অতিরিক্ত চাওয়া { ২ }
৩
নদীর ঝিলসে যাওয়া পানিতে নৌকা চলছে! কালো রঙের বয়সী মাঝি৷ গালে এক চমৎকার টোল পড়ে আছে। গামছা বেঁধে সে দিব্বি নৌকা চালাচ্ছে আর গান গাইছে রেডিওর তালে-তালে। রেডিও থেকে চলা গানটি বেলীও চোখ বুঝে শুনছে৷
কন্যা রে….
কন্যা রে……
কন্যা রে, কন্যা রে বাকা চুলেতে খোঁপা আর বাইন্ধো নারে..
কন্যা রে, কন্যা রে বাকা চুলেতে খোঁপা আর বাইন্ধো নারে…
ওই চুলেতে যাদু আছে রে,
আমার ঘুম আসে না রাতে..
একলা ঘরে রেএএএএ রে….
কন্যা রে, কন্যা রে বাকা চুলেতে খোঁপা আর বাইন্ধো নারে..
কন্যা রে, কন্যা রে বাকা চুলেতে খোঁপা আর বাইন্ধো নারে…
অন্তর কাড়িলা বন্ধু, ঘুম কাড়িলা..
মিথ্যা প্রেমের রঙিন আশা কেনো দেখাইলা..
মন দিয়েছি বন্ধু আমার, প্রান দিয়েছি..
আজ থেকে সবি আমার উজাড় করেছি..
কন্যা রেএএএএ…
আমার কন্যা রেএএ..
কন্যা রে, কন্যা রে বাকা চুলেতে খোঁপা আর বাইন্ধো নারে..
ওই চুলেতে যাদু আছে রে,
আমার ঘুম আসে না রাতে..
একলা ঘরে রেএএএএ রে….
কন্যা রে, কন্যা রে বাকা চুলেতে খোঁপা আর বাইন্ধো নারে..
মাঝি মিষ্টি হেসে তৃষ্ণাকে ইংগিত করল,
— কি নতুন নতুন?
তৃষ্ণা কিছুই বলল না। সে এখনও বেলীকে দেখছে৷
ঠান্ডা হাওয়ায় শরীরের পশম দাঁড়িয়ে যাচ্ছে! চারপাশে শীতকালীন ঠান্ডা ভাব ছড়িয়ে আছে ! বেলীর শরীরের শোয়েটার টা গায়ের সাথে মিশে আছে! ওড়নার দুই প্রান্তর নৌকায় পড়ে আছে! চুলের খোঁপা থেকে হালকা হালকা চুল চোখের উপড়! বেলী আঁড়চোখে তৃষ্ণার দিক তাকাচ্ছে! তাকাচ্ছে বললে ভুল! চোখ চলে যাচ্ছে! চোখ গুলো লাল তৃষ্ণার ! কেমন ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে! শরীর খারাপ নাকি? ঠোঁট নাড়িয়ে মাথা সোজা করল। আবারও চোখ ঘুড়িয়ে পাশে তাকালো! এইবাএ তৃষ্ণা ভ্রু-উঁচু করে তার দিক চেয়ে! দ্রুতো আবার সামনে তাকালো বেলী,
— কি হয়েছে?
— কি হবে? কিছুনা।
–ওড়না ঠিক কর!
তৃষ্ণার গম্ভীর আওয়াজে তার দিক তাকিয়ে!
— ঠিকই তো আছে!
— থাপ্পড় মেরে নদিতে ফেলে দিব।
বেলী গাল বেঁকিয়ে পেছনে ফিরলো! ওড়নার প্রান্তর নদীতে ডুবে! দ্রুতো উঠিয়ে নিলো! নাক_মুখ কুঁচকে আঁড়চোখে তাকালো, তৃষ্ণা মাঝির সাথে কথা বলছে!
ঘাটে দাঁড়িয়ে বেলী! তৃষ্ণা তার মানিব্যাগ থেকে নৌকা ভাড়া দিচ্ছে! ঘাটেঘাটে নৌকার অভাব নেই! হৈচৈ ভরপুর! উপড়ে জিপগাড়ি দেখে বেলী ভালোভাবে তাকালো! হ্যাঁ, এটা তো তৃষ্ণার গাড়ি! আশেপাশে তাকালো খেয়াল করে! চা এর দোকানে অভি, আয়ুশ, আবিদ বসে আছে! তারা আগে চলে এসেছে! পুরো রাস্তা ঘুড়ে! বাবাহ। বেলী সামনে এগোচ্ছে পিছনে তৃষ্ণা কয়েকজনের সাথে কথা বলতে বলতে আসছে!
— কি অবস্থা বেলী?
অভির প্রশ্নে বেলী নিজের সব দাঁত দেখিয়ে দিলো!
— ভালো ভাইয়া! আপনাদের?
আবিদ বলে উঠলো..
— একদম ভালো না! একদমই না। ভাইর শরীর ভালো না।
আমাদের কিভাবে ভালো থাকবে?
আয়ুশ হাতের কনুই দিয়ে আবিদের পেটে গুঁতো দিয়ে দিলো!
বেলী প্রশ্ন করল,
— ভাই? কোন ভাই?
আবিদ আয়ুশের কনুই এর তুয়াক্কা না করে বলল..
— তৃষ ভাই! তার তো কাল প্রচন্ড ফিভার ছিলো! সারারাত কামারখালির ডাক্তার কে বাড়িতে রাখা হয়েছিলো! চাচা , চাচিম্মা বাড়ির কেউ ঘুমায় নি! এখনো শরীরে ফিভার ! ঠান্ডাও প্রচন্ড লেগে আছে! নাক কি লাল হয়ে আছে। দেখেছ? বাড়ির মেইন গেইটে তালাও দেওয়া হয়েছিলো! কিন্তু ভাইকে আটকানো যায় নি! সে গাড়ির চাবি নিয়ে বেড়িয়ে এসেছে! দুপুরের খাবার খায় নি! তার জন্য ঔষুধপত্র ও খাওয়া হয় নি!
অভি তিক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো আবিদের দিক! আয়ুশ ও তাই করলো! আবিদ ভ্রুক্ষেপ না করে নিজের মতো বলে যাচ্ছে..
— বিশ্রাময়ের প্রয়োজন! কিন্তু ভাই কারো কথা শুনছে না! তুমি বলো না !
বেলি বড়বড় চোখ করে আঙুল নিজের দিক ঘুড়িয়ে দেখালো..
— আমি?
আবিদ মাথা দুলাল!
— অসম্ভব। আমি বললে দেখা যাবে আজ আর বাড়িতেই যাবেন না! উল্টো আমাকে থাপ্পড় না দিয়ে দেয়। একটু আগে আমায় ধমকালো! নদিতে ধাক্কা মেরে ফেলে দিবে বলল।
অভি, আয়ুশ হো, হো করে হেসে ফেলল! আবিদ বিষন্ন মুখ নিয়ে মিনমিন করে বলল,
— তুমি বললে তো সারাদিন বিছানায় শুয়ে থাকবে!
নিজেকে সামলিয়ে বলল..
— শুনবে। শান্ত ভাবে বলবে। মিষ্টি হাসবে। ভাইয়া ডাকবে না তখন। ব্যস। কাম হয়ে যাবে!
বেলি বোকার মতো আবিদের দিক তাকিয়ে.
— আমি ভাইয়া না বললে শুনবে?
— অবষ্যই, অবষ্যই! তোমাকে প্রশ্ন করে ” আবিদ শিখিয়েছে? ” তুমি কিন্তু ভুলেও হ্যাঁ বলবে না।
অভি বাঁকা হেসে বলল..
–আমি আর আয়ুশ আছি বলার জন্য!
— তাহলে তিনজন মিলে খাবো রামধোলাই! একদম সমস্যা নেই আমার !
সাথেসাথে মুখ বন্ধ করে ফেলে অভি, আয়ুশ! তৃষ্ণা কে আসতে দেখে আবিদ মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল..
— পিচ্চি বেলী ? কি অবস্থা? হ্যাঁ আমাদের ভালো! তা পড়ালেখার কি অবস্থা? আচ্ছা, বয়স কি বেড়েছে নাকি এখনো ১৬ ?
আচ্ছা এই গানটা শুনেছিলে?
‘ আমি ষোলো পেড়িয়ে গেছি বাবু গো..
ষোলো পেড়িয়ে গেছি? ‘
বেলি ভিষন্ন মুখ নিয়ে মাথা নাড়ালো! তৃষ্ণা এসে ভ্রু-উঁচু করতেই, আবিদ হালকা হেসে বলল..
— গাড়ি সাইড করে আসি!
অর্ধেক গিয়ে আবার উঁকি দিয়ে বলল..
— গানটা শুনিয়ো কিন্তু! তোমার জন্য পার্ফেক্ট!
এখানে মানুষের অভাব নেই! গ্রামের আভাযুক্ত কিছুই নেই! শুধু বয়ে যাওয়া নদী আর সেখানের ঘাটে নানান মাঝি! আর সাইডে সাইডে কিছু গাছগাছড়া! দোকান রয়েছে শতশত! আশপাশ থেকে চিল্লাচিল্লি শুনা যাচ্ছে ! ওঁপারের দিক হাঁটছে বেলী! দুই সাইডে যাবতীয় জিনিষের দোকানঘর! কাপড় থেকে ধরে যাবতীয় জিনিষ! বেলী আপনমনে খুঁজে যাচ্ছে বিমানদের! ঘাটে তার জন্য অপেক্ষা না করে কোথায় চলে গেলো?
বেলী কিছুক্ষণ যাবত মনে সাহস যোগাচ্ছে তৃষ্ণাকে বলার জন্য,
— এইযে বাড়িতে গিয়ে বিশ্রাম নিন!
কিন্তু ভয়ে মুখ দিয়ে বের হচ্ছে না! যদি সকলের সামনে থাপ্পড় টাপ্পড় মেরে দেয়? মান ইজ্জতের সাথে কান্না ফ্রি! তাও সে বুক ভরে সাহস নিয়ে তৃষ্ণার দিক মুড়ে দাঁড়ালো! তার চুলগুলো কপালে পড়ে আছে! চোখ গুলোর কণার দিয়ে লাল হয়ে আছে! সড়ু নাকটাও লাল দেখাচ্ছে বারবার রুমাল ব্যাবহার করাতে! লাল ঠোট গুলো শুকিয়ে! দেখলেই বোঝা যাচ্ছে শরীর খারাপ! কপালে হাত দিয়ে যে দেখবে তার ও উপায় নেই! কই সে পিচ্চি মানুষ, আর কই সেই দানবের মতো লম্বা ব্যাক্তি! বেলী আস্তে করে তৃষ্ণার হাতে ছুঁয়ে দিলো! তৃষ্ণার ছোটছোট চোখ বড় করে বেলীর দিক ফিরে! বেলী দ্রুত বলল..
— শরীর অনেক গরম। মনে হচ্ছে জ্বর।
থেমে গিয়ে..
~ আপনার বিশ্রামের প্রয়োজন!
তৃষ্ণা দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁট চেপে ধরে কিছুক্ষন বেলীর দিক তাকিয়ে থেকে বলল,
— আবিদ শিখিয়েছে তোকে?
বেলি মুখটা হালকা ‘ হা ‘ করে দ্রুতো মাথা নাড়ালো!
— না না বলে নি সে! আপনাকে দেখেই তো বোঝা যাচ্ছে!
–কিভাবে বোঝা যাচ্ছে? কেউ তো ধরতে পারলো না! তারমানে তুই আমায় দেখছিলি?
বেলি মাথা নাড়ালো!
— দেখছিলাম না তো!
— তাহলে কিভাবে বুঝলি শরীর খারাপ?
বেলী মুখ শক্ত করে ফেলল। সি আই ডি ও মনে হয় এতো জাসুসি করে না! বেলী দ্রুত একদমে বলল,
— আপনার মুখ ফ্যাকাসে হয়ে আছে! চোখ গুলো লাল দেখাচ্ছে! ঠোঁট শুঁকিয়ে, শরীর গরম হয়ে আছে! ব্যাস, বুঝে গেছি! আপনার বিশ্রাম নেওয়া দরকার বলে মনে করি! শুধু বিশ্রাম না, খাবার খেয়ে ঔষুধ ও নেওয়া প্রয়োজন!
মনে হলো তৃষ্ণা থেমে গেলো। বেলী কিছুটা সামনে গিয়ে স্বাশ নিল বড় করে। লোকটাকে ভিষণ ভয় পায় বেলী৷ আঁড়চোখে পিছনে তাকালো! তৃষ্ণা এখনো ন্যায়নীতি মতো দাঁড়িয়ে! মিনিটেই বেলির পাশে হাঁটতে লাগলো! হাতের মোবাইল বেলির দিক এগিয়ে দিলো..
— বিমানের নাম্বার উঠা!
বেলী মাথা নেড়ে নাম্বার উঠাতে লাগলো! বেলির পাশের জনের সাথে ধাক্কা লাগার আগেই তৃষ্ণা বেলির আঙুল হালকা ছুঁয়ে অন্যপাশে নিয়ে আসলো! বেলী আরেকদফা বুকে সাহস জুগিয়ে বলল,
— আপনাকে কিছু বলেছিলাম!
তৃষ্ণা কিছুক্ষন চুপ থেকে উত্তর দিলো..
— শুনেছি!
— যাবেন না?
তৃষ্ণা হালকা ধমকের স্বরে বলল,
— এখন কি এই ভিড়ের মাঝে তোকে রেখে চলে যাবো?
বেলী চুপসে গেলো! এভাবে ধমকানোর কি আছে। ভালো ভাবে কি বলা যায় না? অযথা এতো রাগ কেন লোকটার।
তৃষ্ণা একটু স্বাশ ফেলে বলল..
–পরে যাচ্ছি!
শুনেই বেলীর মন ভালো হয়ে গেলো একদম।
তৃষ্ণা কল দিয়ে কিছুক্ষন অপেক্ষা করলো! একটু পরেই কল রিসিভ..
— বিমান?
— হ্যাঁ, তৃষ্ণা বলো!
— বাহ! নাম্বার জানতে নাকি?
কিছুক্ষন চুপ!
— হ্যাঁ! ওই আব্বুর থেকে আর কি!
— কোথায় তোমরা?
ওপাশ থেকে শিলার আওয়াজ..
— ভাইয়া সামনের রোডের গলিতে! ওড়নার দোকানে! এখানে আসুন!
তৃষ্ণা পাশে বেলীর দিক তাকিয়ে বলল..
— তোমরা ঘাটে পৌঁছিয়ে আমাকে কল করিয়ো! বেলীকে নিয়ে চলে আসবো!
বাবলুর আওয়াজ শোনা যাচ্ছে,
— পাউরুটি ও পাউরুটি!
তৃষ্ণা হ্যাঁ বলে কল কেঁটে দিলো! বেলী চুড়ির দোকান থেকে চোখ সরিয়ে তৃষ্ণার দিক ফিরলো..
— কোথায় ওরা? চলুন সেখানে যাই!
— ওদের দিয়ে তোর কাজ কি? যা কিনার কিনতে থাক!
বেলি ভ্রু কুঁচকে বলল..
— শিলা কিনবে তো! শিলার জন্য এসেছি! তাও কিছু কিনা যেতো কিন্তু আপু তো নেই!
— তোকে কি বলেছি মাত্র ? যা লাগবে কিনতে থাক! আরেকবার যদি বলতে হয়!
বেলি মাথা নাড়িয়ে চুপসে গেলো!
পাশাপাশি হাঁটছে দু’জন! মাগরিব এর আযান দিচ্ছে! বেলীর মাথায় ওড়না দেওয়া! শীতকালীন হওয়ায় এখনি অন্ধকারে ছেয়ে আছে আকাশ! শীত চরম ভাবে শরীরে ছুঁয়ে দিচ্ছে! মানুষজন সব উধাও! এতো এতো মানুষ এতোটুকু সময়ে উধাও! হাতেগনা কিছুদের দেখা যাচ্ছে! যারা হাতে ব্যাগ নিয়ে ফিরছে ঘাটের দিক! বেলী খেয়াল করলে হয়তো দেখতো কেউ তার দিক অপলক ভাবে তাকিয়ে! তার ঠোঁট ফুলানো, পা দুলিয়ে এদিক-সেদিক তাকানো, চোখ ডলা সব একনজরে দেখছে!
বাড়িতে ফিরে বেলী দ্রুতো চুড়ি গুলো পরে ঝুনঝুন করলো! বিমান আড়চোখে তাকাচ্ছে..
— চুড়ি কিভাবে নিলি?
বেলী হাত দুলাতে দুলাতে বলল..
— তৃষ্ণা ভাইয়া কিনে দিলো!
— সে কিনে দিলো আর তুই নিয়ে নিলি!
বেলী হাত নাড়ানো থামিয়ে দেয়! সত্যি তো তার নেওয়া উচিৎ হয় নি! বাবলু তার নতুন কেনা খেলনা পিস্তল ঘুড়িয়ে বিমানের দিক ধরে ঘুড়ঘুড় গুল্লি করতে করতে বলল..
— কিনে দিয়েছে তো? তোকে কিনে দিলে তুই তো আরো চাইতি! উল্টো আমার মতে তার গলায় ঝুলে পড়তি!
খুশি পাশের রুম থেকে চিল্লাচ্ছে..
— বাবলু মাইর খাবি তুই? বলেছি না আপু বলে ডাকবি!
— হ্যাঁ বলছি! কিরে বিমাইন্না আপু! কি ব্যাপার স্যাপার?
বিমান ফোন টিপতে টিপতে অন্য সাইডে চলে গেলো!
জানালার পাশে শুয়ে আছে বেলী! তার অপর পাশে বিমান! চুড়ি গুলো এখনো হাতে পড়ে বেলী ! অদ্ভুত অনুভূতি নাড়া দিচ্ছে মনে। চুড়ি গুলো বুকের সাথে লাগিয়ে চোখ বুঝলো ! অন্ধকারে চিনচিন আওয়াজ আসছে জানালা দিয়ে! তার আজ অনেক ভালো লাগছে! কেনো লাগছে? উত্তর নেই! কিন্তু লাগছে ভালো অনেক…
সে মিনমিনিয়ে গান ধরলো..
— পেয়ার কিয়া তো ডারনা কেয়া..
আব পেয়ার কিয়া তো ডারনা কেয়া?
পেয়ার কিয়া কোয়ি চরি নেহি কিয়া..
ছুপছুপ আহে ভারনা কেয়া..
চলবে…