#স্মৃতিতে_তোমার_বন্দনা
#পর্ব_৩২
#Saji_Afroz
.
.
ছোঁয়ার মুখে এমন একটি কথা শুনতে প্রস্তুত ছিল না পরশ । মনেহলো ভুল শুনেছে সে । তাই আবারো একই প্রশ্ন করলো । ছোঁয়া বলল-
ওকে আমি ভালোবাসি ।
-আমি শুনেছি তোমার বফ নেই ।
-নেই, তবে ছিল ।
.
এসব যেন বিশ্বাসই হচ্ছেনা পরশের ।
সে বলল-
আমি কিছুই বুঝতে পারছিনা ছোঁয়া । আমাকে সবটা খুলে বলবে প্লিজ?
.
চোখের কোণে জমে থাকা পানিগুলো আঙুল দিয়ে মুছে ছোঁয়া বলল-
থাক না এসব । চলুন বাড়ি যাওয়া যাক ।
-আমার শোনা অনেক জরুরি ছোঁয়া ।
-মানে?
-না মানে তুমিও আমাদের ফ্যামিলির সদস্যের মত । আমি কি সবটা জানতে পারিনা?
.
ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে ছোঁয়া বলল-
আমাদের রিলেশন ছিল । দুজন দুজনকে ভীষণ ভালোবাসতাম । মাঝখানে বাবার অসুস্থতা ধরা পড়ে । মধ্যবিত্ত ফ্যামিলি বলে চিকিৎসার খরচ চালাতে গিয়ে হিমশিম খেতে হয় । নিজেদের বাড়িটাও বিক্রি করতে হয় । বাবার চিকিৎসার খরচ সামলিয়ে সংসার চালাতে পারছিলাম না । তখন সাহায্য করে রাফসান ভাইয়া । দুই পরিবার আপু আর রাফসান ভাইয়ার বড় ভাইয়ার বিয়ে ঠিক করে । তারপর শুনলাম, রাফসান ভাইয়া আমাকে পছন্দ করে । সে আমায় বিয়ে করতে চায় । এটা আমি মানতে পারিনি । তবুও চুপ ছিলাম । কারণ বিয়েটা তখনি হবে এমন কোনো কথা বলেনি তারা । বাবার চিকিৎসা চলছিল । হঠাৎ বাবা মারা যায় । আমাদের বাসায় রাফসান ভাই এর যাতায়াত বেড়ে যায় । তিনি নানাভাবে আমাকে ইমপ্রেস করতে চায় । আমার এসব ভালো লাগতো না । আমি তাকে আমার ভালোবাসার কথা জানাই । কিন্তু তিনি আমার মা’কে সবটা জানিয়ে দেয় । আরো বলে, আমি যদি তাকে বিয়ে না করি তাহলে রাদিব ভাইয়াও আপুকে বিয়ে করবেনা । আমার মা ঘাবড়ে যায় কথাটি শুনে । আমাকে রাজি করাতে চেষ্টা করতে থাকে তুষারের সাথে যোগাযোগ বন্ধ করার জন্য । কিন্তু আমি করিনি । একপর্যায়ে মা সুইসাইড করার চেষ্টা করে । সেবার মা বেঁচে যায় । তখন তাকে প্রতিজ্ঞা করি, তুষারের সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দিব । আর সেই থেকে তুষারকে ভুলে থাকার বৃথা চেষ্টা আমি করছি ।
.
সবটা শুনে পরশ বলল-
আন্টির কথা নাহয় বুঝলাম, নয়নতারা কেন রাজি হলো এসবে? সে তোমার সুখের জন্য নাহয় রাদিবের সাথে বিয়েটা নাই করতো!
-রাদিব ভাইয়াকে তার পছন্দ, আমাকে এটা বলেছে । আরো বলেছে, আমার জন্য তাকে হারাতে চায়না সে ।
.
পরশ জানে নয়নতারা এসব রাফসানের জন্য বলেছে । নিশ্চয় রাফসান তাকে বাধ্য করেছে ।
.
ছোঁয়া বলল-
অনেক কষ্টে নিজেকে গুছিয়ে নিচ্ছিলাম । এই সময়ে তুষার আমার সামনে না আসলেও পারতো ।
.
চোখের পানি আর আঁটকে রাখতে পারলোনা ছোঁয়া । অনবরত পানি পড়ছে তার চোখ বেয়ে ।
ছোঁয়াকে এভাবে দেখতে পরশের একদমই ভালো লাগছেনা । এত কষ্ট বুকে চেপে রেখেছে এই মেয়েটি, তাকে দেখলে বোঝায় যায়না ।
পরশের চোখও অশ্রুসিক্ত! ছোঁয়াকে বুঝতে না দিয়ে লুকিয়ে মুছে নিলো সে । তারপর নিজের রুমালটা তার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল-
আশেপাশে অনেক মানুষ ছোঁয়া । চোখটা মুছে নাও । চলো বাড়ি যাই ।
.
দূর থেকে তাদের দেখছে তুষার । পরশকে দেখে সে চিনলোনা । ভাবছে, কে এই লোকটি? ছোঁয়া তাকে কি বলছে? তার কি রাফসানের সাথে বিয়েটা এখনো হয়নি! হলে নিশ্চয় অন্য কারো সাথে সে ছোঁয়াকে শপিংমলে আসতে দিতনা….
.
.
নিজের রুমে এসে দরজাটা বন্ধ করে শুয়ে পড়লো পরশ । কিছুক্ষণ চোখটা বন্ধ করলো সে । একটু পর চোখটা
খুলে নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করলো, এটা স্বপ্ন ছিল ।
কিন্তু আফসোস…
এমন কিছুই হলোনা । এটা কোনো স্বপ্ন নয়, বাস্তব । কঠিন বাস্তব!
উঠে পড়লো পরশ ।
শপিং ব্যাগে থাকা কার্ডটি বের করে লিখতে থাকলো-
তুমি বলেছিলে মনের কথা এই কার্ডটিতে লিখে প্রিয়তমা কে দিতে । কিন্তু তুমি এটাই জানতেনা, আমার প্রিয়তমা তুমিই ছোঁয়া!
অনেকখানি ভালোবেসে ফেলেছি তোমাকে । ভেবেছিলাম তোমার ভালোবাসাও পাবো । কিন্তু আজ জানতে পারলাম, তোমার হৃদয়ে অন্য কারো বসবাস । যেখানে আমার জন্য কোনো স্থানই নেই ।
.
আর লিখতে পারছেনা পরশ । হাত কাঁপছে তার।
কি লিখবে সে? কেনই বা লিখবে! এটা কি সে দিবে ছোঁয়াকে?
আচমকা কার্ডটি ছিড়ে তন্নতন্ন করে ফেললো পরশ ।
কাঁদতে ইচ্ছে করছে তার চিৎকার করে । তাতে যদি মনটা হালকা হয়!
.
.
নুপুর জোড়া পায়ে পরে বিছানার এক কোণে পা টেনে হেলান দিয়ে বসে আছে ছোঁয়া । নয়নতারা এসে বলল-
এসেছিস তুই?
রাফসান ফোন দিয়েছিল । রাদিব আসবে দুদিন পর । আর কিছুদিন পরেই দু’বোন এক বাড়িতে বউ হয়ে যাব ।
.
ছোঁয়ার কোনো সাড়া না পেয়ে তার পাশে বসলো নয়নতারা । পায়ের দিকে চোখ পড়তেই সে বলল-
আবার পরেছিস এই পুরনো নুপুর তুই?
-ভালোবাসার মানুষের উপহার পেয়েছ কখনো আপু? যদি পেয়ে থাকো, তবে এর মূল্য বুঝবে ।
.
ছোঁয়ার কাঁধে হাত দিয়ে নয়নতারা বলল-
কি হয়েছে তোর?
.
খুব স্বাভাবিক ভাবেই ছোঁয়া উত্তর দিলো-
আজ না তুষারকে দেখেছি । আগের চেয়েও সুন্দর হয়ে গিয়েছে । আমাকে দেখেই চিনে ফেলেছে সে । তারপর রাগ ঝেড়ে চলে গিয়েছে । ইচ্ছে করেছিল ওর হাতটা ধরে ফেলতে । তারপর কান ধরে বলতে, সরি । এবারের মত মাফ করে দাও ।
আগে তো এভাবেই রাগ ভাঙাতাম। কিন্তু এবার পারিনি আপু । আচ্ছা আপু? যদি এমনটা বলতাম, সে কি ক্ষমা করে দিয়ে নিজের জীবনে ঠাঁই দিতো আমায়? আমার যে ওকে ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করব ভাবলে ভীষণ কষ্ট হয় ।
.
কোনো জবাব দিতে পারলোনা নয়নতারা । ভালোবাসায় যে কি কষ্ট জানে সে ।
ভীষণ কান্না পাচ্ছে তার । ছোঁয়ার সামনে নিজেকে প্রকাশ করলোনা নয়নতারা । দ্রুত বেরিয়ে পড়লো সে রুম থেকে ।
.
সন্ধ্যে হয়ে গেল । ড্রয়িংরুমটা নিজের মনের মত সাজালো ছোঁয়া । শত কষ্টের মাঝেও দায়িত্বের কথা ভুলেনি সে । সাফিনা আহম্মেদ ও শফিউল আহম্মেদ পরশের দেয়া শাড়ি ও পাঞ্জাবি পরে রুম থেকে বেরিয়ে আসলেন । এতক্ষণ ছোঁয়াই রুম বন্দী করে রেখেছিল তাদের ।
তারা ড্রয়িংরুমে এসে চমকে গেলেন । সাফিনা আহম্মেদ খুশিতে বলে উঠলেন-
এসব আমাদের জন্য?
-জ্বি । সবে তো শুরু । আরো কত কত সারপ্রাইজ আছে দেখতে থাকুন ।
.
এরইমাঝে উপস্থিত হলো নয়নতারা ও আফিয়া জান্নাত । তাদের সাথে কথা বললেন তারা । তাদেরও একই রঙের পোশাকে দেখতে পেলেন সাফিনা আহম্মেদ। কিন্তু ছোঁয়া খুবই সাদাসিধা অন্য রঙের সালোয়ার কামিজ পরে আছে । সাফিনা আহম্মেদ বললেন-
তুমি বলেছ পরশ সবার জন্য আজ জামা নিয়েছে । তোমার জন্য নেয়নি?
-নিয়েছে । পরার সময় পাইনি ।
-পরে আসো । আমি পরশকে ডেকে আনি । সেও তৈরী হতে পারলোনা ।
-ঠিক আছে ।
.
সাফিনা আহম্মেদ পরশের রুমে আসলো ।
পরশ সাদা পাঞ্জাবি পরেছে । জানালার ধারে দাঁড়িয়ে আকাশের পানে তাকিয়ে আছে সে ।
.
সাফিনা আহম্মেদ বললেন-
বাহ! আমার ছেলেকে তো দারুণ লাগছে দেখতে ।
.
পরশ মুচকি হেসে বলল-
শুভ বিবাহ বার্ষিকী মা ।
সাফিনা আহম্মেদ ছেলেকে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু খেলেন । তারপর বললেন- ধন্যবাদ । এবার বল, আজ ছোঁয়াকে কিভাবে প্রপোজ করবি? আর আমরাই বা কি বলব? মানে আমরাও তো তাকে প্রপোজ করব তাইনা?
.
মায়ের হাত ধরে পরশ বলল-
এমন কিছু হবেনা আজ ।
-মানে?
-মানে ছোঁয়াকে আমি মনের কথা জানাতে পারব না ।
-কেন?
-কারণ তার মনে অন্য কেউ আছে । সেটা রাফসান নয়, অন্য কেউ । যার জন্য রাফসানকে বিয়ে করতে আপত্তি তার ।
.
সাফিনা আহম্মেদ অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন ছেলের দিকে ।
পরশ বলল-
এটা সত্যি মা ।
.
চলবে