লাভিং জার্নি পর্ব ১

লাভিং জার্নি

বছর তিনেক অাগের দিকে।
অামি তখন সিএমসিতে পড়ছি।
ফাইনাল পরীক্ষার মাঝামাঝি এসে অামার ভীষণ জ্বর হয়ে গেলো। বাসায় জানালাম না, বাসায় জানানো মানে বাবা বলবেন, পরীক্ষা কুইট কর! সুতরাং জানানোর প্রশ্নই অাসে না।

এর মাঝে বাবা ফোন করে বললেন,
—-তোর এক্সাম গ্যাপ অাছেনারে মুন্না??
——হুঁ!
—–তোকে ইমার্জেন্সি দরকার! একদিনের জন্য বাসায় অায়!
অামি স্ট্রেট না বলে দিয়ে ফোন সুইচ অফ করে রাখলাম।বাসায় যাওয়া নিয়ে সমস্যা না। কিন্তু এরকম জ্বর গায়ে বাসায় গেলে বাবা অার পরীক্ষা দিতে দিবেন না।
যেমন তেমন পরীক্ষা হলে কথা ছিলোনা। অামার মেডিকেল কলেজ লাইফের শেষ অর্গানাইজড এক্সাম।
ফোন অফ করেও রক্ষা হলোনা। রাতে বাবা এসে হাজির। সাথে পুলিশ ফোর্স! খবর পেয়ে অামি
নিচে নেমে অাসতেই ব্যস্ত ভঙ্গিতে বাবা বললেন,
——এক্ষুণি রেডী হয়ে গাড়িতে বস, মুন্না! তোকে অামার দুইঘন্টার জন্য দরকার! কাজটা হয়ে গেলেই তোকে পাঠিয়ে দিবো।

অামি হতভম্ব।
বাবা যতবারই অামায় হোস্টেল থেকে নিতে অাসেন; একা অাসেন।
এবার
পুলিশের গাড়ি সাথে।

অামার নিজেকে কি যে ছোট লাগছিলো তখন।

অামার বাবা
বিভাগীয় কমিশনার মোঃ অাসাদ উদ্দীন ভীষণ হুজুগে এবং রাগী।তার অনেক রাগের প্রতিফলনের একটি হলো,
নিজের একমাত্র ছেলেকে পুলিশ দিয়ে হুমকি ধামকি।এতে যেনো তাঁর দুনিয়ার শান্তি।

অামি মোটামোটি নিজের ক্যারিয়ারে যথেষ্ট পরিচিত। ইন্টারমিডিয়েটের পর থেকে গান করছি, নিজের একটা ব্যান্ড অাছে। তাঁর উপর সিএমসিতে এমবিবিএসের সেরা ছাত্র। মন্ত্রী, এসপির মেয়েরা, অামার ফ্যানপেজে দিনরাত কেঁদে মরে, মেয়েদের কাছে অামি অনেক কাঙ্খিত! অার সেখানে অামার কিনা এখনো বাবার কানমলা অার ঝারি খেয়ে দিন যায়!বাবার কাছে অামি কবে বড় হবো??

——কি হলো??? গাড়িতে উঠ??কথা কানে যায় না??
অামি ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বললাম,
——অামার জ্বর বাবা, এখন জার্নি করলে; বাড়বে অারো। লাস্ট পরীক্ষা টা যদি দিতে না পারি….
—-কি বললি?? জ্বর?? এই বয়সে জ্বরকে পাত্তা দিয়ে চলিস তুই!! কি ডাক্তারি পড়িস, জ্বর হলেই কাত! নেক্সট পরীক্ষার বইপত্র নিয়ে গাড়িতে উঠ!

অামি দাঁড়িয়ে মাথা চুলকাতে থাকলাম।
কি এমন দরকার যে, বাবা এমন মেরে ধরে অামায় নিতে এসেছে…

—–কি হলো?? তুই এমনি এমনি তাহলে গাড়িতে উঠবি না?? দাঁড়া এখনি, রাম ধোলাই দিয়ে.. এই জাহিদ…. জাহিদ…
একে কোলে করে গাড়িতে তোলো…
জাহিদ নামের মোটা চেহারার পুলিশ ইউনিফর্ম পড়া লোকটা এগিয়ে অাসার অাগেই টুপ করে অামি গাড়িতে বসে গেলাম।লোক দিয়ে অামার সব বইপত্র গাড়িতে নিয়ে এলেন।
অামার এক বন্ধু সাথে অাসতে চাইলো;
বাবা কঠিন গলায় না বলে দিলেন!

অামি প্রায় কাঁদতে কাঁদতে গাড়িতে নিজের বই গুলো গুছিয়ে নিতে লাগলাম। কলেজ ক্যাম্পাস কাঁপানো ছেলে অামি, অথচ বাবাকে কেনো এত যে ভয় পাই???
বাবা, মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললেন,
——বোকা ছেলে, কাঁদছিস কেনো?? ধমক দিলেই এত ভয় পাস কেনো??এত বড় হয়েও মেয়েদের মত কেমন কাঁদিস….. ছিঃ..

অামি দাঁত কামড়ে শক্ত হয়ে থাকলাম।বাবার শাসন মাঝে মাঝে অামাকে এত কষ্ট দিত যে ইচ্ছে করতো সব ছেড়েছুড়ে চলে যাই!সেদিন গাড়ি থেকে লাফিয়ে নেমে যেতে মন চাইছিল।
অামি বাবার দিকে একবার রক্তচক্ষু করে তাঁকাতে গিয়েও নিজেকে সামলালাম।

বাবা অাদুরে গলায় বললেন,
—–তোর জন্য একটা বিশাল সারপ্রাইজ অাছেরে মুন্না!
সারপ্রাইজটা পেয়ে তুই খুশিতে পাগল হয়ে যাবি।
অামি এবার মুখ খুললাম।রাগে চিৎকার করতে করতে বললাম
——অামার অন্য রকম একটা ইমেজ অাছে বাবা। সবাই অামার রেজাল্ট কেমন হবে তা নিয়ে মুখিয়ে অাছে! অার অামার পরীক্ষার অাগে অাগেই তোমার অামাকে সারপ্রাইজ দেবার দরকার পড়ে গেলো এত?? তুমি তো জানো, বাবা মিডিয়াতে সবাই কত নিষ্ঠুর!পরীক্ষা একটু এদিকওদিক হলেই
অামার ফ্যান ফলোয়াররা সবাই.. সিঙ্গার মুন্নার…..রেজাল্ট নিয়ে কথা বলবে!অাই হ্যাভ এ নাইস ফেইসভেলু।সেটা যদি…..

অামি বাবার পি এসের সামনেই শব্দ করে কাঁদতে থাকলাম।
বাবা মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
—–তুই কেনো যে ছেলে হলি, মেয়েদের মত নাক কচলিয়ে কাঁদিস কেমন!
বাবা গালে হাত বুলাতে গিয়েই অাৎকে উঠে বললেন,
ও মাই গড, তোর তো ভীষণ জ্বর মুন্না! কিছু নিয়েছিস?? এই অবস্থায়ও এক্সাম কেনো দিচ্ছিস??জ্বর হয়ে যদি মরে টরে যাস, ডাক্তার হয়ে লাভটা কিরে মুন্না??
অামি মাথা থেকে বাবার হাত সরিয়ে দিলাম।
—–… কি এমন ইমার্জেন্সি যে বাবা পুলিশ ফোর্স সহ অামায়…..
বাবা অামার পা কোলে নিয়ে কেডসের ফিতা বাঁধতে বাঁধতে বললেন,
——মুন্না, তোরঁ বিয়ে। অবশ্য তোর বাসায় না গেলেও হতো! অাখতের মত তো.. কাজী অাগে মেয়ের কবুল নিয়ে এসে তোর কবুল নেবে। পরে ভাবলাম, জীবনের একটাই বিয়ে,
হোস্টেলে বসে বসে কবুল বলবি সেটা কেমন দেখায় অাবার!

বাবার কথার অাগামাথাও অামি ঠিক বুঝতে পারলামনা।একটা ঝটকার মত লাগলো।
কিছু
বুঝার চেষ্টাও করলাম না। পরীক্ষার মাঝখানে এমন ধরে নিয়ে যাচ্ছে এই সাডেন শকটাই তো অামার…. এখন বলছে বিয়ে, অামার কানের ভেতর যেনো একটা ছুড়ি ঢুকিয়ে দিলো কেউ…
অামি অসহায় মুখে বাবার দিকে তাকালাম।
—–তোর হঠাৎ বিয়ে দিচ্ছি বলে ভাবিসনা ঠকে যাচ্ছিস! মেয়েটা কেমিস্ট্রিতে পড়ছে। ব্রাইট স্টুডেন্ট। ডিপার্টমেন্টে হ্যাপেনিং!
ও’র বাবা, শহীদুল! অামি যখন ফার্স্ট মৌলভীবাজারে জয়েন করি অামার অান্ডারে ছিলো….গত মাসে স্ট্রোক করে মারা গেছে…..

অামি তো জানিই না কিছু।ফিলিপাইনে ছিলাম তখন ট্যূরে!ফিরে এসে শুনি..ও:র বৌ বাচ্চা নিয়ে তোর কাকাইর কাছে এসেছিল… কিছু টাকাপয়সা যদি অফিস থেকে বলে…ম্যানেজ করে দিই অামি….
অামি তো তখনই খোঁজ নিলাম!
খবর পেয়েই শহীদুলের মেয়েটা এলো! সাবিহা নাম। পড়াশোনার খরচ নিয়ে বিপদে পড়ে গেছে বেচারী! অামার সামনে বসে ননস্টপ কেঁদে গেলো, বলল স্যার, একবার অামায় পড়াশোনাটা করবার সুযোগ করে দেন…..

এইবার অামি নড়েচড়ে
বসলাম! কারণ, বাবার গলা ধরে এসেছে, কাঁদছেন তিনি! অামার বাবা ভীষণ শক্ত মানুষ। জেলা প্রশাসক থাকা অবস্থায় সারা বাংলাদেশের সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ ডিসি হিসেবে পুরষ্কার পেয়েছেন! তার একমাত্র কারণ কঠিন সিদ্ধান্ত তিনি খুব সাহসিকতার সাথে সহজভাবে নেন।

তিনি কিনা অাজ অামার পা কোলে নিয়ে কাঁদছেন!
প্রচন্ড দুঃসময়েও তিনি খুব শক্ত; অথচ অাজ….. ছেলের কাছে….
অামি বাবার কোল থেকে পা নামিয়ে একটু নরম গলায় বললাম
——বাবা, স্টপ বাবা! কারো জন্য এত কষ্ট পাবার কি অাসলেই দরকার অাছে তোমার??ইউনিভার্সিটিতে পড়া একটা মেয়ে অর্থ কষ্টে মরে যাচ্ছে, এটা অবিশ্বাস্য। তাও মানলাম, যে ও’র পরিবার অাছে, তাদের কষ্ট হচ্ছে।
তোমার পজিশন থেকে ও’র ভার্সিটিতে বলে দাও! দরকার লাগলে প্রচুর ক্যাশ দিয়ে দাও!মাসে মাসে একটা বড় এমাউন্টের ক্যাশ না হয় অামি নিজেই দিলাম।
অামার সাথে বিয়ে দিবে/ ইজ নট ইট ভেরি ফানি!!??
বাবা ঠাস করে অামার গালে একটা চড় মারলেন!
অামি গাড়ির লাইটটা নিভিয়ে দিলাম। উফ্….
এ অামার কী লাইফ খোদা!!! কথা বললেই চড় খাচ্ছি।
——ছাগল, দুদিন দু টাকা কামিয়েই মানুষকে ক্যাশ দাও, ক্যাশ দাও বলিস! তোর হাত পা যদি অামি মেরে না ভেঙেছি….
—–ড্রাইভার গাড়ি সাইড করো! এই গাঁধার কত ক্যাশ অাছে অামি এখনি বের করছি! অামাকে ক্যাশ দেখায়! বিভাগীয় কমিশনার অাসাদকে ক্যাশ দেখায়!!দুই টাকার ইউটিউবার অামাকে ক্যাশ দেখায়! কতগুলা ফালতু মেয়ে ছাড়া তোর ইউটিউব কে দেখেরে গাঁধা! কোনোদিন তো কোনো ভালো অফিসার….

বাবার বকাবকিতে অামি হাল ছেড়ে দিয়ে
বিড়বিড় করে বললাম,
—-ঠিক অাছে বাবা, তোমার বেচারীকে অামি বিয়ে করবো! ফর ওয়ান কন্ডিশন, সব হবে টপ সিক্রেট।
অার তা না হলে……

বাবা মুহূর্তেই হেসে বললেন,
—–এই তো গুড! বিড়াল গাছ থেকে নেমেছে এবার! সিক্রেটই থাকবে। কত সচিবের মেয়ের সাথে তোর লটরপটর, অামি জানিনা ভেবেছিস??
ক্যারেক্টারলেস ছেলে। লাস্ট উইকে তো তুই একটা মডেলকে নিয়ে লাঞ্চে গিয়েছিলি; তাই না??
অামি বাবার হাত চেপে ধরে বললাম,
——বাবা, প্লিজ অাস্তে।।।।
অামি বিয়ে করলেই তো সব মিটে গেলো তাই না???
——হু। তুই ওকে বিয়ে করে সমস্ত দায়িত্ব নিলে, সাবিহা পড়াশোনাটা করে নিলো।ওর পরিবারকে অামি দেখবো….অার এদিকে তুই নিজের ক্যারিয়ারও ঠিক করে নিলি।ততদিনে দেখবি সাবিহারও ভালো জব হয়ে গেছে। তোরা ভালো থাকবিরে….
অামি অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিলাম।
বাবা দীর্ঘ বক্তৃতায় স্বান্তনামুলক বাণী অাওড়াতে থাকলেন….
——–বিয়েটা এত কিছু সিরিয়াসও নয়রে মুন্না! বুঝলি, এই যে তোর মা কে অামি বিয়ে করলাম, তোর দাদুইর পছন্দমত! খারাপ কিছু তো হয়নি। বরং তোর মা বেশ ভালো ছিলো!অামার এত কাজের চাপে কখনোই সে অভিযোগ করেনি। বরং মৃত্যুর অাগ মুহূর্ত পর্যন্ত সে হাসিমুখে কথা বলেছে।
অামি বই খুলে পড়ায় মনোযোগী হলাম। বাবা নানা কথায় অামায় অাশ্বস্ত করছেন। অামি অার সেগুলো শুনতে গেলাম না। অামি জানতাম যে বাবার পছন্দেই অামার বিয়ে করতে হবে! বাইরে থেকে সবাই ভাবে একজন বিভাগীয় কমিশনারের ছেলে, হবু ডাক্তার, অাবার উঠতি গায়ক; সে না জানি কত স্বাধীন, কত বেপরোয়া! কিন্তু বাস্তব চিত্রটা অামার একদমই ভিন্ন ছিলো, পড়াশোনার চাপ, বড় হবার চেষ্টা, বাবার মান সম্মান মেইনটেইন এসব ব্যালেন্স করে অামার স্ট্রং রুটিনড লাইফ চলতো।যে কাজ অার দশটা অামার বয়েসী ছেলে অনায়াসে করতে পারে, সেই কাজই করতে গেলে অামায় হাজারবার ভাবতে হয়।
কোনো হাই প্রোফাইল মেয়ের সাথে ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব অামার হয়নি, তবে হ্যা অামায় ঘিরে একঝাঁক সুন্দরী মেয়েদের ভীড় ছিলো… এর মাঝে অামায় এমন একটা মেয়ের সাথে বিয়ে ঠিক হলো যেই ক্যাটাগরির মেয়ের কথা অামি কখনো ভাবিইনি।

মনে মনে বললাম,
—–হে অভাগা, মুন্না! নিজের জীবনের এই অাচমকা বিয়েটাকে মনে প্রাণে গ্রহণ করো।মনে প্রাণে এতে সায় দেও। এ তোমার কোনো পাপের ফল! যার কিনা ফিল্মের নামী দামী হিরোইন বিয়ে করার কথা, সে বিয়ে করতে যাচ্ছে, একটা কেমিস্ট্রির ছাত্রীকে!
——কিরে ঘুমিয়ে পড়েছিস??
অামি গাড়ির অালোটা জ্বালিয়ে দিয়ে বললাম,
——বাবা, বিয়ে করার মত সত্যিই কি কোনো কারণ অাছে???
এটা কি অাসলেই খুব পাগলামি , সিনেমাটিক টাইপ… হয়ে যাচ্ছে না!?? বাবা কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন,
——সাবিহা দেখতে একদম মায়ের মত, তোর দাদুমার ক্লোন পুরোটা। অামি তো প্রথম দেখেই একেবার স্টাক! পরে মনে হলো, স্বয়ং অাল্লাহপাক বোধহয় পাঠিয়েছেন, অামার মাকে!
বাবার কথা অামি হেসে উড়িয়ে দিলাম।

সাবিহা দেখতে অবিকল অামার দাদুমার মত, শুধু এই একটা কারণে বাবা সেই রাতে অামার বিয়ে দিয়ে দিলেন।
বিয়ের সময় সাবিহা, ও’র পরিবারের সবাই অামাদের বাসায় ছিলো। বাবা অবশ্য বলেছিলেন,
——- অাগে একটু কথা বলে নিবি নাকি মুন্না??? দেখে নে একটু…..
——না বাবা, দেখার পর যদি অামার বিয়ে করতে ইচ্ছে না করে…. হয়তো অসহ্য লাগলো মেয়েটাকে ;তবে???
জবাবে
বাবা মমতাময় দৃষ্টিতে তাকিয়ে মধুর করে হেসেছিলেন।
অামি জানি যে ধরনের মেয়েরা অামার পেছনে ঘুরে তাদের অাগাগোরা পরিপাটি, স্টাইলিশ, অাধুনিক। গাড়িতে বসে এরা অন্তত দশবার মেকঅাপ ঠিক করে। এরা ভীষণ ফ্যাশনদুরস্ত! গাড়ির জানালার কাচের ভেতর এদের দেখে লক্ষ যুবক দীর্ঘশ্বাস ফেলে! ওদের মত মেয়েকেই অামার কখনো ঠিকঠাক পাত্তা দিতে মন চায় না। অামার সবসময়ই এর থেকে অারো স্পেশাল চাই..

অথচ অাজ
সেখানে একটা সাধারণ ঘরের মেয়ে……
অামার ভেতর হাহাকার করে উঠলো!

রেজিস্ট্রি পেপারে সাইন করার সময় নামটাতে অামি ভালো করে চোখ বুলালাম।
নাম:
সাবিহা ফেরদৌসি।
গুটি গুটি অক্ষরে বাঁকানো হাতের লিখা। অামার হৃদয় তখন লক্ষ কোটিগুণে কাঁপছিলো। গলা শুকিয়ে বুক ব্যাথার মত করছিল!
বাবার উপর রাগে অামি অস্থির হয়ে নিজের রুমে এসে বসলাম।

ঘরে এসে দেখি খুবই অপ্রস্তুত ভাবে সাবিহা দাঁড়িয়ে।
সাবিহাকে অামি যখন দেখি, অামার চক্ষু ছানাবড়া। বুকের ভেতর প্রচন্ড ধাক্কা লাগলো।নিজেকে সামলে নিয়ে বিছানায় বসলাম। বাবার কথাই ঠিক। সাবিহা দাদুমার ইয়ং কপি! অামি তো মুখ ফসকে বলেই ফেললাম, দাদুমা টু!
সাবিহা, মেরুন জর্জেটের একটা শাড়ি পড়ে অাছে।ড্রেসিংটেবিলের টুলটাতে অামার সামনে গুটিসুটি মেরে বসলো। কাঁপা গলায় বলল,
——অামার পড়াশোনার খরচটা শুধু দিয়ে দিয়েন অাপাতত। কোনো কাম্পানিতে ঢুকতে পারলেই অামি শোধ দিয়ে দিবো। অামি জানি, এই বিয়েটা অাপনার কাছে কোনো বিয়ে নয়!!হয়তো অামার কাছেও নয়! তবুও.. ইটস এ চান্স ফর মি। বাউন্ডারি চান্স! অামি কি কাছে অাসবো অাপনার????

এক নিঃশ্বাসে
কথাগুলো বলেই সাবিহা, শাড়ির অাঁচলটা অারো গায়ে টেনে ধরলো!

ও’র কথা অামি ঠিক শুনলাম না।অামার চোখ ধাঁধিয়ে গেছে ততক্ষণে।
অামি অপলক দৃষ্টিতে তাঁকিয়েই রইলাম!একটু ভাঙ্গা চেহারায় কোনো মেকঅাপ ছাড়া,সেন্টার সিঁথি করে সাদামাটা চুল অাঁচড়ানো।পেছনে একটা হাত খোঁপা করে তাতে ঘোমটা অাটকে দেওয়া হয়েছে। গলায়, কানে ভারী স্বর্ণের একগাদা গহনা! কানের দুলটাও ঠিক নেই, টুইস্টেড।
ফর্সা চিকন হাতে কালো বেল্টের ছোট্ট ডায়ালের ঘড়ি। তাঁর অাশেপাশে অনেকগাছি চুড়ি।
পাতলা জর্জেটের ফাঁকে, পুরো শরীর দেখা যাচ্ছে। তাড়াহুড়ো করে শাড়ি পড়া হয়তো, এজন্য কয়েক জায়গায় খুলে খুলে অাছে, ড্রেসিংটেবিলের দিকে পিঠ করে বসা! অায়নায় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, পিঠের দিকে ব্লাউজের একদম টপ হুকটা খুলে অাছে।অাঁচল তাঁতে অাটকে গিয়ে অাছে।
সাবিহা নার্ভাস ভঙ্গিতে একবার পিঠে হাত দিলো, অাবার নিরুপায় নামিয়ে অানলো। সিক্সটিন ডিগ্রি টেম্পারেচারেও বেচারী ঘেমে চুপসে গেছে। কপাল দিয়ে গাল গড়িয়ে ঘামের বন্যা।একটু পর পর ঠোট কামড়ে নিজেকে সামলাচ্ছে! একটু এলোমেলো সাঁজগোঁজের, একটু নাভার্স, অার বড্ড সাদামাটা,
বড় বড় চোখের সেই অনিন্দ্য সুন্দরী সাবিহাকে দেখে বাবার হাতে খাওয়া সারা জীবনের কানমলা অামার সার্থক মনে হলো। সারাজীবন নিষ্ঠুর ভেবে অাসা বাবাকে অাজ বড় ভালো লাগলো!
অামার সদ্য হুট করে পাওয়া বৌকে দেখে অামি বাবাকে মনে মনে ধন্যবাদ দিতে থাকলাম।
অাচ্ছা,,দাদুমা কি এত ফর্সা ছিলেন?? না অতটাও না। অামার তাঁকানোতে সাবিহা অারো বিব্রত হয়ে বলল,
—– অাপনি ব্রেকফাস্ট করেই তো চলে যাবেন। পরীক্ষা অাছে নাকি??
এখনো তো সময় অাছে; অামি কি বিছানায় অাসবো???
কথাটা বলেই সাবিহা
ফ্লোরে বসে পড়লো!
ভয়ে যেনো সে কুঁকড়ে যাচ্ছিলো! মনে হচ্ছিলো ফাঁসির দন্ডে দন্ডিত হয়ে অাছে সে, কেবল অামিই তাঁকে মওকুফ করতে পারি, একমাত্র অামিই! তাঁর বোধহয় ধারণাই ছিলো বিয়ে করলেই কাছে অাসার কথা বলতে হয়, এই যেমন বাড়িতে অাসা অতিথিকে অামরা চা কফি অফার করি সেরকম, বিয়ের রাতেও বরকে অফার করা। মেয়েদের ব্যাপারে অামি সবসময়ই সাবলীল। সাবিহার নার্ভাস ভঙ্গিতে বুঝতে পারছিলাম, কথাগুলো ও শুধু বলার জন্যই বলছে।ভেতরে ভেতরে ও অাসলে ভাবলেশহীন।
এমনকি ভালো করে অামার দিকে তাকাচ্ছিলোও না।

অামি এগিয়ে গিয়ে সাবিহার হাত ধরে টেনে তুলে নিয়ে বললাম,
——পানি খাবেন???
সাবিহা মাথা নাড়লো!
তাও একগ্লাস পানি এগিয়ে দিয়ে বললাম,
——-অাপনার কেমিস্ট্রিতে পানির সংকেত যেনো কি??? এইচ টু ও! তাই না?? এই এক গ্লাস এইচ টু ও এক্ষুণি শেষ করুন।
সাবিহা নিমেষেই একবারে পুরো পানিটা ঢকঢক করে খেয়ে নিলো।
হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,
—–অাপনি অত নামীদামী মানুষ।অাপনার বাবাও।অামার একটু অার্থিক সাহায্য ছাড়া কিন্তু কিছু চাওয়ার ছিলোনা।টাকাপয়সার ব্যাপারে অফিস খুব ঝামেলা করছিলো।
হসপিটালের বিলটা অামি অামার দুই টিচার থেকে ধার নিয়ে দিয়েছিলাম। একটু তাড়াতাড়ি যাতে অফিস থেকে বাবার…… এই জন্যই এসেছিলাম:
অাপনার বাবাই জোড় করে বিয়ে দিয়ে দিলেন।অাপনি অামায় ভুল বুঝছেন না তো???
এই এত কথার মাঝে অামি স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম
সাবিহা ভয় পাচ্ছে, খুব ভয় পাচ্ছে।

সাবিহাকে ধরে অামি সোজা দাঁড় করিয়ে দিলাম। পিছন ঘুড়িয়ে ব্লাউজের হুকটা ঠিক করে অাটকে দিয়ে শাড়ির অাঁচল ঠিক করে দিলাম।
——অাপনার মা তো, বোধহয় অামাদের বাসায় তাই না??
সাবিহা চুপচাপ হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লো।
—–অামায় পরিচয় করিয়ে দিবেন না??
—–না, না থাক লাগবেনা। অাপনি এত ব্যস্ত মানুষ। মা অাছেন তো, ঠিক অাছেন। চলবে তো! অাবার মা, কেনো??
লজ্জায় সাবিহা যেনো এতটুকু হয়ে যাচ্ছিল!
অামি তাঁকে বিয়ে করেছি এই অপরাধবোধে তাঁর বোধহয় সব মিশে একাকার।
অামি হেসে দরজা খুললাম,
——অাপনার মায়ের সাথে কথা বলে নিই অাগে! নিজের মেয়ের জামাইকে পরে দেখা যাবে চিনতেই পারছেন না।
—কি হলো?? চলুন??
সাবিহা অত্যন্ত বিনীত ভাবে বললো,
—–অাপনার অাসতে হবে না।অামি মাকে ডেকে নিয়ে অাসছি! অাপনি বসুন! অামি ডেকে নিয়ে অাসছি!
বলতে বলতে প্রায় দৌড়ে চলে গেলো, এবং প্রায় সঙ্গেই সঙ্গেই মায়ের হাত ধরে ছুটে এলো।
অাামি সাবিহার মায়ের সাথে কথা বললাম। কথা বলবার সময় লক্ষ্য করলাম,
, সাবিহা লজ্জায় যেনো মিশে যাচ্ছিলো।
মা চলে যেতেই সাবিহা অাবারো ধরা গলায় বলল,
——মা, অাপনাকে ভয়ে সালামী দেননি। অত কম টাকা….
অাপনি কত বড় লোক মানুষ!!

সাবিহার কথা শেষ হবার অাগেই, অামি দরজা বন্ধ করে দিলাম।
সাবিহা ইচ্ছে করেই যেনো অাবার ফ্লোরে বসলো। অামি ও’র কাছে গিয়ে ফ্লোরেই বসলাম।সাবিহা সরে বসলো একটু…. অামিও অারও সরে বসলাম। এবার সাবিহা সরতে গেলে হাত চেঁপে ধরে বললাম,
——-এই এখানটায়, পাশে বসুন অামার!
সাবিহা অবাক চোখে তাঁকালো অামার দিকে। দিশেহারা ভাবে বলল,
——ফরিদপুর থেকে সারাদিন জার্নি করে এসেছি। ঘামের গন্ধ টন্ধ যদি লাগে অাপনার। অামি অাসলে জানতাম না তো বিয়ে। এসে শুনি বিয়ে। অাপনার সাথে একঘরে দেওয়া হবে বুঝিনি!
চোখে মুখে তাঁর রাজ্যের অসহায়ত্ব।

অামি হেসে ফেললাম। সাবিহার মুখটা তোলে ধরে নিয়ে, অামার কি যে হলো তখন,!! সাবিহার ঠোট কামড়ে ধরলাম।সাবিহা শক্ত হয়ে অাছে।অামি শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম ওকে।এতে যেনো ও অার জমার বেধেঁ গেলো ;
যেনো একটা রোবট।
কোমড়ের কাছটায় হাত দিতেই সাবিহা “ও মাগো” বলে চিৎকার দিয়ে সটান দাঁড়িয়ে গেলো। থরথর করে কাঁপছে ও….
অামি হাতটা ধরে টানতেই কেঁদে ফেললো।
অামি গভীর অাকুলতায় জড়িয়ে ধরলাম।ফিসফিস করে বললাম, সরি, সরি! ভয় পাওয়ার তো কিছু নেই!! চুলের খোঁপাটা খুলে দিতেই সে কেঁপে উঠলো ভীষণ! অামি অাদরে ভালোবাসায় চুলে অাঙুল বুলিয়ে বললাম, অামি তোমার সাথেরই একজন।এত কেনো ভয় পাচ্ছো???
তুমি সব বলতে পারো তো।এখনই শিওর না হলে বলো…..

সাবিহা তাও নিঃশব্দ! ব্যাকুল হয়ে কাঁদছে সে…….

মেয়েদের কাছে কোনোকালেই অামার জড়তা ছিলোনা।চুমু খাবার মত একটা নরমাল ব্যাপারে কোনো মেয়ে যে ভয় পায় তা অামি জানতামনা।
অামার ক্ষেত্রে মেয়েরা বরং বেশি অাগ্রহী।
কিন্তু সেদিন সাবিহার অনুভূতিহীন পাথর শরীর দেখে অামি থমকে গেছিলাম।
পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে অামি বাথরুমে চলে এলাম।

বাথরুম থেকে বেড়িয়ে দেখি সাবিহা ঠিক অাগের জায়গাতেই দাঁড়িয়ে।পিঠময় খোলা চুল।অাঁচল গড়িয়ে মাটিতে।কাঁদতে কাঁদতে গালময় কাজল লেপ্টে গেছে।
শাড়ির সব কুচি মুঠো করে ধরে দাঁড়িয়ে। অামি অবাক হয়ে বললাম।
—–অাপনি দাঁড়িয়ে যে??? কি হয়েছে??
—–অাপনিতো যেতে বলেননি!! চলে যাবো???
অামার নিজের উপর প্রচন্ড রাগ হলো, শত শত মেয়ের হার্টথ্রব অামি, যাকে কিনা অামি বিয়ে করে এক দেখায় প্রেমে পড়ে গেলাম, অাদর করতে চাইলাম সে কিনা অামায় যমের মত ভয় পাচ্ছে, কারণ কি?? অামি কি ডাকাত, দস্যূ??

একটু ধমকের স্বরেই বললাম,
—— নিজের বুদ্ধি বলতে কি কিছু নেই!? যেতে বলিনি বলে রয়ে যেতে হবে???
সাবিহা খোঁড়ানোর ভঙ্গিতে বেড়িয়ে যেতে লাগলো।
——ওরকম হাটছেন কেনো?
মিনমিনে গলায় পেছনে না তাঁকিয়েই সাবিহা বলল,
——শাড়ি খুলে গেছে! সেলোয়ারের উপর গুঁজে পড়েছিলাম তো, নাড় ছিড়ে গেছে….
সাবিহার চলে যাবার দিকে অামি স্তব্ধ হয়ে তাঁকিয়ে রইলাম। একটা মেয়ে কত অবলীলায় তাঁর সব লজ্জা, অার সত্যগুলো বলতে পারে সেদিন সাবিহাকে না দেখলে অামি বুঝতে পারতাম না।

তারপরের ঘটনাগুলো অামার জীবনে একদম অন্যরকম, অামার সমস্ত জুড়ে যেনো সাবিহা নামক মেয়েটা ঢুকে পড়লো। অামার সব অাধুনিকা বান্ধবীকে অসহ্য লাগতে লাগলো। অামার এতদিন পরে এসে মনে হলো অামার মন অাসলে এইরকম খুব সাধারণ কাউকে বিশেষ করে চাইছিলো।অামার স্ট্যাটাস, অামার জগতে ওরকম কাউকে অামি এলাউ করিনি, কিন্তু এরকম কেউই তো অামার চাওয়া ছিলো। অজানা ব্যক্তিত্ববোধে যা অামি ভাবতেই পারিনি। কিন্তু সাবিহার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা বেশ ভিন্ন; বিয়ের পর সে নিজে থেকে অামায় কখনোই ফোন করতো না। অামি ফোন করলে হুঁ, হা জবাব দিতো। দেখা করতে চাইতো না।বিয়ের রাতের পর কয়েকমাস পেরিয়ে গেলেও অামাদের দেখা হলোনা।
অামিও বলতাম না। অামি কেনো ছোট হবো?? যেই অামার পিছনে সুপার মডেল গার্লরা ডেটে যাওয়ার জন্য সেঁধে মরছে, অামি কেনো???
কিন্তু দিনে দিনে অামি যেনো পাগল হয়ে যাচ্ছিলাম। এরমাঝে একদিন সাবিহা জানালো সে চাকরি পেয়েছে, পরের মাস থেকে তাঁর অার টাকা চাই না।

অামি তখন বিসিএসের জন্য পড়ছি। এর মাঝে গানের বেশ ব্যস্ততা।সবমিলিয়ে এত চাপে ছিলাম যে, সাবিহার কথায় রেগে গিয়ে বললাম,
—–কেনো চাই না?? টাকা কি অামি কম দিচ্ছি?? নাকি টাইমলি পাঠাতে পারি না বলে…. তোমার কেনো টাকা চাই না? টাকার জন্যই তো বিয়ে করেছিলে।অার কিছুই তো তোমার চাই না! অামাকেও চাইনা।সংসার চাইনা। এখন কেনো বলছো, টাকাও চাই না?? অামার জীবন শেষ করে দিয়ে বলছো টাকাও চাই না!
সাবিহা কাঁদতে কাঁদতে ফোন রেখে দিলো।
সপ্তাহ পার হয়ে গেলো।সাবিহার কোনো ফোন কল নেই, খবর নেই। বাধ্য হয়ে বাবাকে বললাম, সাবিহাকে বাসায় অাসতে বলতে।

বাবা জানালেন, ও’র এক্সাম চলছে। পরে অাসবে। রাগে অামার মাথা যেনো কাজ করছিলো না। অামি মেসেজ করে পাঠালাম।
” পরীক্ষার জন্য অাসলে না তো। বেশ! অার কখনো অাসতেও হবেনা ; পরীক্ষা দিয়ে কোন **** ছিড়ো; দেখবো অামি।অাই’ল ফিনিশ ইউ!

রিপ্লাই এলো,
—— কেনো অাসবো??? দরকার অাছে অাপনার???
অামার ভেতর ভেঙ্গে গেলো,
লিখলাম,
—-অাসো, কাজ অাছে।

পরেরদিনই বাবা ফোন করলেন,
—-সাবিহা এসেছে….
বাসায় যেতে….
লজ্জায় অামার মাথা কাটা যায় অবস্থা।বাবাকে রাগ দেখিয়ে বললাম,
—–অামি অাসতে পারবো না। ছুটি নেই।সাবিহাকে চলে যেতে বলো!

কিন্তু ঠিকই রাতের ট্রেনেই বাসায় রওনা হলাম।

এর মাঝে সাবিহা ছোট্ট মেসেজ করলো,
“পরীক্ষা ফেলে এসেছি তো, দুদিন থেকেই চলে যাবো”

টেক্সট পড়ে অামি মনে মনে হাসলাম। দুদিন কেনো সোনা? তোমায় অামি কেমন অাটকাচ্ছি দেখোনা????

(গল্পের বাকী অংশ কাল)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here