অতিরিক্ত চাওয়া পর্ব ৪৮ শেষ পর্ব

অতিরিক্ত চাওয়া { ২ }
৪৮|| অন্তিম পর্ব |

মাদবরের নাতি। এটা এখনও ভার্সিটির সামনে দাঁড়িয়ে। বেলীর পাশে দাঁড়ানো শীলা, বাদাম চিবুতে চিবুতে বলল,
— কল দিয়েই দি ভাইকে একটা। কি বলিস?
বেলী শক্ত চোখে তাকালো,
— হ্যাঁ, তারপর?
— তারপর? তারপর কিছুদিন আর ভার্সিটি আসা লাগবেনা। শুধু বেডরুমে রেস্ট নিবি।
বেলীর ইচ্ছে করলো ভয়াবহ এক গালি দিতে। বিয়াদপ মেয়ে। ভালো কিছু বলবেনা। সব উদ্ভট।
— তুর মাথা। সয়তান মেয়ে। জাহান্নাম যায়গা হবেনা তোদের। যারা যারা আমাকে জ্বালাতন করিস, এরা সব জাহান্নাম যাবি। হুহ। দেখে নিস শয়তানের বাচ্চা।
শীলা অবাক চোখে তাকালো। পরপর তার ফোন থেকে আওয়াজ আসছে,
— কাকে গালাগাল দিচ্ছে এভাবে?
বেলীর মুখ চুপসে গেলো। এই ইতর মেয়ে কল দিয়ে ফেলেছে? বেলী ওড়না দিয়ে মুখ ঢেকে, অন্যপাশ ফিরে গেলো। এখন তো নির্ঘাত হাওয়ার বেগে চলে আসবে।

শীলাকে নিয়ে, আরও বেশকিছুক্ষন দাঁড়িয়ে থেকে, এবার রওনা হলো বেলী। সে ভেবে রেখেছে, দ্রুত পায়ে টমটম চড়ে একবারে বাড়িতে। মাঝে নো দাঁড়ানো। অথচ মধ্য রাস্তায় সেই মাদবরের নাতি নায়ক সেজে দাঁড়িয়েছে। বেলীর ইচ্ছে করলো একটা ইট এনে এটার মাথা ফাটাতে। কিন্তু বেলীর মাথা ফাটাতে হলো না। তার আগেই, হঠাৎ সামনে চোখ যেতেই, বেলীর অসহায় শ্বাস বেরিয়ে এলো। যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই রাত পোহায়। কথাটা একদম পইপই মিলে যাচ্ছে। তৃষ্ণার সাথে আবিদ, আয়ুশ, অভি। ভাইরা ভাইরা গাড়ি পার্ক করে এদিকেই আসছে। বেলী তৃষ্ণাকে দেখেই শীলার পিঁছু লুকালো। আগেই সে বড়সড় আওয়াজে বলল,
— এই লোক শীলার পিঁছু নিয়েছে। সত্যি।
শীলা দুহাত উঁচু করে সরে দাঁড়ালাও। যার অর্থ স্পষ্ট। আবিদ সোজা গিয়ে ছেলেটার কলার চেপে ধরলো। ছেলেটা ইতস্তত গলায় বলল,
— ভাই, খারাপ কিছু করছিনা। টিজ ও করিনি। শুধু পছন্দ হয়েছে। সাবধানে বাড়ি পৌঁছাতে,
বেচারার কথা আঁটকে গেলো থাপ্পড়ের আওয়াজে। থাপ্পড়ের সাথে আবিরের শক্ত আওয়াজ ,
— শালা। ভাবী আমার। চোখ কই দেস?
এবার আয়ুশের এক থাপ্পড় ছেলের মাথায়।
— আমি জানতাম না ভাই।
মানুষ জড়সড় হয়ে আছে। তৃষ্ণার দৃষ্টি এখনো বেলীর দিক। বেলী আরও কিছুটা শীলার পিছু চাপলো।
— আমার দিক তাকিয়ে। আমি কি করেছি। আজিব।
তৃষ্ণার ঠান্ডা আওয়াজ,
— তুই তো মাসুম।
পরপরই তৃষ্ণার শক্ত হাত বেলীর হাত চেপে। বেলী হাত ছুটাতে চাইলো,
— শীলা একা যাবে? ওর সাথে যাই?
তৃষ্ণার তীক্ষ্ণ দৃষ্টির সাথে নিজের দৃষ্টি মিলতেই, বেলী একাই হাঁটা ধরলো গাড়ির দিক। যেতে যেয়ে সে শুনলো তৃষ্ণার কন্ঠ,
— বউ আমার। আর যদি শুনি বা দেখি মাটিতে পুঁতে দিব।
বেলী মুখ কুঁচকালো। এহ, বউ আমার। বউয়ের খবর থাকেনা। এখন আসছে বউ আমার।
গাড়িতে বেলী চুপসে বসে। সে ভেবে রেখেছে, এই কয়েক ঝাড়ি দিবে। তারপর গাল চেপে ধরবে। ব্যস। অথচ হলো উল্টো,
তৃষ্ণা শক্ত এক চুমু খেয়েছে। নানান যায়গায় স্পর্শ করে সে বেলীকে এক ঝাড়ি দিলো,
— এভাবে ছেলে পিছু ঘুরঘুর করলে ভালোলাগে?
বেলী দ্রুত মাথা দুলালো।
— আপনার পিছেও তো ঘুরে।
তৃষ্ণা ভ্রু উঁচু করলো,
— কখন দেখেছিস?
— এহ। আমি সব জানি। আমাকে সব বলে আবিদ৷ আপনি তো প্রতিদিন প্রোপোজাল পান। তার জন্যই সুন্দর ছেলে বিয়ে করতে নেই।
— আচ্ছা?
— হ্যাঁ। এখন না কষ্ট আমাকে ঠেলতে হয়৷
— কি কষ্ট ঠেলতে হয়?
বেলী আঁড়চোখে তাকালো।
— বল, কোন দিক দিয়ে কষ্ট ঠেলতে হয়।
বলতে বলতে সে বেলীর গাল চেপে ধরলো।
অথচ বেলী একদম চুপ।

দরজার সামনে পৌঁছাতেই লিমন দৌঁড়ে তৃষ্ণার কোলে,
— তিষ বাবা। তিষ বাবা।
বেলী ধীরে সাইড হয়ে ভেতরে চলে যাচ্ছে। তৃষ্ণা দু’হাতে জড়িয়ে নিয়ে ভেতরে যাচ্ছে,
— কেমন আছে আমার বাবাই?
— অনেক ভালো। আজকে লিমনের বার্থডে।
তৃষ্ণা অবাক হওয়ার ভান করলো,
— ইশ, বাবা তো ভুলেই গেছে।
— না, বাবা কখনও ভুলেনা।
ড্রয়িংরুমের সবাই হাসছে। লিমনকে কোলে নিয়েই তৃষ্ণা সোফায় বসলো। আওয়াজ করে বলল,
— বেলী, ঠান্ডা পানি।
পরপরই বেলী নিয়ে আসলো। পানি দিয়ে সে আবারও রান্নাঘরে। এদিকে আজ সকলেই আমিদের বাড়ি। সোলাইমানের ছেলে লিমনের বার্থডে। সেই উপলক্ষে সকলেই এখানে। সন্ধ্যার পরপর অনুষ্ঠান হবে।

আবিদের পাশে আরিকা বসে। নাকফুল, চুড়ি পরে একদম বউ রুপে। বিয়ে হয়েছে বছরের পর বছর হচ্ছে। অথচ এখনও আরিকার চোখ অন্য যায়গায় থাকেনা৷ সদার মতো আবিদকে দেখতে ব্যস্ত। তাদের মাঝে এখন একটি বাচ্চার অনুপস্থিতি। সেটাও পূর্ণ হয়ে যাবে। কারণ আরিকা দু’মাসের প্রেগন্যান্ট।
এভাবে এরেঞ্জম্যারেজ হলেও আয়ুশ, তার বউকে চোখে হারায়। সে আঁড়চোখে রান্নাঘরের দিক তাকাচ্ছে। তার বউ সকালের সাথে রান্না ঘরে। রান্নাঘরে থাকলে কি মেয়েদের একটু বেশি সুন্দর দেখায়? কি জানি। তার কাছে তো সুন্দরই দেখাচ্ছে।
অভি একবার রান্নাঘরে উঁকি দিয়ে এসেছে। বিমান কিছুতেই আসছেনা। কয়দিন ধরে কাছে নেই সে। অথচ একবার কাছাকাছি এসে বসছেও না। এ কেমন নির্দয় মেয়ে বিয়ে করলো সে।
আবির আর আয়েশা এসেছে একদম লাঞ্চের সময়। আবিরের কোলে এক বছরের বাচ্চা। এই বাচ্চার জন্যই আয়েশা এখন কম আসে। মেয়েটা তার প্রচন্ড জ্বলায়। তাদের দেখতেই তৃষ্ণা উঠে বাচ্চাকে কোলে নিলো৷ আবিদ, আয়ুশ এরাও বাচ্চা নিয়ে হাসাহাসি শুরু করেছে।
তৃষ্ণা ছাঁদে বসে তার ভাইদের সাথে। কয়েকদিন পর এলো। কোথায় একটু বউয়ের সাথে সময় কাটাবে । তা না, সেটাতো হচ্ছেই না। কারণ, হাওলাদার বাড়ি এসেছে। সকলে সেখানে কথা বলতে ব্যস্ত। এখন তো বেলীকে জোরপূর্বক ও আনা যাবেনা। আবার সাথে তো টাম্মি আছেই।
তৃষার চেঁচামেচিতে বাড়ি মেতে। আবার বাবলু ও চেঁচাচ্ছে। এরা দুজন আবারও ঝগড়া লেগেছে। দুজন-দুজনের চুল ছিঁড়ে ফেলবে এমন অবস্থা । আমিদ তার মেয়েকে টেনে নিয়ে এসেছে। মেয়েকে ধমক কি দিবে, মেয়ে তার আগেই কেঁদে ফেলেছ। কাঁদতে কাঁদতে বলছে,
— এটাকে বাড়িতে ঢুকতে দিবেনা। ও সয়তান। আমার সাথে ইচ্ছে করে লাগে আব্বু।
বাবলু চুল ঠিক করছে। সে বেশ ভাব নিয়ে বলল,
— এ কার মতো হয়েছে। অদ্ভুত মেয়ে।
তৃষা পারছেনা খেয়ে ফেলতে। সেধে তার মাথা থাপ্পড় মেরে, এখন ভালো সাজা হচ্ছেনা। ছেলেটা এমন সয়তান কেন? দেখা গেলো তৃষার বিচারে, বেলী ভাইয়ের কান মুড়ে দিলো। তারপর টানতে টানতে নিজের সাথে নিয়ে গেলো। এদের ঝগড়া লেগেই থাকে। একদম মিলে না দুজনের। সাপ আর বেজি৷

সন্ধ্যার দিক অনুষ্ঠান। লিমনের বার্থডে সেলিব্রেট হচ্ছে। ছাঁদ সুন্দর ভাবে সাজানো। মিউজিক সিস্টেম বাজানো হচ্ছে। বাড়ির মেয়েরা সবাই ব্যস্ত কাজে। লিমন একবার সোলাইমানের কোলে তো একবার তৃষ্ণার কোলে, নাহলে আবির, আবিদ, আয়ুশ, অভি। এদের কোলে বিচরণ করছে। আজ তাকে নামানো হচ্ছেনা। ভালবাসায় তাকে আগলে রাখা হচ্ছে। সকলের জন্য তৃষা একটি নাচ করবে বলা ছিলো। অথচ বাবলু’কে দেখতেই সে নাচ করবেনা জানালো। তো কি করার? বাবলু নিজেই নাচ করলো। বাবলুর নাচ দেখে বড়রা তাকে বকশিস দিলো। রমরমা পরিবেশে লিমনের বার্থডে কেক কাঁটা হলো। অনুষ্ঠান শেষ হয়েছে রাত বারোটার দিক। সেই রাত্রেই যে যার মতো তাদের গাড়ি নিয়ে রফাদফা। পুরো বাড়ি সুনসান করে দিয়ে গেলো। এতো চেঁচামেচি নিমিষেই শেষ।

ড্রয়িংরুমে তৃষ্ণা মুভি দেখছে। সাথে লিমন তৃষাও আছে। মুভির থেকে বেশি নজর তার রান্নাঘরের দিক। এখনও কি কাজ করছে? অনেকক্ষন যাবত ধরে অপেক্ষা করছে সে বেলীর। অথচ এই মেয়ে আসছেই না। এবার সে উঠে দাঁড়ালো। নিজেই রান্না ঘরের দিক গেলো। বেলী তরকারি গরম করছিলো। আর কাউকে রান্নাঘরে না পেয়ে, তৃষ্ণা পেছন থেকে বেলীকে জড়িয়ে ধরে। হঠাৎ এমন হওয়ায় বেলী ভয় পেয়ে যায়। তৃষ্ণাকে সরাতে চাইলেও, সে সরছেনা।
— দ্রুত আয়।
কথাটা বলেই সে রান্নাঘর থেকে চলে যাচ্ছে। বেলী খেয়াল করলো তৃষ্ণা বেডরুমে যাচ্ছে। এবং যাওয়ার পথে আরেকবার বেলীকে ডেকে গেলো। বেলী হেসে ফেলল। লোকটা এমন অধৈর্য কেন?

______

বেলী রুমে পৌঁছালো রাত একটার দিক। এতো এতো কাজ ছিলো। শেষ করতে সময় লেগে গেলো। সে ধীরে উঁকি দিলো। তৃষ্ণা ল্যাপটপে কি যেন করছে। বেলী ভাবলো আরেকটু দেরি করে আসবে। তার আগেই তৃষ্ণা তাকে দেখে ফেলেছে। অগ্যত বেলী ভেতরে ঢুকলো। তৃষ্ণা তখনই ল্যাপটপ সরিয়ে, উঠে এসে দরজা লাগিয়ে দিলো। বড়বড় পা ফেলে বেলীকে কোলে তুলে ফেলল। গভীর ভাবে বেলীর গলায় মুখ ঘষতে ঘষতে বলল,
— মিসড ইউ বেলী।
বেলী শক্ত ভাবে তৃষ্ণার টি-শার্ট ধরে।
— মিথ্যুক।
পরপর তৃষ্ণা বেলীর ঘাড়ে কামড় বসালো। বেলীর মুখ দিয়ে অস্ফুট শব্দ বেরোলো। উফ, ঘাড়টা শেষ মনে হচ্ছে।
— ছাড়ুন। আমার ঘুম পাচ্ছে।
তৃষ্ণা শুনেও শুনলো না। সে বেলীকে বেলকনিতে নামালো। পেছন থেকে বেলীকে জড়িয়ে বাহিরে তাকিয়ে। আকাশের অবস্থা ভালোনা। বৃষ্টি হবে। ঠান্ডা বাতাসে বেলীর চুল উড়ছে। তৃষ্ণার হাত সেই চুল ঠিক করতে ব্যস্ত। ফোঁটা-ফোঁটা বৃষ্টির আগমন শুরু। বাতাসের সাথে তা ছিঁটকে এসে দুজনকে ভিজিয়ে দিচ্ছে। বেলী দ্রুত তৃষ্ণাকে সরাতে চাইলো,
— আপনার ঠান্ডা লেগে যাবে। চলুন।
তৃষ্ণা ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইলো। সে গভীর ভাবে বেলীকে দেখতে লাগলো। বেলী লজ্জায় আবারও আকাশের দিক তাকালো। বৃষ্টি কেমন অদ্ভুত সুখ দেয়। আর সাথে প্রিয় মানুষ থাকলে তো কথাই নেই।
ধীরে ধীরে তীব্র বৃষ্টির ছোঁয়ায় তারা দুজন ভিজে চুপচুপ। বেলীর বুক ধুকপুক করছে। বিয়ের এতদিন হচ্ছে, এখনও সে তৃষ্ণার দুষ্টু হাতের স্পর্শ নিতে অক্ষম। তৃষ্ণা ধীরে বেলীর কানে ফিসফিস করলো,
— তোর মনে হয়না, এখন আমাদের এক রাজকুমারীর প্রয়োজন?
বেলী অবাক হলো,
— আমি এখনও ছোট।
— কিন্তু আমিতো বুড়ো হয়ে যাচ্ছি।
— ইশ, আপনি এখনও,
— আমি এখনও?
বেলী সরতে চাইলে তৃষ্ণা শক্ত করে তাকে ধরে। তাকে পাজাকোলে তুলে ফেলে। ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বলে,
— বেবি নেবার প্রেপারেশন স্টার্ট।
— না।
— হ্যাঁ।
— না। এখন না।
— হ্যাঁ।
এবার বেলীকে না বলার পথ না দিয়ে, তার মুখ দ্বারা বেলীর মুখ আঁটকে দেয়।
— আমার অতিরিক্ত চাওয়ার একটা ফুল তো দরকার তাইনা?
বেলী অস্ফুট ভাবে বলল,
— আপনি বাজে।
— আর তুই তাকেই ভালবাসিস।
— হ..হ্যাঁ।
তৃষ্ণা অবাক স্বরে বলল,
— কি?
— ভালবাসি। অতিরিক্ত।

বাকিটা জীবন নাহয় তারা আড়ালে থাকুক। সুখ দুঃখের মাঝে এক অসীম জীবন অনুভব করুক।

সমাপ্ত

2 COMMENTS

  1. দারুণ হয়েছে💖💖আমার পড়া অন্যতম সেরা রোমান্টিক গল্প..😍😍 আশা করি সিজন ৩ খুব শীঘ্রই পাবো…. 💓💕💓

  2. কি যে বলবো আমি বলে বুঝাতে পারবো। অসাধারণ হয়েছে। আমি ভাবছি আরেকটা সিজন দিলে ভালো হতো। কারণ আমরা পাঠকরা এরকম দুষ্ট মিষ্টি রোমান্টিক প্রেমের গল্প বেশি পড়তে চাই

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here