হিয়ার মাঝে পর্ব – ৩১

#হিয়ার_মাঝে
#পর্বঃ৩১
#আর্শিয়া_ইসলাম_উর্মি

৬৮,
“আমি বাংলা ভাষা বুঝিনা রেইন। সেটা জানো তুমি।”

রায়ার কথার শুনে বুঝতে না পেরে কথাটা বললো লুইস। সে রায়ার পাশে রাদকে দেখে ফরাসী ভাষায় বলে,

“হেই রেইন সে কি তোমার স্বামী?”

রায়া নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করে চলছে। সে তো চেয়েছে লুইস জীবনে মুভ ওন করুক। সেজন্য সেদিন কতো কঠিন কঠিন কথা বলেছিলো। লুইসকে ভালোবাসেনা, ঘৃণা করে কতো কি! তবে আজ কেনো লুইসের পাশে অন্য নারীকে দেখে তার মনের ভেতর আবার সেই অন্তরদ’হনের সূচনা হলো! লুইসেরও বুঝি এতোটাই কষ্ট লেগেছিলো তার বিয়ের খবরে৷ রায়াকে চুপচাপ ফোনের দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে থাকতে দেখে রাদ বললো,

“আপনাকে বোধহয় কিছু জিগাসা করলেন উনি!”

রায়া ধ্যান ভাঙে রাদের কথায়। সে নিজেকে ধাতস্থ করার চেষ্টা করে। প্রতিবারে নিজেকে শক্ত খোলশে আবৃত করে রায়া আজ শক্ত থাকতে পারছেনা। চোখের জল অবাধ্য হয়ে ফোয়ারার ন্যায় বেরিয়ে আসতে চায় যেনো। রায়া তবুও নিজেকে সামলে লুইসকে তার ভাষায় বলে,

“কিছু বললে?”

“বলছি সে তোমার স্বামী?”

“হ্যা।”

“তোমাদের দারুণ মানিয়েছে।”

“থ্যাংকস।”

“আমরা হানিমুনে তোমাদের দেশে যাবো ভাবছি। ইনভাইট করবেনা?”

“সবসময়ই আসতে পারো সমস্যা নেই। শুভকামনা তোমাদের জন্য।”

লুইস মৃদু হাসলো। তার সাথে হেসে উঠলো তার ঘোলা চোখ। রায়া নিষ্পলক সেই হাসি দেখে। একসময় এই হাসি সে সরাসরি সামনে বসে ঘন্টার পর ঘন্টা দেখতো। ক্যাফেতে বসে লুইস বকবক করতো, হাসতো সে তাকিয়ে তা দেখতো। রায়ার চোখে অতীতের পাতা ভেসে উঠে। রাদের রায়ার দিকে খেয়াল নেই। সে লুইসকে দেখছে। তার স্ত্রীর প্রাক্তনকে দেখছে সে৷ সে মুখটায় বিষাদের ছায়া স্পষ্ট, হাসলেও যেনো বিষাদ ঝড়ছে সেই হাসিতে। রাদ আনমনেই ভেবে উঠে, একজনের হাসি প্রাণহীন করে দিয়ে নিজে কি হাসা যায় আদৌও! সেজন্যই হয়তো রায়া তাকে মেনে নিতে পারেনা! রায়া যখন লুইসকে দেখতে ব্যস্ত তখনই লুইস বলে,

“আমার লাইফে সবথেকে বেশি ঘৃণা আমি তোমাকেই করবো রেইন।”

রায়া চোখ বন্ধ করে কথাটা শুনে। টপটপিয়ে কয়েক ফোটা অশ্রু পরে৷ রাদ নিস্তব্ধ হয়ে দেখে। কি বলবে সে! কিছু তো বুঝেনা৷ রায়া চোখ বন্ধ করে বলে,

“ঘৃণা করো লুইস, তাতে ভালো থাকবে। বেস্ট ওফ লাক৷”

“আই হেইট ইউ রেইন।”

“প্লিজ ডোন্ট কল মি রেইন লুইস। আমার দম বন্ধ হয়ে আসে। আমি তোমার রেইন নই, তুমিও আর আমার লেমন নও। আমরা দুজন মানুষ দুজনের মনে থেকে শরীরে অন্য কারোর৷ আমাদের পথ, আমাদের ভাগ্য আলাদা হয়ে গিয়েছে লুইস।”

“একটা কথা বলবে রেইন?”

“বলো!”

“তুমি না বলতে তোমার গডের কাছে যা চাওয়া হয় মন থেকে, তোমার গড দেন। আমি তো তোমার গডের কাছে মন থেকে তোমায় চেয়েছি। আমায় দিলো না কেনো তোমায়? তোমার গড এতো নিষ্ঠুর কেনো রেইন!”

রায়া নিজেকে সামলাতে পারেনা, কান্নায় ভেঙে পরে। লুইসও ওপাশে নিজেকে সামলাতে পারছেনা। কোথাও একটা সব শেষ হয়ে যাওয়ার ঝড় বয়ে চলেছে। যেই ঝড়ে তোলপার চলছে দুটি মনে। রাদ রায়ার কাঁধে হাত রাখে। সামলানোর চেষ্টায় বলে,

“ডোন্ট ক্রাই রায়া।”

“ওকে কখনও কাঁদতে দিও না ব্রো। অনেক যত্নের মানুষ সে আমার। যত্নে রেখো।”

লুইস রাদকে খেয়াল করে কথাটা বলে। এলভিনা তখনই পিছন থেকে রায়ার উদ্দেশ্যে বলে,

“ডোন্ট ক্রাই রেইন। তুমি কাঁদলে এই মানুষটাও কষ্ট পায়৷ প্লিজ ডোন্ট ক্রাই।”

“তোমরা দুজন ভালো থেকো এভি। তুমিও জানো সে আমার কতটা প্রিয় মানুষ। তার কি আমায় কষ্ট দিতো, আর কি ভালো রাখতো। তুমি তাকে ভালো রেখো এভি। গুড বাই।”

রায়া কল টা কেটে দেয়। ফোনটা বিছানায় ছুড়ে মা’রে। কান্নায় মুষরে পরে ফ্লোরে বসে। হাটুমুড়ে মাথা দিয়ে হাউমাউ করে কাদে রায়া। রাদ রায়াকে কি বলে সামলাবে বুঝতে পারছেনা। তখনই ফোনে মেসেজ আসার শব্দ হয়। রাদ কি করবে বুঝতে পারলো না। যদি কারোর ইম্পরট্যান্ট মেসেজ হয়! এই ভেবে সে ফোন নিয়ে রায়ার সামনে বসে। এরপর রায়ার মাথায় হাত দিয়ে মৃদু স্বরে ডাকে।

৬৯,
“রায়া, এই রায়া। প্লিজ কাঁদবেন না৷ আপনি না শক্ত মনের মানুষ। এভাবে কেউ কাঁদে নাকি রায়া?”

রায়া সাড়া দেয়না রাদের ডাকে। রাদ তখন ফের বলে,

“আপনার ফোনে মেসেজ এসেছে।”

“আপনি দেখুন কে মেসেজ দিয়েছে।”

হেচকি উঠে গেছে রায়ার। ঐ অবস্থাতেই উত্তর দেয় সে। রাদ মেসেজটা ওপেন করে। লুইসের মেসেজ। কি লেখা আছে বুঝতে পারেনা। শুধু শেষেরদিকে ইংলিশে হেট ইউ লেখা দেখে রায়াকে বলে,

“লুইস সাহেব মেসেজ দিয়েছেন।”

“কি লিখেছে?”

“বুঝতে পারছিনা কি লেখা!”

রায়া দুহাতে চোখমুখ মুছে নেয়। এরপর ফোনটা হাতে নিয়ে মেসেজটা দেখে। তাতে লেখা ছিলো,

“তুমি একটা কথা বলতে রেইন! জীবনে পিছুটান রাখতে নেই৷ রেখোনা পিছুটান, তোমার স্বামী বুঝলাম অনেক ভালো একজন মানুষ। নয়তো স্ত্রীর প্রাক্তনের সাথে কথা বলতে এলাউ করতো না। দোষ তারও নেই, আমাদেরও নেই। দোষ টা আমাদের নিয়তির। ভালো থেকো তোমরা। কিন্তু আমায় ছেড়ে যাওয়ার জন্য আমি আজীবনই তোমায় ঘৃণা করবো। আই হেইট ইউ রেইন।”

রায়া কান্নায় ভেঙে পরে ফের। দফায় দফায় কান্নার দমক বাড়ছে তার। ইশ! কি যন্ত্রণা! ভালোবাসার মানুষের কাছে ঘৃণা পাওয়া! যে এই পরিস্থিতিতে পরে সেই বুঝে ঠিক কতটা কষ্ট হয়! অবশ্য তার কৃত কর্মের জন্য এটুকু তার পাওনা ছিলো। রাদ রায়ার সামনে হাটুমুড়ে বসে৷ বসে বলে,

“আমি আপনাকে একটু জড়িয়ে ধরি রায়া? আমার বুকেই না হয় আপনার চোখের জল বিসর্জন দিন!”

রাদের কথা শেষ হতে দেরি, কিন্তু রায়ার রাদের বুকে জাপ্টে পরে কাঁদতে দেরি নেই। একটা ভরসার বুক যে তার বড্ড দরকার ছিলো। রাদ রায়ার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। রায়া বিরবির করে বলে,

“আমায় একটু ভালোবাসবেন রাদ? ততোটা ভালোবাসবেন! যতোটা বাসলে একজনের ঘৃণা দুমড়ে মুচড়ে রোজ আমায় ভাঙতে না পারে! আমি হাঁপিয়ে উঠেছি জানেন! আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে!”

“কিছু কিছু মানুষের জীবনে এভাবে বুকে মাথা রেখে, ‘আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে’ কথাটা বলারও মানুষ থাকেনা রায়া। সেখানে আপনার আছে। আর সেটা সবসসময়ই থাকবে ইনশা আল্লাহ। আপনি আমায় একটা সুযোগ দিন ভালোবাসার! আই প্রমিজ, আপনার সব কষ্ট মুছতে না পারলেও নতুন করে কষ্ট আসতে দিবো না।”

রায়া উত্তর দেয়না। সে রাদের শার্ট খামচে কাঁদতে ব্যস্ত। তাদের এই দৃশ্য দেখে বোনের রুমের দরজার সামনে থেকে চলে আসে। হিয়ারও চোখে কয়েক ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পরে। ভালোবাসা এতোটা কষ্টের! যদি ইহসাসকে জীবনে না পাইতো! তাহলে তো সেও বোনের মতো কাঁদতো। কিন্তু ইহসাস এখনও তার হয়নি পুরোপুরি! যদি ইহসাস হারিয়ে যায়! তার কি অবস্থা হবে? সে তো বোনের মতো এতোটা শক্ত নয়! হিয়া নিজের ভাবনায় নিজেই অবাক হয়। কি সব ভাবছে সে! ইহসাস হারাবে কেনো! ইহসাস তো তাকে ভালোবাসে। হিয়া যখন ইহসাসকে নিয়ে ভাবতে ভাবতে বোনের রুমের সামনে থেকে ইহসাসের রুম পেরিয়ে নাতাশার রুমের দিকে যাচ্ছিলো, তখনই ইহসাস সবে গোসল সেরে বের হয়েছে। হিয়াকে এতো ভাবুক দৃষ্টিতে রুমের দিকে যেতে দেখে সে টিশার্ট গায়ে দিতে দিতে হিয়ার পিছু পিছু আসে। হিয়া তার রুম পেরিয়ে চলে গেছে। সে হনহনিয়ে হেঁটে হিয়ার সামনে এসে দাড়ায়। হিয়া এতোটাই চিন্তার মাঝে ডুবে ছিলো ইহসাসকে সে খেয়াল করেনি। ইহসাস সামনে দাড়াতেই হিয়া চমকে ঝাঁকি দিয়ে উঠে। ভয় পায় একটু। ইহসাস হিয়াকে ভয় পেতে দেখে মিটমিটিয়ে হাসছে। ইহসাসকে হিয়া ধ’মকে বলে,

“আপনি হুট করে এভাবে সামনে আসলেন কেনো? মানুষ ভয় পায়না নাকি!”

“বাবাহ, হিয়া ম্যাম আবার ভয়ও পায়!”

“না আমি তো এলিয়েন! ভয় পাবো কেনো?”

“এলিয়েন কেনো হবেন হিয়া ম্যাম! আপনি তো আমার হিয়া। যে আমার সবটা জুড়ে বিরাজ করছে।”

ইহসাস মায়ামোহ কন্ঠে কথাটা বলে। হিয়া লজ্জায় মাথা নিচু করে নেয়। সে ইহসাস কে পাশ কা”টিয়ে চলে যায় মুচকি হেসে। ইহসাস নিজের চুলে হাত বুলিয়ে নিজের রুমের দিকে যেতে ধরে। তখনই জাহিদুল ইসলাম হাঁকডাক করে বাড়ির সবাইকে ডাকে। ড্রইং রুমে জড়ো হতে বলে। উনার ডাকে পরিবারের সকলে ড্রইং রুমে হাজির হয়। ফারহাদ-আনিকা, রাদ-রায়া, রুবেল সাহেব-মিসেস কল্পনা একপাশে সার হয়ে দাড়িয়ে আছে। একে অপরের মুখ চাওয়া চাওয়ি করছে ওরা। জাহিদুল সাহেব সোফায় বসে আছেন। তার পাশে মিসেস সেলিনা কিচেন থেকে এসে বসলেন। হিয়া আর ইহসাস তখনও আসেনি। মিসেস সেলিনা ধৈর্য হারা হয়ে বললেন,

“ষাড়ের মতো চেচিয়ে সবাইকে জড়ো করলে! কই কি বলবে! বলো?”

“বলবো, বলবো। আগে হিয়া আর ইহসাস আসল মানুষ দুটোকে আসতে দাও। ”

বললেন জাহিদুল সাহেব৷ তখনই ইহসাস সিড়ি বেয়ে নামলো, তার পিছনে হিয়া। ওরা আসতেই মিসেস কল্পনা বলেন,

“ঐ তো ওরা এসে গেছে।”

জাহিদুল সাহেব সহ বাকিরাও ওদের দেখলো। জাহিদুল সাহেব বললেন,

“তোমরা দুজন এসে আমার পাশে বসো।”

হিয়া আর ইহসাস একে অপরকে এক ঝলক দেখে হিয়া মিসেস সেলিনা পাশে আর ইহসাস তার বড় বাবার পাশে বসলো। জাহিদুল সাহেব ইহসাসের হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বললেন,

“হিয়ার বাবার সাথে কথা বলেছি। সেটাই আলোচনা করতে তোমাদের ডাকা।”

ইহসাসের বুকের মাঝে দুরুদুরু করে উঠলো! কি এমন বলেছেন শাহীন সাহেব যে জাহিদুল সাহেব সবাইকে জড়ো করে আলোচনা করতে বসলেন! রায়ার মনে চিন্তারা উকি দেয়! তার বাবার তো স্বভাব ভালোবাসা মানতে পারেন না৷ হিয়ার তো চিন্তায় গা মাথা ঘুরে উঠছে! না জানি কি বলেছে তার বাবা। ফারহাদ চিন্তিত মুখে বলে,

“তাওই সাহেব কি বলেছে বাবা?”

“শাহীন বলেছে আগে হিয়ার গ্রাজুয়েট কমপ্লিট করতে হবে! আপাতত শুধু আংটি বদল করে রাখবে। তিনবছর পর হিয়া কানাডা থেকে ফিরলে বিয়ে। আপাতত ওরা আসবেনা। আমাদেরই সব করতে বলেছে!

জাহিদুল সাহেবের মুখে কথাটা শুনে সবাই সস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। যাক মেনে নিয়েছেন উনি। শুধু সস্তি নেই ইহসাসের। সে আহত মনে বলে,

” বড়ো বাবা! সময়টা কমানো যায়না! তিন তিনটা বছর! কম না। হিয়াকে দূরে থাকতে দিবো কিভাবে?”

হিয়া বড়োদের মাঝে লজ্জাহীনের মতো এমন কথা শুনে মাথা নিচু করে নেয়। ঠোটে কাম’ড় দেয়। এই ছেলে মানসম্মান কিছু রাখলোনা। মিটমিট করে হাসছে সবাই৷ এই ছেলের বুদ্ধি কবে হবে! বারবার লজ্জায় ফেলে তাকে! রায়া ইহসাসের কথার উত্তরে বলে,

“দেখতে দেখতে সময় পেরিয়ে যাবে। ভাগ্য ভালো মেনে নিয়েছে বাবা। এটা নিয়েই খুশি থাকো ইহসাস ভাইয়া।”

চলবে?

ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন৷ আসসালামু আলাইকুম

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here