হলুদ বসন্ত পর্ব -শেষ পর্ব

#হলুদ_বসন্ত
#অন্তিম_পর্ব
#Eshika_Khanom

[সবাইকে শেষের লেখাগুলো পড়ার অনুরোধ রইল]

দিনকয়েক পার হয়েছে। বাতাসে ভেসে আসা ফুলের সুঘ্রাণ ঘ্রাণেন্দ্রিয় পার হয়ে যেন অন্তরে পৌছাচ্ছে। প্রস্ফুটিত ফুলগুলো ভালোবাসায় যোগ করেছে নতুন মাত্রা। দূর থেকে শোনা যাচ্ছে,
বাতাসে বহিছে প্রেম,
নয়নে লাগিলো নেশা
কারা যে ডাকিলো পিছে,
বসন্ত এসে গেছে……

পহেলা ফাল্গুন, চারিদিকে উৎসবের আমেজ। তবে হাসপাতাল পর্যন্ত হয়তো সে আমেজ পৌঁছাতে পারে না। যদিও পৌঁছায়, মানুষ তা উপলব্ধি করতে পারে না। আয়াত এগিয়ে এসেছে আদ্রাফের পানে। হাতে রয়েছে একগুচ্ছ গোলাপ। কেবিনের বেডে শুয়ে আছে আদ্রাফ। কিছুটা সুস্থ অনুভব করে সে আগের চেয়ে। তবে এ সুস্থতা নিতান্তই কিছু সময়ের জন্যে। এটা আদ্রাফ সজ্ঞানে অনুভব করে। হাতে খাবারের ব্যাগ নিয়ে এবং একগুচ্ছ গোলাপ হাতে নিয়ে আদ্রাফের কেবিনটিতে প্রবেশ করল আয়াত। কেবিনে নুহাশ বসে ছিল, আয়াত এসেছে তাই বাহিরে চলে গেল। আদ্রাফ দরজা খোলার আওয়াজ পেয়ে চোখ মেলে আয়াতের দিকে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকালো। কোনো কথা না বলেই আয়াত আদ্রাফের ঠিক সামনে বসে পড়ল। আদ্রাফ নিজে নিজে উঠে বসার চেষ্টা করল। এই চেষ্টা সবসময়ই করে সে, তবে সফল হয়না। আয়াতের সহযোগিতায় উঠে বসল সে। আয়াত মিষ্টি হেসে প্রশ্ন করল,
‘কেমন লাগছে আপনার?’

‘আলহামদুলিল্লাহ। তোমার কি অবস্থা?’

‘ আলহামদুলিল্লাহ ‘

‘দাদী কেমনা আছে?’

নিশ্চুপ রয়ে গেল আয়াত। গত এক মাস ধরে একই প্রশ্ন করছে আদ্রাফ। তাকে জানতে দেওয়া হয়নি সে দাদী আর এই দুনিয়াতে নেই। অনেক আগেই স্বার্থপরের মতো সকলের মায়া সে ত্যাগ করেছে। একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
‘আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছে।’

‘আমার সাথে কি দেখা করতে আসবে না? প্রশ্ন করে না আমার কথা?’

আয়াত শুকনো মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল,
‘হ্যাঁ আসতে চায় তো, তবে অসুস্থ যে তাই আমরা আসতে দেই না।’

‘একদিন আসতে দিও, দাদীকে খুব দেখতে ইচ্ছে করে।’

গত কয়েকদিন ধরেই একই কথোপকথন চলে তাদের মধ্যে। আদ্রাফ দাদীকে দেখতে চায়, কথা বলতে চায়। তবে সে জানে না যে তার এই ইচ্ছা আর পূরণ হবে না। আয়াত বলে,
‘একেবারে বাড়িতে ফিরে গিয়েই দেখা করবেন। দাদীকে এই পরিস্থিতিতে হাসপাতালে নিয়ে আসা ঠিক নয়।’

খুব কষ্ট পায় আদ্রাফ। বলে,
‘আর কি বাড়িতে ফেরা হবে আমার?’

‘ইনশাল্লাহ হবে।’

‘হয়তো।’

পরক্ষণেই আবার মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল,
‘আমার লাশ তো বাড়িতেই আগে যাবে তাইনা?’

হু হু করে কেঁদে দিল আয়াত। আর সহ্য হচ্ছে না তার। আদ্রাফ আয়াতকে নিজের বুকে জড়িয়ে নিল। কান্না থামছে না তবুও। আয়াতকে সামলাতে গিয়ে আদ্রাফও কেঁদে দিল। ভিতর থেকে কান্নার শব্দ পেয়ে ফটাফট কেবিনে প্রবেশ করল নুহাশ। তবে নিজেই যেন বোকা বনে গেল। আদ্রাফ ইশারার মাধ্যমে তাকে আশ্বস্ত করল। নীরবেই আবার প্রস্থান করল সেখানে থেকে নুহাশ।

অনেক কান্নাকাটির পর দুজনেই যখন স্বাভাবিক হলো তখন আয়াত আদ্রাফের মুখের সামনে খাবার তুলে দিল। নাকোচ করল আদ্রাফ, বলল,
‘আমার ভালো লাগে না।’

‘তাতে আমি কি করব?’

‘কি করবে মানে? খাবার সরাও আমার মুখের সামনে থেকে।’

‘না সরাবো না। আদ্রাফ খেতে হবে এসব।’

বলেই আদ্রাফের আরও সামনে আয়াত খাবার নিয়ে গেল। আদ্রাফ বাচ্চাদের মতো এদিক সেদিক তার মুখ সরাচ্ছে। আয়াত হাঁপিয়ে উঠলো। আদ্রাফ নির্দোষ এক ভাব নিয়ে বলল,
‘তুমি জানো তো আমার খেতে ভালো লাগে না।’

আদ্রাফের মুখের রুচি নষ্ট হয়ে গিয়েছে। কিছুই স্বাদ লাগে না আর। আয়াত বুঝতে পারে, তবুই তো খাওয়াতে হবেই। এভাবেই আদ্রাফের সাথে আরো কিছুক্ষণ যুদ্ধ করার পর আয়াতকে খাওয়াতে সক্ষম হয় সে।

আদ্রাফের বুকে মাথা রেখে বসে রয়েছে আয়াত। সন্তোপর্ণে তাকে নিজের কাছে আগলে রেখেছে আদ্রাফ। মাঝে মাঝেই বলছে,
‘আমি বাঁচতে চাই আদ্রাফ, সবার সাথে বাঁচতে চাই।’

বাঁচার আকাঙ্খা যেন তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। আয়াতের মনটা উসখুস করছে। বসন্তের আগমন তার মনে এক ভীতি নিয়ে এসেছে। বারবার মনে পড়ছে আদ্রাফেরই একটা কথা,
‘হয়তো আগমনী হলুদ বসন্তেই পড়বে আমার শেষ নিঃশ্বাস।’

আদ্রাফের পরিহিত হাসপাতালের জামাটির বুকের অংশটুকুকে আঁকড়ে ধরে আদ্রাফের বুকে গভীরভাবে মুখ লুকালো আয়াত। বুকের অংশটুকু ভেজা অনুভব করছে আদ্রাফ। বুঝতে পারছে আয়া কাঁদছে, খুব কাঁদছে। আয়াতের মাথায় হাত বুকিয়ে দিতে লাগলো সে।

সময় নিশ্চুপেই পার হচ্ছে। যে আদ্রাফের শারীরিক অবস্থার একটু উন্নতি হয়েছিল, তাও আবার নিমেষেই মিলিয়ে গিয়েছে। বিকেলে আয়াত এবং নুহাশ আদ্রাফের সাথে গল্পে মেতে ছিল। আদ্রাফ যতোই অসুস্থ থাকুক না কেন, প্রিয় মানুষদের সাথে কথা বলে অনেক শান্তি অনুভব করে। সকল কষ্ট যেন মিলিয়ে যায় প্রকৃতির মাঝে। তবে আজ যেন হিতে বিপরীত হলো। কথার মাঝে আদ্রাফের শ্বাসকষ্ট দেখা দিল। ছটফট করতে লাগলো সে। নুহাশ দৌড়ে ডক্টরকে ডাকতে গেল। অস্থির হয়ে উঠলো আয়াত। প্রশ্ন করতে লাগলো,
‘আদ্রাফ কোথায় কষ্ট হচ্ছে আপনার?’

বোধশূণ্য হয়ে আদ্রাফের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। ইতিমধ্যে একজন ডক্টর, একজন নার্স ও নুহাশ কেবিনে উপস্থিত হলো। আদ্রাফ কেমন যেন আচরণ করছে। ডক্টর কি যেন চেক আপ করল আদ্রাফকে। অতঃপর হতাশ চোখে আয়াত এবং নুহাশের দিকে তাকালো। আয়াত কান্না করছে আদ্রাফের দিকে তাকিয়ে। নুহাশ ডক্টরের চাহুনী বুঝতে পারলো। চটজলদি নুহাশ আদ্রাফের পাশে বসে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলতে লাগলো,
‘আদ্রাফ কালেমা পড়, কালেমা পড়।’

আয়াত স্তব্ধ নয়নে একবার নুহাশের দিকে তাকালো। তারপর আবার আদ্রাফের দিকে তাকালো। কান্না থেমে গিয়েছে তার হঠাৎ করেই। নুহাশ থামেনি। সে আদ্রাফের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে এখনো। আর বলছে,
‘আদ্রাফ কালেমা পড়।’

ছটফটানির মধ্যেই আদ্রাফ আধো আধো কন্ঠে কালেমা পড়ল। নুহাশ বলল,
‘আবার পড় আদ্রাফ, আবার পড়।’

বেশ উত্তেজিত নুহাশ। চোখ দিয়ে তার জল গড়িয়ে পড়ছে। তবুও বন্ধুকে কালেমা পড়াতে ব্যস্ত সে। আয়াত তখনও আদ্রাফের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। তবে এখন হাসছে একটু একটু। মুখে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠেছে। আদ্রাফের ছটফটানি কমে আসতে লাগলো। নিস্তেজ হয়ে গেল ধীরে ধীরে। আয়াতের দিকে নিঃশব্দে তাকালো। হাতদুটো আয়াতের দিকে বাড়িয়ে দিল। আয়াত এক স্নিগ্ধ হাসি হাসলো এবং হাতদুটি ধরে নিল। চোখে চোখে তাদের মধ্যকার ভালোবাসা বিনিময় হচ্ছে। সকলে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। আদ্রাফ আর আয়াত কিন্তু কাঁদছে না, তারা হাসছে। ধীরে ধীরে গ্রথিত হয়ে আসলো আদ্রাফের নয়নযুগল। আয়াতের হাতে আবদ্ধ আদ্রাফের হাত দুটো আলগা হয়ে আসলো। পাশের মনিটরে দেখা গেল সরু লাইনগুলো। টু টু করে শব্দ হচ্ছে। নুহাশ আদ্রাফের দেহ ঝাঁকাতে লাগলো। কোনো রেস্পন্স নেই। কেঁদে দিল সে। এখনো কাঁদছে না আয়াত। পাথর হয়ে গিয়েছে সে। তার অন্তরে একটা কথাই বাজছে,
‘আখিরাতে যখন আল্লাহ আমায় তার কাছে কিছু চাইতে বলবে, আমি জান্নাতে তোমায় আমার পাশে চাইব। আমরা আলাদা হবো না আদ্রাফ। ইনশাল্লাহ জান্নাতের হলুদ বসন্তেই আপনার আর আমার মিলন হবে।’

ধীরে ধীরে সকলের সামনেই নিস্তেজ আয়াত পড়ে গেল মাটিতে।
.
.
.

আজও পাখিরা ডাকছে। বসন্তের ফুল ফোটেছে। শুধু সময়টা আলাদা। মুসল্লিরা জুমআর নামাজ পড়ে মসজিদ থেকে বের হয়েছে। নুহাশ বের হয়েছে মসজিদ থেকে। সোজা চলে গিয়েছে গোরস্তানে। দাঁড়িয়েছে দুইটি কবরের সামনে। প্রায় ১৭ বছর কেটে গিয়েছে। কবর দুইটির একটিতে আদ্রাফ এবং অপরটিতে লিখা আয়াতের নাম। দুটি নামই জ্বলজ্বল করছে যেন। অশ্রু মুছলো সে তার চোখ থেকে। মনে পড়ছে তার সেই ভয়ানক দিনের কথা। সেদিন আয়াত যখন মাটিতে পড়ে গিয়েছিল, ডক্টর চেক করে দেখে আয়াত ব্রেন স্ট্রোক করে সেই মূহুর্তেই দুনিয়া ছেড়ে চলে গিয়েছে। মৃত্যু তাদের আলাদা করেছে, তবে হৃদয় এখনো তাদের মিলনের জন্যে ব্যাকুল। নীরব হয়ে প্রতি শুক্রবারই তাদের দেখতে আসে নুহাশ। এক অনিন্দ্যসুন্দর ভালোবাসার সাক্ষী নুহাশ। তাদের কবরে হলুদ বসন্ত ছেয়ে গেছে। ফুল ফুটেছে কবরে। নুহাশও অপেক্ষা করে দুইটি ভালোবাসার মানুষের মিলনের সাক্ষী হতে।

আজিকার দিন না ফুরাতে
হবে মোর এ আশা পুরাতে–
শুধু এবারের মতো
বসন্তের ফুল যত
যাব মোরা দুজনে কুড়াতে।

সমাপ্ত

[

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here