গল্প – অতঃপর তুমি আমি
রেশমী রফিক
পর্ব – ২
ব্যাংক অ্যাকাউন্ট চেক করতে গিয়ে পিউ লক্ষ করল, জুনায়েদের অ্যাকাউন্ট থেকে কিছু টাকা এসেছে। নোটে লেখাঃ সেমিস্টার ফি। নোট পড়েই চোখজোড়া ঝাপসা হয়ে গেল ওর। গত নয় মাস যাবত জুনায়েদের স্মৃতি নিয়ে একাকী থাকতে হচ্ছে এই বাড়িতে। ল্যাপটপ, মোবাইল আর কিছু ডকুমেন্টস ছাড়া আর সবকিছু ফেলে গেছে জুনায়েদ। তার লইয়ার আর একজন অফিসার এসেছিল। ওরাই ওর জিনিসপত্র নিয়ে গেছে। গাড়িটা পর্যন্ত নেয়নি। ড্রাইভওয়েতে পড়ে আছে আগের মতোই। লইয়ারের মাধ্যমে জুনায়েদ জানিয়েছিল, তার ব্যবহৃত সব জিনিসপত্র যেন ফেলে দেয়া হয়। ওসব তার দরকার নেই। পিউ একটু সুতোও ফেলেনি। জুনায়েদের জামাকাপড়, জিনিসপত্র আগলে রেখেছে। প্রতিদিন জামাকাপড়গুলো গুছিয়েছে নতুন করে। জুনায়েদের জন্য রান্না করেছে ইউটিউব দেখে। বিকেলে দেয়ালঘড়ির দিকে তাকিয়ে সময় গুনেছে এই বুঝি জুনায়েদ ফিরল অফিস থেকে! পুর্ব রুটিন অনুসারে প্রতি শনিবার জুনায়েদের গাড়িটা ঝেড়েমুছে পরিস্কার করেছে। পার্থক্য এখানেই যে, আগে গাড়িটা পরিস্কার করত জুনায়েদ আর এখন সে করে। আবার প্রতি রবিবারে বাগানটা পরিস্কার করে। সপ্তাহের অন্যদিনগুলোতে বাড়ির ভেতরটা তো পরিস্কার করা হয়ই। শুধুমাত্র ভালোলাগার জন্য বা জুনায়েদকে ঘিরে ব্যস্ত থাকতে এসব করে, তা নয়। এই কাজগুলো সে আসলে নিজেকে ভুলিয়ে রাখতে করে। অলসতা পেয়ে বসলেই তো জুনায়েদকে মনে পড়ে খুব। একসময় যার উপর পুরোপুরি নির্ভর ছিল, এখন সেই মানুষটার অনুপস্থিতি খুব ভোগায়। যতটা না ভোগায়, তার থেকেও কষ্ট হয় বেশি। কখনোবা মনকে প্রবোধ দেয়, জুনায়েদ তার জন্য একটা অভ্যাস ছিল। দীর্ঘদিনের অভ্যাসের পরিবর্তন ঘটেছে বলেই হয়তো এতটা কষ্ট হচ্ছে। নতুন জীবনে অভ্যস্ত হয়ে গেলে আর সমস্যা হবে না। কিন্তু মন তা মানতে চায় না। রীতিমতো বিদ্রোহ শুরু করে এই বলে, জুনায়েদকে ছাড়া চলবেই না। জুনায়েদের উপর আরো একবার নির্ভর না করুক, কিন্তু জুনায়েদকে পাশে থাকতেই হবে। জুনায়েদবিহীন একাকী জীবনটা চুড়ান্ত পর্যায়ের নরক যন্ত্রণার শামিল।
সারাদিন নিজেকে ব্যস্ত রাখতে পারলেও রাতের বেলা খুব অসহায় লাগে পিউয়ের। না ঘুমিয়ে কিছুক্ষণ এপাশ-ওপাশ করে খালি বিছানায়, কিছুক্ষণ মুর্তির মতো বসে থাকে। লইয়ারের নিষেধ অমান্য করে গত নয় মাসে অসংখ্যবার কল করেছে জুনায়েদের মোবাইলে। প্রতিবারই নাম্বারটা বন্ধ পেয়েছে। হয়তো নাম্বার পালটে ফেলেছে জুনায়েদ। ইমেইল করেও লাভ হয়নি কোনো। অনেকগুলো লম্বা ইমেলের বদলে একটা ছোট্ট রিপ্লাইও আসেনি। জুনায়েদ যদি এতটুকু লিখত “আমি ভালো আছি”, তবু তো মনকে সান্ত্বনা দিতে পারত। জুনায়েদের দিক থেকে সাড়া বলতে এই সেমিস্টার ফি। এই নিয়ে দুবার পাঠিয়েছে। কেবল পাউন্ড পাঠিয়েই সে খালাস। তার কি একটাবারের জন্যও জানতে ইচ্ছে হয়নি, কেমন আছে তার বউ? একবারও কি মনে প্রশ্ন জাগেনি, যে মেয়েটা কখনো তাকে ছাড়া এক পা সামনে আগায়নি, সেই মেয়েটা নয়টা মাস ধরে কীভাবে চলছে-ফিরছে?
এই মুহূর্তে পিউয়ের ইচ্ছে করছে, ঘুষি মেরে কম্পিউটারের স্ক্রিণ ভেঙ্গে ফেলতে। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে রেখেছে। কারণ, এই কম্পিউটার একবার নষ্ট হলে জুনায়েদের সাথে যোগাযোগের শেষ আশাটুকু নিভে যাবে। এই কম্পিউটার দিয়েই জুনায়েদের ইমেইল আর ফেসবুকে লগইন করতে পারে। ফেসবুক অ্যাকাউন্ট সেই কবে থেকে বেকার পড়ে আছে। সে প্রতিদিন লগইন করে ফেসবুকে। জুনায়েদের ইনবক্সে গিয়ে একেকজনের মেসেজ পড়ে। কখনোবা নিউজফিডে আসা মেমরিগুলো জুনায়েদের টাইমলাইনে শেয়ার করে। একদিন জুনায়েদ সেজে তার আগের অফিসের এক কলিগের সাথে চ্যাটও করেছে কিছুক্ষণ। কলিগটা জিজ্ঞেস করছিল, সে এখন কোথায় থাকে, কোন অফিসে জব করে, স্ত্রীর সাথে স্থায়ীভাবে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে কীনা। জুনায়েদের হয়ে চ্যাট করলেও প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে পারেনি পিউ। কোনোরকমে এটা-সেটা বলে এড়িয়ে গেছে। প্রশ্নগুলোর উত্তর যে তারও জানা দরকার ভীষণ। জুনায়েদের ফেসবুক বন্ধুদের অনেকেই তার সম্পর্কে জানতে ইচ্ছুক। জুনায়েদের আইডির পাশে সবুজ বাতি দেখে অনেকেই নক করে, অনেক কিছু জানতে চায়, অনেকে আবার সান্ত্বনাও দেয়। দুই-একজন আছে, যারা খোঁচাখুঁচির উদ্দেশ্যে মেসেজ পাঠায়, “হোয়াজ আপ ব্রো? কষ্ট করে আয়-রোজগার করেছ নিজে, অথচ বউয়ের নামে বাড়ি কিনেছ, গাড়ি কিনেছ। এমনকি সেভিংসটাও বউয়ের অ্যাকাউন্টে জমা রেখেছ। এখন বউ তোমাকে দিয়েছে লাত্থি। তার নতুন বয়ফ্রেন্ডের সাথে মউজমাস্তি করছে। ডিভোর্সের পর তারা বিয়েও করে ফেলবে হয়তো। আর তুমি বসে বসে আঙ্গুল চুষবে। এজন্যই বলি, বউকে মাথায় তুলে রাখতে নেই। এখন বুঝ ঠেলা?” এই মেসেজগুলো পিউকে কতখানি কষ্ট দেয়, তা বলার বাইরে। থমাসের সাথে বন্ধুত্বের বাইরে আর কোনো সম্পর্ক নেই। তবু যাচ্ছেতাই বলে বেড়াচ্ছে মানুষ। বাঙ্গালী কম্যুনিটিতে গসিপ চলছে। সবার মুখে এক বুলি, “বউকে পড়াশুনা করিয়ে শিক্ষিত করতে নেই। তার পরিণাম কী হয়, সেটা জুনায়েদকে দেখে শিখো!” কী জঘন্য এইসব মানুষগুলো! কী জঘন্য তাদের চিন্তাধারা! এই মানুষগুলোর সাথে একটা সময়ে খুব দহরম-মহরম ছিল, গলায় গলায় ভাব ছিল, ভাবতেই গা গুলিয়ে উঠে পিউয়ের। রীতিমতো অসুস্থবোধ করে সে। অবশ্য কিছু কিছু ক্ষেত্রে এই মানুষগুলোর চিন্তাধারাই ঠিক। আসলেই পড়াশুনার কোনো দরকার ছিল না। বাংলাদেশ থেকে আসার পর জিসিএসই-জিএসই পর্যন্ত পড়েছিল, অতটুকুই ঠিক ছিল। ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি না হলেই ভালো হতো। বাঙ্গালী কম্যুনিটির এক ভাবি তখন বলেছিলেন, “হাজব্যান্ডের বয়স বেড়ে গেলে বাচ্চা নিতে সমস্যা হবে অনেক। তোমার তো আরো আগে বাচ্চা নেয়া উচিত ছিল। নাওনি কেন আগে? আচ্ছা, পড়াশুনা করেছ এতকাল। এবারে ক্ষান্ত দাও। পড়াশুনা লাটে তুলে কনসিভ করার চেষ্টা করো। এই দেশের এত পড়াশুনা করতে হয় না। যতটুকু পড়েছ, অনেক বেশি পড়ে ফেলেছ। তোমার তো আর চাকরি করতে হবে না। তোমার হাজব্যান্ডের অফিশিয়াল চাকরি আছে। প্রতি বছর ভালো অংকের পাউন্ড পাচ্ছে। নিজেদের বাড়ি কেনা হয়েছে। ব্যস, আর কী চাই? তোমার এবারে সংসারে মন দেয়া উচিত। বাচ্চাকাচ্চা আর স্বামী-সংসার নিয়ে বাকিটা জীবন পার করে দাও আরামে।“ পিউয়ের তখন কথাগুলো শুনে বিরক্ত লাগলেও এখন মনে হয়, ভাবিটা ঠিক কথাই বলেছিলেন। ওই সময়ে ভাবির পরামর্শ শুনলে, আর দশটা বাঙ্গালী বউয়ের মতো সংসার ধর্মে মন দিলে আজকের এই পরিস্থিতিতে পড়তে হতো না কখনো। অবশ্য জুনায়েদও তখন ভাবির কথা উড়িয়ে দিয়েছিল। বলেছিল, মানুষের মুখ আছে। তারা নানান কিছু বলবে। নানান পরামর্শ দেবে। সব কথা কানে তুলতে হবে, এমন কোনো কথা নাই। আমরা যা করব, আমাদের নিজেদের বুদ্ধিতে করব। তুমি অবশ্যই পড়াশুনা করবা। সংসার যেমন চলতেছে, ওভাবেই চলুক। আর বাচ্চার জন্যও আমি পাগল হয়ে যাইতেছি না। আমার লাইফে তুমি আছ। ব্যস, আর কিছু চাই না। শুধু তুমি থাকলেই আমি পুরোটা জীবন কাটিয়ে দিতে পারব সুখে-শান্তিতে।
পুরনো স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বুক চিরে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসতে চাচ্ছিল। পিউ সেটা আটকে রাখল। আজ যদি একটা বাচ্চা থাকত ওদের, তাহলে জুনায়েদ এভাবে লাপাত্তা হয়ে থাকতে পারত না। যেখানেই থাকুক, বাচ্চাকে একটুখানি দেখার জন্য ছুটে আসত একবার হলেও। ইউনিভার্সিটিতে পড়তে গিয়েই যত ঝামেলার শুরু! ক্লাসে গিয়ে বন্ধুবান্ধব জুটল। জুনায়েদ কখনো বুঝতে চেষ্টা করেনি শুধু অ্যাসাইনমেন্ট দিয়ে প্রতি সেমিস্টারে পার পাওয়া যায় না। একেকটা বিষয়ে মেরিট বা ডিস্টিংশন পেতে গেলে এই বন্ধুবান্ধবেরই দরকার হয়। স্কটিশ অ্যাকসেন্ট এখনো পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারে না সে। তাই প্রফেসরদের লেকচারগুলো অনেকটাই বুঝতে পারে না। হাঁ করে শুনে কেবল। আর ক্লাসে কে লেকচার বুঝল, কে বুঝল না, সেটার দায় নিশ্চয়ই প্রফেসর নিবেন না। তিনি নিজের মতো লেকচার দিয়ে চলে যান। তখন এই বন্ধুদেরই সাহায্য লাগে। প্রতিদিনের লেকচারের একটা সারমর্ম বুঝে নিতে হয় বন্ধুদের থেকে। বিশেষ করে থমাস খুবই উপকারী। তার নোটসগুলো সে বিনা দ্বিধায় বন্ধুদের সাথে শেয়ার করে। কখনো নোটসের কোনো অংশ না বুঝলে নিজের সময় খরচ করে বুঝিয়ে দেয়। বলতে গেলে একরকম নিজ স্বার্থের জন্যই থমাসের সাথে বন্ধুত্ব রেখেছে পিউ। আর সেটাই তার অপরাধ হয়ে গেছে। ফার্স্ট সেমিস্টারে যেদিন ওরা নতুন বন্ধুত্ব হবার অজুহাতে একসাথে ছবি তুলছিল, সেদিন থমাস ওর কাঁধে হাত রেখে একপাশ থেকে জড়িয়ে ধরেছিল। অন্যপাশে ছিল সুজান। সুজানও থমাসের মতো করে জড়িয়ে ধরেছিল। ছবি তোলা শেষ হলে সুজান সরে গিয়েছিল। থমাস তখন আরেকটা ছবি তুলতে বলল ক্যাথিকে। সেই ছবি তুলতে গিয়েই বাধল বিপত্তি। ঠিক তখন জুনায়েদ ক্যাম্পাসে এসেছিল ওকে নিতে। থমাস ওকে জড়িয়ে ধরে ছবি তুলছিল দেখেই ক্ষেপে গিয়েছিল। তারপর বাসায় গিয়ে যা হলো, সেটা ইতিহাস। পিউ সেদিন জুনায়েদকে বুঝানোর চেষ্টা করেছে, ওভাবে জড়িয়ে ধরায় কোনো খারাপ ইনটেনশন ছিল না থমাসের। এই দেশের কালচার অনুসারে একজন বন্ধু আরেকজন বন্ধুকে জড়িয়ে ধরতেই পারে। জুনায়েদ নিজেও একসময় এই দেশে পড়াশুনা করেছে। এই দেশের হালহকিত কিছুই তার অজানা নয়। তবু সে গোঁ ধরে রইল। সেই যে ঝামেলার শুরু, এখন সেটা শেষ হতে যাচ্ছে ডিভোর্সে! আজকের এই দিনটার জন্যই কি সমস্ত পিছুটান ফেলে, পেছনের দিকে না তাকিয়ে, শুধুমাত্র জুনায়েদের হাত ধরে চলে এসেছিল এই বিদেশ-বিভুঁইয়ে? (চলবে)