#অজানা_পৃথিবী
#কলমে_লাবণ্য_ইয়াসমিন
#পর্ব_৪
কুহেলী দ্রুত উঠে বসলো। স্বপ্ন নিয়ে পড়ে থাকলে চলবে না কথাটা ভেবে ও দ্রুত রেডি হয়ে নিলো। ড্রয়ারে সবুজ রঙের একখানা তাঁতের শাড়ি রাখা আছে যদিও সবুজ রঙটা ওর পছন্দ না তবুও এই শাড়িটা ওর বেশ চোখে ধরলো। এই মূহুর্তে শাড়ী পড়ে সাজুগুজু করার ইচ্ছা ছিল না তবুও মনে হলো আবির তো ওকে শাড়িতে দেখতে বেশ পছন্দ করে। এটা সেট ভেবে শেষ পযর্ন্ত ও শাড়িটা পড়ে নিলো। খোলা চুলগুলো একপাশে রেখে ফোনটা নিয়ে বাইরে আসলো। ডাইনিং রুমে দাদু বসে আছেন। কুহেলী ভেবেছিল সেদিকে তাকাবেনা তবুও তাঁকিয়ে ফেলল আর অমনি চোখে চোখ পড়ে গেলো। দাদু চোখমুখ কেমন গম্ভীর করে রেখেছে। হয়তো কিছু একটা নিয়ে চিন্তিত। কুহলী কোনরকম প্রশ্ন না করে দরজা খুঁলতে গেলো তখনই ও মা ওকে ডাকলো,
> সন্ধ্যার সময় বাইরে যাওয়া ঠিক হচ্ছে না। জামাই ফোন করেছিল কথা বলতে বলছে।
> আম্মা তাঁরে বলে দিয়েন আমি সেখানে আর ফিরবো না। আরেকটা বিয়ে করে সংসার শুরু করলে ভালো হয়।
> কি সব আবোলতাবোল বকছিস সত্যি মাথা খারাপ হয়েছে তোর। মানুষের সামনে আর মুখ দেখাতে পারবো না।
> দেখানো লাগবে না আম্মা। তুমি বাবাকে বলো আমি মহিলা হোস্টেলে চলে যেতে চাই ব্যবস্থা করতে। আসছি এখন আর তাড়াতাড়ি ফিরবো।
কূহেলে আর তর্কাতর্কি করতে চাইলো না। যত কথা বলবে ততই কথা বাড়বে। আবির আসবে কি শিউর না যদিও আসার কথা। কথাগুলো ভাবতে ভাবতে ও বাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই একটা সিএনজি এসে থামলো ওর সামনে। কুহেলী কিছুটা আবার হলো হঠাৎ সিএনজি আসার জন্য। মনে হচ্ছে কেউ ওর জন্য পাঠিয়ে দিয়েছে। ও মনে মনে বিড়বিড় করে বলল, “আর কতবার যে অবাক হতে হবে আল্লাহ জানেন”। এবার না হার্ট এটাক হয়” সিএনজি পাঁচ মিনিটের মধ্যে কফি হাউজের সামনে এসে দাঁড়ালো। ও ব্যাগ থেকে দশটাকার একটা নোট লোকটাকে ধরিয়ে দিয়ে হুড়মুড় করে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে গেলো। এখানের একটা টেবিল ওদের বেশ পছন্দের ছিল। সব সময় সেই একটা টেবিলে এসে দুজনে বসতো। হাজারো স্বপ আর খুনসুটি মাখা ভালোবাসার সাক্ষী টেবিলটা। কুহেলী তাড়াতাড়ি ভেতরে গিয়ে দেখলো টেবিল খালি আবির আসেনি। ঘড়িতে সময় প্রায় সাতটা ছুইছুই করছে। আকাশের রঙটা হঠাৎ করেই কেমন বদলে গেলো। নীল থেকে ভয়ঙ্কর কালো আকার ধারণ করেছে। মেঘের ঝলকানি সঙ্গে এলোমেলো হাওয়া। লোকজন বাইরে ছিল তারা ভেতরে এসে দাঁড়িয়ে পড়লো। হয়তো কিছুক্ষণের মধ্যে মুষলধারে বৃষ্টি নামবে। কুহেলীর হঠাৎ ভয় করতে শুরু করেছে আবির আসতে পারবে কি না এটা নিয়ে। আজকের মধ্যেই ওর দেখা করতে হবে। ও নড়েচড়ে নিজেদের সেই কাঙ্ক্ষিত টেবিলে গিয়ে বসলো। একটা কফি অর্ডার করলে মন্দ হয়না ভেবে অর্ডার দিয়ে বসে থাকলো। ওর দৃষ্টি গেটের দিকে। এরকম করতে করতে ঠিক আটটার সময় ও সেই কাঙ্ক্ষিত মানুষের মুখটা দেখতে পেলো। আবির আসছে দেখে কুহেলীর মূখে হাসি ফুটলো। ও উত্তেজনাই দাঁড়িয়ে আবিরের দিকে হাত নেড়ে প্রায় চিৎকার করে ডেকে উঠলো। আবির ভ্রু কুচকে একপা দুপা করে কুহুর সামনে এসে বসলো। ছেলেটার চোখেমুখে কৌতূহল। ও বসতেই কুহু মুখটা ভার করে ছলছল চোখে বলল,
> আসোনি কেনো সেদিন?
> আপনার সঙ্গে পূর্বে কখনও কি আমার দেখা হয়েছিল। ?
> মানে কি বলছো তুমি?
> আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে। আমি আপনাকে চিনি না। ফোন দিয়ে হম্বিতম্বি করলেন তাই দেখতে এসেছি। আমার গার্লফ্রেন্ড আছে।
আবির কথা শেষ করতে পারলো না তার মধ্যেই একটা উল্কা সুন্দরী মেয়ে ভিজতে ভিজতে ভেতরে এসে হাজির। মেয়েটা চুলগুলো হাতের সাহায্যে ঝাড়তে শুরু করেছে। খোলামেলা মডার্ন পোশাক বৃষ্টির পানিতে গায়ের সঙ্গে প্রায় লেপ্টে আছে। কুহেলী একবার তাকিয়ে চোখটা ফিরিয়ে নিলো।অশালীন পোশাকে জন্য ওর কেমন লজ্জা লাগছে। সামনে আবির আছে ছেলেটা কি ভাবছে ভেবেই ওর অস্বস্তি হচ্ছে।। কিন্তু মেয়েটাকে দেখে আবিরের চোখে মুখে খুশীর ঝিলিক দেখা গেলো।ও দ্রুত উঠে গিয়ে মেয়েটাকে নিজের সঙ্গে জড়িয়ে নিয়ে ভাব বিনিময় করে আবারও কুহেলীর পাশে গিয়ে বসলো। ততক্ষণে মেয়েটার ভেজা কাপড় কিছুটা ঠিক হয়েছে। মেয়েটার চোখে কৌতূহল খেলা করছে তেমন কুহেলীরও। দুজন দুজনার অচেনা কিন্তু আবিরের চেনা। মেয়েটাকে দেখিয়ে আবির প্রথম মুখ খুললো,
> মিস কুহেলী এই হচ্ছে আমার গার্লফ্রেন্ড সামিরা। আগামী মাসের প্রথম সপ্তাহে আমাদের বিয়ে।
> কিন্তু আবির তুমি তো আমাকে…..
কূহেলী আর কথা বলতে পারলো না তার আগেই মেয়েটা বলে উঠলো,
> আবির আমাকে বলেছে আপনি ওকে বিরক্ত করছেন কিন্তু কেনো? আপনার জন্য আমাদের সম্পর্ক খারাপ হচ্ছে। দয়াকরে আপনার ওকে ছেড়ে দিন নয়তো কিন্তু খারাপ হবে।
কুহেলী হতভম্ব হয়ে বসে আছে। সত্যি মিথ্যা সব গুলিয়ে একাকার।ভাবলো আবির ওকে ঠকিয়েছে তাই বাবা মা ওকে অন্য মানুষের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছে এটাই ঠিক হবে। কিন্তু আবির এমন কেনো করলো? পানিতে ওর চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। কুহেলী মাথা নিচু করে বসে ছিল যখন ও নিজেকে প্রস্তুত করে চোখের পানি মুছে কথা বলতে গেলো তখন দেখলো ওর সামনে কেউ নেই। মেয়েটা আর আবির হঠাৎ হাওয়া, কারো টিকিটাও খুঁজে পেলো না। আশেপাশে টেবিলে যারা ছিল তারা নিজেদের মতো গল্প করছে। ও উঠে গিয়ে কয়েকজনকে জিঞ্জাসা করলো কিন্তু কেউ কিছুই বললো না। মনে হচ্ছে এরা বুঝতেই পারছে না ও কি বলছে। কুহেলী শেষমেষ হতাশ হয়ে কফির বিলটা ওখানে রেখে বেরিয়ে আসলো। ফিসফিস করে বৃষ্টি পড়ছে। রাস্তায় তেমন একটা গাড়ি চলছে না। বিশ মিনিটের রাস্তা।ও আর এখানে দাঁড়িয়ে সময় নষ্ট না করে রাস্তায় নামলো হেটে বাড়িতে আসার উদ্দেশ্যে। শুনশান নিরব রাস্তা। শনশন বাতাসে শীত করছে কুহেলী জড়সড় হয়ে এলোমেলো পা ফেলে এগিয়ে চলছে। পাশের ডোবা থেকে ব্যাঙ ডাক ভেসে আসছে। যখন ও চৌরাস্তার মোড়ে আসলো ঠিক তখনই দমকা হাওয়ার সঙ্গে গরম একটা হাওয়ার ঝটিকা ওর গায়ে এসে লাগলো। হঠাৎ বাতাশের তাল সামলাতে না পেরে ও হুড়মুড় করে পড়ে গেলো। পায়ে প্রচণ্ড চোট লাগার জন্য ওর চোখে পানি এসে গেছে। ও পা ধরে নিচে বসতেই হঠাৎ চারদিকে অগণিত যানবাহনে ছেয়ে গেলো। কুহেলী অবাক হয়ে তাঁকিয়ে আছে। ও যে এখনে বসে আছে কেউ এগিয়ে আসছে না,যে যার মতো চলছে। ও এই রাস্তায় আগে কখনও এরকম ব্যস্ত হতে দেখেনি। গাড়ির এরকম চলাফেরার জন্য কুহেলী ভয় পাচ্ছে। পায়ের যা অবস্থা তাতে ও কিছুতেই একা বাড়িতে ফিরতে পারবে না। হাতে ফোনটা নেই হয়তো বাড়িতে রেখে আসছিল নয়তো বসেছিল সেখানে রেখে আসছে মনে পড়ছে না। আবিরের জন্য খারাপ লাগছে। ছেলেটা ওকে চরমভাবে ঠকিয়েছে। অপমানে ওর মরে যেতে মন চাইছিল তারপর আবার পায়ের এমন আঘাত সবমিলিয়ে ওর প্রচণ্ড কান্না পেলো। কুহেলী চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করলো ঠিক তখনই ওর মনে হলো ও শূন্যে ভাসছে। কেউ একজন ওকে উপরের দিকে তুলছে। ও অবাক হয়ে উপরের দিকে তাঁকিয়ে চমকে উঠলো কারণ সেই লোকটা ওকে ধরে রেখেছে। কুহেলী লোকটাকে স্বামী হিসেবে মানেনি আর সেই লোকটা ওকে এভাবে ধরে রেখেছে দেখে ওর মেজাজ খারাপ হলো। ও আবারও রাগে কেঁদে ফেললো। ওকে এভাবে কান্না করতে দেখে লোকটা ধমক দিলো,
> কুহু একদম কাঁদবে না। ফাজলামি পাইছো? কফি হাউজে গিয়ে একা একা বকবক করে ফোন রেখে চলে আসলে। পেছন থেকে ডাকছি শুনছো না। রাস্তায় এতো গাড়ি চলছে যদি দুর্ঘটনা ঘটতো তখন?এখন রাস্তার মধ্যে কান্নাকাটিও করছো, আমাদের সম্মান নিয়ে তোমার একটুও চিন্তা নেই তাইনা?। আমি কিন্তু কঠোর হতে বাধ্য হবো।
লোকটা একদমে কথাগুলো বলে থামলো। কুহেলী কান্না থামিয়ে ভ্রু কুচকে আছে। কফি হাউজে ও একা কিভাবে থাকবে আবির আর ওর গার্লফ্রেন্ড ছিল। ও সন্দেহভাজন দৃষ্টিতে বলল,
> ওখানে আমি একা ছিলাম না আবির ছিল। আমাকে নামিয়ে দিয়ে বাড়ি ফিরবো।
> আবারও সেই আবির? তোমার মাথায় দেখি সত্য সমস্যা হয়েছে। বিশ্বাস না হলে চলো ওখানের ক্যামেরা চেক করি।
> চলুন।
লোকটা আর অপেক্ষা করলো না ওকে নিয়ে সুরমা কফি হাউজের দিকে এগিয়ে চলল। কুহেলী লোকটার শার্টের কলার আটকে ধরে রেখেছে। বৃষ্টি থামার পর আকাশ পরিষ্কার হয়ে গেছে। মেঘমুক্ত আকাশে হাজারো তারার মাঝে একখণ্ড চাঁদ উঁকি দিচ্ছে। চাঁদের জোছনা ধারা পাহাড়ি ঝর্ণার মতো পৃথিবীতে নেমে এসেছে। সেই আলোতে লোকটাকে কেমন ভয়ংকর সুন্দর লাগছে। কুহেলী বারবার লোকটার দিকে তাঁকিয়ে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিচে। চাঁদ আর মেঘের লুকোচুরির সঙ্গে কুহুও এরকম লুকোচুরিতে শামিল হলো। যতই ভাবছে লোকটাকে আর দেখবে না ততই ও লোকটার দিকে তাকিয়ে ফেলছে। নিজের উপরে ও বিরক্ত হলো। লোকটা ঠিক কফি হাউজের ভেতরে গিয়ে ওকে নামিয়ে দিলো। তারপর কয়েকজনকে ইশারা করতেই ওরা ল্যাপটপ নিয়ে হাজির। কুহেলীর সামনে সন্ধ্যার ভিডিও ফুটেজ চলছে। ও যখন এসেছিল তার আগ মূহুর্ত থেকে শেষ পযর্ন্ত। ভিডিও দেখে ওর চোখ ছানাবড়া। কোথায় আবির আর কোথায় সেই মেয়েটা, কেউ নেই। ভিডিওতে কিছুক্ষণ থেকে ও একাই বকবক করে কাঁদতে কাঁদতে বেরিয়ে গেলো। কুহেলী ঘামতে শুরু করেছে প্রচণ্ড ভয় আর চিন্তা ওর শারা শরীর মনে ঝঙ্কার দিয়ে উঠলো আর ও জ্ঞান হারলো।
চলবে
।





