অতঃপর তুমি আমি পর্ব ১০

গল্প – অতঃপর তুমি আমি
রেশমী রফিক
পর্ব – ১০
নির্দিষ্ট স্টপে বাস থামতেই পিউ নেমে পড়ল। ব্যস্ত ভঙ্গিতে পা বাড়াল জুনায়েদের অফিসের দিকে। লাঞ্চটাইমের আর মাত্র দশ মিনিট বাকি। এই সময়ে জুনায়েদ তার কেবিনে থাকবে কীনা সন্দেহ। চাইলে এর মধ্যেই একবার দেখে আসা যায় ওকে। কিন্তু ভয় হচ্ছে, যদি কোনোভাবে টের পেয়ে যায় জুনায়েদ। দোনোমনার মাঝেই লিফটে ঢুকল পিউ। উল্টাদিকে মুখ করে দাঁড়াল। অফিস বিল্ডিংটা চৌদ্দ তলা উঁচু। জুনায়েদের অফিস আট তলায়। মূল বিল্ডিংয়ের বাইরে একপাশের দেয়ালের সাথে লাগানো এই লিফট। তিনপাশ কাচ দিয়ে ঘেরা, তাই এখান থেকে বাইরের দিকটা দেখা যায় স্পষ্টভাবে। লিফট যতই উপরে উঠে, ততই শহরের অনেকখানি ধরা পড়ে দৃষ্টির সীমানায়। আনমনে সেদিকেই তাকিয়ে ছিল পিউ। হঠাৎ ওর চোখ গেল নিচের দিকে। ওদিকটায় বিশাল এলাকা জুড়ে পার্কিংয়ের ব্যবস্থা। এই বিল্ডিংয়ে যারা কাজ করে, সব স্টাফদের গাড়ি এখানেই পার্ক করে। পিউয়ের দৃষ্টি নিবদ্ধ একটা গাড়ির উপর। দূর থেকেও সে চিনতে পারল, গাড়িটা জুনায়েদের। পাশে জুনায়েদ আর একটা মেয়েকে দেখা যাচ্ছে। তাকে চেনে সে। এলিজা, জুনায়েদের কলিগ। কয়েকমাস আগে অফিসের একটা পার্টিতে সস্ত্রীক নিমন্ত্রণ ছিল। সেদিন অন্যসব কলিগদের মাঝে এই মেয়েটার সাথেও পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল জুনায়েদ। লিফট থেমে থেমে উপরদিকে এগোচ্ছে। লাঞ্চটাইম বলে সবাই যার যার অফিস থেকে বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে। বিল্ডিংয়ের একদম উপরতলায় দুইটা ফ্লোর মিলিয়ে একটা ফুড কোর্ট। বেশিরভাগ মানুষ সেখানে যাবার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। তাই প্রতিটা ফ্লোরে লিফট থামছে কিছু সময়ের জন্য। লিফটের ভেতর থেকেই পিউ স্পষ্ট দেখল, জুনায়েদ আর এলিজা কথা বলছে হাসিমুখে। জুনায়েদ মাথা ঝাঁকিয়ে কিছু একটা বলছে। আর এলিজা হাসতে হাসতে অস্থির হয়ে যাচ্ছে। জুনায়েদের মুখেও হাসি। পিউয়ের অভিমান হলো খুব। প্রায় অনেকদিন হলো, এমন হাসিমুখে ওর সাথে কথা বলে না জুনায়েদ। বাসায় পা দেয়ামাত্রই তার মুখ কালো হয়ে যায়। গম্ভীর মুখে বাসার কাজকর্ম করে। ভালোভাবে একটু কথাও বলতে চায় না। ওরা দুজনই গাড়িতে বসল। কোথাও যাচ্ছে বোধহয়। কিন্তু কোথায়? একসাথে লাঞ্চ করতে? হয়তো বাইরের কোনো একটা রেস্টুরেন্টে যাচ্ছে। কাছেই তো ম্যাকডোনাল্ডস আর কেএফসি আছে। আবার অন্য কোথাও যেতে পারে। গাড়িটা এবারে পার্কিং থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। পিউয়ের মনে হলো, গাড়ির ভেতরেও দুজন কথা বলছে হেসে-হেসে। এবার চোখজোড়া ঝাপসা হলো ওর। ওকে সাথে নিয়ে যখন ড্রাইভ করে জুনায়েদ, তখন এমন করে হাসে না। সাধারণ একটা কথা বললেও বিরক্ত হয়। কপাল কুঁচকে রাখে। অথচ এখন কী সুন্দর হাসিমুখে কথা বলছে এলিজার সাথে!
লিফট ততক্ষণে আটতলায় পৌঁছে গিয়েছে। পিউয়ের পাজোড়া চলছে না, তবু সে নিজেকে টেনে নিল লিফটের বাইরে। জুনায়েদ অফিসে নেই জেনেও সেদিকে পা বাড়াল। রিসিপশনে গিয়ে জুনায়েদের খোঁজ করল। সেখান থেকে জানানো হলো, ঘন্টাখানেকের জন্য বাইরে গিয়েছে জুনায়েদ। লাঞ্চটাইমের পর এলে তাকে অফিসে পাওয়া যাবে। শুনে আর দাঁড়াল না সে। দ্রুত বেরিয়ে এলো অফিস থেকে। আবারও সেই একই লিফট! সেটায় পিউ একা। বুকের ভেতর হাতুড়ি পেটার শব্দ হচ্ছে। অসহনীয় একটা কষ্ট কলিজা ফুঁড়ে বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে। কান্নাগুলো গলায় কাছটায় আটকে আছে। চোখভর্তি টলমল করছে পানি। পিউ আপ্রাণ চেষ্টা করছে কষ্টগুলো উগরে দিতে। কিন্তু পারছে না। অদৃশ্য কিছুতে যেন আটকে আছে। সুযোগও মিলল না তেমন করে। লিফট নিচে নামতেই দুই-একজন করে উঠানামা করতে লাগল। আর লিফটও যেন রকেটের গতিতে নিচে নামছে!
অফিস বিল্ডিং থেকে বেরিয়ে সোজা বাস স্টপের দিকে এগোল পিউ। ততক্ষণে চোখ উপচে নোনা পানি পড়তে শুরু করেছে অবিরাম। মন কিছুতেই মানতে পারছে না, জুনায়েদ মিথ্যে বলতে শুরু করেছে। একটা সময় ছিল, যখন মিথ্যে কথা একদম শুনতেই পারত না সে। মিথ্যে কথা শোনামাত্রই ক্ষেপে বোম্ব হতো। এখন সে দিনের পর দিন অনর্গল মিথ্যে বলে যাচ্ছে। তার অফিসে কাজের অনেক চাপ। এজন্য কাজের ফাঁকে একটাবার কল করার সময় পায় না। প্রায়দিনই রাত দশটার পর বাড়ি ফেরে ওভারটাইমের বাহানায়। কখনোবা আগে ফিরলেও অফিসের কাজের বাহানায় ল্যাপটপ নিয়ে ব্যস্ত থাকে। পিউ চেষ্টা করেছে জানতে, কেন এই অবজ্ঞা আর অবহেলা। জুনায়েদ নানা ধরনের অজুহাত দিয়েছে কিন্তু সত্যিটা ভুল করেও মুখে আনেনি। আজ সত্যিটা জানা হয়ে গেল। এজন্যই কী ডিভোর্স ক্যানসেল করতে এত আপত্তি ছিল জুনায়েদের? ডিভোর্স ক্যানসেল করার আগে সে বারবার বলেছিল আরেকটু চিন্তাভাবনা করতে। বয়স আর মনমানসিকতার পার্থক্য দেখিয়ে কীসব ফালতু যুক্তি শোনাচ্ছিল। আচ্ছা, এলিজার সাথে কী আরো আগে থেকেই পরিচয় জুনায়েদের? হতেও পারে।
কষ্ট হচ্ছে পিউয়ের, খুব কষ্ট। এত কষ্ট কখনো পায়নি। কোনোদিনও পায়নি। হলফ করে বলতে পারবে সে। আজ স্বচক্ষে যা কিছু দেখল, আপাতদৃষ্টিতে এই দেখাটুকু তেমন কিছুই না। কিন্তু এটুকুই ওকে জানিয়ে দিল জুনায়েদের মনের খবর, তার না বলা কিছু কথা। কথাগুলো অব্যক্ত রয়ে যাওয়াতেই রক্ষা! নয়তো কষ্ট আরো বেশি হতো। অতীতে অনেক কষ্ট পেয়েছে সে। আর দশটা মেয়ের মতো রাজকন্যা হয়ে বাবার ঘরে জন্ম নিলেও ভাগ্য তার জন্য অন্যকিছু লিখে রেখেছিল। সেই ভাগ্যকে খন্ডানো যায়নি। এক এক করে অনেকগুলো কষ্ট জমা হয়েছে ওর ঝুলিতে। কিন্তু আজকের এই কষ্টটা সেসবের থেকে একদমই আলাদা। অতীতের সমস্ত কষ্টগুলোকে ছাপিয়ে গেছে আজকেরটা। এটুকুর জন্যই বোধহয় অবচেতন মন তাকে টেনে নিয়ে এসেছিল এখানে! নইলে কেন সে ক্লাস ফেলে এভাবে ছুটে আসবে? আগে কখনো তো এমন হয়নি। ক্লাস বাংক করেছে অনেকবার। বন্ধুবান্ধবদের সাথে আড্ডা দিয়েছে। কিন্তু কখনো জুনায়েদের অফিসে ছুটে আসতে মন চায়নি। কতদিন এমনও গিয়েছে, সকালে জুনায়েদের সাথে দেখা হয়নি। মন খারাপ হয়েছে তখন কিন্তু এভাবে উচাটন হয়নি। আজ কেন হলো?
বাসায় ফিরে বেশ কয়েকবার জুনায়েদকে কল করল পিউ। কল রিসিভ হলো না, এমনকি কোনো মেসেজও আসলো না। এমনটাই হবার ছিল কারণ, জুনায়েদ এখন এলিজাকে নিয়ে ব্যস্ত। লাঞ্চটাইম শেষ হয়েছে এতক্ষণে। দুজন অফিসে ফিরেছে হয়তো। তবু নিজেদের ব্যস্ততা শেষ হয়নি। পাশাপাশি কেবিন তাদের। কাচের ফাঁক গলে পরস্পরকে এমনিতেই দেখতে পারে ওরা। কাজের অজুহাতে কাছাকাছিও আসতে পারে। এসময় তাদের দুজনের জগতে আর কারো প্রবেশাধিকার নেই। জুনায়েদের সমস্ত চাহিদা মেটায় এলিজা, সেকারণেই স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কে শীতলতা এসেছে। এখন আর আগের মতো উত্তাল ভালোবাসাবাসি চলে না। কালে-ভদ্রে দুটো শরীর এক হয়। কিন্তু তাতে যতখানি ভালোবাসা মেশানো থাকে, তার থেকে বেশি থাকে অভ্যেস আর প্রয়োজন।
পিউ বাগানে গিয়ে দোলনায় বসল। পুরোটা রাস্তা সে কেঁদেছে। একদম পেছনের সিটে গিয়ে বসেছিল এক কোণে। গাল বেয়ে নোনা পানির বন্যা বয়ে গেছে। সে আটকাবার কোনো চেষ্টাই করেনি। বাসের অন্যসব প্যাসেঞ্জারগুলো হতবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল তার দিকে। অতি কৌতুহলী কয়েকজন সমবেদনার সুরে জিজ্ঞেস করেছে, “হোয়াট হ্যাপেন্ড ডিয়ার? ইজ দেয়ার এভ্রিথিং ওকে? আর ইউ অলরাইট?” সে পাত্তা দেয়নি ওদের। তারাও উত্তর না পেয়ে নিজেদের জগতে ডুবে গেছে। তবে এক মধ্যবয়সী স্কটিশ মহিলা হাল ছাড়েননি। নিজের সিট থেকে উঠে এসে ওর পাশে বসেছিলেন। কিছু জিজ্ঞেস করেননি, শুধু ওর হাতটা ধরে রেখেছিলেন যতক্ষণ বাসে ছিলেন। ওর মাথাটা জোর করে টেনে নিয়েছিলেন নিজের কাঁধে। গন্তব্য চলে এলে বাস থেকে নেমে যাবার আগে গালে হাত রেখে বলেছিলেন, “আ ডোন্ট নো দ্য রিজন, ডোন্ট ওয়ান্ট টু নো। ইউ জাস্ট মেড মি রিমেম্বারড মাই ডটার, হোম আ লস্ট ফিউ ইয়ারস এগো। শি ওয়াজ ক্রাইং জাস্ট লাইক ইউ দ্যান! গড ব্লেস ইউ, ডিয়ার”। পিউ তখন কান্না থামিয়ে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল মহিলার দিকে। মহিলার চোখের দিকে তাকিয়ে তার আচমকাই মনে পড়ে গিয়েছিল আম্মুর কথা। আম্মুও কী কাউকে এভাবে বলে, আই লস্ট মাই ডটার ফিউ ইয়ারস এগো? মহিলার চোখে ঠিক একইরকম কান্নার আভাস দেখেছে সে, যেমনটা দেখত আম্মুর চোখে। ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করেছিল, হোয়্যার ইজ ইউর ডটার নাউ? ডিডন্ট ইউ ফাইন্ড হার ব্যাক? মহিলা বিষন্ন ভঙ্গিতে উত্তর দিয়েছিলেন, শি ইজ নো মোর।
মহিলা এরপর বাস থেকে নেমে গিয়েছেন। পিউয়ের গন্তব্য আরো কয়েকটা স্টপ সামনে। ততটুকু পথ আর কাঁদেনি সে। কান্নাটা যেন হুট করে থমকে গিয়েছে। তখন থেকেই বারবার মনে পড়ছে আব্বু-আম্মুর কথা। খুব জানতে ইচ্ছে করছে, তারাও কী এভাবে বিষন্নতা মাখা সুরে কাউকে বলে, আমাদের বাবুনী হারিয়ে গেছে, আমরা হারিয়ে ফেলেছি আমাদের মেয়েকে? খুব মনে পড়ছে পুরনো দিনগুলোর কথা। সোনালী শৈশব আর কৈশোরের স্মৃতিগুলো চোখের সামনে ভাসছে। সেই স্মৃতির একটা অংশে জুনায়েদও আছে। কৈশোরের মাঝামাঝিতেই জুনায়েদ এসেছিল তার জীবনে। সেই থেকে একসাথে পথ চলা ওদের। মাঝে কয়েক মাসের জন্য আলাদা হলেও আবার এক হয়েছিল দুজন। প্রতিজ্ঞা করেছিল সারাজীবন পাশাপাশি চলার। কোথায় গেল সেই প্রতিজ্ঞা? জুনায়েদের জীবনে এখন সে অনাকাংক্ষিত! মন বলছে, জুনায়েদ কখনোই ওকে ভালোবাসেনি। কখনোই বউ হিসেবে মেনে নেয়নি। প্রথম বিয়েটা ছিল জোরজবরদস্তির, পরেরটায় ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইলের শিকার হয়েছিল সে। তারই জের ধরে ওকে নিয়ে এসেছে এই দেশে। বউ হিসেবে মর্যাদা দিয়েছে। কিন্তু মন থেকে মানতে পারেনি। হয়তো এতগুলো দিন ধরে এই সম্পর্কটা বয়ে বেড়াতে গিয়ে হাঁপিয়ে উঠেছে। তাই ডিভোর্সের নোটিশ পেয়েও আপত্তি করেনি। উলটো লোকচক্ষুর আড়ালে চলে গিয়েছিল। ডিভোর্সের ঝামেলা মিটিয়ে নতুন কাউকে নিয়ে জীবন শুরু করতে চেয়েছিল আবার। তাতেও জল ঢেলেছে পিউ। আরো একবার জোরজবরদস্তি করে জুনায়েদের সাথে থেকে গেছে। একবারও মনে হয়নি, জুনায়েদ এখন মুক্তি চাচ্ছে ওর থেকে। ক্রিসের কথাই ঠিক ছিল তাহলে! তখন যদি একবারও মাথায় ঢুকত এই সহজ সমীকরণ, তাহলে আর আজকে এসব দেখতে হতো না। জুনায়েদের পাশে অন্য কাউকে দেখাটা ওর জন্য মৃত্যুর শামিল।
মুখ তুলে বাড়িটার দিকে তাকাল পিউ। বাড়িটা জুনায়েদ ওর নামে কিনেছিল। বলেছিল, “আমি অতটা বড়লোক না। খেঁটে খাওয়া মানুষ। তাই বিয়ের সময় দামি গয়না, শাড়ি আর বিয়ের গিফট দিতে পারি নাই। এজন্য বাড়িটা তোমার নামে কিনলাম। তোমার বিয়ের গিফট এটা। যতদিন বাঁচব, আমার সারাজীবনের ইনকাম থেকে একটু একটু করে এই বাড়িটার কিস্তি শোধ করব।” বাড়িটা দেখে সে খুশি হয়েছিল খুব। তার নিজের এমন একটা বাড়ির শখ ছিল অনেক আগে থেকেই। গ্রামে জুনায়েদের দাদার যে বাড়িটায় ওরা থাকত, সেই বাড়িটায় সারাজীবন থাকার আবদার করেছিল। কিন্তু জুনায়েদ তো বাংলাদেশেই থাকবে না। তাই ওখানে আর থাকা হয়নি। এই দেশে কৃত্রিমতার মাঝখানে আধুনিক ফ্ল্যাটগুলোর মধ্যে কেমন দমবন্ধ হয়ে আসত ওর। জুনায়েদ বুঝত ওর মনটাকে। এজন্যই হয়তো বাড়িটা কিনেছিল অনেক দেন-দরবার করে। অন্তত এতদিন এরকমই ভেবেছিল সে। আজ কেন যেন মনে হলো, জুনায়েদ তার অতীতের কৃতকর্মের জন্য এখনো অপরাধী ভাবে নিজেকে। আর এই অপরাধবোধ থেকেই বাড়িটা কিনেছে এক ধরনের ক্ষতিপূরণ বাবদ। ওর আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেই তার নিজের সঞ্চয়গুলো রেখেছে ওর ব্যাংক অ্যাকাউন্টে। কারণ জিজ্ঞেস করায় বলেছিল, আমার সবকিছুই তোমার। এজন্য সবকিছু তোমার নামেই বরাদ্দ হচ্ছে। থাকুক তোমার কাছেই! সেই মানুষটা একবারও ভাবল না, সে নিজে ওর জীবনে না থাকলে এই বাড়ি-গাড়ি, ব্যাংক ব্যালেন্স দিয়ে কী করবে পিউ? বিয়েটাই যদি না টেকে, তাহলে এই বিয়ের গিফট দিয়ে কী করবে?
পিউয়ের আবারো কান্না পাচ্ছে। ভেতরটা ভেঙ্গে চুরমার করে বেরিয়ে আসছে চাচ্ছে কান্নাটা। এবারে সে কান্নাটা চেপে রাখল। ভাবতে চেষ্টা করল কী করা উচিত এখন। জুনায়েদ ফিরলে তার সাথে চিৎকার-চেঁচামেচি করবে? তাকে বের করে দেবে বাড়ি থেকে? তাহলে তো এই বাড়িতে একাই পচে মরতে হবে ওকে। নাকি নিজেই চলে যাবে এই বাড়ি ছেড়ে? কিন্তু কার কাছে যাবে? বাংলাদেশে আব্বু-আম্মু সবাইকে ফেলে চলে এসেছে এখানে, শুধুমাত্র জুনায়েদের হাতটা ধরে। সেই হাতটাই যদি ছেড়ে দিতে হয়! যাই করুক, তার কাছে জুনায়েদবিহীন জীবন মানেই ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাওয়া। তার চেয়ে বরং মৃত্যুটাই শ্রেয়।
পাশে রাখা বড় ছুরিটা হাতে নিল সে। বাগানে আসার সময় রান্নাঘর থেকে নিয়ে এসেছে এটা। উপরের কাবার্ডে রাখা ছিল। ছুরিটায় অনেক ধার, এজন্য জুনায়েদ কখনো এই ছুরিটা ওকে ধরতে দেয় না। বলে, “তুমি এটা দিয়ে কাঁটাকাঁটি করতে পারবা না। দেখা যাবে, কিছু কাঁটতে গিয়ে তোমার নিজের হাতই কেঁটে ফেলছ!” আজ এই ছুরিটা দিয়ে সত্যিই হাত কাঁটবে সে। জুনায়েদ প্রায়ই বলে, আত্মহত্যা করা মহাপাপ। কিন্তু এই মুহূর্তে ওর মনে হচ্ছে, বিয়ের পর থেকে এই পর্যন্ত ওর কারণে জুনায়েদ যতটা ভুক্তভোগী হয়েছে, যতটা সহ্য করেছে ওর ছেলেমানুষী আর পাগলামীগুলো, সবকিছু উসুল করতে এই মহাপাপটা করাই যায়। তাতে করে অন্তত জুনায়েদের জীবনে জোরজবরদস্তি থাকতে চাইবার প্রায়শ্চিত্ত করা হবে। জুনায়েদকে মুক্ত করে দিতে পারবে সারাজীবনের জন্য। খুব সাবধানে ডান হাতে ছুরিটা ধরে বাম হাতের কব্জিতে ছোঁয়াল সে। খুব কী ব্যাথা পাবে? নাকি কাঁটার সাথে সাথেই অজ্ঞান হয়ে যাবে। অজ্ঞান হলেই ভালো। ব্যাথার কষ্টটা আর হবে না তাহলে। মোবাইলে একবার সময় দেখল। বিকেল পাঁচটা বাজে। জুনায়েদের অফিস ছুটি হয় সাতটায়। কিন্তু সে আরো দেরি করে ফেরে বাসায়। কমসে কম আটটার আগে তো বাসায় পা দেবেই না। তার মানে হাতে দুই থেকে তিন ঘন্টা সময় আছে। ওপারে যেতে কী এই তিন ঘন্টা যথেষ্ট না? (চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here