#হিয়ার_মাঝে
#পর্বঃ২৪+২৫
#আর্শিয়া_ইসলাম_উর্মি
৫৩,
নাতাশা আর ইহসাস একে অপরের মুখের দিকে চাওয়া চাওয়ি করছে। তাইবার জন্য যে মানুষটির আসার কথা সে এসে গিয়েছে। তাইবা তাদের থেকে একটু দূরে গিয়ে কথা বলছে। এদিকে সী-বীচের শীতল বাতাস আর মনোরম পরিবেশে থেকেও হিয়া যথেষ্ট বিরক্তবোধ করছে৷ যে এসেছে, তার সাথে পরিচয় না করিয়ে, নিজে দূরে গিয়ে কথা বলছে। আর তাদের অপেক্ষায় রেখেছে তাইবা। একদম বিরক্তিকর। রায়া নিজমনে ফোন দেখছে। রাদ তাকিয়ে আছে তাইবা আর তার সাথে কথা বলা মানুষটির দিকে। আর ইহসাসের তো মাথার উপর দিয়ে সব যাচ্ছে। এই লোকটা এখানে কি করে! নাতাশা ইহসাসের একদম কাছে দাড়িয়ে ইহসাসের পিঠে খোঁচা দেয়। ইহসাস তাকাতেই সে ফিসফিস করে বলে,
“ভাইয়া! এই বেডা এ জায়গায় কি করতে আসছে?”
“যাই করতে আসুক, তার ভালোবাসার মানুষকে নিয়ে বিদেয় হলে আমি বাঁচি।”
“সে না হয় বুঝলাম। কিন্তু বাঁচবি কেন? তোরে কি তাইবা আপু মে”রে ফেলেছে?”
“বাতাসা! মুখ টা বন্ধ রাখ বইন।”
“রাখবোনা। আগে বল তাইবা আপু বিদেয় হলে এতো খুশি কেনো তুই?”
“তোর মনে নাই কিছু? ওর নাটক দেখে দেখে মন তিক্ত হয়ে গিয়েছে ওর প্রতি। মা-বাবা, বড়ো বাবা-বড়ো মা সবাইকে এক প্রকার ঠকিয়ে চলেছে তাইবা৷”
“সবই তো মনে আছে। সেজন্যই বুঝতে পারছিনা, এই লোক এখানে কেনো?”
“এই তোমরা কি ফুসুরফাসুর করছো?”
হিয়া ইহসাস আর নাতাশাকে ফিসফিস করে কথা বলতে দেখে প্রশ্ন টা করে৷ নাতাশা বলে,
“ও কিছু না। এমনিই ভাইবোনের কথা। তুমি শুনে কি করবে?”
“আচ্ছা শুনলাম না। কিন্তু বলো তো এই লোকটা কে? তাইবা আপু দূরে দাড়িয়ে কি এতো কথা বলে চলছে?”
নাতাশা বললো,
“ওনি আমাদের হবু দুলাভাই বোধ হয়।”
“হবু দুলাভাই মানে? তাইবা আপুর সাথে না ইহসাস ভাইয়ার বিয়ের কথা?”
ইহসাস হিয়ার মুখে ভাইয়া ডাক শুনে একপ্রকার ভেতরে ভেতরে রা”গে ক্ষুব্ধ হয়ে যায়। নাতাশা তো মুখ গোমড়া করে ফেলেছে। সে চায় হিয়াকে ভাবী স্বরুপ, আর এ মেয়ে তো সোজা ভাইয়া বলে দিলো। নাতাশা চুপসে যাওয়া মুখে বলে,
“সে অনেক কাহিনী, তুমি বুঝবেনা। কিন্তু তুমি আমার ভাইকে ভাইয়া কেনো বললে?”
“তো কি বলবো? উনি তো আপুর দেবর, আমারও বড়ো। যতোই বেয়াই হোক না কেনো সম্পর্কে, তবুও ভাইয়াই তো হয়।”
নাতাশা কপালে হাত দিয়ে বলে,
“ওহ গড, মেয়ে টার মাথায় বুদ্ধি দাও।”
“কেনো নাতাশা আপু? ভাইয়া বলার সাথে বুদ্ধির কি সম্পর্ক?”
ইহসাস এতোবার ভাইয়া শব্দ টা শুনে এবার চুপ থাকতে পারলোনা। সে চি”বিয়ে চি”বিয়ে বললো,
“ভাইয়া ক্যান বি সাইয়া সাইয়া? ইউ গট ইট? আর একবার ভাইয়া ডাকলে রাঙ্গামাটি গিয়ে পাহাড়ে উঠিয়ে একদম নিচে ফে”লে দিবো?”
কথাটা বলেই ইহসাস হনহনিয়ে চলে যায় সেখান থেকে। হিয়া কোমড়ে হাত দিয়ে ভাবুক দৃষ্টিতে ইহসাসের যাওয়ার পানে তাকিয়ে নাতাশাকে বলে,
“এটা কি হলো আপু?”
“যা হওয়ার তাই হয়েছে। এবার চুপ কারো মেরি বেহেন।”
“বাঙালি মেয়ে তুমি, হিন্দি বলো কেনো?”
নাতাশা এবার হিয়ার উপর চটে যায়। চটে গিয়ে বলে,
“ঠোট দুইটা বন্ধ রাখ বইন। তোরে সবসময় ম্যাচিউর লাগে, এখন এরকম বোকার মতো কথাবার্তা আমার রাগ উঠিয়ে দিচ্ছে।”
হিয়া মিটমিটিয়ে হাসে। তার নাতাশাকে রা”গাতে বেশ লাগছে। কিন্তু রে”গে গেলে নাক দুটো ফুলছে আর চুপসে যাচ্ছে। নাতাশা মেয়েটা বেশ সুন্দর। তাকে ভাইয়ের বউ হিসেবে পেলে মন্দ হবে না। কিন্তু তার যে ভাই, তার সব ভাবনায় জল ঢেলে দেখা যাবে কোনো বিদেশীনিকে বিয়ে করে তাকেই সারপ্রাইজ করে দিবে।
৫৪
“ইহসাস চলে গেলো কেনো?”
রাদের প্রশ্নে হিয়া চমকে ঝাঁকি দিয়ে উঠে। সে ভাইয়ের বিয়ের ভাবনা নিয়ে একদম তার আশপাশ ভুলে বসেছিলো। সে কিছু বলার আগেই নাতাশা রাদের কথার উত্তরে বলে,
“এতোক্ষণ এভাবে কারেন্টের খাম।বার মতো দাড়িয়ে থাকে কে?”
“হয়তো কোনো জরুরী বিষয় নিয়ে আলোচনা করছে!”
“জরুরী বিষয় না ছাই কে জানে?”
“এভাবে বলছিস কেনো?”
“আপুকে তুমি ডাক দাও ভাইয়া।”
নাতাশা বিরক্তির সহিত কথাটা বলে। রায়া নিজের শাড়জর আঁচল হাতপর সাথে পেঁচিয়ে নিয়ে দাড়ায়। ফোনে কিছু দরকার কথা বলে নিলো সে। জীবনের মোড়টা গুছানো দরকার এবার। রাদ তাইবাকে ডেকে বলে,
“এদিকে এসো। ছেলেটা কে পরিচয় করাও। কতোক্ষণ এভাবে দাড়িয়ে থাকবো বলো তো?”
“আসছি ভাইয়া।”
তাইবা একটু জোড়ে উত্তর দেয়। তার সাথে ছেললটা রাদের মুখোমুখি জতে ভয় পাচ্ছে। সেজন্য দূরে দাড়িয়ে তাইবার সাথে আলোচনা করছিলো সে। তাইবা এবার রে”গে ছেলেটার বাহু ধরে টেনে নিয়ে আসে। রায়া এবার মুখ খুললো। সে প্রশ্ন করলো,
“এতোক্ষণ ধরে কথা বলছো, অথচ ইনি কে আমাদের না বলে দাড় করিয়ে রেখেছো! এটা কেমন ব্যবহার তাইবা?”
“স্যরি ভাবী, কিন্তু ও আসতে ভয় পাচ্ছিলো, আর আমাদেরও কিছু সমস্যা ছিলো। সেগুলো মিটিয়ে নিতে একটু সময় লাগলো।”
“যাই হোক ইনি কে?”
“আমার বয়ফ্রেন্ড।”
“মানে?”
রাদ বি’ষ্ফো’রক চাহনীতে তাকিয়ে কিছুটা চেঁচিয়ে কথাটা বলে। হিয়া তো কথা বলতেই ভুলে গেলো যেনো! যার হবু বর জেনে নিজের প্রথম ভালো লাগার অনুভূতিকে ভুলতে চেষ্টা করছে সে, তারই বয়ফ্রেন্ড বেরুলো! হচ্ছে কি এসব! হিয়া নখ কা’মড়াতে শুরু করে। কিছুই বুঝছেনা সে। নাতাশা নির্বাক, সে জানে এসব। রায়া নিরলস ভঙ্গিতে দাড়িয়ে আছে। যদিও অবাক হওয়া উচিত তার, কিন্তু সব অনুভূতিরা মৃ”ত প্রায়। তাইবা মাথা নিচু করে দাড়িয়ে আছে। পাশে দাড়িয়ে থাকা ব্যক্তিটিও নিরুত্তর ভঙ্গিতে মাথা নিচু করে দাড়িয়ে আছে৷ তাইবা উত্তর দিচ্ছে না দেখে রাদ শান্তস্বরে বলে,
“দেখো তাইবা, আমাকে বড়ো ভাই বলে মানো তো?”
“জ্বি ভাইয়া। আমার আপন বলতে তো মামা-মামীর পর আপনারাই সব৷”
“আমরা সব! তুমি বুঝতে পারছো তো তুমি কি বলছো?”
তাইবা নিরুত্তর। রাদ এবার দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,
“নাতাশা আর ইহসাস বলেছিলো আমাদের, তোমার রিলেশন আছে। তোমায় যেনো ইহসাসের সাথে বিয়ে না দেওয়া হয়। কিন্তু ওদের বাবা মা মানে আমার চাচা চাচী ওদের বিশ্বাস না করে, তোমায় ফোন করে জিগাসা করেছিলো, সব সত্য কিনা! তুমি অস্বীকার করে গিয়েছিলে। বলেছিলে ইহসাস বিয়ে ভাঙতে মিথ্যা অপবাদ দিচ্ছে তোমায়৷ কিন্তু এসব কি তাইবা?”
“আমি সত্যি এসবের জন্য মন থেকে অনুতপ্ত ভাইয়া৷ ছোটো মা যেদিন ফোন দিয়ে সত্যি টা জানতে চায়, সেদিন বলতে আমার গলা কাঁপছিলো। তখন ছোটো মা কান্না কান্না গলায় বলেছিলো, তার বেস্টফ্রেন্ডের শেষ চিহ্ন আমি, আমায় কাছে রাখতে চান৷ আমি যেনো এমন কিছু না করি, যাতে তারা কষ্ট পায়। ঐ যে বললাম আপন ভাবি, সেই ভাবনা থেকেই রাহেদ, আমার বয়ফ্রেন্ড ওর সাথে ব্রেকআপ করে ইহসাসের দিকে মন ঘোরানোর চেষ্টা করি৷ কিন্তু ইহসাস তো সত্য টা জানতো, আর নাতাশাও। কিন্তু সেই সত্যি চেপে গিয়ে ছোটো মা ছোটো বাবার কাছে ওদের মিথ্যাবাদী বানানোর দোষে ওরা আমায় সহ্যই করতে পারেনা। তবুও ছোটো মার কথা ভেবে ইহসাসের দিকে মন ঘুরিয়ে ভালোবেসে বিয়ে করতে চেষ্টা করছিলাম, আমি পারলাম না ভাইয়া৷ এই পাগল টার ভালোবাসার কাছে আমি হেরে গেলাম। ও আমার বেস্টফ্রেন্ডের ভাই রাদ ভাইয়া। ওর বোনকে মাঝে মাঝে দেখতে যেতো, সেখান থেকেই আলাপ পরিচয় অতঃপর ভালোবাসা। আর ওর বাড়ি চট্টগ্রাম জেলা সদরে। আমি চট্রগ্রাম এসেছি শুনে ওর বোনকে দিয়ে আমায় রাজী করিয়েছি দেখা যেনো করি। আর আমিও ভাবলাম, ইহসাসের মনের আঙিনায় যখন অন্য কেউ রাঙা পায়ে প্রবেশ করেছে, আমার বৃথা চেষ্টা না করাই ভালো। একজনকে ভালোবেসে, মনে জায়গা দিয়ে অন্য জনকে ভালোবাসার চেষ্টা করা বুকের মাঝে তীড়ের আ”ঘাতের মতো ভাইয়া। আমি বেশিদিন আর পারলাম না এই আ”ঘাত সহ্য করতে। আর এই পাগলকেও দেখো, এতোটাই ভালোবাসে এসব জেনেও সেই আমাকেই চায়৷”
৫৫,
তাইবা একদমে কথাগুলো বললো। রাদ এবার নির্বাক। কি বলবে ভাষা খুজে পাচ্ছে না। রায়াও নিস্তব্ধ, নিষ্প্রভ হয়ে দাড়িয়ে আছে। নাতাশা এসব জানে বলে তার কোনো অনুভূতি নেই তাইবার কথাবার্তা নিয়ে। হিয়া নখ কা”মড়ানো বাদ দিয়ে পাথরের মতো দাড়িয়ে আছে। ইহসাসের মনের আঙিনায় অন্য জন মানে! কিছুই তো মাথায় ঢুকছেনা তার৷ রাদ এবার বললো,
“সবই বুঝলাম তাইবা। কিন্তু এসব সত্য ছোটো মাকে বললে, তার কি অবস্থা হবে ভেবে দেখেছো?”
“ছোটো মাকে আমি সামলে নেবো ভাইয়া। তার ছেলেকে ভালোবাসতে পারবোনা আমি, সেও পারবেনা। শুধু শুধু দুটো জীবন নষ্ট করে লাভ আছে! যেখানে জানিই সে অন্য কাউকে ভালোবেসে ফেলছে, আর আমি তো আগে থেকেই অন্য কাউকে ভালোবাসি। পরিবারের দিকে তাকিয়ে পারলাম না ভালোবাসা ব”’লিদান দিতে। হয়তো ইহসাসের মনে অন্য কেউ না আসলে আমি হয়তো চেষ্টা করতামই। কিন্তু মনের আর শান্তি থাকতোনা। মানসিক অশান্তির বোঝা টানতে টানতে হয়তো একদিন টুপ করে ঝড়ে পরে যেতাম। তার থেকে ভালো একটু মন খুলে বাঁচি ভাইয়া। জীবনটা ছোট্ট, এই ছোট্ট জীবনকে কি দরকার এতো প্রেশারে ফেলে বেঁচে থাকতেই অন্তরাত্মা মে”রে ফেলার৷”
“এখন কি চাইছো তবে?”
“আপনারা রাঙ্গামাটি চলে যান ভাইয়া। রাহেদ তার পরিবারের সাথে আমায় পরিচয় করাবে বলে নিয়ে যেতে চায়। সেজন্য এসেছে। তাছাড়া আমার বেস্টফ্রেন্ড! সেও বাড়িতেই এসেছে।”
“কিন্তু তোমায় একা কি করে ছাড়ি তাইবা?”
“কোনো কিন্তু নয়, তাইবা যেতে চায়, যেতে দিন৷ অন্তত কারোর ভালোবাসা তো পূর্ণতা পাক।”
রায়া তাইবা আর রাদের কথার মাঝখানে কথাটা বলে। রাদ থেমে যায়। আর কোনো কথা বলেনা। হিয়ার মাথায় একটা কথাই ঘুরছে, ইহসাসের ভালোবাসা! এ মেয়েটা আবার কে! ইহসাস তো দেখায়, সে হিয়ার প্রতি দুর্বল। কিন্তু আসলেই কি তাই? ধুর এসব নিয়ে ভাবা বাদ দে হিয়া, বি কুল। এসব ভেবে মাথা নষ্ট করার দরকার নেই! কিন্তু কি করার! ভাবনা চিন্তা তো মাথায় এসে যায়। ধুর বাবা ভাল্লাগেনা।’ হিয়া নিজেই আনমনে কথাগুলো বলে নিজেকে। নাতাশা হিয়ার দিকটা খেয়াল করে হিয়ার কানে কানে বলে,
“কি হয়েছে তোমার? এমন বাদরের মতো লাফিয়ে উঠছো কেনো?”
“আপুউ!”
হিয়া অসহায় চোখে তাকায়। রাদ দোনামনা করছে। সে তাইবাকে একটা অচেনা ছেলের সাথে ছাড়বে কিভাবে! ভরসা পাচ্ছে না। রাহেদ ব্যাপারটা বুঝতে পেরে উশখুশ করে বলে উঠে,
“ভাইয়া ভরসা করতে পারেন। বাবা মাকে তাইবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে আপনারা ফিরলে আমি প্রস্তাব নিয়ে আপনাদের কাছে যাবো৷ আপনার আমার সাথে ওকে একা ছাড়তে ভয় পেলে আমার বাবা মায়ের সঙ্গে কথা বলতে পারেন। তাছাড়া আরও একটা অপশন, আপনারাও আমার সাথে যেতে পারেন। সেক্ষেত্রে আপনাদের ঘোরাঘুরি নষ্ট হবে শুধু। তাতে অবশ্য আমার সমস্যা নেই। সবাই একসাথে থেকে পরিচিত হবো, আড্ডা দেবো। ভালোই হবে৷”
রাহেদ কথাটুকু বলে হাসার চেষ্টা করে। রাদ রাহেদের কাঁধে হাত রেখে বলে,
” সমস্যা নেই ভাই, নিয়ে যেতে পারো। কিন্তু আগে রিসোর্ট থেকে আমরা চেক আউট করে আসি। চলো যাওয়া যাক৷”
তাইবা হাফ ছেড়ে বাঁচে। রাদ কি বলে না বলে ভয়ে এতোক্ষণ দম আটকে আসছিলো। এখন শান্তি লাগছে। তারা রিসোর্টের দিকে হাটা ধরে৷
৫৬
গাড়ি ড্রাইভ করছে রাদ। পাশেই রায়া বসা। পিছনে ইহসাস, নাতাশা, হিয়া বসে আছে। তাইবা রাহেদের সঙ্গে চলে গিয়েছে। তারা রিসোর্টে গিয়ে লাঞ্চ করেই বেরিয়ে এসেছে চেক আউট করে। ইহসাস নাতাশার মুখে তাইবার ব্যাপারে সব শুনেছে। তার এসব নিয়ে কোনো মাথা ব্যাথা নেই।আকাশে অন্ধকারের ছোয়া নামছে। চট্টগ্রাম মূল শহর থেকে রাঙামাটির দূরত্ব ২ঘন্টার। ওরা যেহেতু মূল শহর থেকে অনেকটা দূরে ছিলো, রাঙামাটি পৌছাতে প্রায় চারঘন্টার মতো সময় লাগবে। ঘড়িতে সময় এখন বিকেল পাঁচটা। পৌঁছাতে পৌঁছাতে সাতটা বেজে যাবে। রাদ মনোযোগ দিয়ে ড্রাইভ করছে। রাঙামাটি যাওয়ার পথ কিছু টা আঁকাবাকা, পাহাড়ি রাস্তা তো। সাবধানে ড্রাইভ না করলেই বিপদ। ওরা রাঙামাটির দোয়েল চত্বরে গিয়ে একটা হোটেল বুক করে রাত টা থেকে সকালে ঘুরতে বের হবে। এরপর ঘুরেফিরে রাতে এসে হোটেল থেকে চেক আউট করে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে চলে আসবে। এরপর রাহেদদের বাসায় বা কোনো একটা হোটেলে উঠে রাতটুকু থেকে দিনে একটু ঘোরাঘুরি, কেনাকাটা করে রাতে রওনা দিবে বাড়ির জন্য। রায়ার মন টানছেনা এতো ঘোরাঘুরি। ইচ্ছে করছে সব ছেড়েছুড়ে কোনো একদিকে পালিয়ে যেতে। রায়া ফোনের ডাটা ওন করে৷ মেসেন্জারে ঢুকতেই আবার সেই ঘোলা চোখের অধিকারী পুরুষের মেসেজ ফোনের স্কিনে ভেসে উঠে। মনের মধ্যে ধড়ফড় করছে রায়ার। সে সবার দিকে একটা বার নজর বুলায়। হিয়া আর নাতাশা একেঅপরের সাথে গল্প করতে ব্যস্ত। ইহসাস কানে ইয়ার পট গুজে গান শুনছে বোধ হয়। রায়া কাঙ্ক্ষিত মানুষটিকে কল করে। আজ এই টানাপোড়েনের ইতি ঘটানো দরকার। মনের আর বিবেকের লড়াই এ ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছে সে। ওপাশ হতে কল রিসিভ হতেই সেই ভরাট কণ্ঠের চেনা স্বর ভেসে আসে রায়ার কানে। ওপায়ের ব্যক্তিটি নিজের ভাষায় রায়াকে জিগ্যেস করেছে,
“কেমন আছো রেইন, মাই কুইন?”
“আমি তোমার কুইন নই লুইস। এটা তোমার মাথায় রাখতে হবে এখন।”
রায়াও লুইসের বোধগম্য ভাষায় উত্তর দেয়। হিয়া চমকে উঠে বোনের কন্ঠে ফরাসী ভাষা শুনে। লুইস নামটা শুনে তার হিয়ার মাঝে ধ্বক করে উঠেছে। নাতাশা হিয়ার চমকে উঠা মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। রাদ তো গাড়িটা একপাশে ব্রেক করে থামিয়ে দিয়েছে। লুইসের নামটা কানে ঝনঝনিয়ে বাজছে রাদের। তবে রায়া তার প্রাক্তন প্রেমিকের সাথে কথা বলছে। ইহসাস হঠাৎ গাড়ি থামায় ইয়ারপট কান থেকে খুলে ভাইকে জিগাসা করে,
“গাড়ি থামালে কেনো ভাইয়া?”
“এমনিই, রাস্তায় মোড় এসেছিলো। বুঝতে পারিনি।”
রাদ আমতা আমতা করে ইহসাসের কথার উত্তর দিয়ে কথাটা কাটিয়ে দেয়। রায়া নির্লিপ্ত, চারপাশের মানুষের মনে কি চলছে! সেটা দেখার সময় তার নেই। সে আপন মনে ফোনের ওপাশে থাকা মানুষের কথার উত্তর দিতে ব্যস্ত। কেউ তার কথার মানে না বুঝলেও হিয়া ঠিকই বুঝতে পারছে। নাতাশা ভাবীর মুখে হড়হড়িয়ে বলা ফ্রেঞ্চ ভাষা কিছুই বুঝতে পারছেনা। সে এ ভাষার সাথে পরিচিত, কিন্তু বুঝেনা। সে হিয়াকে প্রশ্ন করে,
“রায়া ভাবী কাকে এই ভাষায় কি বলছে হিয়া?”
“বাদ দাও আপি। রায়া আপুর পারসোনাল কথা। আমাদের আলোচনা না করাই ভালো।”
নাতাশা মাথা নাড়ায়। রাদ আবার গাড়ি চালানো শুরু করে। কিছু সময় পর রায়া কথা বলা শেষে ফোন টা কেটে দেয়। মেসেন্জার আনইন্সটল করে দেয় রায়া। রাদ সেটা আড়চোখে দেখে। মনে মনে ভেবে নেয় পরে কোনো এক সময় রায়াকে জিগাসা করা যাবে৷ হিয়া সীটে গা এলিয়ে দেয়। সব কথার মানে সে বুঝতে পেরেছে। কিন্তু স্বামীর পাশে বসে প্রাক্তনের সাথে কথা বলা! সেটা তার বোনের মতো অনুভূতি হীন পাথরের দ্বারাই সম্ভব। যতোই তার বোনের কথার মানে কেউ না বুঝলো! কিন্তু যতোদূর সে বুঝেছে, লুইস ভাইয়ার কথা তার দুলাভাইকে বলতে বাকি রাখেনি তার বোন। সে তার বোনকে ভালো মতোই চিনে, মিথ্যে দিয়ে সম্পর্কের সূচনা করার মেয়ে তার বোন নয়। সেখানে প্রতিটা কথার শেষে তার আপা লুইস নামটা উচ্চারণ করেছে। রাদের মনে বিষয়টা কতটা আ”ঘাত করেছে বিষয়টা নিয়ে চিন্তিত হয়ে পরলো হিয়া৷
৫৬,
পরদিন সকালবেলায়,
রাঙামাটির দোয়েল চত্বরে হোটেল প্রিন্সে উঠেছে রাদ-রা। হোটেলের রুমে বসে জুতার ফিতে বাধছে রাদ। সবাই ঘুরতে বের হবে একটু পর। রায়া তখন ফ্রেশ হয়ে ওয়াশরুম থেকে বের হয়। শাড়ির বদলে কাফতান পরেছে সে। লাল রঙের কাফতান, জিন্স আর গলায় ঝুলিয়ে দিয়ে লাল ওরনা। গোসল করে বের হয়েছে, চুল থেকে টপটপিয়ে পানি ঝড়ছে তার। দেখতে অপরুপ লাগছে রাদের কাছে। কিন্তু রাদ বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারলোনা। চোখ নামিয়ে নিলো। গত পরশু রাত থেকেই অপরাধ বোধে ভুগছে সে। রায়ার মনের ধারকাছে ঘেষতে পারলোনা৷ অথচ সে রায়াকে জড়িয়ে ঘুমিয়ে পরেছে। নিজের কাছে নিজেরই কেমন অপরাধবোধ হচ্ছে রাদের। রায়া ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাড়িয়ে নিজের পার্স থেকে রেডি হওয়ার সব জিনিস বের করে একটা একটা করে মুখে লাগাচ্ছে আবার ব্যাগে তুলছে। রাদ পিছন থেকে রায়ার কাছে দাড়ায়। রায়া ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় একবার রাদকে দেখে নিজের কাজে ব্যস্ত হয়। একহাতে চুড়ি অন্য হাতে ঘড়ি পরে নেয়। এরপর সব গুছিয়ে ব্যাগে তুলে রাদের দিকে ঘুরে জিগাসা করে,
“কিছু বলবেন?”
“আ’ম স্যরি রায়া।”
“ফর হোয়াট?”
“তোমাকে তোমার অনুমতি ব্যতিত জড়িয়ে ঘুমিয়ে পরেছিলাম এজন্য।”
“তাতে কি যায় আসে?”
রায়া রাদকে পাশ কা”টিয়ে হাতের ছোট্ট ব্যাগটা খাটে রেখে নিজেরও জুতার ফিতে বাধতে ধরে। রাদ রায়ার পাশে বসে। এরপর বলে,
“মন ছোয়ার আগেই শরীর হালকা ভাবে ছুয়ে ফেলেছি। এটা আমার কাছে অপরা”ধের মতোই রায়া।”
“বুঝলাম, তবে এতো স্যরি বলার কিছু হয়নি। স্বামী যখন, ছোয়ার অধিকার তো আছে।”
“আমি তেমন স্বামী হতে চাইনা রায়া, যে বউয়ের অনুমতি ছাড়া তাকে করবো! নিজের অধিকার না দেওয়া অব্দি পেতে চাইনা আমি।”
“বাদ দিন। ভালো লাগছেনা।”
“আচ্ছা, তবে একটা কথা জিগাসা করবো?”
“কি কথা?”
“লুইস মানুষটির সাথে কথা বললে তাইনা?”
“হ্যাঁ।”
রায়া উঠে দাড়ায়। তার রেডি হওয়া শেষ। রাদ নিজেও দাড়িয়ে প্রশ্ন করে,
” কি বললে?”
“চলুন যাওয়া যাক। আমার রেডি হওয়া শেষ।”
কাঁধে সাইড ব্যাগ ঝুলিয়ে দিতে দিতে কথাটা বলে রায়া। রাদ বলে,
“এড়িয়ে যাচ্ছো?”
“না, তবে সময় হলে সব জানবেন।”
“সময়টা কখন আসবে রায়া?”
“যখন আসার।”
রাদ আর কিছু বলে না। সে রায়াকে নিয়ে রুম থেকে বের হয়৷ হিয়া, নাতাশা, ইহসাস আগে থেকেই বাইরে অপেক্ষা করছিলো। রাদ আর রায়া আসতেই ইহসাস বলে,
“চলো, যাওয়া যাক।”
রাদ প্রশ্ন করে,
“কিন্তু প্রথমে যাবি কোথায়?”
“এখান থেকেই ট্রাক স্ট্যান্ড, পিছনেই নৌকার ঘাট আছে। একটা নৌকা ভাড়া করে শুভলং পাহাড়, এরপর শুভলং ঝর্ণা, ঝুলন্ত ব্রিজ, কাপ্তাই হ্রদ তো পুরোটা ঘিরেই আছে। এসব দেখেই ফিরে আসবো। পুরো দিনটাই লেগে যাবে।”
“আচ্ছা চল।”
ওরা সবাই রওনা দেয়। রাদ আর রায়া আগে আগে, নাতাশা হিয়া তাদের পিছনে, ইহসাস ওদের দুজনের পিছনে হেঁটে যাচ্ছে। হাঁটতে হাঁটতেই ইহসাস হিয়ার পাশাপাশি এসে যায়। সে হিয়ার কান ছুঁইয়ে ঠোট নাড়িয়ে বলে,
“আই লাভ ইউ বেয়াইন সাহেবা।”
ইহসাস সন্তোর্পণে কথাটা বলে ওদের পাশ কা”টিয়ে রাদের সাথে কথা বলতে ব্যস্ত হয়ে যায়। তার বলা কথাটা হিয়া ব্যতিত কেউ শুনলো না। হিয়া এটা কি শুনলো! সে হাঁটা বাদ দিয়ে রোবটের মতো দাড়িয়ে যায়। এটা কেমন প্রপোজ! নাতাশা হিয়াকে দাড়াতে দেখে বলে,
“এই মেয়ে! কি হলো তোমার? হাটা থামিয়ে দিলে কেনো?”
হিয়া স্তব্ধ, সে যেনো কথা বলতে ভুলে গেছে। ইহসাস এটা কি বলেছে তাকে! মাত্র কয়েকদিনের পরিচয়ে আদৌও ভালোবাসা হয়! হিয়া এসব ভাবনায় মশগুল হয়ে পরে৷ নাতাশা হিয়ার থেকে উত্তর না পেয়ে হিয়াকে ধরে ঝাঁকি দেয়। রায়া, রাদ, ইহসাস নাতাশার চি’ল্লিয়ে হিয়াকে ডাকাডাকির শব্দে পিছন ফিরে তাকায়। ওরা গল্প করতে করতে অনেকটা দূরে চলে গেছে নাতাশা আর হিয়াকে পিছনে ফেলে৷ ইহসাস বলে,
“তোমরা এখানেই দাড়াও, আমি দেখছি ব্যাপার টা।”
রাদ মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দেয়। ইহসাস হিয়ার সামনে দাড়াতেই হিয়া টনক নড়ে। সে ‘থ’ মে’রে দাড়িয়ে থাকতেই ঝাঁকি দিয়ে উঠে। ইহসাসের দিকে চোখ দুটো ছোটো করে তাকায়। ইহসাস তার দিকে এভাবে তাকাতে দেখে চোখ টিপ মে”রে দেয়। এরপর বলে,
” কি হলো মিস বেয়াইন সাহেবা? এভাবে রোবোটের মতো দাড়িয়ে আছেন কেনো রাস্তার মাঝে?”
ইহসাস এমন ভাবে কথাগুলো বললো, যেনো সে কিছুই জানেনা। হিয়ার রা’গে গা পিত্তি জ্ব’লে উঠলো। সে রাস্তার মাঝেই আঙুল উচিয়ে ইহসাসের দিকে তেড়ে গিয়ে বলে,
“একটু আগে কি বলে গেলেন আপনি?”
“কি বলেছি?”
নাতাশা তো কিছু বুঝতে না পেরে ওদের দেখছে। বেচারূ জানেও না তার ভাই কি করেছে!
চলবে?
ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন, গতকাল দিইনি, আমার বাবা অসুস্থ, হাসপাতালে এডমিট। এখনও ভালো নিউজ নেই। তারমাঝে ২৭০০+ ওয়ার্ড টাইপ করেছি। আর রাঙামাটির কিছু ইনফরমেশন ওগুলো একজন ভাইয়ার থেকে কালেক্ট করা। হ্যাপি রিডিং আসসালামু আলাইকুম।