অচিত্তাকর্ষক পর্ব -০৪

#অচিত্তাকর্ষক
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
|৪|

খাবার টেবিলে সবাই খেতে বসলো। অনেক দিন পর দেশীয় রান্না দেখে জুভানের ভীষণ ভালো লাগছে। তার উপর চিংড়ি মাছ থেকে সে যেন আর লোভ সামলাতে পারলো না। স্মৃতি তার প্লেটে বড়ো দেখে দু খানা মাছ তুলে দিল। খাবার টা মুখে দিয়েই জুভান উচ্ছল কন্ঠে বললো,

‘উমম, দারুণ হয়েছে।’

মারিয়াম আহমেদ তখন হেসে হেসে বললেন,

‘নিধি রেঁধেছে, দারুণ না হয়ে উপায় আছে।’

মা’র কথা টা শোনা মাত্রই জুভান সশব্দে হেসে উঠে। ওর এমন হাসি দেখে সবাই বিব্রত হয়ে পড়ে। নিধি ব্রু কুঁচকে বলে,

‘এইভাবে হাসছো কেন?

‘মা, এবার মিথ্যে বলা বন্ধ করো। স্মৃতির হাতের রান্না আমি চিনি। তাই অযথা কাউকে উপরে তোলার জন্য মিথ্যে বলো না, প্লিজ।’

জুভানের কথা শুনে মারিয়াম আহমেদ বেজার হয়ে যান। নিধিও চোখ মুখ কুঁচকে নিজের খাবার খেতে লাগে। আর তাদের অমন মুখশ্রী গুলো দেখে জারা মুচকি মুচকি হাসে।

বাড়ির সবাই একসাথে খেতে বসেছে, শুধু স্মৃতি ছাড়া। সে সবাই কে খাবার পরিবেশন করে দিচ্ছে। জুভান অনেকবার তাকে বসতে বলেছে, কিন্তু সে বসেনি। সবার খাওয়া শেষ হওয়ার পর সে খাবে। কারণ এটা করতেই সে বাধ্য। কারণ এটা তার উপর তার শাশুড়ি’র ধার্যকৃত নিয়ম। আর সেই নিয়মের বাইরে স্মৃতি কখনও যায়নি আর হয়তো যাবেও না।

খাওয়ার মাঝেই জুভান তার বাবা কে তাদের ব্যবসার কথা জিজ্ঞেস করলো। মজুমদার সাহেব খেতে খেতে সেই বিষয়ে বিশদ আলোচনা করলেন। সব শুনে জুভান বললো,

‘কাল থেকেই আমি অফিসে জয়েন করবো। আর নিধি, তোমার বাবা কে আজ আসতে বলো। জমির ব্যাপারে আজই কথা হবে।’

মুখের খাবার টা গলায় আটকালো নিধির। সে কাশতে আরম্ভ করলো। জুভান তার দিকে পানির গ্লাস এগিয়ে দিয়ে বললো,

‘আস্তে, নিশ্বাস আটকে আবার মা*রা পড়ো না যেন।’

নিধি ঢকঢক করে পুরো পানি গিলল। খাবার আর বাকি টা শেষ করতে পারলো না সে। সেখানেই ফেলে রেখে নিজের রুমে চলে গেল। মারিয়াম আহমেদ তখন অত্যন্ত বিরক্ত কন্ঠে বললেন,

‘মেয়েটা কে একটু শান্তিতে খেতে পর্যন্ত দিলি না।’

‘ওর খাওয়ার প্রয়োজন নেই। ওকে এই বাড়িতে ফ্রি তে শুধু খাওয়ার জন্য রাখেনি। যে কাজে রেখেছি সেই কাজ হলেই ও এখান থেকে চলে যাবে।’

স্মৃতি অত্যাশ্চার্য বনে গেল। সে মাঝে মধ্যেই এই জমি নিয়ে আলোচনা শুনে। তবে সে এই ব্যাপারে বেশি কিছু জানে না। নিধির বাবার কাছে জুভানের কীসের জমি আছে? আর ঐ জমির কথা উঠলে নিধিই বা কেন এমন করে? আর জুভানও বা ঐ জমির পেছনেই কেন পড়ে আছে? ওর তো জমি জমার অভাব নেই, তাহলে?
নিজের মনে প্রশ্নগুলো আওড়াতে থাকে স্মৃতি। এই প্রশ্নের উত্তর মেলা ভার। জুভানের হাব ভাব দেখেও কিছু বোঝা যায় না। ও যতই সব ব্যাপারে শান্ত থাকুক না কেন, ওর এই নিরবতার পেছনে যে ঘোর বিশৃঙ্খলা আছে সেটা স্মৃতি ঠিকই আন্দাজ করতে পারছে। মানুষ টা সবার সামনে যেমন থাকে আসলে ও এমন না। ও অন্যরকম, সবার থেকে অন্যরকম।

স্মৃতি খাওয়া শেষ করে রান্নাঘরে সব গুছিয়ে নিজের রুমে গেল। গিয়ে দেখল জুভান চিৎ হয়ে বিছানায় শুয়ে আছে। স্মৃতি আস্তে করে তার পাশে গিয়ে বসলো। জুভান টের পেল তার উপস্থিতি। তার কোলে মাথা রাখল। স্মৃতি বসে বসে ভাবল, তাকে জমির কথা জিজ্ঞেস করা উচিত হবে কিনা। যদি এই জমিই সেই জমি হয়, যদি এই জমিটাই তার বাবার জমি হয়। তাহলে সে কখনোই এই জমি কাউকে দিবে না। এমন কী জুভান কেও না।

মনে স্তূপীকৃত প্রশ্নের বেড়া জাল ডিঙিয়ে স্মৃতি এবার তাকে জিজ্ঞেস’ই করে বসলো,

‘আপনি কোন জমির কথা বলছিলেন জুভান?’

‘এটা অফিসিয়াল ব্যাপার, তুমি বুঝবে না।’

জুভান ঘুম ঘুম কন্ঠে জবাব দিল। না, এই জবাবে স্মৃতি সন্তুষ্ট হতে পারলো না। সে পুনরায় প্রশ্ন করলো,

‘একটা সামান্য জমির জন্যই কি আপনি নিধি কে বিয়ে করেছিলেন?’

জুভান এবার উঠে বসলো। স্মৃতির চোখে সরাসরি দৃষ্টি তাক করে বললো,

‘হ্যাঁ করেছি। ঐ জমি আমার। ওর বাবা চালাকি করে আমার কাছ থেকে নিয়েছে। যেকোনো মূল্যে এখন আমার ঐ টা ফেরত চাই। ঐ জমির জন্য আমি একটা খ..(থেমে বললো) ঐ জমি টা আবার লাগবে স্মৃতি। আর তা না হলে আমি ঐ বাপ মেয়ে দুজনকেই এক সঙ্গে ঐ জমিতে পুঁতে ফেলব।’

জুভানের চোখ মুখের ভঙিমা দেখে স্মৃতি ঘাবড়ে গেল যেন। এতটা আক্রমনাত্মক তাকে আগে কখনও দেখায়নি। একটা জমির জন্য মানুষ এত টা ক্রুদ্ধ হয়ে উঠে। স্মৃতি এবার বুঝতে পারছে, সম্পদের লোভ কতটা ভয়নাক। এই সম্পদের লোভের মাড়প্যাঁচে পড়েই তার বাবা কে জীবন দিতে হয়েছে, মা কে বিধবা হতে হয়েছে। শুধু একটা জমি, এই একটা জমিই তার কাছ থেকে তার বাবা কে কেড়ে নিয়েছে। আবার আজ আরেক জমি নিয়ে এত ঝামেলা শুরু। স্মৃতির বক্ষ ছাতির ভেতর হঠাৎ ধক করে উঠল। চিন্তিত হয়ে ভাবল, আবার এই সম্পদ কাউকে কেড়ে নেওয়ার জন্য আসেনি তো?

জুভান স্মৃতির মৌনতা দেখে আবার তার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ল। চোখ বুজে মৃদু সুরে বললো,

‘একটু চুলগুলো টেনে দাও না।’

স্মৃতিও তার কথায় সাড়া দিল। আস্তে আস্তে জুভানের চুল টানতে লাগল। আরাম আর ক্লান্তি তে তখন তার লোচন কোণে নিষুপ্তির দলবেঁধে আগমন ঘটল।

একপর্যায়ে খাটের সাথে হেলান দিয়ে বসে থাকতে থাকতে স্মৃতিও নিদ্রাচ্ছন্ন হলো।

সূর্য ডুবে চারদিক তখন তমিস্র স্নান করছে। বাড়ির বাইরে নিয়নের লাইটগুলো জ্বলে উঠে। বাগানের চারদিকে গেইটফুলের গাছগুলো খুব সুন্দর করে নিয়ন লাইটের আলোতে সাজানো। আর সেগুলো দেখতেও অতিশয় সুন্দর। স্মৃতি চুলায় চা পানি বসিয়ে রান্নাঘরের জানলা দিয়ে তাই দেখছিল। চা’র পানি ফুটে আসতেই সে চা পাতা আর দুধ দিয়ে সেটা প্রস্তুত করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। সবার জন্য চা নাস্তা বানিয়ে স্মৃতি সেগুলো নিয়ে ড্রয়িং রুমে গেল। নিধির বাবা এসেছেন। স্মৃতি উনাকে সালাম দিল। নিধির বাবা নিচু স্বরে জবাব দিলেন। উনাকে দেখে ভীত লাগছে। নিধিও এক কোণে ভয় ভয় ভঙিমায় দাঁড়িয়ে আছে। মজুমদার সাহেব ছেলের পাশে বসে কী ফাইল যেন দেখছেন। তার উল্টো পাশে বসেছেন মারিয়াম সাহেবা। উনার চোখে মুখে কেমন একটা উদ্ভ্রান্ত ভাব স্পষ্ট। স্মৃতি কে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে জুভান তাকে বললো,

‘স্মৃতি, তুমি ভেতরে যাও। আমরা এখানে কথা বলছি।’

স্মৃতি চলে এলো সেখান থেকে। বিয়ে হয়েছে পাঁচ বছর। এই বাড়ির মানুষগুলোর ব্যবহার এখনও তার বোধগম্য হয়ে উঠেনি। বিশেষ করে জুভান আর তার বাবা। দুজনেই বড্ড শীতল। তাদের চাহনী, তাদের কথার ধরন সবকিছুই বড্ড তীক্ষ্ণ আর তীব্র। আর আজ মনে হচ্ছে তা যথেষ্ট ভয়ানকও।

কিছুটা সময় পর নিধির কান্নার শব্দ পাওয়া গেল। স্মৃতি তার রুমে ছিল বিধেয় প্রথমে শুনতে পায়নি। পরে সে বুঝতে পেরে দ্রুত রুম থেকে বের হলো। তখন নিধিও ছুটে এলো তার কাছে। হুট করেই তার পায়ে পড়ে বলতে লাগল,

‘স্মৃতি, প্লিজ আমার বাবা কে বাঁচাও। জুভান আমার বাবা কে মে*রে ফেলছে।’

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here