#হৃদয়াসিক্ত_কাঠগোলাপ
#সাদিয়া_জাহান_উম্মি
#পর্বঃ৪৫
আজ আলিফাদের বাড়িতে যাবে সাখাওয়াত বাড়ির সকলে।মূলত আজই বিয়ের কথাবার্তা পাকাপাকি করে আসবেন তারা।জায়ান দুপুরেই অফিস থেকে ফিরে এসেছে।আরাবী তখন আলিফাদের বাড়িতে কি কি নিবে তা গোছাচ্ছিলো রান্নাঘরে।ও খেয়াল করেনি জায়ান এসেছে।অবশ্য সাথি বেগম খেয়াল করেছেন।সাথি বেগম ছেলেকে দেখতে পেয়েই কর্মরত আরাবীকে থামিয়ে দিলেন।আরাবী বলে,’ কি হয়েছে মা?’
‘ জায়ান এসেছে।তুমি রুমে যাও।বাকিটা আমি সামলে নিব।’
‘ কখন এলেন তিনি মা?আমি তো দেখলাম নাহ।’
‘তুমি খেয়াল করোনি। এখন ওর জন্যে একগ্লাস পানি নিয়ে উপরে যাও।’
‘ আচ্ছা।’
আরাবী একগ্লাস ঠান্ডা পানি দিয়ে লেবুর শরবত বানিয়ে নিল।তারপর উপরে যাওয়ার জন্যে পা বাড়াল। রুমে এসে দরজা আটকাবে এমন সময় জায়ানের গম্ভীর গলার স্বরে খানিক চমকালো ও।
‘ আমি এসেছি পনেরো মিনিট হয়েছে।তুমি কোথায় ছিলে?’
আরাবী হাতের লেবুর শরবতটা এগিয়ে দিল জায়ানের দিকে।জায়ান সেটা নিতেই আরাবী বলে,’ আসলে আপনি যে এসেছেন আমি খেয়াল করিনি। মা বলল আমায় আপনার কথা। তাই শরবত বানিয়ে নিয়ে একেবারে আসলাম।’
জায়ান একনিশ্বাসে শরবতটুকু খেয়ে খালি গ্লাস বাড়িয়ে দিল আরাবীর দিকে।আরাবী গ্লাসটা হাতে নিয়ে সেটা পাশেই রাখা টেবিলে রেখে দিল।তারপর জায়ানের কাছে গিয়ে ওর কোট খুলতে সাহায্য করল।জায়ান কোট খুলতে খুলতেই বলে,’ নিচে কি এতো করছিলে?যে আমি এসেছি সেটা তুমি খেয়ালই করো নাই।’
কোটটা খুলে আরাবী পাশের কাপড় রাখা ঝুড়িতে রেখে দিল।তারপর বলে,’ আলিফাদের বাড়ি যাবো না আজ?সেইজন্যেই তত্ত্ব সাজাচ্ছিলাম।’
‘ ওহ।’
‘ হুহ! আপনি ফ্রেস হয়ে আসুন।আমি খাবার দিচ্ছি।’
‘ আমি ওয়াশরুমে যাচ্ছি। আমার জামা কাপড়গুলো বের করে রেখো।’
‘ আচ্ছা।’
জায়ান ওয়াশরুমে যেতেই আরাবী জায়ানের জন্যে জামা-কাপড় বের করে বিছানায় রেখে দিল।তারপর চলে গেল নিচে।নিচে আসতেই শামিম সাহেবের ডাক শুনতে পেলো আরাবী।
‘ আরাবী মা এদিকে আসো তো একটু।’
আরাবী তার ডাক শুনে এগিয়ে গেল সেদিকে।নম্র গলায় বলে,’ জি আংকেল ফুপা বলেন।’
‘ আমায় এক কাপ কফি বানিয়ে দিবে।আসলে তোমার হাতের কফি খুব মজা।তাই লোভ সামলাতে পারিনা।’
হেসে দিল আরাবী। বলে’, জি এখনই দিচ্ছি।’
আরাবী চলে গেল রান্নাঘরের দিকে।শামিম সাহেব তাকিয়েই রইলেন আরাবীর দিকে।কেন যেন মেয়েটাকে তার বড্ড আপন মনে হয়।তার অনেক কাছের একজন মানুষের সাথে এই মেয়েটার চেহারার অনেক মিল।প্রথমে এই মেয়েটাকে দেখেই তো চমকে উঠেছিল।পরক্ষনে যে এটা হবার নয় ভেবেই দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিলেন।শামিম সাহেব চোখ বন্ধ করে সোফায় গা এলিয়ে দিলেন।
এদিকে আরাবী কফি বানিয়ে নিয়ে শামিম সাহেবের কাছে গেল।দেখে তিনি চোখ বন্ধ করে আছেন।আরাবী মৃদ্যুস্বরে ডাকে,’ ফুপা ঘুমিয়ে পরেছেন?’
আরাবীর ডাকে চোখ মেলে তাকায় তিনি।হেসে বলেন,’ নাহ ঘুমায়নি।এইতো একটু চোখ বন্ধ করে ছিলাম।’
‘ আচ্ছা।এই নিন আপনার কফি। ‘
আরাবী তার হাতে কফি দিয়ে জায়ানের জন্যে খাবার গরম করতে চলে গেল।খাবার গরম করে একপ্লেট খাবার নিয়ে উপরে চলে গেল।একটু বেশি করেই নিয়েছে।কারন সে নিজেও খায়নি। অপেক্ষা করছিল জায়ানের জন্যে।উপরে এসে দেখে জায়ান এখনও বের হয়নি।তাই খাবারটা টেবিলে রাখল আরাবী।এমন সময়েই জায়ান মাথা মুছতে মুছতে ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে আসল।জায়ানের উন্মুক্ত পেটানো সুঠাম দেহ আরাবী দৃষ্টিগোচড় হতেই আরাবীর বুকটা ধুক করে উঠল।সদ্য গোসল করায় জায়ানকে অনেক আকর্ষনীয় দেখাচ্ছে।
‘ এভাবে তাকিয়ে থাকলে তো আমার কিছুমিছু হয়ে যায় বউ।’
আচমকা এমন একটা কথায় ভড়কে যায় আরাবী।শুকনো ঢোক গিলে দ্রুত নজর ফিরিয়ে নিল।জায়ান শব্দবিহীন হাসল।তারপর আরাবীকে পেছন থেকে ঝাপ্টে ধরল।জায়ানের ঠান্ডা দেহের সংস্পর্শে এসে আরাবীর উষ্ণ দেহটা কেঁপে উঠল।আরাবী কাঁপা গলায় বলে, ‘ ঠা..ঠান্ডা লাগছে।’
‘ আমার তো বেশ লাগছে।তোমার নরম, গরম শরীরটা আমার এই হিমশীতল শরীরে স্পর্শ করছে আমার বেশ ভালো লাগছে।’
আরাবী মাথা নিচু করে নিল লজ্জা পেয়ে।জায়ান আরাবীর ঘাড়ে ঠোঁটের স্পর্শ দিল ছোটো ছোটো। আরাবী আবেশে চোখ বন্ধ করে নিলো।জায়ানের প্রতিটা স্পর্শে অদ্ভূত শিহরণ বয়ে যায় আরাবী দেহ,মনে।মাতাল হয়ে যায় ও।স্পর্শের গভীরতা আরো তীব্র হতেই আরাবী দ্রুত পিছনে ঘুরে জায়ানের উন্মুক্ত বুকে মুখ গুজে দিল।জায়ান হেসে আরাবীকে জড়িয়ে নিল নিজের সাথে।কিছুক্ষণ এইভাবেই নিরবে,নিভৃতে কেটে গেল।হঠাৎ খাবারের কথা মাথায় আসতেই জায়ানের কাছ থেকে সরে আসল আরাবী।জায়ান বিরক্ত হলো এতে।ভ্রু-কুচকে বলে,’ কি হলো?’
‘ খাবার ঠান্ডা হয়ে যাবে তো।’
‘ খাবার টাবার বাদ।এখন আমার তোমাকে লাগবে।জলদি বুকে আসো।’
জায়ান কথাটা বলেই হাত পেতে দিল।আরাবী মুঁচকি হেসে জায়ানের হাতে হাত রাখে।তারপর মৃদ্যু স্বরে বলে,’ বুকে তো আসবই।সেটা আপনি বললেও আসব না বললেও আসব।আমার জায়গায় আমার যেতে কারো পার্মিশনের প্রয়োজন হয় নাহ।’
‘ তাহলে আসো।’
‘উফ এখন নাহ তো।দেখুন দেরি হয়ে যাবে আলিফাদের বাড়ি যেতে।খেয়ে নিন নাহ। তাছাড়া আমারও ক্ষুদা লেগেছে।’
আরাবীরও খুদা লেগেছে শুনে জায়ান তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল আরাবীর দিকে।তারপর প্রশ্ন করল,’ তুমি খাওনি?’
‘ নাহ।’
আরাবীর এমন কথা রেগে গেল জায়ান।ধমকে বলে,’ তোমাকে না বলেছি আমার জন্যে অপেক্ষা করবে নাহ?তুমি অসুস্থ আরাবী।’
আরাবী মুখ গোমড়া করে নিল জায়ানের ধমকে।ছোট্টো কণ্ঠে বলে,’ আমার কি দোষ?আপনিই তো আমার এই বদঅভ্যাস করেছেন।’
‘ হয়েছে আর পেচার মতো মুখ করতে হবে না।এদিকে আসো।’
জায়ান গায়ে জামা জড়িয়ে নিয়ে।খাবারের প্লেট হাতে নিল।তারপর আরাবীকে ইশারায় পাশে বসতে বলল।আরাবীও মনের আনন্দে জায়ানের পাশে বসল।তারপর দুজনে একসাথে খাবার খেয়ে নিল।
———
নূরের ফোন লাগাতার বেজে চলেছে।ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে আসল নূর।দ্রুত ফোনটা হাতে নিয়ে দেখে ফাহিমের কল এসেছে।ফোন রিসিভ করতে করতে কেটে গেল ফোনটা।আবারও পুরোদমে সেটা বেজে উঠল ফোন।নূর এইবার তাড়াতাড়ি ফোন ধরল।ফোনটা কানে রাখতেই অপাশের ব্যাক্তির প্রচন্ড ধমকে কেঁপে উঠল নূর।
‘ কোথায় আছ তুমি বেয়া’দব মেয়ে। ‘
‘ আস…’ নূর কথা সম্পূর্ণ করার আগেই আবারও সেই বাঁজখাই গলার ধমক শুনে থেমে গেল।
‘ চুপ করে আছ কেন?চ’ড়িয়ে তোমার দাঁত ফেলে দিব।’
‘ আরে আপনি আমার কথা শুনবেন তো।’
‘ কি কথা শুনব হ্যা?কি কথা শুনব?তুমি কোথায় আর তোমার ফোন কোথায় থাকে? আমি যে এতোবার কল করলাম সেটা দেখোনি? ফোন না চালাতে জানলে ফোন আমার কাছে নিয়ে এসো।ফোনটা ভেঙে আমি ভাঙারি ওয়ালার কাছে দিয়ে দিব।’
ফাহিমের একের পর এক ধমকে নূর এইবার অধৈর্য হয়ে উঠল। ও আর একটা কথাও বলল নাহ।ফাহিম মনের আনন্দে ধমকে ধামকে শেষ করে নিল।অপাশ হতে নূরের কোন প্রতিক্রিয়া না অনুভব করতে পেরে বলে,
‘ চুপ করে আছ কেন? আমি কথা বলছি দেখছ নাহ?জবাব দিচ্ছ না কেন?’
নূর তাও চুপ করে রইল।ফাহিমের ধমকা ধমকিতে বেশ অভিমান করেছে ও।লোকটা ওকে কিছু বলতেই তো দিল নাহ। নূরকে চুপ থাকতে দেখে ফাহিম নিজেকে কিছুটা শান্ত করল।তারপর গম্ভীর গলায় বলে,’ কি হয়েছে?সোজাসাপটাভাবে আমাকে সব বল।’
নূর বুঝল এইবার ফাহিমকে কিছু না বললে এই লোক আবারও রেগে যাবে।তাই নূর অভিমানি কণ্ঠেই বলে,’ আমি ওয়াশরুমে ছিলাম তাই আপনি ফোন করেছেন বুঝতে পারিনি।যখন ফোনের রিংটোন শুনলাম তখনই ছুটে এসেছি।🥹’
‘ আচ্ছা বুঝলাম।তা আজ কোচিংয়ে আসো নি কেন?’ ফাহিমের শান্ত কণ্ঠস্বর।
‘ আসলে আজ ইফতি ভাইয়ার জন্যে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যাব আলিফা আপুদের বাসায়।আজই বিয়ের ডেইট পাকাপোক্ত করে আসবে।আমি নিজেও জানতাম নাহ এই কথা।মা একটু আগে আমাকে জানাল।আর আপনাকে আমি একটু পরেই ফোন করে জানাতাম।’
‘ হুহ আচ্ছা সাবধানে যেও।’ কথাটা বলেই লম্বা শ্বাস ফেলে ফোন রেখে দিল ফাহিম।এদিকে ফাহিমের এমন কান্ডে ফোন কান থেকে সরিয়ে হা করে রইল নূর।এটা কি হলো?লোকটা এইভাবে কিছু না বলেই হুট করে ফোন কেটে দিল কেন?নূর রাগে গজগজিয়ে উঠল।কল করল আবার ফাহিমের নাম্বারে।একবার রিং হতেই ফাহিম কলটা ধরল।শান্ত কণ্ঠে বলল,
‘ হ্যা বলো।’
‘ হ্যা বলো মানে কি হ্যা?আমার উপরে অযথা চিল্লাচিল্লি করলেন।আমি অভিমান করেছি সেটা বুঝেও আমার অভিমান ভাঙালেন নাহ।কিছু না বলেই হুট করে ফোন কেটে দেওয়ার মানে কি? হ্যা?’ রাগে প্রায় চিৎকার করে বলল নূর।
ফাহিম শীতল গলায় বলে,’ চিৎকার করছ কেন?’
‘ আপনি চিৎকার করেননি আমার উপর?’
‘ হ্যা করেছি তো?’
‘ কেন করবেন?আগে তো আমার কথা শুনে নিবেন।তা তো করলেন নাহ।’
‘ আমি চিন্তায় ছিলাম নূর তোমার জন্যে।কেন বুঝ না?তুমি কোচিং-এ আসোনি।তাই আমার মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছিল।ফোনটাও ধরছিলে না।তাই একটু তোমার উপর চিৎকার চেচামেচি করে ফেলেছি।’
ফাহিমের মুখে নিজের জন্যে চিন্তার কথা শুনে অভিমান গলে গেল নিমিষেই নূরের।তাও গলার স্বরে সেটা প্রকাশ করল নাহ।বলল,’ কেন চিন্তা করবেন?আমি যদি আপনার জন্যে চিন্তা করি সেটা মানা যায়।কারন আমি আপনাকে ভালোবাসি।কিন্তু আপনি তো আমায় ভালোবাসেন না।তাহলে আমার জন্যে এতো চিন্তার কি আছে?যেহেতু আমায় ভালোবাসেন নাহ।সেহেতু আমি যদি মরেও যাই এতেও প্রবলেম হবার কথা নয় আপনার।’
এইটুকু কথা বলতে দেরি অপাশ হতে ফাহিমের গর্জন শুনতে পেল নূর। সাথে সাথে কিছু ভা’ঙার তীব্র শব্দ।অস্থির হয়ে উঠল নূর।হঠাৎ কি হলো?লোকটা এমন করল কেন?নূর অস্থির কণ্ঠে বলে উঠে,’ হ্যালো?হ্যালো ফাহিম?আপনি শুনছেন হ্যালো?’
অপাশ হতে নিরবতা ছেঁয়ে আছে।ভয়ে নূরের ক’লিজা শুকিয়ে আসল।লোকটার কিছু হলো না তো আবার?নূর আবারও কিছু বলবে তার আগেই ফাহিমের রাগি কণ্ঠস্বর শুনতে পেল ও।
‘ ডোন্ট কল মি এগেইন।কোচিং ছাড়া ভুলেও আমার সামনে আসবে না তুমি।আমার সামনে যদি আসো তুমি তাহলে ম’রার খুব শখ তাই নাহ তোমার?আমি নিজে স্বয়ং তোমায় মে’রে ফেলব।এই বলে দিলাম।’
খট করে ফোনের লাইন কেটে গেল।নূর তাজ্জব বনে বসে রইল।কি হলো সবটা মাথার উপর দিয়ে গেল।কি এমন করল ও?যে ফাহিম এমন ভয়ানকভাবে রেগে গেল?এখন ফাহিমের এই রাগ ভাঙাবে কিভাবে নূর?
———–
মাথা নিচু করে বসে আছে আলিফা।ইফতিরা বিয়ের কথা পাকাপোক্ত করতে এসেছে ওদের বাড়িতে।ভীষন লজ্জা লাগছে ওর।আর ইফতি বে’হায়া লোকটা কিভাবে হা করে তাকিয়ে ছিল যখন ওকে এখানে আনা হলো।এখনও তাকিয়ে।আলিফা সবার অগোচরে চোখ তুলে শাষি’য়েছে ইফতিকে।কিন্তু লোকটা শুনলে তো?এদিকে দু পরিবারে মতামতে ইফতি আর আলিফার বিয়ের দিন তারিখ ধার্য করা হল।এখন আপাতত আংটি পরিয়ে রাখা যাক।হলোও তাই।ইফতি আর আলিফাকে পাশাপাশি বসানো হলো।দুজন দুজনকে আংটি পরানোর মাধ্যমে বাগদান সম্পন্ন করে নিল।সবাই এইবার মিষ্টিমুখ করানোতে ব্যস্ত হয়ে পরল।এই সুযোগে ইফতি আলিফার হাত চেপে ধরল।আলিফা চমকে উঠে।চোখজোড়া বড় বড় হয়ে আসে ওর।ফিসফিস করে বলে,’ কি করছেন?হাত ছাড়ুন।’
‘ কেন ছাড়ব?’
‘ আরে আশ্চর্য? এখানে সবাই আছে।মাথা খারাপ হয়ে গেছে আপনার?’
আলিফার কথায় বাঁকা হাসল ইফতি।মাথাটা একটু ঝুকিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,’ হ্যা মাথা তো খারাপ হয়েই গিয়েছে তোমাকে এই শাড়ি পরিহিত অবস্থায় দেখে।অপেক্ষা যেন আর ভালো লাগে না।কবে যে তোমাকে আমার বউ করে নিয়ে যাব।আলুরে তুই তো সেদিন শেষ হয়ে যাবি।’
ইফতির এমন অসভ্য কথাবার্তায় কান গরম হ য়ে গেল আলিফার লজ্জায়।চোখ খিচিয়ে বন্ধ করে বলে,’ বন্ধ করুন আপনার অসভ্য কথাবার্তা। ‘
‘ আচ্ছা আজ নাহয় বন্ধ করলাম।কিন্তু সেদিন আমাকে থামাবে কিভাবে?সেদিন সবদিক দিয়ে ঘায়েল করব তোমাকে।দেখে নিও।’
ইফতির এমন লাগামছাড়া কথায় আলিফার সারাশরীর লজ্জায় কাঁপছে। ইফতি আলিফার অবস্থা দেখে হাসে।অনেক হয়েছে মেয়েটাকে আর লজ্জা দেওয়া যাবে নাহ।দেখা যাবে আর ও সামনেও আসবে না।
—–
চুপচাপ বসে আছে আরাবী।মাথাটা প্রচন্ড ব্যাথা করছে ওর।সাথে কেমন যেন অস্থির লাগছে।বসেও শান্তি পাচ্ছে না।আবার দাঁড়াতেও ইচ্ছে করছে না।গলা শকিয়ে আসছে বারবার।এই নিয়ে প্রায় ছয় সাত গ্লাস পানি খেয়ে নিয়েছে আরাবী।তাও যেন তৃষ্ণা মিটছে না।এদিকে সামনে রাখা খাবার থেকে যেন আরাবী অদ্ভূত একটা গন্ধ পাচ্ছে।যা ওর কাছে অনেক খারাপ লাগছে।পেট মোচড় দিচ্ছে বারবার।এদিকে আরাবীর এই অস্থিরতা অনেকক্ষন ধরেই খেয়াল করেছে জায়ান।এইবার না পেরে জিজ্ঞেস করল, ‘ কি হয়েছে আরাবী?এমন করছ কেন?কেমন অস্থির দেখাচ্ছে তোমায়?’
জায়ানের কথায় আরাবী সোজা হয়ে বসল।দূর্বল কণ্ঠে বলে,’ জানি না কি হয়েছে।ভালো লাগছে না আমার।অস্থির লাগছে কেমন যেন।মাথাটাও ব্যথা করছে।’
আরাবীর কণ্ঠস্বর শুনেই জায়ানের বুকটা ধ্বক করে উঠল।হঠাৎ কি হলো মেয়েটার?বাড়িতে থাকতেও তো ভালো ছিল।চিন্তিত কণ্ঠ জায়ানের,’ বেশি খারাপ লাগছে?তাহলে চলো আমরা সবাইকে বলে এখনই চলে যাই।ওনারা নাহয় পরে আসবেন।’
‘ আরে না তার কোন দরকার নেই।একটু পর এমনিতেই ঠিক হয়ে যাব।’
‘ কিন্তু তোমায় দেখে তো তা মনে হচ্ছে না আরাবী।কোন কথা না। আমি মায়ের কাছে বলে আসি।আমরা এক্ষুনি ফিরব।’
‘ আরেহ শোনেন তো।’
কিন্তু কে শুনে কার কথা।জায়ান তার কথামতো সোজা সাথি বেগমের কাছে চলে গেল।গিয়েই সোজাসাপ্টাভাবে বলে,’ মা আরাবীর শরীরটা বোধহয় ভালো না।ওকে অনেক দূর্বল দেখাচ্ছে।আমি এখনই ওকে নিয়ে বাড়ি ফিরতে চাইছি।’
সাথি বেগম আলিফার মায়ের সাথে কথা বলছিলেন।পুত্রবধূর অসুস্থতার কথা শুনতে পেয়েই তিনি অস্থির কণ্ঠে বলেন, ‘ সে কিরে?কখন থেকে ভুগছে মেয়েটা আমার।আমাকে একটাবার বললও না।আর তোরা বাড়ি ফিরবি মানে?আমিও যাচ্ছি তোদের সাথে।চল।’
আলিফার মা এইবার এগিয়ে এসে বলেন,’ সে কি আপা।রাতের খাবারের ব্যবস্থা করছি আমি।আরাবী মায়ের শরীর বেশি খারাপ হলে আমি ডক্টর ডেকে আনছি।তুমি চিন্তা করো না বাবা।’
জায়ান থমথমে গলায় বলে,’ ধন্যবাদ আন্টি আপনার আন্তরিকতার জন্যে।কিন্তু আমি ওকে নিয়ে একেবারে বাড়ি ফিরতে চাইছি।আমাদের ফ্যামিলি ডক্টর আছেন উনাকেই দেখাব।’
তারপর সাথি বেগমের উদ্দেশ্যে বলেন,’ আর মা তোমরা থাকো।চিন্তা করো না। আমি আছি তো।সামলে নিব।আমি যাওয়ার সময় বাবাকেও বলে যাব নেহ।’
‘কিন্তু বাড়িতে একা তুই কিভাবে?’
‘ মা বললাম তো চিন্তা করতে না।আর বাড়িতে একা কোথায়?রহিমা আন্টি আছেন।আমি তাকে ডেকে নিব কোন সাহায্য প্রয়োজন হলে।আর অবস্থা বেশি খারাপ হলে আমি তোমাদের ফোন করে জানিয়ে দিব।’
সাথি বেগম ছেলের কথায় একটু ভরসা পেলেন তাই অনুমতি দিয়ে দিলেন।তবে তিনি পুরোপুরি দুঃশ্চিন্তা মুক্ত হতে পারলেন নাহ।
জায়ান নিহান সাহেবকে বাড়ি ফিরার কথা বলে আরাবীর কাছে ফিরে আসল।তখন আরাবীর কাছে আলিফা এসে বসেছে।জায়ানকে দেখেই আলিফা চিন্তিত কণ্ঠে বলে,’ ভাইয়া?আরাবীর কি হয়েছে?ওকে কেমন যেন দেখাচ্ছে।আমি এতোবার জিজ্ঞেস করলাম কিছু বলছেও না।বলে কিছু হয়নি।’
জায়ান নিস্তেজ হয়ে থাকা আরাবীর দিকে একবার তাকিয়ে।তারপর আলিফার প্রশ্নের জবাব দেয়,’ ওর শরীরটা একটু খারাপ।মাথা ব্যথা।তাই আমি ওকে নিয়ে বাড়ি ফিরছি।তুমি চিন্তা করো না।আমি আছি তো।আর আমি আর আরাবীই চলে যাচ্ছি বাকিরা থাকবে।তোমার আম্মু দেখলাম রাতের খাবারের ব্যবস্থা করছেন।তাই আমি সবাইকে ডিনার সেরে তারপরেই আসতে বলেছি।এখন অনুমতি দেও।’
আরাবী অসুস্থতা জেনে আলিফা আর না করল নাহ।জায়ান ইফতিকে বলল সবাইকে সাবধানে বাড়ি নিয়ে ফিরতে।তারপর আরাবীর কাছে আসল।ধীর স্বরে ডাকল,’ আরাবী,উঠ।বাড়িতে ফিরব আমরা।’
আরাবী চোখ খুলে তাকাল।স্থির চোখজোড়ায় যেন রাজ্যের ক্লান্তি।জায়ান আরাবীকে উঠতে সাহায্য করল।জায়ান বলে,’ যাওয়ার সময় ডক্টর দেখিয়ে যাব।’
‘ কোন কিছু করা লাগবে না।প্লিজ আমি কোন ডক্টরের কাছে যেতে পারব নাহ।ক্লান্ত লাগছে।বাড়ি ফিরতে চাই আমি ব্যস।’
আরাবীর কথা আর ফেলতে পারল না জায়ান।তাই আরাবীকে নিয়ে সোজা বাড়ির দিকে রওনা হলো।
#হৃদয়াসিক্ত_কাঠগোলাপ
#সাদিয়া_জাহান_উম্মি
#পর্বঃ৪৬
সাখাওয়াত বাড়ির ভীতরে গাড়ি প্রবেশ করতেই তা থেমে গেল।গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়াল জায়ান।তারপর আবার অপারপাশে গিয়ে দরজা খুলে আরাবীকে কোলে তুলে নিলো।যাওয়ার আগে দারোয়ানকে বলে গেল গাড়ি ভালোভাবে পার্ক করে দিতে।আরাবীকে নিয়ে দ্রুত নিজেদের রুমে ফিরে আসে জায়ান।আরাবীর দূর্বল ছোট্টো শরীরটা বিছানায় রাখল।পরপর নিজের শক্তপোক্ত হাতটা নিয়ে আলত স্পর্শ করল আরাবীর নরম গালে।পিটপিট করে নেত্র মেলে তাকাল আরাবী।জায়ান চিন্তিত কণ্ঠে বলে,’ অনেক বেশিই কি খারাপ লাগছে?আমি ডক্টরকে ফোন করি।’
‘ তা..তার প্রয়োজন ন..নেই।একটু বি..বিশ্রাম নিলেই ঠিক হ..হয়ে যাব।’ থেমে থেমে বলল আরাবী।
জায়ান না চাইতেও ধমকে ফেলল ওকে, ‘ কি চাইছ টা কি তুমি? রাস্তায় দু দুবার বমি করেছ।আমি বললাম হসপিটালে নিয়ে যাই।তাও রাজি হলে নাহ।এখন দূর্বলতার কারনে ঠিকঠাকভাবে একটু কথাও বলতে পারছ না।তারপরেও আমাকে ডক্টর ডাকতে বারণ করছ কেন তুমি? আমায় এতোটা অস্থিরতার মাঝে রাখতে কি তোমার ভালো লাগে?’
আরাবী কিছুই বলল না।চুপচাপ জায়ানের সব অভিযোগ শুনল।মূলত ও কথা বলার শক্তিটুকও পাচ্ছে নাহ।জায়ান আরাবীর এমন অবস্থা দেখে চুল খামছে ধরে জোড়ে জোড়ে শ্বাস নিয়ে নিজের রাগ কমানোর চেষ্টা করল।অতঃপর সোজা চলে গেল ওয়াশরুমে। একমগ পানি নিয়ে ফিরে আসল আরাবীর কাছে।ওর ছোটো রুমালটা ভিজিয়ে নিল।তারপর আরাবীর মুখে স্পর্শ করতেই ঠান্ডায় কাঁপল আরাবী।ধীর আওয়াজে বলে,’ ক..কি করছেন?’
‘ ওয়াশরুমে তো যেতে পারবে না।তাই এইভাবে আপাততো ফ্রেস হয়ে নেও।যেই অবস্থা শরীরের গায়ে সামান্য শক্তিও নেই।’
জায়ান ভালোভাবে রুমাল ভিজিয়ে আরাবীর গা মুছে দিল।এরপর আলমারি থেকে আরাবীর জামা কাপড় নিয়ে ফিরে আসল।আরাবীর শাড়ির আঁচলে হাত দিবে এমন সময় আরাবী আৎকে উঠে।বলে,’ এমন ক..করছেন কেন?’
‘ জামা কাপড় চেঞ্জ করবে নাহ?’
‘ ক..করবো।আমায় দিন। আমি চেঞ্জ করে নিচ্ছি।আপনার করা লাগবে নাহ।’
আরাবীর কথা শুনে জায়ান ভ্রু-কুচকালো। অতএব গম্ভীর গলায় বলে,’ শুধু শুধু লজ্জা পাচ্ছ তুমি।এখানে লজ্জা পাওয়ার কিছুই নেই।আমি তোমার স্বামি হই।তোমার অসুস্থতার সময় আমি তোমার সেবা করব এটা স্বাভাবিক।আর আমার অসুস্থতার সময়েও সেম কাজটা তুমিও করব।আর রইল জামা কাপড় চেঞ্জ করার কথা।তোমার শরীরের ইঞ্চি ইঞ্চির সম্পর্কে আমি জানি।সো লজ্জা টজ্জা পেয়ে লাভ নেই।’
আরাবী ঠোঁট কামড়ে ধরে ওপাশে ফিরিয়ে নিল মুখশ্রী।জায়ান আরাবীর জামা চেঞ্জ করে দিল।এরপর ল্যান্ডলাইনে সার্ভেন্টসকে খাবার আনতে বলল।
তারপর নম্র কণ্ঠে আরাবীকে বলে,’ তুমি থাকো।আমি একটু ফ্রেস হয়ে আসছি।খবরদার ঘুমাবে নাহ।আমি এই যাব এই আসব।খাবার না খেয়ে ঘুমাতে পারবে না তুমি।ঠিক আছে?’
‘ ঠিক আছে।’
জায়ান ফ্রেস হতে চলে গেল।ঝড়ের গতিতে গিয়ে তুফানের গতিতে ফিরে আসল যেন।এসে দেখে আরাবীর নেত্রজোড়া বন্ধ।জায়ান ভরাট কণ্ঠে বলল,’ আরাবী ঘুমিয়েছ?’
আরাবী ঘুমায়নি।চোখ বন্ধ করে ছিল এমনিতেই।জায়ানের ডাকে দ্রুত চোখ খুলল।ধীর আওয়াজে বলে,’ নাহ।এমনিতেই একটু চোখ বন্ধ করে ছিলাম।’
জায়ান সস্থির নিশ্বাস নিলো।যাক মেয়েটা ঘুমায়নি।এমন সময় দরজায় টোকা পরল।জায়ান গিয়ে দরজা খুলে দেখল সার্ভেন্ট খাবার নিয়ে এসেছ।খাবারটা নিয়ে দরজা বন্ধ করে আবার ফিরে আসল জায়ান।আরাবীর পাশে বসে ওকে দুহাতের সাহায্যে জড়িয়ে নিয়ে উঠিয়ে বসাল।বিছানার হেডবোর্ডের সাথে একটা বালিশ রেখে সেখানে হেলান দিয়ে বসাল আরাবীকে।তারপর খাবারের প্লেট হাতে নিল।মাছের ঝোলের তড়কারি দিয়ে ভাত মাখিয়ে আরাবীর মুখে সামনে ধরতেই আরাবী আতকে উঠে দুহাতে মুখ নাক ঢেকে ফেলল।জায়ান খাবারের প্লেট রেখে দিল আরাবী এমন করায়।অস্থির গলায় বলে,’ কি হলো তোমার? এমন করছ কেন?’
‘ আপ..আপনি কি দিয়ে ভাত মেখে দিয়েছেন?’
‘ কেন কি হয়েছে?মাছের ঝোলের তরকারি।’
‘ ভীষণ গন্ধ ওটায়।জঘন্য লাগল।আমি ওটা খাবো না।’
আরাবীর কথায় জায়ান অবাক হলো।গন্ধ কোথায় পেল মেয়েটা?তারপরেও মনের দ্বিধা দূর করার জন্যে খাবারের প্লেট হাতে তুলে নিল।ওই তরকারিটা দিয়ে মাখা ভাতটুক অনায়াসে খেয়ে নিল জায়ান। কপালে ভাঁজ পরল জায়ানের।আশ্চর্য ওর কাছে তো কোন গন্ধই লাগল নাহ।সব তো ঠিকই আছে।আর এই মাছের ঝোলের তরকারি তো আরাবীর অনেক পছন্দের তাহলে মেয়েটা আজ এমন করছে কেন?জায়ান আর অতোশতো ভাবল নাহ।হয়তো আজ ভালো নাও লাগতে পারে।সবসময় যে সবার একরকম লাগবে এমন তো কোন কথা নাহ।জায়ান নরম গলায় আরাবীকে বলে,’ আচ্ছা ওই তরকারি দিয়ে খাওয়া লাগবে নাহ।আমি ওটা খেয়ে নিয়েছি।তুমি অন্য তরকারি দিয়ে খাও।’
আরাবী জায়ানের পাশে রাখা ট্রেতে উকি দিল।মূলত ওখানেই বাটিতে করে রাখা আছে বাকি তরকারিগুলো।একটা বাটিতে করলা ভাজি দেখেই আরাবী বলল,’ আমি করলা ভাজি দিয়ে ভাত খাবো।’
জায়ান আরাবীর এহেন কথায় একবার আরাবীর দিকে তো একবার করলা ভাজির বাটির দিকে তাকাচ্ছে।ওকে এমন করতে দেখে আরাবী বিরক্ত হয়ে বলে,’ কি হলো এমন করছেন কেন?’
জায়ানের কণ্ঠে স্পষ্ট বিষ্ময়,’ তুমি সিয়র তুমি এটা দিয়েই খাবে?’
‘ হ্যা।কেন কি হয়েছে।’
‘ না কিছু হয়নি।আচ্ছা ঠিকাছে।’
জায়ান করলা ভাজি দিয়ে ভাত মেখে আরাবীকে দিতেই আরাবী বিনাবাক্যে খেয়ে নিল।জায়ান প্রশ্ন করল,
‘ এখন ঠিক আছে?’
‘ হ্যা।দিন আমাকে।এটা অনেক ভালো।’
আরাবী করলা ভাজি দিয়েই অনায়াসে সবটুকু ভাত শেষ করে নিল।খাওয়া শেষে জায়ান বলে,
‘ আর ভাত নিব?আর খাবে?’
‘ নাহ।পেট ভরে গেছে।’
জায়ান এইবার নিজেও খেয়ে নিল।এঁটো থালাবাটিগুলো পাশের টি-টেবিলে রেখে হাত ধুয়ে আসল।রুমের লাইটগুলো নিভিয়ে গিয়ে আরাবীর পাশে সুয়ে পরল।আরাবী এসে জায়ানের বুকে মাথা রাখল।জায়ান দুহাতে আরাবীকে নিজের সাথে জড়িয়ে নিলো ভালোভাবে।তারপর আরাবীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে,’ ঘুমিয়ে যাও।শরীর ভালো না তোমার।’
জায়ানের আদুরে হাতের স্পর্শে একপর্যায়ে ঘুমিয়ে পরলো আরাবী।কিন্তু ঘুম নেই জায়ানের চোখে।মাথাটা চিন্তায় ফেটে যাচ্ছে।আরাবীর হঠাৎ কি হলো?মাছের তরকারি অনেক প্রিয় আরাবীর।সেই তারকারি ওর মুখের সামনেও নিতে পারলো না ও।আর করলা ভাজি তো দেখলেই আরাবী দশ হাত দূরে সরে যায়।আর আজ কিনা সেই মেয়ে করলা ভাজি দিয়েই ভাত খেলো।আর আরাবী স্বাভাবিকভাবে এতো ভাত খায় না।আজ তুলনামূলকভাবে স্বাভাবিকের তুলনায় একটু বেশিই ভাত খেয়েছে।হঠাৎ আরাবীর এমন পরিবর্তনগুলো দেখে জায়ানের চিন্তা লাগছে মেয়েটার জন্যে।এটা সেটা ভেবে মধ্যরাতের দিকে জায়ানের চোখ লেগে আসল।আর সেইভাবেই ঘুমিয়ে পরলো।
__________
কোচিং-এর ক্লাসে একদম মনোযোগ নেই নূরের।ওর ধ্যানজ্ঞান সবটা মগ্ন সামনে থাকা পুরুষটার উপর।পুরুষটা বড্ড নিষ্ঠুর।তাইতো ভুল করেও তাকাচ্ছে না নূরের দিকে।কেন এমন করছে লোকটা?কি এমন করেছে ও? যার কারনে লোকটা এমন রেগে আছে?কোচিং-এ আসার পথে ফাহিমের সাথে দেখা হয়েছিল পথে নূরের।নূর ভেবেছিল ফাহিম ওকে দেখে ওর কাছে আসবে।কিন্তু তা সম্পূর্ণ ভুল প্রমান করে নূরকে দেখা সত্ত্বেও বাইক ছুটিয়ে চলে গিয়েছে।এমনটা মোটেও আশা করেনি নূর।ব্যথিত হৃদয় নিয়ে একলাই আসে এখানে।কিন্তু এখানে এসেও একই অবস্থা।ফাহিমের কাছ থেকে কোন প্রকার রেস্পন্সই পাচ্ছে না ও।হঠাৎ কারো তিক্ত কণ্ঠে হুশ ফিরে আসে নূরের।ফাহিম বলছে,’ মিস নূর।ক্লাসে এসে যদি প্রেম ভালোবাসা নিয়ে চিন্তা ভাবনা করেন তাহলে আমি বলব আমার ক্লাসে আপনি আর আসবেন নাহ।আপনার কারনে আমার অন্য স্টুডেন্ট্সদের সমস্যা হয়।’
ক্লাসের সবাই হেসে উঠল ফাহিমের কথায়।ফাহিম ধমকে উঠল,’ সাইলেন্স।হাসির কি আছে এখানে?চুপচাপ ক্লাসে মনোযোগ দিন সবাই।’
ফাহিমের ধমকে সবাই চুপ হয়ে গেল। নূরের পিছনে বসা একটা মেয়ে ফিসফিস করে বলছে,’ ফাহিমের স্যারের কি হয়েছে কে জানে?স্যার তো এতো রাগি না। কাল থেকেই দেখছি অযথা ভীষণ রাগারাগি করছেন।’
‘ আমিও জানি না দোস্ত।তবে যাই বলিস নূরকে যা বলল না স্যার। আমার অনেক হাসি পেয়েছে।’
‘ আমারও হা হা হা।’
নূর সবই শুনল।নূরের চোখে জল টলমল করছে।নূর সবসময়েই একজন ভালো স্টুডেন্ট। কখনও পড়া নিয়ে বা রেজাল্ট নিয়ে ওর বাবা মায়ের হা হুতাশ করতে হয়নি।আর এমনকি কখনও স্কুল,কলেজ থেকে বিচারও যায়নি ওদের বাড়িতে।কোনোদিন স্যারদের থেকে কটু বাক্যও শোনেনি।আর আজ এমন একটা কথা শুনলো ও।তাও নিজের প্রিয় মানুষটার কাছ থেকেই।সবার সামনে হাজির পাত্র বানাল ফাহিম ওকে।নূর নিজের অস্রু লুকাতে মাথা নিচু করে নিল।আর একবারও তাকাল না ফাহিমের দিকে।সম্পূর্ণ ক্লাস এইভাবেই শেষ করল ও।ক্লাস শেষ হতেই সবার আগেই বের হয়ে গেল।না চাইতেও এইবার গাল গড়িয়ে পরল চোখের জল।ও কি কোন ভুল করল?ফাহিম তো ওকে কোনোদিন বলেনি যে ফাহিম ওকে ভালোবাসে।ও কি অনেক বেশিই আশা করছে ফাহিমের কাছ থেকে? নাকি ভালোবেসে ও অনেক বেশিই বেহায়া হয়ে গিয়েছে?ফাহিম হয়তো নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে।নূরকে ও একটুও পছন্দ করে না।হয়তো অন্য মেয়েকে ভালো লাগতে শুরু করেছে এখন।আনমনা হয়ে হাটছিল নূর।রাস্তার পাশে অনেকগুলো ঝোপঝাড় হঠাৎ সেই ঝোপঝাড়ের মাঝে হঠাৎই নূরের হাত লেগে গেল।কাটা গাছের ঝোপ ছিল বোধহয়।তাই নূরের হাত ছি’লে রক্ত বের হয়ে আসল।ব্যথায় মৃদ্যু আওয়াজ করে উঠল।হঠাৎই কেউ এসে ওর সেই ব্যথাযুক্ত হাতটা টেনে নিল নিজের কাছে।নূর কান্নার কারনে লাল হয়ে যাওয়া চোখ দিয়েই তাকাল।নজরে আসল ফাহিমের উদ্বিগ্ন মুখশ্রী।ফাহিম নূরের হাত ওর দুহাতের মাঝে নিয়ে অস্থির হয়ে বলছে,’ কিভাবে হাটো?দেখে হাটতে পারো নাহ?দেখলে তো কিভাবে হাতটায় ক্ষ’র হলো।এমন কেন তুমি?নিজের প্রতি বিন্দু পরিমান কেয়ার নেই তোমার।’
নূর চোখ সরিয়ে নিল।মনের ব্যথার তুলনায় এই ব্যথা তার জন্যে কিছুই না।ও কিছু না বলে টেনে হাতটা ছাড়িয়ে নিলো ফাহিমের হাতের থেকে।তারপর কিছু না বলে কাধের হাতটা ভালোভাবে আঁকড়ে ধরে সামন্ব্র দিকে হাটা ধরল।ফাহিম নূরের আচড়ণে হতবাক।কতো বড় সাহস মেয়েটার।ওকে কিছু না বলেই চলে যাচ্ছে।রাগে চোয়াল শক্ত হয়ে আসল ফাহিমের।তেড়েমেড়ে এগিয়ে গেল নূরের কাছে।বিনাবাক্যে নূরের বাহু খামছে ধরে ওকে নিজের দিকে ফিরালো।ফাহিম রাগে হিসহিস করে বলে,’ কি সমস্যা তোমার?কথা বলছিলাম না আমি?তাহলে আমায় উপেক্ষা করে চলে যাওয়ার সাহস পেলে কোথায় তুমি?’
নূর বরাবরের মতোই শান্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করল ফাহিমের দিকে।নূরকে কোনপ্রকার কথা বলতে না দেখে ফাহিম ধমকে উঠে,’ কি সমস্যা?কথা বলছিস না কেন?আমাকে কি তোর পাগল মনে হয়?যে ফাউ কথা বলতে থাকব তোর সাথে?’
‘ আপনিই না বলেছিলেন আপনার চোখের সামনেও যেন না আসি?তাহলে সমস্যাটা আমার কোথায়?আমি তো আপনার কথাই পালন করছি।আপনি এমন করছেন কেন?আপনার সমস্যাটা কি?’ অভিমানি কণ্ঠে বলল নূর।
ফাহিম দুকদম এগিয়ে আসল নূরের কাছে।তারপর নূরের দু বাহু খামছে ধরে তীব্র আক্রোশপ্রসূত মনোভাব পোষণ করে বলে,’ আমার সমস্যা তুই।তুই-ই আমার সবচেয়ে বড় সমস্যা।আমার সবকিছু তোর কারনে এলোমেলো হয়ে গিয়েছে।খেতে গেলে তোর কথা মনে পরে,বসতে গেলে তোর কথা মনে পরে,শুতে গেলেও তোর কথা মনে পরে।আমি খেতে পারি না,শান্তিতে বসতে পারি না,ঘুমোতে পারি না।সর্বদা তুই আমার মস্তিষ্কে কিলবিল করে ঘুরে বেড়াস।তুই তো আমাকে যন্ত্রনা দিয়ে শান্তি পাস।তাই তো কাল কি সুন্দর অনায়াসে ম’রে যাওয়ার কথা বললি।একবারও ভাবলি ওইপাশের ব্যক্তিটার কেমন লেগেছে তোর কথা শুনে।কতোটা কষ্ট পেয়েছে সে।যদি ভাবতিই তাহলে কাল ওইসব কথা বলতি না। এখন বল আমার এতো এতো সমস্যার একমাত্র কারন তুই।আমাকে এইভাবে যন্ত্র’না দেওয়ার জন্যে তোকে কি শা’স্তি দিব বল তো?’
#চলবে___________