হয়ত পর্ব ৩৫(শেষ)

#হয়ত
পর্ব:- ৩৫
.
বর্ষণ আজ ভীষণ ব্যস্ত। এক বার্থডে পার্টির দুইশত লোকের খাবার যাবে ওর রেস্তোরাঁ থেকে। কর্মচারীরা কাজ করছে, বর্ষণ সব তত্ত্বাবধান করছে।

গতকাল রেস্তোরাঁয় একটা বড় ধরণের ঝামেলা হয়েছে। ইলিয়াস হোসেন নামের একজন ফুড ব্লগার বর্ষণের কাছে অনেক দিন যাবত চাঁদা চেয়ে আসছে। কিন্তু বর্ষণ চাঁদা দিতে রাজি নয়। বলা বাহুল্য ইলিয়াস হোসেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকের খুব জনপ্রিয় মুখ। দুটো ফুড গ্রুপের এডমিন সে। বর্ষণ বরাবরই এই চাঁদা বাজদের পছন্দ করে না। নিজের কষ্টে উপার্জিত টাকা কেইবা দিতে চায়? বর্ষণ টাকা দিতে রাজি হয়নি। ইলিয়াস তাই চার- পাঁচদিন আগে নিজের দুইজন লোক পাঠিয়েছিল বর্ষণের রেস্তোরাঁতে খাবার খেতে। ওরা খাবার খাওয়ার পর ফূড গ্রুপে রেস্তরাঁ সম্পর্কে নেগেটিভ রিভিউ দেয়। এরপর ইলিয়াস ফোন দিয়ে টাকা দাবি করে। এও বলে টাকা দিলে পোষ্ট ডিলিট করে দেওয়া হবে। বর্ষণ ইলিয়াস হোসেনের সাথে কথোপকথনের রেকর্ড নিজের ফেসবুক ওয়ালে শেয়ার করে। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ইলিয়াসের লোক গতকাল বর্ষণকে শাসাতে আসে। এক কথা দু’কথায় ঝামেলা অনেক বড় হয়ে যায়।

ফোনের রিংটোন শুনে বর্ষণ পকেট থেকে ফোন বের করলো।
-‘ হ্যালো বর্ষণ?’
-‘ জি, কে বলছেন?’
-‘ আমি অথৈ। ‘
-‘ ওহ অথৈ বলো।’
-‘ এতো বছরেও আমার নাম্বারটা সেভ না করার কারণ কী আমি জানতে পারি?’
-‘ ব্যস্ত আছি। সেভ করাই আছে খায়াল করি নি। কী জন্য ফোন দিয়েছ সেটা বলো।’
-‘ তুমি বদলে গেছ বর্ষণ। কথায় কথায় রাগ দেখাও।’
বর্ষণ গলাটা যথাসম্ভব স্বাভাবিক এনে বলল,
-‘ কী হয়েছে অথৈ? ‘
-‘ আমার সাথে একটু দেখা করতে পারবে?’
-‘ আজ নয়। আজ ব্যস্ত আছি।’
-‘ প্লিজ বর্ষণ।’
-‘ আচ্ছা বিকালে দেখা করব। কোথায় যেতে হবে টেক্সট করে দিও।
————————
-‘ তাপৌষি আর ইউ শিউর?’
-‘ অফ কোর্স।’
-‘ এই চাকরিটা সত্যি করতে চাও?’
-‘ সামিরা আমার এখন একটা চাকরির খুব দরকার। আমি চলতে পারছিনা। হোস্টেলের বিল বাকী রয়েছে। খাবারের টাকা দিতে পারছিনা।’
-‘ আচ্ছা রেডি থেকো। কাল আমি তোমাকে নিয়ে যাব। আর প্লিজ এমন ড্রেস পড়ো না। শীতের ওই ভোটকা পোশাক গায়ে দিবা না। এখন মোটেও শীত নেই।’
-‘ আচ্ছা। তাহলে কী পড়বো আমি?’
-‘ জিন্স, কুর্তি আর স্কার্ফ পড়ো। এই রকম ঢোলা পায়জামা আর জামা পড়বা না। ফার্স্ট ইম্প্রেশন বলে তো একটা কথা আছে তাইনা?’
-‘ আচ্ছা পড়ব। কিন্তু আমার যে জিন্স নেই।’
সামিরা আপাদমস্তক তাপৌষিকে দেখে বলল,
-‘ আমার জিন্স নিও। আমারটা তোমার হবে।’
—————
বর্ষণ রেস্তোরাঁ থেকে সরাসরি অথৈর সাথে দেখা করতে এসেছে। আজ ওর বাসায় খেতে যাওয়া হয়নি।
-‘ কী দরকারে ডেকেছ?’
-‘ হাল-চাল জিজ্ঞেস করলে না যে?’
-‘ মাথা ঠিক নাই অথৈ। কাজ শেষ করে এখানে এসেছি সরাসরি। ‘
-‘ চলো রমনায় যাই। বটতলার ওখানে বসবো। তোমার তো প্রিয় জায়গা। রাস্তায় দাঁড়িয়ে আবার কথা বলা যায় নাকি?’
-‘ না অথৈ। ‘
-‘ কেন না? চলো। ‘
-‘না।’
-‘ হুর..চলো তো।’
-‘ বললাম তো যাব না। কেন বারবার জ্বালাচ্ছ তাপৌষি?’

অথৈ বর্ষণের দিকে তাকিয়ে হাসল। বর্ষণ অপরাধীর মতো মাথা নুইয়ে রেখেছে। মনে হচ্ছে এখন বিরাট কোন অন্যায় সে করে ফেলেছে।

অথৈ আস্তে করে বর্ষণের হাত ধরে বলল,
-‘ চলো হাটতে হাটতে কথা বলি।’

আজ আকাশে মেঘ নেই। পরিষ্কার আকাশ। দুপুরের দিকে অবশ্য কড়া রোদ উঠেছিল। শহরবাসীর কথায়, ঢাকা শহরেও এবার প্রচণ্ড ঠাণ্ডা পড়েছিল। তবে লেপ কম্বল গায়ে না নিয়ে এরা ফ্যান ছেড়ে দিয়ে কাঁথা নিয়েছিল।

-‘ আমি তোমাকে খুব ছোট থেকে ভালোবাসি বর্ষণ। জানো তো?’
বর্ষণ অথৈর কথার কোন জবাব দেয়না। চুপ করে হাটছে। ওকে দেখে মনে হচ্ছে হাটা চলা করতে পারা এক জীবন্ত পুতুল।
অথৈ কিছুক্ষণ থেমে আবার বলল,
-‘ আমি ভালোবাসি তোমাকে, অথচ তুমি ভালোবাস তাপৌষিকে। তাপৌষিও তোমাকে ভালোবাসে। তাহলে আমি কে? আমার অবস্থান কোথায় বর্ষণ?’

অথৈ বর্ষণের হাত ছেড়ে ওর সামনে দাঁড়াল; চোখের কোণে জল মুছে এক চিলতে হাসল। রমনার এই জায়গায় এখন বেশি মানুষ নেই।

-‘ রাজশাহী যাও বর্ষণ। তাপৌষিকে নিয়ে এসো। আমি ভালোবাসাহীন কোন সম্পর্ক কখনও চাইনি। তোমাকে তোমার দায়বদ্ধতা থেকে আজ এই মুহূর্তে আমি মুক্তি দিলাম।’
বর্ষন অবাক চোখে অথৈকে দেখছে। আসলে ও ওর কান কে বিশ্বাস করাতে পারছে না ও ঠিক শুনেছে তো?

-‘ যাও বর্ষণ।’
-‘ আই এম সরি অথৈ। খুব সরি।’
-‘ উঁহু তোমার তো কোন দোষ নেই। ভালোবাসা তো আর বলে কয়ে আসে না।’
এতো দিন মনে হচ্ছিল বুকের উপর কেউ এক টনের পাথর চাপিয়ে রেখেছিল। বর্ষণ ধীরে ধীরে সেই পাথর সরে যাওয়ার অনুভূতি পাচ্ছে। প্রাণ খুলে একটা শ্বাস নিয়ে ও বলল,
-‘ ধন্যবাদ অথৈ। ‘
প্রতি উত্তরে অথৈ শুধুই হাসলো।

চোখে জল, মুখে হাসি, শ্যামবর্ণা এই মেয়েটিকে দেখতে বর্ষণের খারাপ লাগছে না। ও তো চেয়েছিল এর সাথেই জীবন সাজাতে। ভালোবাসা না থাকুক তাতে কী? সব সংসারে ভালোবাসা থাকে না। তবে “তাপৌষি” এসে সব এলোমেলো করে দিল। বর্ষণের সব পরিকল্পনা ভেস্তে দিল।
-‘ যাও বর্ষণ।’

বর্ষণ হেটে চলে যাচ্ছে। অথৈ বুঝে গেছে এই বর্ষণ আর কখনো অথৈর কাছে আসবে না। অথৈ কখনো একে নিয়ে ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখতে পারবে না। এই বর্ষণ তাপৌষির বর্ষণ। অথৈ নিস্তেজ দেহ নিয়ে ঘাসের উপর বসে পড়ল। বিড়বিড় করে বলে উঠল,
” ভালো থেকো আমার ভালোবাসা।”
—————-
বর্ষণ বাসায় এসে প্রথমেই রৌদের ঘরে যেয়ে তাপৌষির নাম্বার চাইলো।
-‘ আমার কাছে নাই ভাইয়া।’
-‘ মিথ্যা বলিস না রৌদ। নাম্বার দে। আমি ওকে ফিরিয়ে আনতে যাব। আমার হবু বউয়ের নাম্বার আমাকে দিবি না?’
রৌদ চিৎকার করে বলে উঠল,
-‘ সত্যি ভাইয়া?’
-‘ আস্তে চিল্লা। দে নাম্বার দে।’
বর্ষণের তাড়ায় রৌদ দ্রুত বিছানার উপর পড়ে থাকা ফোনটা বর্ষণের হাতে দিল। তাপৌষির নাম্বার নিজের ফোনে তুলে নিয়ে বর্ষণ রৌদকে ওর ফোন ফেরত দিল। তারপর বলল,
-‘ তাপৌষিকে জানাবি না। এটা ওর জন্য সারপ্রাইজ। ‘
-‘ আচ্ছা। এমনিতেও একমাস ধরে লজ্জায় কথা বলিনি। তুমি কী এখন রওনা দিবা? দিশা জানে?’
-‘ দিশা জানে। আমার ঘরে ব্যাগ গুছিয়ে দিচ্ছে। রাতের ট্রেনের টিকিট পাইনি। কাল সকালে রওনা দিব।’
-‘অল দ্য বেস্ট ভাই।’
—————-
কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে ট্রেন ছাড়ার কথা ছিল ৭:৩০। কিন্তু ট্রেন ছেড়েছে সকাল আটটায়। আর মাত্র কিছুক্ষণের পথ বাকি। ট্রেন যমুনা সেতু অলরেডি ক্রস করে ফেলেছে। তাপৌষির আর অপেক্ষা করতে হবে না।
.
” তোমার মুঠো ভর্তি স্বপ্ন সাজানোর নায়ক
এক আমি হবো।
যে তোমার স্বপ্নগুলোকে রঙিন পাখনা দিবে।
তোমার ক্লান্ত বিকেলের শীতল হাওয়া
এক আমি হবো।
যে তোমার ক্লান্তিগুলোকে এক নিমিষে মুছে দিবে।
তোমার ইচ্ছাপূরণের যন্ত্র
এক আমি হবো।
যে তোমার ইচ্ছাগুলোকে সারাজীবন মাথায় করে রাখবে।”
.
-‘ বউ বুঝি?’
পাশের সীটে থাকা এক বয়স্ক বৃদ্ধ লোকের কথায় বর্ষণ ঘাড় ঘুরায়। লোকটি বর্ষণের ফোনের ওয়ালপেপারের দিকে ইঙ্গিত করছে।
-‘ হবু বউ চাচা।’
-‘ খুব ভালোবাসিস তাইনা?’
-‘ হুম।’
বৃদ্ধ উদাসী গলায় বলল,
-‘ ভালোবাসার মানুষকে কখনো হারাতে দিবি না বেটা। একবার ভালোবাসা হারালে ফিরে পাওয়া যায় না।’
বর্ষণ জানালার বাইরে দৃষ্টি ফেলল। ডান হাতটা বুকের বা’ পাশে রেখে সীটে হেলান দিল।
.
” আমার ভালোবাসা
তোমায় দিলাম আমার নির্ঘুম একশ রজনী
কিংবা
আমার ডায়রির কবিতার প্রতিটি শব্দ।
জানি, অপেক্ষায় আছো তুমি।
অপেক্ষা করছি আমিও।
এইতো আর কিছুটা পথ দেরি
অপেক্ষার হবে সমাপ্তি।”……
—————-
-‘ সামিরা আমার ড্রেসাপ ঠিক আছে তো?’
-‘ আরে হ্যাঁ?’
-‘ অফিসটা কোথায়?’
-‘ এইতো বেশি দূরে না।’
সামিরা হাত বাড়িয়ে একটা রিকশা ডাকল।
-‘ মামা শিরোইল কলোনি মাঠ স্কুলের একটু সামনে নামব।’
তাপৌষি সামিরার কথা শুনে ওর দিকে তাকাল। রেল স্টেশনের পেছনে। এই জায়গায় বড় অফিস কোনটা?

তাপৌষি আজ রেশমিকে লুকিয়ে বের হয়েছে। রেশমি যখন জানতে পারবে তাপৌষি সামিরার সাথে বের হয়েছে কী তুলকালামই না বাঁধাবে! তাপৌষির ভয় লাগছে।
.
সামিরা রিকশা থামাল একটা আবাসিক হোটেলের সামনে।
-‘ তুমি হোটেলে চাকরি করো? রিসেপশনে বসো?’
-‘ হ্যাঁ ওই রকমই।
-‘ ওহ।’

সামিরা ভাড়া মিটিয়ে তাপৌষিকে বলল,
-‘ শুনো তাপৌষি তোমার ইন্টার্ভিউ নিবে পারসোনালি আমাদের হেড বস। উনি যা বলবে বুঝে শুনে উত্তর দিবে। যা বলবে তাই করবে।’
-‘ মানে?’
-‘ এই ধরো তোমাকে বেড কভার বদলাতে বলতে পারে বা অন্য কোন কাজ।’
-‘ ঠিক আছে।’

তাপৌষি বসে আছে রিসেপশন কাউন্টারের সামনে রাখা সোফায়। সামিরা ওকে রেখে গেছে তো গেছেই। আসার আর নাম নেই। হঠাৎ ওর ফোনে বিপ করে একটা ম্যাসেজ এলো।

” অপেক্ষার শেষ হলো।
রাজশাহী রেলস্টেশনে দুপুর দুটোয় ট্রেন থামবে। এতো এক্সাইটেড যে আগেই বলে দিলাম। আসবে তো?
বর্ষণ”

তাপৌষি ম্যাসেজ পড়েই বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেছে। বর্ষণ আসছে। ওর অপেক্ষার অবসান ঘটেছে। একবার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে জলদি ব্যাগ কাঁধে নিল। আর মাত্র ত্রিশ মিনিট বাকী। দ্রুত যেতে হবে ওকে। বেশি দূরে নয় তো। একটুখানি হেটে ওভারব্রিজ ব্যবহার করলেই স্টেশন।

-‘ তাপৌষি কোথায় যাচ্ছ? ‘
-‘ আমার খুব জরুরি দরকার। প্লিজ।’
-‘ না এভাবে তো হবে না। আমি স্যারকে কত কষ্ট করে রাজি করিয়েছি তুমি জানো? চলো ইন্টার্ভিউ দিয়ে তারপর অন্য দরকারে যেও। ‘
-‘ আসছি।’
.
-‘ তাপৌষি ফোন আর ব্যাগ রিসেপশনে রেখে দাও।’

তাপৌষি কী করবে বুঝতে না পেরে ব্যাগ থেকে ফোন বের করল। এরপর বর্ষণকে ম্যাসেজ দিল,
” আপনি কী কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে পারবেন? আমার বেশি সময় লাগবে না।”

এইটুকু লিখেই ও ফোন জিন্সের পকেটে রেখে দিল। বর্ষণ ম্যাসেজ দিতে পারে। এখন ফোন হাত ছাড়া করা যাবেনা কিছুতেই।
.
একটা ডেকোরেটেড ভিয়াইপি ঘর। তাপৌষি ভালো করে ঘরটা দেখে নিল। ওর সামনের সোফায় বসে আছে তিনজন ব্যক্তি। একজন তাপৌষির বাবার বয়সি। নাম কামাল আহসান। নারী পাচার চক্রের এক সক্রিয় কর্মী। আর বাকী দুজন অল্পবয়সী সহকারী। একজন আসিফ, অপরজন মিজান। এরা বারবার তাপৌষির মাথা থেকে পা চোখ দিয়ে স্ক্যান করছে।
-‘ তাপৌষি ইনি কামাল আহসান। আমাদের বস। আর ইনি মিজান ভাই, বসের সেক্রেটারি। আর উনি আসিফ ভাই, বসের সাথেই থাকে। সালাম দাও উনাদের।’
তাপৌষি সালাম দিল।

কামাল নামের লোকটা তাপৌষিকে একবার দেখে নিয়ে সামিরাকে জিজ্ঞেস করল,
-‘ সামিরা মাল ফ্রেশ তো? যেমন চেয়েছিলাম তেমন?’
-‘ জি বস। দুই কূলে কেউ নেই।’
ওদের এরকম অশ্লীল কথা বলার ধরণ দেখে তাপৌষি চমকে উঠেছে। ভরাট জল ভরা দৃষ্টিতে সামিরার দিকে চেয়ে আছে।
-‘ কত নিবি?’
-‘ পঞ্চাশ হাজার হলেই হবে।’
-‘ জিনিস আমার পছন্দ হয়েছে। তোকে আমি পঞ্চান্ন হাজার দিলাম। নে।’
-‘ ধন্যবাদ, আসি বস।’
তাপৌষি দৌড়ে সামিরার হাত চেপে ধরল।
-‘ কোথায় যাচ্ছ তুমি আমাকে এখানে ফেলে?’
তাপৌষির খুব কাছে পেছন থেকে এক পুরুষ কণ্ঠ ভেসে আসলো।
-‘ একা ফেলে যাচ্ছে কই। আমারা আছি তো।’

ভীত তাপৌষি ছিটকে দূরে সরে গেল। আসিফ নামের লোকটা বিশ্রী ভাবে হাসছে।
-‘ সামিরা প্লিজ আমাকে একা ফেলে যেও না।’
-‘ উফ কাম অন তাপৌষি। স্টপ বিহেভ লাইক এ কিড। হ্যাভ ফান সুইটহার্ট। বাই।’
তাপৌষি সামিরার পিছে পিছে দৌড় দিয়ে বের হতে যাচ্ছিল কিন্তু ও পৌঁছানোর আগেই কেউ বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে দিয়েছে।
————–
বর্ষণ ট্রেন থেকে নেমে ওয়েটিং রুমের দিকে যাচ্ছিল। তবে একটা বাচ্চা মেয়ে ওকে পথে আটকে দিয়েছে। এই বয়সে যার স্কুলে যাওয়ার কথা সে বেলীর মালা হাতে রেলস্টেশনে ফেরী করে বেড়াচ্ছে।
-‘ ভাই ফুল নেন না।’
-‘ স্কুলে যাও না?’
-‘ যাই তো। রাতে পড়ি আমরা। ওই যে পাশের টিনের ঘর ওখানে আমাদের পড়ায়।’
-‘ তোমার ভাষা অনেক স্পষ্ট।’
মেয়েটা দাঁত বের করে হাসল। বর্ষণের মনে হলো এই ধরণের প্রশংসা এর আগে হয়ত মেয়েটিকে কেউ করেনি।
-‘ ভাইয়া ফুল নেন না। এইটা মালা নেন। বউয়ের চুলে লাগিয়ে দিয়েন।’
মেয়েটার কথায় বর্ষণ কিছু একটা ভাবল। তারপর দুটো মালা কিনে তিনটে মালার দাম দিল। আজ ও অনেক খুশি। তাপৌষির সাথে যখন দেখা হবে তখন ওর ঘন কালো চুলে এই বেলীর মালা গেঁথে দিবে বর্ষণ।
-‘ ভাই আপনি খুব ভালো।’
বর্ষণ হেসে হাত দিয়ে মেয়েটার ছোট চুলগুলো এলো মেলো করে দিল।
———
-‘ আমার কাছে আসবেন না বলে দিলাম।’
-‘ আসলে?’
তাপৌষি ঘাবড়ে গেছে। এদের কারও সাথে যে ও পারবে না তা আগেই বুঝতে পেরেছে। রেশমি আপুর কথা না শুনে সামিরার কাছে যাওয়া যে কত বড় ভুল আজ টের পাচ্ছে।
মিজান আর আসিফ তাপৌষিকে চেপে ধরে রেখেছে যাতে ও পালাতে না পারে। তাপৌষির সাথে ওরা রীতিমত জোরজবরদস্তি শুরু করেছে। ওদের চেষ্টা তাপৌষিকে কোনভাবে বিছানায় ফেলা। তাপৌষি উপায় না পেয়ে ওকে পিছন দিয়ে ধরে রাখা মিজানের পায়ের উপর হিল দিয়ে খুব জোরে চাপা মারে। লোকটা এখন ওকে ছেড়ে দিয়ে নিজের পা ধরে ব্যথায় কাতরাচ্ছে। এরপর সামনে দাঁড়ান আসিফের পেট বরাবর পা দিয়ে লাথি দেয়। আসিফ পেট চেপে মাটিতে বসে গেছে। এরপর সোফায় বসে থাকা বয়স্ক কামাল ওর দিকে এগিয়ে আসতে গেলে ও উনাকেও ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়। এক মুহূর্ত দেরি না করে দ্রুত দরজার দিকে এগোতে যায়। যদি এবার দরজা খোলা পায়!
কিন্তু তার আগেই কেউ একজন ওকে চুলের মুঠি ধরে দেয়াল বরাবর ছুড়ে মারল। ‘ধাপ’ শব্দে একটা আওয়াজ হলো।
.
তাপৌষির কপালের একসাইড দিয়ে রক্ত পড়ছে। ফর্সা মুখের একপাশ লাল রক্তে ভরে গেছে।
-‘ খান* বেটির খুব ভাব বেড়েছে। আজকে এরে সাইজ করব। ওরে তুলে নিয়ে আয়।’

ওদের কথা শুনে অশ্রু টলমল চোখে তাপৌষি পিটপিট করে তাকাল। ধীরে ধীরে দেয়াল ধরে উঠে দাঁড়াল। জিন্সের পকেটে থাকা ফোন ‘বিপ’ শব্দ করে উঠল।

মিজান নামের লোকটা আওয়াজ শুনে জলদি তাপৌষির পকেট থেকে ফোন বের করলো। তাপৌষির গায়ে এখন লড়াই করার শক্তি নেই।
.
” এই শহরের রোদ, বৃষ্টি, ছায়ায়
আমি তোমায় খুঁজি।
তোমার ব্যস্ত শহরের ধূলিমাখা রাস্তায়
আমি তোমায় খুঁজি।
অপেক্ষায় আছি তোমার জন্য।
আসবে না?
অপেক্ষার সময় যে দীর্ঘ হচ্ছে।
আমি তোমায় ভালোবাসে
তোমার অপেক্ষায় বসে আছি।
বর্ষণ….”
.
মিজান ম্যাসেজটা খুব জোরেই পড়ল। তারপর হো হো করে হেসে বলল,
-‘ বস এর দেখি আগে থেকে নাঙ আছে। তা বেটি আগে বলবি না?’

অস্পষ্ট আওয়াজে তাপৌষিকে কিছু বলতে শুনল মিজান,
-‘ দয়া করে আমাকে যেতে দিন। আমার অপেক্ষায় আছে কেউ একজন। আমি আপনার মেয়ের বয়সী। যেতে দিন।’

তাপৌষি হাত জোর করে কাঁদছে কামাল আহসানের সামনে। তবে ও তো জানে না, ভুল মানুষের সামনে চোখের জল ফেলছে ও। এই লোকটা যে ওর কান্নাতে আলাদা আনন্দ খুঁজে পেয়েছে।
কামাল ঠোঁটের এক কোণে হালকা হাসির রেখা ফুটিয়ে বলল,
-‘ আচ্ছা যা। ‘
কামালের সম্মতি পেয়ে গায়ের সমস্ত জোর দিয়ে তাপৌষি দেয়াল ধরে দরজার দিকে এগোতে লাগলো। কিন্তু তার আগেই আসিফ তাপৌষির পায়ের নিচের কার্পেটটা ধরে টান দিল। তাপৌষি আবার পরে গেল। ঘরে বিকট শব্দ হলো। সোফার সামনে রাখা কাঁচের টি- টেবিলটা ধরাম শব্দে উল্টে তাপৌষির উপর পড়ল। কাঁচ ভেঙে পেটের ভেতর ঢুকে গেছে ওর।
.
-‘ বস এ তো শ্বাস নিচ্ছে না।’
-‘ বেঁচে নেই?’
-‘ না মনে হয়।’
-‘ধুর মিয়া। কিছুই জানো না।’ বলে আসিফ এসে তাপৌষির কানের পেছনে হাত রাখে।
-‘ ভাই হালকা হালকা শ্বাস নিচ্ছে।’
-‘ একে মেরে ফেল। এই অচেতন বস্তু নিয়ে কই যাব? হাসপাতালে গেলে পুলিশ কেস হবে।’

আসিফ মিজানকে ইশারা করার পর মিজান পকেট থেকে কিছু একটা বের করে আসিফের হাতে দেয়। ‘ব্লেড’।
মুচকি মুচকি হাসছে খুনীরা। ঠাণ্ডা মাথায় খুন করতে ভালোই লাগছে। ভিতরের পিশাচ আজ নিজের ঘৃণ্যতম রূপ দেখাচ্ছে।
-‘ ভাই বেটি কিন্তু সুন্দর ছিল।’ বলেই আসিফ খুব ধীরে তাপৌষির গলার উপর ব্লেড দিয়ে তিন চারটা টান দিল। ফিনকি দিয়ে রক্তের স্রোত বইছে। গলা কাটার সময় কিছু রক্ত ছিটকে মুখে পড়েছে।
আসিফ ব্লেড ফেলে দুই হাত দিয়ে মুখ মুছল। উঠে দাঁড়িয়ে তাপৌষির মাথায় পা দিয়ে একটা লাথি মেরে বলল,
” শান্তির ঘুম ঘুমা এখন।”
.
-‘ বস এই লাশ কী করব?’
-‘ কী করবি তা কী আমার বলে দিতে হবে? গাধাদের দল সব। এরে বস্তায় ভরে পাথর বেধে নদীতে ফেলে দিয়ে আসবি। তবে এখন না। রাতে যাবি। আপাতত এই রক্ত , আসবাব পরিষ্কার করার ব্যবস্থা কর।’
———–
পাঁচ ঘণ্টা হতে চলল তাপৌষির কোন দেখা নেই। বর্ষণ সেই কখন থেকে তাপৌষির ফোনে ফোন দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু বারবার ফোন বন্ধ দেখাচ্ছে। কী হলো মেয়েটার? আসছে না কেন?
চিন্তা হচ্ছে তো।
খানিক্ষণ পরপর জনমানবহীন ওয়েটিং রুমে বসে হাতে থাকা বেলীর মালাটা নাকের সামনে এনে ঘন্ধ নিচ্ছে বর্ষণ। মালাটা শুকিয়ে যাচ্ছে।
হতাশ গলায় হঠাৎ ও বলে উঠে,
“কোথায় তুমি তাপৌষি?”
.
এখন রাত আটটা বাজে। চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বুজে রয়েছে বর্ষণ। কিছুক্ষণ ধরে ও এক কথা বিড়বিড় করে বলে চলেছে,
” বুঝেছি তাপৌষি, হয়ত প্রতিশোধ নিচ্ছ?
আমার কতটা ধৈর্য্য শক্তি তার পরীক্ষা নিচ্ছ?
আমি যে এই পরীক্ষায় সম্পূর্ণ নাম্বার পেয়ে পাশ করবো।
তোমার জন্য আমি ঠিক অপেক্ষা করে যাব। “..
(সমাপ্ত)

( এটার সিজন ২ হবে এবং তার নাম দেওয়া হবে” ছায়া হয়ে মিশে রব কল্পনাতে” তাই আপনারা নিজ দায়িত্বে হয়ত পড়ার পর এটা পড়া শুরু করবেন।ধন্যবাদ প্রিয়জনরা গল্পের ঠিকানার পাশে থাকার জন্য)

1 COMMENT

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here