অতঃপর তুমি আমি পর্ব শেষ

গল্প – অতঃপর তুমি আমি
রেশমী রফিক
পর্ব – ১৪ (শেষ পর্ব)
জুনায়েদ চমকাল না একটু। কোনো প্রতিক্রিয়াও দেখাল না। যেন সে নিশ্চিতভাবে জানত, পিউ এই কথা বলবে। বেশ শান্তসুরে বলল,
– আচ্ছা, ঠিক আছে। যেতে চাইলে যাবা। সেটা কোনো প্রবলেম না।
– কালকেই যাব।
– কাল? কালকে কীভাবে সম্ভব?
– কেন সম্ভব না? প্লেন তো বাংলাদেশে প্রতিদিনই ফ্লাই করতেছে। আর আমারও বাংলাদেশে যাইতে ভিসা লাগবে না। শুধু টিকেট বুক করতে হবে। তুমি আপাতত টিকেট বুক করে দাও। আমি বাংলাদেশে গিয়ে তোমাকে টাকা পাঠিয়ে দেব।
– টিকেট আমি এমনিতেই বুক করে দেব। টাকা পাঠানো লাগবে না। কিন্তু যাবার আগে প্রিপারেশনের ব্যাপার আছে। লাগেজ গোছানো লাগবে। শপিং করতে হবে।
– কোনো প্রিপারেশনের দরকার নাই। আমি কোনো লাগেজ নিব না। আমার যা কিছু আছে, সবকিছু ফেলে দিবা। আমি কিচ্ছু নিয়ে যাব না এখান থেকে।
– এটা কোনো কথা হলো? এত্ত এত্ত জামাকাপড়, জিনিসপত্র কিনে দিছি কী ফেলে দিতে? আমি তো তোমার বাপের মতো বিশাল বড়লোক না। তারপরেও যখন যেটা কিনতে চাইছ, কিনে দিছি। কখনো না বলি নাই। আর আজকে তুমি বলতেছ, এইগুলা সব ফেলে দিব!
– (নিশ্চুপ)
– তোমার জিনিসপত্র অবশ্যই নিয়ে যাবা তুমি। যা কিছু আছে, সব নিয়ে যাবা। নাইলে তোমার ফ্যামিলি বলবে, আমি তোমাকে ফকিন্নি বানায় রাখছি।
পিউয়ের চোখজোড়া ঝাপসা হয়ে আছে। বুক ভেঙ্গে কান্না বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে। যতটা না কষ্ট হচ্ছে জুনায়েদ দূরে সরে যাওয়ায়, তার থেকেও বেশি কষ্ট হচ্ছে জুনায়েদের এমন কথাবার্তা শুনে। একবারও জিজ্ঞেস করল না কেন বাংলাদেশে যাবে সে। একবারও মনে করিয়ে দিল না, ওর ফিরে যাবার কথা ছিল না কখনো। বাংলাদেশ থেকে যেদিন চলে এসেছে, সেদিনই প্রতিজ্ঞা করেছিল আর কখনো বাবা-মায়ের নাম মুখে আনবে না, আর কখনো তাদের সাথে কোনোরকম যোগাযোগ বা সম্পর্ক রাখবে না। এসব কি ভুলে গেছে জুনায়েদ? হয়তোবা ভুলে গেছে। এজন্যই এত সহজভাবে কথা বলে যাচ্ছে। ওর বাংলাদেশে ফিরে যাওয়ায় তার কোনো আপত্তি নেই। বরং তার জন্য ভালোই হবে। ঘাড় থেকে বোঝা নামবে। এলিজাকে নিয়ে নতুন করে জীবন শুরু করতে পারবে। এতটা দুঃখের মাঝেও পিউয়ের হাসি পেয়ে গেল জুনায়েদের শেষ কথাটা শুনে। সেই সুযোগে ফট করে চোখের পানি বেরিয়ে পড়ল বেহায়ার মতো। আগেই অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে রেখেছিল সে। এবারে আরেকটু ঘুরে তাকাল অন্যদিকে। কয়েক মুহূর্তে কোনো সাড়াশব্দ নেই কারো। পিউ তাকিয়ে আছে ওদের বাড়িটার দিকে। ভাবছে, বাংলাদেশে গিয়েই জুনায়েদকে এই বাড়ির মালিকানা বুঝিয়ে দেবে কাগজপত্রে। চাইলে এখানকার উকিলের কাছে গিয়েও করা যায়। কিন্তু তাতে সময় লাগবে। পিউয়ের এখানে এক মুহূর্তও মন টিকছে না। যত দ্রুত সম্ভব, জুনায়েদের কাছ থেকে দূরে চলে যেতে চায়, যতটা দূরে সম্ভব!
আচমকাই নিজেকে শুন্যে আবিস্কার করল সে। জুনায়েদ পেছন থেকে কোলে তুলে নিয়েছে ওকে। সে অবস্থাতেই রান্নাঘরের দরজার দিকে এগোচ্ছে। বাড়ির ভেতরে গিয়ে দোতলার সিঁড়িতে পা রাখল সে। পিউ তখন ছটফট করছে। নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে, কোল থেকে নামতে রীতিমতো যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। কিন্তু বরাবরের মতোই জুনায়েদের শক্তির কাছে পরাস্ত সে। জুনায়েদ ওকে এমনভাবে জাপটে ধরেছে যে, পায়ের নিচে শক্ত কিছুর নাগাল পাওয়া তার পক্ষে সম্ভব হলো না। জুনায়েদ ওকে বেডরুমে নিয়ে গেল সরাসরি। রুমের দরজা বন্ধ করল প্রথমে। তারপর বিছানায় ছুঁড়ে মারল। চাপা সুরে দাঁত কিড়মিড় করে বলল,
– বাংলাদেশে যাবা মানে কী? বাংলাদেশে যাবা কেন? তোমার মনে নাই, এখানে আসার আগে কী কথা হইছিল? তুমি প্রমিজ করছিলা, আর কখনো তোমার বাপ-মা, জ্ঞাতিগুষ্টির নাম আনবা না মুখে। বলছিলা, আর কখনো আমাকে ছেড়ে যাবা না। কয়েক বছরেই সবকিছু বেমালুম গুলে খাইছ! সব ভুলে গেছ তুমি!
জুনায়েদের রুদ্রমুর্তি দেখে পিউয়ের আত্মা খাঁচাছাড়া হবার জোগাড়। অনেকগুলো দিন পর এই মূর্তি দেখল সে। মন বলছে, এক্ষুণি ওকে থাপ্পড় মারবে জুনায়েদ। এই বদ্ধ রুমের মধ্যে ওর উপর অত্যাচার চালাবে, ঠিক যেমনটা আগে করত। গ্রামের বাড়িতে সেই বন্দি দিনগুলোর কথা মনে পড়তেই সে ঘেমেনেয়ে একাকার হলো। ঢোক গিলে পালাবার পথ খুঁজল। ক্ষণিকের মধ্যেই জরিপ করল। প্রথম কথা হলো, দরজা বন্ধ করলেও লক করেনি জুনায়েদ। দ্বিতীয় কথা হচ্ছে, দরজা থেকে দূরে, বিছানার পায়ের দিকটায় দাঁড়িয়ে আছে জুনায়েদ। দৌড় দিলে কি ওকে ধরে ফেলবে সে? উত্তরটা না খুঁজেই হুড়মুড় করে বিছানা থেকে নামল পিউ। ছুট লাগাল দরজার দিকে। কিন্তু দরজা পর্যন্ত যাবার আগেই ওর হাত চেপে ধরল জুনায়েদ। ঝাঁঝের সুরে বলল,
– কোথায় যাইতেছ তুমি? আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে কোথায় যাইতেছ?
পিউ উত্তর না দিয়ে হাত ছাড়ানোর জন্য প্রাণপনে চেষ্টা করতে লাগল। জুনায়েদ এবারে জাপটে ধরল ওকে। বলল,
– কথা বলো, পিউ। আমি তোমার কাছে কিছু জানতে চাইছি।
পিউ ক্ষান্ত হয়নি। নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করেই যাচ্ছে। কোনোমতে বলল,
– ভুলি নাই। কিচ্ছু ভুলি নাই। কিন্তু তুমি ভুলে গেছ। তোমার কিচ্ছু মনে নাই। মনে থাকলে আমার সাথে এই রকম করতে পারতা না।
– কী করছি আমি?
– কী করছ, সেইটা তুমি ভালো করেই জান। বলার রুচি নাই আমার। তুমি সরো। আমাকে যাইতে দাও। নাইলে কিন্তু পুলিশ ডাকব।
– পুলিশ ডাকার সুযোগ পাইলে তো ডাকবা তুমি।
– আমি এখন চিল্লাব। আমি চিল্লাইলে অ্যান্ডি পুলিশ ডাকবে।
– কেন চিল্লাবা তুমি? একটার পর একটা কাহিনি ঘটায়ে যাইতেছ তুমি! আমাকে কষ্ট দিতে ভালো লাগে তোমার?
– আর কষ্ট দিব না। চলে যাব বাংলাদেশে।
– আরেকবার বাংলাদেশের নাম আনলে তোমার বারোটা বাজাব আমি।
এবারে পিউ গলা চড়িয়ে বলল,
– কেন? বারোটা বাজাবা কেন? আমি চলে গেলেই তো তোমার লাভ। তোমার রাস্তা ক্লিয়ার হয়ে যাবে।
– কীসের রাস্তা?
– ন্যাকামি করবা না। তুমি জান না, আমি সরে গেলে কীসের রাস্তা ক্লিয়ার হবে? জান না তুমি?
জুনায়েদ হতবাক। কীসব বলছে পিউ? কথার মাথামুন্ডু কিছুই ওর মাথায় ঢুকছে না। বলল,
– কী বলতেছ তুমি, পিউ?
– বলতেছি যে, তোমার ভালোর জন্যই সরে যাব আমি। তুমি মুক্ত হয়ে যাবা।
– মুক্ত হয়ে যাব?
– (নিশ্চুপ)
– আমি কী তোমার কাছে মুক্তি চাইলাম কখন?
– সবকিছু মুখে বলতে হয় না। কিছু কথা আপনাতে বুঝে নিতে হয়।
হতবিহ্বল ভাবটা কাটিয়ে আবার পুরনো রুপে ফিরল জুনায়েদ। ক্ষণিকের জন্য বাঁধন আলগা হওয়াতে পিউ দরজার দিকে এগোচ্ছিল। ওর বাহু চেপে ধরে আবার কাছে টেনে আনল সে। চড়া সুরে বলল,
– এইসব সিনেমাওয়ালা ডায়লগ ঝাড়বা না আমার সামনে। কী হইছে সরাসরি বলো।
– (নিশ্চুপ)
– আমার উপর রাগ করছ তুমি? আমি তোমাকে সময় দেই নাই বলে? তুমি বুঝ না কেন, পিউ? আমার অফিসে কাজের অনেক চাপ। সেজন্য…
– আমাকে কিছু বলার দরকার নাই। আমি জানি, তোমার অফিসে কাজের অনেক চাপ। তার নমুনাও দেখা হইছে।
– এই যে কাজ করতেছি। কার জন্য করতেছি? তোমার জন্যই তো! কাজ না করলে কেমনে চলবে, বলো? আমাদের বাড়ি আছে। তাই থাকার জায়গা নিয়ে চিন্তা নাই। কিন্তু খাব কী? চলব কেমনে? তোমার ইউনিভার্সিটির খরচ জোগাড় করব কেমনে? তুমি তো এখন আর আগের মতো ছোট নাই। এখনো যদি না বুঝ… কাজ না করলে তোমার বাড়িঘর, তোমার সংসার কেমনে চলবে?
– বাড়িঘর, সংসার কোনোটাই আমার না। তুমি তো আমাকে এখানে আনতেই চাও নাই। আমি জোরজবরদস্তি করছিলাম বলে আমাকে নিয়ে আসতে বাধ্য হইছ। এখন পর্যন্ত আমার সাথে আছ বাধ্য হয়েই।
– তো? তাতে কী এমন সমস্যা হইছে?
– তোমার লাইফ বরবাদ হইতেছে। আমি না থাকলে তুমি অন্য কাউকে বিয়ে করতে পারতা। হ্যাপি লাইফ লিড করতে পারতা।
– আমি অলরেডি হ্যাপি, পিউ। তোমাকে নিয়ে আমি অনেক ভালো আছি। এর থেকে বেশি ভালো থাকার তো দরকার নাই।
– মিথ্যা কথা বইলো না, প্লিজ। তোমার সাথে থাকতে থাকতে আমারও এখন মিথ্যা কথা শুনলে সহ্য হয় না। অথচ তুমি ঠিকই মিথ্যা কথা বলো।
– আমি কী মিথ্যা কথা বলছি?
– এই যে এখন বললা, আমাকে নিয়ে তুমি হ্যাপি।
– অবশ্যই হ্যাপি আমি। এখানে মিথ্যার কী দেখলা?
– সত্যিই যদি হ্যাপি হইতা, তাহলে তো লাইফে আরেকজনের দরকার হইতো না তোমার। আমি এখনো তোমার লাইফে আছি বলেই সেই আরেকজনকে নিয়ে হ্যাপি হইতে পারতেছ না তুমি। এজন্যই তোমার লাইফ থেকে সরে যাইতে চাই। ভালো থাক তোমরা দুইজন!
– আরেকজন কে? কার কথা বলতেছ?
– (নিশ্চুপ)
– কথা বলো, পিউ। চুপ করে থাকবা না। আমার ফ্যামিলি বলো আর আপনজন, সবই তুমি। এইখানে আরেকজন আসল কোথা থেকে?
– আসে নাই এখনো। আসবে। আমি সরে গেলেই আসবে।
– কে আসবে?
– এলিজা।
– এলিজা? কে সে?
– সেইটা তো তুমিই আমার থেকে ভালো জান। কে এই মেয়ে? কবে থেকে তোমার সাথে পরিচয়? এইসব তো আমার জানার কথা না।
জুনায়েদের মাথায় ঢুকল না পিউ কার কথা বলছে। সে কিছুক্ষণ হতবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। তারপর বলল,
– ক্লিয়ার করে কথা বলতে কী মুখ ব্যাথা করে তোমার? সেই কখন থেকে কথা প্যাচাইতেছ। সরাসরি কি বলতে পারতেছ না কী হইছে? কে এই এলিজা?
পিউ চিবিয়ে চিবিয়ে উত্তর দিল,
– এলিজাকে এত্ত তাড়াতাড়ি ভুলে গেলা? ডেইলি অফিসে গিয়ে তো ওর চেহারাই দেখ। এরপরেও ভুললা কীভাবে?
– এলিজা? অফিসে? এলিজা থমসন? মানে আমার সাথে কাজ করে এলিজা থমসন, সিস্টেম এক্সিকিউটিভ। ওর কথা বলতেছ তুমি?
– এরপরেও সন্দেহ আছে তোমার?
– কিন্তু এলি কীভাবে আসল এখানে?
– নামটাও ছোট্ট করে ফেলছ? কী সুইট! এলিজা থেকে এলি!
– কী বলো তুমি এইসব? ওকে সবাই এলি বলে ডাকে। আমি ডাকলেই দোষ?
– হ্যাঁ, দোষ। এলিজার সাথে প্রেম করতেছ ধুমায়ে। দিনরাত অফিসের কাজের চাপের দোহাই দিয়ে ওর সাথে বিজি থাক। হাহা-হিহি করো। একসাথে ঘুরতে যাও। সারাদিন তো ওর সাথেই থাক। বাসায় আসো খালি ঘুমাইতে। আমার ফোন রিসিভ করার সময় হয় না, অথচ এলিজাকে নিয়ে লাঞ্চ করতে যাও। এমন ভাব করতেছ জানি ভাঁজা মাছটা উল্টায় খাইতে জান না। অবাক হইতেছ খুব। ভাব দেখাইতেছ আমি উলটাপালটা কীসব বলতেছি। আজকাল তো অভিনয়টাও ভালো শিখছ। তোমাকে বেস্ট অ্যাক্টর অ্যাওয়ার্ড দেয়া উচিত।
– আমি আসলেই কিছু বুঝতেছি না। কবে এলির সাথে ঘুরতে গেছি আমি?
– গেছ… আজ না হলেও গতকাল। গত পরশু। প্রায়ই তো যাও একসাথে ঘুরতে। স্পেসিফিক্যালি বলার মতো কী আছে?
– কে বলছে তোমাকে এইসব?
এক ঝটকায় নিজেকে ছাড়িয়ে নিল পিউ। ঝাঁঝের সুরে বলল,
– কে বলবে? কারো বলার ধার আমি ধারব কেন? আমি নিজের চোখে দেখছি। আমার সামনে দিয়ে তুমি তোমার পরাণের এলিকে নিয়ে লাঞ্চ করতে গেছ। হাহা-হিহি করতে করতে অফিস থেকে বের হইছ। সবই দেখছি আমি।
– আমি?
হতভম্ব হয়ে কয়েক মুহূর্ত পিউয়ের দিকে তাকিয়ে রইল জুনায়েদ। মাথার ভেতর প্রবল গতিতে ঘুরছে গত কয়েকদিনের স্মৃতিগুলো। বিশেষ করে পিউ যেদিন সুইসাইড করার উদ্যোগ নিয়েছিল, সেদিন কিংবা তার আগের কয়েকদিনের কথা। আচমকাই তার মনে পড়ল বারো দিন আগের কথা। সেদিনই পিউ সুইসাইড করেছিল! সে বলল,
– তুমি যেদিন সুইসাইড করতে নিছিলা, সেদিনের কথা বলতেছ? সেদিন দেখছ আমি এলির সাথে ঘুরতে গেছি?
– (নিশ্চুপ)
– আমি ওইদিন এলিজার সাথে অফিস থেকে বাইর হইছিলাম। মনে হয় লাঞ্চটাইমে। তুমি কী সেইটার কথা বলতেছ?
– এই তো, সব মনে পড়ে গেছে তোমার।
– হ্যাঁ মনে পড়ছে। কিন্তু তুমি দেখলা কেমনে? তুমি তো তখন ক্লাসে ছিলা। নাকি বাসায়?
– আমি ওইদিন তোমার অফিসে গেছিলাম।
– আমার অফিসে? কেন?
– কেন গেছি, সেইটা না জানলেও চলবে তোমার। আমিও গেছিলাম আর তুমিও এলিজাকে নিয়ে ঘুরতে বের হইছিলা। আমি সবকিছুই দেখছিলাম। ব্যস, কথা শেষ।
বলেই পিউ দরজার দিকে পা বাড়াল। পেছন থেকে জুনায়েদ ওকে জাপটে ধরার চেষ্টা করল। না পারতে দরজাটা লক করে নিজেই দরজার সামনে দাঁড়াল। বলল,
– তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে, পিউ। ইউ আর টোটালি অ্যা গন কেস। সাইকোলজিস্ট তোমার কোনো ট্রিটমেন্টই করতে পারেনাই। উল্টা আগের থেকে ডিমোশন হইছে!
– হ্যাঁ, এখন তো নিজের দোষ ঢাকতে আমার খুঁত খুঁজে বের করবা-ই। ধরা পড়লে সবাই এরকম করেই দোষ ঢাকে। দিনকে রাত, আর রাতকে দিন বলে।
– তুমি… তুমি কেমনে ভাবলা আমি এলির সাথে প্রেম করতেছি? আমি ম্যারিড। আমার বউ আছে, ঘরসংসার আছে। আর আমি কীনা এলির সাথে… কেমনে কী?
– এখন বলো, আমার হ্যালুসিনেশন হইছে। আমি কীসব ভুলভাল দেখছিলাম ওইদিন। বাস্তবে আসলে ওরকম কিছুই ঘটে নাই। তুমি নিপাট ভালোমানুষ। আর তোমার এলিও সতীসাধ্ববী!
– ভু্লভাল দেখ নাই। আমার যতদূর মনে পড়ে, লাঞ্চটাইমে আমি আর এলি অফিস থেকে বের হইছিলাম। কিন্তু যা দেখছ, সেটাকে পজিটিভলি নিতে পারোনাই। এটাই তোমার প্রবলেম।
– হ্যাঁ, এখন সবই আমার প্রবলেম। আমি-ই পাগল। আমি-ই ছাগল। আমি-ই এখন বকরি দ্য গ্রেট।
– তুমি আসলেই বকরি দ্য গ্রেট! সেদিন আমি আর এলি প্রেম করতে যাই নাই কোথাও। ঘুরাঘুরি করতেও যাই নাই। হেডঅফিস থেকে কল আসছিল। আমরা ওখানেই গেছিলাম। একটা প্রেজেন্টেশন করার কথা ছিল লাঞ্চটাইমের পর। আমাদের অফিসেই হবার কথা ছিল। কিন্তু লাস্ট মোমেন্টে বস বলল, প্রেজেন্টেশন হবে হেডঅফিসে। আমার আর এলির ওখানে থাকতে হবে। কারণ…
– ভালোই গল্প বানাইছ। তোমাকে তো স্টোরি রাইটারের অ্যাওয়ার্ড দেয়া উচিত। এক কাজ করো। একটা প্রেমকাহিনী লিখে ফেল। এরপর কোনো পাবলিকেশনসের সাথে যোগাযোগ করে বই ছাপাও। বেস্ট সেল হবে। আমিই সবগুলা কপি কিনে নিব ডাবল দামে। এরপর মানুষজনকে উপহার দিব। আমার হাজব্যান্ডের এক্সট্রা ম্যারিটাল অ্যাফেয়ার স্টোরি।
জুনায়েদ হতাশ ভঙ্গিতে বলল,
– পিউ, তুমি আসলেই পাগল হয়ে গেছ।
– আমি তো পাগল-ই। সুস্থ ছিলাম কবে? কথায় আছে, পাগলে কী না বলে। আর এজন্যই আমি এখন বাজে বকতেছি। তুমি হলা নিষ্পাপ সাধু পুরুষ। তোমার গায়ে আমি এখন কলঙ্ক লাগাচ্ছি।
– হইছে থামো। তোমার এইসব বকবকানি আরেকটু শুনলে আমিও পাগল হয়ে যাব।
– পাগল যাতে না হও, এজন্যই বাংলাদেশে চলে যাব আমি। সরে যাব তোমার লাইফ থেকে।
– পাগল নিয়ে বসবাস করতেছি আমি। কী কপাল আমার!
– অতি কপাইল্লা হলে যা হয়, আর কী! তোমার এখন সেই অবস্থা। নাইলে হেড অফিসের গল্প ফাঁদলা। কিন্তু গল্পে যে গোঁজামিল আছে, সেইটা তো ধরতে পারলা না।
– কী গোঁজামিল?
– গোঁজামিল এখানেই যে, তোমাকে আর এলিজাকে হেড অফিসে ডাকছে। আর তোমরা ট্যাং ট্যাং করে দুইজন একসাথে গেছ। হেডঅফিস থেকে নিশ্চয়ই বলে নাই, দুইজনকে একসাথেই আসতে হবে। নাইলে চাকরি নট!
– পিউ, এলির গাড়ি গ্যারাজে। ওর গাড়ির এমওটি ফেল করছে। কিছু কাজ করানো লাগবে গাড়ির। সেজন্য কিছুদিন সে ট্রেনে যাওয়া-আসা করছে। সেদিনও ট্রেনে চড়েই গেছিল অফিসে। হেড অফিসেও যাইত ট্রেনেই। কিন্তু একই অফিস থেকে আমিও যাইতেছি আর আমার গাড়ি আছে। সেজন্য আমি ওকে লিফট দিছি। বলছি, চাইলে আমার সাথে যাইতে পারে। আর সেও রাজি হইছে। আর এই সামান্য বিষয়টাকে তুমি প্যাঁচায়ে এত্ত কাহিনি করে ফেলছ! একবার আমাকে ফোন করে জিজ্ঞেস করতে পারতা, আমরা কোথায় যাইতেছি।
– ফোন করছিলাম। তুমি রিসিভ করো নাই। এলিসের সাথে হাহা-হিহি করতেছিলা তখন।
– আর সেইজন্য তুমি সুইসাইড করতে গেছিলা?
– হ্যাঁ। তোমার আর তোমার এলির রাস্তা ক্লিয়ার করতে চাইছিলাম।
জুনায়েদ হতাশ। ভীষণ রকমের হতাশ। কয়েক মুহূর্ত পর লম্বা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
– কীসের পাল্লায় পড়লাম আমি? এই সামান্য ব্যাপারটা নিয়ে সুইসাইড করা লাগবে? আমি ফোন রিসিভ করি নাই। তাতে কী হইছে? তুমি আমার বাসায় ফেরা পর্যন্ত ওয়েট করতে পারতা। আমি ফিরলে এরপর আমাকে জিজ্ঞেস করতে পারতা। তারপর যদি আমি অস্বীকার করতাম কিংবা মিথ্যে বলতাম, তাইলে নাহয় সুইসাইড করতা। আর… মানে কী? সুইসাইডের প্রসঙ্গ আসতেছে কেন? আমি যদি এলির সাথে প্রেম করি, তাইলে তুমি সুইসাইড করবা কেন? তুমি আমার সাথে ঝগড়া করতে পারতা। আমার নামে কেস করতে পারতা। আগেরবার যেমন সেপারেশনের নোটিশ পাঠাইছিলা, সেরকম আরেকটা নোটিশ পাঠাইতে পারতা।
– হ্যাঁ, তুমি তো এটাই চাও। ডিভোর্স হইলে তোমার থেকে খুশি এই দুনিয়াতে আর কেউ হবে না।
– পিউ, তুমি… তুমি এত্ত ছেলেমানুষ কেন? তোমার এই ছেলেমানুষীর জন্য আমাকে সারাটাজীবন ভুগতে হইত। সুইসাইড করলে তুমি মরে যাইতা। আমি শান্তি পাইতাম না একটুও। তোমাকে বাঁচায়ে রাখব বলেই, তোমার সুখ-শান্তির জন্যই তোমাকে বাংলাদেশ থেকে নিয়ে আসছি। এতদিন ধরে আমরা একসাথে আছি। কত ঝগড়া-ঝাটি হইছে, মারামারি হইছে। এই কিছুদিন আগেও কী থেকে কী হয়ে গেছিল। তারপরেও কেউ কাউকে ছেড়ে থাকার কথা ভাবি নাই। আর আজকে… তুমি ভাবতেছ আমি এলির সাথে প্রেম করি। সেজন্য তুমি গেছ সুইসাইড করতে। কী সব ননসেন্স এগুলা!
– (নিশ্চুপ)
– একটা মানুষ কখন এক্সট্রা ম্যারিটাল অ্যাফেয়ার করে, তুমি জান? যখন সে ঘরের মানুষটার কাছে শান্তি পায় না। কিন্তু আমার সব শান্তি তোমার কাছে। এই যে কাজ সেরে বাসায় ফিরি, কেন ফিরি? তোমার জন্য, শুধুমাত্র তোমার জন্য ফিরে আসি। জব করতেছি, ওভারটাইম করতেছি, বাড়ি কিনছি, গাড়ি কিনছি। কেন? শুধুমাত্র তোমাকে ভালো রাখার জন্য। আমার সমস্ত শান্তি যার কাছে, তাকে ভালো না রাখলে আমার শান্তি তো থাকবে না। সেখানে তোমাকে বাদ দিয়ে আমি কেন অন্য কাউকে কেন আমার লাইফে জড়াব?
– কারণ, আমাকে তোমার পছন্দ না।
– কে বলছে? আমি?
– বলা লাগে না এইসব কথা। আমি জানি। তুমি সবসময় আমার সাথে চিল্লাচিল্লি করো। আমাকে বকো, ধমকাও। আমার কোনোকিছুই তোমার পছন্দ না।
– কবে বকছি? গত কয়েক মাস ধরে আমি একটা টু শব্দ করি নাই। একটুখানি গলা উঁচা করে কথা বলি নাই।
– আগে তো করছ এইসব।
– হ্যাঁ, আগে আমি ভুল করছিলাম। এখন তো নিজেকে শুধরায় নিছি। তুমি ফ্রেন্ডদের সাথে চলতেছ-ফিরতেছ। আমি কি কিছু বলছি? বলি নাই। উলটা তোমার ফ্রেন্ডদের সাথে দেখা হইলে ভালোভাবে কথা বলি। তুমি যখন হাসপাতালে ছিলা, তখন আমাকে পুলিশ ধরছিল। আমি কাস্টডিতে ছিলাম তিন দিন। তখন থমাস গেছিল আমার জামিনের ব্যবস্থা করতে। ওর সাথে আমার কথা হইছে। আমি সত্যিই নিজেকে শুধরায় নিছি। তোমার কোনোকিছুতেই আমার আর কোনো প্রবলেম নাই।
পিউ এবারে দুই হাতে জড়িয়ে ধরল জুনায়েদকে। ওর বুক মুখ গুঁজে কান্নাভেজা সুরে বলল,
– কেন শুধরাইছ? আমি কি বলছিলাম শুধরাইতে? উলটো আমিই তোমার মনমতো করে চলার চেষ্টা করতেছিলাম। কারণ, আমি তোমাকে ভালোবাসি। তুমি যেমনে পছন্দ করো, সেভাবেই চলতে চাই। আর তুমি কেন এমনে পালটায় গেছ? একসময় সারাদিন আমার পেছনে লেগে থাকতা। অফিসে গেলেও ঘন্টায়-ঘন্টায় আমাকে কল দিতা। আমি কী করতেছি, কোথায় আছি, কার সাথে আছি সবকিছু খুটিয়ে খুটিয়ে জিজ্ঞেস করতা। আমার ক্লাস শেষ হইলে কল দিয়ে বলতা, ফ্রেন্ডদের সাথে আজাইরা টাইম নষ্ট না করে বাসায় যাইতে। সবসময় আমাকে নিয়ে ঘুরতে বের হইতা। সারাক্ষণ জোঁকের মতো লেগে থাকতা আমার পেছনে। আর এখন তুমি দিন, সপ্তাহ, মাস পার হয়ে গেলেও আমার দিকে তাকাও না। আমি কী করতেছি, কেন করতেছি কোনোকিছুতে তোমার আগ্রহ নাই। তুমি এমন ভাব করো যেন এই বাসায় আমরা আলাদা দুইজন। কেউ কাউকে চিনি না। কেউ কাউকে দেখি না। এমনকি আমি কান্নাকাটি করলেও তুমি অন্য রুমে গিয়ে ঘুমাও। দরজা লক করে ঘুমাও যাতে আমি তোমার পিছু নিতে না পারি। আমার তো মনে হয়, আমি মরে গেলেও তুমি পাত্তা দিবা না। বলবা, মরে গেছে ভালো কথা। এখন যাই, ফিউনারেল কমপ্লিট করে আসি। তুমি… তুমি এরকম হয়ে গেলা কেন?
সাইকোলজিস্টের কথা বলতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিল জুনায়েদ। পিউকে জড়িয়ে ধরল বুকের মধ্যে। ওর মাথার চাঁদিতে আলতো চুমু দিয়ে বলল,
– স্যরি বউ। আমার ভুল হয়ে গেছিল। আমি সারাক্ষণ কাজ নিয়ে পড়ে থাকতে গিয়ে তোমার কথাই ভুলে গেছিলাম। অ্যাম এক্সট্রিমলি স্যরি। আর কখনো এরকম হবে না।
– সত্যি বলতেছ তো?
– সত্যি।
– প্রমিজ করো। আর কখনো আমাকে ইগনোর করবা না।
– তার আগে তুমি আমাকে প্রমিজ করো। আর কখনো সুইসাইড করার চিন্তা মাথায় আনবা না। আর কখনো বাংলাদেশের নাম নিবা না মুখে। বাংলাদেশে কেউ নাই তোমার। কিচ্ছু নাই। তুমি শুধুমাত্র আমার। এখন থেকে কোনোকিছুতে সন্দেহ হইলে আমাকে সরাসরি জিজ্ঞেস করবা। আমার দিক থেকে হান্ড্রেড পার্সেন্ট নিশ্চিত থাকতে পার, তুমি ছাড়া আর কেউ নাই আমার লাইফে। আর কেউ কখনো আসবেও না। কারণ, আমি তোমাকে ভালোবাসি। অনেক বেশি ভালোবাসি। আমার নিজের থেকেও অনেক বেশি। সত্যি বলতে আমি আগে কখনো… আমি কাউকে তোমার মতো করে কখনো ভালোবাসি নাই। এজন্যই এখন পর্যন্ত তোমাকে নিয়েই বেঁচে আছি আর তোমাকে নিয়েই বাঁচতে চাই সারাজীবন।
পিউয়ের চোখে নোনা পানির বন্যা। সেই বন্যায় ভিজে যাচ্ছে জুনায়েদের শার্ট। জুনায়েদের চোখও ভিজে গেছে। রুমের মাঝখানে দুটি মানুষ একে অন্যকে জাপটে ধরে কাঁদছে। এই দুনিয়াতে তারা একে অন্যের পরিপূরক, ভালো থাকার মহৌষধ, বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন। অতঃপর তারা দুজন…

কয়েকদিন পর…
সাইকোলজিস্টের ক্লিনিকে, ডাঃ ম্যাকক্লেয়ারের রুমে বসে আছে জুনায়েদ। ডাক্তার কথা বলছেন ওর সাথে। পিউয়ের সুইসাইডের কারণ জানতে পেরে তিনি যারপরনাই আনন্দিত। হাসিমুখে বললেন,
– তোমার বউ এখন হান্ড্রেড পারসেন্ট ফিট।
– মানে কী ডক্টর? এত তুচ্ছ একটা ব্যাপার নিয়ে এত বড় কাহিনি ঘটে গেল আর আপনি বলছেন পিউ সুস্থ!
– ইয়েস, শি ইজ টোটালি ফাইন দ্য নাউ। কেন জান? কারণ, এতদিনে সে স্বাভাবিক একজন মানুষের মতো রিঅ্যাক্ট করেছে। এটাই তার মানসিক সুস্থতার সাইন। সে তোমাকে দেখেছে তোমার কলিগের সাথে। তুমি তোমার কলিগের সাথে হাসিমুখে কথা বলছ। তার সাথে বাইরে যাচ্ছ। অথচ পিউকে ইগনোর করে যাচ্ছ কন্টিনিউয়াসলি! পিউ দুয়ে দুয়ে মিলিয়েছে। ঘরে বউকে ইগনোর করে, বাইরে কলিগের সাথে হাহা-হিহি করাটা নিশ্চয়ই ভালো লক্ষণ নয়। এই যে পিউয়ের মাথায় এই সুক্ষ্ম ব্যাপারটা ঢুকেছে, এর মানেই সে সুস্থ মস্তিষ্কে চিন্তাভাবনা করতে পারছে। তার মনে সন্দেহ ঢুকেছে তোমাকে নিয়ে। এগুলো কিন্তু এতদিন ছিল না। কারণ, এতদিন তার মনের বয়সটা আটকে ছিল চৌদ্দ-পনেরতে। ওই বয়সের মেয়ের মাথায় এই ব্যাপারটা ক্লিক করার কথা না। কিন্তু বাইশ বছরের একজন স্ত্রীর মাথায় অবশ্যই ক্লিক করবে। স্ত্রী মাত্রই তার স্বামীর খুঁটিনাটি গতিবিধি লক্ষ করবে।
– তাই কী?
– তুমিই ভাব। আসলেই কী তাই? তোমার তো এলি ছাড়াও আরো অনেক কলিগ আছে। আগেও ছিল। কখনো কী পিউ রিঅ্যাক্ট করেছে এভাবে? করেনি। এতগুলো বছর ধরে সে তোমাকে মেয়ে কলিগদের সাথে চলাফেরা করতে দেখেছে। তার মনে একটুও সন্দেহ জাগেনি। কারণ, সে তার কিশোরী মনের জগতে বন্দি ছিল। এখন সে মুক্ত হয়ে এসেছে। পা রেখেছে যৌবনে। এখন সে সতর্ক। এখন সে এলিকে দেখামাত্রই রিঅ্যাক্ট করেছে। দিস ইজ দ্য সাইন দ্যাট শি হ্যাজ ফুলি রিকভারড!(সমাপ্ত)

1 COMMENT

  1. Khub sundor…. But golpota ending ta ar aktu sojjito hole valo hoto…… Frist to last golpota ak rokomi roye gelo…. Kono twist holo na……. But valo laglo….. Thanks for beautiful story.

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here