#হয়ত
পর্ব:- ২০
.
-‘ চলো তাপৌষি আজ আমরা সাদা ভাত খাবো সাথে সবজি, মুরগির ঝোল আর আচার। চলবে?’
বর্ষণের প্রশ্নের উত্তর দিশা দিল।
-‘ দৌড়াবে বড় ভাইয়া।’
খাবারের মেন্যু শুনে রৌদ মুখ শুকনা করে তাকিয়ে ছিল। যখন দেখল কেউ ওর শুকনা মুখের দিক তাকাচ্ছে না তখন নিজে থেকেই নিজ কষ্টের কথা বলা আরম্ভ করলো।
-‘ ভাইয়া আমি ভাবছিলাম ব্যাংকক থেকে ধরে আনা মুরগি খাবো। তোমার এই মুরগির ঝালে যদি ব্যাংককের মুরগি ইউস করা না হয়?’
-‘ রৌদ ফাজলামি করবি না।’
-‘ আমি ফাজলামি করছি না। আমি ব্যাংকক চিকেন খাবো। চেস্ট কেমন জানতে ইচ্ছা করছে।’
বর্ষণ রৌদের কথায় সাড়া না দিয়ে একজন ওয়েটারকে ডাকলো। পছন্দমত খাবার অর্ডার করলো। কিন্তু রৌদ অদ্ভুত এক কাজ করে বসলো। ওয়েটারের হাতের কলমটা টপ করে নিজ হাতে নিয়ে জ্ঞানী জ্ঞানী মুখ বানিয়ে প্রশ্ন করলো,
-‘ এই সকল অর্ডারকৃত খাবারের সাথে ব্যাংকক চিকেন নিয়ে আসবেন। দেশি চিকেন আনলে দোতলা দোকান একতলায় নামানোর ব্যবস্থা করবো। বুঝেছেন?’
লোকটা কী বলবে বুঝতে পারছে না। এরকম অদ্ভুত মানুষ সে তার তিন বছরের চাকরি জীবনে কখনো দেখেনি।
বর্ষণ রৌদের হাতের কলম ওয়েটারকে ফিরিয়ে দিয়ে বলল
-‘ ভাই আমাদের আর কিছু লাগবে না। ও মজা করছে। ব্যাংকক চিকেনও লাগবে না। আপনি খাবার একটু তাড়াতাড়ি দিবেন।’
লোকটা যেন এই ধরণের কথার অপেক্ষাতেই ছিল। দ্রুত সে পা চালিয়ে ওদের টেবিল থেকে চলে গেল। তারপর বর্ষণ রৌদের কানের কাছে মুখ নিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
-‘ তাপৌষি অনেক হেসেছে। ওকে হাসাচ্ছিস ভালো কথা। তবে হাসাতে যেয়ে যে নিজে জোকার সাজচ্ছিস সে দিকে খেয়াল আছে? আশে পাশে তাকিয়ে দেখ। মানুষ তোকে এলিয়েন ভাবছে।’
রৌদ আশেপাশে তাকিয়ে দেখল। সত্যি অনেকে অদ্ভুত চোখে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। ধুর এভাবে যেচে নিজের বেইজ্জতি করা উচিত হয়নি।
একটু আগের বেইজ্জতি লুকাতেই রৌদ তাপৌষির সাথে গল্প জুড়ে দিয়েছে। তাপৌষির এখন ভালো লাগছে। একটু আগের মতো জান ঘাটছে না। এসির বাতাসে মাথা ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। দিশা যদিও ওকে সরাসরি এসির বাতাসের আশেপাশে বসায় নি।
.
-‘ তো তাপৌষি ঢাকায় কোথায় কোথায় ঘুরবার ইচ্ছা?’
-‘ দেখি।’
-‘ কী দেখি? তুমি বলো। আমরা নিয়ে যাব।’
-‘ এখনো ঠিক করিনি ভাইয়া।’
-‘ আমি কয়েকটা জায়গার নাম বলি তুমি তা শুনো। ঢাকায় কিছু দর্শনীয় স্থান ও স্থাপনা আছে। যেমন:- ঢাকা চিড়িয়াখানা, মিরপুরের শাক্যমুনি বৌদ্ধ বিহার, লালবাগের কেল্লা, সামরিক জাদুঘর (বিজয় সারণি, তেজগাঁও), কাওরান বাজারের সার্ক ফোয়ারা, আগারগাঁও এর মুক্তিযুদ্ধ জাদুগর, রায়ের বাজার বধ্যভূমি স্মৃতিসৌধ, জাতীয় প্যারেদ স্কয়ার, কবি ভবন (ধানমন্ডি), শিখা চিরন্তন (সোহরাওয়ার্দি উদ্যান), শিখা অনির্বাণ (ঢাকা সেনানিবাস), বলধা গার্ডেন, বোটানিক্যাল গার্ডেন, বাংলাদেশ সচিবালয়, তিন নেতার মাজার, মুক্তি ও গণতন্ত্র তোরণ, জাতীয় জাদুঘর, জাতীয় স্মৃতিসৌধ, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, পাবলিক লাইব্রেরি, সেনা কল্যাণ ভবন, হাইকোর্ট চত্ত্বর এর কদম ফোয়ারা, বিটিভি ভবন, দোয়েল চত্ত্বর, শিল্পকলা একাডেমি, শিশু একাডেমি, বাংলা একাডেমি (নজরুল সড়ক, ঢাবি), বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র (শেরে বাংলা নগর), আহসান মঞ্জিল, বাংলাদেশ সচিবালয়, সংসদ ভবন (শেরে বাংলা নগর), আসাদগেট, শাহবাগ, তারা মসজিদ (লালবাগ), সাতগম্বুজ মসজিদ (মোহাম্মদপুর), আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট (সেগুনবাগিচা), ফ্যান্টাসি কিংডম (আশুলিয়া, ঢাকা), নন্দন পার্ক, রমনা পার্ক, শিশু পার্ক, যমুনা ফিউচার পার্ক, বসুন্ধরা কমপ্লে…..’
-‘ ছোট ভাইয়া থাম এবার, খাবার চলে এসেছে। খেয়ে আবার বলা শুরু করিস।’
দিশার কথায় রৌদ দম নেয়। তাপৌষি চোখ বড়বড় করে রৌদকে দেখছে। ওর কাছে রৌদকে এখন এলিয়েন এলিয়েন লাগছে।
.
-‘ কী দেখছ তাপৌষি?’
-‘ এটাই সেই বিখ্যাত গোলাপ শাহ্ মাজার?’
রৌদ তাপৌষির কথা শুনে বিড়বিড় করে বলল, “লউ ঠেলা। এই মাজারের আগরবাতির গন্ধের এই মেয়ে পেটের সব খাবার বমি করে ঢাকা শহর ভাসায়ে দিল। আর মাজার এখন খেয়াল করলো?’
-‘ কিছু বললেন ভাইয়া।’
-‘ আরে নাহ। গোলাপ শাহ্ মাজার সম্পর্কে জানতে চাও?’
-‘ জি। আপনি জানেন?’
-‘ জানবো না কেন? শুনো
গুলিস্থানের গোলাপ-ফুল আল্লাহর কুতুব বাবা হযরত গোলাপ শাহ আউলিয়া মাজার এটি। পাক-মহাভারত মাজার। গুলিস্থান জামে মসজিদের বিপরীত পাশে অবস্থান। হযরত সেকান্দার শাহ্ ইয়ামেনি (র) ২০০ বছর পূর্বে বাংলাদেশে ইসলাম প্রচার করার উদ্দেশ্যে আগমন করেন এবং তাহার ইন্তেকালের পর তাকে সসম্মানে নিম গাছ তলি নামক স্থানে সমাহিত করা হয়।তখন এই মাজার নিম গাছ তলীর মাজার নামে লোক মুখে পরিচিত হয়ে উঠে। এর কয়েক দশেক পর হজরত গোলাপ শাহ্ (র) নামে এক কামেল সূফী ভারত উপমহাদেশ থেকে আগমন করেন এবং সারা জীবন সেকান্দার শাহ্ বাবার খিদমতে কাটিয়ে দেন। পরবর্তীতে তাকে সেকান্দার শাহ্ বাবার ডান পাশে সমাহিত করা হলে, তখন থেকে এই মাজারের নাম হয়ে যায় গোলাপ শাহ্ বাবার মাজার।
আজ পর্যন্ত গোলাপ শাহ্ মাজারের পাশে একবারের জন্যও কোন গাড়ি দুর্ঘটনা হয় নি, অথচ প্রতিদিন সে গোলাপ শাহ্ মাজারের পাশ দিয়ে লক্ষ লক্ষ গাড়ি যাওয়া-আসা করছে। (সংগৃহিত)
আশ্চর্যের বিষয় না?’
-‘ বড় ভাইয়া থামতে বলো একে।’
-‘রৌদ..’
-‘ কী হয়েছে? আমি তো তাপৌষিকে তথ্য দিচ্ছিলাম।’
-‘ তোর তথ্য রাখ। বাড়ি ফিরতে হবে। রিকশা ডাক।’
দিশা তাপৌষির দৃষ্টি অনুসরণ করে সামনে তাকাল।
-‘ওটা টমটম তাপৌষি। আরেক দিন চড়বো ওতে। ঠিক আছে?’
-‘ আচ্ছা আপু।’
.
পুরানা পল্টনে রিকশা ঢোকার পর তাপৌষির মনে হলো এখানকার মানুষ মনে হয় সবচেয়ে উঁচু বিল্ডিং বানানোর প্রতিযোগিতায় নেমেছে। বাড়িগুলো সর্বনিন্ম ছয় তলা তো হবেই। ওরা এসে থেমেছে ‘অদিতি টাচ’ (কাল্পনিক) নামের একটি এপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সের সামনে। দিশা আর ও এক রিক্সায় এবং রৌদ ও বর্ষণ আরেক রিক্সায় এসেছে। তাপৌষি ভেবেছিল এদের কাছে গাড়ি থাকবে। যেহেতু এদের বাবা ছেলে মেয়ের জন্য ফ্ল্যাট কিনে দিয়েছে তাইলে গাড়ি কিনে দেওয়া তো কোন ব্যাপারই না। কিন্তু ওদের গাড়ি নেই। এপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সে ঢোকার সময় সিকিউরিটি গার্ডটা কেমন চোখে যেন তাকাল তাপৌষির দিকে।
সিকিউরিটি গার্ডটার নাম রুবেল ইসলাম। গত দুইবছর ধরে এই এপার্টমেন্টে নিযুক্ত। রুবেল ছাড়াও আরও দুইজন গার্ড এখানে নিযুক্ত।
উচ্চ মাধ্যমিকে তিনবার ফেল করে আর পরীক্ষা না দেওয়া রুবেলের চাকরি হয়েছে ওর এক দুঃসম্পর্কের আত্মীয়ের মাধ্যমে। বয়স পঞ্চাশ ছুঁইছুঁই। বর্ষণ, দিশা এবং রৌদ সম্পর্কে রুবেলের একটা নোংরা ধারণা আছে। ও এদের মাঝকার ভাইবোনের সম্পর্ককে কুৎসিত নজরে দেখে। দিশার দিকে নোংরা চোখে তাকায়। পিছে এই পরিবারকে নিয়ে হাসি ঠাট্টা করে। আজ তাপৌষিকে নিয়েও ওর মনে জঘন্য এক চিন্তা জন্ম নিয়েছে। তবে বর্ষণ কিংবা রৌদের সামনে এই লোকটা কখনো নিজের আসল রূপ দেখায় না।
.
-‘ তাপৌষি খারাপ লাগছে?’
-‘ না দিশা আপু। আসলে লিফটে চড়ার অভ্যাস নেই খুব একটা। মাথা ঘুরায় উঠলে।’
-‘ ওহ। আর একটু।’
-‘ কয় তলাতে থাকো তোমরা?’
-‘ আট তলা। খুব কষ্ট হচ্ছে? পানি খাবে? দুপুরে তো কিছুই খেলে না।’
-‘ না আপু কষ্ট হচ্ছে না বেশি। ইট’স ওকে। চিন্তা করো না।’
.
.
চলবে…