে আজ এভাবে আমাকে ছোট না করলেও পারতে।
আমি শান্ত গলায় বললাম
“আমি কি করলাম?
“সবেমাত্র আমাদের প্রেমটা শুরু হয়েছে, আর তাতেই তুমি তোমার বান্ধবীকে দিয়ে বাধা দিতে শুরু করে দিলে? নিজে তো আমায় ভালো বাসলেই না, আবার অন্যকেও ভালোবাসতে দিবে না। কেমন মেয়ে মানুষ তুমি?

আমি মুচকি হাসলাম। ধীর গলায় বললাম
“এখনো আমার একটা বিয়েও হলো না, ডিভোর্সও হলোনা, তার আগেই আপনার মন থেকে আমার প্রতি ভালোবাসা উধাও হয়ে গেলো? ভালোবাসার দরজাটাও দেখছি বন্ধ হয়ে গেছে। তাহলে আমিই ঠিক ছিলাম…

সে এবার একটু নরম হয়ে বললো
“তুমি তো আমায় ভালো বাসো নি, তাহলে আমি কোন আশায় তোমার জন্য অপেক্ষা করবো?
আমি বললাম
” আপনি আমার জন্য অপেক্ষা করেন নি, তাতে আমি খুশিই হয়েছি। কারণ অপেক্ষা অনেক কষ্টের, আর ভালোবাসা না পাওয়া আরো বেশি কষ্টের। আপনি আমার অপেক্ষায় থাকলে সেই কষ্টটাই পেতেন। আমি আপনাকে আদৌ ভালোবাসতে পারতাম কিনা জানিনা।

সেদিনের পর ওর আর আমার আর কোনো যোগাযোগ হয় নি। আমিও সবকিছু ভুলে আবারও সামনের দিকে এগিয়ে যেতে শুরু করলাম। তবে একটা জিনিস কনফার্ম হলাম যে সজল আমাকে।কখনোই সত্যিকারের ভালোবাসেনি। সত্যি সত্যি ভালোবাসলে এতো তারাতাড়ি আমাকে ভুলে অন্য কাউকে মন দেওয়া সম্ভব হতো না। আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করলাম এটার জন্য যে, আল্লাহ আমাকে দ্বিতীয় বারের মতো মন ভাঙ্গার হাত থেকে বাঁচিয়েছেন।

ইন্টার মিডিয়েড শেষ করে অনার্সে ভর্তির প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম তখন। একটা ভালো কলেজে চান্স পেয়েছি। ব্যাপারটা আমার জন্য সুখকর, কিন্তু আমার কাছের কয়েকটা বান্ধবী আমার সাথে চান্স পায় নি.. আর কয়েক জনের বিয়ে হয়ে গেছে এক্সামের পরপরই। যে কারণে আমি মানসিকভাবে ভেঙ্গে পরি। ওদের ছাড়া একা একা কলেজে যাওয়া আমার জন্য মোটেও সহজ ছিলো না।

একেতো কলেজটা ছিলো বাড়ি থেকে অনেকটা দূরে, তার উপর পরিচিত কেউ নেই সেখানে। আমি মানসিকভাবে কিছুটা ভেঙ্গে পরেছিলাম। কিন্তু বাবা মায়ের এতো কষ্টের টাকায় ভর্তি হয়েছি, যে কারণে টাকার মায়াতে হলেও কলেজে যেতেই হবে।

আবারও লেখাপড়ায় মন দিলাম। নতুন কলেজ, নতুন মুখ.. সবকিছুই নতুন। এতো এতো নতুনের ভীড়ে নিজেকে খুবই একা মনে হতে লাগলো। বার বার মনে হতে থাকলো, নতুন করে হলেও কিছু বন্ধু বান্ধব জুটলে মন্দ হতোনা। আমি আমার ক্লাসের মেয়েদের সাথে ভাব জমানোর চেষ্টা শুরু করলাম। সবাই আমার সাথে কথা বলছে, মিশছে.. কিন্তু মনের মত কাউকেই পাচ্ছিনা। পুরোনো বান্ধবীদের খুব মিস করতে লাগলাম।

এভাবেই যাচ্ছিলো দিন। মাসখানেক পরে আমাদের ক্লাসে আরেকটা নতুন মুখের দেখা পেলাম। সে কোনো মেয়ে নয়, একটা ছেলে। আগেই ভর্তি হয়েছিলো, কিন্তু এতদিন আসেনি। আমার মতো সেও এই কলেজে নতুন, তারও কোনো বন্ধু নেই এখানে।।ক্লাসের একটা কোনায় একদম একা একা বসে আছে সে। আমি সেদিকে নজর দিলাম না তেমন। সেদিনই ক্লাসের শেষে দোতলায় কলেজের কেরাণীর সঙ্গে দেখা করতে গেলাম কোনো একটা বিষয় জানার জন্য। ফিরে আসার পথে দেখা হলো সেই ছেলেটির সাথে। আমি তাকে পাশ কেটে চলে আসতে চাইলে আমাকে পেছন থেকে ডাকলো।

আমি দাঁড়িয়ে পরলাম। প্রশ্ন করলাম
“কিছু বলবেন?
“তোমার নামটা জানতে পারি?
” কেন?
“আমার এ কলেজে পরিচিত কেউ নেই, আর রেগুলার কলেজে আসতেও পারবোনা আমি। ছোটখাটো একটা ব্যবসা আছে আমার সেজন্য। তাই তোমার সাথে একটু পরিচিত হতে চাই।
যেহেতু আমাদের সাথে পড়ে তাই আমি উনার সাথে পরিচিত হলাম। ছেলেটা ভালোই, দেখতেও দারুণ। বেশ ভালোই কথাবার্তা হলো আমাদের। শেষে সে আমার ফোন নাম্বার চাইলো যেনো কলেজে না আসলেও আমার মাধ্যমে কলেজের আপডেট ইনফরমেশন পেতে পারে। আমি প্রথমে ফোন নাম্বার দিতে অস্বীকার করলে সে আমায় বলে বসে
“আমি তোমার ক্লাসমেট, তাহলে আমাকে ফোন নাম্বার দিতে তোমার সমস্যাটা কোথায়?

মনে মনে ভাবলাম,
“ঠিকই তো। একসাথে পড়ি, তাহলে নাম্বার দেওয়াই যায়।
বলে রাখা ভালো, তখন আমার হাতে এন্ড্রয়েড ফোন ছিলো। ভাইয়ার কাছে দাবী করেছিলাম ইন্টার পাশের পর যেনো আমাকে একটা ফোন কিনে দেয়। ভাইয়া কিনেও দিয়েছিলো।।

পরবর্তীতে তার সাথে আমি ফেইসবুকেও এড হই। প্রায়ই সে আমাকে ফেইসবুকে নক দিতো, কলেজ সম্পর্কে এটা ওটা জিজ্ঞাসা করতো। ফোনেও কথা হতো মাঝে মাঝে। তার ব্যক্তিত্বও অসাধারণ… কথাবার্তায় সেটা বুঝা যায়। আমার ভালো মন্দ খোঁজ খবর নিতো সবসময়।। একসময় সে আমাকে বন্ধুত্বের অফার দেয়। আমি বিনাবাক্যে সেটা গ্রহণ করি।

ইদানিং সে নিয়মিত কলেজে এটেন্ট করে। রেগুলার ক্লাস করে। আমার পাশের বেঞ্চেই সে বসে। তার ভাষ্যমতে, আমার মতো ভালো বন্ধু পাওয়া দুষ্কর। সেসব কথায় আমি তেমন কান দেই না। ছেলেরা মেয়েদের এমন কথা বলবে এটাই স্বাভাবিক। দিনে দিনে আমাদের বন্ধত্ব খুবই গভীর হতে থাকে। তার কথাবার্তা, হাঁটাচলা, ব্যক্তিত্ব, হাসি.. সবকিছুই আমাকে মুগ্ধ করে। ভালোই লাগে তাকে… ফেইসবুকে যখন দেখি ‘মোঃ মৃদুল হাসান’ নামটা জ্বলজ্বল করছে তখন মুখে হাসি ফোটে আমার। মনে মনে আল্লাহর কাছে ইচ্ছা পোষণ করে, সে যেনো সর্বদায় আমার ভালো বন্ধু হয়ে থাকে। মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে তাকে ভালোবেসে ফেলি.. তবে সে দুঃসাহস বেশি সময় টিকে থাকে না।

মৃদুলের সাথে বন্ধুত্ব হওয়ার পর জানতে পারি সে আমার থেকে দুই বছরের সিনিয়র, কোনো কারণবশত সে দুই বছর গ্যাপ দিয়ে এবারে এখানে ভর্তি হয়েছে।

দিন যতই গড়াচ্ছিলো, আমাদের বন্ধুত্বের গভীরতাও চুড়ান্ত পর্যায়ে চলে যাচ্ছিলো।

এর মাঝে ভালো একটা প্রাইভেট টিউটরের সন্ধান করতে থাকি আমি, আমার সাব্জেক্ট ছিলো একাউন্টটিং.. সে কারণে প্রাইভেট পড়াটা ছিলো আবশ্যিক। মৃদুলের মাধ্যমে ভালো একটা প্রাইভেট টিচারের সন্ধানও পেয়ে যাই।

বেশ ভালোই কাটছিলো দিনকাল, কলেজ, প্রাইভেট, মৃদুলের বন্ধুত্ব সব মিলিয়ে অসাধারণ দিন কাটছিলো আমার।

সেদিন প্রাইভেট শেষ হবার পর মৃদুল আমাকে কিছু কথা বলার জন্য ডাকে। আমি বুঝতে পারি সে কি বলতে চায়। সে যে আমার প্রতি দুর্বল সেটাও আমার অজানা নয়। তবে নিজের দুর্বলতা প্রকাশ করি না।।

আমার মনের ভাবনাকে সত্য প্রমাণ করে মৃদুল আমাকে সেদিনই প্রপোজ করে বসে। আমি বুঝতে পারিনা কি উত্তর দিবো তাকে। না পারছিলাম ভালোবাসা গ্রহণ করতে, আর না পারছিলাম সেটা অস্বীকার করে ওর ভালোবাসা প্রত্যাখ্যান করতে। কি করা উচিত আমার?

আমাকে চিন্তিত দেখে মৃদুল আমাকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সময় দেয়। তবে সন্ধ্যার সময় সে আমার কাছে পজেটিভ উত্তরই আশা করে।

অনেক চিন্তা ভাবনার পর আমি একটা সিদ্ধান্ত নেই। সন্ধ্যের পর আমি তাকে উত্তর দেওয়ার প্রস্তুতি নেই। তবে মুখে নয়, লিখে। আমি ফেইসবুকের মেসেজ অপশনে গিয়ে টাইপ করতে থাকি আমার মনের অব্যক্ত কথা।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here