কবুল বলে ফেলার পরও ধারার ঠিক বিশ্বাসই হচ্ছে না যে, শুধুমাত্র এইচএসসিতে জিপিএ ফাইভ পায়নি বলে তার বাবা আজ তার সত্যি সত্যিই বিয়ে দিয়ে দিলো। আর তাও নাকি গ্রামের একটা চাষার সাথে। হ্যাঁ, ঠিক এই কথাটাই তো পাশের বাসার এক কাকী বৌ সাজানোর সময় ধারার কানে কানে বলল, ধারার যার সাথে বিয়ে হচ্ছে সে নাকি ক্ষেত খামারে কাজ করে। ধারা আর কিছু ভাবতে পারছে না। তার মাথাটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। পাশেই ধারাকে কেন্দ্র করে সবাই হাসি ঠাট্টায় মেতে উঠেছে। একটুপরই শেরোয়ানী গায়ের একজনকে নিয়ে আসা হলো। বিনা সঙ্কোচে অধিকার প্রাপ্তির সুরে বসিয়ে দেওয়া হলো ধারার পাশে। নতুন জামাইয়ের আগমনে ঠিক তখনই ঘরে থাকা অল্প বয়সী মেয়ে ছেলেদের সে কি হৈ হুল্লোড়! পাশেই একটা শক্তপোক্ত পুরুষ অবয়ব। যে নাকি এখন থেকে ধারার স্বামী নামেই জানা যাবে। অথচ যাকে এখনও এক নজরের জন্য দেখেনিও পর্যন্ত ধারা। তবুও ধারা চোখ তুলে তাকালো না। তাকালো না তো তাকালোই না। একটুপরে একটি সুকারুকার্য আয়না রাখা হলো তাদের সম্মুখে। বর কনের যে এবার পরিপূর্ণ অধিকারের সহিত নিজ নিজ জীবনসঙ্গীর মুখ দেখার পালা। পাশের পুরুষটি হয়তো আয়না মুখে চোখ রেখেছে অনেক আগেই। সময় নিচ্ছে শুধু ধারা। শেষমেশ যখন দাদী খালাদের জোড়াজুড়িতে স্বচ্ছ দর্পণে তার ভেজা পাঁপড়ির আনত দৃষ্টি মেলে ধরলো তখন ঝাপসা চোখে একটা বাদামী মুখের অস্পষ্ট প্রতিবিম্ব ছাড়া আর কিছু অবলোকন হলো না।
ধারার বাবা আজিজ তালুকদার। গ্রামের একজন সমৃদ্ধশালী ব্যক্তি। কথাবার্তা বলেন খুব কম। কিন্তু যা একবার বলেন তা ফিরিয়ে নেওয়ার সাধ্যি কারো নেই। শিক্ষা এবং সমৃদ্ধিতে মধুপুর গ্রামের যে কয়েকটি পরিবার এগিয়ে তাদের মধ্যে ধারাদের পরিবার একটি। আজিজ তালুকদার ইন্টার পাশের পর বিএ তে ভর্তি হয়েছিলেন। দুই বছর যাওয়ার পর কিছু পুঁজি যোগাড় করে নেমে পড়েন ব্যবসায়। এবং সফলও হন। মাঝখান থেকে ছুটে যায় পড়ালেখা। শহরে তার বড় কয়েকটি দোকান আছে। ছোট ভাই শাহেদ মাস্টার্স পাশ। একটুর জন্য বিসিএসে টেকেননি। তারপরও একটা বড় সরকারি চাকরির পদে কর্মরত আছেন। চাকরি সূত্রে বর্তমানে পরিবার নিয়ে আছেন চট্রগ্রামে। ছোট ভাইকে পড়ালেখায় দীক্ষিত করার অবদান সম্পূর্ণ আজিজ তালুকদারের। শাহেদের তাই একান্তই মান্য ব্যক্তি তিনি। শিক্ষিত এবং বড় চাকরিজীবী ছোট ভাইয়ের পড়ামর্শ আজিজ তালুকদারও সর্বাধিক গুরুত্ব দেন। পরিবারের জন্য কাজের চাপে নিজের শিক্ষা গ্রহণ সম্পূর্ণ হয়নি। তাই শিক্ষাকে তিনি কদর করেন। চেয়েছিলেন ছেলে মেয়েগুলোকেও একই ভাবে গড়ে তুলবেন। শিক্ষা দীক্ষায় এরা বড় হবে। এবং সেই শিক্ষাটা অবশ্যই হতে হবে সেরা। এ প্লাস পাওয়া ছাড়া শিক্ষার কোন দাম থাকে নাকি! এই চিন্তাটাই ধারার মাথায় নেমে আসে বিশাল চাপ হয়ে। ছোট থেকেই শুনে এসেছে পরীক্ষার ফলাফল মানে অবশ্যই এ প্লাস। আর সেটাও হতে হবে সাইন্স থেকে। বাবার কথা মতই সাইন্স নিয়েছিল ধারা। কিন্তু সাইন্সের সাবজেক্টগুলো একটু কমই বোধগম্য হয় তার। তার উপর বাবার আদেশ ইন্টারে এ প্লাস পেতেই হবে। তিনি গ্রামে সবার কাছে বড় মুখে বলেছেন তার মেয়ে পরীক্ষায় অবশ্যই এ প্লাস পাবে। বিশেষ করে তার সবথেকে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী জয়নাল খাঁ-কে শুনিয়ে। যার ছেলেও কিনা এবার ধারার সাথেই পরীক্ষা দেবে। মেয়ে যেন এ প্লাসই পায় এই জন্য অসুস্থতার বাহানা দিয়ে ইন্টারে এক বছর মেয়েকে গ্যাপও দেওয়ান তিনি। গ্রামে তার মুখটা যে করেই হোক রাখতে হবে। এই সব কিছুই প্রেশার হয়ে উঠে ধারার কাছে। মনে সৃষ্টি করে প্রচন্ড ভয়। এতকিছুর পরও যদি এ প্লাস না পায়! প্রচন্ড ভয়, নার্ভাস আর প্রেশারে পরীক্ষায় খারাপ করে বসে ধারা। একটুর জন্য আসে না কাঙ্খিত ফলাফল জিপিএ ফাইভ। অপরদিকে জয়নাল খাঁ-য়ের ছেলের এ প্লাস পাওয়ার খবর ছড়িয়ে যায় পুরো গ্রামময়। রাগে, ক্ষোভে, অপমানে আজিজ তালুকদার সেদিনই বাড়ির মধ্যে ঘোষণা দেন এই মেয়ের পড়ালেখা দিয়ে কিছু হবে না। একে অতি শীঘ্রই বিয়ে দেওয়া হোক। যেই সম্বন্ধ এরপর আসবে তার সাথেই দিয়ে দেওয়া হবে। গ্রামে মেয়েদের ষোল বছর মানেই প্রাপ্তবয়স্ক। সেদিক বিবেচনায় ধারা বিয়ের জন্য উপযুক্ত হয়েছে আরো আগেই। কিছুদিন পরপরই তাই তাদের বাড়িতে বিয়ের সমন্ধ নিয়ে লোকের আসা যাওয়া চলতো। তাই রেজাল্ট পাওয়ার দু দিন পরই যখন তাদের পাশের গ্রাম রূপনগর থেকে একটা সম্বন্ধ আসে তখন ধারার বাবা জেদের বশবর্তী হয়ে সেটাতেই হ্যাঁ বলে দিয়ে আরো দুই দিন দেখা সাক্ষাৎ, কথা বার্তা চালিয়ে সাত দিনের মাথাতেই মেয়ের বিয়ে দিয়ে দেন। এতদিন তো তিনি সব সম্বন্ধ না বলে রাখতেন কারন মেয়ে নিয়ে তার আশা ছিল। এখন তো অপদার্থ মেয়ে তার সব আশাই ভেস্তে দিল।
এসব ভাবতে ভাবতেই বাসর ঘরে বসে বসে চোখের জলে নিঃশ্বাস ভারী হয়ে উঠছে ধারার। অশ্রু যেন থামার নামই নিচ্ছে না। কান্নার দমকে তার ক্লান্ত শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে বারংবার। চোখ মুখ হয়ে উঠেছে রক্তিম। গভীর বেদনায় জর্জরিত ধারা শুধু একটি কথাই ভাবছে, কি থেকে কি হয়ে গেল! এ প্লাস না পাওয়ার এতো বড় শাস্তি যে তার বাবা তাকে দেবে তা হয়তো কখনোই ভাবতে পারেনি সরল মনের ধারা। বাবাকে সে জমের মতো ভয় পায়। তাই তো এর বিপরীতে টু শব্দটিও করতে পারেনি সে। ধারারই বা আর কি করার ছিল! সে তো তার সাধ্য মতোই চেষ্টা করে ছিল। কিন্তু পরীক্ষার হলে অতিরিক্ত নার্ভাসনেসের দরুণ সে ভালো করার মতো প্রশ্নের উত্তরেও ভালো করতে পারেনি। যার পরিবর্তে আজ তার জীবনে এই পরিবর্তন নেমে আসলো।
দরজা খুলে রুমের ভেতরে প্রবেশ করতেই শুদ্ধ দেখলো, ফুল দিয়ে সাজানো বিছানার ঠিক মাঝ বরাবর বসে লাল টুকটুকে শাড়ি পরিহিতা তার সদ্য বিবাহিতা নব বধু হেঁচকি তুলে তুলে কাঁদছে। কম্পিত শরীরের ভাঁজে তার সুন্দর মুখশ্রীটুকুও ঢাকা পড়ে গেছে। রুমে কারো প্রবেশের আভাস পেতেই চট করে বিছানা থেকে নেমে মেঝেতে দাঁড়িয়ে পড়লো ধারা। খাটের গা ঘেঁষে একদম পাশুটে মেরে দাঁড়িয়ে রইল। ভয়ে আতঙ্কে তার মুখ জমে এতটুকু হয়ে গেছে। চোখের সামনে দাঁড়ানো সাদা পাঞ্জাবী পরণের এই উজ্জ্বল গাত্রের রোগা, লম্বা ছেলেটাই কি তবে তার স্বামী! ছেলেটা একটু এগিয়ে এসে ভরাট গলায় ধারাকে প্রশ্ন ছুড়লো,
‘কি হলো আপনি এভাবে কাঁদছেন কেন?’
ধারা কিছু বলতে পারলো না। কান্নার চোটে তার গলা হয়ে উঠেছে অবরুদ্ধ। ছেলেটি আবারো বলল,
‘কি হলো বলুন।’
ধারা এবারও কিছু বলতে পারলো না। তার কান্নাটা বরঞ্চ আরো একটু যেন বাড়লো। শুদ্ধ বিরক্তবোধ করলো। ভ্রু কুঁচকে চুপচাপ কিছুক্ষণ সন্ধিগ্ন চোখে ধারার দিকে তাকিয়ে থেকে স্পষ্ট স্বরে বলল,
‘আপনার কি বিয়েতে মত ছিল না?’
ভয়ার্ত চোখে একবার শুদ্ধ’র দিকে তাকিয়ে বহু কষ্টে ধারা কাঁপা কাঁপা শরীরে মাথা দুলালো। ধারার মাথা দুলানো দেখেই মেজাজ বিগড়ে গেলো শুদ্ধ’র। বলল,
‘বিয়েতে মত ছিল না তাহলে বিয়ে করেছেন কেন?’
শুদ্ধর কণ্ঠে স্পষ্ট রাগ। ধারা আরো ঘাবড়ে গেলো। কোনমতে আমতা আমতা করে বলল,
‘বাবা বলল তাই…!’
‘বাবা বলল তাই মানে? বাবাকে আগে না করেননি?’
কাঁদতে কাঁদতে ধারা আবারো দু দিকে মাথা দুলালো। এবার সত্যিই ভীষণ রাগ লাগছে শুদ্ধ’র। ঝাঁঝালো স্বরে বলল,
‘বাবা বলল আর ওমনিতেই বিয়ে করে নিলেন! এখন আবার বিয়ে করে মরা কান্না জুড়ে বসেছেন। এখন কি আশা করছেন, সিনেমার মতো আমি আপনাকে এসে বলবো, ‘কোন অসুবিধা নেই। আপনি একটুও চিন্তা করবেন না। আপনি আপনার মতো থাকবেন, আমি আমার মতো থাকবো।’ এই?’
ধারা এমনিতেই ভয় পেয়ে ছিল। শুদ্ধ’র ধমকের চোটে ভয় পেয়ে ও’র কান্না আরো বাড়তে লাগলো। বিরক্ত স্বরে শুদ্ধ বলল,
‘প্লিজ! সর্বপ্রথম আপনার এই কান্নাটা বন্ধ করুন। এই কান্নাটা কি বিয়ের আগে কাঁদতে পারেননি? বিয়ের আগে বাবাকে না করলেন না কেন?’
শুদ্ধ’র কঠিন চোখের দৃষ্টি থেকে লুকিয়ে বাঁচতেই এদিক ওদিক তাকাতেই ধারার হঠাৎ নজর পড়ল পাশের টেবিলে থাকা একটা ল্যাপটপের দিকে। কান্নার মধ্যেই বড্ড অসময়ে এমন অসংলগ্ন চিন্তা আসতেও ধারার দেরি হলো না, আচ্ছা চাষারাও কি আজকাল ল্যাপটপ চালায়?
কোন উত্তর না পেয়ে শুদ্ধ পুনরায় বলল, ‘আপনাকে আমি কিছু জিজ্ঞাসা করছি।’
চমকে উঠে ভাবনা থেকে ফিরে এসে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে ধারা বলল, ‘আমি আমার বাবাকে খুব ভয় পাই তাই আর…!
উত্তর শুনে প্রচন্ড বিরক্ত আর রাগান্বিত শুদ্ধ বলতে লাগলো,
‘বাবার কথায় যেহেতু বিয়ে করে ফেলেছেন তাহলে বাবার কথায় নিশ্চয়ই সংসারটাও করে ফেলবেন। তাহলে এখন আমার কাছে আসায় এভাবে কুঁকড়ে যাচ্ছেন কেন?’
কথাটা বলতেই বলতেই ধারার দিকে দ্রুত এক কদম এগিয়ে যায় শুদ্ধ। পিছিয়ে যেতেও ধারা আর পিছুতে পারলো না। তার আগেই শরীরের সমস্ত ভার নিয়ে হেলে পড়ে সামনের ছেলেটার বুকে। ধারার স্পর্শ পেতেই আঁতকে উঠে শুদ্ধ। মেয়েটার গায়ে দেখি সাংঘাতিক জ্বর।
চলবে,
#হাতটা_রেখো_বাড়িয়ে
#পর্ব_১
#Writer: ইশরাত জাহান সুপ্তি