#অচিত্তাকর্ষক
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
|৫|
নিধির কথা শুনে হতভম্ব হয়ে গেল স্মৃতি। সে তড়িঘড়ি করে ছুটে গেল ড্রয়িং রুমে। গিয়ে দেখল ভয়ানক ঘটনা। নিধির বাবার নাক মুখ দিয়ে র/ক্ত পড়ছে। উনি এমন ভাবে সোফায় চিৎ হয়ে পড়ে আছেন যে দেখে বোঝা যাচ্ছে না জ্ঞান আছে কী নেই। স্মৃতির হাত পা ঠান্ডা হয়ে গেল এসব দেখে। তার সামনে উগ্র মূর্তির ন্যায় দাঁড়ানো জুভান কে দেখে বাকরুদ্ধ হলো। জুভান স্মৃতির দিকে না তাকিয়েই দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
‘এখান থেকে চলে যাও স্মৃতি।’
নিধি কাঁদতে কাঁদতে স্মৃতি কে বললো,
‘স্মৃতি, তুমি প্লিজ জুভান কে বলো আমার বাবা কে ছেড়ে দিতে। আমার বাবা অসুস্থ, উনি মা/রা যাবেন তো।’
জুভান সঙ্গে সঙ্গে এসে শক্ত করে নিধির ডান হাত টা চেপে ধরলো। এতটাই শক্ত করে ধরল যে নিধির মনে হচ্ছে এক্ষুণি তার হাড় ভেঙে যাবে। সে চিৎকার দিয়ে উঠল। জুভান সেই চিৎকার অগ্রাহ্য করে নিজের শক্তি আরো বাড়িয়ে দিল। নিধি কান্নার বেগ বেড়ে যাওয়ায় স্মৃতি জুভানের হাতের উপর হাত রেখে বললো,
‘ছেড়ে দিন না প্লিজ।’
এবারও জুভান তার দিকে না তাকিয়েই বললো,
‘তোমাকে আমি চলে যেতে বলেছি স্মৃতি।’
স্মৃতি শক্ত গলায় বললো,
‘আপনি কেন এমন করছেন জুভান? প্লিজ, বন্ধ করুন এসব। উনাদের ছেড়ে দিন।’
জুভান নিধির হাত ছেড়ে দিল। স্মৃতির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বললো,
‘তোমাকে আমি যেতে বলেছি। আমার সব ব্যাপারে তুমি নাক গলাবে না। চলে যাও এখান থেকে। ওদের কে কী করতে হবে না হবে সেটা আমি বুঝে নিব।’
স্মৃতি ঝিম মেরে দাঁড়িয়েই রইল। সে যাবে না। তার শাশুড়ি মা গর্জে উঠে বললেন,
‘তোকে না যেতে বলেছে এখান থেকে, কথা কি কানে যায় না?’
স্মৃতি এবার অনুনয়ের সুরে তার শাশুড়ি মা’কে বললো,
‘মা, আপনি তো আপনার ছেলেকে একটু বোঝাতে পারেন। উনি এসব কী করছেন। আর যাই হোক ঐ লোকটা তো সম্পর্কে উনার শ্বশুর, উনার বাবা। উনি কী করে ঐ লোকটার উপর হাত তুলতে পারলেন? এটা তো ঠিক না মা। মা আপনি..’
আর কিছু বলার আগেই ভয়ংকর এক শব্দে থেমে গেল স্মৃতি। চেয়ে দেখল তাদের সামনে রাখা গ্লাসের টি টেবিল টা ভেঙে চৌচির হয়ে আছে। চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে তার চূর্ণ বিচূর্ণ কাচগুলো। স্মৃতি বোকার মতো তাকাল জুভানের দিকে। জুভান রাগে রীতিমতো কাঁপছে। তার এমন বিভৎস রূপ স্মৃতি আগে কখনো দেখেনি। বিয়ের এক মাসের মাথায়’ই জুভান বিদেশ চলে যায়। তখন যা কথা হতো সব ভিডিও কলে। কখনও সে এমন ব্যবহার করেনি। কখনও স্মৃতি কে একটা ধমক ও দেয়নি। আর আজ এত বছর পর এসে সে জুভানের এই রূপ মেনে নিতে পারছে না। মেলাতে পারছে না কিছু, সবকিছু বড্ড এলোমেলো লাগছে।
ছেলের এমন রাগ দেখে মারিয়াম আহমেদ ছোট্ট ঢোক গিললেন। মনে মনে ভাবলেন, এত বছর পর এসেও তার ছেলে এইটুকুও বদলায় নেই। সে এখনও আগের মতোই রয়ে গেছে। তিনি দ্রুত স্মৃতির কাছে গেলেন। তাকে হালকা ধাক্কা দিয়ে বললেন,
‘যা নারে মেয়ে। কেন ছেলে টা কে এইভাবে রাগিয়ে দিচ্ছিস?’
‘মা, আপনার ছেলে অন্যায় করছে। আপনি দয়া করে উনাকে থামান।’
পদ্ম ভয়ে ভয়ে বললো। মারিয়াম আহমেদ বললেন,
‘আহ, তুই এত কথা কেন বলছিস? ওর টা ও বুঝে নিবে। তুই উপরে যা। আর ভুলেও নিচে নামবি না।’
তাদের কথাবার্তার মাঝখানেই নিধির বাবার শরীর আরো বেশি খারাপ করলো। তিনি হঠাৎ করেই বুকে হাত দিয়ে জোরে জোরে নিশ্বাস নিতে লাগলেন। দেখে মনে হচ্ছে, হয়তো শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। নিধি ছুটে গেল বাবার কাছে। বাবার বুক ঘষতে ঘষতে বললো,
‘কী হয়েছে বাবা? কষ্ট হচ্ছে? শ্বাস নিতে পারছো না?’
নিধির বাবা জবাব দিতে পারছেন না। কেবল মাথা উঁচু করে শ্বাস টানার চেষ্টা করছেন। নিধি তখন তাগাদা করে বাবা পকেট হাতরাতে শুরু করে। পকেট থেকে ইনহেলার টা বের করে বাবার মুখের সামনে ধরতেই জুভান এসে সেটা নিয়ে ছুড়ে মারে। স্মৃতি এবার রেগে যায়। ইনহেলার টা নিচ থেকে তুলে এনে বলে,
‘পাগল হয়ে গিয়েছেন? আপনার সামনে একটা মানুষ দম বন্ধ হয়ে মরে যাচ্ছে, আর আপনি তাকে ইনহেলার নিতে দিচ্ছেন না? আপনি তো এতটা খারাপ নন জুভান।’
এই বলে সে ইনহেলার টা নিধির কাছে দিতে নিলে এবার সেটা জুভানের বাবা নিয়ে নেয়। তিনি শান্ত গলায় বলেন,
‘নিধি, তোমার বাবাকে বলো এই পেপারে একটা সাইন করে দিতে। আর তা না হলে উনি আর কখনোই ইনহেলার নিতে পারবেন না।’
স্মৃতি চোখ মুখ কুঁচকে বিস্মিত কন্ঠে বললো,
‘বাবা, আপনিও?’
মজুমদার সাহেব স্মৃতির দিকে তাকিয়ে বললেন,
‘তুমি বড্ড বেশি কথা বলছো বৌমা। আমাদের কাজ আমাদের মিটাতে দাও। যাও তো, তুমি গিয়ে কড়া করে এক কাপ রং চা বানিয়ে নিয়ে এসো তো।’
স্মৃতি আর কী বলবে ভেবে পাচ্ছে না। এই যেন মানুষগুলোর নব্য এক রূপ। স্মৃতির মাঝে কোনো হেলদোল না দেখে তার শাশুড়ি মা তাকে টানতে টানতে রুমের বাইরে নিয়ে গেলেন। খুব রাগ দেখিয়ে তিনি বললেন,
‘কলিজা দেখছি তোর দেড় হাত বড়ো। শ্বশুরের কথাও কানে তুলছিস না। এত সাহস কিন্তু ভালো না বউ। যা, রান্নাঘরে যা। শ্বশুর যেটা বলেছে সেটা কর, যা।’
উনি কথা বলে ফিরতে নিলেই স্মৃতি বলে,
‘এত অন্যায় আল্লাহ সইবেন না মা। দয়া করে এসব বন্ধ করুন। ঐ অসুস্থ মানুষ টা কে বাঁচতে দিন। একটা সামান্য জমির জন্য কারো প্রাণ নিবেন না। নয়তো এই অন্যায়ের জের আপনাদের আজীবন দিতে হবে।’
শাশুড়ি মা মুখ কালো করে ঠোঁট নাড়িয়ে কী কতক বলে সেখান থেকে চলে যান। স্মৃতি ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকে এক জায়গায়। এই মুহূর্তে গায়ে যেন নড়ার শক্তিটাও পাচ্ছে না সে। তখন সিঁড়ি দিয়ে জারা নেমে এলো। তার কাছে এসে নরম সুরে বললো,
‘আমাদের বাড়িতে এই জমি জমা নিয়ে দুদিন পরপরই অশান্তি চলে। আর ভাইয়া আসলে এই অশান্তি আরো বেশি হয়। আমি এত কিছু না বুঝলেও এইটুকু ঠিকই বুঝি যে আমার ভাইয়া আর বাবা প্রচন্ড লোভী দুজন মানুষ।’
স্মৃতি তখন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
‘জানো তো লোভ মানুষ কে ধ্বংস করে দেয়। তোমার বাবা আর ভাই আজ সাবধান না হলে আগামী তে তাদের ধ্বংস ও অনিবার্য। কেউ সেটা ঠেকাতে পারবে না, কেউ না।’
স্মৃতি আর ঐ রুমেই গেল না। রান্নাঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রইল ঠাঁই। কিছুক্ষণ পর দেখল ড্রয়িং রুম থেকে বাবা আর ছেলে বেরিয়ে আসছেন। দুজনেরই চোখে মুখে একটা খুশি খুশি ভাব স্পষ্ট। জুভান তার বাবাকে হেসে হেসে বলছিল,
‘দেখেছেন বাবা, আপনি যা এত বছরে করতে পারেননি তা আজ আমি একদিনেই করে ফেলেছি।’
মজুমদার সাহেব চমৎকার হাসলেন, যেন অনেক বড়ো একটা মিশনে তারা সাকসেসফুল হয়েছেন। তিনি বললেন,
‘হ্যাঁ, সেই জন্যই তো বলছিলাম তাড়াতাড়ি চলে এসো। তুমি আসলেই সব সমাধান হবে। ভাবছি, কাল থেকেই জমির কাজ শুরু করে দিব। আমাদের নতুন কম্পানি টা ঐখানেই হবে।’
‘জ্বি বাবা, আপনি শুরু করুন। আর আমিও এখন আছি, কোনো অসুবিধা হলে দেখে নিতে পারবো।’
কথার পর্ব শেষ করে মজুমদার সাহেব উনার রুমে চলে গেলেন। জুভান রান্নাঘরের কাছে এসে স্মৃতি কে দেখে দাঁড়িয়ে গেল। তারপর সিঁড়ির কাছে গিয়ে গম্ভীর সুরে বললো,
‘রুমে চলো স্মৃতি।’
চলবে…