অতিরিক্ত চাওয়া পর্ব ৪৩

অতিরিক্ত চাওয়া { ২ }
৪৩|

তৃষ্ণার হুটহাট কাজকর্ম আনন্দ’কে প্রচন্ড রাগিয়ে দেয়। সে থরথর করে রাগে কাঁপছে। এতো রাত্রে তার মেয়েকে নিয়ে চলে গেলো? তার পারমিশন নেওয়ার প্রয়োজন মনে করলো না? এই ছেলে কি দিয়ে তৈরি? এতো অসভ্য ছেলে আনন্দ তার, এতো বছরের জীবনে আর একটা দেখেনি। যেটা যখন মন চাইবে করে ফেলবে। সমাজ, ভাবনাচিন্তা, মনমানসিকতা, অবস্থা কিছুই লক্ষ্য করে না। কী উদ্ভট প্রচারণা চালাচ্ছে। ছেলের পক্ষ নিয়ে যখন আমিদ কল করলো, আনন্দ রাগী কন্ঠ শোনা গেলো,
–” এগুলো কেমন আচরণ? এসব উদ্ভট আচরণ তো মানা যাচ্ছেনা। সব আয়োজন হয়েছে। কাল তুলে দেওয়া হবে। এর মাঝে এমন ঘটনা। ”
–” আপনি শান্ত হোন। ”
আনন্দের রাগের কারণে, দেখা গেলো আমিদ সেই রাত্রেই আবির’কে নিয়ে হাওলাদার বাড়ি হাজির।
চেয়ারে বসে, আবির খুকখুক করে উঠলো। তারপর ঠান্ডা স্বরে বলল,
–” আসলে, তৃষ্ণা…
কিছুটা বলে আবির চুপ মেরে যায়। আনন্দের মুখের অবস্থা তেমন ভালো না। প্রচন্ড রেগে। এমন মুহুর্তে যদি সে তৃষ্ণা যা বলেছে তা বলে, তাহলে আনন্দ নিশ্চিত এক্সপ্লোর হয়ে যাবে ইনস্ট্যান্ট। আবিরের অবস্থা দেখে, আমিদ’ই কথা শুরু করলো,
–” আপনি রাগবেন না আনন্দ ভাই। ছেলেটা আমার বিগড়ে যাওয়া। তা তো জানেনই। ওর চিন্তাভাবনা আমাদের ছাড়িয়ে। ও যা ভাবে তা করবেই। থামানোর মতো অবস্থা রাখেনা। এককালে আপনি ওর শিক্ষক ছিলেন। আপনি তো জানবেনই ও কেমন ছেলে। ”
দেখা গেলো আনন্দ মনে মনে বলছে,
–” তা আবার না জানা? অসভ্য ছেলে। ”
মুখে আনন্দের জবাব,
–” এবার আপনার ছেলে কি কীর্তি করবে শুনি? ”
আমিদ নিজেও সংকট এ। কীভাবে বলবে ভেবে পাচ্ছেনা। ভাগ্যক্রমে তৃষ্ণা নিজেই কল করেছে। আবির রিসিভ করতেই সে বলল,
–” মামা স্পিকারে দাও। ”
আবির স্পিকারে দিয়ে সামনে রাখল। তৃষ্ণার শান্ত কন্ঠস্বর। যেখানে তাড়াহুড়োর কোনো চিহ্ন নেই।
–” চাচা। আপনি অবশ্যই রেগে আছেন…
আনন্দ কথা থামিয়ে বলতে নিচ্ছিলো, তখনই তৃষ্ণা আবারও বলে উঠে,
–” কথা শেষ হয়নি। শেষ করি আগে। কাল উঠিয়ে দিতেন, সেটা আমি আজকেই সেরে ফেলেছি। কথা হচ্ছে, কাল বেলীকে আনতে যাবো, তারপর ও আপনাদের ছেড়ে আসতে চাইবে না, কাঁদবে। আপনারাও মেয়ে দিতে চাইবেন না, কাঁদবেন। সেখানে আমাকে ওকে একপ্রকার জোরপূর্বক ভাবে আনা লাগবে। দেখা যাচ্ছে আমি ভিলেন। তো কাল ওকে কাঁদিয়ে তুলে আনা থেকে, এখনই নিয়ে আসাটা বেশি সুন্দর দেখাচ্ছে। আর কিছুদিন আগেই বিমানের বিয়ে এতো খরচ গেলো আপনার। অবশ্যই টাকার সমস্যা হচ্ছে। এমন মুহুর্তে আবার কাল এতো খরচা করার আমি রিজন দেখছি না। পরে নাহয় আমরা একটা রিসিপশন করে নিব। ইজন্ট ইট ব্যাটার?”
আনন্দ রাগে দাঁত কিড়মিড় করতে লাগলো ,
–” বাবা’র একটা কর্তব্য আছে। মেয়েকে বুঝিয়ে হাতে হাতে তুলে দেওয়া বাবার কর্তব্য। ”
–” আচ্ছা। আপনি তুলে দিন, আমি নিচ্ছি। আমি তৃষ্ণা রাজ চৌধুরী, আনন্দ হাওলাদারের ছোট কন্যা বেলীর, সকল দায়িত্ব গ্রহণ করলাম। ”
রাগের কারণে আনন্দর মুখ স্তব্ধ হয়ে আছে। তৃষ্ণা জবাব না পেয়ে, শান্ত স্বরে আবারও বলল,
–” এখন সবাইকে দেখিয়ে মেয়ে তুলে দিতে হবে? মনে মনে উঠিয়ে দিলেও হচ্ছে। তাই না? সামনে বাবা আছে, মামা আছে, আপনি আছেন আর আমি। ব্যস। আর কাকে লাগবে দেখাতে?
আপনি জানেন আমি আপনার মেয়েকে কতটা ভালবাসি। বেলীকে আমি সুখী রাখব চাচা। চিন্তা করবেন না।”
শেষের কথায় আনন্দের মন নিমিষে শান্ত হয়ে গেলো। তারপরও সে শক্ত চেহরা করে আছে। আঁড়চোখে তাকাল ফোনের দিক। তৃষ্ণা শেষ বারের মতো বলল,
–” রাখছি তাহলে চাচা। নিজের এবং চাচীর যত্ন নিবেন। ”
আমিদ আর আবির অসহায় চাহনি আদানপ্রদান করে ফেলল।

বেলী স্তব্ধ মেরে বসে। লজ্জায় তার মাথা ধরে আসছে। এতো নির্লজ্জ মানুষ কিভাবে হয়। সে এমন ঘাড়ত্যাড়া লোক এই জীবনে, আর দুটো দেখেনি। এতো এতো ঘাড়ত্যাড়া কিভাবে হয় কেউ। মানে নিজে যেটা ভাববে সেটাই। অন্যের ভাবনার কোনো মূল্য নেই। বেলী রেগে অন্যদিকে ফিরে। অথচ তার রাগ ভাঙানোর জন্য কেউ নেই। তৃষ্ণা দিব্বি গাড়ি চালাচ্ছে। আঁড়চোখে বেলীর দিক তাকাচ্ছেও না। নিষ্ঠুর লোক। একদম নিষ্ঠুরতম। দেখা গেলো সারারাস্তা বেলী একটাও কথা বলল না। চুপচাপ বসে। মনেমনে ভিষণ ভাবে কিছু, বকাঝকা করল তৃষ্ণাকে। এমন নীরবতায় বেশ কিছুক্ষণ কেঁটে গেলো। এমন নীরবতা আর নিতে না পেরে, বেলী মুখ খুলল।
–” এতো…”
বেলীর বাকি কথা গুলো আর শোনা গেলো না। তৃষ্ণার ঠোঁট জোড়া হঠাৎ তীব্র ভাবে এসে তার ঠোঁট ছুঁয়ে, তাকে আরও নীরব করে দিলো। হঠাৎ এমন কিছু হওয়ায় বেলী নিজেও চুপ। এতক্ষণের আঁড়চোখে তাকানোও বন্ধ। হঠাৎ তৃষ্ণার গভীর কন্ঠের হাসি শোনা যাচ্ছে। সে হাসতে হাসতে বাম হাত দিয়ে বেলীর গাল টেনে দিলো।
–” তুই রাগলে তোকে কতটা আগুন লাগে জানিস? মাত্রাতিরিকিক্ত। আগুন মাত্রাতিরিক্ত। ইচ্ছে করে ধরে তোর ঠোঁট, গাল, ঘাড় কামড়ে খেয়ে ফেলি। এইযে এখন তোর গাল লাল হয়ে আছে। তোকে একদম আমার নতুন বউ দেখাচ্ছে। ব্যস, বাসর বাকি। বেলী তুই, ”
দেখা গেলো বেলী দু’হাতে কান চেপে চোখ বুঝে। সে বেশ কষ্টে ছোটো আওয়াজে বলল,
–” আপনার কথা বলতে হবেনা। চুপ থাকুন। প্লিজ। ”
বেলীর কথায় তৃষ্ণার গভীর কন্ঠের হাসি আবারও শোনা গেলো।

চৌধুরী বাড়িতে আয়োজন চলছে। আয়োজন হচ্ছে বউ উঠানোর। যা যা নিয়ম তা আলোচনা করা হচ্ছে। এবং যা যা লাগবে তৈরি করা হচ্ছে। সব তৈরি করে রাখবে। যাতে তৃষ্ণা বেলী আসলে সাথে সাথে উঠানো যায়।৷ ড্রয়িং রুমে বেশ কিছু শপিং। সেখানের মধ্যে সোফায় তৃষা বসে। তার সামনে তিনটে লেহেঙ্গা। সে বারবার কালো রঙের লেহেঙ্গা দেখিয়ে বলছে,
–” প্লিজ, প্লিজ। কালোটা পরতে দিবে ছোট ভাবীকে। কালোতে তাকে অনেক সুন্দর দেখায়। আর দেখো কালো’র জন্য ম্যাচিং জুয়েলারি বেশি সুন্দর। আর দেখো ভাইয়ার কালো পাঞ্জাবি কি সুন্দর ম্যাচিং যাচ্ছে। ”
জয়া একবার ধমক দিয়ে ফেলেছে,
–” বড়দের মাঝখানে এতো কথা কেন? চুপচাপ বসে থাকো। ”
তৃষা থেমে নেই,
–” এই মামী তুমি বলো কালো’টা বেশি সুন্দর না? এই লাল লেহেঙ্গা ক্যান্সেল। আমার ভাবী আমি কিভাবে, উঠাবো আমি ডিসাইড করব। ভাবীর আগমন কালো লেহেঙ্গা দিয়ে হবে। এটাই ফাইনাল। ”
আয়েশা হ্যাল্পল্যাসলি মাথা দুলালো,
–” আচ্ছা আচ্ছা বাবা। কালো ফাইনালেই। ”

অঞ্জলি কে চুপচাপ দেখা যাচ্ছে। চুপচাপ থাকলেও মুখে এক অদ্ভুত হাসি। কেমন অদ্ভুত আনন্দের ছোঁয়া। জয়া ব্যাপারটা বেশ কিছুক্ষণ যাবত লক্ষ্য করছে। এবং এটাও খেয়াল করেছে অঞ্জলি তাকে কিছু বলতে চাচ্ছে। এইবার যখন রান্নাঘর খালি হয়েছে, জয়া অঞ্জলির হাত ধরলো,
–” কি হয়েছে অঞ্জলি? কিছু বলবি? ”
অঞ্জলি মাথা নিচু করে। সে কিছু বলবে তার আগেই বাহির থেকে সোলাইমানের চিৎকার। সে চিৎকার করতে করতে প্রবেশ করছে। ড্রয়িংরুমে পৌঁছে দেখলো সোলাইমানের হাতে মিষ্টির ব্যাগ। সে ব্যাগটা রেখে দৌঁড়ে অঞ্জলিকে জড়িয়ে ধরে। তার ভিতর থেকে তীব্র খুশির হাসির আওয়াজে ড্রয়িংরুম আলোকিত। সে তারপর জয়াকে জড়িয়ে ধরে, ককিছুক্ষণ পর তার অনবরত কথা,
–” তোমার ছেলে বাবা হতে চলেছে মা। আহ। আমি বাবা হবো। আমি বাবা হতে চলেছি। আমাদের সন্তান এডোপ্ট করতে হবেনা। আমার অঞ্জলি মা হবে। ”
অঞ্জলি কেঁদে ফেলেছে। তার চোখের পানি দিয়ে মুখ ভেসে। আয়েশা পেছন থেকে অঞ্জলি’কে ধরে। বাড়িতে চিৎকার চেঁচামেচি শুরু। তৃষা লাফাচ্ছে। জয়া আনন্দে ছেলের মুখের দিক তাকিয়ে। তার ছেলে এতো সহজে ভেঙে পরে না। অথচ আজ তার ছেলের ভেঙে পরে যাওয়া মনেরে জীবন্ত হওয়ার রুপ দেখা যাচ্ছে। আজ সাত বছর যাবত তাদের বিয়ে হয়েছে। অথচ অঞ্জলি কানসিভ করতে পারছিলো না। একটার পর একটা ডক্টর, ট্রিটমেন্ট। কিছুই কাজে দিচ্ছিলো না। সবাই আশা হারিয়ে ফেলেছিলো একদম। এখন সেই হারিয়ে যাওয়া আশা পূর্নতা পেয়েছে। পূর্নতা পেয়েছে তাদের সকল করা দুয়া।
আমিদ আবিরের হাত থেকে মিষ্টি খেতে খেতে বলল,
–” দুয়া করেছিলাম। দাদা হওয়ার সুসংবাদ পেলে মাদ্রাসার এতিম বাচ্চাদের খাওয়াব। তা পূর্ণ করতে হবে। আমি কালই সব জোগাড় করব। ”
জয়া নিজেও মান্যত করে রেখেছে। অঞ্জলি, সোলাইমান তারা তো আরও বড়বড় মান্যত করে রেখেছে।

–” নাম। ”
বেলী বাহিরের পরিবেশ দেখে বলল,
–” রেস্টুরেন্ট? আমি যাবো না। বাড়ি যাবো। ”
–” ইউ চুজ ইট। ”
ব্যস। তৃষ্ণা তৈরি বেলীকে কোলে নিতে। কিন্তু এইবার সে সত্যি বেলীকে পাজাকোলে তুলে ফেলে। বেলীর অসাধারণ চিৎকার ও তাকে থামানো যাচ্ছে না। বেলী এবার মুখ ঢেকে ফেলে,
–” আল্লাহ। প্লিজ, প্লিজ। আমি যাবো। নামিয়ে দিন। প্লিজ, প্লিজ নামান। আল্লাহ প্রমিজ কিছুতেই আর না করব না। ”
এমন মধুময় কন্ঠের আবদার তৃষ্ণা উপেক্ষা করতে পারলো না। নামিয়ে দিলো। বেলী নেমে আশপাশ তাকাতে লাগলো। কিছু মেয়েরা দেখতে পেয়েছে। অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে। বেলী মুখ কালো করে ফেলল,
–” আমি বাড়ির কাপড় পরে। এগুলো পরে কেউ রেস্টুরেন্ট আসে। ”
তৃষ্ণার ত্যাড়া উত্তর,
–” কোথায় লিখা রেস্টুরেন্ট আসতে হলে, সেজেগুজে
আসতে হবে? ”
–” তাহলে, আপনি এভাবে সেজেগুজে এসেছেন কেন? ”
–” আমি সেজেছি? ”
–” অবশ্যই! ”
–” তুর সাজা লাগবেনা। আসবি না কোলে নিব? ”
বেলী মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে। তার প্রচন্ড অদ্ভুত লাগছে। সকলে কি সুন্দর সেজেগুজে বা সুন্দর ড্রেস পরে। অথচ সে। এভাবে যেতে বেলীর বিবেকে বাঁধছে। তৃষ্ণা বেলীর হাত টেনে নিতে নিতে বলল,
–” ছাঁদ বুক করা। কেউ থাকবে না। ”
–” এটা তো পাব্লিক। পুরো ছাঁদ বুক করতে দিলো? ”
–” হ্যাঁ। রেস্টুরেন্টের ওউনার আমার ফ্রেন্ড। ইশফাক। মনে আছে একবার তোকে চড় মেরেছিলাম মেইনরোডে? সেখানে যে বারবার আমাকে থামাচ্ছিলো সেটাই ইশফাক ছিলো। ”
বেলী স্তব্ধ হয়ে রইলো। সেই থাপ্পড়ের কথা আবার প্রাউড নিয়ে বলছে। বেলী আরেকদফা রেগে গেলো।

ছাঁদটা বেশ সুন্দর ভাবে সাজানো। রোমান্টিক সফট ট্যুন প্ল্যা হচ্ছে। নানান লাইটস জ্বলজ্বল করছে চারপাশ থেকে। মাঝে সুন্দর টেবিল স্যাট করা। অবশেষে তৃষ্ণার কথা সত্য হলো। পুরো ছাঁদ সম্পুর্ন ফাঁকা। এমন সিচুয়েশনে বেলীর কেমন রিয়েকশন থাকা উচিৎ সে বুঝতে পারছে না। হঠাৎ তৃষ্ণার হাত পিঠে পেয়ে চমকে যায়। তৃষ্ণা পেছন থেকে তাকে জড়িয়ে নেয়,
–” সবাই বলে, এখন তুই আমার বউ। আমার তোকে তুমি বলা উচিৎ। তুই কি বলিস তুমি করে বলব? ”
বেলী অতিরিক্ত লজ্জা পাচ্ছে। নাহলে বলতো,
–” না, আপনার মুখে আমার জন্য তুমি একদমই মানায় না। ”
অথচ উত্তর না দিয়ে বেলী চুপ মেরে রইলো। তৃষ্ণা বেলীকে নিজের দিক ঘুরালো। বেলীর দিক গভীর ভাবে লক্ষ্য করে বলল,
–” তোর আপনি আপনি ওল্ড হয়ে আছে। তোর মনে হয়না এটা পরিবর্তন করা উচিৎ? ”
বেলী দ্রুত মাথা দুলালো। যার মানে ” না!
–” মাথা দুলানো কি? এখন ছেড়ে দিচ্ছি। রাত্রে দেখব তোকে বাড়িতে। বাসর ঘরে! ”
তৃষ্ণার কথা শুনে বেলী চোখ বড়বড় করে ফেলল। এই ব্যাপারটা তার মাথায় একদম আসেনি। একদমই না।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here