#হৃদয়জুড়ে_প্রেয়সীর_আভাস
#পর্ব_১৪
#মোহনা_হক
স্টেজে বসা লোকটির দিকে অপলক ভাবে তাকিয়ে রুয়াত। হঠাৎ কিভাবে যেনো এই বিরক্তিকর লোককে ভালোবেসে ফেলে তার জানা নেই। রুয়াতের এহেন চাহনি দেখে নিমি না হেসে পারলো না। হুঁশ ফিরে আসে রুয়াতের। চোখ মুখ কুচকে তাকায় নিমির দিকে।
-‘এভাবে অহেতুক কারণে হেসে বেড়াচ্ছিস কেনো?’
হাসি বন্ধ হয়ে গেলো নিমির।
-‘তুই যে ওনার প্রেমে পড়ে পাগল হয়েছিস সে খেয়াল আছে কি?’
বিরক্ত হয়ে রুয়াত বলে-
-‘বাদ দে না। আমারটা আমি বুঝবো। আর এসব বিষয় নিয়ে একটা কথাও শুনতে চাই না নিমি।’
চুপ হয়ে রইলো নিমি। রুয়াতের কথা মতোন আর কথা বাড়াতে চাইলো না। দু’জনের দৃষ্টি সামনের দিকে। অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করলো সে মেয়েগুলো। এক পর্যায়ে আয়াজ কে বলা হলো পরিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে কিছু বলতে। আয়াজ অনেক কথা বললো পরিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে। কলেজের অনেক স্যার মিলে আয়াজ কে কিছু উপহার দেয়। হাসিমুখে গ্রহণ করে সবকিছু। আজ আয়াজ তার সাথে বডিগার্ড ও এনেছে সাথে করে। এতো মানুষের ভিড়ে থাকবে কখন কি হয়ে যায় বলা তো যায় না। ইকরামুল কে ও বলা হয়েছে। আজ অনেক নেতারাই এখানে উপস্থিত রয়েছে। সবার সাথে আয়াজের ভালো সম্পর্ক থাকলেও বরাবরের মতোই ইকরামুল আর আয়াজের সম্পর্কের কোনো রকম উন্নতি নেই। পাশাপাশি বসে আছে দু’জন। ইকরামুল সবার সামনে আয়াজ কে ছোট করেছে আজ। সে অনেক আগেই এখানে এসেছিলো। যখন এমপির আগমন ঘটে বা স্টেজে ওঠে তখন ইকরামুল তার জায়গায় বসে ছিলো। আয়াজ স্টেজে ওঠার সময় সকলে দাঁড়িয়ে সম্মান প্রদর্শন করেছে কিন্তু ইকরামুল বসেছিলো যা সবার কাছেই দৃষ্টিকটু লেগেছে। সবাই আয়াজের সাথে কথা বলার জন্য প্রায় অধীর আগ্রহে বসেছিলো আর সেখানে পাশে একজন এমপি বসে থাকার পর ও কোনো হেলদোল নেই ইকরামুলের।
আয়াজ সেসব কথা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে তার প্রেয়সীর দিকে তাকিয়ে আছে। এতো মানুষের ভিড়ে বোঝার উপায় নেই যে আয়াজ কার দিকে তাকিয়ে আছে। প্রেয়সীর যেনো আজ নতুন রূপের সুচনা হয়েছে। মায়াময়ীরূপ জন্মেছে। অধর প্রসারিত হলো আয়াজের। শুধুমাত্র নিজের পেশার কাছে হেরে গিয়ে আজ রুয়াতের পাশে বসার সুযোগটুকু হলো না। মানুষ তাকে নিয়ে নানান কথা রটাবে। চরিত্রহীন ভাববে তাকে। দু’দিন রুয়াতের সাথে কথা বলতে না পেরে তার হৃদয়টুকু আবার অশান্ত হয়ে ওঠেছে। নজর সরিয়ে আয়াজ অনুষ্ঠানে মনোযোগ দিলো।
সাহেদ এগিয়ে এসে আয়াজের কানে বলে-
-‘স্যার ইকরামুল কার সাথে কথা বলার জন্য ওঠে গিয়েছে। ও আজ আপনাকে অসম্মান করেছে এবারও চুপ করে থাকবেন স্যার?’
ইকরামুলের ব্যবহারের কথা স্মরণ করতেই চোয়াল শক্ত হয়ে এলো আয়াজের। শুধুমাত্র এটা একটা অনুষ্ঠান দেখে কোনো রকম সিনক্রিয়েট না করে মানবতার খাতিরে বসে আছে। যদি আয়াজ সেরকম কিছু করতো তাহলে যুদ্ধের ময়দান বেঁধে যেতো এখানে।
-‘সাহেদ শান্ত থাকো। এভাবে হুটহাট মাথা গরম করলে চলবে না। ওর করা প্রত্যেকটা অপমানের হিসেব তুলবো।’
সাহেদের শরীর রাগে রীতিমতো যেনো ফেঁটে যাওয়ার উপক্রম। কোনোমতেই সে আয়াজের অসম্মান হোক সেটা চায় না। সাহেদ সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো আয়াজের পিছন বরাবর। ইকরামুল এখানে নেই কেউ কল দিয়েছে তাই কথা বলার জন্য ওঠে গিয়েছে। এই ফাঁকে আয়াজ একজন কে বলে দিয়েছে ইকরামুলের যতো দোকান আছে সবগুলো যেনো বন্ধ করে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। বেশ কিছু প্রমাণ তার হাতে এসেছে শুধু অনুষ্ঠান শেষ হবার পালা। এরপর আয়াজ বুঝিয়ে দিবে ইকরামুলের জায়গা আসলে ঠিক কোঁথায় হওয়া দরকার।
.
অনুষ্ঠান প্রায় শেষের দিকে। সবার মন্তব্য শেষ হয়ে গিয়েছে। আধঘন্টা পর অনুষ্ঠানের পরিসমাপ্তি ঘটে। এর মাঝ থেকে ইকরামুল আগেই বিদায় নেয় তার সব দোকান বন্ধ হয়ে গিয়েছে শুনে মাথা ঠিক ছিলো না। আশেপাশের দোকানের মালিকেরা খবর দিয়েছে পুলিশ এসে নাকি দোকানগুলো বন্ধ করে দিয়েছে।এমন খবর শুনে ইকরামুল চলে যায়।
অনুষ্ঠান শেষে যে যার মতো বাসায় চলে যায়। রুয়াত নিমি কে আটকে রেখেছে শুধু আয়াজের সাথে কথা বলার জন্য। কিন্তু এতো ছেলেরা তাকে ঘিরে আছে যার কারণে সাহস পাচ্ছেনা। এক সময় নিমি চলে যায় ওর ভাইয়া কল দিয়েছিলো। অনেক্ক্ষণ যাবত আয়াজ দূর থেকে খেয়াল করেছে রুয়াত ঠায় দাঁড়িয়ে আছে মাঠের মধ্যে। যেখানে মানুষের সমাগম খুবই কম। প্রায় বেশিরভাগ মেয়েরা চলে গিয়েছে। আরও কিছু কিছু রয়েছে যারা কেউ কেউ ছবি তুলছে, এক জায়গায় বসে কথা বলছে। কিন্তু রুয়াতের সাথে কেউই নেই। আর না রুয়াত বসে কারও জন্য অপেক্ষা করছে। এই জায়গা বর্তমানে তার প্রেয়সীর জন্য নিরাপদ নয়। আয়াজ হেডস্যারের লাইব্রেরী থেকে রুয়াত কে দেখেই যাচ্ছে।
সাহেদ কে ডাক দিয়ে বললো-
-‘তোমার ম্যাডাম কে বলো বাসায় চলে যেতে।’
আয়াজের কথামতো সাহেদ রুয়াতের কাছে গেলো। সাহেদ কে আসতে রুয়াত অবাক হয়। হঠাৎ আয়াজের সাথের লোক কেনো রুয়াতের দিকে আসছে? সাহেদ ভদ্রতা বজায় রেখে প্রথমে রুয়াত কে সালাম দিলো।
-‘আসসালামু আলাইকুম ম্যাডাম। স্যার আপনাকে বলেছে বাসায় চলে যেতে।’
জিহ্বা দ্বারা অধর ভেজালো মেয়েটা। যার জন্য বসে অপেক্ষা করছে সে এখন বলছে বাসায় চলে যেতে।
-‘আপনার স্যারের কাজ শেষ হবে কখন? তিনি কখন বাসায় যাবেন?’
সাহেদ সৌজন্যবোধক হাসি দিয়ে বললো-‘
-‘ম্যাডাম স্যারের কাজ শেষ হতে সময় লাগবে। এখানের কাজ শেষ হলে আবার অন্য কোথাও যাবেন। স্যারের আজ গুরুত্বপূর্ণ মিটিং আছে ম্যাডাম।’
রুয়াত ছোট্ট করে উত্তর দিলো।
-‘ওহ্।’
তৎক্ষনাত কল আসে সাহেদের মোবাইলে। পকেট থেকে মোবাইল বের করে দেখে আয়াজ কল দিয়েছে। তড়িঘড়ি করে কল রিসিভ করে সাহেদ। রিসিভ করতেই আয়াজের কন্ঠস্বর ভেসে ওঠে।
-‘তোমার ম্যাডাম কে রিকশায় তুলে দিয়ে এখানে আসো।’
-‘জ্বী স্যার।’
কল কেটে দেওয়ার পর সাহেদ মোবাইল আবার পকেটে ঢুকাতে ঢুকাতে বলে-
-‘ম্যাডাম স্যার বলেছে আপনাকে রিকশায় তুলে দিতে। এরপর আমায় যেতে হবে স্যারের কাছে। চলুন ম্যাডাম আপনাকে রিকশায় তুলে দিয়ে আসি।’
চারপাশে তাকালো রুয়াত। কিছু ছেলে মেয়েরাও চলে গিয়েছে যারা এতক্ষণ এখানে ছিলো। কোনো মেয়েরা নেই। যা আছে সব ছেলেরা যারা আয়াজের কাছে। রুয়াত আর থাকতে চাচ্ছে না এখানে।
-‘ভাইয়া আমি চলে যেতে পারবো। আপনার আসার দরকার নেই। ‘
-‘না না ম্যাডাম। চলুন আমিই দিয়ে আসি আপনাকে।’
রুয়াত আর মানা করলো না। সাহেদ রুয়াত কে রিকশায় তুলে দেয়। বাসায় চলে আসে সে। আজও সেই মানুষটার সাথে কথা হলো না। ভালো লাগছে না তার। বাসায় এসেই দেখে জাফরি দৌড় দিচ্ছে একা একা। রুয়াত কে দেখেই স্থির হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু সে কি শান্তশিষ্ট মেয়ে স্থির হয়ে দাঁড়িয়েই থাকবে? রুয়াত কে দেখেই একদম দৌড়ে ঝাপিয়ে পড়ে তার কোলে। শাড়ি উল্টো পাল্টা হয়ে গেলো তার। একটু আধটু গলার স্বর কঠিন করে বললো-
-‘জাফরি তুমি বড় হয়েছো না? আর এভাবে দৌড়ে আসবে না কারও কোলে। কেউ বাহির থেকে আসলে তার শরীরে ময়লা থাকে সে ফ্রেশ হওয়ার পর তারপর তুমি তার কোলে উঠবে। ঠিক আছে?’
ছোট অবুঝ মেয়েটা মাথা নাড়লো তার মিম্মিমের কথায়। রুয়াতের কন্ঠস্বর শুনে ইনিমা তার রুম থেকে বেরিয়ে আসে। দিনকে দিন তার শরীর ও একদম দূর্বল হয়ে যাচ্ছে। তাই বেশি একটা রুম থেকে বের হয় না সে।
ইনিমা হেসে বলে-
-‘আমার মেয়ে হলেও মিম্মিমের মতো নম্র, ভদ্র হয়েছে।’
রুয়াত মৃদু হাসলো বোনের কথায়। জাফরি কে কোল থেকে নামিয়ে উপরে চলে যায়। দীর্ঘ কয়েক ঘন্টা শাড়ি পড়ে প্রায় অধৈর্য্য হয়ে গিয়েছে। ফ্রেশ হয়ে একটা কম্ফোর্ট ড্রেস পড়ে নেয়। সারাদিনের ক্লান্তিতে এক সময়ে ঘুম এসে পড়ে রুয়াতের।
(*)
আজ যে গুরুত্বপূর্ণ মিটিং ছিলো সেটা ক্যান্সেল করা হয়েছে। ইকরামুলের দোকানের সামনে মেয়র আরও অন্যান্য অনেক নেতা এসে ভির জমিয়েছে। পুলিশের সাথে ক্রমাগত তর্ক করে যাচ্ছে ইকরামুল। আয়াজ কে খবর দেওয়া হয়েছিলো কিন্তু সে এখনো এসে উপস্থিত হয়নি। আয়াজ নিজেও জানে সে এখানে না এলে কক্ষনো কেউ সমাধান করতে পারবে না তাই একটু ভাবসাব নিয়ে নিজের অফিসে বসে আছে। এদিকে ইকরামুলের মাথা প্রায় পাগল হয়ে গিয়েছে। পুলিশ কোনোমতেই তার দোকানগুলো ছাড়ছে না। এমনকি দোকানের ভিতরেও প্রবেশ করতে দিচ্ছে না। এক প্রকার না পেরে আয়াজ কে অনুরোধ করে এখানে আসার জন্য। ইকরামুলের অনুরোধের কথা শুনে বিদ্রুপ হাসি দেয়। যে মুভির মজা নেই সে মুভি কখনো আয়াজের ভালো লাগে না। গাড়ি, গার্ড আর তার দলের কিছু লোক নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখে সবাই প্রায় একদম জোট পাকিয়ে আছে। আয়াজের প্ল্যান মতোই সব এগুচ্ছে। ধীর পায়ে আগায় সেখানে। আয়াজ আগেই পুলিশ প্রশাসকের সাথে বৈঠক করে। সব জানায় প্রমাণ ও দেখায়। আর পুলিশ প্রশাসককে বলা হয়েছে যেনো আয়াজ সেখানে উপস্থিত হলেই যেনো সব ঘটনা মানুষ কে জানাবে। তারাও সেরকম কাজ করেছে। কিন্তু কারণের ভিত্তিতে চার মাস ইকরামুলের দোকাল টোটালি বন্ধ রাখার ঘোষণা জানায়।
মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে ইকরামুল। অনেকে ইকরামুল কে বুঝিয়েছে। কিন্তু তার মাথা ঠিক নেই সব কিছুর জন্য মনে মনে আয়াজ কে দোষারোপ করছে। সবাই চলে গেলো। আয়াজ আর সাহেদ থেকে গেলো সেখানে। ইকরামুলের কাঁধে হাত দিয়ে বললো-
-‘তোমাকে আমি বুঝিয়েছিলাম ইকরামুল কিন্তু তুমি বুঝোনি। এসব অনৈতিক কাজ করলে চলে বলো?’
রক্তিম চোখে তাকায় ইকরামুল আয়াজের দিকে। এ যেনো কাঁটা গায়ে নুনের ছিঁটা। পিছনে দাঁড়ানো সাহেদ পৈশাচিক আনন্দ পাচ্ছে। কাঁধ থেকে ঝাড়া দিয়ে হাত সরিয়ে দিলো আয়াজের।
-‘সব কিছুর পিছনে আপনি ছিলেন তাইনা!’
হাসে আয়াজ।
-‘তোমার কি আমাকে আজাইরা থাকার মানুষ মনেহয় ইকরামুল?’
ইকরামুল কটমট করে তাকায় আয়াজের দিকে।
-‘যারা আমাকে আজ এমন দুদর্শা পরিস্থিতিতে এনেছে তাদের কাউকে ছাড় দিবো না আমি।’
আয়াজ হাসতে হাসতে চলে আসলো। এটা তো কিছুই না আরও কত কাহিনী বাকি আছে। আয়াজ সেখান থেকে চলে আসলো। এখনো তার কাজ শেষ হয়নি আরও অনেক কাজ বাকি আছে। সে কাজের উদ্দেশ্যে রওনা দিলো অন্য জায়গায়।
ইকরামুল ফোন করে জানিয়ে দিলো যেভাবেই হোক আজ যেনো আয়াজ কোনো মতেই বাড়ি ফিরতে দেওয়া না হয়। ইকরামুলের দলের লোকেরা তাকে বোঝালো আয়াজের সাথে এখন কিছু করলে তারা ফেঁসে যাবে। কিন্তু প্রতিশোধের তাড়নায় পাগল ইকরামুল। তাদের কথা মানতে রাজি হলো না। আর তারা ইকরামুলের জন্য বাধ্য হয়েই কথাটি মানতে রাজি হলো।
(*)
সন্ধ্যায় পড়ার টেবিলে বসে পড়ছে রুয়াত। তার রুমেই ইনিমা আর জাফরি মায়া চৌধুরীর সাথে কথা বলছে। হঠাৎ আরহামের কল আসায় মায়া চৌধুরীর কল কেটে দেয় ইনিমা। কল রিসিভ করতেই আরহাম ভাঙা গলায় কিছু একটা বললো। যা শুনে রীতিমতো ইনিমার শরীর কাঁপছে। রুয়াত কে ডাক দিলো। রুয়াত ইনিমার এমন কান্ডে ছুঁটে এলো বোনের কাছে। ইনিমার গালের দু’পাশে হাত রেখে জানতে চাইলো কি হয়েছে। কিন্তু সে নিশ্চুপ। অনেক জিগ্যেস করার পর ইনিমা বললো-‘
-‘আয়াজের এক্সিডেন্ট হয়েছে।’
#চলবে…#হৃদয়জুড়ে_প্রেয়সীর_আভাস
#পর্ব_১৫
#মোহনা_হক
স্তব্ধ রুয়াত। আয়াজের সাথে ঘটে যাওয়া এমন ঘটনা শুনে যেনো তার শরীর কেঁপে উঠে। চোখ দিয়ে অনবরত পানি পড়ছে। তার শরীরের প্রবাহিত রক্ত যেনো হঠাৎ করে থেমে যায়। ইনিমা তড়িঘড়ি করে জড়িয়ে ধরে বোন কে।
-‘রুয়াত নিজেকে শান্ত রাখ। এমন করলে চলবে না।’
ইনিমা মেহরুবা কে ডাকে। আরহাম বলেছে মায়া চৌধুরী কে নিয়ে যেনো তারা তাড়াতাড়ি হসপিটালে পৌঁছায়। সবাই হসপিটালে পৌঁছায়। মাঝ পথ থেকে মায়া চৌধুরী কে নিয়ে যায়। রুয়াত সারাক্ষণ গাড়িতে বসে কেঁদেছে। সবাই এতো বার করে বলেছে কাঁদতে না। তাও আয়াজের এমন ঘটনা শুনে নিজেকে সামলাতে পারেনি। ভীষণ খারাপ লাগছে তার। মেহরুবা তার মেয়ে কে অনেক বোঝায়। নাহ্ কোনো লাভ হলো না মেয়ের কান্না বন্ধ হচ্ছে না। রুয়াতের এরকম আচরণে সবাই কিছুটা অবাক হয়। শুধুমাত্র এমন প্রতিকূল মুহূর্তে এসব নিয়ে এতো বেশি মাথা ঘামায় নি।
মায়া চৌধুরী এসেই ছুটেছে ছেলের কাছে। আয়াজের এমন হয়েছে শুনে তার হৃদয় যেনো কাতর হয়ে আছে। চোখের শান্তি মিটাবার জন্যে তিনি ছুটলেন ছেলের কাছে। আয়াজ খুব কম জায়গায় ব্যাথা পেয়েছে। আবার যে জায়গাগুলো তে পেয়েছে সেগুলো একদম অনেক ক্ষত হয়েছে। ডাক্তার সব চেকাপ করার কিছু মেডিসিন লিখে দেয়৷ এগুলো খেলে ঠিক হয়ে যাবে। আজকের দিন হসপিটালে থেকে কাল বাসায় চলে যাবে। মূলত আরহাম আজ বাসায় নিতে দিবে না। তাই বাধ্য হয়েই আয়াজের এখানে থাকতে হচ্ছে।
মায়া চৌধুরী কাঁদছেন ছেলে কে বুকে জড়িয়ে। আয়াজ আর আরহাম অনেক বুঝিয়েছে তাকে। কিন্তু তার মনের ভয় সংকট কোনোটিই দূর হচ্ছে না। আজ যদি তার আদরের ছোট ছেলের কিছু হয়ে যেতো নিজেকে কিভাবে ক্ষমা করতেন তিনি? মায়া চৌধুরী কখনো চায়নি ছেলে রাজনীতি করুক। এই অবাধ্য ছেলে আর কার কথা শুনে? পরিবারের বিরুদ্ধে গিয়েই রাজনীতিতে যোগ দেয়। প্রথমে মায়া চৌধুরী আর ফজলুল চৌধুরী মত না দিলেও পরবর্তী সময়ে তারাও রাজি হয়েছেন।
আয়াজ তার মায়ের মাথায় হাত বুলাচ্ছে।
-‘মা আমার তেমন কিছু হয়নি তো। তুমি এতো কেঁদো না। কয়েকদিন যেতেই দেখবে আমি ঠিক হয়ে গিয়েছি একদম।’
মন মানছে না মায়া চৌধুরীর। আরহাম এসে তার মায়ের হাত ধরে বলে-
-‘আয়াজ ঠিক হয়ে যাবে। এখন বাহিরে চলো। সবার তো দেখা করা লাগবে।’
মায়া চৌধুরী ছেলে কে ছেড়ে যেতে চাচ্ছিলেন না। আরহাম জোর করে বাহিরে নিয়ে আসে। এক এক করে ফজলুল চৌধুরী, মেহরুবা, হান্নান মজুমদার দেখা করে আসে। একসাথে এক জনের বেশি মানুষ দেখা করতে পারে না। হাসপাতালের কতৃপক্ষের নিষেধ রয়েছে। বাকি রইলো ইনিমা আর রুয়াত। আরহাম তাদের সামনে এসে বলে-
-‘এখন কে আগে যাবে বলো? দু’জনেই আমার খুব কাছের মানুষ।’
ইনিমা রুয়াত কে বলে-
-‘তুই আগে যা রুয়াত।’
রুয়াত মাথা নাড়িয়ে বললো-‘
-‘তুমি দেখা করে আসো।’
গলার অবস্থা বারোটা বেজে গিয়েছে রুয়াতের। আজ ঘামে গরমে রৌদের মধ্যে থেকে ঠান্ডা লেগেছে। তার
উপর আয়াজের জন্য কেঁদেছে কতক্ষণ। সারাটা পথ রুয়াত কেঁদে কাটিয়েছে। ইনিমা টিস্যু দিয়েছিলো সেটা পুরোপুরি ভিজিয়ে ফেলেছে। এখন কাঁদলে শুধু ওড়নায় চোখ মুখ মুছে। ইনিমাই আগে দেখা করতে যায় আয়াজের কাছে।
আয়াজ বেডে শুয়ে আছে। পিঠ ধরে গিয়েছে তার। এভাবে শুয়ে থাকা যায় নাকি?
-‘কেমন আছেন দেবর সাহেব?’
ইনিমার কন্ঠস্বর শুনেই আয়াজ তাকায় সেদিকটায়। সোজাসাপ্টা বলে-
-‘এইতো ভালো আছি।’
ইনিমা আয়াজের সামনে গিয়ে বলে-
-‘কোন কোন জায়গায় লেগেছে? এখন ও ব্যাথা আছে?’
-‘তেমন লাগেনি। মেডিসিন দিয়েছে এখন ব্যাথা একটু কম।’
ইনিমা হেসে বলে-
-‘তোমার চিন্তায় একজন চেহেরাটা কি বানিয়েছে সামনে থেকে দেখলে বুঝবে। আসার সময় সারা পথ শুধু কেঁদেছে।’
আয়াজ ভ্রু কুচকে ফেলে। শুধু রুয়াত ছাড়া আর কেউ নেই যে এখনো তার সাথে দেখা করেনি। তাই সর্ব প্রথম তার প্রেয়সীর কথাটিই মনে পড়ে।
-‘এসেছে?’
-‘হুম।’
ইনিমা আরও কিছুক্ষণ কথা বলে আয়াজের সঙ্গে। ইনিমার আসতে দেরি হচ্ছে দেখে রুয়াত ওয়াশরুম থেকে মুখে পানি দিয়ে আসে। খুব বাজে লাগছিলো তাকে। ইনিমা বের হয়ে আসে। এবার রুয়াত যাবে। হাত পা কাঁপছে। বুক ধুকপুক শুরু করেছে। আয়াজ কে একদম পুরোপুরি মন থেকে মেনে নেওয়ার পর এই প্রথম তার সাথে দেখা করবে। মনের ভিতর কেমন ভয় লাগা শুরু হয়েছে। না জানি আয়াজ কি বলবে। সে নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছে। আরহাম নিয়ে যায় রুয়াত কে। কেবিনে রুয়াত কে দিয়ে আসার পর সে চলে আসে। আয়াজ বেডের পিছন দিক বালিশ দিয়ে এখন হেলান দিয়ে বসে আছে। দু হাত বুকে গুঁজে আছে। কেবিনে ঢুকে রুয়াতের আর সাহস হয়নি সামনে এগোনোর। পা যেনো চলছে না। আয়াজ ক্রমাগত দেখেই চলছে রুয়াতের কর্মকান্ড।
-‘দূর থেকে আমাকে দেখা শেষ হলে এবার কাছে এসো। আমার তোমাকে দেখা শেষ হয়নি এখনো।’
রুয়াত মাথা তুলে তাকায় আয়াজের দিকে। আবার তৎক্ষনাত চোখ সরিয়ে ফেলে। কিন্তু আয়াজ কে কিভাবে বোঝাবে তার ভয় করছে সে সামনে এগুতে পারছে না। রুয়াত আসছে না দেখে একটু ধমক দিয়ে বলে-
-‘আসবে তুমি? নাকি আমি উঠে আসবো বলো।’
আরহাম তখন বাহিরে দাঁড়িয়ে বলেছিলো আয়াজ পায়ে ব্যাথা পেয়েছে বেশি। আর রুয়াত কখনোই চায় না তার জন্য আয়াজের কিছু হোক। তাই দ্রুত পায়ে আয়াজের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। আয়াজ একটু সরে হাত ধরে রুয়াতের। টান দিয়ে বসায়। বসতে বললেও বসবে না। তাই ইচ্ছে করেই এমন করেছে।
-‘এতো কাঁদার কি আছে? এমন মনে হচ্ছে আমি মরে গিয়েছি তার জন্য এমন ভাবে কেঁদেছো।’
বুকটা যেনো ছ্যাৎ করে উঠে রুয়াতের। সামান্য এক্সিডেন্টের কথা সহ্য করতে পারেনি আর সেখানে তো। রুয়াত একটু নিচু স্বরে বললো-‘
-‘এমন কথা বলবেন না দয়া করে। আমার কষ্ট হয় খুব।’
আয়াজ হাসে। তার প্রেয়সী যে তাকে ভালোবাসে এটা খুব সহজেই উপলব্ধি করতে পেরেছে। এখন মনেহচ্ছে সে ব্যর্থ হয়ে যায়নি। শুধুমাত্র রুয়াতের মুখ থেকে শোনার অপেক্ষা।
-‘কোঁথায় কষ্ট হয় তোমার?’
রুয়াত আশেপাশে তাকায়। মাঝে মাঝে আয়াজ এমন এমন প্রশ্ন করে উত্তর দেওয়ার কোন পথ রাখে না। আয়াজ রুয়াতের হাতের তালুতে ছোট ছোট চুমু দেয়। রুয়াত চোখ বন্ধ করে আছে। আয়াজ হেসে বলে-
-‘এটুকু সহ্য করতে পারছো না। বড় বড় জিনিস কিভাবে সহ্য করবে সেটাই ভাবছি।’
সর্বাঙ্গ শরীর কেঁপে উঠে রুয়াতের। হসপিটালে রয়েছে তারপরেও তার এমন লাগামহীন কথা-বার্তা যাচ্ছে না।
-‘এখন কেমন আছেন আপনি?’
আয়াজের সম্পুর্ণ নজর রুয়াতের দিকে। কিন্তু বরাবরের মতোই রুয়াতের দৃষ্টি নিচের দিকে।
-‘এই তুমি আমার দিকে তাকাও। অন্য কোনো ছেলের দিকে চোখ তুলে তাকানো হারাম। তোমার সম্পুর্ণ নজর আমার উপর থাকবে। আমি পরপুরুষ নই। তাকাও আমার দিকে।’
রুয়াত একবার তাকালেও আবার চোখ সরিয়ে নেয়। আয়াজের চোখ অতিরিক্ত লাল হয়ে আছে। এমন ভয়ংকর চোখের দিকে তাকানোর সাহস নেই রুয়াতের। আয়াজ তার প্রেয়সীর থুতনিতে হাত রেখে মাথা উঠিয়ে দেয়।
-‘চোখ মুখ লাল বানিয়ে ফেলেছো একদম। আমায় দেখো তোমার থেকে একদম ভালো আছি।’
-‘একটু ও ভালো নেই আপনি। কিভাবে এসব হয়েছে?’
আয়াজ রুয়াতের দিকে তাকিয়ে আছে। রুয়াত কে
কখনোই বলা যাবে না। যদি জানে রাজনীতি বিষয়ক ঝামেলা নিয়ে এমন হয়েছে এখন যেভাবে ভালোবেসেছে তখন ভালোবাসার ‘ভ’ ও বাসবে না।
-‘আজ দেখা করতে চেয়েছিলে?’
বড়সড় ঢোক গিলে রুয়াত।
-‘জ্বী। আপনি অনেক ব্যস্ত ছিলেন।’
-‘হ্যাঁ। তোমার সাথের মেয়ে চলে গিয়েছিলো তুমি কেনো দাঁড়িয়ে ছিলে? কলেজে তুমি ছাড়া আর কোনো মেয়ে ছিলো না আমি যা দেখেছি। চলে আসতে পারলে না? কতো ছেলে ছিলো। সেফটি জিনিস বুঝো তো আসলে?’
আয়াজ শেষের কথা একটু জোরেই বলেছে। রুয়াত তো তার সাথেই কথা বলতে গিয়েছিলো।
-‘আপনি অসুস্থ আর এটা হসপিটাল। দয়া করে জোরে কথা বলবেন না।’
শান্ত হয় আয়াজ।
-‘পরের বার থেকে মনে থাকে যেনো। আর ভুলে গেলে সেটার জন্য শাস্তি পাবে। এখনকারটা তোলা থাকলো। আশাকরি বুঝেছো।’
মাথা নাড়ায় রুয়াত।
-‘আমি আসি এবার।’
আয়াজ হাত ছেড়ে দেয় রুয়াতের। মেয়েটি সামনে থাকলে নিজেকে বড্ড বেসামাল লাগে। ইশারায় বলে চলে যেতে। রুয়াত চলে আসে বাহিরে। হান্নান মজুমদার আবার দেখা করে আসে আয়াজের সাথে। রুয়াত মেহরুবার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। মায়া চৌধুরী চলে যাবেন একটু পর বাসায়। আয়াজের সাথে আরহাম থাকবে। আরহাম কাউকে থাকতে দেয়নি। সবাই কে বাসায় যাওয়ার জন্য তাড়া দিচ্ছে।
ইনিমা আরহামের পাশে দাঁড়ায়।
-‘তুমি কিভাবে সবদিক সামলাবে? আমি থাকি নাহয়?’
আরহাম ইনিমার কাঁধে হাত দেয়।
-‘আমি পারবো সামলাতে। তুমি অসুস্থ এখন। বাসায় যাও ফ্রেশ হও রেস্ট নাও কাল নাহয় একবার আমাদের বাসা থেকে ঘুরে এসো। এই ফাঁকে আয়াজ কে ও দেখা হয়ে যাবে।’
-‘আচ্ছা।’
আরহাম সবাই কে গাড়ি তে উঠিয়ে দেয়। আয়াজ বলেছে জলদি কাজ সেড়ে তার কাছে যেতে। আর আরহাম ও তাই করলো। কেবিনে দু’জন পুলিশ এসেছে। আয়াজের এক্সিডেন্টের খবর মুহুর্তেই ছড়িয়ে পড়ে। হসপিটালের কতৃপক্ষ শুধুমাত্র আয়াজের জন্য নিয়ম লঙ্ঘন করেছেন। পাশের কেবিন থেকে সাহেদ কে ও নিয়ে আসা হয়েছে। আয়াজের থেকে সাহেদের বেশি ক্ষতি হয়েছে। হাতের কনুই আর পা ছিলে গিয়েছে একদম। গাড়িটার অবস্থা খুব খারাপ হলেও আয়াজের তেমন লাগেনি। আয়াজের প্রথমত ভুল হচ্ছে গার্ডদের ছাড়া কোঁথাও যাওয়া। কোনো পলিটিক্যাল কারণ ছাড়া আয়াজ গার্ড সাথে রাখে না। এটাই হচ্ছে তার সর্বোচ্চ ভুল। আয়াজ সোজা হয়ে বসে। তার দৃষ্টি জানালার দিকে।
-‘আমি পুরোপুরি সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত আপনারা ইকরামুল কে কোনো রকম শাস্তি দিবেন না।’
আরহামের রাগ হয় আয়াজের কথায়। এমন কথার কোনো ভিত্তি আছে? মানে যা মনে আসে তাই বলে।
-‘কেনো? আবার যদি তোর ক্ষতি করার চেষ্টা করে তখন?’
সাহেদ আরহামের কথায় একমত। শুধু স্যার কে ভয় পায় বলে আজ আরহামের সাথে চিৎকার করে ‘সহমত’ কথাটি বলতে পারছে না। আর আইন সবার ঊর্ধ্বে। সেখানের আয়াজের এরূপ কথা মেনে নিতে পারছে না পুলিশ প্রশাসক।
-‘দেখুন মি. চৌধুরী আমরা আইনের লোক। আর আপনার উপর এরূপ অ্যাটাক এসেছে আমরা যদি ঘাপটি মেরে বসে থাকি আমাদের উপরের কোনো অফিসার এটা জানলে সমস্যা হবে। আপনি সুস্থ হয়ে উঠুন আর আমরা ইকরামুল কে শাস্তি দেওয়ার ব্যবস্থা করছি। আপনার আর এসব বিষয়ে না জড়ানোটাই ভালো।’
আয়াজ শান্ত স্বরে বলে-
-‘আইন আমি আপনাদের দেখাবো। শুধু বেশি না তিনটে দিন আমায় সময় দিন আমি সুস্থ হয়ে নিই তারপর আমার ব্যপার আমি বুঝবো। আমার ব্যক্তিগত বিষয়ে কারো না জড়ানোটাই ভালো।’
পুলিশ প্রশাসক হকচকিয়ে গেল। আয়াজ তার কথা আবার তাকেই ফিরিয়ে দিলো।
-‘জ্বী। কিন্তু এবার থেকে সব সময় গার্ড রাখবেন সঙ্গে। আসি আসসালামু আলাইকুম।’
পুলিশ চলে যায়। সাহেদ কে ধরে একটা নার্স তার কেবিনে দিয়ে আসলো। আরহামের মেজাজ গরম হচ্ছে। প্রতিবার তার ভাই এমন ত্যা’ড়া’মি করবে আর শেষে অস্ত্রের সাহায্যে নিবে।
-‘কিছু কিছু সময়ে মানুষের কথাও শুনতে হয়।’
আয়াজ বিরক্তিকর শব্দ করলো।
-‘কথা বলো না। আমার কারো কথা শোনার প্রয়োজন নেই।’
আরহাম রাগে মুখটা ফিরিয়ে নিয়েছে। মিনমিন করে বললো-
-‘এই আধ পাগলকে কে সামলাবে।’
আয়াজ শুনে ফেলেছে ঠিকই। আরহাম মুখটা বেজার করে রেখেছে। আয়াজ অট্টহাসি দিয়ে আরহামের দিকে তাকায়।
-‘একমাত্র তোমার শালীকাই এই আধ পাগলটা কে সামলাতে পারবে।’
#চলবে….