গল্প – অতঃপর তুমি আমি
রেশমী রফিক
পর্ব – ১১
কনফারেন্স রুমের প্রজেক্টর রেডি হচ্ছে। স্টাফরা সবাই টেবিলের এপাশ-ওপাশে সারিবদ্ধভাবে বসে আছে। এমডি আর দুইজন ডিরেক্টরও উপস্থিত আছেন। প্রত্যেকের সামনে তাদের পারসোনাল ল্যাপটপ। তাতে বুঁদ হয়ে আছে সবাই। আজকের মিটিং আর প্রেজেন্টেশনের সফট কপি তাদের প্রত্যেকের কাছে বিলি করা হয়েছে। সেটাই মনোযোগ দিয়ে দেখছে তারা। অথচ বুঁদ হবার কথা শুধুমাত্র জুনায়েদের। আজকের এই মিটিংয়ে তার প্রেজেন্টেশনটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটার উপর একটা বড়সড় ডিলের ভবিষ্যত নির্ভর করছে। এজন্য গত দুইটা সপ্তাহ ধরে নাকেমুখে কাজ করেছে সে। মিটিংয়ের এজেন্ডা আর প্রেজেন্টেশনের স্লাইডগুলো তৈরি করেছে। সেগুলোর সফট কপি সংশ্লিষ্ট সবাইকে ইমেইল করে পাঠিয়েছে। এবং বাড়তি কিছু কপি প্রিন্ট করে রেখেছে, যদি বা কারো দরকার হয়। এই মুহূর্তে সবথেকে বেশি মনোযোগী হওয়া উচিত তার। সে ল্যাপটপের স্ক্রিণের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ঠিকই, কিন্তু মনোযোগ দিতে পারছে না। কারণ, তার পকেটে মোবাইলটা অনেকক্ষণ যাবত ভাইব্রেট করছে জোরেশোরে। এভাবে একনাগাড়ে কল দেয়ার মতো মানুষ একজনই, পিউ। তারছিঁড়া মানুষ সে। একবার কল করতে শুরু করলে কমসে কম আধঘন্টা চলতেই থাকে, যতক্ষণ না কলটা রিসিভ হয়। সময়-অসময় কিছুই তার ধাতে আসে না তখন। একবার বুঝতে চেষ্টা করে না, যাকে কল করা হচ্ছে সে ব্যস্ত থাকতে পারে। কল রিসিভ করার মতো পরিস্থিতি নাও থাকতে পারে তার। তাকে বারবার সে নিষেধ করেছে যেন অফিস টাইমে কখনো কল না করে। নতুন অফিসে কাজের খুব চাপ। ঘাড়ের উপর সিসিটিভি ক্যামেরা আছে প্রতিটা কেবিনে। সেইসব ক্যামেরা সর্বক্ষণ মনিটরিং করা হয় হেড অফিস থেকে। এবং এই কাজটি করেন স্বয়ং এমডি। আর কোনো কাজ তাকে কখনো করতে দেখেনি জুনায়েদ। সমস্ত কাজের নির্দেশনা দিয়ে রাখেন পিএসকে। পিএস-ই সব কাজ করে। তিনি কেবল মনিটরিং করেন কোথায় কী হচ্ছে। এমনিতেও অফিসের নিয়মকানুন বেশ কড়া। একটু ঘাড় ফেরাবার উপায় নেই। ক্লকইন করার পর থেকে ক্লকআউট পর্যন্ত শিরদাঁড়া সোজা করে রাখতে হয়। আর নতুনদের অবস্থা আরো খারাপ। পারলে তাদের উপর সমস্ত কাজ চাপিয়ে দেয়। এগুলো পিউকে বুঝানো যায় না। বুঝালেও সে বুঝতে চায় না। অবুঝের মতো আচরণ করে। অনেক সময় দেখা যায়, তাকে বুঝাতে গিয়ে মেজাজ খারাপ হয়ে গেছে। এজন্য আজকাল আর বুঝাতে যায় না ওকে। মোবাইলটা সাইলেন্ট করে রাখে। এমনকি ভাইব্রেশনটাও অফ করে দেয়। তারপর যত খুশি কল আসুক, কোনো সমস্যা নেই। ক্লকআউট করার পর গাড়িতে বসে সবগুলো মিসড কল আর মেসেজ চেক করে। যেহেতু বাসায় ফেরার সময় তখন, তাই আর কলব্যাক করে না বা মেসেজের রিপ্লাই দেয় না।
যাকগে ওসব কথা। আজ মোবাইলটা সাইলেন্ট করলেও ভাইব্রেশন অফ করেনি। ফলাফলে, এখন চুড়ান্ত সময়ে পকেট কাঁপাকাঁপি শুরু হয়ে গিয়েছে। চোখ ল্যাপটপের স্ক্রিণে থাকলেও মানসিক প্রস্তুতি নিতে পারছে না। পাশে বসে আছে এলিজা। জুনায়েদের পানসে চেহারা দেখেই কিছু একটা বুঝল সে। ফিসফিস করে বলল,
– কী খবর, জুনায়েদ? প্রিপারেশন কেমন? অল ডান?
– আর প্রিপারেশন!
– কেন? কী হয়েছে? সবকিছু ঠিকঠাক আছে তো?
– কিচ্ছু ঠিক নেই।
– মানে?
– মানে আমার বউ কল দিয়েছে।
– সো, প্রবলেমটা কোথায়? বউ তো কল দিতেই পারে।
– প্রবলেম হচ্ছে, বউ লাগাতার কল দিয়েই যাচ্ছে। অথচ এই মুহূর্তে কল রিসিভ করা সম্ভব না।
– কিন্তু রিসিভ করতে হবে। নইলে প্রেজেন্টেশনের কী হবে?
– বুঝতে পারছি না। এমডি স্যার এখানে না থাকলে মোবাইলটা পকেট থেকে বের করে অফ করে দিতাম।
– আমি তো আমারটা সেই কখন অফ করে দিয়েছি। ব্যাগে আছে।
– আমি অফ করিনি। ভুল করেও মনে হয়নি এই সময়ে আমার বউ কল করতে পারে।
– হয়তো আর্জেন্ট কিছু।
– আমার বউয়ের কল করতে আর্জেন্ট কারণ লাগে না। একটু মন খারাপ, ব্যস আমাকে কল করে। একটু মাথাব্যাথা, আমাকে কল করতে হবে। কোনোকিছু খুঁজে পাচ্ছে না, তখন আমাকে কল করতে হবে।
মুচকি হাসল এলিজা। বলল,
– ইউর ওয়াইফ ইজ অ্যা কিউটি পাই।
– অ্যা মাংকি টু! আমার লাইফ ত্যানা ত্যানা করে ফেলল এই মেয়ে।
– বেটার তুমি এখন কলটা রিসিভ করো। প্রেজেন্টেশন শুরু হয়ে যাবে এখনই। কল রিসিভ করে জাস্ট বলো যে ঘন্টাখানেক পর তুমি কলব্যাক করবে। তারপর মোবাইল অফ করে দাও।
– এখন? কল রিসিভ করব?
– বাইরে গিয়ে রিসিভ করো। এখানে না।
– থাক। এখন বাইরে গেলে এমডি স্যার খেয়াল করবেন।
– কাম অন, জুনায়েদ। যাও!
“এক্সকিউজ মি” বলে উঠে দাঁড়াল জুনায়েদ। এমডি ওর দিকে তাকাতেই বলল,
– আইল বি ব্যাক ইন টু মিনিটস।
এমডি বললেন,
– বাট দ্য মিটিং ইজ অ্যাবাউট টু বিগিন!
– ইয়েস স্যার, আইল বি ইন অ্যা মিনিট।
– ইজ দেয়ার এনিথিং আর্জেন্ট?
– ওয়াশরুম, স্যার!
কয়েক মুহূর্ত বিচিত্র ভঙ্গিতে তাকিয়ে রইলেন এমডি। তারপর বললেন,
– হারি আপ। অ্যাম গনা স্টার্ট দ্য মিটিং অ্যান্ড ইউর টাইম ইজ আপ, হোয়েন ইউ উইল গেট ইন।
– শিউর স্যার।
প্রায় দৌড়ে কনফারেন্স রুম থেকে বের হলো জুনায়েদ। ততক্ষণে রিং বেজে লাইন কেটে গিয়েছে। সে মোবাইল চেক করে দেখল, পিউ কয়েকবার কল করেছে লাঞ্চ টাইমে। এরপর মেসেজ পাঠিয়েছে। কিন্তু সর্বশেষ কলটা করেছে অন্য কেউ। নাম্বার দেখা যাচ্ছে না। কললিস্টে প্রায় দশ-বারোটার মতো “প্রাইভেট নাম্বার”! তবে কী পিউ নাম্বার হাইড করে কল করেছে? নাকি অন্য কেউ? আরো একবার রিং বাজতেই ঝট করে কল রিসিভ করল জুনায়েদ। চোখেমুখে স্পষ্ট বিরক্তির ছাপ। এটা যদি পিউ হয়, তাহলে ওর খবর আছে। ভালোরকমের খবর আছে! বেশ কড়া সুরে “হ্যালো” বলল সে। পরমুহূর্তেই চেহারা পালটে গেল। বিরক্তি সরে গিয়ে চেহারায় ভর কর একরাশ হতবিহ্বলতা। কী শুনছে সে এসব? সত্যি নাকি স্বপ্ন? এলিজা ততক্ষণে বাইরে চলে এসেছে। মিনিটখানেক বা মিনিট দুয়েকের কথা বলে এসেছে জুনায়েদ। এখন তিন মিনিট হয়ে গেছে। এমডি ওকে ডেকে পাঠিয়েছেন জরুরী ভিত্তিতে। জুনায়েদ কোনোরকমে এলিজাকে বলতে পারল,
– আই হ্যাভ টু গো, এলি। প্লিজ!
তারপরই উর্ধ্বশ্বাসে দৌড় দিল অফিসের গেটের দিকে। পেছনে রেখে গেল হতভম্ব এলিজা আর কনফারেন্স রুমে তার প্রেজেন্টেশনের অপেক্ষায় থাকা জনা দশেক কর্মকর্তা আর ম্যানেজিং ডিরেক্টরকে। কীভাবে এবং কতক্ষণে ড্রাইভ করে হাসপাতালে পৌঁছুল, কোনো খেয়াল নেই তার। রাস্তায় কম করে হলেও তিনটা সিগন্যাল অমান্য করেছে। স্পিড লিমিট পেরিয়ে গেছে শুরুতেই। রাউন্ডঅ্যাবাউট পার হবার সময় সিরিয়াল মেইনটেইন করেনি। পুলিশ কার পিছু নিয়েছে। পেছন থেকে সাইরেন বাজাচ্ছে। গাড়ি থামাবার নির্দেশ দিচ্ছে বারবার। কোনো হুঁশ নেই ওর। তার কানে বাজছে ফোনের কথাগুলো। ফোনটা পুলিশই করেছিল। জানিয়েছে, পিউ সুইসাইড করেছে। তাকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় হাসপাতালে নেয়া হয়েছে। ব্যস এতটুকুই। পুলিশ আরো কিছু বলেছিল ওকে। সে শোনেনি। কানে শুধুমাত্র হাসপাতালের নামটা ঢুকেছে। পেছনে তাড়া করা পুলিশের গাড়িকে অগ্রাহ্য করেই সে হাসপাতালের দিকে ছুটল। ততক্ষণে আরেকটা পুলিশ পেট্রল কার উল্টোদিক থেকে তাড়া করেছে। কিন্তু জুনায়েদ সাঁই করে সেটাকে পাশ কাটিয়ে হাসপাতালের কম্পাউন্ডের ভেতর ঢুকল। গাড়িটা নিয়ে গেল হাসপাতালের মেইন ডোর বরাবর। বায়ে রেখে গেল পার্কিং। এই মুহূর্তে ধীরেসুস্থে গাড়ি পার্ক করার মতো অবস্থায় নেই সে। তাছাড়া পেছনে পুলিশের গাড়িও চলে এসেছে। গাড়িটা পার্ক করার ব্যবস্থা তারাই করুক!
প্রথমে ইমারজেন্সিতে গিয়ে খোঁজ নিল সে। তারপর আইসিইউতে গেল। পিউকে ওখানেই রাখা হয়েছে। তাকে নিয়ে যমে-মানুষে টানাহেঁচড়া চলছে। প্রচুর রক্ত বেরিয়ে গেছে শরীর থেকে। একজন অফিসার দাঁড়িয়ে ছিলেন আইসিইউয়ের বাইরে। পাশে প্রতিবেশি অ্যান্ডি আর তার স্ত্রী। তাদের কাছ থেকেই জানা গেল, বাগানের দোলনায় বসে হাত কেঁটেছে পিউ। ডান হাতের কবজিতে দুটো রগ কেঁটে গিয়েছে। অ্যান্ডি তখন বাগানের গাছগুলোয় পানি দিচ্ছিল। বেড়ার ফাঁক দিয়ে আচমকাই সে দেখতে পায়, বেকায়দা অবস্থায় দোলনায় শুয়ে আছে পিউ। দেখার পর কৌতুহল জাগে। বেশ কবার পিউকে ডাকে সে। তার ডাক শুনে বাড়ির ভেতর থেকে তার স্ত্রী চলে এসেছিল। অথচ পিউয়ের কোনো নড়চড় নেই। অ্যান্ডির স্ত্রী-ই প্রথম লক্ষ করেছিল পিউয়ের হাতে রক্ত। দোলনার কিছু অংশ আর বাগানের মাটিতেও রক্ত। কী ঘটেছে অনুমান করতে পেরে এক মুহূর্তে দেরি করেনি ওরা। নাইন-নাইন-নাইনে কল করেছিল। প্রথমে অ্যাম্বুলেন্স এসেছে, তারপর দুই মিনিট পর পুলিশ। পিউয়ের বাড়ির দরজা খুলতে না পেরে অ্যান্ডির বাড়ির বাগানের বেড়া টপকে ওপাশে গিয়েছে অ্যাম্বুলেন্স স্টাফ।
সবটা শোনার পর জুনায়েদের মাথা ঘুরতে লাগল বনবন করে। পিউ কেন সুইসাইড করতে গেল, সেটা তার বোধগম্য হচ্ছে না। ওদের মধ্যে এমন কিছু ঘটেনি, যার কারণে এরকম কিছু ঘটবে। কোনোরকম মনোমালিন্য ছিল না। কোনো ঝগড়া-বিবাদও নয়। বরং ইদানীং পিউয়ের ইচ্ছে বা মতামতকেই বেশি প্রাধান্য দেয় সে। যখন যা করতে চায়, কখনো নিষেধ করে না। এমনকি পিউয়ের মেন্টাল ট্রিটমেন্টের রিপোর্টও ভালো এসেছে। গত সপ্তাহে সাইকোলজিস্ট বলেছেন, পিউয়ের শরীর আর মনের বয়স অনেকটাই কাছাকাছি চলে এসেছে। জুনায়েদের চোখেও ধরা পড়েছে সেটা। আগে পিউ সংসার সম্পর্কে উদাসীন ছিল। এখন মনোযোগ দিয়েছে। প্রায়দিনই নিজ থেকে কিছু না কিছু রান্না করার চেষ্টা করে। ঘরদোর গোছায়, নিজ থেকেই এটা-সেটা করে। প্রতি মাসের বাজারের লিস্ট তৈরি করে। এরপর নিজেই সুপার মার্কেটে গিয়ে শপিং করে আনে। কখনোবা অনলাইনে অর্ডার করে আজদা বা টেসকো থেকে। ডেলিভারিম্যান এলে সেগুলো নিজ দায়িত্বে বুঝে নেয়। রান্নাঘরের জিনিসপত্র নিজেই সাজিয়ে রাখে। কখনোবা উনিশ-বিশ হয়, ভুল হয়। জুনায়েদ তা নিয়ে টু শব্দ করে না। ভুল করুক, ভুল করেই শিখুক। কিন্তু হুট করে কী থেকে কী হয়ে গেল? গতকাল অবশ্য পিউকে আপসেট লাগছিল। অকারণে মন খারাপ করছিল, কান্নাকাটি করছিল। সকালে ওকে বাগানের দোলনায় ঘুমন্ত দেখে এসেছে। কম্বলমুড়ি দিয়ে, আরাম করে ঘুমুচ্ছিল তখন। তারপর নাশতা বানিয়ে, অফিসের জন্য রেডি হয়ে, ওর জন্য একটা নোট লিখে রেখে এসেছে। আজ অফিস থেকে তাড়াতাড়ি ফেরার কথা ছিল, পিউ কথা বলতে চাচ্ছিল বলে। এই নিয়ে সকাল সাড়ে দশটার দিকে পিউ মেসেজও পাঠিয়েছে। জিজ্ঞেস করেছিল, কখন ফিরবে অফিস থেকে। সেই অনুযায়ী অফিসে বলে রেখেছে, প্রেজেন্টেশনের পরেই সে বাসায় ফিরবে। এর মধ্যে আচমকা কী ঘটল? দুই হাতে মাথা চেপে ধরে আইসিইউয়ের সামনেই ফ্লোরে বসে পড়ল জুনায়েদ। ঠিক তখনই দুজন অফিসার এসে ওর হাত পিছমোড়া করে হ্যান্ডকাফ লাগাল। বলল,
– ইউ হ্যাভ টু গো উইথ আস। (চলবে)