সেদিন বসন্ত ছিল পর্ব -৩৮+৩৯

#সেদিন_বসন্ত_ছিল
#রাহনুমা_রাহা
#পর্বঃ৩৮

১০০° সেলসিয়াস তাপমাত্রায় টগবগ করে ফুটতে থাকা পানির দিকে তাকিয়ে একদৃষ্টে অবলোকন করছে তাদের জলীয়বাষ্প হয়ে উড়ে যাওয়ার দৃশ্য। তার জীবনটাও বোধহয় উড়ন্ত জলীয়বাষ্প রুপে পরিবর্তিত হওয়ায় ক্ষণে উপস্থিত। উড়তে উড়তে একসময় হারিয়ে যাবে মহাশূন্যে। না থাকবে ভালবাসা আর নাই-বা পিছুটান।

জীবনের পাওয়া না পাওয়ার হিসেব মেলাতে গিয়ে নোভার মনে হলো সে পায় নি, কিচ্ছু পায় নি। জীবন তাকে শুধু একজন আদর্শবান মা এবং একজন ম্যাজিক্যাল দাদাভাই দিয়েছে। আর দিয়েছে আকাশসম ভালবাসার ক্ষমতা। অথচ দেয়নি তাকে একবার ছোঁয়ার অনুমতি। চরম কষ্টের মূহুর্তে একবার ইস্পাত কঠিন বুকটাতে ঝাপিয়ে পড়ে কষ্ট বিসর্জন দেওয়ার অনুমোদন কিংবা অঢেল সুখের মূহুর্তে আহ্লাদী হয়ে ওই বুকটাতেই লেপ্টে যাওয়ার আজ্ঞা।

নোভা উদাস নয়নে উপরে তাকাল। সন্তর্পণে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে পুনরায় ফুটন্ত পানিতে নজর দিল। অবজ্ঞার সহিত বলল,
“তোরা আমার কষ্টের অনুভূতি ঝলসে দেওয়ার ক্ষমতা রাখিস? পারিস আমার এই টানটান ত্বক জ্বালিয়ে দিতে? পারিস তার হতে না পারার যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিতে? জানি পারিস না। তোরাও পারিস না। তোদেরও ক্ষমতা নেই। নেই তোদের ক্ষমতা। তোরাও আসলে তার মতোই মেরুদণ্ডহীন। তোদের ক্ষমতা নেই চোখে চোখ রেখে সত্যিটা স্বীকার করার। প্রয়োজন নেই তোদের থাকার। নেই কোনো প্রয়োজন।”

শেষোক্ত কথাগুলো কাঁদতে কাঁদতে বলে উত্তপ্ত পাত্র বাহাতে ঠেলে নিচে ফেলল নোভা। আগুন গরম পানিটুকু মূহুর্তেই ছড়িয়ে পড়ল ঝা-চকচকে মেঝেতে। হয়তো ছিটেফোঁটায় সরষের দানার ন্যায় ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ফোঁসকায় ছেয়ে গেল মসৃণ ফর্সা পা দু’খানা। কিন্তু তার কাছে সময় কোথায় এসব দেখার! ধ্যান তো কেবল হৃদয়জুড়ে বয়ে যাওয়া প্রবল জলোচ্ছ্বাসের পানে।

হৃদয়হারিণীর উন্মাদনা দেখে দরজার ওপাশে লুকিয়ে থাকা অব্যক্ত প্রেমিক দিশাহীন বোধ করল। শক্ত খোলস ছেড়ে বেরিয়ে ছুটে গেল প্রণয়িনীর সন্নিকটে। নোভার দু’বাহু ধরে ঝাকিয়ে ক্লান্ত ভঙ্গিতে বলল,
“আর কত নোভা! আর কত জ্বালাবি নিজেকে? অঙ্গার হতে আর কত বাকি?”

নোভা স্থিরচিত্তে তাকাল। একদৃষ্টে তাকিয়ে ধীর গলায় বলল,
“তোমার উপর অন্য কারো অধিকার দেবে রিফাত ভাই? খুব সহজেই একজন এসে তোমায় লুফে নেবে? অথচ আমি সাধনার পর সাধনা করেও ব্যর্থ। আমার তপস্যায় কি কমতি ছিল রিফাত ভাই? তবে কি আমার ভালবাসায় খাদ ছিল? আমি ভালবাসতে পারি নি?”

রিফাত বাহু ছেড়ে নোভার গাল স্পর্শ করল। দু’গালে হাত রেখে নরম গলায় বলল,
“তুই ভালোবেসেছিস পিচ্চি। খুব করে ভালোবেসেছিস। আমিই পারিনি তার মূল্য দিতে। ব্যর্থতা তোর নয় আমার। আমি পারি নি মূল্যবান হীরেকে নিজ শরীরে ধারণ করতে। পারি নি সমুদ্রসম ভালবাসায় তলিয়ে যেতে। আকাশসম ভালবাসার পরিধি দেখে হারিয়ে যাওয়ার ভয়ে পিছু হটেছি রে পিচ্চি।”

নোভা চোখের কোণের জলটুকু সন্তর্পণে মুছে ফেলল। গাল থেকে হাত সরিয়ে দিয়ে জোর করে মুচকি হেসে বলল,
“কংগ্রাচুলেশন রিফাত ভাই। নতুন জীবন সুখের হোক।”

রিফাত বিস্ময়কর নেত্রে তাকাল। কিছুক্ষণ আগেই ভেঙে গুড়িয়ে যাওয়া মেয়ের শক্ত খোলসে আবৃত হওয়ার দৃশ্য দেখে চমকপ্রদ হলো সে।
নোভা অবাক হওয়া চোখে আরও একটু মাত্রা বাড়িয়ে বলল,
“চা খাবে তো? তুমি যাও আমি নিয়ে আসছি এক্ষুণি।”

রিফাত চোখ বন্ধ করে নিজেকে সামলানোর প্রবল চেষ্টা চালাল। কিন্তু ব্যর্থ সে। শান্ত দৃষ্টি মূহুর্তেই অশান্ত হয়ে উঠল। চোয়াল শক্ত হয়ে কপালের রগগুলো ফুলে উঠল।

দু কদম এগিয়ে এসে মুখোমুখি দাঁড়াল। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“এত কিসের শীতলতা? কিসের এত উদাসীনতা? এক মূহুর্তেই ভালবাসা পালিয়ে গেল? দম শেষ? শুনে রাখ আমি বিয়ে টিয়ে করছি না। এতগুলো বছর ধরে আমাকে জ্বালানোর, চুপিচুপি যন্ত্রণা দেওয়ার শাস্তিগুলো তোকে ভোগ না করিয়ে আমি মরবও না। বিয়ে তো কান ছাড়। কান খুলে শুনে রাখ- আমি পরছি না অন্যকারোর মালা।”

নোভা স্মিত হাসল। বলল,
“এতকিছু বলছো। অথচ একবার মুখ ফুটে বলতে পারছো না ভালবাসো? কেন বলছো না রিফাত ভাই? মরে যাওয়ার আগে কি এটা জানতে পারব না যে যার জন্য কৈশোর, তারুণ্য এমনকি যৌবন পর্যন্ত অঢেল প্রেম নিয়ে অপেক্ষার প্রহর কাটিয়েছি সে একবার হলেও ভালোবেসেছে। কাছে টেনে নিয়েছে এক মূহুর্তের জন্যও।”

রিফাত দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। নিচের দিকে তাকিয়ে নিজেকে স্থির করে ভেজা গলায় বলল,
“আমি তোকে ভালবাসি রে পিচ্চি। খুব খুব খুব ভালবাসি। যতটা তোর কল্পনায়ও ধারণ করতে পারিস না। ঠিক ততটা। কিন্তু আমি নিরুপায়। তোকে পেতে চাইলে যদি আমার বন্ধুত্ব হারাতে হয়। যদি আমার পরিবারটা হারিয়ে ফেলতে হয়। মা, ভাই সব হারিয়ে আমি বাঁচব না রে। ভালবাসা হারিয়ে জ্যান্ত লাশ হলেও সব হারালে মৃত লাশ হব। পচন ধরবে তাতে। চিল, শকুনে খাবে।”

নোভা কিছু বলার আগেই দরজায় শব্দ হলো। চমকে পেছনে তাকাতেই হৃদযন্ত্র অচল হওয়ার উপক্রম। আবরার রুদ্রমূর্তি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রিফাত বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে আবরার কে দেখে নোভার ভীত মুখপানে তাকাল।

আবরার পায়ে পায়ে এগিয়ে এসে শান্ত গলায় বলল,
“কতদিন ধরে চলছে এসব?”
রিফাত নোভাকে পেছনে রেখে সামনে এগিয়ে বলল,
“আবরার আমার কথা শোন ভাই…”

আবরার হাত উঁচিয়ে থামিয়ে দিয়ে বলল,
“আমি জানতে চাইছি কতদিন ধরে চলছে এসব। সাহস কি করে হলো তোর? এই তোকে বিশ্বাসের প্রতিদান? ভলবাসার প্রতিদান?”

রিফাত পুনরায় কিছু বলার চেষ্টা করতেই আবরার নোভার কান্নারত মুখের দিকে তাকাল। মূহুর্তেই রাগে অন্ধ হয়ে কলার চেপে ধরে বলল,
“তোকে আজ আমি… ”

নোভা তৎক্ষনাৎ সামনে এসে আবরারের কলার আঁকড়ে রাখা হাত ছাড়িয়ে দিল। দু’হাত জোর করে বলল,
“রিফাত ভাইকে মেরো না দাদাভাই। রিফাত ভাইয়ের কোনো দোষ নেই। মারলে আমাকে মারো। রিফাত ভাই কিছু করে নি। একবারও প্রশ্রয় দেয় নি আমাকে। একবারও না। ভিক্ষে চেয়েও এক বিন্দু মায়া কুড়াতে পারি নি আমি দাদাভাই।”

আবরার নোভা কে সরিয়ে স্বশব্দে চড় বসিয়ে দিল রিফাতের গালে। কিংকর্তব্যবিমূঢ় রিফাত কেবল ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল বন্ধু নামক মানুষটার পানে।

চলবে….#সেদিন_বসন্ত_ছিল
#রাহনুমা_রাহা
#পর্বঃ৩৯

অগ্নিশিখার ন্যায় জ্বলতে থাকা আবরার রিফাতের হাত ধরে টানতে টানতে বসার ঘরে নিয়ে ছাড়ল। পেছনে নোভা উদভ্রান্তের ন্যায় ছুটে এসে চিৎকার করে ডাকল,
“মা; মা কোথায় তুমি? মা; মা এসো।”

রিফাত মাথা নিচু করে অপেক্ষা করছে পরের আঘাতের। নোভা পাগলের মত হাত কচলে যাচ্ছে অনবরত। কিঞ্চিৎ সময় পর ফাহিমা করিম নিজের ঘর থেকে প্রায় দৌড়ে এলেন। পেছনে পেছনে এলো ইভানাও।

আবরার রিফাতের কলার ধরে পুনরায় আঘাত হানার আগেই নোভা হাঁটু গেড়ে বসে আবরারের পা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
“মেরো না দাদাভাই। রিফাত ভাইয়ের কোনো দোষ নেই। মারতে হলে তুমি আমাকে মারো। দোহাই আল্লাহর, রিফাত ভাই কে মেরো না আর।”

আবরার কলার ছেড়ে শক্ত চোখে রিফাতের দিকে তাকাল। তাচ্ছিল্য করে বলল,
“দেখ! দেখ তাকিয়ে। কাকে কাঁদাচ্ছিস তুই বছরের পর বছর ধরে। আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে পায়ে পড়তেও একবার ভাবে নি মেয়েটা। আর তুই দিনের পর দিন, রাতের পর রাত প্রবল যন্ত্রণায় বিধ্বস্ত করলি তাকেই। সাহস কি করে হলো তোর? আমার বোনকে কাঁদানোর অধিকার তোকে কে দিয়েছে?”

ঘরজুড়ে নিস্তব্ধতা বিরাজ করল কিয়ৎক্ষণ সময়। আবরারের কথাগুলো বোধগম্য হলো না গুটিকতক মানুষের। কেবল এবং কেবলমাত্র ফাহিমা করিম আশ্চর্যান্বিত হলেন না। এমনটাই তো হওয়ার ছিল!

আবরার পুনরায় তেড়ে গেল রিফাতের দিকে। কলার ধরে ঝাঁকিয়ে বলল,
“এই দাম দিলি বন্ধুত্বের? এই প্রতিদান? এই বিশ্বাস? কাঁদিয়ে দিলি বোনটাকে? এই তুই আমার সবচেয়ে কাছের? এই ভরসায় আমি আমার জীবনটা রেখে চলে যাই হাজার মাইল দূরে? কেন রে ভাই? একটা বার মুখ ফুটে বলতে কিসের এত দ্বিধা তোর? একবার বলে দেখতে পারতিস। পৃথিবী এফোড় ওফোড় করে দিতে পারি তোর জন্য। আর এ-তো একটা মেয়ে। হোক সে আমার বোন। তোর তো ভালবাসা। আমি কি এতটাই খারাপ বন্ধু, ভাই? কেন আপনার ভাবিস না তুই? আমার বিশ্বাসে কি খামতি ছিল রে? আমি কি বন্ধু হিসেবে এতটাই অপারগ?”

রিফাত চোখে জল মুখে হাসি নিয়ে দু’হাতে ঝাপটে ধরল বন্ধু নামক ভাইটাকে। এতিম অসহায় জীবনটাকে আজ প্রাণঢালা অভিনন্দন জানাতে ইচ্ছে হচ্ছে তার। এই খামতিটার জন্যই তো এত এত পূর্ণতা।

আবরার রিফাত কে মৃদু ধাক্কা দেয়। অভিমানের সুরে বলে,
“ছাড়। তোর মত বন্ধুর দরকার নেই আমার। দূর হ তুই।”

রিফাত ছাড়ে না। বরং আরও শক্ত বাঁধনে বেঁধে বলে,
“আজন্ম ধরে রাখার অধিকার পেয়ে গেছি ভাই। আর দ্বিধা নেই।”

আবরার পেটে গুঁতো মেরে চাপা গলায় বলল,
“শালা ছাড়। সমকামী বানানোর পায়তারা করছিস নাকি ব্যাটা। আমার কিন্তু বউ আছে, ক’দিন পর বাচ্চাও হবে। তোর মত অন্য কাউরে খুঁজে নে।”

রিফাত ছেড়ে দিয়ে চোখ ছোট ছোট করে তাকাল। আবরার চোখ ঘুরিয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
“মা, নোভার বিয়ে দেবে তো এখন?”

ফাহিমা করিম নোভার দিকে তাকালেন। নোভা আড়চোখে রিফাতের দিকে তাকিয়ে মাথা নিচু করে ফেলল।

আবরার পুনরায় বলল,
“ইমরানের কথা মনে আছে তোমার মা?”

ফাহিমা করিম মনে করার চেষ্টা করলেন। কিঞ্চিৎ সময় পর বললেন,
“নওশের ভাইয়ের ছেলে ইমরান? গালে জন্ম দাগ ছেলেটার?”

“মনে আছে তবে! ইমরানের বিয়ের জন্য মেয়ে দেখছে। আমাকে নোভার কথা বলল আংকেল। কোথায় দেখেছে যেন। পছন্দও হয়েছে। এখন তুমি রাজি থাকলে আমি ওদের আসতে বলতে পারি।”

রিফাত চমকে উঠল। অবিশ্বাস্য চোখে তাকাল আবরারের দিকে। নোভা কোনো ভাবাবেগ দেখাল না।এত এত চমক পেয়ে মস্তিষ্ক আর নিতে পারছে মা। কোনো প্রতিক্রিয়াও দেখাতে পারছে না।

ফাহিমা করিম নীরব রইলেন।
আবরার পুনরায় বলল,
“ছেলেটা ভালো মা। গোয়েন্দা বিভাগে আছে। একদম তুখোড় গোয়েন্দা। নোভা নিশ্চয়ই ভালো থাকবে।”

ফাহিমা করিম দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন,
“যা ভালো বুঝিস কর।”

ইভানা চাপা স্বরে বলল,
“আপনি পাগল হয়ে গিয়েছেন? কি বলছেন এসব? ওরা দুজন দু’জনকে ভালবাসে জেনেও দু’জনের আলাদা বিয়ে দেওয়ার জন্য উঠেপড়ে লেগেছেন! কেন?”

আবরার রহস্যময় হেসে বলল,
“চুপচাপ দেখে যাও আর এনজয় করো বেবস্।”
ইভানা বিরবির করে ডজনখানেক গালি দিয়ে সরে দাঁড়াল।

রিফাত ঠায় দাঁড়িয়ে রইল বেশ কিছুক্ষণ। অতঃপর বলল,
“গোয়েন্দার সাথে বিয়ে দিবি, ক’দিন পর যদি তদন্তে গিয়ে মরে গিয়ে লটকে যায়? তখন কিন্তু সারাজীবন তোর বোন কে কাঁদতে হবে।”

“তুই তো বেঁচে থেকেই কাঁদাচ্ছিস। ও না-হয় মরে গিয়েই কাঁদালো। ক্ষতি কি?”

রিফাত আর না পেরে হতাশ গলায় বলল,
“কেন মেরে ফেলতে চাইছিস আমায়?”

আবরার তাচ্ছিল্য হাসল। বলল,
“কতগুলো বছর ধরে যে প্রতিনিয়ত আমার বোনটাকে মারছিস, তার বেলায়? তোর জন্য আমার বোনটার জীবন থেকে রং হারিয়ে গেছে। কি ভেবেছিস আমি এসব জানি না? বুঝি না? বলদ আমি? চোখে ঠুলি পরে ঘুরি? কত দিন অপেক্ষা করেছি দু’জনের একজন অন্তত এসে বলবি মনের লুকিয়ে রাখা কথাগুলো। কিন্তু হায়! আমি তো আদ্যিকালের সেই দানবীয় ভাই! ভালবাসার মর্ম আমি বুঝি নাকি? একজন বলে, আমি নাকি ম্যাজিক্যাল দাদাভাই। অথচ জীবনের সবচেয়ে বড় ম্যাজিকটা দেখানোর দায়িত্বটুকুও পালন করতে দিতে রাজি নয় সে। দিব্যি কষ্টগুলো কবর দিয়ে দিল মনের ভেতরে। আমি সবদিকেই ব্যর্থ। না ভালো বন্ধু হতে পেরেছি না ভালো ভাই। আমারই চলে যাওয়া উচিৎ সব ছেড়ে।”

মাথা নিচু করে থাকা অবস্থায় মাথার উপর কারো হাতের স্পর্শ পেয়ে ফুঁপিয়ে উঠল নোভা। ইভানা চোখের ইশারায় আবরার কে দেখিয়ে বলল কাছে যেতে। নোভা গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে এসে দাঁড়াল আবরারের মুখোমুখি।
আবরার বোনের গালে আদুরে স্পর্শ রেখে নরম গলায় বলল,
“একবার বলতে পারতে তো। ছোট্ট মনটাকে এত পুড়ানোর দরকার ছিল?”

নোভা ফুঁপিয়ে উঠে। দাদাভাইয়ের বুকের একপাশ আঁকড়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলে। আবরার মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত গলায় বলে,
“দাদাভাই সব ঠিক করে দেবে এবার। শান্ত হয়ে যাও।”

নোভা খানিকটা শান্ত হয়ে ভেজা গলায় বলল,
“সবটা বলা যায় না দাদাভাই। পরিস্থিতিও তেমন ছিল না। আমি বলতে পারি নি দাদাভাই। নিরূপায় আমি কঠিন সময়টাতে তোমাকেও পাশে চাইতে পারি নি। কি করতাম আমি? যদি আমার জন্য রিফাত ভাই সব হারিয়ে ফেলে।যদি সবটা নষ্ট হয়ে যায়। কি করতাম আমি দাদাভাই!”

আবরার পুনরায় রিফাতের দিকে তাকিয়ে কড়া গলায় বলল,
“সব কিছুর মূলে তুই? তোরে তো আজ আমি… ”

রিফাত হাত বাড়িয়ে বলল,
“আয়।”

“পাঁচ মিনিটের মধ্যে দুজনের মত স্থির করে আসবি। বিয়ের মত গুরুদায়িত্ব নেওয়ার মত সাহস অর্জন করে আসবি। সময় মাত্র পাঁচ মিনিট। এক সেকেন্ডও যদি এদিক ওদিক হয় আমি তৎক্ষণাৎ ইমরানকে আসতে বলব। ছেলে গোয়েন্দাগিরি রেখে এসে কবুল বলে তোর পাখি নিয়ে ফুড়ুৎ। তখন তুই গঞ্জের হাটে বাদাম বেচিস।”

কথা শেষ করে প্রতিত্তোরের অপেক্ষা না করে সকলকে নিয়ে বসার ঘর ত্যাগ করল আবরার। রয়ে যায় শুধু নোভা রিফাত।

নিস্তব্ধ, নিশ্চল কামরায় নীরবতার বরফ গলিয়ে রিফাত মৃদুস্বরে বলল,
“আমায় বিয়ে করবি পিচ্চি?”
নোভা উদাস নয়নে তাকাল। এটাই তো এতকাল চেয়ে এসেছে সে। তবে আজ কেন অদৃশ্য শক্তি গলা টিপে ধরেছে তার।
রিফাত উত্তর না পেয়ে পুনরায় বলল,
“আমি তোকে আরাম আয়েশের জীবন দিতে পারব না ঠিকই তবে, তোর জীবনের এক একটা মূহুর্ত ভালবাসায় মুড়িয়ে দেব। হয়তো টুকটাক কাজ করে খেতে হবে তোকে। হাত পুড়িয়ে রান্না করতে হবে কিন্তু মনের শান্তিতে কখনো টান পড়বে না। সপ্তাহ জুড়ে কাজ থাকলেও ছুটির দিনগুলোতে তোকে রাণীর আসন দেব। বাস্তবিকে তোকে রাণী বানাতে না পারলেও আমার মনের রাজ্যে তুই আমার সাম্রাজ্যের রাণী ছিলিস,আছিস এবং থাকবি। এতগুলো বছরের প্রতি ফোটা চোখের জলের প্রতিদান দিতে আমি এক ফোটাও কার্পণ্য করব না রে পিচ্চি। শুধু একবার বল বিয়ে করবি তো আমায়? এভাবেই পাগলের মত ভালবাসবি?”

নোভা স্থির দৃষ্টিতে রিফাতের দিকে তাকিয়ে নরম গলায় বলল,
“বিয়ের পরও তুই তুই করে বলবে?”

রিফাত হেসে উঠল। অনেকগুলো বছর পর প্রাণখোলা হাসি। দু-হাত দু’দিকে মেলে বলল,
“অঢেল সুখের মূহুর্তে আহ্লাদী হয়ে লেপ্টে যাওয়ার আজ্ঞা দেওয়া হলো তোকে।”

ঠোঁটে হাসি চোখে জল নিয়ে কিঞ্চিৎ সময় বিলম্ব না করে ঝাপিয়ে পড়ল কঠিন পুরুষটির কঠোর বুকটাতে, ভালবাসার খোঁজে। অভিষেক হলো মনের সিংহাসনে। সুখ টুকু আজ চোখের জল হয়ে ঝরে গেল গাল বেয়ে।

সময় যখন পাঁচ মিনিটই সঠিক তখন দুজন উপস্থিত হলো আবরারের ঘরের সম্মুখে। আবরার তখন ঠায় তাকিয়ে ছিল দরজার পানেই। দু’জনের পদধূলি পড়তেই মৃদুমন্দ আওয়াজ তুলে বলল,
“যদি থাকো রাজি, তবে ডাকো কাজী।”

চলবে….

নোটঃ প্রমিস করা ছিল কারো কাছে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here