#হৃদয়াসিক্ত_কাঠগোলাপ
#সাদিয়া_জাহান_উম্মি
#পর্বঃ৪৭
সাখাওয়াত বাড়িতে আজ মানুষের আনাগোনায় ভরপুর।জিহাদ সাহেব তার পরিবার নিয়ে এসেছেন।আলিফাও এসেছে ওকে ইফতি গিয়ে নিয়ে এসেছে।বসার রুমে সবার আড্ডা চলছে।আরাবী চুপচাপ বসে।তার ভালো লাগছে না কিছুই।সকাল থেকেই প্রচন্ড খারাপ লাগছে ওর।আলিফা আরাবীর শুকনো মুখ দেখে ওর কাছে গিয়ে বসল।ধীর আওয়াজে ডেকে উঠে,’ আরাবী?’
আলিফার ডাকে চোখজোড়া খুলে আরাবী বলে, ‘ হুম কিছু বলবি?’
‘ তোর কি হয়েছে?খারাপ লাগছে তোর?’
‘ আসলে তেমন কিছুই না।সকাল থেকেই কেমন যেন লাগছে।’
আলিফাকে চিন্তিত দেখাল।কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে কিছু একটা ভাবল।অতঃপর ওর ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠল।ওকে এমন হাসতে দেখে আরাবী ভ্রু-কুচকে বলে,’ আমি অসুস্থ আর তুই হাসছিস?’
আলিফা ওর বত্রিশ পাটি দাঁত দেখিয়ে দিল।তারপর আবার সিরিয়াস হয়ে গেল।অত্যন্ত মনোযোগ সহকারে আরাবীকে জিজ্ঞেস করে, ‘ তোর কি খাবার দেখলে বমি পায়? সত্যি করে বলবি।’
আরাবী অতোশতো না ভেবে সত্যি কথাই বলল, ‘ হ্যা ইদানিং বমি পায়।’
‘ মাথা ঘুরায়।’
‘ ওতোটাও না। তবে মাঝে মধ্যে।’
‘ ঘন ঘন ক্ষিদে পায়?’
‘ হ্যা।আর আমি খাচ্ছিও অনেকগুলো করে খাবার।’
‘ হুট হাট মুড সুয়িং হয়?’
‘ হ্যা হয়!’
‘ তোর লাস্ট পিরিয়ড কবে হয়েছিল?’
এই প্রশ্নটা ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল আলিফা।আরাবী চোখ বড় বড করে তাকাল আরাবীর দিকে।এইবার একনিমিষেই বুঝে গেল আলিফা কিসের ইঙ্গিত দিচ্ছে।আলিফা শুকনো ঢোক গিলে বলে,’ সত্যিই কি এটা হবে আলু?’
‘ তুই তোরটা ভালো জানিস।আমি যাস্ট ইঙ্গিতগুলো ধরিয়ে দিলাম।বাকিটা তোর হাতে।’
আরাবী দুহাতে মুখ ঢেকে নিল।ওর শরীর কাঁপছে।সত্যিই কি এটা হবে? ও কি মা হতে চলেছে? ওর পিরিয়ডের ডেট অনেক অভার হয়ে গিয়েছে।এতো ঝুট ঝামেলার মাঝে তো সেটা খেয়ালই নেই আরাবীর। আলিফা আরাবীর অবস্থা বুঝতে পেরে ওর কাধে হাত রাখল।আরাবী ছলছল চোখে ওর দিকে তাকাল।আলিফা হেসে বলে,’ বোকা মেয়ে।কাঁদছিস কেন?’
‘ আমি কি সত্যি মা হবো আলিফা?’
‘ আল্লাহ্ যদি রহমত করেন। আর এতে কান্নার কি আছে?এটা খুশির খবর।’
‘ আমি তো খুশিতে কাঁদছি।’
‘ ধুর এতো কান্না কাটি করে লাভ নেই।আমি বলে কি তুই একটা প্রেগ্ন্যাসি কিট এনে টেস্ট করে দেখে নিস।অথবা তুই হাসপাতালে গিয়ে টেস্ট করতে পারিস।এটাই বেস্ট হবে।এটায় একেবারে ১০০% সিউর হতে পারবি।’
আলিফার কথায় আরাবী মাথা নাড়িয়ে সায় জানাল।ইস,সত্যিই কি ও মা হবে? উপরওয়ালার কাছে দোয়া করল আরাবী যাতে এটা যেন সত্যি হয়।আচ্ছা জায়ান যখন জানবে সে বাবা হতে চলেছে। তখন লোকটা কি করবে?খুশিতে কি করবে লোকটা?যদিও এটা অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে হয়ে গিয়েছে।এখনও বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে কোন প্লানিং করেনি ওরা।তবুও উপরওয়ালার রহমত বর্ষণ করে দিয়েছেন।তাই উপরওয়ালার দরবারে লাখো কোটি শুকরিয়া আদায় করে নিল।এটাই যেন হয়।আরাবীর খুশিতে তো পাগল পাগল লাগছে। ছুটে চলে যেতে ইচ্ছে করছে জায়ানের কাছে।লোকটা সেইযে বেড়িয়েছে কোন খবর নেই।কে বলে স্পেশাল একজন নাকি আসবে।তাকে আনতে গিয়েছে।কে এমন স্পেশাল মানুষটা কে জানে।আরাবী বুকের মাঝে চাপা উত্তেজনা নিয়ে অধীর আগ্রহে প্রিয় মানুষদের অপেক্ষা করতে লাগল।
——
এদিকে আলিফা খুশিতে পারে না চিল্লিয়ে বাড়ি মাথায় উঠিয়ে ফেলতে।নিজ বাড়িতে হলে এতোক্ষণে তাই করত।এখন আছে শশুড়বাড়ি।নিজেকে অনেক কষ্টে কন্ট্রোল করে রেখেছে।এইবার আল্লাহ্ আল্লাহ্ করে ওর ভাবনাটা একশো পার্সেন্ট সিউর হলেই হলো।আলিফা যখন নিজের ভাবনায় ব্যস্ত।এমন সময় ওর ফোনের টোন বেজে উঠল।ভাবনা চ্যুত হয়ে আলিফা ফোন হাতে নিয়ে দেখে ইফতির মেসেজ।মেসেজটা ওপেন করল আলিফা।সেখানে লিখা,
‘ একটু উপরে আসবে।কথা আছে।’
আলিফা মেসেজটা পড়া শেষ করেই আশেপাশে তাকাল এখানে সবাই আছে।ইফতির কাছে যেতে হলে সবার সামনে দিয়ে গিয়ে সিড়ি পেড়িয়ে তারপর যেতে হবে।যা ওর কাছে লজ্জার বিষয়।আর এখন এটা ওএ শশুডবাড়ি।বাগদানের পর এইটাই ওর প্রথম আসা।আলিফার রিপ্লাই মেসেজ লিখল,
‘ এখানে সবাই আছে।কিভাবে আসব?’
‘ সবাই আছে তো কি হয়েছে?’
‘ সবার সামনে দিয়ে সিড়ি ডিঙিয়ে আপনার রুমে যাব আমি।মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে আপনার?’
‘ মাথা তো অনেক আগেই খারাপ হয়ে গিয়েছে।যবে থেকে তোমার প্রেমে পরেছি।’
‘ ফ্লার্টিং বন্ধ করুন।আর এতোগুলো মানুষ আমরা নিচে আপনি উপরে কি করছেন?’
‘ ভাবছিলাম তোমার সাথে একটু রোম্যান্স করব।তাই রুমে এসেছিলাম।এখন সেই ঘুরে বালি।’
আলিফা হেসে দিল ইফতির মেসেজে।তারপর লিখে,
‘ রোম্যান্সের ধান্দা বাদ দিন।এই মুহূর্তে ভদ্র ছেলের মতো।’
‘অভদ্র হয়েছি আমি তোমারি প্রেমে , তাই
কাছে আসো না আরো কাছে আসো না’
‘উফ কি শুরু করলেন।নিচে আসুন।’
‘ আসছি।’
আলিফা লাজুক হেসে মাথা নত করে নিল।ইফতি টাও যে এমন।লোকটার কথায় এতো লজ্জা পায় আলিফা।তবে যাই হোক ভালোলাগে আলিফার ইফতির এই স্বভাবটা।
______
আরাবী জিহাদ সাহেব আর লিপি বেগমের দিকে বার বার তাকাচ্ছে। উশখুশ করছে কিছু জিজ্ঞেস করার জন্যে।জিহাদ সাহেব অনেকক্ষন যাবত মেয়েকে এমন আনচান করতে দেখে এইবার বলে উঠলেন,’ কিরে মা কিছু বলবি?’
বাবার কথায় যেন ভরসা পেল আলিফা।
‘ তোমাকে অনেকদিন একটা কথা জিজ্ঞেস করব।কিন্তু তুমি আর মা যদি কষ্ট পাও তাই সাহস করে উঠতে পারছি না।’
লিপি বেগম বলেন,’ তুই নির্দ্বিধায় আমায় বল মা।’
আরাবী সাহস পেয়ে বলে উঠে,’ মা ফিহা কোথায়?ওকে কেন দেখিনা।প্রায় মাস পেড়িয়ে গেল ওর কোন খবর পেলাম নাহ।কি হয়েছে ওর?ও কি এখনও আমায় ঘৃ’না করে মা?’
আরাবীর কথায় তারা জিহাদ সাহেব আর লিপি বেগমের মুখ অন্ধকার হয়ে গেল।চুপ হয়ে গেলেন তারা।নিহান সাহেব বলে উঠেন,’ আসলেই ভাই। মানছি ফিহা যা করেছে সেটা অন্যায়।তবে এভাবে আর কতোদিন চলবে?ওর কোন খবরই নেই একদম।’
ফাহিম বাবা মায়ের দিকে তাকাল।তারপর আরাবীর দিকে তাকাল।বাবা মায়ের কষ্টটা বুঝল ফাহিম।ওর নিজেরও কম কষ্ট হচ্ছে না ফিহার জন্যে।হাজার খারাপ হোক বোন তো ওর।ফাহিম বাবা মা’কে চুপ থাকতে দেখে নিজেই বলে উঠল,’ ফিহাকে আমরা লন্ডন পাঠিয়ে দিয়েছি।ওর এখানে থাকা ভালো হবে না।ওর মনে তোর প্রতি এতোই ঘৃ’না যে ওর মস্তিষ্ক কোনটা ভালো কোনটা মন্দ তাও মানছে না।উন্মাদের মতো হয়ে গিয়েছে।মা যখন নিজের ভুল বুঝতে পারে।তখন ওকেও বলেছিল তোর কাছে এসে যেন ও ক্ষমা চায়।ও মাকেও আক্রমন করতে গিয়েছিল।তাই সবটা বিবেচনা করে তোর জন্যে,ওর জন্যে মোট কথা আমাদের সবার ভালোর জন্যে ওকে দূরে পাঠিয়ে দিয়েছি।দূরে গিয়ে যদি মেয়েটা পরিবারের গুরুত্ব বুঝে।’
ফাহিমের বুক ভার হয়ে আসল।চোখটা জ্বলছে।বোনের জন্যে বুকের ভীতর হাহাকার করছে।কেমন আছে মেয়েটা কে জানে? অভিমান করে আছে অনেক ওদের প্রতি।তাই তো লন্ডন যাওয়ার পর কোন প্রকার যোগাযোগ করেনি ওদের সাথে।জিহাদ সাহেবও মেয়ের জন্যে বুকটা পু’ড়ে যাচ্ছে।সন্তান যতোই খারাপ হোক।সন্তান তো সন্তানই।লিপি বেগম চোখ থেকে পানি ঝরছে।মেয়েটার সাথে আজ কতোদিন হলো তিনি কথা বলেন নাহ।কতোদিন হলো ফিহার কণ্ঠে মা ডাক শোনা হয় না।এসবই যে উনার পাপের ফল তা উনি ভালো ভাবেই জানেন।তবুও উপরওয়ালার কাছে উনি সর্বদা চান তার মেয়েটাকেও যেন তার মতো সুবুদ্ধি দান করেন।সময় থাকতে ভালো পথে ফিরে আসে।পরিবার, পরিজন যে কতোটা গুরুত্বপূর্ণ তা যেন মেয়েটা বুঝতে পারেন।
এদিকে আরাবী স্তব্ধ। ও কোনদিন ভাবতেও পারেনি।বাবা মা এমন একটা সিদ্ধান্ত নিবেন।শেষে কিনা ফিহাকে সবার থেকে এতো দূরে পাঠিয়ে দিলেন।তারা তো ওর জন্মদাতা পিতা মাতা না।তাও ওর ভালোর জন্যে নিজের জন্ম দেওয়া সন্তানকে তাদের থেকে দূরে সরিয়ে দিলেন।আরাবী কি বলবে ভেবে পেল না।আপন মা বাবারাও তো সন্তানের জন্যে এতোটা করে না।আর ও তো দত্তক নেওয়া।কুড়িয়ে পাওয়া সন্তান তাদের।কৃতজ্ঞতায় বুক ভার হয়ে আসে আরাবীর।সোজা গিয়ে ঝাপিয়ে পরে জিহাদ সাহেবের বুকে।কাঁপা গলায় বলে উঠে,’ আমার জন্যে আজ ফিহাকে এতো কষ্ট করতে হচ্ছে।আমার জন্যে ওকে এতো দূরে গিয়ে পরিবার ছাড়া থাকতে হচ্ছে।আমায় ক্ষমা করে দিও বাবা।আমার জন্যে তোমাদের এতো কষ্ট সহ্য করতে হচ্ছে।’
জিহাদ সাহেব মেয়েকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে বলেন,’ কে বলেছে তোর জন্যে?আমরা ওর জন্যে,ওর ভালোর জন্যেই ওকে দূরে সরিয়েছি।তাই একদম নিজেকে দোষারপ করবি না।’
আরাবী ছলছল চোখে বাবার দিকে তাকিয়ে তারপর আবার মায়ের দিকে তাকাল।কান্নারত গলায় বলে,’ আমায় ক্ষমা করে দিও মা।আমার কারনে তুমি তোমার সন্তান থেকে দূরে।’
লিপি বেগম আরাবীর গালে মমতাময়ী হাতের স্পর্শ দিয়ে বলেন,’ এইসব কি ক্ষমা টমা চাচ্ছিস তুই।লন্ডন পাঠিয়েছি ফিহার ভালোর জন্যেই।ওখানে গিয়ে ওর পড়ালেখাও ভালো হবে।নিজেকে সময় দিতে পারবে।পরিবারের ভালোবাসা কি সেটাও বুঝবে।আর আমার এক মেয়েকে দূরে পাঠিয়েছি তো কি হয়েছে?আরেক মেয়ে তো এখানেই আছে।’
আরাবী লিপি বেগমকে জড়িয়ে ধরল।সবার ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠল বাবা মা আর সন্তানের এই আবেগঘন মূহুর্ত দেখে।ঠিক এমন সময় বাড়ির কলিংবেল বেজে উঠল।সাথি বেগম বলেন,’ ওই তো জায়ান এসে পরেছে বোধহয়।মুন্নি যা তো দরজাটা খুলে দিয়ে আয়।’
মিহান সাহেব বলে, ‘ কে এমন স্পেশাল মানুষটা এসেছে দেখতে তো হবেই।যার জন্যে আজ জায়ান কাউকেই কোন কাজে যেতে দেয়নি।’
‘ এইতো চাচ্চু।এখন অনায়াসে তাকে দেখে নিতে পারো।’
জায়ানের কণ্ঠস্বর পেয়ে সবাই দরজার দিকে তাকাল।আরাবীর ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটল জায়ানকে দেখে।পরক্ষণে ওর পাশে দাঁড়ানো একজন মধ্যবয়স্ক থেকে একটু বেশি বয়স হবে এমন একজন মহিলাকে দেখে ভ্রু-কুচকালো। কে এই মহিলা?একে তো কোনদিন দেখেনি আরাবী? আরাবী সাথি বেগমের দিকে তাকিয়ে ধীরে বলে উঠে,’ ইনি কে মা?’
সাথি বেগম নিজেও আজ প্রথম দেখলেন এই মহিলাকে।তাই আরাবীর প্রশ্নে তার ভাবুক গলার উত্তর,’ আমি নিজেও জানি না মা।আমি তো আজ তাকে প্রথম দেখলাম।’
সাথি বেগমও চিনেন না।আরাবী অবাক নজরে তাকিয়ে রইল জায়ান আর ওই মহিলাটির দিকে।
এদিকে দরজার দিকে একজনের নজর যেতেই যে ওর বুকের কাঁপন বেড়ে গিয়েছে।হাঁপা’নি রোগের ন্যায় শ্বাস নিচ্ছেন তিনি।ভয়ে তার হাত পা কাঁপছে। বরফের ন্যায় শীতল হয়ে পরেছে দেহ।বাইশ বছর পর আবার সেই মুখের সাথে দেখা পেলেন তিনি।বাইশ বছর আগের অতীত কি এইবার সবার সামনে আসতে চলেছে?আর কি পারবেন না তিনি তা লুকিয়ে রাখতে?এদিকে জায়ান তার দিকে তাকিয়ে বাঁকা হাসি দিল।এতে যেন তার গলা আরও শুকিয়ে গেল।মরুভূমির মতো।তার কণ্ঠনালি ভেদ করে কাঁপা স্বরে একটা নাম বেড়িয়ে আসল অস্ফুটস্বরে, ‘ রোজি?’
#হৃদয়াসিক্ত_কাঠগোলাপ
#সাদিয়া_জাহান_উম্মি
#পর্বঃ৪৮
স্তব্ধ,বিমুঢ় আর ভয়মিশ্রিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা শামিম সাহেবকে দেখে জায়ানের ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠল।তারপর ডা.হোসনে আরা রোজিকে ধীর আওয়াজে বলে উঠে,’ খেলা তো পুরো জমে যাচ্ছে আন্টি।’
‘ তা দেরি কিসের?চলো যাওয়া যাক।’
‘ হ্যা,চলুন আন্টি।’
জায়ান ডা.রোজিকে নিয়ে এগিয়ে গেল সবার মাঝে।রোজি সালাম জানালেন।সবাই সালামের জবাব নিলেন।নিহান সাহেব বলে উঠলেন,’ জায়ান কে উনি?উনাকে চিনলাম না তো বাবা।’
জায়ান ডা. রোজিকে বসতে বলে নিজেও সোফায় আয়েশ করে বসল।বলল,’ বোসো সবাই।তারপর পরিচয় করাচ্ছি।’
সবাই বসল জায়ানের কথায়।জায়ান নিজের হাতের আঙুলগুলো নড়াচড়া করে দেখতে দেখতে হঠাৎই তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করল শামিম সাহেবের দিকে।শামিম সাহেব যেন ভড়কে গেলেন এতে।জায়ানের ওই তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ভয়ে র’ক্ত হিম হয়ে যাচ্ছে উনার।জায়ান বাঁকা হাসল তার এই অবস্থা দেখে।পরক্ষনেই বলে,’ ফুপা আন্টিকে খুব ভালোভাবে চেনেন।কি বলেন ফুপা?চিনেন তো?’
মিথিলা স্বামির দিকে তাকালেন।স্বামির ভয়ার্ত মুখশ্রী দেখেই বুঝে নিলেন।কিছু একটা খারাপ হতে চলেছে।
শামিম সাহেব জায়ানের কথা শুনে কাঁপা কাঁপা গলায় বলে, ‘ এ…এসব তুই ক..কি বলছিস বাবা? আমি একে চিনিনা।’
‘ সত্যি চিনো নাহ?’
‘ নাহ!’
নিহান সাহেব ছেলের হোয়ালিপনায় বিরক্ত হয়ে গেলেন।বললেন,’ হচ্ছেটা কি জায়ান?সোজাসাপ্টাভাবে উনার পরিচয় করিয়ে দিলেই তো হয়? এতো হোয়ালি করছ কেন?’
জায়ান শামিম সাহেবের দিকেই তাকিয়ে।সেই অবস্থাতেই দাঁত খিঁচিয়ে বলে,’ বাইশ বছর ধরে তো তোমরা হোয়ালিপনার মাঝেই ছিলে বাবা।আজ আমি নাহয় একটু হোয়ালি করলাম।এতে ক্ষতি কি?’
সাথি বেগম চিন্তিত কণ্ঠে বললেন,’ তুই এসব কি রকম কথাবার্তা বলছিস বাবা?’
‘ এখনই সব জানতে পারবে মা।আজ আর কোনো লুকোচুরি হবে না।সব সত্য আজ সবার সামনে বেড়িয়ে আসবে।’
জায়ান দৃষ্টি তাক করল আরাবীর দিক।মেয়েটা তাকিয়ে ওর দিকে।ওই দৃষ্টিজোড়ায় কি অসীম প্রেম তার জন্যে।এক আকাশসম ভালোবাসা দেখতে পায় জায়ান আরাবীর ওই চোখজোড়ার দিকে তাকালে।ওই আদুরে মুখশ্রীর মায়া মায়া চাহনী দেখলেই মনটা জুড়িয়ে যায় জায়ানের।জায়ান একপা দুপা করে এগিয়ে যায় আরাবীর কাছে।আরাবী প্রশ্নোসূচক চোখে তাকিয়ে আছে।জায়ান আরাবীর নরম হাতজোড়া নিজের শক্তপোক্ত হাতজোড়া দিয়ে আঁকড়ে ধরল।তারপর নরম কণ্ঠে বলে উঠল,’ আমার স্ট্রং গার্ল তুমি তাই নাহ বলো?’
আরাবী কিছুক্ষণ অবাক চোখে তাকিয়ে রইল জায়ানের দিকে।পরক্ষণে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিল।জায়ান হালকা হেসে বলে,’ আমি জানতাম তুমি এটাই বলবে।’
জায়ানের হঠাৎ এইসব কথাবার্তায় আরাবীর কেমন যেন লাগছে।তাই জিজ্ঞেস করল,’ কিন্তু হয়েছে কি?আমাকে বলবেন আপনি?’
‘ এখনই সব জানবে।তুমি কোনোভাবেই ভেঙে পরবে না।সাহস রাখবে মনে।ভরসা রাখবে নিজের উপর।আমার উপর।আমি আছি তো তোমার জন্যে।আমার শেষ নিশ্বাস অব্দিই থাকব।’
আরাবী চুপচাপ জায়ানের কথাগুলো শুনল।তার মনটা কু ডাকছে।কি এমন করতে চলেছে জায়ান?যার জন্যে লোকটা ওকে এসব কথা বলছে।জায়ান আরাবীর হাত ধরে নিয়ে সেইভাবেই এগিয়ে গেল ডা.রোজির কাছে।তারপর হাসি মুখে বলে,’ আন্টি এইটাই হলো আরাবী।আমার স্ত্রী।’
ডা.রোজি ছলছল চোখে তাকিয়ে আছেন আরাবীর দিকে।এই মেয়েটাকেই কিনা? মা’রার জন্যে পাঠিয়ে দিয়ছিল ও অন্যের হাতে দিয়ে।মেয়েটার মায়াভরা মুখশ্রীটা দেখেই অনুশোচনাগুলো যেন কিলবিল করে আঁকড়ে ধরল উনার হৃদপিণ্ডটা।তিনি আরাবীর একহাত ধরে সেই হাতের উপর উনার কপালটা ঠেকিয়ে কেঁদে উঠলেন।কান্নারত কণ্ঠে বলতে লাগলেন,’ আমায় ক্ষমা করে দেও মা।আমায় ক্ষমা করে দেও।তোমার সাথে অনেক বড় অন্যায় করেছি আমি।আমায় ক্ষমা করে দেও।বিগত বাইশটা বছর আমি অনুশোচনায় প্রতি মুহূর্ত দগ্ধ হয়েছি।তিলে তিলে যা আমায় ভীতর থেকে শেষ করে দিচ্ছিল।তুমি আমায় মাফ করো মা।অনেক জঘ’ন্য অন্যায় কাজ করেছি আমি।’
আরাবী দ্রুত উনার হাতের থেকে হাত ছাড়িয়ে নিল।তারপর ডা.রোজির বাহু ধরে সোজা করে দাঁড় করিয়ে বলে,’ এসব কি বলছেন আপনি আন্টি।কিসের ক্ষমা চাইছেন আপনি।আমি তো আপনাকে চিনিই না।তাহলে আমার সাথে অন্যা’য় করলেনই বা কিভাবে?’
ডা.রোজি চোখ মুছলেন।আরাবীর কথায় জবাব না দিয়ে এগিয়ে গেল শামিম সাহেবের দিকে।তিনি বিষ্মিত হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন।এ কি হচ্ছে?কিসব দেখছেন উনি?আর রোজি-ই বা আরাবীর কাছে এইভাবে মাফ চাইছে কেন?তবে কি সেদিন ওই বাচ্চাটাকে রোজি মা’রেনি?আর…আর সেই বাচ্চাটাই কি এখনকার আরাবী?কিন্তু কিভাবে সম্ভব?কিভাবে?এটা হবার নয়।বাচ্চাটা মা’রা গিয়েছে।এ হতে পারে না।ওনার ভাবনার মাঝেই রোজি এসে উনার সামনে উপস্থিত হন।শামিম সাহেব ভড়কে গেলেন।তা দেখে রোজি হাসলেন।ঠান্ডা গলায় বলে উঠেন,’ কেমন আছিস রাশেদ?’
শামিম সাহেব চমকে উঠলেন।জায়ান ভ্রু উচিয়ে বলে উঠল,’ আরে আন্টি শুধু রাশেদ বললে তো হবে না।পুরো নামটা বলবেন নাহ?আচ্ছা আমি বলে দিচ্ছি।মি.রাশেদুল শামিম শেখ।কি ঠিক বলছি তো ফুপা?’
শামিম ভয়ার্ত গলায় বলেন,’ কি হচ্ছে কি এসব?তোমরা এমন করছ কেন আমার সাথে?’
জায়ান রাগি গলায় বলে, ‘ আমরা কোথায় করলাম ফুপা?করেছ তো তুমি।নিজের স্ত্রীর মৃ’ত্যুতে উল্লাস করেছ।নিজের সদ্যোজাত সন্তানকে মা’রার জন্যে অন্যকে মোটা অংকের টাকা দিয়েছ।যাতে তোমার কুকীর্তি সম্পর্কে কেউ না জানে।’
ভয়ে বুকটা ধরাস করে উঠল শামিমের।এই সত্য জায়ান জানল কিভাবে?হঠাৎ ডা.রোজির দিকে নজর যেতেই বুঝলেন।রোজিই আছে যে জায়ানকে সব বলে দিয়েছে।শামিমের মাথায় ধপ করে রাগ উঠে গেল।তারপর এতো বছরের পরিকল্পনা সব ভেস্তে গেল।বাইশটা বছর ধরে যেই সত্যকে তিনি ধাপাচাপা দিয়ে রেখেছিলেন আজ তা সবার সামনে বেড়িয়েই আসল।শামিম রেগে তেড়েমেড়ে এগিয়ে গেল রোজির কাছে।রাগে হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে বলেন,’ তুই এমন কিভাবে করলি আমার সাথে?তোকে মুখ বন্ধ রাখতে বলেছিলাম না আমি? তার জন্যে মোটা অংকের টাকাও দিয়েছিলাম তোকে।তাহলে কেন আমার সাথে বেঈমানী করলি বল?কেন করলি?আজ তো তোকে মেরে ফেলব আমি।’
শামিম রোজির গলা চেপে ধরল।ইফতি আর ফাহিম এসে দ্রুত রোজিকে ছাড়িয়ে আনল শামিমের কাছ থেকে।জায়ান রেগে ফোঁস ফোঁস করতে এগিয়ে গেল শামিমের দিকে।তারপর শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে চড় লাগাল শামিমের গালে।হুংকার ছুড়ে বলে,’ তোর সাহস কিভাবে হলো এটা করার?তুই আমার বাড়িতে থেকেই আমার মানুষদের মারার চেষ্টা করিস।’
জায়ানের এমন ব্যবহারে সবাই অবাক।শামিম সম্পর্কে ওর ফুপা হয়।সেই ফুপার সাথে এমন বেয়াদবি আচরণ নিশ্চয়ই শোভা পায় না।নিহান সাহেব ছেলের এমন আচরণগুলো অবাক হয়ে দেখছেন।তবে তিনি এটুকু জানেন তার ছেলে অন্যায়ভাবে কোনোদিন কারো সাথে এমন বিহেইভ করতে পারেন নাহ।আর গুরুজনদের তো একেবারে না-ই।এর পিছনে নিশ্চয়ই কোন কারন আছে।এদিকে মিথিলা স্বামির সাথে জায়ানের এমন ব্যবহার দেখে তেতে উঠে বলেন,’ বড় ভাইয়া এসব হচ্ছে টা কি?তোমার সামনে তোমার ছেলে আমার স্বামির সাথে এমন বেয়াদবি করছে। আর তুমি কিছু বলছ না কেন?’
নিহান সাহেব তাকালেন না অব্দি মিথিলার দিকে।তিনি জায়ানের উদ্দেশ্যে বেশ শান্তভাবেই বলে উঠেন,’ জায়ান সবাইকে সবটা খুলে বল।কেন তুমি এমন করছ?আর শামিমই বা কি করেছে?আর কিসের সত্যির কথা বলছ তুমি? সবটা বলো।’
#চলবে___________