#অতঃপর_সন্ধি (০৪)
রূপন্তি রাহমান (ছদ্মনাম)
দুপুরের বিষয়টা মাথায় আসতেই বুঝতে বাকি রইলো না মেসেজটা কে পাঠিয়েছে। থমকে গেল পুষ্পিতা। অবিশ্বাস্য চোখে মোবাইল স্ক্রিনে তাকিয়ে রইলো। হৃদপিণ্ড খুব দ্রুত গতিতে লাফাচ্ছে। অপ্রত্যাশিত মেসেজ পেয়ে মুখের বিরক্তি ভাবটা সরে লাজুকতা দেখা দিলো। প্রসারিত হয় ঠোঁটের কোণ। সে কিছু একটা লিখতে গিয়েও লিখলো না। যদি ওপাশ থেকে আর কোনো রিপ্লাই না আসে? ভাবনার মাঝে আবারও টুং করে শব্দ হলো। নাম্বারটা থেকে আবারও মেসেজ এসেছে।
‘কি হলো উত্তর দিচ্ছেন না যে।’
উপায় না পেয়ে কাঁপা কাঁপা হাতে টাইপ করলো,
‘আসলেই তখন আমার খিদে ছিলো না।’
মিনিটের মাথায় আবারও মেসেজ আসলো।
‘মিথ্যে কথা। আমি দেখেছিলাম আপনি আসছিলেন। পরে আমাকে দেখে আড়ালে চলে গেলেন।’
ধরে পড়ে যাওয়ায় জিভে কামড় দিলো।
‘আপনি ভুল দেখেছেন।’
‘চশমা পড়ে ভুল দেখার প্রশ্নই আসে না।’
তাদের বাকবিতন্ডা চলতে থাকলো মাঝরাত অব্দি। হয়তো এই বাকবিতন্ডা থেকেই প্রণয়ের সূচনা ঘটবে।
____________________
গুটি গুটি পায়ে পেরিয়ে গেছে অনেকগুলো দিন। মায়ান আর পুষ্পিতার মাঝে বেশ সখ্যতা বেড়েছে। বেড়েছে তাদের রোজ কথা বলা। দুই মিনিট থেকে চার মিনিট আর এখন ঘন্টা পেরিয়ে যায় কথা শেষ হয় না। আগে মেসেজে কথা হতো আর এখন কলে কথা হয়। একজন একনাগাড়ে কথা বলে যায়৷ আরেকজন চুপটি করে সে কথা শুনে। কখনো কখনো মেতে উঠে খুনসুটিতে। আর সাথে বেড়েছে তানজিফের পাগলামিও। তানজিফ থেকে বেশ দূরত্বে থাকার চেষ্টা করে পুষ্পিতা। তারপরও রেহাই মিলে না। কখনো কখনো বউ বলে ডেকে ওঠে সে। হকচকিয়ে যায় পুষ্পিতা। অস্বস্তিতে কোনো দিকে তাকাতে পারে না। এসবের মজা নেয় জারিন।
ফোনের লুকানো ফোল্ডার থেকে মায়ানের ছবি বের করে সেটার দিকে অপলক তাকিয়ে আছে পুষ্পিতা। মায়ানের ভ্রু যুগল কুঁচকানো। চেহারায় গম্ভীরতা আর চোখে কালো ফ্রেমের চশমা। ফারদিনকে পড়াচ্ছিল সে৷ সেই ফাঁকে লুকিয়ে ক্লিক করেছিল পুষ্পিতা। সাদাসিধা ছেলেটার মাঝে কি আছে ভেবে পায় না সে। শুধু তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে তার। অপলক, অনিমেষ।
মোবাইল রিং হওয়া শুরু করলো। স্ক্রিনে নাম দেখে হাসলো সে।
‘ঘুম ভাঙালেন আমার। কাজটা কি ভালো হলো?’
মায়ান কালবিলম্ব না করে চোখ বন্ধ করে এক নিঃশ্বাসে বলল,
‘শুভ জন্মদিন মেম।’
বিস্ময়ে চোখ জোড়া বড় হয়ে গেলো পুষ্পিতার। চমৎকৃত কন্ঠে বলল,
‘আজ আমার জন্মদিন?’
পুষ্পিতার করা প্রশ্নে মৃদুস্বরে হাসলো মায়ান।
‘ইয়েস মেম। আজ ডিসেম্বরের তিন তারিখ। অলরেডি ঘড়ির কাঁটা বারোটার ঘর ক্রস করেছে।’
পুষ্পিতার বিস্ময় যেন কাটছেই না।
‘আপনি জানলেন কি করে?’
‘ফেসবুকের বদৌলতে।’
মায়ানের সাথে কথা বলায় ব্যস্ত পুষ্পিতা। একের পর এক কল দিয়ে চলেছে তানজিফ। কল গুলো দেখেও ইগনোর করলো সে। একরাশ ভালো লাগার মাঝে সে মুড খারাপ করতে ইচ্ছুক না কোনোমতে।
নিজের রুমের লাগোয়া বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে তানজিফ। গায়ে স্যান্ডো গেঞ্জি আর শর্ট প্যান্ট। বাইরে হিমেল হাওয়া বইছে। সেই হাওয়া তানজিফকে মোটেও স্পর্শ করতে পারছে না। তার মন অশান্ত আর বিক্ষিপ্ত। বার বার একটা কথায় মাথা ঘুরছে পুষ্পিতা একটু একটু করে আরো বেশি দূরে সরে যাচ্ছে। সময় দেখলো সে। দেড়টা বাজে। তপ্ত শ্বাস ফেলে আবারও ফোন লাগালো পুষ্পিতার নাম্বারে। আবারও ওয়েটিং। বড্ড অসহায় লাগছে তার। বুকের মধ্যে হাহাকার আর হারিয়ে ফেলার ভয়।
‘কার সাথে এতো কথা বলিস? বার বার ওয়েটিং বলতেছে। তোকে প্রথম উইশ করার জন্য সেই কখন থেকে ওয়েট করতেছি। তোর কাছে তো আমার জন্য সময়ই নেই। হয়তো বেশি বিরক্ত করি তোকে। ‘শুভ জন্মদিন আমার জীবন্ত পুষ্প।’ তুই মানিস আর না মানিস, তোকে পাই বা না পাই তুই সারাজীবন আমার কাছে আমার ব্যক্তিগত পুষ্প হিসেবেই থাকবি।’
মেসেজটা সেন্ট করে সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলো সে। ওয়েটিং শব্দটা কানে ভাসতেই বক্ষঃস্থলে প্রকাণ্ড ঝড় বয়ে যাচ্ছে।
_________________
ঘুমে চোখ নিভু নিভু করছে মায়ানের। কল কেটে পিছনে ফিরে কালো অবয়ব দেখে এক লাফে দূরে সরে যায়। ভয়ার্ত, তটস্থ গলায় প্রশ্ন করলো,
‘কে কে?’
নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে আছে কালো অবয়বটি। মায়ান তাড়াতাড়ি ফ্ল্যাশলাইট মুখ বরাবর ধরলো। মুখটা স্পষ্ট হতেই বুকে থুথু দিলো মায়ান। একটা ঝাড়ি দিয়ে বলল,
‘কথা বলতে পারিস না বেয়াদব।’
হাত ভাঁজ করে সূঁচালো দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আতিক।
‘এতোরাতে বাইরে এসে কার সাথে কথা বলিস?’
আতিকের করা প্রশ্নটা যেন মায়ানের কর্ণকুহর অব্দি পৌঁছালো না। ফেসবুক স্ক্রল করতে ব্যস্ত সে।
‘একটা প্রশ্ন করেছি তো আমি।’
মোবাইলে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
‘পুষ্পিতার সাথে।’
বিস্ময়ে চোয়াল ঝুলে গেল আতিকের। হা হয়ে মায়ানের দিকে তাকিয়ে রইলো।
‘মুখ বন্ধ কর। না হয় মশা ঢুকে যাবে।’
‘মজা করছিস আমার সাথে?’
এবার মোবাইল থেকে মনযোগ সরিয়ে আতিকের দিকে দৃষ্টিপাত করলো মায়ান।
‘ভাগ্যকে একটা সুযোগ দিচ্ছি। দেখি আমার ফেভারে যায় কিনা।’
আতিক দৈবাৎ মায়ানের একটা হাত আকঁড়ে ধরলো। প্রফুল্ল, প্রাণোচ্ছল গলায় প্রশ্ন করলো,
‘প্রপোজ করেছিস?’
মাথা নাড়ে মায়ান।
‘খুব শীঘ্রই করবো। পৃথিবীতে সবকিছুর ঔষধ পাওয়া গেলেও মনের রোগের কেবল একজনের কাছেই পাওয়া যায়। যার জন্য প্রতিনিয়ত হৃদয় পুড়ে তার সান্নিধ্যে গেলেই সেই পোড়া প্রশমিত হয়।’
মায়ানের পিঠে চাপর মা’রে আতিক।
‘এতোদিনে বুদ্ধিসুদ্ধি হয়েছে তোর এতেই আমি খুশি।’
_______________________
‘রাতে এতোগুলো কল দিলাম, মেসেজ দিলাম রিপ্লাই দিলি না যে।’
তানজিফের কথায় ভ্রু উঁচিয়ে তাকায় পুষ্পিতা। পাত্তা দিলো না তেমন একটা।
‘দেখতে পাইনি।’
‘মিথ্যে বলছিস কেন? রাতে না হয় দেখিসনি। সকালে তো মোবাইল হাতে নিয়েছিস। তখন দেখিসনি?’
‘দেখেছি কিন্তু মেসেজের রিপ্লাই বা কলব্যাক করার প্রয়োজন মনে করিনি।’
তানজিফ মলিন, বিষন্ন স্বরে প্রশ্ন করলো,
‘তোর জীবনের বাতিলের খাতায় আমি।’
‘সেটা তো বহুদিন আগে থেকেই।’
সদুষ্ণ শ্বাস ফেলে তানজিফ। পুষ্পিতা মাথায় হাত রাখল তানজিফ। মৃদুস্বরে তার কন্ঠনালী দিয়ে স্ফুরিত হলো,
‘শুভ জন্মদিন আমার পুষ্প। আমার ভাগের হায়াত যেন আল্লাহ তোকে দেয়।’
বিমূঢ়, স্তব্ধ হয়ে তানজিফের দিকে তাকিয়ে রইলো পুষ্পিতা। তানজিফ মলিন হেসে চলে গেলো।
‘ফারদিনের টিচার তোকে প্রথমে উইশ করাতে খুশি হয়েছিলি না? আই থিংক তোর এই উইশটার জন্য খুশি হওয়া দরকার। এবারের জন্মদিনের তোর বেস্ট উইশ এটা।’
জড়বস্তুর মতো বসে আছে পুষ্পিতা। নির্জীব, প্রাণহীন চোখে জারিনের পানে চেয়ে রইলো। পুষ্পিতার বিমূঢ়তা দেখে আর ঘাটালো না জারিন। পরিবেশ স্বাভাবিক করতে বলল,
‘আজ তো আর ক্লাস হবে না। আয় আমাকে তোর জন্মদিনের ট্রিট দিবি।’
_____________________
ভার্সিটি থেকে বেরিয়ে কিছুটা পথ এগিয়ে যেতেই রিক্সায় মায়ানের সাথে অন্য একটা মেয়েকে দেখে একেবারে স্থির হয়ে গেলো পুষ্পিতা। অপলক সেই দিকে তাকিয়ে রইলো।
হাঁটতে হাঁটতে কিছুটা পথ এগিয়ে গিয়েছে জারিন। হঠাৎ পাশে পুষ্পিতা কে না দেখে ভয় পেয়ে যায় সে। পিছনে ফিরে পুষ্পিতাকে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। একদৌড়ে কাছে এসে পুষ্পিতা কে আস্তে ধাক্কা দিতেই সম্বিত ফিরে আসে।
‘এখানে দাঁড়িয়ে আছিস যে?’
‘কিছু না, এমনি।’
নিজের মনকে অনেক ভাবে বুঝানোর চেষ্টা করলো। মেয়েটা প্রেমিকা হবে না।
রিক্সায় বসে আছে জারিন আর পুষ্পিতা। রিক্সা শপিং মলের আসতেই জারিন বলল,
‘পরে খাবো আগে তোকে আমার তরফ থেকে একটা গিফট দেই। তোর পছন্দ মতো কিছুই আমি তোকে কিনে দিবো।’
ভাড়া মিটিয়ে দুজন শপিং মলে গেল। সেকেন্ড ফ্লোরে গিয়ে হাঁটা হাঁটি দেখতে লাগলো কি নেওয়া যায়। আচমকা ঘড়ির দোকানে আবারও মায়ানকে দেখে দাঁড়িয়ে পড়ে সে। মায়ান খুব যত্ন সহকারে মেয়েটার হাতে ঘড়ি পড়িয়ে দিচ্ছে।
পুষ্পিতার মন খারাপ যেন আরো গাঢ় হচ্ছে। হারিয়ে ফেলার তীব্র গন্ধ নাকে এসে ঠেকলো। কিছু কেনার মুডই চলে গেল তার।
‘কিরে চল। একটু পর পর এভাবে দাঁড়িয়ে পড়ছিস কেন?’
জারিনের উৎফুল্ল মুখটার দিকে তাকালো। নিজের মন খারাপ চাপা দিয়ে অন্যদিকে গেলো। কসমেটিকসের দোকানে গিয়ে একটা আইশ্যাডো প্লেট আর একজোড়া কানের দুল কিনলো। তারপর গেল রেস্টুরেন্টে। রেস্টুরেন্টে গিয়ে খাওয়ার পর বাঁধে বিপত্তি। ব্যাগ হাতরে পুষ্পিতা ছোট্ট পার্সটা বের করে টাকা পেলো না। পঞ্চাশ টাকার মতো আছে। দুইজনের বিল আসছে এক হাজারের উপর। জারিনও গিফট কিনার চক্করে সব টাকা খরচ করে ফেলছে। দুইজন মুখ কালো করে বসে আছে।
অকস্মাৎ ওদের সামনে এসে দাঁড়ায় তানজিফ। দু’জনের গোমড়ামুখে দেখে প্রশ্ন করে, কি হয়েছে?
তানজিফ কে দেখে মুখ ঘুরিয়ে নিলো পুষ্পিতা। জারিনের যেন জানে পানি আসলো।
‘আরে খাওয়ার পর বিল দিতে গিয়ে দেখি দুজনের কারো কাছে টাকা নেই। রেস্টুরেন্ট কর্তৃপক্ষ আমাদের চুর বলে না আবার মা’রা শুরু করে।’
তানজিফ আস্বস্ত করে বলল,
‘ওহ্ এই ব্যপার? সমস্যা না আমি বিল মিটিয়ে দিচ্ছি। তুই আমাকে পরে দিয়ে দিস।’
তানজিফের কথাকে তেমন একটা পাত্তা দিলো না পুষ্পিতা। অকস্মাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে।
‘তুই থাক আমি বাবাকে বললে এখনই বিকাশে টাকা পাঠিয়ে দিবে। আমি ক্যাশআউট করে আসছি।’
পুষ্পিতাকে আটকালো তানজিফ।
‘বললাম তো আমি দিয়ে দিচ্ছি। আমাকে পরে দিয়ে দিস।’
এবারে গর্জে উঠলো পুষ্পিতা। উচ্চ শব্দে বলল,
‘তোর কাছে আমি টাকা চেয়েছি? চাইনি তো? তাহলে এমন আলগা পিরিত কেন দেখাচ্ছিস? এসব হিরোগিরি অন্যদের গিয়ে দেখা অন্তত আমাকে না।’
#চলবে#অতঃপর_সন্ধি (০৫)
রূপন্তি রাহমান (ছদ্মনাম)
তানজিফ যেন স্তব্ধ, বিমূঢ়, স্তম্ভিত পুষ্পিতার কথা শুনে। জারিন আশেপাশে তাকাল। সবার দৃষ্টি তাদের দিকে।এমন আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে যেন সার্কাস চলছে। জারিন পুষ্পিতার হাত চেপে ধরে অনুরোধের স্বরে বলল,
‘পুষ্পিতা অফ যা। সবাই দেখছে। মানসম্মানের ব্যপার।’
জারিনের দেখানো ভয়কে পরোয়া করলো না সে।
‘দেখুক, কেউ যেচে অপমানিত হতে আসলে এতে আমার কিছু করার নেই। আর তুই।’
আঙ্গুল তাক করলো তানজিফের দিকে,
‘আমাকে ফলো করিস তাই না? একবার বলেছি না তোকে আমার পছন্দ না। তারপরও বেহায়ার মতো পিছু পিছু ঘুরিস। লজ্জা করে না? তোর একটু সেল্ফ রেসপেক্ট নেই? ছেলে মানুষ বেহায়া না এদের থাকা লাগে তেজ।’
জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে পুষ্পিতা। মায়ানের সাথে মেয়েটাকে দেখে এমনি মন মেজাজ বিগড়ে আছে। তার ওপর তানজিফের এমন আদিখ্যেতা সব মিলিয়ে নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারেনি সে।
‘তুই দশ মিনিট অপেক্ষা কর। আমি ক্যাশআউট করে আসছি।’
পুষ্পিতা রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়েছে দুই মিনিট। তানজিফ এখনো নিশ্চল, জড়বস্তুর ন্যায় দাঁড়িয়ে আছে। ঠিক কেমন প্রতিক্রিয়া দেখানো উচিত তার জানা নেই। এতোদিনের এতো কথা হজম হলেও আজকের কথা গুলো হজম হচ্ছে না তার।
‘তানজিফ?’
জারিনের ডাকে নির্জীব চাহনি নিক্ষেপ করে সে।
‘ওর কথায়,,,,,
জারিনকে কথা শেষ করতে দিলো না। বিষন্ন, নিষ্প্রভ হাসলো সে।
‘কি মনে করবো বল? আমি তো এসব শুনতে শুনতে অভ্যস্ত। তবে কি এমন বললাম যে এভাবে রিয়েক্ট করলো?’
থামল তানজিফ।আশেপাশে আরেকবার নজর বুলালো। সবাই যে যার কাজে মনযোগ দিয়েছে। রেস্টুরেন্টে গুটিকয়েক মানুষ। তাদের সামনে আজ সে অপমানিত হয়েছে।
‘আসলেই আমি বেহায়া রে। না হলে এতো অপমান করার ওর পিছু পিছু ঘুরি বল? আমি ওরে বুঝাইতেই পারি না আমি ওকে কতটা ভালোবাসি। ওর সঙ্গ আমার কতটা ভালো লাগে।’
মাথা নুইয়ে রেস্টুরেন্ট থেকে বের হতে গিয়েও হলো না সে। আবারও এসে জারিনের মুখোমুখি দাঁড়াল।
‘ওকে বলে দিস পুরুষ মানুষ সবাইকে তেজ দেখায় না। তেজ সবার সাথে যায় না। নির্দিষ্ট মানুষটার কাছে এলে সব পুরুষই বেহায়া হয়ে যায়।’
_________________
আজ আধঘন্টা লেট করে ফারদিন কে পড়াতে এসেছে মায়ান। ড্রয়িং রুমে চোখ বুলিয়ে পুষ্পিতা কে খুঁজলো সে। তবে তাকে দেখল না। ফারদিনকে পড়ানোর ফাঁকে ফাঁকে দরজার দিকেও খেয়াল রেখেছে। পুষ্পিতাকে একটু দেখার আশায়। সে গুড়ে বালি। আজ কোনো অজুহাতে পুষ্পিতা এইদিকে আসেনি। ফারদিনকে পুষ্পিতার কথা জিজ্ঞেস করতে গিয়েও করলো না মায়ান।
মায়ানের পড়ানো শেষ। ড্রয়িংরুমে পা দিতেই পুষ্পিতা মাত্র বাসায় আসলো। চোখমুখে রাগের আভা। নাকের ডগা কিঞ্চিৎ লাল। মায়ানের চোখে চোখ পড়তে মায়ান হাসলো।তবে মুখ ঘুরিয়ে নিলো পুষ্পিতা। মায়ানকে পাশ কাটিয়ে নিজের রুমে সশব্দে দরজা বন্ধ দিলো।চমকে উঠলো মায়ান। কপালে ভাঁজ পড়ে চিন্তার।
রাস্তায় নেমে পুষ্পিতার নাম্বারে কল করলো। কল কেটে দিলো পুষ্পিতা। আবারও কল দিলো। এবারও কল কেটে দিলো পুষ্পিতা। মায়ান বুঝে নিলো যে পুষ্পিতা তার কল রিসিভ করবে না। উপায় না পেয়ে টেক্সট করলো,
‘আপনি কি আমার উপর রেগে আছেন?’
উত্তরের আশায় সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলো মায়ান।
দাঁতে দাঁত চেপে নিজের রাগ কন্ট্রোল করার চেষ্টা করছে পুষ্পিতা। রাগ কোনোমতে কমছেই না। রাগটা কার উপর? মায়ান নাকি তানজিফের উপর বুঝে উঠতে পারছে না। দেয়ালে নিজের মাথা ঠুকে দিতে ইচ্ছে করছে। পরপর দুইবার কলের মায়ানের মেসেজ দেখে মেজাজ যেন আরো খারাপ হয়ে গেলো। মোবাইল বিছানায় ছুঁড়ে মা’রে। গটগটিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো। লম্বা শাওয়ার না নিলে মাথা ঠান্ডা হবে না।
মিনিট দশেক অতিক্রম হওয়ার পরও কোনো উত্তর পেলো না তখন ঘড়ির দিকে তাকাল। আরেকটা টিউশনির সময় হয়ে গিয়েছে। বিলম্ব না করে সেইদিকে হাঁটা শুরু করলো মায়ান।
___________________
অন্ধকারাচ্ছন্ন রুমটায় হঠাৎ আলোর ঝলকানিতে চোখ কুঁচকে নিলো তানজিফ। চোখ দুইটা ভীষণ জ্বলছে। চোখ জোড়া পিটপিট করে তাকায় সে।
আলো জ্বালিয়ে তানজিফের শিউয়ের কাছে এসে বসলেন সুমনা এহমাদ। আহ্লাদী হয়ে তানজিফের কপালে হাত ঠেকিয়ে চমকে উঠেন তিনি। ত্রাসিত কন্ঠে বলল,
‘তোর তো জ্বর। আমাকে ডাকলি না কেন?’
মায়ের আতঙ্ক দেখে পীড়িত মুখে মলিন হাসলো সে।
‘তুমি মাথায় বুলিয়ে দাও দেখবে জ্বর সেরে গেছে। শারীরিক অসুস্থতায় মায়ের স্পর্শ এন্টিবায়োটিকের থেকেও দ্রুত কাজ করে।’ বলেই সুমনা এহমাদের কোলে মাথা রাখলো।
‘এসব মনগড়া কথা। আগে কয়েক লোকমা খেয়ে তারপর ঔষধ খাবি।’
কিয়ৎকাল চুপ থেকে তানজিফ নির্জীব স্বরে বলল,
‘যদি কেউ তোমার উপর বিরক্ত থাকে। তোমার উপস্থিতি যদি তার কাছে অসহ্যকর লাগে। নিশ্চয়ই তার থেকে দূরত্বে থাকা উচিত?’
‘যে মূল্য দিতে জানে না তার কাছে না যাওয়াই উত্তম।’
‘কিন্তু তোমার ছেলে যে মা চেয়েও পারছে না। দূরত্বের কথা মাথায় আসলে হৃদয়ে অদৃশ্য র’ক্ত’ক্ষরণ হয়।’
আলতো করে তানজিফের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন সুমনা এহমাদ।
‘তুই সব বললি আজও বললি না মেয়েটা কে। আমি ভেবেছিলাম আফসানার মেয়ের সাথে তোর বিয়ে পাকা করবো।’
‘অজানাই থাকুক। কিছু কিছু কথা অজানা থাকাই শ্রেয়। সম্পর্ক সুন্দর থাকে।’
চুপ করে মায়ের স্পর্শ অনুভব করতে লাগলো। নিরবতা ভেঙে তানজিফ পুনশ্চ বলল,
‘মা? তোমার ছেলে কি দেখতে খুব বাজে?’
পরম মমতায় তানজিফের কপালে ঠোঁট ছুঁয়ালেন সুমনা এহমাদ।
‘কে বলেছে আমার ছেলে দেখতে খারাপ? আমার ছেলে তো লাখে একজন।’
‘তাহলে আমায় ভালো কেন বাসে না?’
‘কারন সেই মেয়ের চোখ খারাপ। আসল রত্ন চিনে না।’
‘মোটেও না। তার চোখ দু’টোর মায়ায় ডুবেছি আমি।’
সুমনা এহমাদ রঙ করে বললেন,
‘বাব্বাহ্! এখনই মায়ের বিরুদ্ধে যাচ্ছিস? বিয়ে করলে তো মনে হয় আমাকে,,,,, ‘
‘আরো বেশি ভালবাসবো মা।’ বলে মায়ের কোমর জড়িয়ে ধরলো।
_______________________
খাওয়া দাওয়ার পাঠ চুকিয়ে শুয়ে আছে পুষ্পিতা। অন্যদিন এইসময় মায়ানের সাথে কথা বলায় ব্যস্ত থাকে সে। কয়েকবার মায়ান কল করেছে। পুষ্পিতা ফোন উঠায়নি। সে আর কোনোভাবে মায়ানের সাথে কথা বলতে আগ্রহী না। ভাবনার মাঝে আবারও মোবাইল বেজে উঠলো। মোবাইল উল্টিয়ে রাখলো সে। একের পর এক মোবাইল বেজেই চলেছে। বিরক্ত হয়ে ফোন উঠালো সে। কল রিসিভ করে চুপ রইলো। ওপাশেও নিরব। কয়েক সেকেন্ড নিরব থাকার ওপাশের মানুষটা নিরবতা ভাঙে।
‘আমার উপর রেগে আছেন?’
পুষ্পিতা কোনোরকম ভণিতা ছাড়াই বলল,
‘আপনার যে গার্লফ্রেন্ড আছে বলেন নাই কেন?’
আহাম্মক হয়ে গেলো মায়ান।
‘কিসব ফালতু কথাবার্তা।’
‘লুকিয়ে লাভ নেই। আপনি ধরা পড়ে গেছেন। আজ শপিংমলে তো তার হাতেই খুব যত্ন সহকারে ঘড়ি পড়িয়ে দিচ্ছিলেন।’
‘তো এটা থেকে প্রমাণিত হয় সে আমার গার্লফ্রেন্ড?’
উত্তর না দিয়ে চুপ করে রইলো পুষ্পিতা। আচমকা সে ফোঁপাতে শুরু করে।
‘আপনি কাদঁছেন?’
কাঁপা কাঁপা গলায় ভেঙে ভেঙে বলল,
‘আপনারা পুরুষ মানুষ সব বুঝেও না বুঝার ভান করেন। আপনি বুঝেন না আমি আপনাকে পছন্দ করি।আমার আপনাকে ভালো লাগে।’
ওপাশে থাকা মায়ান হাসলো।তবে হাসির নিনাদ পুষ্পিতার কান অব্দি এলো না।
‘তারপর?
‘কোনো মেয়ে কারন ছাড়া একটা ছেলের সাথে লং টাইম কথা বলে? আপনি সবকিছু বুঝেও কেন আমার আবেগ নিয়ে মজা করলেন? আপনার গার্লফ্রেন্ড থাকা সত্বেও আমার সাথে কথা বলেছেন। আমার টেককেয়ার করেছেন এজ এ বয়ফ্রেন্ড।’
‘সময় এসেছে সব বলে দেওয়ার।’
পুষ্পিতা নাক টেনে বলল,
‘আর কিছু বলতে হবে না। যা দেখার আমি নিজের চোখে দেখে নিয়েছি।’
মায়ান গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
‘কাল দেখা করতে পারবেন?’
‘কেন আপনার গার্লফ্রেন্ডের সাথে পরিচয় করিয়ে দিবেন?’
‘দিতেও পারি।’
‘আমার এতো বড় উপকার করার কোনো দরকার নাই।’
‘মাঝে মাঝে আমাদের চোখের দেখাও কিন্তু ভুল হতে পারে। যা আমরা ভাবি হয় তার উল্টো।
#চলবে