সেদিন বসন্ত ছিল পর্ব -৩৬+৩৭

#সেদিন_বসন্ত_ছিল
#রাহনুমা_রাহা
#পর্বঃ৩৬

বিমানবন্দরে অব্যন্তরীণ কার্যক্রম শেষে বাহির মুখো হতেই আবরারের চোখ পড়ল বহুল প্রতীক্ষিত একটি মানুষের উপর। যার স্থির নেত্রে বিরাজ করছে প্রিয় বন্ধুরূপী ভাইকে কাছে পাওয়ার প্রত্যাশা। তীব্র আকাঙ্খা যখন বাস্তব হয়ে ধরা দিল, ঝলমলিয়ে উঠল চোখের সামনে, ঠিক সেই মূহুর্তটায় টলটলে সরোবরের ন্যায় স্বচ্ছ হলো চার জোড়া আঁখি।

রিফাত গত একঘন্টা যাবত অপেক্ষা করছে আবরারের আসার। ফ্লাইট এক ঘন্টা ডিলে হওয়ায় অপেক্ষার মাত্রা আরও বেড়েছে। তবুও এক ফোঁটা বিরক্তির ভাজ পড়েনি কপাল জুড়ে। উৎফুল্ল ছিল ছয়মাস পর সাক্ষাতের ক্ষণের প্রতীক্ষায় ।

অবশেষে যখন ট্রলিব্যাগ হাতে গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে আসতে দেখল কালো স্যুটব্যুট পরিহিত সুদর্শন পুরুষকে, ঠিক সেই সময়টায়ই ছলাৎ ছলাৎ করে বইতে শুরু করল মন পদ্মার ঢেউগুলো। অবাক হলো ধরনী। বন্ধুর জন্যও বুঝি এমন অনুভূতি হয়!

এক চিলতে হাসি ফুটিয়ে রিফাত দু’হাত দু’দিকে মেলে দিল। আবরার মুচকি হেসে দু’হাতে ঝাপটে ধরে নিরসন ঘটাল ছয়মাসের দীর্ঘ বিরহের।

রিফাত ভ্রুকুটি করে আবরারের পা থেকে মাথা অবধি নজর বুলিয়ে পেটে কনুই দিয়ে গুঁতো মেরে বলল,
“মামা, সাদা সুন্দরীর চক্করে পড়েছো নাকি? বুড়ো হচ্ছো নাকি তাগড়া হচ্ছো, কনফিউজড হয়ে যাচ্ছি আমি। চারবেলা সুন্দরীদের ছোঁয়ায় হচ্ছে নাকি এই পরিবর্তন!”

আবরার রিফাতের পিঠে চাপড় মেরে বলল,
“তুই আমার সংসার শুরু হওয়ার আগেই শেষ করতে চাস নাকি শালা। এডি ইভানার কানে গেলে ও বাড়িই ঢুকতে দেবে না। থেমে যা বাপ।”

রিফাত হেসে ফেলল। বলল,
“বউকে এত ভয়?”

আবরার সুখী হাসল। কণ্ঠে স্নিগ্ধতা ফুটিয়ে বলল,
“ভয় নয় ভাই, ভালবাসা।”

কিঞ্চিৎ সময় পর আবরার ভ্রুকুটি করে বলল,
“রিফাত, পিচ্চি কে নিয়ে আসিস নি? কোথায় আমার বোনটা?”
রিফাত চাপা হেসে বলল,
“তোর বিদেশিনী পিচ্চি মানুষের নজর এড়াতে গাড়িতে ঘাপটি মেরে বসে আছে।”
আবরার ভ্রু কুঁচকে তাকালে রিফাত পুনরায় বলল,
“নোভা এসেছিল এখানে। ছিলও কিছুক্ষণ। কিন্তু লোকজন বিদেশী ভেবে তাকিয়ে ছিল। একজন তো এসে জানতেও চাইল কোন দেশে থাকে। বাংলা বলতে, বুঝতে পারে নাকি। বাংলাদেশে কেন এসেছে। বিশ্বাস কর। তোর বোন ওই লোকের সাথে না পেরে আমাকে প্রায় চিবিয়ে খেয়েই নিচ্ছিল। তাই গাড়িতে বসিয়ে এসেছি।”

আবরার মুচকি হাসল। বলল,
“চল তাড়াতাড়ি। কোন দিকে রেখেছিস? কি যে করিস না!”

প্রত্যাশিত স্থানে পৌঁছুতেই নোভাকে দেখতে পেল আবরার। ওই তো চঞ্চল হরিণী আঁখি জোড়া বন্ধ করে সিটে গা এলিয়ে পড়ে আছে পিচ্চিটা। গ্লাসে নক করে নিজেদের উপস্থিতি জানান দিল রিফাত। নোভা ধীরেসুস্থে চোখ খুলে বাইরে তাকাল। প্রিয় মুখখানায় এক চিলতে হাসি ছড়িয়ে থাকতে দেখে নোভা স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। আবরার মৃদু হেসে বলল,
“বাইরে এসো আপুনি।”
নোভা ধ্যান ভেঙে দরজা খুলে বাইরে এলো। দাদাভাইয়ের বুকের একপাশ দখল করে ভেজা গলায় বলল,
“দাদাভাই! আমার দাদাভাই!”
আবরার স্নেহাবিষ্ট হয়ে সিক্ত ঠোঁট মাথায় ছোঁয়াল ছোট্ট মেয়েটার। নিজেও ভিজে যাওয়া গলায় বলল,
“আমার পিচ্চিটা।”

ঘন্টাখানেক পর বাড়ির দোরগোড়ায় এসে দাঁড়াল আবরার। ফাহিমা করিম প্রথম সন্তানের আগমনী বার্তায় যেরকম আনন্দের জোয়ারে ভেসেছিলেন ঠিক তেমনি আনন্দে যেন আজও তার হৃদয় উচ্ছ্বসিত হলো। দরজায় দাঁড়িয়ে মাতৃস্নেহের সহিত বরণ করে নিলেন ঘরমুখো আবরার কে।
আবরার মায়ের দেওয়া স্নেহময় স্পর্শে আবেগাপ্লুত হয়ে মা’কে জড়িয়ে ধরে বলল,
“সব ভালবাসা কি আজই দিয়ে দেবেন আম্মাজান? পরের বারের জন্যও রেখেদিন। পরের বার তো ভালবাসায় টান পড়বে না হলে।”
ফাহিমা করিম ছেলের কান টেনে বললেন,
“মায়ের ভালবাসায় টান পড়ে বাঁদর ছেলে? আগে বাবা হ তারপর বুঝবি বাবা মায়ের ভালবাসায় টান পড়ে কি-না।”
আবরার হেসে বলল,
“তুমি কি ইনিয়ে বিনিয়ে দাদী হওয়ার অভিপ্রায় জানাচ্ছো আম্মা?”
ফাহিমা করিম সরু চোখে তাকিয়ে বললেন,
“জানালে আপত্তি আছে? আমার ছেলে, আমার বউমা। হবেও আমার নাতি নাতনী তোর কি ব্যাটা?”
আবরার জোরে শ্বাস ছেড়ে বলল,
“আসলেই আমার কি। আমি তো কলুর বলদ।”
শেষের বাক্যাংশ চাপা গলায় বলে পুনরায় বলল,
“আর কাউকে দেখছি না কেন মা?”

ফাহিমা করিম হেসে ফেললেন ছেলের প্রশ্নে। হাসতে হাসতেই বললেন,
“আর কেউ? নাকি ইভানা?”
আবরার মাথা চুলকে হেসে বলল,
“ওই তো হলো। কোথায় সে?”

ফাহিমা করিম কিছু বলার আগেই নোভা এগিয়ে এসে চাপা গলায় বলল,
“ভাবী ঘরে আছে দাদাভাই। সকাল থেকে ঘরেই ঘাপটি মেরে বসে আছে। আমি কত করে বললাম আমাদের সাথে যেতে। সে শুনলোই না আমার কথা। তুমি যাও তো গিয়ে দেখো কি হয়েছে।”
আবরার মুচকি হেসে বলল,
“ঠিক আছে; আমি দেখছি।”

ঘরের প্রতিটি কোণায় কোণায়, বারান্দায় হন্যে হয়ে খুঁজেও যখন ইভানার হদিস পেল না তখন আবরার পুনরায় নক করল ওয়াশরুমের দরজায়। গলা বাড়িয়ে বলল,
“ইভানা, ভেতরে আছো তুমি? থাকলে সাড়া দাও।”

ইভানা ভেতরে দরজার সাথে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে আছে। প্রথমবার, এই প্রথমবার ভালবাসার মানুষের স্পষ্ট, হৃদয়গ্রাহী কণ্ঠ কর্ণকুহর ভেদ করছে তার। যা নাড়িয়ে দিচ্ছে তাকে ভেতর থেকে। বুকের বা পাশটা চেপে ধরে অনবরত ঠকঠক করে কাঁপছে সে।

ছ’মাস আগের আবরার আর এই আবরারের সংঙ্গা, বিবরণ সম্পূর্ণ আলাদা তার কাছে। তখনকার অনুভূতি ছিল সাধারণ। এখন সেই সাধারণ অনুভূতির জায়গায় বইছে গভীর সমুদ্রের উদ্দাম ঝড় আর উত্তাল ঢেউ।

আবরার পুনরায় দরজা ধাক্কা দিতে চেয়েও হাত গুটিয়ে নিল। মনের কোণে কিছু উঁকি দিতেই মুচকি হেসে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
“তৃষ্ণার্তের তেষ্টা নিবারণ করানো নাকি প্রতিটি মানুষের কর্তব্য। এখন কেউ যদি আমার তেষ্টা না মেটায় তাহলে আমি এক বুক তৃষ্ণা নিয়েই ওই দূর আকাশে পাড়ি জমাব।”

আবরার জুতোয় শব্দ করে দু কদম ফেলতেই খুট করে শব্দ করে খুলে গেল ওয়াশরুমের দরজা।
আবরার পিছু ফিরে তাকানোর আগেই ইভানা গ্লাস নিয়ে ছুট লাগাল। আবরার তৎক্ষনাৎ হাত আঁকড়ে ধরে কাছে টেনে নিচু গলায় বলল,
“কোথায় যাচ্ছো?”
ইভানা মাথা নিচু করে কাঁপা গলায় বলল,
“পানি।”
আবরার ভ্রুকুটি করে বলল
“পানি দিয়ে কি করবে?”

“আপনি বললেন তেষ্টা….”

আবরার মুচকি হেসে বলল,
“তেষ্টা পেয়েছে বলেছি। পানি তেষ্টা পেয়েছে সেটা বলেছি?”
ইভানা এবার মাথা উঁচু করে আবরারের চোখে চোখ রাখল। বুঝতে চেষ্টা করল স্থির দৃষ্টির গভীরে গেঁথে থাকা কাব্যকাথাগুলো।
আবরার পুনরায় বলল,
“তোমায় দেখার তেষ্টা পেয়েছে আমার। পেয়েছে তোমায় ছোঁয়ার তেষ্টা। তোমায় সবটুকু উজার করে ভালবাসার তৃষ্ণায় তৃষ্ণার্ত আমি।”
ইভানা স্থির দৃষ্টি মেলে অনুধাবন করল হৃদয়ের অন্তর্লীন হতে নিঃসৃত কিছু মধুবাক।

আবরার হাত বাড়িয়ে ইভানার চিবুকে রাখল।
ইভানা হাতের ওপর নিজের হাতের স্পর্শ দিতেই আবরার মোহনীয় কণ্ঠে বলল,
“আমার আরাধ্যের মানিক। এমনই জ্বলজ্বল করে জ্বলতে থাকো আমার হৃদয় জুড়ে।”
ইভানা নিভু নিভু চোখে তাকিয়ে রইল। চোখে চোখে বলে দিল হাজারো অব্যক্ত অনুভূতির গল্প।

চোখের ভাষা পড়তে পড়তেই এক সময় দুটি হৃদয় বাঁধা পড়ল একই সুতোয়। সুচ গলার ফাঁকটুকু না রেখে আঁকড়ে ধরল একে অপরকে। মিশিয়ে নিল বক্ষপিঞ্জরে। ঘুচিয়ে দিল এত দিনের বিরহব্যথা। রচিত করল ব্যক্ত অব্যক্ত কাব্যকাথা।
এহেন সময় ওই দূর পাহাড় থেকে এক ঝাঁক শিমুল পলাশের সাজ এসে সাজিয়ে দিয়ে গেল বসন্তের সাজে। কোকিলেরাও যেন গাইতে শুরু করল সুরে সুরে। ভরা বর্ষায়ই রচিত হলো বসন্ত প্রেমের।

চলবে…..

অগোছালো হয়ে গেছে বোধহয়। একটু কষ্ট করে বুঝে বুঝে পড়বেন।#সেদিন_বসন্ত_ছিল
#রাহনুমা_রাহা
#পর্বঃ৩৭

ভোরের স্নিগ্ধতা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অলিতে-গলিতে, পাহাড়ে-পর্বতে, মৃত্তিকা-নিলীমায়। ভরা বর্ষার স্নিগ্ধ রুপে বিমোহিত ধরনী সেজেছে নতুন আঙ্গিকে। রাত ভর তুমুল বর্ষণ শেষে পৃথিবী মেতেছে শীতলতার আবেশে। রূপ যেন ঠিকরে এসে চোখে লাগছে।
প্রকৃতির কোমলতায় অতি পরিচিত বিছানায় গা এলিয়ে নিশ্চিন্তমনে দিবানিদ্রায় মত্ত আবরার।
ইভানা রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে নিজেদের ঘরে প্রবেশ করল। আবরার কে পড়ে পড়ে ঘুমোতে দেখে কোমরে হাত রেখে চোখ ছোট ছোট করে তাকাল। কিঞ্চিৎ সময় পর গলা বাড়িয়ে বলল,
“আপনি কি উঠবেন নাকি আমি পানি নিয়ে আসব? আপনি চেনেন না কিন্তু আমাকে! ঘুম হারাম করে ফেলব একেবারে।”
আবরার ঘুমন্ত মুখে মুচকি হেসে বলল,
“বিগত রজনীর পর আর তোমার ছিটেফোঁটাও চিনতে বাকি নেই আমার। বউ তো নয় যেন আস্ত একটা রাক্ষসী।”
ইভানা সরু চোখে তাকাল। চোখ পাকিয়ে বলল,
“আপনি খুব সাধু পুরুষ? লজ্জা করছে না আমাকে এভাবে বলতে?”
আবরার ওঠে আয়েশ করে বসল। হাস্যজ্জল কণ্ঠে বলল,
“করছে না গো। বিশ্বাস করো, একটুও লজ্জা করছে না আমার। আমি কেন লজ্জা পাব? লজ্জা কি পুরুষের ভূষণ? বোকা মেয়ে। লজ্জা তো তুমি পাবে।আমি ভাঙাব,নিশ্চিহ্ন করে দেব। তুমি পুনরায় লাজে রাঙা হবে, আমি পুনরায় সেই লাজুক সুবাসে সুবাসিত হব।”

ইভানা আবরারের কণ্ঠ ক্রমশ পরিবর্তিত হতে দেখে বিছানা ত্যাগ করার উদ্দেশ্যে এক পা নিচে ফেলল। আবরার তৎক্ষনাৎ হাত আঁকড়ে ধরে হেসে বলল,
” পালাচ্ছো কোথায় মেয়ে?”
ইভানা হাত মুচড়ে ছাড়ানোর চেষ্টা করেও থেমে গেল। পুনরায় পা তুলে বসে স্থির দৃষ্টিতে তাকাল আবরারের দিকে। চিকচিক করতে থাকা চোখগুলো অসহাসত্ব ফুটিয়ে তুলল অতিদ্রুত।

আবরার কিছু বলার আগেই ইভানা আবরারের খোলা বাহুতে আলতো ছুঁয়ে বলল বলল,
“এখানে এই দাগটা কিসের আবরার?”
আবরার ইভানার হাতটা দু’হাতের মুঠোয় চেপে ধরে নিচের দিকে তাকিয়ে চুপিসারে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল।
কিয়ৎক্ষণ পর নরম গলায় বলল,
“ল্যাবে আগুন লেগে গিয়েছিল।”
ইভানা ভ্রু কুঁচকে তাকাল। সন্দিহান গলায় বলল,
“ল্যাব? আপনি কলেজে পড়ান না?”
আবরার ইভানার হাতের উল্টো পিঠে নিজের হাতের তালুর স্পর্শ দিতে দিতে বলল,
“ইউনিভার্সিটি। হ্যা পড়াই। সাথে গবেষণার কাজেও যুক্ত। ইউনিভার্সিটি গবেষণাগারেই আমাদের গবেষণা চলছে অবিরত। খুব তাড়াতাড়িই আমরা সফলতা পাব ইভানা। আমি আমার স্বপ্ন চূড়ার সন্নিকটে পৌঁছে গেছি।”

ইভানা আগাগোড়া কিছু বুঝতে না পেরে চোখ পিটপিট করে তাকাল।
আবরার পুনরায় বলল,
” গুরুত্বপূর্ণ একটা সময়ে আমি সব ছেড়ে দেশে এসেছি ইভানা। শুধু তোমার জন্য। শুধুমাত্র তোমার জন্য কাঁচাগোল্লা। কথা দিয়েছিলাম ফিরব খুব তাড়াতাড়ি। ফিরেছি। আমার আবার ফিরতে হবে গন্তব্যে। ছুঁতে হবে স্বপ্নের পর্বতচূড়া। জয় করতে হবে পৃথিবী। তারপর আমি একেবারে ফিরব ইভানা। তোমার কাছে, আমার পরিবারের কাছে। তখন আমরা প্রতিদিন, প্রতি মূহুর্ত একসাথে থাকব, একসাথে বাঁচব।”

ইভানা মুচকি হেসে মাথা নাড়ালো। এগিয়ে এসে কাঁধে মাথা রেখে বাহুতে হাত বুলাতে বুলাতে বলল,
“ব্যথা আছে এখনো?”
আবরার হেসে বলল,
“না রে পাগলি। এটা পুরনো ক্ষত। আগুন লেগে গিয়েছিল কেমিকেল থেকে। সেখান থেকেই হঠাৎ করে লেগে যায় এখানে। কয়েকদিন খুব যন্ত্রণা হলেও ডাক্তারের সাজেশন নিয়ে ঠিক হয়ে গেছে আস্তে আস্তে।”

ইভানা গোমড়া মুখে বলল,
“আপনি একটা বার জানানোর প্রয়োজন মনে করলেন না।”
আবরার একহাতে ইভানার মুখ তুলে কপালে ঠোঁট ছুঁয়ে দিল। চিবুকে হাত গলিয়ে চোখে চোখ রেখে বলল,
“শুধু দাগ দেখেই যে মন খারাপ করে ফেলছে, সে দগদগে ঘা দেখলে কি করতো?”

“তাই বলে বলবেন না? এভাবে চুপিসারে কষ্টগুলোকে কবর দিয়ে ফেলবেন?” অভিমানী গলায় বলল ইভানা।

আবরার স্মিত হেসে বলল,
“আমি তোমার হাসি মুখ দেখতে চাই ইভা। আমার কষ্টগুলো যেন তোমায় কখনো ছুঁতে না পারে।”

ইভানা স্থিরচিত্তে তাকাল। থমথমে গলায় বলল,
“আপনার দেওয়া সুখটুকু আমার হলে কষ্টটুকুও একান্তই আমার।”

খাবার টেবিলে মুখোমুখি বসে আছে আবরার, রিফাত। অদূরেই বসে ফাহিমা করিম। নোভা আর ইভানা তার দুইপাশে মনোযোগী দর্শকের ন্যায় দাঁড়িয়ে। যেন চোখ সরালেই মহামূল্যবান কিছু মিস হয়ে যাবে।

ভারী হয়ে থাকা পরিবেশে আবরার থমথমে গলায় শুধালো,
“রিফাত, মা কি বলছে এসব? তুই নাকি এ বাড়ি সমীহ করে চলছিস আজকাল? কি করেছে তারা? আগে তো এমন ছিলিস না। আমার বিয়ের পর থেকে এড়িয়ে যাচ্ছিস। ইভানা কিছু বলেছে?”

ইভানা হকচকিয়ে গেল। ভ্রুকুটি করে বিরবির করে বলল,-যাহ বাবা! আমি এখানে কোত্থেকে উদয় হলাম!

রিফাত আবরার কে থামিয়ে কড়া গলায় বলল,
“ইভানা কে দোষ দিচ্ছিস কেন ফাজিল ছেলে। আমি এমনিতেই আসি না। তুই এসেছিস এখন থেকে আসব। আর তুই-ই বল এভাবে বাইরের কেউ থাকলে লোকে কি বলবে?”
আবরার মূহুর্তেই অগ্নিমূর্তি ধারণ করল। চোখ গুলো রক্তিম বর্ণ হয়ে এলো। রাগের তোড়ে দাঁড়িয়ে টেবিলে শব্দ করে চাপড় মেরে চিৎকার করে বলল,
“বাইরের লোক তো এখানে বসে আছিস কেন এখনো? ওঠ এক্ষুণি। বেরিয়ে যা আমার বাড়ি থেকে।”

আবরারের এহেন ভিন্ন রূপ দেখে অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল ইভানার। শান্ত মানুষটার পরিবর্তন চোখে লাগছে বড্ড। চুপিসারে নোভার পেছনে গিয়ে দাঁড়াল। শঙ্কিত হয়ে নোভার কাঁধে হাত রাখতেই নোভার অবিরত কম্পন বোধগম্য হলো ইভানার। অত্যাশ্চার্য হলো সে। নোভাও কি তবে প্রথম দেখছে এই অগ্নিমুখটা!

রিফাত সন্তর্পণে ওঠে দাঁড়াল। একবার মলিন মুখে ফাহিমা করিমের দিকে তাকিয়ে নোভার ভীত, দিশাহীন চেহারা দেখে কষ্ট গিলে ফেলে মুচকি হাসল। নোভা একাগ্রচিত্তে তাকিয়ে আছে রিফাতের পশ্চাৎ গমনের দিকে। যেন এটাই স্বাভাবিক। এটাই হওয়ার ছিল।

দরজার সন্নিকটে পৌঁছাতেই আবরার দেহের ভার ছেড়ে চেয়ারে বসে পড়ল। নিভু নিভু আগুনের মত অল্প তেজি গলায় বলল,
“বাইরের লোকের জন্য মনের ভেতরের সাথে সাথে বাড়িতেও আলাদা রুম থাকে। বাইরের লোকের জন্য হৃদয়ের এখানটায় খুব জ্বলে। দহনে দহনে দগ্ধ হয়ে যায়। বাইরের লোকের জন্যই মনে হয় পৃথিবীতে ভাই, বন্ধু বলেও কোনো শব্দ আছে। বাইরের লোকের জন্যই দূর প্রবাসে থেকেও মনে হয় আমার পরিবার একা নেই। একটা বটগাছ আমি রেখে এসেছি তাদের জন্য। যে অনবরত ছায়া দিয়ে চলেছে তাদের। তার ছায়ায় সুরক্ষিত আমার ছোট্ট নোভা, আমার মা আর আমার আট বছর আগের সেই পিচ্চি ইভানাটাও। যে কথা আমার মা জানতো না, সেই কথাটা শুধুমাত্র বাইরের লোকটাই জানতো। এই যে এখন হৃদয় গহীনে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। কার জন্য? সবটাই তো বাইরের লোকের জন্যই। যাক চলে সে। আমি থাকতে বলি নি। বলবও না। কোনো বাইরের লোকের জায়গা নেই আমার কাছে। চলে যাক সে।”

রিফাত উল্টো ফিরেই দাঁড়িয়ে রইল কিছু সময়। হৃদয় মন্দিরে হওয়া রক্তপাত চোখ ফেটে বেরিয়ে আসতে চাইলেও শক্ত আবরণে বেঁধে ফেলল নিজেকে।

পায়ে পায়ে এগিয়ে এসে আবরারের মুখোমুখি দাঁড়াল। স্থিরচিত্তে তাকিয়ে ভেজা গলায় বলল,
“তোর দেওয়া অধিকারের আমি অমর্যাদা করে ফেলেছি ভাই। ভেঙে ফেলেছি সম্পর্কের বাঁধন। যেদিন জানবি সেদিন কপাল চাপড়ে নিজেকে ধিক্কার জানাবি এই বন্ধুত্বের জন্য। তোর দেওয়া ভাইয়ের স্বীকৃতির সম্মান আমি রাখতে পারি নি রে। ভুলে ভরে ফেলেছি নিজের সর্বস্ব। বন্ধুত্বের দায়বদ্ধতা ভুলে আমি শত্রুর ন্যায় মস্তিষ্ক গঠন করেছি। তদনুযায়ী কার্যকলাপ করে ফেলেছি। তোর দেওয়া দায়িত্ব আমি রাখতে পারি নি। ভালো রাখার দায় নিয়ে কাঁদিয়ে দিয়েছি অবিরত। জীবন্তই মেরে ফেলেছি কাউকে। পারলে আমায় মাফ করিস।”

আবরার একাগ্রচিত্তে শুনল রিফাতের বলা বিষবাক্যগুলো। কিন্তু তা কেবল শোনার জন্যই। না মস্তিষ্কে প্রয়োগ করল আর না মনে।
দু’হাত দুদিকে মেলে বলল,
“আমার যে ভুলে ভরা ভাইটাকেই চাই। শত পাপে জর্জরিত হলেও আমার তোকেই চাই। প্রতিটি পদে পদে তোকে চাই। হাসতে পারি না তোকে ছাড়া। তোকে ছাড়া কাঁদতেও পারি না। তুই কি চাস আমি অনুভূতিহীন পাষণ্ড হয়ে যাই? যদি না চাস তবে আয়। আয় সব ভুলে নতুন করে বাঁচি।”
রিফাত এতক্ষণ লুকিয়ে রাখা চোখের জলটুকুর নিঃশর্ত মুক্তি দিল। বিনা বাঁধায় গড়িয়ে যেতে লাগল তা গাল বেয়ে।

দুজন শক্তপোক্ত খোলসে মুণ্ডিত পুরুষের অশ্রুসিক্ত নয়ন দেখে অশ্রুসিক্ত হলো আরও তিনজোড়া আঁখি।

বাহুবন্ধনে আবদ্ধ অবস্থায় আবরারও রিফাত কে দেখে দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে অন্য আরেকজন পুরুষ শব্দ করে হাত তালি দিল। উচ্চ আওয়াজে বলল,
“বাহ! বাহ! এখানে প্রেমলীলা চলছে। আর আমি জ্বলে ভাসা কচুরিপানা?”

চমকে সেদিকে তাকাতেই নজরে এলো শ্যামলের হিংসাত্মক চেহারা। আবরার হাত বাড়িয়ে কাছে ডাকল। শ্যামল গোমড়া মুখে এগিয়ে এসে বলল,
“এখন ডাকতে হবে না। এতক্ষণের প্রেমলীলা দেখে নিয়েছি। নেহাৎই অসময়ে এন্ট্রি করে ফেলেছি। তাই কাছে ডাকছিস।”

আবরার গলা নামিয়ে বলল,
“তুমি যে মামা এতদিন ফুলে ফুলে মধু খেয়ে বেড়াচ্ছিলে সেটা সবার সামনে জোরসে আওয়াজে বলব?”

শ্যামল আবরারের বাহুতে চাপড় মেরে বলল,
“শালা হিসেব করে কথা বল। বউয়ের সাথে মধুচন্দ্রিমায় গেলে তাকে ফুলে ফুলে মধু খাওয়া বলে না। বেয়াকুফ কোথাকার। যাই হোক এত পিরিত উতলে উঠছে কেন দুজনের?”

আবরার সবটা সংক্ষিপ্ত আকারে বলার পর শ্যামল সরু চোখে তাকাল রিফাতের দিকে। রিফাত মাথা এদিক ওদিক করে দৃষ্টি লুকোচ্ছে।

কিঞ্চিৎ সময় পর শ্যামল দুজন মানুষের হৃদয় উত্তাল ঢেউয়ে ভাসিয়ে দিয়ে বলল,
“রিফাতের বিয়ের ব্যবস্থা করতে হবে এবার।”
আবরার যেন আরও একধাপ এগিয়ে। তৎক্ষণাৎ মৃদু হেসে বলল,
“সে ব্যবস্থা করা হয়ে গেছে আমার। আগামীকাল যাচ্ছি আমরা কনে দেখতে। ইভানা, নোভা তোমরা যাবে?”

নোভা চকিতে তাকাল রিফাতের দিকে। তার দৃষ্টিও তখন অবলীলায় ঘুরে বেড়াচ্ছে নোভার মুখশ্রীতে।

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here