হৈমন্তীকা পর্ব ৬

হৈমন্তীকা

৬.
দরজার একদম মধ্যিখানে বিশাল বড় নেমপ্লেটে নামের জায়গায় গুটিগুটি অক্ষরে লেখা, ‘It is forbidden to bother at special times and for no reason. Stranger girls are strictly forbidden to come. ‘Coz I hate it! And mustly nock the door.’

আফতাব সাহেব বিড়বিড় করে পড়লেন পুরো চার বাক্যের ইংরেজী পাঠ্যটি। দীর্ঘশ্বাস ফেলে কড়া নাড়লেন দরজায়। দুই, তিনেক বার কড়া নাড়তেই ভেতর থেকে আওয়াজ এলো, “কে?”
আফতাব সাহেব থমথমে গলায় জবাব দিলেন,
— “আমি।”

মিনিট পেরোতেই আলস্য ভঙ্গিতে দরজা খুললো তুষার। ভ্রু কুঁচকে আফতাব সাহেবের দিকে তাকিয়ে, মাথার পেছনের অংশের চুলে হাত বুলিয়ে প্রশ্ন করলো,
— “তুমি হঠাৎ এখানে? কিছু বলবা?”
— “পড়ালেখার কি খবর তোমার? কি করছো আজকাল?” আগের মতোই থমথমে গলা উনার।
তুষারের কপালে আরেকটু দৃঢ় ভাঁজ পড়লো। প্রশ্নাত্মক চাহনিতে তাকিয়ে উত্তর দিলো,
— “ভালোই চলছে। কয়েকদিন পর টেস্ট এক্সাম আছে। ওটারই প্রিপারেশন নিচ্ছি। তুমি হঠাৎ এসব জিজ্ঞেস করছো কেন?”
— “কারণ তুমি পড়ালেখা করছো না। বখাটেগিরি করে বেড়াচ্ছ। প্রায় প্রতিদিনই তোমার মারপিটের কমপ্লেন আসে আমার কাছে। আজকে তো আমাদের বিল্ডিংয়ের হৈমন্তী নামের মেয়েটাও এসেছিল। তুমি নাকি ওকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়েছো?”
— “না। আমি উনাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছি।”

বেশ স্বাভাবিক কণ্ঠে বললো তুষার। যেন সে জানতো, এমন পরিস্থিতিতে পরতে হবে তাকে। এবং সে এর জন্য প্রস্তুতও হয়ে ছিল। ছেলের কাঠকাঠ উত্তরে আফতাব সাহেব খানিক থমকালেন। অবিশ্বাস্য চোখে তুষারের দিলে চেয়ে বললেন,
— “মেয়েটা তিন বছরের বড় তোমার, তুষার! তাছাড়া তুমি অনার্সে উঠেছ মাত্র। এসব চিন্তা আসে কোথা থেকে তোমার? আদরে, আহ্লাদে পাগল হয়ে গেছ নাকি?”
তুষার কণ্ঠস্বর আরও শীতল করলো,
— “একদম না। আমি সুস্থ মস্তিষ্কেই আছি। আর হৈমন্তীকাকেই বিয়ে করতে চাই।”
আফতাব সাহেব ধমক দিয়ে উঠলেন,
— “নিজের চেয়ে তিন বছরের বড় মেয়েকে বিয়ে করতে চাওয়াকে সুস্থ মস্তিষ্ক বলো তুমি? আমি তোমাকে ওয়ার্নিং দিচ্ছি তুষার। ওই মেয়ে থেকে দূরে থাকবে। আবার যদি তোমার নামে এমন বাজে কমপ্লেন আসে, তো আমার চেয়ে খারাপ কেউ হবে না।”

চেঁচামেচি শুনে তুষারের মা হেনা চলে এলেন সেখানে। আফতাব সাহেবকে জিজ্ঞেস করলেন,
— “কি হয়েছে? ছেলেকে এভাবে বকছো কেন?”
শুনে যেন আরও তেঁতে উঠলেন তিনি। গলার আওয়াজ বাড়িয়ে বললেন,
— “তোমার ছেলে পাগল হয়ে গেছে, হেনা। নিজের চেয়ে বয়সে বড় মেয়েকে বলে কি-না বিয়ে করবে! কিছু বলো একে।”
হেনা বিস্ফোরিত নয়নে ছেলের দিকে তাকালেন। প্রশ্ন ছুড়লেন,
— “তুষার? তোর বাবা কি বলছে এসব?”
— “জানি না মা।” একটু থেমে আবার বললো, “টেবিলে নাস্তা বাড়ো তো মা। ক্ষুধা লেগেছে। আমি হাত-মুখ ধুয়ে আসছি।”

বলেই কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে নিঃশব্দে দরজা আটকে দিলো সে।
আফতাব সাহেব রেগে গেলেন,
— “দেখেছো? দেখেছো তোমার ছেলেকে? কি পরিমাণ বেয়াদব হয়েছে! আমাদের মুখের ওপর দরজা আটকে দিলো।”
হেনা শান্ত ভাবে ব্যাপারটা সামলাতে চাইলেন,
— “এবার থামো তো! পরে কথা বলো এ নিয়ে। এখন একটু শান্ত হও।”
আফতাব সাহেব শান্ত হলেন না। একদফা রাগারাগি করার পর নিজের রুমে চলে গেলেন। একটু পরেই আবার উঁচু গলায় হাঁক ছাড়লেন,
— “হেনা? একগ্লাস ঠান্ডা পানি আনো।”

_____

সকাল ৯টা ৩০.
ভার্সিটির বিরাট বড় কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে বসে আছে হৈমন্তী। আজকে এখনো পারু আসে নি। হৈমন্তী উদাস মনে একটা চ্যাপ্টার পড়ার চেষ্টা করছে। আকস্মিক, কোত্থেকে তুষার এসে বসল তার পাশে। হৈমন্তী ভ্রু কুঁচকে তাকালো। কিন্তু তুষার তাকালো না। তার ফর্সা মুখটা গরমে ঘর্মাক্ত হয়ে আছে। কপালে বেন্ডেজ এখনো বিদ্যমান। চেহেরায় এক আলাদাই ক্লান্তি। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিঁজিয়ে, এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে তুষার বললো,
— “আপনার কাছে পানি আছে হৈমন্তীকা?”

হৈমন্তী জবাব দিলো না। কিছুপলক ভ্রু কুঁচকে চেয়ে থেকে ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করলো। তুষারের দিকে এগিয়ে দিতেই সে বিনাবাক্যে নিয়ে নিলো বোতলটি। আঘাত প্রাপ্ত হাত দিয়ে বোতলের ঢাকনা খুলে যেই না মুখে দিতে যাবে, ওমনি হৈমন্তী দ্রুততার সঙ্গে বলে উঠল,
— “বোতলে মুখ লাগাবেন না!”
তুষার ভ্রু উঁচালো। কথাটা শুনেই নি এমন ভাব করে মুখ লাগিয়ে ঢকঢক করে পান করে নিলো পুরো অর্ধেক পানি। হৈমন্তী তখন ঝাঁঝালো স্বরে আঁওড়ালো,
— “সমস্যা কি? মুখ লাগাতে মানা করেছি না? তাও এমন করলেন কেন?”

তুষার ধীর স্থির ভঙ্গিতে বোতলের ঢাকনা লাগালো। সবুজ দূর্বাঘাসের ওপর বোতলটি রেখে শান্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো হৈমন্তীর পানে। বললো,
— “আপনি যদি তখন ওই কথাটা না বলতেন, আমি বোতলে মুখ লাগাতাম না। তাই দোষ আপনার।”

হৈমন্তী তাজ্জব বনে গেল,
— “আমার দোষ? আপনি এমন কেন বলুন তো তুষার! আমাকে জ্বালানো কবে বন্ধ করবেন?”
— “যখন আমার নিশ্বাস থেমে যাবে।”
— “বাজে কথা বন্ধ করুন। আপনার বাবা কি আপনাকে কিছু বলে নি?”
— “বলেছে।”
— “বকা খেয়েছেন উনার কাছে?”
— “হ্যাঁ।”
— “তবুও নির্লজ্জের মতো আমার কাছে এসেছেন কেন?”
তুষার নির্বিকার ভাবে বললো,
— “কারণ আমার লজ্জা নেই।”

হৈমন্তীর রাগ যেন এবার আকাশসম হয়ে গেল। রাগে আর কিছু বলার ইচ্ছেই মিইয়ে গেল তার। শব্দ করে ঘাসের ওপর থেকে বোতলটি নিয়ে, ব্যাগে পুরে নিতেই তুষার প্রশ্ন করলো,
— “আপনি আমাকে আপনি করে ডাকেন কেন হৈমন্তীকা? আপনার মনে তো আমার জন্য কিছুই নেই। তাহলে?”
— “কে বলেছে কিছু নেই? ছোট ভাই হিসেবে যথেষ্ট আদর করি আপনাকে। আর হ্যাঁ, ঘনিষ্ঠতা নেই এমন ছোট বড় সবাইকেই আপনি বলে ডাকি আমি। আপনি কেন ব্যতিক্রম হবেন?”

তাচ্ছিল্য ভাবে বললো হৈমন্তী। পালটা জবাব দিতে পারলো না তুষার। শক্ত মুখে বসে রইলো। তারপর যখন দেখল হৈমন্তী চলে যাচ্ছে, তখন আবার বললো,
— “চলে যাচ্ছেন হৈমন্তীকা?”
— “হ্যাঁ।”
— “আরেকটু বসুন।”

ভীষণ মায়াময় কণ্ঠে আবদার করে উঠল সে। হৈমন্তীর মন গলে গিয়েও গললো না যেন। বাহ্যিক দিকে শক্ত রইলো সে। তাকে উপেক্ষা করে চলে গেল। তুষার পিটপিট নেত্রে চেয়ে রইল সেদিকে।

_____

হেমন্তর কাছে তুষার হলো একটা প্রিয় নাম। তুষারের সাথে বেশ খাতির তার। এ নিয়ে কম বকা খায়নি সে হৈমন্তীর কাছে। হৈমন্তীর এক কথা, “তুষারের সঙ্গে মেলামেশা করা যাবে না মানে যাবে না!”

হেমন্ত শুনে না সেকথা। যতই বকা দেওয়া হোক না কেন, সে সর্বদাই তুষারের পেছনে আঠার মতো লেগে থাকে। হৈমন্তীও এখন হাল ছেড়ে দিয়েছে প্রায়।
বারান্দার গাছ গুলোতে পানি দিচ্ছিলো হৈমন্তী। তার অত গাছের প্রতি নেশা নেই। রাবেয়ার আছে। তিনিই গাছগুলো রেখেছেন এখানে। যার পরিচর্যা করতে হয় তাকে। অবশ্যক এতে খারাপ লাগে না তার। ভালোই লাগে। তার সবচেয়ে প্রিয় ফুল হলো বেলী। বেলীর ঘ্রাণে মনটা কেমন নিমিষেই ভালো হয়ে যায় তার।

হৈমন্তী বেলী ফুলের গাছে পানি দিচ্ছিল। হঠাৎ হেমন্ত দৌঁড়ে এলো তার কাছে। অত্যাধিক উত্তেজনার সঙ্গে বললো,
— “জানো আপু কি হয়েছে?”

হৈমন্তী আগ্রহহীন ভাবে জবাব দিলো,
— “কি হয়েছে?”
— “তুষার ভাইয়ার জ্বর হয়েছে। ভয়াবহ জ্বর। এক’শ দুই ডিগ্রি!”
হৈমন্তীর কপাল কুঁচকে গেল,
— “মানে?”

___________________

চলবে…
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা
~অনুগ্রহ করে গঠনমূলক মন্তব্য করবেন। ভালোবাসা❤

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here