#হাতটা_রেখো_বাড়িয়ে
#পর্ব-২৯
Writer: ইশরাত জাহান সুপ্তি
ভোরের সূর্যটা আকাশের বুকে নিজেকে স্পষ্ট রূপে প্রকাশ করতেই তার এক ছটাক আলো জানালা গলিয়ে ধারার মুখ বরাবর পড়লো। আলোর আবির্ভাবে সদ্য ভেঙে যাওয়া ঘুম থেকে চোখ পিটপিট করে তাকালো ধারা। কারো লোমশ বুকে নিজের মাথাটা আবিষ্কার হতেই ধারা মাথা উঁচু করে দেখে নিলো তাকে। শুদ্ধ চোখ বন্ধ করে বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। সকালের নরম রোদে পরিস্ফুট হওয়া তার ঘুমন্ত মুখটি দেখতেই গতকাল রাতের কথা স্মরণে এনে লজ্জাবতী গাছটির মতো গুটিয়ে গেলো ধারা। ঠোঁটে লজ্জার হাসি ফুটে উঠতেই চোখ তুলে তাকাতেই পারলো না আর তার দিকে। শুদ্ধ’র ঘুম ভাঙার আগেই বিছানা ছেড়ে উঠে গেলো সে। দ্রুত পায়ে রুম ত্যাগ করে সেই সকাল আর শুদ্ধ’র সামনাসামনি হলো না। খোদেজা রান্নাঘরে বসে রুটির জন্য আটা মাখছিলো। ধারা গিয়ে সেই কাজে হাত লাগালো। বসে বসে গোল গোল রুটি বানাতে লাগলো সে। ঘুম ভাঙার পর থেকেই শুদ্ধ লক্ষ করলো ধারা তার সামনে আসছে না। আর এলেও কিছুক্ষণ পর পর হুটহাট চোখের সামনে থেকে উধাও হয়ে যাচ্ছে। তাকে খুঁজতে খুজতে শেষমেশ যখন রান্নাঘরে এসে দেখা মিললো তার, তখন শুদ্ধও একটা ব্রাশ হাতে নিয়ে দরজার সামনে বসে বসে দাঁত মাজতে লাগলো। আর আড়চোখে দেখতে লাগলো ধারাকে। ধারার গায়ে হালকা গোলাপি রঙের থ্রি পিছ। ছোট ছোট ফুল তোলা সুতি ওড়নাটা দিয়ে মাথায় ঘোমটা তুলে রুটি বানাচ্ছে সে। অর্ধ প্রকাশিত চেহারার যতটুকুই বা বের হওয়া তার সম্পুর্ণে লাজুকতার লাল আভা স্পষ্ট। খোদেজা ধারার পাশ থেকে শুদ্ধকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠল,
‘কিরে মাহতাব তুই দুয়ারে বইসা আছোস কি করতে? তাড়াতাড়ি কল থিকা মুখ ধুইয়া আয়।’
ধারা একবার আড়চোখে শুদ্ধ’র দিকে তাকায়। তার রুটি বানানো শেষ। তাই উঠে দাঁড়ায়। ঘরের ভেতর যে যাবে তার উপায় নেই। মানুষটা দরজার সামনেই বসা। খোদেজার কথার প্রতিউত্তরে শুদ্ধ ধারার দিকে তাকিয়ে বলে,
‘কলে যেতে ইচ্ছা করছে না আম্মা। আলসেমি লাগছে। কেউ যদি এক মগ পানি এনে দিতো!’
খোদেজা ধারাকে বলে, ‘বউ, কলপাড়ে বালতিতে পানি চাবানোই আছে। তুমি একটু এক মগ পানি এনে মাহতাবরে দাও তো।’
ধারা খানিক কাঁচুমাচু করে পানি আনতে যায়। শুদ্ধ মনে মনে খুশি হয়। এবার ধারা কি করে তার সামনে না এসে থাকবে তাই দেখার। কলপাড়ে গিয়ে ধারা দেখে চুমকিও মুখ ধুতে এসেছে। তার ধোয়া প্রায় শেষ৷ ধারা তাই তার হাতেই এক মগ পানি শুদ্ধ’র কাছে পাঠিয়ে দিয়ে অপর পাশ দিয়ে ঘরে চলে যায়। খোদেজার বিছানায় কিছু জামাকাপড় এলোমেলো হয়ে পড়েছিল৷ তাই ভাঁজ করে ঠিকমতো আলনায় সাজিয়ে রাখতে থাকে ধারা। শুদ্ধ ততক্ষণে মুখ ধুয়ে এসে ধারার পেছন পেছন ঘুরতে থাকে। ধারা লজ্জায় জবুথবু হয়ে দেখেও না দেখার ভান করে নিজের কাজ করতে লাগলো। শুদ্ধ পেছন পেছন বলতে থাকে,
‘কালকে রাতে কি সত্যিই তোমার মাথায় পেত্নী চেঁপেছিল নাকি! আজকে তো দেখি আবারো সেই আগের মতো লাজুকলতা হয়ে গেছে আমার বউটা। আমার দিকে কি আজকে একটুও তাকাবে না?’
ধারা কোন উত্তর দিচ্ছে না দেখে তার আরক্তিম লাজুক মুখটার দিকে তাকিয়ে শুদ্ধ মুচকি হেসে বলল,
‘বুঝলাম না আমাকে দেখে এতো লজ্জা পাওয়ার কি আছে?’
শুদ্ধ ধারার পেছন পেছন হাঁটছিল। ধারা হঠাৎ পেছনে ঘুরে তাকানোয় ধাক্কা খেতে খেতেও বেঁচে গিয়ে শুদ্ধ দুই হাত উঁচু করে অদ্ভুত ভাঁবে ভ্রু উঁচিয়ে বলল, ‘ওপস!’
ধারা শাসনের সুরে বলল, ‘তোমার আজকে কাজ নেই। যাচ্ছো না কেন?’
শুদ্ধ বিছানার উপর বসতে বসতে মেকি আফসোসের ভঙ্গিতে বলল,
‘কি কপাল আমার! অন্যের বউরা মাঝেমধ্যে তার জামাইকে আরো কাজে যেতে বারণ করে। আর আমার বউ আমাকে ঠেলেঠুলে পাঠিয়ে দেয়।’
ধারা কোমরে এক হাত রেখে দাঁড়িয়ে শুদ্ধ’র অভিনয় দেখতে লাগলো। তখন চুমকি এলো গরম গরম রুটি আর আলু ভাজির বাটি নিয়ে। শুদ্ধ’র সামনে রাখার পর শুদ্ধ খেতে শুরু করে। চুমকি তবুও ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। তাকে কিছুটা বিভ্রান্তকর দেখায়। মাথা চুলকে গভীর কোন ভাবনা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে আছে সে। শুদ্ধ রুটির টুকরো মুখে দিয়ে জিজ্ঞেস করে,
‘কিরে তোর আবার কি হলো?’
ধারাও একই প্রশ্ন করলো। বলল, ‘কি ভাবছো চুমকি?’
চুমকি ধারার দিকে তাকিয়ে উদ্গ্রীব স্বরে বলল,
‘আচ্ছা নতুন ভাবী, তোমার কখনও এমন হইছে যে তোমার মনে হচ্ছে তুমি স্বপ্ন দেখতাছো কিন্তু আসলে এতোটাই বাস্তব বলে মনে হয় যে ঐটারে স্বপ্ন বলে মনে হয় না। কিন্তু আসলে স্বপ্নই।’
শুদ্ধ খেতে খেতে বলে, ‘পাগলের মতো কি বলতাছোস এগুলা?’
চুমকি জোর গলায় বলে, ‘না ভাই সত্যি। এমনটাই লাগতাছে আমার। দেখো, কালকে রাতে আমার এমন লাগলো মনে হইলো যে রাতের বেলা ঘুম ভাইঙ্গা দেখলাম তুমি নতুন ভাবিরে কোলে কইরা বাইরে থেকে নিয়া আসতাছো। এখন বলো এটা কি সম্ভব? এতো রাতে তোমরা এমন করবা কেন?
মনে তো হয় স্বপ্নই দেখছি। কিন্তু এতো আবার স্পষ্ট লাগতাছে….
চুমকির কথা শুনে শুদ্ধ’র বিষম উঠে যায়। ধারা বিছানার খুঁটির সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। সেও পুরো সোজা হয়ে যায়। চুমকি হন্তদন্ত হয়ে বলে, ‘আরে আরে মাহতাব ভাই পানি খাও, পানি খাও!’
শুদ্ধ নিজেকে ধাতস্থ করে বলে, ‘তুই আসলেই একটা বেকুব চুমকি। কোথায় কি বলতে হয় না কিচ্ছু বুঝিস না। ঐটা স্বপ্নই ছিল। এখন যা!’
চুমকিকে আবার বিভ্রান্ত দেখায়। বিভ্রান্ত মনেই সে চলে যায়। চুমকি যেতেই শব্দ করে হেসে উঠে শুদ্ধ। ধারা শাসনের চোখে শুদ্ধ’র দিকে তাকালে শুদ্ধ হাসি থামিয়ে ইনোসেন্ট ভাব নিয়ে বলে,
‘আমার দিকে এভাবে তাকিয়ে আছো কেন? আমার কি দোষ? আমি কি এবার তোমাকে পানিতে ফেলেছিলাম? তুমি ফেলছো। তুমিই তো আমাকে পুকুরে ধাক্কা দিয়ে কিস…..
শুদ্ধকে কথা সম্পূর্ণ করতে না দিয়ে তার সামনের অর্ধেক রুটিটা দ্রুত তুলে ধারা সম্পূর্ণ শুদ্ধ’র মুখে পুরে দেয় বেলাজ ছেলেটার কথা বলার রাস্তা আটকায়। আর নিজেকে লাজুকতার অথৈ অম্বরে ডুবে যাওয়া থেকে বাঁচিয়ে চলে যায়।
__________________________________________
দুদিন বাদেই আসবে হেমন্ত। কার্তিকের অবস্থা এখন যাই যাই। মাঠ জুড়ে শুধু সোনালী ধানের ঝিলিক। পাকা ধানের সৌন্দর্যে ভরে আছে বাংলার প্রকৃতি। শালিকের উড়ন্ত পাখার সাথে ভেসে আসা খোলা হাওয়ায় দুরন্ত ধানের শিখা নজর কাড়ে। আশেপাশের কিছু ক্ষেতে ধান কাটা শুরুও হয়ে গেছে। কাটা ধান সারি সারি ভাবে বিছিয়ে রাখা। ক্ষেতে আসার পর ধারা কিছুক্ষণ ধানক্ষেতের আলের উপর দাঁড়িয়ে সেই সৌন্দর্যে চোখ মেলে তাকায়। তার পরনে একটা সাধারণ সুতি থ্রি পিছ। হাতে খাবারের স্টিলের টিফিন বাক্স। সে যাচ্ছে শুদ্ধ’র কাছে। শুদ্ধ আজকাল বড্ড বেশি ব্যস্ত থাকে। সারাদিনটা এই ক্ষেতে খামারেই কেটে যায় তার। কখনো কখনো দুপুরে বাড়িতে গিয়ে খাবারের অবকাশও হয় না। মাঝে মাঝে খোদেজা খাবার নিয়ে আসে। আজ ধারা এসেছে। শুদ্ধ’র জন্য নিজ হাতে খাবার নিয়ে আসার তার বহুদিনের শখ। ক্ষেত পেরিয়ে শুদ্ধ’র কাছে পৌঁছে ধারা দেখে শুদ্ধ কিছু লোককে সার হাতে নিয়ে কি যেন বুঝিয়ে দিচ্ছে। লোকগুলো চলে গেলে ধারা পেছন থেকে গিয়ে শুদ্ধ’র কানের কাছো ‘ভো’ করে উচ্চ শব্দ করলো। শুদ্ধ চমকালো না। পেছনে ফিরে ভ্রু উঁচিয়ে ইশারা করলো। ধারা হতাশ গলায় বলল,
‘ভয় পেলে না কেন?’
শুদ্ধ মৃদু হেসে বলল, ‘ভয় পাবো কেন? তোমার কণ্ঠ কি আমি চিনি না!’
ধারা মুখ ভার করে ঘুরিয়ে বলল, ‘একটু অবাকও তো হলে না! এই যে আমি আসলাম তোমার জন্য খাবার নিয়ে।’
শুদ্ধ ধারার হাত ধরে কাছে টেনে বলল, ‘আমার বউ আমার জন্য খাবার নিয়ে এসেছে তাতে অবাক হবো কেন? অন্য কারো বউ যদি নিয়ে আসতো তাহলে অবাক হতাম।’
ধারা শুদ্ধ’র হাতে হালকা বারি দিতেই শুদ্ধ হেসে ফেললো। ধারা শুদ্ধ’র হাত টেনে ছায়া দেখে একটা গাছের নিচে বসলো। টিফিন বক্স খুলতে খুলতে ধারা বলল, ‘অনেকগুলো পদ নিয়ে এসেছি। কোনটা দিয়ে আগে খাবে?’
‘তুমি খাইয়ে দাও। যা দিবে তাই খাবো।’
কথাটা বলেই শুদ্ধ চোখ বন্ধ করে হা করলো। ধারা ঠোঁট চেঁপে একটু হেসে টিফিন বক্স থেকে একটা কাঁচা মরিচ বের করলো। শুদ্ধ’র মুখে দিতেই কামড় দেওয়ার পর শুদ্ধ হকচকিয়ে চোখ মেলে তাকালো। ধারা মুখে হাত দিয়ে অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো। শুদ্ধ সরু চোখে তাকিয়ে বলল,
‘আচ্ছা! আমিও দেখাচ্ছি মজা।’
ধারা হুটোপুটি করে উঠে দাঁড়িয়ে শুদ্ধ’র হাত থেকে বাঁচতে সামনে দৌঁড় লাগালো। পেছনে ছুটলো শুদ্ধও। ধানের আল ধরে হাসতে হাসতে এলোপাথাড়ি দৌঁড়াতে লাগলো তারা। একসময় ধারার নাগাল পেয়ে যায় শুদ্ধ। খপ করে ধারার হাত ধরে ফেলে তাকে কোলে তুলে নেয়। ধারা ছোটার জন্য খানিক ছটফট করে আশেপাশে তাকিয়ে দেখে এই মুহুর্তে মাঠে কেউ না থাকলেও দূরে একটা বুড়ো দাদুকে চোখে পড়ছে। বুড়ো দাদুটি ওদের দিকে তাকিয়ে আবার মিটিমিটি হাসছেও। ধারা লজ্জা পেয়ে বলল, ‘প্লিজ আমাকে নামাও। ঐ বুড়ো দাদুটা দেখছে।
শুদ্ধ বলল, ‘দেখলে দেখুক। তখন এমন করলে কেন? এখন কেমন লাগে?
শুদ্ধ সহজে নামাবে না বুঝে ধারা লজ্জায় দু হাত দিয়ে মুখ ঢেকে নিলো। শুদ্ধ মুচকি হেসে ধারাকে কোলে নিয়েই একটা ঘূর্ণন দিলো।
খাওয়া শেষে শুদ্ধ বোতলের পানি দিয়ে হাত ধুয়ে নেয়। বাতাসের আবির্ভাব থাকলেও রোদের তাপ ভালোই। সামনে ধূ ধূ করা খোলা প্রান্তর। তাতে ফলানো সোনা রঙা পাকা ধান। ওরা দুজন গাছের ছায়ার নিচে সবুজ ঘাসের উপর বসা থাকলেও সূর্যের বিকিরিত রশ্মির উত্তাপ থেকে মুক্তি নেই। শুদ্ধ’র কপাল থেকে দর দর করে ঘাম ঝরতে থাকে। সকাল থেকে অনেকটা খাটনি গেছে তার। ধারা তার ওড়না দিয়ে শুদ্ধ’র মুখের ঘাম মুছে দেয়। মিষ্টি করে হাসে শুদ্ধ। ধারা জিজ্ঞেস করে,
‘আচ্ছা, তুমি যা চাইছিলে তেমনটা কি এখন হয়েছে?’
শুদ্ধ সামনের ধানের ক্ষেতে দৃষ্টি মেলে ধরে বলে,
‘উহুম! এখনও হয়নি। তবে হবে। সামনের বছর এই ক্ষেতে সোনা ফলবে ধারা।’
শুদ্ধ’র চোখে স্বপ্ন চিকচিক করে উঠে। তার প্রতিফলন ফুটে ধারার মধ্যেও।
চলবে,
[
~সুপ্তি