হৃদয়াসিক্ত কাঠগোলাপ পর্ব -৩৭+৩৮

#হৃদয়াসিক্ত_কাঠগোলাপ
#সাদিয়া_জাহান_উম্মি
#পর্বঃ৩৭
ভালো লাগছে না আরাবীর।এই কয়দিন জায়ান দিনরাত ২৪ ঘন্টা ওর সাথে ছায়ের মতো থেকেছে।এখন জায়ানকে ছাড়া একমুহূর্তও ভালো লাগেনা আরাবীর।মুখ গোমড়া করে জায়ানকে ফোন করল আরাবী।কিন্তু জায়ান ফোন কেটে দিলো।আরাবীর ফোন কান থেকে সরিয়ে হা করে রইলো। এমনটাতো জায়ান কোনদিন করে না।শতো ব্যস্ততার মাঝে আরাবীর ফোন কল দেখলে সাথে সাথেই রিসিভ করে।তাহলে আজ কি হলো?গাল ফুলিয়ে নিলো আরাবী।সেইযে গেলো লোকটা এখনও আসার নাম নেই।এদিকে আলিফার নজর হঠাৎ দরজার দিকে যেতেই হাসে আলিফা।তারপর আলগোছে উঠে চলে যায়।আরাবী আবারও জায়ানকে ফোন দিতে নিবে এমন সময় সামনের দিকে নজর যেতেই দেখে আলিফা নেই।অবাক হয় আরাবী।নিজ থেকে বিরবির করে,
-‘ আরেহ! আলুটা আবার কোথায় গেলো?’

আরাবী দরজার দিকে তাকালো।তাকাতেই জায়ানের মুখশ্রী নজরে এলো আরাবীর।ঠোঁটের কোণে নিজের অজান্তেই হাসি ফুটে উঠলো আরাবীর।জায়ানও হাসে আরাবীকে হাসতে দেখে।তারপর আরাবীর কাছে এগিয়ে আসতে আসতে বলে,
-‘ মিস করছিলে বুঝি?’

আরাবী অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলো।ঠোঁট টিপে হেসে বলে,
-‘ আমি কাউকে মিস টিস করি না।’
-‘ ওহ আচ্ছা তাই বুঝি?’
-‘ হু!’

জায়ান হাতের ফোনটা আরাবীর মুখের সামনে ধরে বলল,
-‘ তাহলে হোয়াইট্স এ্যাপে এই ফোনকলগুলো কার?’

আরাবী জায়ানের ফোনটা নিতে হাত বাড়াতেই জায়ান ফোন সরিয়ে নেয়।আরাবী হেসে দিলো।তারপর জায়ানের বাহুতে নিজের শরীর এলিয়ে দিলো।জায়ানও দুহাতে জড়িয়ে নিলো আরাবীকে।আরাবী রিনরিনে কণ্ঠে বলে,
-‘ কোথায় গিয়েছিলেন?এতো সময় লাগলো?’

জায়ান জবাবে বলে,
-‘ এইতো কিছু না। একটু জরুরি দরকার ছিলো। একজনের সাথে একটু দেখা করতে গিয়েছিলাম।’
-‘ ওহ!’
-‘ খেয়েছিলে তুমি কিছু?’
-‘ হুম,মা এসে স্যুপ খাইয়ে দিয়েছে।’

জায়ান আরাবীর ব্যাথা পাওয়া হাতটা স্পর্শ করে ধীরে বলে,
-‘ এখনও ব্যাথা আছে অনেক তাই নাহ?’

আরাবী ছোট্টো কন্ঠে বলল,
-‘ ওহ একটু তো এখনও করবেই।চিন্তা করবেন নাহ।দ্রুত সেরে যাবে।’
-‘ তোমাকে এমন অবস্থায় দেখতে যে আমার একটুও ভালো লাগে না আরাবী।তোমার গায়ে সামান্য একটু আঁচড় আমি সহ্য করতে পারিনা।সেখানে তোমার গায়ে এই এতো এতো আঘাতগুলো দেখে আমার ঠিক কতোটা খারাপ লাগে বুঝ তুমি?’

জায়ানের কণ্ঠে মন খারাপের আভাস পেয়ে আরাবী বলে,
-‘ উফ,মন খারাপ করছেন কেন বলুন তো? আমি ঠিক আছি।আপনি সাথে থাকলে জলদিই ঠিক হয়ে যাবো।এখন যান ফ্রেস হয়ে আসুন।দুপুরের খাবার খাবেন নাহ?আমি কিন্তু আপনার সাথে খাবো বলে বসে আছি।’

জায়ান আরাবীর কপালে চুমু খেয়ে উঠে দাঁড়ালো।তারপর বলল,
-‘ হুম।বোসো তুমি।আমি আসছি।’

আরাবী মাথা নাড়ালো।জায়ান ওয়াশরুমে চলে গেলো ফ্রেস হতে।
———
গুনগুন করে গান গান গেয়ে হেটে যাচ্ছিলো আলিফা।আচমকা কারো হেঁচকা টানে ভয় পেয়ে যায় ও। চিৎকার দিতে নিলে মুখ চেপে ধরে ওই অজানা ব্যাক্তিটি।আলিফা চোখ বড় বড় করে সামনে তাকালো।বিষয়টা ঠাহর করতে পারলেই বুঝতে পারে ব্যাক্তিটি আর কেউ না ইফতি।আলিফা ইফতির হাতটা দুহাতে টেনে সরিয়ে দিলো।তারপর জোড়ে জোড়ে শ্বাস নিতে লাগল।নিজেকে সামলে নিয়ে আলিফা দাঁতেদাঁত চিপে বলে,
-‘ কি হচ্ছে এসব?এইগুলো কেমন ব্যবহার আপনার?’

ইফতি ভ্রু-কুচকে বলে,
-‘চিল্লানোর কি আছে?আমিই তো?’
-‘ আপনিই তো কি হ্যা? আপনি দেখেই কি এইভাবে শয়’তানের মতো করে টেনেটুনে আনবেন আমাকে?’

আলিফা রাগে হিসহিস করে বলল।ইফতি হা হয়ে বলে,
-‘ কি আমাকে তোমাকে শয়’তানের মতো টানাটানি করি?’
-‘ তা নয়তো কি?এইভাবে কেউ কাউকে টান দেয়?যদি দেয়ালের সাথে আমার মাথাটা ঠুকে যেতো?অথবা আমার হাতটাও ভেঙে যেতে পারতো।যেভাবে আপনি টান দিয়েছেন।’

আলিফার বকরবকরে হার মানলো ইফতি।নাক ফুলিয়ে বলে,
-‘ হয়েছে।ক্ষমা করো আমায়।আমি সরি বললাম তোমাকে।আর কখনও তোমায় এইভাবে টান দিবো নাহ।তোমাকে সোজা ভাবে ডাকলে তো তুমি জীবনেও আসতে নাহ।তাই এইভাবে আনলাম।এখন দেখি এটা করেও অন্যায় করে নিয়েছি।’
-‘ অন্যায় করলে সরি বলতে হবেই।’
-‘ সেটা তো করলামই।’

দাঁত খিচিয়ে বলল ইফতি।আলিফা মুখ ভেংচি মারলো ইফতিকে।তারপর কিছু একটা ভেবে বলে,
-‘ এই এক মিনিট আপনি তো এই টাইমে অফিসে থাকেন।তাহলে এখন বাড়িতে কি করছেন?’

ইফতি রাগি স্বরে বলে,
-‘একজন আছে যার সাথে দেখা করতে এসেছিলাম।এমনিতে তো সেই মহারানির নাকি আমার সাথে দেখা করার সময় হয় না।তাই যখন শুনলাম তিনি আমাদের বাড়িতে এসেছেন।তাই কাজ ফাকি দিয়ে তার সাথে একটু দেখা করতে এলাম।এখন দেখি মহারানি আমার মুখটাও বুঝি দেখতে চান নাহ।ভালোবাসি তো শুধু আমি একাই।তার তো আমার জন্যে সামান্য একটু মায়াও হয় নাহ।’

ইফতির কথায় যেন আলিফার মন খারাপ হলো।আসলেই কি ও কি খুব বেশিই বাড়াবাড়ি করে ফেলছে ইফতির সাথে?আরাবী অসুস্থ জায়ান তাই অফিসে যেতে পারেন নাহ।এইজন্যে ইফতিকে অনেক খাটাখাটুনি করতে হচ্ছে অফিসে। এখন এই ক্লান্ত শরীর নিয়ে ইফতি আবার এতোটা পথ পারি দিয়ে আলিফার সাথে দেখা করতে চায়।এতে লোকটা আরো ক্লান্ত হয়ে পরবে।এইটা ভেবেই তো আলিফা মানা করে দেয়।কিন্তু ও তো জানতো না যে ইফতি এতোটা কষ্ট পাবে।আলিফা মন খারাপ করে বলল,
-‘ আমি সরি।আসলে আপনি সারাদিন অফিসে এতোটা কাজ করেন।এর মধ্যে আবার আমার সাথে দেখা করতে আসতে কতোটা পথ জার্নি করতে হয় আপনার।আপনার শরীরের উপর অনেক ধকল পরে যায়। এটা ভেবেই আমি মানা করি আপনাকে।তবে আপনি এতো কষ্ট পাবেন আমি জানতাম নাহ।সরি।’

আলিফাকে মন খারাপ করতে দেখে ইফতির সকল রাগ যেন উধাও হয়ে গেলো।ইফতি এইবার আলগোছে স্পর্শ করলো আলিফার গাল।আলিফা কেঁপে উঠে।মৃদ্যু পলক ঝাপ্টে তাকায় ইফতির দিকে।ইফতি নরম গলায় বলে,
-‘ এতোবার সরি বলতে হবে না। আমি জানি তুমি আমার ভালোর জন্যেই আমাকে মানা কর‍তে।’

আলিফা মলিন হাসল।তারপর ইফতির বুকে মুখ গুজে দিলো।ভীষণ অবাক হলো ইফতি।আলিফা আজ নিজ থেকেই ওকে এই প্রথম জড়িয়ে ধরলো।ইফতির অবাকের রেশ কাটতেই ওর ঠোঁটের কোণে মুঁচকি হাসি ফুটে উঠল।ইফতি দুহাতে জড়িয়ে ধরলো আলিফাকে। তারপর আলিফার চুলের ভাঁজে চুমু ফিসফিস করে বলে,
-‘ ভাবিকে একটু সুস্থ্য হতে দেও।তারপর খুব শীঘ্রই তোমাকে আমার বউ করে আমার ঘর নিয়ে আসব।শুধু একটু অপেক্ষা করো।’
-‘ আমি শতো জনম অপেক্ষা করতে রাজি।’
_______
জিহাদ সাহেব রাতে অফিস থেকে ফিরতেই আরাবীর রুমে চলে গেলেন।কয়েকদিন যাবত তিনি আরাবীর রুমেই ঘুমান।লিপি বেগমও তাকে আর ঘাটায়নি এই কয়েকদিন ততো একটা।মূলত অপরাধবোধ আর লজ্জায় তিনি স্বামির সামনে যাওয়ার সাহস পেতেন নাহ।জিহাদ সাহেব আর ফাহিম প্রতিদিন বাহির থেকেই খাবার খেয়ে আসেন।তবে আজ জিহাদ সাহেব খেয়ে আসেননি।মূলত আজ শরীরটা তেমন একটা ভালো নেই তার।লিপি বেগম দূর থেকে স্বামির মুখশ্রী দেখেই বিষয়টা ধরতে পারেন।তাই সব একদিকে সরিয়ে দিয়ে তিনি একগ্লাস লেবুর শরবত গুলে নিয়ে স্বামির কাছে যান।জিহাদ সাহেব অফিসের পোষাক বদলাননি। সেইভাবেই বিছানায় শুয়ে আছেন।লিপি বেগম আমতা আমতা করছেন।কিভাবে জিহাদ সাহেবকে ডাক দিবেন আসলে তিনি তাই ভাবছেন।আজ দীর্ঘদিন যাবত স্বামির সাথে উনার কথা হয় নাহ।অতঃপর সাহস করে লিপি বেগম জিহাদ সাহেবের শিয়রে বসলেন।পাশে কারো অস্তিত্ব অনুভব হতেই জিহাদ সাহেব বুঝলেন এটা তার স্ত্রী।এতো বছর ধরে সংসার করছেন যার সাথে তার অস্তিত্বটুকু বুঝা আসলে কোন ব্যাপার নাহ।জিহাদ সাহেব তাও চোখ খুললেন নাহ।লিপি বেগম অবশেষে সাহস নিয়ে বলে উঠলেন,
-‘ শুনছেন?উঠুন নাহ! এই শরবতটুকু খেয়ে নিন।দেখবেন ভালো লাগবে।’

জবাব দিলেন নাহ জিহাদ সাহেব।লিপি বেগমের কান্না পেলো।স্বামির এমন অবহেলা মেনে নিতে পারছেন নাহ তিনি।লিপি বেগম ধরা গলায় বললেন,
-‘ আমার সাথে রাগ আছেন বুঝলাম।তবে নিজের শরীরের সাথে তো আর রাগ নেই?আপনি অসুস্থ।শরবতটুকু খেয়ে নিন নাহ।’

জিহাদ সাহেব তাও কোন সারাশব্দ করলেন নাহ।লিপি বেগমের বক্ষে অসহনীয় যন্ত্রনা হলো।তিনি এইবার নিচে বসে পরলেন।তারপর দুহাতে চেপে ধরলেন জিহাদ সাহেবের পাজোড়া।স্বামির পায়ে মাথাটা ঠেকিয়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন।জিহাদ সাহেব হকচকিয়ে উঠলেন। দ্রুত উঠে বসলেন।লিপি বেগম কাঁদতে কাঁদতে বলেন,
-‘ আমায় ক্ষমা করে দেও গো।আমি নিজের কাজে নিজেই নিজের কাছে আজ লজ্জিত।আমাকে এইভাবে তোমরা দূরে ঠেলে দিও নাহ গো।আমার তাহলে মরন ছাড়া উপর নেই।আমায় তোমরা ক্ষমা করো।আ..আমি আরাবীর কাছেও ক্ষমা চাইবো।ওর পা ধরেও ক্ষমা চাইবো।আমায় তোমরা এইভাবে অবহেলা করো না।’

জিহাদ সাহেব উঠে দাঁড়ালেন।তারপর লিপি বেগমকে টেনে দাড় করালেন।লিপি বেগম কাঁদতে কাঁদতে অস্থির হয়ে গিয়েছেন।তার শ্বাসকষ্ট শুরু হয়ে গিয়েছে।জিহাদ সাহেব আর পারলেন নাহ নিজের রাগ ধরে রাখতে।শতো হোক এই মানুষটাকে তিনি ভালোবাসেন।যতোই খারাপ হোক লিপি বেগম।সত্য কথা তিনি এই খারাপ মানুষটাকেই ভালোবাসেন।আর আজ তো তিনি লিপি বেগমের চোখে স্পষ্ট অনুশোচনা দেখতে পাচ্ছেন।তিনি লিপি বেগমকে বিছানায় বসালেন।লিপি বেগম জিহাদ সাহেবের বুকে মাথা রাখলেন।কেঁদে কেঁদে বলেন,
-‘ আমি অনেক খারাপ গো।অনেক খারাপ।আমার মেয়েটাকে আমি কিভাবে এতোটা কষ্ট দিয়ে ফেললাম গো।মানছি আমি জন্ম দেয়নি।তবে আমি তো মা বলো।আমি কিভাবে এতো খারাপ হলাম?ওকে তো আমি এই দুহাতে লালনপালন করেছি বলো।ওর প্রথম মা বলতে পারায় পুরো বিল্ডিংয়ের মানুষকে তো আমি নিজ হাতে পায়েস বানিয়ে খাইছিলাম বলো?মনে আছে তোমার?সেই আমি কিভাবে আমার মেয়েটাকে এতো কষ্ট দিয়ে ফেললাম?আমার মতো মানুষের বেঁচে থাকার অধিকার নেই।মরে কেন যাই না আমি।আমায় তুমি মেরে ফেলো।আমি নিষ্ঠুর।আমার জন্যে আজ আরাবীর এই অবস্থা।আরাবী আমায় কি ক্ষমা করবে?আমি নিজেই তো নিজেকে ক্ষমা করতে পারছি না।’

জিহাদ সাহেব লিপি বেগমের পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বিচলিত গলায় বলেন,
-‘ থামো লিপি থামো।হয়েছে তো।তোমার শ্বাসকষ্ট শুরু হয়ে গিয়েছে।আমি আর রাগ করে নেই তোমার প্রতি।তুমি নিজের ভুল বুঝতে পেরেছো এতেই হয়েছে।আর আরাবী কেমন মনের মানুষ।এটা তুমি ছাড়া আর কেই বা ভালো বুঝবে বলো?তুমি একটু ওকে আদর করে বুকে টেনে নিও দেখবে তো সব ভুলে যাবে।তোমার কোলে নিজেকে সপে দিবে।ও এতো পাষাণ মনের নাহ।ও তোহ আমাদের মেয়ে বলো?আমাদের মেয়ে কি কখনও আমাদের উপর রাগ করে থাকতে পারে? ও নিজেও পারবে না আমি জানি।হয়েছে তো আর কাঁদে নাহ।’

লিপি বেগম চোখ মুছে নিলেন।তারপর অস্থির হয়ে বলেন,
-‘ ও অনেক ভালো আমি জানি ও আমায় ক্ষমা করে দিবে।কিন্তু…কিন্তু জায়ান?জায়ান আমার উপর অনেক রাগ।জানো তো আমাদের মেয়েটা অনেক ভাগ্যবতী।ও এতো ভালো একটা স্বামি আর পরিবার পেয়েছে।আমি হাসপাতালে গিয়েছিলাম।জায়ান আমাকে দেখেই রেগে বলে আমায় চলে যেতে।আরাবীর নাকি ক্ষতি করতে এসেছি আমি।তাই আরাবীর কাছে আমায় যেতেই দিলো না।জায়ানকে কিভাবে বুঝাবো?’
-‘ চিন্তা করো না।আরাবী মেনে গেলে জায়ানও মেনে যাবে।ছেলেটা যে আমাদের মেয়েকে অনেক ভালোবাসে।আরাবীর জন্যে ও সব কর‍তে রাজি।’
-‘ ঠিক বলছো।আমি কালই যাবো আরাবীর কাছে।ওর কাছে মাফ চাইবো।আমি জানি আরাবী আমায় ফিরিয়ে দিবে নাহ।’
-‘ আচ্ছা যেও।’
#হৃদয়াসিক্ত_কাঠগোলাপ
#সাদিয়া_জাহান_উম্মি
#পর্বঃ৩৮
আরাবী ঘুমোচ্ছে।কড়া ডোজের মেডিসিন খাওয়ার কারনে ইদানিং আরাবীর ভীষণ ঘুম পায়।জায়ান ওর পাশেই বসা ছিলো।এমন সময় ইফতির কণ্ঠস্বর পাওয়া গেল, ‘ ভাইয়া আছো?কথা ছিলো একটু।’

ইফতির গলার স্বরে উঠে দাড়ালো জায়ান।তারপর ধীর আওয়াজে বলে,’ হু! আসছি দারা।’

জায়ান আরাবীর গায়ে ভালোভাবে কাথা টেনে দিলো।তারপর ধীর পায়ে রুম থেকে বেড়িয়ে আসল।ইফতি জায়ানকে দেখেই বিচলিত কণ্ঠে বলে,’ ভাইয়া! জরুরি কথা বলবো।’

‘ হুম! বাগানেচল।আরাবী ঘুমোচ্ছে।আওয়াজে জেগে যেতে পারে।’

জায়ান আর ইফতি রুম থেকে সরে গিয়ে বাগানের নিরিবিলি জায়গায় গিয়ে বসল।জায়ান শীতল গলায় প্রশ্ন করে,’ হ্যা বল। কি বলবি!’

‘ ভাইয়া সেদিন তোমায় বললাম নাহ।আমার এক ফ্রেন্ড ওই হাসপাতালের ডক্টর।সাথে ওর আম্মুও ডক্টর ওই একই হাসপাতালের।’

ইফতির কথায় জায়ান ভ্রু-কুচকালো। বলল, ‘ হ্যা তো?’

ইফতি বলল, ‘ আমি আমার সেই ফ্রেন্ডের সাথে কথা বলেছিলাম।সাথে আন্টির সাথেও।আন্টিকে বিষয়টা জানাতে উনি আমায় তারিখ’টা জিজ্ঞেস করেছিলো।আমিও বললাম।তারিখটা বলতেই কেমন যেন তিনি থমথমে হয়ে গিয়েছিলো।শুধু বলল তোমাকে নিয়ে যেন তার সাথে দেখা করি।আমার মন বলছে ভাইয়া।কিছু একটা ঘাপলা আছে।’

জায়ানের কোচকানোর ভ্রু-জোড়া আরও কুচকে আসে।কি এমন হলো?যে তারিখ বলতেই তাকে যেতে বলল।জায়ান বলল, ‘ ঠিকই বলছিস ইফতি।কিছু একটা তো সমস্যা অবশ্যই আছে।’

‘ এখন তুমি কবে যাবে?’
‘ তিনি আমায় কবে যেতে বলেছেন?’

ইফতি বলল,’ তুমি গেলেই নাকি হবে।’
‘আচ্ছা তাহলে কাল যাবো নেহ।’
‘ ওকে।তাহলে আমি আন্টিকে জানিয়ে দিবো নেহ।’
‘হুম দিস!’

——-
কোচিং শেষে নূর বাহিরে দাঁড়িয়ে ওর ক্লাসমেট একটা ছেলের সাথে কথা বলছে।ফাহিম কোচিং-এর সকল কাজ শেষ করে বের হচ্ছিলো। গেটের সামনে নূরকে একটা ছেলের সাথে কথা বলতে দেখে ভ্রু-কুচকে আসে ওর।হঠাৎই রাগ উঠে গেলো ফাহিমের। ইদানিং নিজেকে নিজেই বুঝতে পারেনা ফাহিম।ওর কিযে হয়েছে।নূরকে অন্য কোন ছেলের সাথে কথা বলতে দেখলেই ওর রাগ লাগে।এমনটা আরাবীর এক্সি’ডেন্ট হয়েছিলো সেদিন নূরের সাথে একটু একান্তভাবে কথা বলেছিলো।নূর ওকে শান্তনা দিয়েছিলো ওইদিন থেকেই নূরের প্রতি আলাদা একটা অনুভূতি কাজ করে ফাহিমের।এই অনুভূতির নাম কি দেবে ফাহিম জানে নাহ।এইযে ফাহিমের যে রাগ লাগছে নূরকে অন্য একটা ছেলের সাথে দেখে।এটা তো অহেতুক রাগ তাই নাহ?মনকে বুঝ দিচ্ছে ফাহিম।তাও মন কথা শুনলে তো? ফাহিম মনের কথা শুনেই এগিয়ে গেলো নূরের কাছে। কথার মাঝে হঠাৎ ফাহিমকে দেখে থেমে যায় নূর।আঁড়চোখে তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নেয়।ফাহিম থমথমে গলায় বলে,’ নূর,এদিকে আসো। ‘

‘ কেন স্যার?’
‘ একটু দরকার আছে।’
‘ বাট স্যার কোচিং-এর কথা তো কোচিং-এর মধ্যেই বলতে হয়।এখন তো কোচিং টাইম শেষ।তাই যা বলার কাল বলবেন।’

নূর ফাহিমকে মুখের উপর ঘুরিয়ে পেচিয়ে না করে দিলো। খুব সুক্ষভাবে অপমান যাকে বলে।ফাহিম দাঁতেদাঁত চিপল।রাগল ঝাড়ল পাশে দাঁড়ানো ছেলেটার উপর।ফাহিম বলে, ‘ এই ছেলে?তোমার পড়ালেখা নেই?ক’টা বাজে?বাড়ি যাও না কেন?কোচিং-এর টেস্টে কি বাজে রেজাল্ট করেছ সেই খেয়াল আছে?’

ধমক খেয়ে ছেলেটা ভয় পেলো।তড়িঘড়ি করে চলে গেলো দ্রুত পায়ে।ফাহিম এইবার তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল নূরের দিকে।রাগি গলায় বলে,’ ওই ছেলের সাথে এতো কথা কিসের তোমার?’

নূরের একরোখা জবাব, ‘ তাতে আপনার কি?’
‘ নূর আমায় রাগিও নাহ।’
‘ আশ্চর্য! এখানে তো আপনি রেগে যাবেন এমন কিছুই হয়নি।অন্তত আমার চোখে তো পরছে নাহ।’

হাত চেপে ধরল ফাহিম নূরের।ব্যাথা পেলো নূর।তাও কিছু বলল নাহ।ফাহিম টেনে নূরকে নিয়ে কোচিং সেন্টার থেকে বেড়িয়ে আসল।তারপর বলে,’ তুমি আমাকে ইগনোর করছ কেন?’
‘ আপনাকে ইগনোর কোথায় করলাম স্যার? আপনিই তো সেদিন বলেছিলেন না কোচিং-এ যাতে আপনার সাথে ক্লাস বাদে।অহেতুক কথা যেন না বলি।’

নূরের সাথে কোচিং-এ প্রথম দেখার দিনের স্মৃতি মনে পরে গেলো ফাহিমের।মেজাজ খানিকটা ঠান্ডা হলো।মেয়েটা কি তবে অভিমান করেছে?সেদিনের ওর বলা কথার জন্যে?তবে ফাহিম যা করেছিলো তা নূরের ভালোর জন্যেই তো করেছিলো।ফাহিম ঠান্ডা গলায় বলল,’ আমি যা বলেছিলাম তোমার ভালোর জন্যেই তো বলেছিলাম।’
‘ তো?আমি তো আপনার কথাই মানছি।’

ফাহিম দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো।তারপর হুট করে বললে, ‘ আচ্ছা সরি।’

চমকে গেলো নূর।ও কখনও ভাবতেই পারেনি ফাহিম ওকে এইভাবে হুট করে সরি বলবে।আসলে সত্যিই নূর অভিমান করেছিলো ফাহিমের সেদিনের ব্যবহারের কারনে।কিন্তু ফাহিমের এই একটা সরি বলাতেই যেন অভিমানের পাহাড় ধ্বসে পরে গেলো নূরের।নূরের চোখ ভরে উঠতে চাইল।তাও সামলে নিলো নূর নিজেকে।ধীর গলায় বলে, ‘ আমি বাসায় যাবো স্যার?’
‘ এতো অভিমান কিসের নূর?আমি জানি তুমি আমায় ভালোবাসো।’ ফাহিমের সোজাসাপটা কথায়।

নূরের যেন চোখ বেড়িয়ে আসার উপক্রম।ও তো কখনও এই লোকটাকে ভালোবাসার কথা বলেনি।অথবা এমনও কোন আঁচড়ন করেনি।যা দেখলেই লোকটা বুঝে যাবে ও লোকটাকে ভালোবাসে।তাহলে কিভাবে বুঝল লোকটা? নূরের অবাক হওয়া মুখশ্রী দেখে হাসল ফাহিম।তারপর বলে, ‘ অবাক হয়েছ তাই নাহ?যে আমি জানলাম কি করে?’

নূর জিজ্ঞাসাসূচক দৃষ্টিতে তাকাতেই ফাহিম আবার বলে, ‘ আমি তোমার চোখ পড়তে পারি নূর।তোমার চোখে আমি স্পষ্ট আমার জন্যে ভালোবাসা দেখতে পাই।’

নূরের বুক ভাড় হয়ে আসল কষ্টে।লোকটা বুঝে যে ও লোকটাকে ভালোবাসে। তাও ওকে এতোটা অবহেলা করে।কেন করে?কেন এতো কষ্ট দেয় ওকে?নূর ধরা গলায় বলে, ‘ জেনেশুনে তাও তো কষ্ট দেন আমাকে।’

‘ আমায় বিয়ে করবে নূর?’

এইবারের চমকে যেন নূরের হার্ট এ’ট্যাক হয়ে যাবে।এটা কি বলল ফাহিম?সত্যিই কি বিয়ের কথা বলল ওকে? নাকি ও ভুল শুনল? ওর মাথা খারাপ হলো নাকি লোকটার মাথা খারাপ হলো? নূর কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, ‘ আপনি ঠিক আছেন?কিসব বলছেন আপনি?’

ফাহিমের সরল গলায় জবাব,’ চলো বিয়ে করে ফেলি নূর।তুমি তো আমায় ভালোবাসো তাই নাহ?প্রমিস করছি বিয়ের পর একটুও অবহেলা করবো নাহ।’

‘ কিন্তু আমায় তো আপনি ভালোবাসেন নাহ।ভালোবাসেন? সত্যি সত্যি উত্তর দিবেন।’
‘ নাহ ভালোবাসি নাহ।’

তাচ্ছিল্য হাসল নূর।ফাহিম ওকে ভালোবাসে না সেটা নূর ভালোভাবেই জানে।নূর তাচ্ছিল্যভরা কণ্ঠে বলে,’ যেহেতু আমায় ভালোবাসেন নাহ।সেখানে বিয়ে করার প্রশ্নই আসে নাহ।আমি আপনাকে ভালোবাসি ঠিকই।কিন্তু যে আমায় ভালোবাসে নাহ।তাকে বিয়ে আমি করব নাহ। আমাকে দয়া দেখাতে হবে নাহ।আমি কারও দয়ার পাত্রি হতে চাই নাহ।’
‘ আমি তোমায় ভালোবাসি না ঠিকই নূর।তবে সত্যি বলছি আমি তোমাকে মন থেকে আমার স্ত্রীর রূপে চাইছি।আমি তোমাকে দয়া করছি নাহ নূর।’
‘ প্লিজ আপনি থামুন। আমি আর কিছু শুনতে চাই নাহ।’

বলেই নূর চলে যেতে নিতেই ফাহিম ওর হাত টেনে ধরে।গম্ভীর স্বরে বলে, ‘ আমি তোমাকে ভালোবাসি নাহ ঠিকই। তবে তুমি আশেপাশে থাকলে আমার ভালোলাগে।তোমার জন্যে মনের মাঝে আলাদা একটা অনুভূতি কাজ করে নূর।ভালোলাগে তোমার কথা শুনতে।এখন এটাকে আমি কি বলব আমি জানি নাহ।তবে আমি এটুকু জানি আমি তোমার সাথেই সারাজীবন ভালো থাকবো নূর। তুমি শুধু একটু মানিয়ে নিও।’

ফাহিম অতোটা মনের কথা ব্যক্ত করতে পারে নাহ।তবে যেটুকু পারল মনের কথা সবটা বলে দিলো নূরকে।নূর আর পারল না নিজেকে ধরে রাখত। এতোটা অপেক্ষার পালা এইবার শেষ হয়েই গেলো তবে।নূর ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে। নূরকে কাঁদতে দেখে ভড়কে যায় ফাহিম।কি করবে দিশা পাচ্ছে না।চারপাশে তাকাল ফাহিম।দেখল কেউ আছে নাকি! না কেউ নেই।নিশ্চিত হতেই নূরকে বুকে টেনে নেয় নূর।নূর ফাহিমের একটুখানি ছোঁয়া পেতেই।আরো সিটিয়ে যায় ফাহিমের কাছে।ফাহিম আলতো হাতে নূরের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল।নরম গলায় বলে,’ কেঁদো না নূর।আমায় হাতটা একবার ধরো বিশ্বাস করে।ওয়াদা করলাম তোমার এই হাত আমি কোনদিন ছাড়বো না।আজীবন এইভাবেই আমার বুকের মাঝেই আগলে রাখব।’

#চলবে_________

ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন। কেমন হয়েছে জানাবেন।কেমন হয়েছে বলতে বলব নাহ।কারন গল্পটা ইদানিং অনেক খারাপভাবে লিখছি আমি।এইতো আর কয়েকটা পর্ব।এরপরেই শেষ হয়ে যাবে।একটু সহ্য করে নিন।
#চলবে_______
ভুলগুলো ক্ষমা করবেন।কেমন হয়েছে জানাবেন।দেরি করার জন্যে আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here