অগোচরে তুমি পর্ব -১৪+১৫

#অগোচরে_তুমি
লেখনীতেঃ স্বর্ণালী তালুকদার

১৪.

– আন্টি আপনার ছেলের কি কোনোদিনও আক্কেল জ্ঞান হবে না?

দিহাদ করুন চোখে তাকিয়ে আছে আয়েশা বেগমের দিকে।কালকে বিকালে এনজিও থেকে অর্ক বেড়িয়ে আসার পর অর্কের ফোনের অনেকগুলো কল দিয়েছিল দিহাদ।কিন্তু রিসিভ করে নি ও।তারপর সন্ধ্যার দিকেও অনেক গুলো কল দেয় দিহাদ।অর্ক তখনও ওর কল রিসিভ করে নি।ইনফ্যাক্ট আজ সকালেও কল দিয়েছে!কিন্তু দিহাদ তখনও হতাশই হয়।কারণ অর্ক আজ সকালেও কলটা রিসিভ করে নি।এত বার ট্রাই করার পরেও যখন অর্ক ফোন তুলছে না তখন দিহাদের চিন্তা হতে থাকে অর্কের জন্য।যদি ওর কোনো বিপদ আপদ হয়ে থাকে।তাই সকাল সকাল বাসায় এসে উপস্থিত হয়েছে।আয়েশা বেগম দিহাদের কথার মানে বুঝতে না পেরে স্মিত হেসে বললো,

– কেন কি করেছে ও ?

আয়েশা বেগম যেনো কাটা গায়ে নুন ছিটিয়ে দিলেন।এতক্ষণ কোমড়ে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল দিহাদ।কিন্তু এখন আর ওর পক্ষে দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব না।তাই পাশের সোফাটায় ধপ করে বসে পড়লো।ফোঁসফোঁস করে দম ছেড়ে গলার স্বর উঁচু করে বললো,

– কি করে নি সেটা বলুন আন্টি।কাল বিকাল থেকে শুরু করে সন্ধ্যার পর পর্যন্ত মনে হয় এক হাজার কল দিয়েছি ওকে।কিন্তু একটা বারের জন্যও কলটা রিসিভ করার প্রয়োজন মনে করলো না ও?কারো বিপদ আপদও তো হতে পারে।আচ্ছা তাও আমি এটা মানতে পারি যে,ও হয়তো তখন ফোনের কাছে ছিল না।কিন্তু পরে কি ও ওর ফোনটা হাতে নেয় নি?দেখে নি যে কেউ ওকে এতগুলো কল দিয়েছে?

– ফোন ওর সাথে থাকলে তো দেখবে।

আয়েশা বেগমের দিকে ভ্রু কুচকে তাকায় দিহাদ।আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞাস করলো,

– মানে?

– মানে হলো,কাল সকালে যখন এনজিওতে গিয়েছিল তখন ফোনটা বাসায়ই ফেলে রেখে চলে গিয়েছিল।বিকালে ফোনের রিংটোনের শব্দ পেয়ে বুঝতে পারলাম অর্ক ওর ফোনটা বাসায়ই ফেলে রেখে গেছে।পরে সন্ধ্যায় আবার যখন কল আসে তখন গিয়ে দেখি ফোনের এই দশা।

আয়েশা বেগম অর্কের ফোনটা দিহাদের দিকে এগিয়ে দিয়ে শেষের কথাটা বলেন।দিহাদ ফোনটা দেখতে পেয়েই ফিক করে হেসে দেয়।আয়েশা বেগম হতাশার সুর টেনে বললো,

– স্ক্রিনে কিছু দেখা যায় না কিভাবে বুঝবো তখন তুমি কল দিয়েছিলে?

আয়েশা বেগম পরমুহূর্তেই কপালে চিন্তার ছাপ ফেলে বললো,

– আচ্ছা দিহাদ ওর ফোনটা এমন বাজে ভাবে চূর্ণবিচূর্ণ হলো কি করে?

– কিরণ চৌধুরীর কেলানি খেয়ে আপনার ছেলের সাথে সাথে এই ফোনটারো হাড়গোড় ভেঙ্গেছিল ওইদিন।

দাঁতে দাঁত চেপে মিনমিনে স্বরে বললো দিহাদ।আয়েশা বেগম বুঝতে না পেরে বললো,

– কিছু বললে?

দিহাদ গলা খাঁকারি দিয়ে বলে,

– হ্যাঁ, ওইদিন অর্ক এক্সিডেন্ট করলো না।তখনই ফোনটা ভেঙে গিয়েছিল আন্টি।

দিহাদের কথায় আয়েশা বেগম রাগ দেখিয়ে বললো,

– দেখেছো কেমন বেখেয়ালি আচরণ এই ছেলের।তোর ফোনটা ভেঙে গেছে তো তুই আরেকটা নতুন ফোন নিবি না।কিন্তু না,উনি সেটা না করে এই ভাঙা ফোন দিয়েই কাজ চালিয়ে নিচ্ছে।কেন?তোর কাছে টাকা না থাকলে আমাকে বলতি আমি দিতাম।এই ভাঙা ফোনে তোকে কেউ কল দিলে যেমন তুই দেখতে পাস না তেমনি তুইও তো কাউকে কল দিতে গেলে দেখতে পাস না।তুমি ঠিকই বলেছো দিহাদ,এই ছেলের আসলেই কোনো দিন আক্কেল জ্ঞান হবে না।আচ্ছা ওর কথা বাদ দাও তো।মুখ দেখে তো মনে হচ্ছে বাসা থেকে কিছু খেয়ে আসো নি।তুমি টেবিলে বসো আমি খাবার দিচ্ছি।

দিহাদ আসলেই বাসা থেকে কিছু খেয়ে আসে নি।তাই আয়েশা বেগমের কথা মতো চুপচাপ গিয়ে খেতে বসে গেলো।

___________________

– ভাবী আমার সিরিয়ালের কাগজটা কোথাও খুঁজে পাচ্ছি না।

বাংলাদেশ আই ভিশন হসপিটালের করিডরে বসে আছে মেহেনূর আর রোশনি।সিরিয়াল নাম্বার ছাড়া তো ডক্টরের কেবিনে এলাউ করবে না।কানাডায় মেহেনূর যে ডাক্তারের কাছে ওর চোখের ট্রিটমেন্ট করতো সেই ডাক্তার মানে ডঃ স্নিগ্ধজিৎ ব্যানার্জি এখন বাংলাদেশে এসেছে।তাই এখানে উনার সাথে দেখা করতে এসেছে ও।কারণ রাওনাফ আর রোশনির বিয়ে শেষ হওয়া অব্দি অনেকটা সময় লেগে যাবে।আর ততদিন মেহেনূরের পক্ষে ওয়েট করা পসিবল না।তাই মেহেনূর ডঃ স্নিগ্ধজিৎ ব্যানার্জির সাথে কথা বলে জানতে চেয়েছিল বাংলাদেশে ওর আই টেস্ট করাতে পারবে কিনা।মেহেনূরের গুড লাক,উনিই নাকি আগামী সপ্তাহেই বাংলাদেশে আসবেন আর আই ভিশন হসপিটালে তাকে পাওয়া যাবে।তাই মেহেনূর কালকে একটা সিরিয়াল কেটে রাখে আর আজ ও হসপিটালে আসে।কিন্তু হসপিটালের এসে দেখে ব্যাগে সিরিয়ালের কাগজটা নেই।

ইদানীং মেহেনূরের চোখে একটু বেশিই প্রবলেম হচ্ছে।চশমা পড়লেও চোখে ঘোলা দেখে।বই পড়তে গেলে অনেক প্রেশার দিতে হয় চোখের উপর।ফলে চোখে আর মাথায় প্রচন্ড রকমের ব্যাথা অনুভব হয়।তাই মেহেনূর ভেবেছিল আজকে ডাক্তারকে দেখালেই ঠিক হয়ে যাবে।কিন্তু এখন মনে হচ্ছে আজকে আর পসিবল হবে না।রোশনি মেহেনূরকে মুখ গোমড়া করে বসে থাকতে দেখে বলে,

– ভালো করে খুঁজে দেখো পাবে।

মেহেনূরের এবার কান্না চলে আসছে।নিজের এমন ইরেসপন্সিবল কাজের জন্য নিজের উপর বিশাল রাগ হচ্ছে।রোশনির দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে কাঁদো কাঁদো গলায় বললো,

– আরে না ভাবী,ব্যাগে নেই।আমি ভালো করেই খুঁজে দেখেছি।

– তুমি ব্যাগটা আমার কাছে দাও তো দেখি আমি….

– যেটা খুঁজছেন সেটা তো আমার কাছে ব্যাগে পাবেন না।

রোশনি ওর পুরো কথা শেষ করার আগেই অর্কের কথা শুনে চমকে উঠে। মেহেনূর আর রোশনি দুজনেই চকিত দৃষ্টিতে সামনের দিকে তাকায়।অর্কের কথার মানে বুঝতে না পেরে মেহেনূর আশ্চর্য হয়ে বলে,

– মানে?

অর্ক একটা মুচকি হাসি দিয়ে ওদের সামনে এসে দাঁড়ায়।তারপর হাতে থাকা কাগজটা মেহেনূরের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,

– এটা বাসাই ফেলে রেখে এসেছিলে।

কাগজটা দেখতে পেয়ে যেন আত্মায় পানি আসে মেহেনূরের।সৌজন্যমূলক হাসি দিয়ে অর্কের হাত থেকে কাগজটা নিয়ে বলে,

– থ্যাংকস।আপনি এটা কোথায় পেয়েছেন?

– ড্রয়িং রুমে পড়েছিল।

রোশনি আশ্চর্য হয়ে অর্কের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললো,

– কিন্তু অর্ক তুমি কি করে জানলে আমরা এখানে আছি?

অর্ক রোশনির বোকামি কথায় মনে মনে হাসে।অর্ক নিজের হাসি নিজের মধ্যেই দমিয়ে রেখে বললো,

– ওইটাতে তারিখ আর সময়ের সাথে হসপিটালের নামটাও দেওয়া আছে।

– ও তাই তো,আমিও না।যাকগে,কিন্তু তুমি শুধু শুধু কষ্ট করতে গেলে কেন রাওনাফকে বললেই তো হতো।

– ইটস ওকে,আসলে আমিও একটু শপিং মলের দিকে যাবো।তো ভাবলাম এইদিক দিয়েই যেহেতু যাবো আমিই না হয় দিয়ে যাই।শুধু শুধু ওকে দৌড় করানোর কি দরকার।

– ও আচ্ছা।

– হুম।আচ্ছা,আমি এখন আসি।

– ঠিক আছে।

অর্ক চলে যাওয়ার মিনিট পাঁচেক পরেই মেহেনূর আর রোশনি ডাক্তারের চেম্বারে ঢুকে।ডাক্তারকে মেহেনূর ওর আগের সব রিপোর্ট গুলো দেখায়।কিন্তু এখন আই টেস্ট না করে আগের রিপোর্ট দেখে কোনো কাজ হবে না।তাই প্রথমেই মেহেনূরকে আই টেস্ট দেওয়া হয়।তারপর ওই টেস্টের রিপোর্ট নিয়ে আবার ডাক্তারের সাথে দেখা করে।পুরো রুম জুড়ে পিনপতন নীরবতা।ডাক্তার সাহেব খুব সিরিয়াস মুখ করে নতুন পুরাতন সব গুলো রিপোর্ট পর্যবেক্ষণ করছেন।ভয়ে মেহেনূরের গলা শুকিয়ে আসছে। না জানি রিপোর্টে কি রেজাল্ট এসেছে।রোশনির হাত শক্ত করে চেপে ধরে রেখেছে মেহেনূর।রোশনি ওর হাতের উপর নিজের হাত রেখে আশ্বাস দিয়ে বলে,

– ভয় পেয়ো না।রিপোর্ট ভালোই আসবে।

কিন্তু মুখের কথায় কি কাজ হয়।যতক্ষণ না পর্যন্ত জানতে পারছে ততক্ষণ পর্যন্ত মেহেনূরের ওই অশান্ত মন শান্ত হবে না।রোশনির দিকে এক পলক তাকিয়ে আবার ডাক্তারের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে মেহেনূর।মিনিট দুয়েক পরেই ডাক্তার সাহেব রিপোর্ট গুলো তুলনামূলক শব্দ করেই টেবিলের উপর রেখে দিয়ে মুখে একটা অমায়িক হাসি ঝুলিয়ে বললো,

– ওয়েলকাম মিস মেহেনূর হোসেন।তোমার অপারেশন সাকসেসফুল হয়েছে।যদিও অপারেশনের পরে ডাউট ছিল যে তুমি কি আদৌ চশমা ছাড়া দেখতে পাবে কিনা।কিন্তু এখন আর কোনো ডাউট নেই।এভ্রিথিং ইজ ওকে।তাও তোমার রিকভার হতে একটু সময় লেগেছে।তোমার চোখে অপারেশন হয়েছে প্রায় আরো দুই মাস আগে।তোমাকে বলেছিলাম চশমা ইউজ না করতে কিন্তু তুমি মনে হয় আমার কথাটা শুনো নি।বাংলাদেশে আসার পর থেকেই তুমি চশমা ইউজ করছো।ফলে মাঝে মাঝে তুমি চোখে ঝাপসা দেখো।তোমার চোখে লেন্স বসানো হয়েছে মেহেনূর।এখন তো আর এই চশমাটা ইউজ করার কোনো প্রশ্নই আসে না।হ্যাঁ তবে, আমি তোমাকে বলেছিলাম যদি কখনো দেখতে অসুবিধে হয় তখন তুমি চশমাটা ইউজ করতে পারো।কিন্তু তুমি কি করলে চব্বিশ ঘণ্টাই চোখে চশমা লাগিয়ে বসে রইলে।

ডাক্তার সাহেবের কথায় মেহেনূর কিছুটা হকচকিয়ে যায়।স্মিত হেসে বলে,

– আসলে আমি সব সময় চশমাটা চোখে দেই নি।বিশেষ করে যখন বাহিরে রৌদ্রের মধ্যে যেতাম তখন দিতাম।বাসায় বাবা মা জানে না আমি চোখে অপারেশন করিয়েছি। তাদেরকে সারপ্রাইজ দেবো বলে বলি নি।কিন্তু আমি যদি চশমাটা না পড়ি তাহলে তাদের সন্দেহ হতো না?তাই আরকি!

– ওকে,বুঝতে পেরছি।যাইহোক, এখন আর এই চশমাটা ইউজ করার প্রয়োজন নেই।তুমি এখন খালি চোখেই দেখতে পাবে।আর শুনো কিছু দিন তোমাকে সেইফলি চলাফেরা করতে হবে।বাহিরে গেলে সানগ্লাস পড়ে যাবে।মেডিসিন গুলো আরো ছ’মাস কন্টিনিউ করতে হবে।মুখে সব সময় ঠান্ডা পানি ইউজ করবে ঠিক আছে।মেহেনূর তোমার চোখের রং টা কিন্তু রেয়ার,যত্নে রেখো সবসময়।কয়জনের এই নীল চোখ আছে বলে তো।অনেকে তো কৃত্রিম লেন্স লাগিয়ে নিজেদের মনের আশা পূরণ করে।আর সেই জায়গায় তুমি সৃষ্টিকর্তা কাছ থেকে এই অপরূপ চোখের অধিকারিণী হয়েই পৃথিবীতে এসেছো।

মেহেনূর খুব মনোযোগ দিয়ে ডাক্তারের কথাগুলো শুনছিল।ডাক্তারের বলা শেষের কথাটা শুনে বিনিময়ে শুধু স্মিত হাসে।পরমুহূর্তেই জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে বললো,

– আচ্ছা ডক্টর, আমি কি মাইনাস পাওয়ারের কোনো নরমাল চশমা ইউজ করতে পারবো?

– সেটার তো কোনো প্রয়োজন নেই।ইউ আর অলরাইট নাউ।

মেহেনূর করুণ স্বরে বললো,

– দরকার আছে ডক্টর।প্লিজ বলুন না।

– করা যাবে।আমি তোমাকে একটা গ্লাস সাজেস্ট করছি,যদি কখনো চশমা ইউজ করো তাহলে এই পাওয়ারের গ্লাসটা ইউজ করবে ঠিক আছে।আর অবশ্যই তিন মাস পর পর নতুন গ্লাস ইউজ করবে।

ডাক্তার সাহেব একটা ফাইলের মধ্যে সব ডিটেইলস লিখে দিলেন কি করতে হবে না করতে হবে।ডাক্তারের কাছ থেকে সবকিছু বুঝে নিয়ে মেহেনূর আর রোশনি হসপিটাল থেকে বেড়িয়ে আসে।

______________

অর্ক শপিং করে সোজা এনজিওতে চলে যায়।বাচ্চাদের জন্য নিয়ে আসা সব জিনিসপত্র ওদের সবাইকে বুঝিয়ে দিয়ে নিজের ডেস্কে এসে বসে।টেবিলের উপর একটা সবুজ খামে চোখ পড়ে অর্কের।খামটা হাতে নিয়ে দুপাশে ঘুড়িয়ে দেখলো কোনো ঠিকানা দেওয়া আছে কিনা।ঠিকানা না পেয়ে খামটা খুলে অর্ক।খামটা খুলতেই চমকে উঠে অর্ক।খামটার ভিতরে বিশ লাখ টাকার একটা চেক।হাতের সাইনটা খুব পরিচিতি।অর্ক আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে আছে চেকটার দিকে।দরজা খোলার আওয়াজ পেয়ে সামনে তাকিয়ে দেখে দিহাদ এসেছে।দিহাদ অর্কের হাতের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে বললো,

– ও রকম হা করে তাকিয়ে থাকার মতো অবিশ্বাস্য কিছু হয় নি।ওটা কিরণ চৌধুরীরই হাতের সাইন।বাচ্চাদের জন্য ওই টাকা ডোনেশন দিয়েছে।অবশ্য এর প্রভাব কিছুটা তোর উপরেও পড়তে পারে।

দিহাদের কথার ধরণ অর্ক বুঝতে পারছে না।কপাল কুচকে তাকায় দিহাদের দিকে।ভারী গলায় বললো,

– মানে?

দিহাদ তাচ্ছিল্যের সুরে বললো,

– সূর্যের কিরণের স্মৃতি জড়িয়ে আছে তো ওই চেকটায়।

দিহাদের ওমন হেয়ালি করে কথা বলাটা অর্কের খুব বিরক্ত লাগছে।সোজা কথা সোজাসাপটা ভাবে কোনো দিনই বলবে না ও।সব সময় ঘুরিয়ে প্যাচিয়ে কথা বলে।অর্ক চোখ রাঙিয়ে বললো,

– ভনিতা না করে ক্লিয়ারলি বল তো কি বলছে চাচ্ছিস তুই?

দিহাদ একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে অর্কের সামনের চেয়ারটায় বসে।তারপর অর্কের হাত থেকে খামটা নিয়ে নেয়।অর্ক হা করে দিহাদের দিকে তাকিয়ে আছে। দিহাদ চেকটা খামের ভেতর রাখতে রাখতে বললো,

– গত দুই রাত পর পর দু’দিন কিরণ চৌধুরীর কনসার্ট ছিল।পরশু দিনেরটা ছিল লেকের ধারে পুরাতন স্টেডিয়ামে আর গত রাতে ছিল নীল চত্ত্বরে।আর গত রাতের কনসার্টটাই কিরণ চৌধুরীর শেষ কনসার্ট ছিল।

অর্ক হতভম্ব হয়ে দিহাদের দিকে তাকিয়ে আছে।কি বলবে বুঝতে পারছে না।মাথার চুল উল্টে ধরে টেবিলের উপর হাতের কনুইয়ে ভর দিয়ে কয়েক সেকেন্ড চুপ করে বসে থেকে ধীর কন্ঠে বললো,

– আমাকে বলিস নি কেন?

অর্কের কথা শুনে দিহাদের রাগ হলেও এই মুহূর্তে ওর রাগ প্রকাশ করা উচিত হবে না।কেননা,অর্ক অলরেডি এক ঝটকা ছ্যাকা খেয়ে ফেলেছে।কাটা গায়ে আর নুন ছিটিয়ে লাভ নেই।তাই দিহাদ নরম গলায় বললো,

– পরশু দিন যে কনসার্ট ছিল সেটা আমিও কাল জানতে পারি।আর কাল রাতেও যে কনসার্ট ছিল সেটা অবশ্য আগেই জানতে পেরেছিলাম।কাল তোকে বিকাল থেকে সন্ধ্যা অব্দি অনেক গুলো কল দিয়েছিলাম।কিন্তু তুই একবারও রিসিভ করিস নি।আজ সকালেও অনেকগুলো কল দিয়েছি কিন্তু তুই তখনও কল রিসিভ করিস নি।পরে অপারগ হয়ে তোর বাসায় গিয়ে আন্টির কাছ থেকে জানতে পারি তুই তোর ফোন সাথে করে নিয়ে বের হোস নি।এখন বল,এতে আমার কি করার থাকতে পারে?আমি তো চেষ্টার কোনো কমতি রাখি নি।

নিজের করা বেখেয়ালি আচরণের জন্য অর্কের নিজের উপর খুব রাগ হচ্ছে।কিন্তু এই মুহূর্তে রাগের মাথায় কোনো কাজ হবে না।তাই নিজের রাগকে কন্ট্রোল করে শক্ত গলায় বললো,

– কালকেই যে শেষ কনসার্ট করেছে এটা তোকে কে বললো?

– কিরণ চৌধুরী নিজেই কালকে বলেছে।কালকের কনসার্টটাই ছিল ওর এইখানের শেষ কনসার্ট।

– আর চেক? এটা এইখানে কি করে এলো?কে দিয়ে গেছে?

দিহাদ স্মিত হেসে বললো,

– তোকে আগেই বলেছি যে, এই মেয়ে ওর উপার্জনের অর্থের বিশাল অংকের একটা এমাউন্ট ডোনেশনের কাজে দিয়ে দেয়।আমাদের এনজিওর সামনে যে দোকানটা আছে ওই দোকানের রহিম চাচা বললো,তার দোকানে নাকি কালকে কিরণ চৌধুরীর পদধূলি পড়েছিল।চা খেতে খেতে এক পর্যায়ে আমাদের এই এনজিওর কথা জিজ্ঞাস করলে রহিম চাচা যা যা জানে সব বলে।আর সাথে অনাথ আশ্রমের কথাটাও বলে।তখন তার হাতে এই খামটা ধরিয়ে দিয়ে যায়।সকালে আমি যখন এনজিও তে আসি তখন রহিম চাচা এসে এই খামটা আমার হাতে দিয়ে গেছে।রহিম চাচাকেও নাকি দুই লাখ টাকা দিয়েছে।তবে তাকে আমাদের মতো চেক দেয় নি ক্যাশ দিয়েছে।ভাবতে পারছিস?আচ্ছা এই মেয়ের চলাফেরা কেমন জানি!আমার কাছে খুব রহস্যময় মনে হয়।

দিহাদ একটু থেমে অবাক স্বরে বললো,

– না ভাই,আ’ম ডেম শিউর এই মেয়ে কোনো সাধারণত মানুষ নয়।

এইমুহূর্তে অর্কের মাথার নিউরন গুলো কোনো কাজ করছে না।দিহাদের কথার প্রত্যুত্তরে কি প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করবে সেটাও ও বুঝতে পারছে না।ঘটে যাওয়া ঘটনা গুলো ওর সাজাতে একটু সময় প্রয়োজন।তবে মুহূর্তে সেটা পসিবল না।অর্ক ওর হাতের ঘড়িটায় তাকিয়ে দেখে পৌনে পাঁচটা বাজে।দিহাদকে উদ্দেশ্য করে বলে,

– আমাকে একটু বেরুতে হবে।আসছি আমি।

চলবে……..#অগোচরে_তুমি
লেখনীতেঃ স্বর্ণালী তালুকদার

১৫.

অর্ক বিষন্ন মনে এনজিও থেকে বেড়িয়ে সোজা মেহেনূরদের বাড়িতে চলে আসে।তারপর ওখান থেকে রাওনাফকে নিয়ে এয়ারপোর্টে চলে যায়।এইদিকে মেহেনূর আর রোশনি শপিং শেষ করে শপিং কমপ্লেক্স থেকে বেড়িয়ে গাড়িতে উঠতে যাবে ঠিক তখনই মেহেনূরের মনে পড়ে ওর চশমাটা কেনা হয় নি।তাই রোশনিকে গাড়িতেই বসতে বলে মেহেনূর আবার শপিং কমপ্লেক্সের ভেতরে চলে যায়।কিচ্ছুক্ষণ পরেই চশমা নিয়ে চলে আসে মেহেনূর।মাকে দেওয়া কথা রাখতে সন্ধ্যার আগেই ওরা বাড়ি চলে আসে।বাড়িতে এসে দেখে রোশনির বাবা মা চলে এসেছে।অবশেষে বাসায় এসে বাবা মাকে সারপ্রাইজটা দিয়েই দেয় মেহেনূর।মেহেনূরের এই পরিবর্তনে রেনুফা বেগম আর মেহরাব সাহেব আসলেই অবাক হয়েছেন তার সাথে অনেক খুশিও হয়েছে।খুব ছোট বেলায়ই মেহেনূরের চোখের সমস্যা ধরা পড়ে।কাছের জিনিস ক্লিয়ার দেখতে পেতো না।আর দূরের জিনিস তো একদমই দেখতে পারতো না।মেহরাব সাহেব কত চেষ্টা করেছেন মেহেনূরের চোখে অপারেশন করাতে।কিন্তু মেহেনূর খুব ভয় পেতো।অপারেশন করাতে দেয় নি।পরে তো রাওনাফের সাথে কানাডাতেই চলে যায়।তাও মেহেরাব সাহেব আর রেনুফা বেগম বলেছিলেন,বিদেশের উন্নত চিকিৎসায় মেহেনূর যাতে ওর চোখের অপারেশনটা করিয়ে নেয়।কিন্তু মেহেনূর তখন রাজি হয় নি।ওর নাকি চশমা ব্যবহার করতে কোনো সমস্যাই হয় না। বরং চমশা পড়তে ওর ভালোই লাগে।যাইহোক এত বছর পর মেয়ের সম্মতি হয়েছে এটাই তাদের কাছে অনেক।

সন্ধ্যার পরে মেহেনূরদের বাসার সবাই ড্রয়িং রুমে জড়ো হয়েছে।রাওনাফ আর রোশনির বিয়ের আলাপ আলোচনা করার জন্য।আকাশ সাহেব আর আয়েশা বেগমও এসেছেন।তাদেরকেও নিয়ে আসা হয়েছে।কিন্তু এই মুহূর্তে তাঁদের ছেলের উপর খুব রাগ হচ্ছে উনাদের।রাওনাফ বললো,এয়ারপোর্টে যাওয়ার পর অর্ক রাওনাফ বললো রোশনির বাবা মাকে নিয়ে বাড়ি চলে আসতে আর ওর নাকি এয়ারপোর্টে কি কাজ আছে তাই ও এয়ারপোর্টেই রয়ে গেছে।কিন্তু এখন, রাওনাফ যখনই অর্ককে কল দিচ্ছে তখনই শুধু বলছে আসছি।কিন্তু এখনো ওর আসার নাম গন্ধ নেই।আকাশ সাহেব ছেলের এমন ব্যবহারে বিরক্ত হয়ে আয়েশা বেগমের কানে কানে ফিসফিস করে বললেন,

– তোমার ছেলের কি কোনোদিনও বুদ্ধিশুদ্ধি হবে না?এতগুলো মানুষকে এইভাবে বসিয়ে রাখার কোনো মানে হয়?

আয়েশা বেগমও দাঁতে দাঁত চেপে ফিসফিস করে বলেন,

– ছেলে কি শুধু আমার একার নাকি?তোমারও তো ছেলে।আর তুমি কাকে কি বলছো?ছেলে তো হয়েছে তোমারই মতো!

– আমার মতো মানে?আমি কি করেছি?

– কেন?মনে নেই আমার ভাইয়ার জন্য বউ দেখতে যাওয়ার সময় কি করেছিলে?

– বেশ করেছি!আমার বন্ধু,আমি যা খুশি তাই করবো।তুমি বলার কে শুনি?

– তাহলে এখন ছেলেকে বকছো কেন?ওরো তো বন্ধুর বিয়ে!

আয়েশা বেগমের সাথে যে উনি কথায় পেরে উঠবেন না সেটা খুব ভালোভাবে জানেন।তাই বউয়ের সাথে আর কথা না বাড়িয়ে মেহরাব সাহেবকে উদ্দেশ্য করে বললো,

– মেহরাব ভাই,আপনারা আলোচনা শুরু করেন।অর্ক না হয় পড়ে এসে জয়েন করবে।

– না আঙ্কেল!যে পর্যন্ত অর্ক না আসছে সে পর্যন্ত বিয়ের ডেইট ফিক্সড করা যাবে না।ও আসলেই ডেইট ফিক্সড করা হবে।

রাওনাফ বেঁকে বসে আছে। ও অর্ককে ছাড়া বিয়ের কথা শুরু করবে না।আকাশ সাহেব রাওনাফের কথায় হেসে দিয়ে বলেন,

– আরে বাবা আলোচনা করা কি মানে বিয়ের ডেইট ফিক্সড করা নাকি? একটা বিয়েকে কেন্দ্র করে আরো কতকিছুর আয়োজন করতে হয়।আমরা না হয় এখন ওইগুলো নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনাটা সেড়ে নিই।অর্ক আসলে তারপর না হয় তোমরা বিয়ের ডেইটটা বলে দিও।

আকাশ সাহেবের কথায় যথাযথ যুক্তি আছে।তাই রাওনাফ আর মানা করতে পারলো না।বড়রা সবাই মিলে বিয়ের অনুষ্ঠান কোথায় কিভাবে করা হবে, বিয়েতে কতজন গেস্ট থাকবে এইসব নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলাপ আলোচনা করছেন।তাদের এইসব আলাপকালেই আগমন ঘটে অর্কের।রাওনাফের ইচ্ছা অনুযায়ী অর্ক আসার পরেই আগামী শুক্রবার রাওনাফ আর রোশনির বিয়ের ডেইট ফিক্সড করা হয়।তবে বিয়ের অনুষ্ঠান বাহিরের কোনো রিসোর্ট বা কমিউনিটি সেন্টারে করা হবে না।রাওনাফের বিয়ের রিসেপশনের আয়োজন বাড়িতেই করা হবে।কিন্তু সমস্যা হলো রোশনিদের নিয়ে। এখানে রোশনিদের কোনো আত্মীয়স্বজন নেই যে, ওদের বাসা থেকে রোশনির বিয়েটা হবে।তাই রোশনির বাবা মা ঠিক করলো তারা বিয়ের অনুষ্ঠানের জন্য রিসোর্ট বুক করবেন।তাদের এমন ধারা কথা শুনে আকাশ সাহেব ফিচেল হেসে উঁচু গলায় বললো,

– আরে ভাই সেটা কি করে হয়!আমার এত বড় বাড়ি থাকতে আপনাদের রিসোর্টে যেতে হবে কেন?আর আপনাদের তো এখানে কোনো আত্মীয়ও নেই যে গেস্টদের ঝামেলা আছে।বরযাত্রী যারা আসবে ওদের আপ্যায়নটা করার জন্য শুধু শুধু রিসোর্ট বুক করার কোনো দরকার নেই।রোশনিকে আমাদের বাড়ি থেকে উঠিয়ে দেওয়া হবে ব্যাস, ডিসিশন ফাইনাল।এর মধ্যে কোনো কিন্তু নেই।কেউ কোনো কথা বলবেন না।আমি যা বললাম তাই হবে।এখন উঠুন ব্যাগপত্র নিয়ে আমাদের সাথে চলুন।বিয়ের বাকি আছে আর মাত্র তিন দিন।মেয়ের বিয়ে বলে কথা অনেক কাজ করতে হবে সে খেয়াল আছে?

আকাশ সাহেব জোর গলায় বললেন কথাগুলো।তাকে ফিরিয়ে দেওয়ার সাধ্য কারোর নেই।তাই তার এক কথাতেই সবাই রাজি হয়ে গেছে।অর্ক বাবার এমন উদারতা দেখে মনে মনে বেশ প্রশান্তি পাচ্ছে।ছেলের মনের কথাগুলোই বলে দিয়েছেন আকাশ সাহেব।বাবা দিকে কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে উঠে দাঁড়ায় অর্ক।অর্ককে দাঁড়াতে দেখে রেনুফা বেগম উৎকন্ঠিত স্বরে বললো,

– আরে অর্ক তুমি উঠছো কেন?খাওয়া দাওয়া শেষ করে তবেই যাবে।

– উঠছি না আন্টি।বর এখানে থাকলেও কনেকে তো কোথাও দেখতে পাচ্ছি না।যাই একটু তার সাথে দেখা করে আসি।

– ও আচ্ছা,ঠিক আছে যাও।

অর্ক রাওনাফকে নিয়ে উপরে মেহেনূরের ঘরের উদ্দেশ্যে চলে গেলো।ওরা সিঁড়ি পর্যন্ত যেতেই রাওনাফের ফোনে কল আসে।রাওনাফ অর্ককে যেতে বলে একটু সাইডে গিয়ে কলটা রিসিভ করে।অর্ক মেহেনূরের ঘরে গিয়ে দেখে ঘর ফাঁকা,কেউ নেই।অর্ক ঘর থেকে বেড়িয়ে আসার জন্য উদ্যত হতেই কারোর উচ্চ স্বরে হাসির শব্দ ওর কর্ণকুহরে প্রবেশ করে।হাসিটা অপরিচিত লাগলো অর্কের কাছে।থেমে যায় অর্ক।হাসির শব্দ অনুসরণ করে পেছনে পেছনে পা ফেলে হাটছে অর্ক।হাসির আওয়াজটা ব্যালকনি থেকে আসছে।অর্ক পিছন ফিরে এগোয় ব্যালকনির দিকে।ব্যালকনির দরজাটা লাগানো,তবে পুরোপুরিভাবে নয়।অনেকটাই ফাঁক হয়ে আছে।অর্ক দরজার কাছে যেতেই আধখোলা ওই দরজার ফাঁক দিয়ে মেহেনূরের হাস্যউজ্জ্বল মুখটা স্পষ্ট ধরা পড়ে অর্কের চোখে।কোনো এক অন্যজগতের ভাবনায় চলে গেছে অর্ক।মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে মেহেনূরের দিকে।এ কোন মেহেনূরকে দেখছে ও?এর আগে মেহেনূরকে এই রূপে কোনোদিন দেখে নি অর্ক।রাওনাফের সাথে ওর দূরত্ব তৈরি হওয়ার সময় মেহেনূর খুব ছোট ছিল।কিন্তু যখন রাওনাফের সাথে সম্পর্কটা ভালো ছিল তখন ওদের বাসায় যাওয়া আসার প্রায় সময়ই দেখতো মেহেনূর ওর রুমেই চুপচাপ বসে থাকতো।নয়তো মায়ের সাথে থাকতো।চোখে চশমা পড়তো বিদায় অর্ক ওকে চাশমিশ বলে ডাকতো।মেহেনূর খুব বেশি অর্কের সামনে আসতো না। লজ্জায় নাকি রাগে কারণটা মেহেনূরই ভালো জানে।তারপরে কানাডায় চলে যাওয়ার পরে অনেক দিন পর পর মেহেনূর ওদের বাড়িতে আসতো।আয়েশা বেগমের মুখে শুনতো মেহেনূর নাকি দেখতে শুনতে মাশাল্লাহ অনেক সুন্দর হয়েছে।কিন্তু অর্ক মায়ের কথায় কোনো দিনই সেইভাবে পাত্তা দেয় নি।রাস্তায় চলা ফেরায় অনেকবার দেখা হতো মেহেনূরের সাথে।যদি কখনো চোখাচোখি হয়ে যেতো তাহলে মেহেনূর শুধু সালাম দিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে যেতো।কেমন অদ্ভুত যেন মেয়েটা।সবসময় কেমন জানি চুপচাপ থাকে।দশ কথার প্রত্যুত্তরে একটার উত্তর দেয়।মেয়ের মুখে হাসি নেই বললেই চলে।তাই মেহেনূরকে বরাবরই বোরিং লাগতো অর্কের।কিন্তু আজ যেনো এই মেয়ের হাসির বাঁধ ভেঙেছে।আজকে চোখের সেই কালো মোটা ফ্রেমের ভারী গ্লাসের চশমাটা নেই।চশমা ছাড়া তো ওকে চেনাই যাচ্ছে না। চুলে বেনুনিও নেই।খোলা চুলগুলো হাসির সুরের ঝংকারে যেনো ঢেউ তুলছে।দেখতে অপরূপ সৌন্দর্য্য লাগছে।এই মেয়ে এতো হাসতে পারে?এই গুণের করা অর্কের জানা ছিল না।অর্ক নিজের মনে অজান্তেই হাত বাড়িয়ে দরজাটা আরেকটু খুলে দেয়।দরজার ফ্রেমটায় হেলান দিয়ে বুকে হাত গুজে এক দৃষ্টে তাকিয়ে আছে সামনে থাকা মেহেনূরের দিকে।হঠাৎ করেই দরজার দিকে চোখ পড়ে রোশনির।অর্ককে ওইভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রোশনি আশ্চর্য হয়ে গলার স্বর উঁচু করে বললো,

– আরে অর্ক যে!তুমি কখন এলে?

রোশনির গলার আওয়াজ পেয়ে ঘোর কাটে অর্কের।চটজলদি নিজেকে সামলে নিয়ে এগোয় সামনের দিকে।মুখে কৃত্রিম হাসি ঝুলিয়ে বললো,

– এইতো মাত্রই।আপনারা কথা বলছিলেন তাই ডিস্টার্ব করি নি।সবাই নিচে আপনাদের বিয়ের দিন তারিখ ঠিক করছে আর আপনারা এখানে বসে আড্ডা দিচ্ছেন?

অর্ককে দেখে ঠিকঠাক হয়ে দাঁডালো মেহেনূর।রোশান পাশ কাটিয়ে বোনের সাথে গিয়ে দাড়ালো। রোশনি মিষ্টি হেসে বললো,

– মেহেনূর আর রোশান ওরা বেস্ট ফ্রেন্ড। আসলে অনেক দিন পর রোশান এসেছে তো তাই মেহেনূর ওকে পেয়ে রাজ্যের আলাপ জুড়ে দিয়েছে।ওদের আলাপচারিতাই শুনছিলাম। আর নিচে যাই নি কারণ বড়রা যেটা ভালো মনে করবেন সেটাই হবে।এতে আমার কোনো আপত্তি নেই।

– তা আপনি কি জানেন এই বাড়ি থেকে আপনার বিয়েটা হচ্ছে না?

আঁতকে উঠে রোশনি।অর্কের এই কথার মানে কি?রোশনি উৎকন্ঠিত স্বরে বললো,

– মানে?

অর্ক সবার দিকে চোখ বুলিয়ে রোশনি আর রোশানের চোখে মুখে ভয়ের ছাপ দেখতে পেয়ে উচ্চ স্বরে হেসে দেয়।আকস্মিক অর্কের এমন হাসির কারণ বুঝতে না পেরে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় রোশনি আর রোশান।অর্কের কথার মানে ওরা না বুঝলেও মেহেনূর বুঝতে ঠোঁট টিপে হাসছে।রোশনিকে জড়িয়ে ধরে বললো,

– আরে ভাবী এতো হাইপার হওয়ার কিছু নেই।তোমার বিয়েটা এই বাড়ি থেকে হচ্ছে না মানে এই না যে বিয়েটাই আর হচ্ছে না!উনার কথার মানে হলো,আমাদের বাড়ি থেকে তোমার বিয়েটা দেওয়া হবে না।ভাইয়া বরযাত্রী নিয়ে অন্যকোথাও থেকে তোমাকে আমাদের বাড়িতে তুলে নিয়ে আসবে।বুঝতে পেরেছো এবার?

রোশনি মেহেনূরের কথা শুনে মনে স্বস্তি পেলো। নরম গলায় বললো,

– ও আচ্ছা তাই বলো।অর্ক, ভাই তুমি তো আমাকে ভয়ই পাইয়ে দিয়েছিলে!

– এত ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই।এই জন্ম সহ আগামী ছয় জন্ম পর্যন্ত তোমাকে আমি ছাড়ছি না!

প্রিয় মানুষটির চিরচেনা কন্ঠস্বর কর্ণগোচর হতেই চকিত দৃষ্টিতে দরজার দিকে তাকায় রোশনি।তড়িৎ বেগে ছুটে এসে জড়িয়ে ধরলো কাঙ্ক্ষিত মানুষটিকে।রাওনাফ তাল সামলাতে না পেরে কিছুটা পিছিয়ে যায়।তবে যথাসময়ে নিজেকে সামলে ঔ শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো রোশনিকে।রোশনি এবার কেঁদেই দিয়েছে।মেহেনূর আর রোশান ওদের একটু স্পেস দেওয়ার জন্য ব্যালকনি থেকে বেড়িয়ে আসে।কিন্তু আহাম্মককে মতো দাঁড়িয়ে আছে অর্ক।রাওনাফ ওকে চোখে ইশারা করলো চলে যাওয়ার জন্য।অর্ক কিছুক্ষণ রাওনাফের দিকে তাকিয়ে থেকে স্মিত হেসে চলে আসে।

_________________

মেহেনূরদের বাসা থেকে একটু আগেই সবাই চলে আসে অর্কদের বাসায়।অর্ক নিজের ঘরে এসে ফ্রেশ হয়ে নিয়ে সিগারেটের প্যাকেট আর লাইটার টা নিয়ে ব্যালকনিতে চলে যায়।আজো নেশার ঘুরে গা ভাসাতে মন চাইছে।সিগারেট টা মুখে পুরে লাইটার দিয়ে আগুন ধরাতে গেলেই ওইদিন মেহেনূরের বলা কথাটা মনে পড়ে গেল অর্কের।সিগারেট স্বাস্থ্যের জন্য হানিকারক!অর্ক মুখে থেকে সিগারেটটা নামিয়ে নিয়ে তাচ্ছিল্যে হাসে।এই নেশা ওর স্বাস্থ্যের জন্য হানিকারক নয়।বরং যে নেশায় ও আসক্ত হয়েছে ওই নেশায় বিভোর হতে না পারায় ওর জীবন ধীরে ধীরে বিষাদে রূপান্তরিত হচ্ছে।কিছুতেই ওর ধরা ছোয়া পাচ্ছে না।বার বার ওর চোখে ধূলো দিয়ে সে কোথাও হারিয়ে যাচ্ছে।অবাক করার বিষয় হলো আজকে এয়ারপোর্টে অর্ক খুঁজ নিতে গিয়ে জানতে পারে গত দু’মাসেও কিরণ চৌধুরী নামে কোনো প্যাসেঞ্জার দেশের ভেতরে বা বাহিরে যায় নি।যদিও একই নামের একজনকে পেয়েছিল।কিন্তু তিনি একজন বয়স্ক মহিলা,যুক্তরাষ্ট্রে থাকেন।গতকাল সন্ধ্যার ফ্লাইটে উনি চলে গেছেন।হতাশ হয়ে চলে আসলেও অর্কের মনে সন্দেহের বীজ বুনছে আরো তীব্র ভাবে।তাহলে কিরণ চৌধুরী কি ওর ছদ্মনাম?তবে আসল নাম কি? হুট করেই সকালের কিরণের ওই চেকটার কথা মনে পড়ে অর্কের।দিহাদকে কল দিয়ে বলে ব্যাংকে যাওয়ার জন্য।কিন্তু আরেক দফায় অবাক হয় অর্ক।ব্যাংকে কিরণ চৌধুরীর নামে একাউন্ট আছে,আর দিহাদ চেকটা দিয়ে টাকা’টাও তুলেছে!অর্কের মাথা কাজ করছে না।এটা কিভাবে সম্ভব?ও কিভাবে এই রহস্যের গন্ডি অতিক্রম করে সত্যের মুখোমুখি হবে?হাতে থাকা সিগারেটটা ফেলে দিয়ে দ্রুত গতিতে ঘরে চলে আসে অর্ক।ভাবতে হবে!গভীর থেকে গভীরত ভাবে চিন্তা করতে হবে।ওর অগোচরে ঘটে যাওয়া ঘটনা গুলোর হিসাব মেলাতে হবে।এতো রাতে অর্কের রুমের লাইট অন দেখে আয়েশা বেগম এসে দেখেন অর্ক সারা ঘর জুড়ে পাইচারি করছে।কেমন যেন অস্থিরতা ভাব ওর মধ্যে।আয়েশা বেগম ছেলের কাছে এসে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে গম্ভীর স্বরে বললো,

– এত রাত হয়ে গেছে তুই এখনো ঘুমোস নি কেন?

মায়ের গলার স্বর সেই সাথে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দেখে হকচকিয়ে যায় অর্ক।এত রাতে ওর মা এ ঘরে আসবে ভাবতে পারে নি।তবে আসাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়।কারণ বরাবরের মতো অর্ক আজো ওর রুমের দরজা বন্ধ করে নি।অর্ককে চুপ থাকতে দেখে আয়েশা বেগম ফের বলেন,

– কি হলো কথা বলছিস না কেন?
– ঘুম আসছিল না।

অর্কের মুখে যা এসেছে তাই বলে দিয়েছে।কিন্তু আয়েশা বেগমের কাছে অর্কের উত্তরটা যুক্তিসঙ্গত মনে হলো না।অর্কের জেগে থাকার কারণটা অন্যকিছুই মনে হচ্ছে উনার।তিনি তার ছেলেকে খুব ভালো করেই চেনেন।সন্দিহান চোখে তাকিয়ে বললেন,

– কেউ কি এইভাবে হেটেচড়ে ঘুমায়?বিছানায় না শুলে ঘুমাবি কি করে?

মায়ের কথা শুনে আমতা-আমতা করতে থাকে অর্ক।এবার মাকে কি উত্তর দিবে বুঝতে পারছে না। নিজের কথার জালে নিজেই ফেঁসে গেছে।মুখে জোরপূর্বক হাসি টেনে বললো,

– আমি এক্ষুনি ঘুমিয়ে পড়ছি।তুমি যাও গিয়ে দেখো গেস্টদের কিছু লাগবে কি না।

– যা গিয়ে ঘুমিয়ে পড়।আমি লাইট অফ করে দিয়ে গেলাম।

আয়েশা বেগম চলে যেতেই ফোঁস করে দম ছাড়ে অর্ক।মায়ের সামনে মিথ্যে বলার দুঃসাহস ওর নেই।দরজার দিকে সেকেন্ড দুয়েক তাকিয়ে থেকে তারপর গিয়ে শুয়ে পড়ে।কিন্তু পনেরো মিনিট কেটে যাওয়ার পরেও অর্কের চোখে ঘুম আসছে না।বিছানায় শুয়ে ছটফট করছে অর্ক।কিছুতেই দু’চোখের পাতা এক করতে পারছে না।চোখ বন্ধ করতেই মেহেনূরের ওই হাস্যউজ্জ্বল মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠছে।নিজের মন মস্তিষ্কের উপর থেকে মনে হচ্ছে ওর কন্ট্রোল ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে।এইসবের মধ্যে মেহেনূর কত্ত থেকে এলো?ওকে নিয়ে তো ও ভাবছে না,তাহলে? অর্কের সাথে এইসব কি হচ্ছে ও বুঝতে পারছে না।জোর করে চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকে ও।কিন্তু ব্যর্থ হয় অর্ক।বরাবরের মতো আজো একটি নির্ঘুম রাত কাটবে অর্কের।

চলবে…….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here