#অগোচরে_তুমি
লেখনীতেঃ স্বর্ণালী তালুকদার
১৬.
যখন অর্কের ঘুম ভাঙে তখন ঘড়ির কাঁটা সাড়ে এগারোটার গন্ডি পেরিয়ে বারোটার ঘর ছুঁইছুঁই।বাড়িতে বিয়ের আমেজ বলে কথা।হট্টগোল হবে এটাই তো স্বাভাবিক।মেহেনূরদের বাসার হৈচৈও অর্কদের বাসা থেকে শুনা যাচ্ছে।আত্মীয় স্বজনরা সবাই আসতে শুরু করেছে।এত হৈহল্লার মধ্যেও অর্ক সজাগ হয় নি!অর্কের ঘুম ভাঙে রাওনাফের চিৎকারে।পনেরো মিনিট যাবৎ রাওনাক অর্ককে খুব ভালো করে ডাকছিল।কিন্তু অর্কের যেন তাতে কোনো হেলদোলই নেই।শেষমেশ উপায় না পেয়ে অর্কের কানে কাছে গিয়ে দিলো এক গগনবিদারী চিৎকার।ব্যাস,কাজ হয়ে গেলো।ধরফরিয়ে উঠে বসে অর্ক।বুকে থুথু দিয়ে রাওনাফের দিকে কড়মড় করে তাকিয়ে বাজখাঁই গলায় বললো,
– এই শালা!এমন হনুমানের মতো চেচাচ্ছিস কেন?
– সাবধান অর্ক!কথায় কথায় এমন শালা ডাকবি না।আমি তোর কোন জন্মের শালা লাগি হুম?
রাওনাফ কথাটা বলে চোখ রাঙিয়ে অর্কের দিকে তাকিয়ে আছে।অর্ক ফোকলা হেসে রাওনাফকে জড়িয়ে ধরে বললো,
– আরে ভাই,এটা তো কথার কথা।তুই আমার শালা হতে যাবি কোন দুঃখে?তুই তো আমার জানেমান!
অর্ক চোখ টিপ দিয়ে শেষের কথাটা বললো।রাওনাফ মুখ গোমড়া করে অর্কের আলিঙ্গন থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে থমথমে মুখে বললো,
– হুম সেটা তো দেখতেই পাচ্ছি!কাল দিন বাদে পরশু আমার বিয়ে।বিয়ের শপিং থেকে শুরু করে যাবতীয় কাজ এখনো পড়ে আছে।এই একদিনে কিভাবে সবটা ম্যানেজ করবো যেই চিন্তায় আমি শেষ হয়ে যাচ্ছি। অথচ তুই এখনো পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছিস।আবার বলে নাকি আমি ওর জানেমন!ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখেছিস কয়টা বাজে?
অর্ক রাওনাফের উপর থেকে দৃষ্টি সড়িয়ে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে ঠিক বারোটা এক মিনিট বাজে।রাতে ঘুম না হওয়ার কারণে সকালের দিকে চোখটা লেগে এসেছিল।তাই বলে এত দেরি হয়ে যাবে এটা অর্কও ভাবতে পারে বি।চটজলদি বিছানা ছেড়ে উঠে সোজা ওয়াশরুমে ঢুকে পড়ে অর্ক।শাওয়ার নিয়ে বেড়িয়ে এসে সোজা ড্রয়িং রুমে গিয়ে দেখে সবাই বসে ইভেন্টের লোকজনদের সাথে আলাপ আলোচনা করছে।একপাশে বসে আছে ওর নানু।দৌড়ে গিয়ে নানুকে জড়িয়ে ধরলো অর্ক।উৎফুল্ল হয়ে বললো,
– বিবিজান তুমি কখন এসেছো?(অর্ক ওর নানুকে বিবিজান বলেই ডাকে)
আমেনা বেগম অর্কের কান ধরে আদুরে গলায় বললো,
– বিবিজানের কোনো খুঁজ খবর রাখিস তুই হুম?সেই সকাল বেলা এসেছি।তোর মা বললো,তুই অনেক রাত করে ঘুমিয়েছিস তাই আর তোকে সজাগ করি নি।
অর্ক চারপাশে চোখ বুলিয়ে আমেনা বেগমের কানে ফিসফিস করে বললো,
– এখন তো তোমার সাহেবের কাছে চলে এসেছো।এবার সাহেবের এত আদর সোহাগ সামলাতে পারবে তো?
– ওরে দুষ্টু!দাড়া তুই!
আমেনা বেগম অর্ককে ধরার জন্য উদ্যত হতেই অর্ক দৌঁড়ে চলে আসে।রাওনাফকে কোথাও দেখতে না পেয়ে রোশনির কাছে জিজ্ঞাস করে জানতে ও ওদের বাড়ি গেছে।শপিংয়ে যাওয়ার জন্য অর্ক রোশনিকে রেডি হতে বলে ও চলে গেলো রাওনাফকে আনতে।অর্ক মেহেনূরদের বাসার গিয়ে ডোরবেল এ চাপ দিতে যাবে তখন দেখলো দরজাটা খোলাই আছে।কিঞ্চিৎ ফাঁক হয়ে আছে।অর্ক দরজাটা ঠেলে ভেতরে ঢুকতে যাবে ওমনি কেউ চিৎকার দিয়ে উঠে।অর্ক ভরকে গিয়ে উপরে তাকাতেই দেখে কেউ একজন হুড়মুড়িয়ে উপর থেকে নিচে পড়ে যাচ্ছে।অর্ক চটজলদি তাকে ধরে ফেলে।মুখের সামনে কতগুলো আর্টিফিশিয়াল ফুল ধরে রেখেছে।যার কারণে অর্ক ওর মুখ দেখতে পাচ্ছে না।তবে এই মুহুর্তে যে ওর কোলে চেপে আছে, সে যে একজন মেয়ে অর্ক সেটা খুব ভালো করেই বুঝতে পারছে।মেহেনূর ভয় পেয়ে গিয়ে চোখ মুখ খিঁচে বন্ধ করে নেয়।পরমুহূর্তেই মেহেনূরের মনে হলো ও যেনো হাওয়ায় ভাসছে।মুখের সামনে থেকে ফুলগুলো সড়িয়ে পিটপিটিয়ে চোখ খুলে উপরের দিকে তাকায়।দেখে অর্ক ওর দিকে কপাল কুচকে তাকিয়ে আছে।মেহেনূর চোখ খুলতেই চমকে উঠে অর্ক।নীলাদ্রি এক জোড়া আঁখি ওর দিকে ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে আছে।অর্ক এক ধ্যানে মেহেনূরের ওই চোখের দিকেই তাকিয়ে আছে।কাল রাতেও মেহেনূরের চশমা বিহীন চোখ ব্যালকনিতে দেখেছিল অর্ক।কিন্তু তখন তো এই নীল চোখ দেখে নি ও।মেহেনূরের চোখগুলো অর্কের খুব চেনা চেনা লাগছে।কোথাও দেখেছে ও এই চোখজোড়া।কিন্তু মনে করতে পারছে না।অর্কের মস্তিষ্কের নিউরন গুলো যেন কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে।আর এই দিকে অর্ককে এইভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে মেহেনূরের হৃদযন্ত্র কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে।শ্বাস আটকে শক্ত হয়ে আছে মেহনূর।অর্কের কোলে থাকায় মেহেনূরের খুব অস্বস্তি হচ্ছে।আর বেশ লজ্জাও লাগছে।এইভাবে অর্কের কোলে পড়ে যাবে ভাবতে পারে নি ও।তারউপর অর্ক ওইভাবে তাকিয়ে আছে।যেটা মেহেনূরের লজ্জা আরো দ্বিগুণ বাড়িয়ে দিচ্ছে।মেহেনূরের শুকনো একটা ঢোক গিলে মাথা নিচু করে নিয়ে মিনমিনে স্বরে বললো,
– আমাকে নামান।
অর্কের যেন কোনো হুশই নেই।নির্বিকারভাবে এখনো তাকিয়েই রয়েছে মেহেনূরের দিকে।মেহেনূর ফের বললো,
– নামান আমাকে।
এইবার ঘোর কাটে অর্কের।মেহেনূরকে চটজলদি কোল থেকে নামিয়ে ব্যতিব্যস্ত হয়ে বললো,
– ঠিক আছো তুমি?কোথাও লাগে নি তো তোমার?
– জ্বি আমি ঠিক আছি।সরি,আসলে আমি বুঝতে পারি নি আমি এইভাবে পড়ে যাবো।
– ইটস ওকে,কিন্তু তুমি উপরে কি করছিলে…..
কথাটা বলতে বলতে মাথা ঘুরিয়ে পিছনে তাকাতেই অবাক হয়ে যায় অর্ক।অর্ক আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে আছে।চারপাশে চোখ বুলিয়ে দেখে এ তো এলাহি কান্ড!অলরেডি মেহেনূরদের বাড়ির ভিতরের সব ডেকোরেশন কমপ্লিট।খুব চমৎকার ভাবে ডেকোরেশন করা হয়েছে।বাড়ির রঙের সাথে ফ্লাওয়ার কম্বিনেশনও দারুণ মানিয়েছে।অর্ক ঘুরে ঘুরে এইসব কিছু দেখছে আর ভাবছে এত তাড়াতাড়ি কিভাবে সবটা পসিবল হলো?সবে কাল রাতের বেলায়ই ডেইট ফিক্সড করা হলো আর আজ দুপুর সাড়ে বারোটায় সব কমপ্লিট!এইটুকু সময়ের মধ্যে কিভাবে পসিবল এটা?অর্ক হা করে তাকিয়ে আছে।অর্ককে হা করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রাওনাফ গলার স্বর উঁচু করে বললো,
– কি রে, এইভাবে কি দেখছিস?
অর্ক রাওনাফের দিকে ফিরে বললো,
– এতো তাড়াতাড়ি বাড়ি ডেকোরেশন করে ফেললি?কিভাবে সম্ভব এটা?
অর্কের পুরোকথা শুনার আগেই রাওনাফ মেহেনূরের দিকে তাকায়।মেহেনূর আবার মই বেঁয়ে উপরে উঠে হাতে থাকা অবশিষ্ট ফুলগুলো দরজার উপরের ফ্রেমে ভালো করে লাগিয়ে দিয়েছে।মেহেনূর যখনই মই থেকে নামতে যাবে ঠিক তখনই মইটা হালকা কেঁপে উঠলো।বোন যদি এই মই থেকে পড়ে তাহলে নির্ঘাত হাড়গোড় ভেঙ্গে একাকার হয়ে যাবে।যে ভাইয়ের বিয়ের জন্য এত আয়োজন করছে শেষে সেই ভাইয়ের বিয়ে খেতে হবে হসপিটালের বেডে শুয়ে থেকে।কথাটা ভাবতেই গা শিউরে উঠে রাওনাফের।দৌড়ে গিয়ে মই’টা ধরলো রাওনাফ।এইদিকে অর্ক ওর কথার প্রত্যুত্তরে কোনো জবাব না পেয়ে পিছনে তাকিয়ে দেখে রাওনাফ নেই।ও দরজার কাছে মই ধরে দাঁড়িয়ে আছে আর মেহেনূর মই বেঁয়ে নামছে।যে মেয়েকে একটু আগেই হাড়গোড় ভেঙ্গে যাওয়ার মতো এক্সিডেন্ট থেকে ও বাঁচালো সেই মেয়েই কিনা মিনিট দুয়েক পড়েই আবার নাচতে নাচতে গিয়ে মইয়ে উঠে পড়লো।অর্কের কেন যেন খুব রাগ হচ্ছে মেহেনূরের উপর।এই মেয়েটা এত ইরেসপন্সিবল কি করে?অর্ক রাগে গজগজ করতে করতে ওদের দিকে এগিয়ে গিয়ে মেহেনূরকে কড়াগলায় বললো,
– এই মেয়ে তোমার সাহস তো কম বড় না।একটু আগেই তো এখান থেকে পড়ে হাড়গোড় সব গুড়া করে ফেলতে।নেহাতই আমি ধরেছিলাম বলে।নয়তো এতক্ষণে হসপিটালের অপারেশন থিয়েটারে থাকতে হতো।এখন আবার উঠেছো এখানে।
অর্কের কথা শুনে রাওনাফ অবাক হয়ে মেহেনূরের দিকে তাকায়।মেহেনূর মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। রাওনাফ ব্যাতিব্যস্ত হয়ে বোনকে বুকের সাথে শক্ত জড়িয়ে ধরলো।মেহেনূরের মাথায় চুমু দিয়ে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো উৎকন্ঠিত স্বরে বললো,
– তোর কোথাও লাগে নি তো বোন।কতবার করে তোকে মানা করছি।তাও শুনছিস না আমার কথা।এখন যদি তোর কিছু হয়ে যেতো?
ভাইয়ের আলিঙ্গন থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে মিষ্টি একটা হাসি ফিরিয়ে দেয় মেহেনূর।ধীর কন্ঠে বললো,
– কিন্তু কিছু হয় নি তো ভাইয়া!আমি একদম ঠিক আছি দেখ।
মেহেনূর ফের বললো,
– তখন মই থেকে ফুলগুলো লাগাতে পারছিলাম না বলে একটা পা দরজার উপরে রেখেছিলাম।উনি দরজা খোলার জন্য ধাক্কা দিলেন আর দরজাটা একটু নড়ে উঠতেই পা টা স্লিপ করে গিয়েছিল বলে আমি পড়ে গিয়েছিলাম।
রাওনাফ অর্কের দিকে তাকিয়ে চোখ পাকিয়ে বললো,
– এখন যদি আমার বোনটা পড়ে ব্যাথা পেতো?
অর্ক ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়।যত দোষ এই নন্দ ঘোষ!একই তো এই মেয়ে ইডিয়েটের মতো দরজা খুলে রেখে তারউপর আবার পা তুলে বসে ছিল।আবার পড়ে যাওয়ার হাত থেকে ওই তো ওকে বাঁচালো!আর এখন, এই মেয়ে ভাইয়ের কাছে ইনিয়েবিনিয়ে ঘুরিয়ে প্যাচিয়ে দোষটা ওর ঘাড়েই দিচ্ছে?এ তো দেখছে ভারী বজ্জাত, শয়তান মেয়ে।অর্ক মেহেনূরের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে ঝাঝালো কন্ঠে বললো,
– আমার কি দোষ?আমি কি জানতাম তোর বোন দরজা খোলা রেখে ওটার উপর বাদরের মতো ঝুলে দাঁড়িয়ে আছে।
– তাই বলে তুই দেখবি….
– ভাইয়া,তুই শুধু শুধু উনাকে বকছিস কেন?দোষটা তো আমারই ছিল।আমিই তো দরজাটায় পা রেখে কাজ করছিলাম।উনি কিভাবে জানবে আমি দরজায় পারা দিয়ে দাঁড়িয়ে আছি।আর উনিই তো আমাকে বাঁচালেন।নয়তো সত্যি সত্যি আমি এখন হসপিটালেই থাকতাম।
মেহেনূর ওর কথাগুলো শেষ করেই ওখান থেকে চলে যায়।অর্ক কপাল কুচকে মেহেনূরের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে।এই মেয়েটা সব সময় ওর চিন্তা ভাবনা গুলোকে তিনশো ষাট ডিগ্রি ঘুরিয়ে দেয়।ওকে সব সময়ই ভুল প্রমাণ করে দেয় মেহেনূর।অর্ক মেহেনূরকে যেমনটা ভাবে মেহেনূরের কাছ থেকে অর্ক ঠিক তার বিপরীত প্রতিক্রিয়াটাই পায়।অর্ক রাওনাফের দিকে তাকিয়ে একটা তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে গলার স্বর উঁচু করে বললো,
– শুনলি তো এবার?
– সরি!
– ইটস ওকে।আচ্ছা বললি না তো বাড়ির ডেকোরেশনটা কারা করেছে?
– মেহেনূর!
– ও তো চলে গেছে।
– আরে গাধা আমি বললাম মেহেনূরই এইসব করেছে। কালকে রাতে তোরা সবাই চলে যাওয়ার পর এখানকার অনেকজন ইভেন্ট ম্যানেজারের সাথে কথা বলে মেহেনূর।ওদের সাথে কথা বলে যাদেরকে ওর পছন্দ হয়েছে তাদেরকে বলেছে বিয়ের সব ধরনের ডেকোরেশন করে দেওয়ার জন্য।মেহেনূর বলেছে যে বাড়ির ভিতরে আর বাহিরে যেখানে রিসেপশনের আয়োজন করা হবে ওইখানের ডিজাইন সব মেহেনূরই বলে দিবে।উনারা শুধু ওর কথামতো সাজিয়ে দিবে।
অর্ক অবাক হয়ে রাওনাফের কথাগুলো শুনলো।এই মেয়ে এইসব বিষয়েও পারদর্শী?কিভাবে?এতটুকু একটি মেয়ে এইসবের কিই বা বুঝে।অর্ক অবাক স্বরে বললো,
– তোর বোন কি বিদেশে এইসবই করে বেড়ায় নাকি?
অর্কের কথায় রাওনাফ হেসে দিয়ে বলে,
– হ্যাঁ!মেহেনূর হোটেল ম্যানেজমেন্ট নিয়ে পড়াশোনা করছে।তার সাথে ইভেন্টে এই বিষয়গুলোও ও ভালো বুঝে।
– তাই নাকি?
– হুম।আমার বোনের যে আরো কত গুণ আছে সেইসব তোদের ধারণাতেও আসবে না।
এই বোরিং মেয়ের এত গুণ?ভাই তো দেখা যাচ্ছে বোনের প্রশংসায় পঞ্চমুখ!কি জানি হয়তো ভাই বলেই!অর্ক মনে মনে কথা গুলো আওড়িয়ে বললো,
– আচ্ছা এইসব কথা এখন বাদ দে।আমরা এখন শপিং করতে যাবো।ভাবীকে বলে এসেছি রেডি হওয়ার জন্য।তুইও গিয়ে তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে আয়।
___________________
শপিং করার জন্য সেই দুপুর একটায় বাসা থেকে বের হয়েছিল অর্ক,রাওনাফ,মেহেনূর,রোশনি আর রোশান।এখন বাজে রাতের একটা পঁচিশ।পনেরো মিনিট আগেই সবাই বাসায় ফিরেছে।মোটামুটি সবার জন্য শপিং কমপ্লিট।রাত পেরোতেই রাওনাফ আর রোশনির গায়ে হলুদ।আজকে সারাদিনের মধ্যে দুই বাসার লোকজন তাঁদের গেস্টদের দাওয়াত দেওয়া থেকে শুরু করে বাড়ির সব ডেকোরেশন, লাইটিং, সাউন্ড সিস্টেম সেট করা সব কমপ্লিট করে ফেলেছে।সকালে অনেক কাজ আছে বলে সবাই খাওয়া দাওয়া শেষ করে যার যার ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ে।রোশনি ফোনে রাওনাফের সাথে প্রেমালাপ করছে।যতোই হোক, ওদের বিয়ে বলে কথা।অন্য সবার মতো ঘুমিয়ে পড়াটা সাজে না।বিয়ের আগে রাত জেগে হবু বরের সঙ্গে প্রেম করাটাও অন্যরকম একটা ভালো লাগা, ভালোবাসার বিষয়।রোশানও শুয়ে শুয়ে কারো সাথে চ্যাটিং নিয়ে ব্যস্ত।ক্ষনে ক্ষনেই ম্যাসেঞ্জারের টং টাং শব্দ শুনা যাচ্ছে।
মেহেনূর সারাদিন বাড়িতে ছিল না।অবশ্য শপিংমল থেকে ভিডিও কল দিয়ে সবটা ওই বলে দিয়েছে সবাইকে।তারপরেও সব কাজ ঠিকঠাক মতো হয়েছে কিনা সেটা চেক করে এসে মাত্রই শুয়েছে।সারাদিন অনেক দখল গেছে ওর উপর দিয়ে।শরীরটা ভীষণ ক্লান্ত লাগছে ওর।তারউপর কাল সারারাত ঘুমায় নি।ক্লান্ত শরীরটা হেলিয়ে দিলো বিছানায়।ঘুমানোর জন্য লম্বা একটা হাই তুলে চোখ বুজতেই দুপুরে অপ্রত্যাশিতভাবে ঘটে ঘটনাটা মেহেনূরের চোখে ঝলঝল করে উঠে।চমকে উঠলো মেহেনূর।ঘুমানোর জন্য ফের চোখ বন্ধ করতেই আবার একই ঘটনা ঘটেছে। যখনই ঘুমানোর জন্য চোখ বন্ধ করছে তখনই অর্কের সেই ঘোর লাগা চাহনি মেহেনূরের চোখে ভেসে উঠছে।ফলে বার বার আঁতকে উঠছে মেহেনূর।তার সাথে সাথে কেমন অদ্ভুত রকমের অস্বস্তিও হচ্ছে মেহেনূরের। ওর সাথে এর আগে এমনটা কখনো হয় নি।বুকের মধ্যে কেমন যেন চিনচিনে ব্যথা অনুভব হচ্ছে ওর।মনগহীনে অন্যরকম এক অনুভূতির অস্তিত্বের জানান দিচ্ছে হৃদযন্ত্রটি।এই অনুভূতির সাথে মেহেনূর পূর্বপরিচিত নয়।
অন্যদিকে বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে সিলিং ফ্যান টার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে অর্ক।চোখে ভাসছে এক জোড়া নীলাদ্রি চোখ।মেহেনূরের ওই নীলাদ্রি চোখের ভয়ার্ত চাহনির কথা ভাবতেই অর্কের মন শিহরিত হচ্ছে বার বার।আজ শপিংমলেও মেহেনূরের অগোচরে লুকিয়ে সেই চোখ দেখেছে বহুবার!এটা কি অন্যায় নয়?নিজের মনকেই প্রশ্ন করে অর্ক।ওর মনে যে আরেকজনের বাস!আর এখন যে ও অন্যজনের ধ্যানে নিমগ্ন হয়ে আছে!না না এটা অন্যায়।কিন্তু বেহায়া মন যে ঘুরেফিরে মেহেনূরের দিকেই ছুটে যাচ্ছে ক্রমশ।মেহেনূরের নেশা জড়ানো সেই চোখের চাহনি,ভয়ার্ত মুখটা বার বার ওর মনকে ব্যাকুল করে তুলছে।তবে কি ও কিরণের জায়গা নেওয়ার চেষ্টা করছে?না!এটা হতে পারে না।আর কিছু ভাবতে পারছে অর্ক।মাথা চেপে ধরে বিছানা ছেড়ে উঠে বসে।সংরক্ষণে রাখা সিগারেট আর লাইটার নিয়ে চলে যায় ব্যালকনিতে।আঙুলের ফাঁকে সিগারেট রেখে কিছুক্ষণ পর পর মুখে পুরে নিচ্ছে আর মনের সুখে ধোঁয়া উড়াচ্ছে।নেশায় ভোর হয়ে থাকলে নিশ্চয়ই মনের দরজায় অন্যায় আবদার নিয়ে এসে, কেউ কড়া নাড়বে না!মালিকের অসহায়ত্বের সুযোগ নিতে চাইবে না নিশ্চয়ই!
চলবে…….#অগোচরে_তুমি
লেখনীতেঃ স্বর্ণালী তালুকদার
১৭.
ঘুম থেকে জেগে প্রতিবারের ন্যায় আজো অর্ক নিজেকে ব্যালকনিতে আবিষ্কার করলো।তবে অন্যদিনের তুলনায় আজকে অর্কের সাথে ব্যাতিক্রম ঘটনা ঘটেছে।প্রতিবার এই ব্যালকনিতে ঘুমিয়ে যাওয়ার পরে হয়তো আয়েশা বেগমের ডাকাডাকিতে অর্কের ঘুম ভাঙে, নয়তো সূর্যোদয়ের তীর্যক রশ্মি চোখে মুখে পড়ে অর্কের ঘুম ভাঙে!কিন্তু আজ এই দুই রীতির কোনোটাই অর্কের সাথে ঘটে নি।বরং আজ, স্বয়ং মুয়াজ্জিন তার সুরেলা কন্ঠে মহিমান্বিত করে অর্ককে ডেকে তুললো!আযানের প্রতিধ্বনি কর্ণকুহরে প্রবেশ করতেই ঘুম ভেঙে সজাগ হয়ে যায় অর্ক।ব্যালকনি থেকে ঝটপট উঠে গিয়ে দ্রুত গতিতে ওয়াশরুম ঢুকে পড়ে।আলমারি খুলে জায়নামাজ বের করে নামাজ কায়েম করতে বসে পড়ে।সূর্য আজকে কোন দিকে উঠতে চললো?প্রকৃতির চিরন্তন সত্য নিয়ম মেনে সৃষ্টিকর্তার ইশারায় এক সূর্য উদয় হয়!আর আজ সেই সৃষ্টিকর্তার ফরজ কাজ করে আরেক সূর্যের দিন শুরু হচ্ছে।মাশাল্লাহ!ছেলেকে নামাজে দেখে আয়েশা বেগম আশ্চর্য হয়েছিলেন বটে। তবে তার মনে বেশ প্রশান্তিও লাগছে।ছেলে আল্লাহর ইবাদতে মগ্ন।স্মিত হেসে দরজাটা ভিড়িয়ে দিয়ে আয়েশা বেগম নিজের ঘরে চলে যান।
আজ রাওনাফ আর রোশনির গায়ে হলুদ।অর্কদের বাড়ি থেকে যেহেতু রোশনির বিয়েটা দেওয়া হবে। সেহেতু এক হিসেবে এটা রোশনির বাড়ি হিসাবে ধরাই যেতে পারে।মেয়ের বাড়ি বলে কথা।অনেক কাজ করতে হবে সকাল থেকে।বাড়িতে মেহমানরাও রয়েছেন।সকালবেলা আরো মেহমান আসবেও।গায়ে হলুদের অনেক আয়োজন করতে হবে।রাতে অর্করা অনেকটা দেরি করে বাড়ি ফেরায় ছেলের সাথে সেভাবে কথা বলতে পারেন নি আয়েশা বেগম।তাই ফজরের নামাজটা শেষ করে এসেছিলেন অর্কের সাথে একটু কথা বলবেন বলে।কিন্তু ছেলেকে যে এইমুহূর্তে নামাজে দেখতে পাবেন এটা ভুলেও কল্পনা করতে পারেন নি আয়েশা বেগম।
– মা!
ধীর কন্ঠে ডাক দিলো অর্ক।আয়েশা বেগম অর্কের ঘর থেকে বেড়িয়ে এসে নিজের ঘরে চলে আসেন।অর্কের যতক্ষণ না নামাজ শেষ হচ্ছে ততক্ষণ অব্দি তসবিহ টাই না হয় পড়তে থাকেন।অবশ্য আয়েশা বেগম রোজই ফজরের নামাজ শেষ করে কুরআন তিলাওয়াত আর তসবিহ পড়েন।আয়েশা বেগম হাতের তসবিহ টা জায়গা মতো রেখে রুমের ভেতর থেকে গলার স্বর উঁচু করে বললেন,
– দরজা খোলাই আছে।
অর্ক দরজা ঠেলে ঘরের ভেতরে ঢুকলো।আয়েশা বেগম জায়নামাজ ভাঁজ করে আলমারিতে রাখেন।অর্ক বিছানায় তাকিয়ে দেখে আকাশ সাহেব বিছানায় নেই।কপাল কুঁচকে মায়ের দিকে তাকায়।ছেলের জিজ্ঞাসুক দৃষ্টি দেখে আয়েশা বেগম স্মিত হেসে বললো,
– ফজরের নামাজ পড়তে মসজিদে গেছেন।
এক চিলতে হাসি ফিরিয়ে দেওয়া ছাড়া মায়ের কথার কোনো প্রত্যুত্তর করলো না অর্ক ।মায়ের কাছে এসে নরম গলায় বললো,
– তখন কি আমাকে কিছু বলতে গিয়েছিলে?
অর্কের দিকে চকিত দৃষ্টিতে তাকান আয়েশা বেগম। অর্ক তো নামাজে ছিল!তাহলে অর্ক কিভাবে জানলো উনি ওর রুমে গিয়েছিলেন?উনি একটু শব্দও করে নি, তাহলে ও টের পেলো কি করে?
আয়েশা বেগম কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই অর্কের দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে ছিলেন।অর্ক বুঝতে পারছে এইমুহূর্তে ওর মায়ের মনে অনেক প্রশ্ন উঁকি ঝুকি মারছে।অর্ক আয়েশা বেগমের হাত ধরে বিছানায় বসিয়ে মৃদু হেসে শীতল কণ্ঠে বললো,
– তুমি চুপচাপ চলে আসলে কি হবে,তোমার গায়ে মাখা আতরের ঘ্রাণ এখনো আমার ঘরে রয়ে গেছে।
অর্কের কথায় মুচকি হাসলেন আয়েশা বেগম।আতর সুরমা লাগানো তার পুরোনো অভ্যাস।ফজরের নামাজ শেষে আতর সুরমা মেখে তার দিন শুরু হয়।অর্কের ঘ্রাণশক্তি প্রখর। আতরের ঘ্রাণ অর্কের আছে বরাবরই একটু বেশিই তীব্র মনে হয়।আয়েশা বেগম আজকে আতর মাখেন নি।কাল দুপুরে যুহরের নামাজ শেষ করে অল্প একটু দিয়েছিলেন।তাও ছেলের নাক এড়ায় নি!আয়েশা বেগম ধীর কন্ঠে বললো,
– আজ রাওনাফ আর রোশনির গায়ে হলুদ।একটা মেয়ে বিয়ে দিতে গেলে যা যা লাগে সব নিয়ম-কানুন যথাযথ ভাবে পালন করতে হবে।রোশনির বাবা মায়ের সাথে আমার রাতে সব কথা হয়েছে।যেহেতু এখানে উনাদের কোনো আত্মীয় স্বজন নেই আর আমরা নিজেরাই উনাদের ইনভাইট করে নিয়ে এসেছি, সেহেতু আমাদের তরফ থেকে কোনো ধরনের গাফিলতি যেন না হয়।সন্ধ্যা বেলায় গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান।অনুষ্ঠানে আমি কোনো ঝামেলা চাই না।আজকের এবং কালকের অনুষ্ঠানটা যাতে সুষ্ঠু ভাবে সম্পূর্ণ হয় সেটার খেয়াল রাখতে হবে বুঝেছো।
মায়ের কথায় সায় দিয়ে মাথা নাড়ায় অর্ক।আয়েশা বেগম ক্ষুদ্র একটা নিঃশ্বাস ফেলে ফের বললো,
– সকালে ঘুম থেকে উঠেছো,আল্লাহর ফরজ কাজও করেছো।কালকে অনেক রাত করে ঘুমিয়েছ।যদি আরেকটু ঘুমের প্রয়োজন হয় তাহলে একটু ঘুমিয়ে নিতে পারো।যাও এখন।
অর্ক মায়ের কথামতো উনার পাশ থেকে উঠে কয়েক কদম এগোতেই আয়েশা বেগম ভারী গলায় বললো,
– অর্ক!
মায়ের ডাক শুনতে পেয়ে দাঁড়িয়ে যায় অর্ক।মায়ের দিকে জিজ্ঞাসুক দৃষ্টি স্থির করে তাকিয়ে আছে।আয়েশা বেগমের মুখে গম্ভীরতার ভাব।অর্ক উনার দিকে তাকাতেই আয়েশা বেগম কপালে ভাঁজ ফেলে শীতল কণ্ঠে বললো,
– ওইদিনের পর থেকে মেহেনূর আমাদের বাসায় আসে না!সেটা কি তুমি জানো?
অর্ক আয়েশা বেগমের কথায় মোটেও অবাক হলো না।ব্যাপারটা যে ওর চোখ এড়িয়েছে তেমনটাও নয়।অনলাইন ক্লাসের নাম করে ওদের বাসায় দাওয়াত খেতে না আসা।বাড়ির দারোয়ান দিয়ে খবর পাঠানো।রোশনিরা ও বাড়ি থেকে চলে আসার সময় বাড়ির গেইট অব্দি এগিয়ে দিয়ে মেহেনূরের চলে যাওয়া।আয়েশা বেগম মেহেনূরকে উনাদের বাড়ি আসতে বললে কোনো না কোনা বাহানা দেখিয়ে এড়িয়ে যাওয়া।এই সব কিছু অর্কের নজরে পড়েছে অনেক আগেই।অর্ক ধারণা করেছিল মেহেনূর হয়তো ওদের বাসায় আসতে চায় না।তবে এখন, মায়ের কথায় ওর ধারণাটা সত্যি হলো।
অর্ক মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে।মেহেনূরের এ বাড়িতে না আসার কারণটা ও-ই।হয়তো ওইদিন মেহেনূর অপমান বোধ করেছিল।অবশ্য করাটাই স্বাভাবিক।চোখের সামনে কাউকে নিজের ব্যাপারে এইভাবে ওইরকম কথা শুনলে যে কারোরই নিজেকে খুবই হ্যাংলা মনে হবে।মেহেনূর কথাগুলো যদি না শুনতো তাহলে হয়তো লজ্জা পেতো না।
অর্ককে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আয়েশা বেগম তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে ফের বললো,
– তারমানে তুমি জানো!মেহেনূর এ বাসায় আসে না,এটা এতো দিন কারোর নজরে পড়ে নি।কিন্তু এখন যদি নিজের ভাইয়ের বিয়েতেও আমাদের বাড়িতে আসতে না চায়?ব্যাপারটা খুবই লজ্জাজনক হবে আমাদের জন্য!কেউ যদি এর কারণ জানতে চায় তাহলে মেহেনূর যে রকম মেয়ে,ও কাউকেই বলবে না।ঠিক কোনো না কোনো কারণ দেখিয়ে চলে যাবে।কিন্তু এটা কি অযাচিত অশোভন নয়?আমি চাই না নিজেদের মধ্যে কোনো ধরনের মনোমালিন্য হোক।কথাটা মাথায় রেখো।
অর্ক তখনও নির্লিপ্তভাবে দাঁড়িয়ে আছে।অর্ক লক্ষ্য করছে আয়েশা বেগম তখন থেকে অর্ককে তুমি বলে সম্মোধন করছে।ওর মা যখন সিরিয়াস থাকেন তখনই এরকম তুমি বলে সম্মোধন করে।তবে কখনো কখনো এর ব্যাতিক্রমও ঘটে। অর্ক কোনো কথা না বলে চুপচাপ মায়ের ঘর থেকে বের হয়ে আসে।
_________________
– তুমি কি চাও এই বয়সে এসেও আমি মায়ের হাতে মার খাই?
কিছুটা ঝাঁঝালো কণ্ঠে পরিচিত মানুষের বলা কথাটা কর্ণকুহরে প্রবেশ করতেই চমকে উঠে মেহেনূর।আচমকায় আতংকিত হওয়ায় ওর হাতে থাকা ফোনটা ছিটকে গিয়ে আটকায় ছাদের কার্নিশে।আরেকটু হলেই নিচে পড়ে যেতো।একটা তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে পিছনে ঘুরে মেহেনূর।ফোনটার দিকে এক পলক তাকিয়ে বুকে হাত বেঁধে কপালে ভাঁজ ফেলে সামনের মানুষটার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে বললো,
– মানে?
মেহেনূরের দৃষ্টি অনুসরণ করে তড়িঘড়ি করে অদূরে পড়ে থাকা ফোনটা কুড়িয়ে নিয়ে আসে অর্ক।মেহেনূরের মুখের দিকে তাকিয়ে মেকি হেঁসে বললো,
– ভাঙে নি।
মেহেনূরের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি এবার ফোনের দিকে।হাত বাড়িয়ে অর্কের কাছ থেকে ফোনটা নিয়ে ভালো করে এপিট ওপিট দেখে নিয়ে ফের অর্কের দিকে তাকায়।মেহেনূর পূর্বের ভঙ্গিমায় বললো,
– তো কি যেনো বলছিলেন?
তখন যতটা রাগ নিয়ে কথাটা বলে ফেলেছিল এখন মেহেনূরের চোখ দেখে অর্কের ঠিক ততটাই ভয় হচ্ছে।নেত্রযুগলক দিয়ে ধনুকের তীর তাক করে আছে।কথার হেরফের হলেই সেই তীর মুহুর্তেই এসে বিঁধবে অর্কের বক্ষমাঝে।মেহেনূরের এই রূপ অর্কের কাছে আগে কখনো ধরা দেয় নি।চোখ বড় বড় করে শুকনো একটা ঢোক গিলে অর্ক।জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে ফিচেল হেসে বললো,
– কই কিছু বলি নি তো!
কপাল কুঁচকে আসে মেহেনূরের।অর্কের বলা কথাটা স্পষ্ট শুনেছে ও।উঁচু গলায় বলা কথাটায় বেশ ঝাঁঝও ছিল।আর এখন বলছে কিছু বলেই নি!অদ্ভুত!তবে অর্কের মুখ দেখে মনে হচ্ছে ও কিছু বলতে চাচ্ছে।মেহেনূর অর্কের দিকে আঁড়চোখে তাকিয়ে ফোনের পাওয়ার বাটন অন করে।এক পলক ফোনের স্ক্রীনের দিকে চেয়ে ক্ষীণ স্বরে বললো,
– আসছি আমি,আটটায় আমার অনলাইন ক্লাস আছে।
মেহেনূর চলে আসার জন্য কয়েক কদম এগোতেই পথ আগলে দাঁড়ায় অর্ক।মেহেনূর অর্কের এহেন কাজে একটু অবাক হয়।অর্ককে পাশ কাটিয়ে চলে আসতে নিলে অর্ক ফের একই কাজ করলো।এবার অবাকের সাথে সাথে প্রচন্ড বিরক্তও হয় মেহেনূর।আংশিক কড়া গলায় বললো,
– বার বার পথ আটকে দাঁড়াচ্ছেন কেন?বললাম না আটটায় আমার ক্লাস আছে।
অর্ক কোনো কথা বলছে না।মুখটা কেমন যেনো ভার করে রেখেছে।কয়েক সেকেন্ড অতিবাহিত হওয়ার পরেও যখন অর্ক কোনো কিছু বলছে না তখন মেহেনূর চলে আসার জন্য উদ্যত হতেই অর্ক মিনমিনে স্বরে বললো,
– তুমি আমাদের বাসায় যাও না কেন?
ঠায় দাঁড়িয়ে যায় মেহেনূর।অর্কের মুখে এই প্রশ্নটা শুনে এক পা পিছিয়ে অর্কের সামনে এসে দাঁড়ায়।স্মিত হেসে শীতল কণ্ঠে বললো,
– আমার যাওয়া নিয়ে তো আপনার আপত্তি!
মেহেনূরের দিকে আহত দৃষ্টিতে তাকায় অর্ক।মেহেনূর ফের বললো,
– আপনাদের বাড়ি,আপনাদের রাইট আছে কাকে বাড়িতে এলাউ করবেন আর কাকে নয়!বিশ্বাস করুন আমি যে এলাউ নই এটা আগে জানলে আমি কখনোই আপনাদের বাড়িতে যেতাম না।ওইদিন আমার জায়গায় অন্যকেউ হলে হয়তো সত্যিই কষ্ট পেতো বা রাগ করতো।কিন্তু বিশ্বাস করুন,আমি মোটেও কষ্ট পাই নি আর রেগেও নেই।
– তাহলে?
– আত্মসম্মানবোধ!আমি রাগ করি নি ঠিক আছে।কষ্ট পাই নি এটাও ঠিক আছে।কিন্তু আমার তো একটা আত্মসম্মানবোধ আছে নাকি?আমাকে কেউ পছন্দ করে না এটা জানার পরেও কি আমি আবার একই ভুল করবো?
মেহেনূর কথাগুলো শেষ করতেই অর্ক হুট করে মেহেনূরের হাতদুটো ধরে ফেলে।মেহেনূর ভয় পেয়ে গিয়ে কিছুটা পিছিয়ে যায়।অর্ক মেহেনূরের দিকে তাকিয়ে করুণ সুরে বললো,
– বিশ্বাস করো,ওইদিন কথাগুলো আমি মন থেকে বলি নি।তোমাকে বা আঙ্কেলকে কষ্ট দেবো বলেও বলি নি।ইচ্ছাকৃতভাবে হোক বা অনিচ্ছাকৃতভাবেই হোক,আমি জানি আমার কথায় তুমি কষ্ট পেয়েছো।সরি ফর এভ্রিথিং!
অর্ক মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে।আঁড়চোখে অর্কের দিকে তাকায় মেহেনূর। অর্ক আসলেই অনুতপ্ত, লজ্জিত।হয়তো ও যা যা বললো সবটাই সত্যি।মেহেনূর অর্কের হাত থেকে নিজের হাতগুলো ছাড়াতে ছাড়াতে ধীর কন্ঠে বললো,
– ইটস ওকে!
এতক্ষণে অর্কের খেয়াল হলো ও মেহেনূরের হাত ধরে আছে।চটজলদি মেহেনূরের হাতটা ছেড়ে দিয়ে কিছুটা পিছিয়ে দাঁড়ায়।পর পরেই মুখ গোমড়া করে বললো,
– যদি কেউ কারোর ঘুমের বারোটা বাজায় তাহলে তার উপর রাগ হওটাই স্বাভাবিক নয় কি?তুমিও নিজেও জানো, তুমি গানটা ঠিকঠাক গাইতে পারো না!তাহলে কেন গাও বলো তো?
অর্কের কথা বলার ভঙ্গিমা দেখে ফিক করে হেসে দেয় মেহেনূর।অর্ক অবাক হয়ে বললো,
– হাসছো কেন?
মেহেনূর ঠোঁটের কোণে হাসি ঝুলিয়েই গলার স্বর উঁচু করে বললো,
– না এমনি!অবশ্য আপনি ঠিকই বলেছেন।আর রেওয়াজ করতেও আমার একদম ভালো লাগতো না।শুধু বাবার ভয়ে করতে হতো!
– সন্ধ্যায় আসছো তো?
অর্ক প্রশ্নটা করে উৎসুকভাবে মেহেনূরের দিকে তাকিয়ে আছে।অর্কের প্রশ্নটা শুনে সঙ্গে সঙ্গে মেহেনূরের মুখের হাসিটা মিলিয়ে যায়।
চলবে……..