অতৃপ্তির মাঝে তৃপ্তিময় সে পর্ব -০১

#অতৃপ্তির_মাঝে_তৃপ্তিময়_সে
#লেখিকা- সালসাবিল সারা

পর্ব-১.

(১)
–“খ’বরদার!আমার গায়ে হাত দেওয়ার কথা ভুলে যান।হাত সরান বোতাম থেকে।একবার যদি আমার হাত খোলা পায়,তবে দেখিয়ে দিবো আমার সাহস।”
নিজের সর্বস্ব হারানোর পূর্বে একজন মেয়ের এমন উক্তি মানতে নারাজ,আদ্রিন।মেয়েলি তুখোড় কণ্ঠটি ঠিক বাজের মতো তীক্ষ্ণ। করুণ পরিস্থিতিতে একজন মেয়ের এহেন কথা যেনো একেবারে বেমানান।মেয়েটা এখনো চিল্লিয়ে যাচ্ছে সমানতালে।অথচ,মেয়েটার কথায় লোকটার কাজে কোনো হেলদুল হচ্ছে বলে আদ্রিনের ধারণা নেই।চোখে পট্টি বাঁধা,গালের ভেতরকার অংশে কাপড়ে ঠাসা আবার তার উপর শক্ত কিছুর বাঁধন,হাত-পায়ের বাঁধনও তীব্রতার সহিত খিঁচে থাকায় কুপোকাত সে।কেবল মস্তিষ্ক তার সচল,তাও খানিক পূর্বে নিজের সজ্ঞানে ফিরেছে এই মানব।এরপরই মেয়েলী কণ্ঠের এমন শব্দ তার মস্তিষ্কে বিচরন করলো।মাথায় তার ভোতা যন্ত্রণা।মেয়েটির সামনে অবস্থিত পুরুষের অবয়ব,চালচলন এবং কথার আন্দাজে সবকিছুই ধোঁয়াশা আকারে তার চোখের সামনে ভাসমান।আঁখি দ্বারা পর্যবেক্ষণ না করেও আদ্রিন সবটা দেখছে এবং বুঝছে তার সিক্সথ সেন্সের সহিত।
ইতিমধ্যে নিজের দক্ষ কৌশলে হাতের বাঁধন খোলায় ফোকাস করলো সে।তার উপস্থিতিতে পাশে কোনো মেয়ের সম্মানহানি হবে,এটা আদ্রিন ইহকালে সম্ভব হতে দিবে না।লেগে পড়লো সে আড়ালে নিজের হাতের বাঁধন খোলার চেষ্টায়।এরই মাঝে অজ্ঞাত লোকের ঝাঁঝালো স্বর তার কানে ভেসে এলো,
–“এতো কি পড়িস কাপড়ের ভেতর?এখনো তো কাঙ্খিত বস্তু দেখলাম’ই না।তোর মুখ খুললাম আ’র্তনাদ শোনার জন্যে।আর তুই আমারে হু’মকি দেস?”
পরপর মেয়েটাকে আঘাতের শব্দ কর্ণপাত হলো আদ্রিনের।সম্ভবত ঘুষি দিয়েছে।ততক্ষণে আদ্রিন হাতের বাঁধন খুলতে সক্ষম।লোকটা লাল’সায় এতটা বুদ হলো যে ভুলেই গেলো,পাশে আদ্রিন নামক ছেলেটা ঠিক কতটা ভয়ঙ্কর!এই ছেলেকে অপ’হরণ করতেই তাদের তিনমাসের প্ল্যানিং এবং সেই প্ল্যানিং বাস্তবায়ন করতে আরো চারমাস লেগেছিল।একবার তো এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে কক্ষে উপস্থিত লোকটার কপালে সেলায়ের দরকার পড়েছিল।কারণটাও ছিলো অবশ্য আদ্রিন।ছেলেটাকে নাস্তানাবুদ করা অসম্ভব কাজের আওতায় পড়ে।কৌশলে আদ্রিন নিজের চোখ,মুখ এবং পায়ের বাঁধনে মনোনিবেশ করলো।এরমাঝে এক বিন্দুর জন্যেও সে ডানে বামে ফিরে প্রতিপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেনি।

(২)
শীতের দরুণ তৃপ্তির লং শার্টের ভেতরেও কাপড়ের কয়েক আস্তরণ বিদ্যমান।আর এতেই সামনের অপহরণকারীর যতো রাগ।তৃপ্তির সাথে কুইকি করতে চেয়েও মেয়েটার কাপড়ের স্তূপ তাকে বিষিয়ে তুলেছে।শেষ পর্যন্ত সফল হলেও,টাইট জিন্সের গণ্ডি হতে শেষ গেঞ্জিটা তুলতে না পেরে পুনরায় মুষ্টিবদ্ধ হাতের আঘাত দিতে ভুলেনি তৃপ্তির নাক বরাবর।নাকের অলংকারের দরুণ সেটা নাকে গেঁথে রক্তপাতের দেখা মিললো।
–“তোরে খা’ওয়ার সখ আমার মিটা গেছে। মা*! এতো কি পড়ছিস।খুল এটা।”
–“গাধার বাচ্চা।হাত খুল,এরপর বলিস।”
তৃপ্তি ব্যথাকাতর কণ্ঠে বললো।
ক্ষেপে গিয়ে লোকটা তৃপ্তির গেঞ্জি টেনে হিচঁড়ে ছিঁড়ে ফেললো।
এতক্ষণ সাহসী মনোভাব বজায় রাখলেও,তৃপ্তির অবস্থা এখন বেসামাল।গায়ে হাত না দেওয়ার জন্যে সে তীব্র কণ্ঠে চেঁচিয়ে যাচ্ছে।তৃপ্তির দৃশ্যমান বক্ষদেশের আন্ডারগার্মে’ন্টসে হাত দিতে গেলে,আদ্রিনের দানবীয় পায়ের আঘাতে সপাত হলো লোকটা।আদ্রিনের আঁখি জ্বলন্ত।যেনো ভস্ম হবে সামনে থাকা সেই কুলাঙ্গার।

–“মেয়ের দেহের তৃষ্ণা আমি মেটাচ্ছি তোকে।”
অতঃপর আদ্রিনের তীব্র আঘাতে লোকটা কুপোকাত।শব্দ করতেও পারছে না,আদ্রিনের পেশীবহুল বাহু তার গলায় পেঁচিয়ে থাকার দরুণ।

তৃপ্তি সংকুচিত।ইচ্ছে করছে নিজের জামার অবস্থা পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে দিতে।কিন্তু,কিছু করার নেই।হাত বাঁধা।আদ্রিনের শব্দ শুনে সে নিশ্চিন্ত কিছুটা।কারণ,এইখানে তিনজন মানুষের অবস্থান।তৃপ্তি,সাথে সেই লোকটা যাকে অপহরণের দৃশ্য দেখতে গিয়ে তাকেও এইখানে নিয়ে এসেছে অপহরণকারী।কাকে অপহরণ করেছে,এটা তৃপ্তি জানেনা।লোকটার চেহারা দেখার পূর্বেই চোখের সামনে সব তিমির হয়েছিল মেয়েটার।

আদ্রিন লোকটাকে বাঁধলো চেয়ারে।মুখের শক্ত বাঁধনে লোকটার গালটাই ছিঁড়ে যাওয়ার উপদ্রব।তৃপ্তির সম্মুখে না গিয়ে পেছনে হতেই হাতের বাঁধন খুলে দিলো আদ্রিন।হাতের বাঁধনের ছাড় পেয়ে তৃপ্তি সর্বপ্রথম তার কাপড় ঠিক করলো,পরপর খুললো চোখের বাঁধন।সবকিছু ঝাপসা।কয়েকবার পিটপিট করেও লাভ হয়নি।
লোকটার পকেট হাতড়ে ফোন উদ্ধার করে,তারই ফিঙ্গার প্রিন্টের সহিত মোবাইল লক খুললো আদ্রিন।আধুনিক প্রযুক্তির ভালো দিকের পাশাপাশি খারাপ দিকটাও যথার্থ। বাঁকা হেসে আদ্রিন ফোন লাগালো কাঙ্খিত নাম্বারে।কল রিসিভ হতে সময় লাগলো কয়েক সেকেন্ড।হয়তো অপর পাশের মানুষটা ফোনের অপেক্ষায় ছিলো!
–“আমি কোথায় জানিনা,আম্মি।বাট,ফোন ট্র্যাক করো।আমি মুক্ত।বেরুনোর চেষ্টা করবো।পারলে জানিয়ে দিবো লোকেশন।আর না পারলে এইখানে থাকবো।”
মায়ের বক্তব্য না শুনেই আদ্রিন ফোন রাখলো।

ধীর পায়ে হেঁটে তৃপ্তির সামনে গেলো সে।মেয়েটা আঁখি বুঁজে। নাক নিয়ে ব্যস্ত কিছুটা।আদ্রিন পকেট হাতড়ে রুমাল এগিয়ে দিলো তৃপ্তির পানে,
–“এটা দিয়ে..।”
বলতে গিয়েও থামলো আদ্রিন।মেয়েটাকে দেখে কিশোরী মনে হচ্ছে তার।বড়জোর সতেরো হবে বয়স! ঊনত্রিশ বছরের জোয়ান যুবক এমন হাঁটু বয়সী মেয়েকে আপনি বলাটা কেমন বেমানান।তাও নিজের ভদ্রতার গুণকে প্রকাশ্যে প্রকাশ করে সে বললো,
–“টেক দিজ।নাকে চেপে ধরুন। ব্লা’ড যাওয়া বন্ধ হবে কিছুটা।”
দৃষ্টি না মিলিয়ে হাত বাড়িয়ে রুমাল নিয়ে নাকে চাপলো তৃপ্তি।তার পিঠের মধ্যভাগ সমান চুল চারিদিকে পেখম মেলেছে।
–“থ্যাংকস।”
তৃপ্তি মলিন কণ্ঠে বললো।
আদ্রিন পকেটে হাত দিয়ে একবার তৃপ্তির পানে দৃষ্টি নিক্ষেপ করছে তো আরেকবার দরজার দিকে।এই মুহূর্তে বাহিরের অবস্থা না জেনে এইখান থেকে বেরুনো বিপজ্জনক। বাঁচার সম্ভাবনা নাও থাকতে পারে।রাজনৈতিক পরিবারের উত্তম বংশধর হওয়ায় আদ্রিনকে এমন হুটহাট হামলা,অপহরণের অপচেষ্টা সহ্য করতে হয় বারংবার।মাঝে মাঝে গার্ড থাকে,তবে আজ সে একা ছিলো।নিজের ব্যবসায় সে ব্যস্ত।ব্যক্তিগত ভাবে রা’জনীতি তার অপছন্দ,তাই সেই খাতায় নাম লেখায়নি আদ্রিন।এই নিয়ে মায়ের সাথে কম ঝামেলার সম্মুখীন হয় না সে।
দরজা হতে দৃষ্টি সরিয়ে তৃপ্তির পানে গম্ভীর নজরে দৃষ্টি জ্ঞাপন করলো মানবটা।এই মেয়েকে কেনো তার সাথে অপহরণ করেছে এটা তার চঞ্চল হৃদয় ব্যাপক জানতে চায়।মনের মাঝে প্রশ্ন তৈরি করে সিদ্ধান্ত নিলো,এমন হাঁটু বয়সী মেয়েকে সে আপনি বলে সম্মোধন করবে না।

–“তোমাকে কিডন্যাপ করার কারণ?”
পকেটে হাত গুঁজে মেয়েটার পানে চেয়ে সে। তৃপ্তি নিজের পূর্বের অবস্থা বহাল রাখলো,
–“আপনাকে কিডন্যাপ করার সময় আমি সেদিকেই ছিলাম।এটাই আমার কাল।শর্টকাটে বাড়ি ফিরতে গিয়েই এমন দুর্গতি।”
আদ্রিন খানিকটা ভাবলো।রাস্তাটা শর্টকাটের জন্যে সেও ব্যবহার করেছিল,কিন্তু কে জানতো এমন একটা পরিস্থিতি হুট করেই চলে আসবে সম্মুখে।
–“ওহ,আচ্ছা।কাউকে ফোন করবে কি?নিশ্চয় তোমার বাড়ির সকলে চিন্তিত?”
আদ্রিনের কথায় তৃপ্তি কানের পিছে স্বর্ণ-কালো রঙ মিশেলের চুল গুঁজলো,
–“কেউ নেই চিন্তিত।”
তৃপ্তির উত্তরে সটান ভ্রু কুঁচকে এলো আদ্রিনের।
পুনরায় প্রশ্ন না করে সে মায়ের নাম্বারে ফোন লাগালো।এইখান থেকে বেরিয়ে বাকি প্রশ্ন করা যাবে বলে ভাবলো আদ্রিন।যেই ভাবা তার সেই কাজ।

তৃপ্তি ব্যথিত হৃদয়ে ভেবে যাচ্ছে,কে আছে তার কথা ভাবার?মা নেই আজ পাঁচ বছর।বড় ভাই নিশ্চয় বাবার পাঠানো টাকায় নেশায় মত্ত।আর ছোট বোন ‘প্রিয়’ নেয়ে খেয়ে পুতুল খেলায় ব্যস্ত অথবা চামেলীর সাথে ঘুমে।তারা হয়তো এতটুকু ভাবছে না,তৃপ্তির কোনো বিপদ হতে পারে।তারা তো জানে,তৃপ্তি কাজে।তার কাজের শেষ নেই।আর বাবা!বাবার কথা তার স্মরণে আনতেও রুচিতে বাঁ’ধে।
খানিক বাদে শব্দমান হলো দরজায় খট খট শব্দ।তৃপ্তি চমকালো না।কেনো যেনো মনে হলো,এই পুরুষের উপস্থিতিতে তার কিচ্ছুটি হবে না।কক্ষের অপহরণকারী এখনো অজ্ঞান।তারই গলার স্বর নকল করে আদ্রিন প্রশ্ন করলো,
–“কে?”
–“ঐ মামা।এখনো কাম শেষ হয় নাই?মাইয়্যাটারে খাইবা কইয়া ঢুকছো আর খবর বাতি নাই।বড় সাহেব কইছে আমাগো উপরের তলায় থাকইতে।এই দুইজনের কাছে সর কাউকে থাকইতে মানা করছে। শুধু কইলো,ইনজেকশনের কড়া ডোজ দিয়া তাগো অজ্ঞান রাইখতে।”
অজ্ঞাতনামা ছেলেটি বলে যাচ্ছে হুরহুর কণ্ঠে।যেনো তার অনেক তাড়া।
–“তুই যা।আমি আসছি।”
ছেলেটা চলে যাওয়ার শব্দ হলো।

আদ্রিন তৃপ্তির সম্মুখে এসে প্রশ্ন করলো,
–“ব্লিডিং বন্ধ হয়েছে?”
রুমাল সরিয়ে এইবার তৃপ্তি তার সম্মুখে দাঁড়ানো বলিষ্ঠ দেহের অধিকারী লোকটার পানে তাকালো।তৃপ্তি যতোই না চমকিত,তার চেয়েও বেশি চমকিত আদ্রিন।তৃপ্তির এই চোখ জোড়া,বোচা নাক, খরশান চোয়াল, চীনদেশীয় মেয়েদের লাহান মুখের গঠন সবকিছুই তো মিলে যাচ্ছে ছবির সেই মেয়ের সাথে।চুলের রঙ পর্যন্ত একই। শুধু তফাৎ বেশভূষায়।ছবির মেয়েটা ছিলো কালো রঙের জামদানি শাড়িতে আবৃত আর আজকের মেয়েটা লংশার্ট, জিন্সে।তবে,একই মেয়ে।এই মেয়ের খোঁজ আদ্রিন কতো জনের দ্বারা করিয়েছিল ইন্ডিয়া থাকাকালীন!বরংচ গত সপ্তাহে দেশে ফিরেই,প্রত্যেকটা দিনই এই মেয়ের সন্ধানে অনেক লোককে মোটা অংকের টাকা দিয়েছে।আর সেই মেয়ে কিনা আজ তার সামনে!তাদের সরাসরি দেখা হ‌ওয়ার নিয়তি এমন হবে এটা মানতে নারাজ আদ্রিন।ব্যাবসায়িক কাজে ইন্ডিয়া অবস্থানকালীন,বিয়ের জন্যে মেয়ে পছন্দের করার তাগিদে তার মা ছবি পাঠালে; এইযে তার সামনে অবস্থানরত মেয়েকে তার মনে ধরে।মাকে জানালে,সে একদিনের খোঁজ নিয়ে মেয়েটাকে বিয়ে করতে না করলো।মায়ের সাথে কথা না বাড়িয়ে আদ্রিন নিজেই মেয়েটার সব খবর নিতে চেয়েও বারবার ব্যর্থ হচ্ছিলো।কারণ,ছবিতে শুধু তার অবয়ব ছিলো,না কোনো নাম বা ঠিকানা।এইসবের দায়িত্ব তার মায়ের ছিলো,তার দায়িত্ব ছিলো কেবল মেয়ে পছন্দ করা।

(৩)
আদ্রিনকে বিস্ফোরিত হতে দেখে খানিক চমকালো তৃপ্তি।আদ্রিনকে সে চিনে।পরিচিত এক মুখ আদ্রিন।পুরো নাম,আহানান শেখ আদ্রিন।তবে,এই পরিচিতির পূর্ব হতেও আদ্রিনকে মনে ধরেছিল তৃপ্তির।তবে,না কখনো প্রকাশ করেছিল না কখনো ব্যক্ত করবে এই মনের আভাস।বহু বছর খানেক পূর্বে বাবার বাড়ি থাকাকালীন আদ্রিনকে ক্রিকেট খেলতে প্রায় দেখতো তার কাকাতো ভাইদের সাথে।সেখান থেকেই আদ্রিনের জন্যে মনে নরম দিক তৈরি হয়।তবে,হাওয়া হয়েছিল আদ্রিন।তার কঠিন ব্যক্তিত্বের কথা শুনে,কখনোই মনের কথা কাউকে জানায়নি।উল্টো,ইন্টারে উঠেই আদ্রিনের চেহারার সাথে মিল ছিলো এমন এক আহাম্মকের সাথে ছয় মাস প্রেম করে নিজেই তাকে ছেড়েছিলো তৃপ্তি।আদ্রিনের মতো দেখতে হলেও,
ছেলেটা ছিলো অকর্মার ঢেঁকি।এখনো তৃপ্তির ব্যথিত হৃদয়ে দাগ কেটে আছে দুর্দান্ত তামাটে রঙের সুদর্শন এই যুবক। যার এখন শরীর এবং চেহারায় ভরপুর ভরাট গাম্ভীর্যতা এবং তীব্র চাকচিক্যতা।

দৃষ্টি মেলার পর অনেক্ষণ সময় কাটলো।দু’জনে দু’জনাতে মশগুল।তবে,মনের চাঞ্চল্যতাকে বেশি দূরে এগোতে দিলো না তৃপ্তি।বাবার জন্যে মায়ের অবস্থা ভোলা কখনো সম্ভব নয়।

–“কমেছে।”
তৃপ্তির কণ্ঠস্বরে ঘোর কাটলো আদ্রিনের।সেদিনের ছবির মেয়েটা অন্তরের গহীনে এতদিন বাস করেছে আর আজ মেয়েটা তার সামনে।নজর ফেরানো দায় তার।অথচ,চেহারা না দেখা অব্দি মেয়েটাকে সে কিশোরী ভেবেছিল। তবে,এখনো আদ্রিন সঠিক নয়,তৃপ্তির রহস্য সম্পর্কে।

–“আমাদের এখন বেরুনো উচিত।লোকটার কথায় বুঝলাম,সকলে এখন উপরে।আমরা অনায়াসে বেরুতে পারবো।”
আদ্রিন তৃপ্তির রক্ত জমে থাকা নাকের পানে দৃষ্টি দিলো।কেমন যেনো ব্যথিত হচ্ছে তার পাষাণ হৃদয়।ব্যথায় মেয়েটার মুখটা একটুখানি।সেদিন ছবিতেই তৃপ্তির মাঝে হারিয়েছিল সে নিজেকে।তবে সে জানেনা,আর কিছুক্ষণ দুইজনে একই সাথে কাটালে,তৃপ্তির শুভ্র হলদেটে অবয়বের ভালোবাসায় না মত্ত হয়ে যায় সে!আদ্রিন নিজেকে সামলানোর ব্যর্থ চেষ্টায়।তবে সে নিরুপায়,ছবির মানুষটার জন্যে মরিয়া হয়ে উঠা আদ্রিন আজ নিজের উপর নিয়ন্ত্রনহীন।

তৃপ্তি উঠে দাঁড়ালো চেয়ার হতে।উচুঁ সু পড়েও মাথা তার আদ্রিনের কাঁধ অব্দি।খানিক লজ্জা পেলো যেনো তৃপ্তি।বাধ্য মেয়ের মতো চুপচাপ হাঁটতে আরম্ভ করলো সে।দরজা হতে বেরুতেই আচমকা এক কাজ করলো আদ্রিন, তৃপ্তির হাত নিজের মুঠোয় নিলো।কম্পিত হলো দু’জনের তনু।অপরাধী কণ্ঠে আদ্রিন বললো,
–“কিছু মনে করো না।উচুঁ নিচু কংক্রিটে পা মচকে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি।”
তৃপ্তি খেয়াল করলো মেঝেতে।আসলেই তো কংক্রিটে তার পা বেঁকে যাচ্ছে।তার উপর উচুঁ জুতো।তৃপ্তি ঠিকভাবে পা ফেলতে নিজের উপর হাত দিয়েও আঁকড়ে ধরলো আদ্রিনের হাত।
সামান্য এক মেয়ের স্পর্শে আদ্রিনের কেমন নতুন অনুভূতির সঞ্চার হয়।অথচ, দেশ বিদেশে কতো মেয়ে বান্ধুবি,কলিগের সাথে হাত মিলিয়েছে কাজের উছিলায়।কই তখন তো এমন অনুভূতি হয়নি।তৃপ্তি তার অন্তরের বিশেষ কিছু হতে চলেছে বলেই কি মনের অনুভূতির এই পরিবর্তন!
আদ্রিনের ফোন বাজছে তথা সেই অপহরণকারীর ফোন।আদ্রিন দ্রুত বাটন চেপে সাইলেন্ট করলো মোবাইল।মেইন দরজার দিকে যাওয়ার ভুল করলো না।আদ্রিনের পরিকল্পনা অনুযায়ী তারা বাথরুমের উপরের দেওয়াল টপকে পালাতে সক্ষম হলো।অথচ, কেউ টের‌ই পেলো না।পাবে কিভাবে?তারা কেউ কেউ নেশায় বুদ আর কেউ মেয়েলি বেহায়াপনায় মত্ত।তাদের ধারণা,আদ্রিন আর তৃপ্তি সেই লোকের বন্ধীতেই আড়ষ্ট।

বেশ দূরত্বে এলে হাঁফ ছাড়ে দুইজনই।তৃপ্তি বুকে হাত রেখে শ্বাস ফেলছে।দৌড়ানোর ফলে এই হিম শীতেও যেনো উষ্ণতার ধোঁয়া ছড়াচ্ছে তনু।আদ্রিন আড় চোখে তৃপ্তির হলদেটে গালের রক্তিম আভা পর্যবেক্ষণ করছে নিভৃতে।বিধাতা কি তাদের ভাগ্যে লেখনির জোরে তাদের সরাসরি সাক্ষাৎ করিয়েছে!তবে আদ্রিন মনে মনে ঠিক করলো,বিধাতার এই বিধান আদ্রিন তার শেষ নিশ্বাস অব্দি পালন করবে।কি সাধারণ তার মনোভাব,অথচ এখন অব্দি মেয়েটা নাম জানলো না সে।নিজের মনোভাবে নিজেই হাসলো কিছুটা।কিন্তু,তার অন্তর গহীনে মেয়েটাকে নিয়ে নিজস্ব পরিকল্পনা এখন কেবল বাস্তবায়নের আশায়।

ফোনে গার্ড এবং পুলিশদের সকল তথ্য জানালো আদ্রিন।তারা এখন পুলিশ বক্সের সামনে ব্যাপক নিরাপদে।
–“তোমার নাম?”
–“তৃপ্তি।তাসরিয়া জামান তৃপ্তি।”
–“আমি আহানান শেখ আদ্রিন।”
তৃপ্তির ইচ্ছে করলো চিল্লিয়ে বলতে,আপনাকে আমি চিনি।কিন্তু, বলা হলো না তার।আগের মতো কিছুই তো নেই তার জীবনে।
–“আমার কিডন্যাপিং দেখতে গিয়ে নিজেই এমন অ্যাডভেঞ্চারের শিকার হয়েছো।ব্যাপারটা খুবই জঘন্য,তাই না?”
জঘন্য?সত্যি কি জঘন্য?মন থেকে উত্তর এলো,”না”।হঠাৎই এই মানুষের দেখা পাওয়া তাও এতো বর্ষ বাদে,ব্যাপারটা কখনো জঘন্য হবে না।কিন্তু,নিজের ছোট ব্যাবসা নিয়ে কিঞ্চিৎ তৃপ্তি।তার পার্টনার,বান্ধুবী ‘আলেয়া’ একা কি সামলাতে পেরেছে?সে যায় হোক,আজ তৃপ্তি ক্ষণিকের জন্যে হলেও খুশি কিছুটা।অধরে হাসির রেখা টেনে বললো,
–“নাহ, অ্যাডভেঞ্চার আমার পছন্দের।”
প্রত্যুত্তরে আদ্রিন জবাব দিলো,
–“সেম হেয়ার।”

গরম কফির ধোঁয়া উঠা মগের দিকে তৃপ্তি তাকিয়ে।ছোট বোনটা কি করছে এই নিয়ে তার মাথাব্যথা।যদিও জানে বাচ্চাটা ভালো আছে,তাও মনের মাঝে একটা বিশাল পাথর।আদ্রিন তার অবস্থা লক্ষ্য করে শুধালো,
–“কফি ঠান্ডা হচ্ছে।”
তৃপ্তির ঘোর ভাঙলো ভরাট কণ্ঠ কর্ণপাতে।আদ্রিনের দিকে দৃষ্টি দিতেই দেখলো সাদা হুডিতে আবৃত ছেলেটা কফিতে মশগুল।অতীতের সেই অনুভূতি আবারও হানা দিতে চাইলে জোরপূর্বক মনের দরজা বন্ধ করলো তৃপ্তি। মায়ের দশা সে কস্মিককালে নিজের জীবনে আসতে দিবে না।
–“খাচ্ছি।”
আদ্রিনের নজর শকুনের মতো প্রখর।মানুষকে দেখেই তার ভেতরকার বাহিরের সকল পেরেশানি ধরতে পারে অত্যন্ত নিখুঁতভাবে।তাই কথাবার্তা চালানোর সিদ্ধান্ত সে’ই নিলো।কারণ,তৃপ্তি একটু চাপা আর শক্তমুখী স্বভাবের;বুঝতে বেগ পেতে হলো না আদ্রিনের।
–“কিসে পড়ো?”
আদ্রিন’ই কথাবার্তা শুরু করলো।
–“অর্নাস থার্ড এ।”
–“আর আমি ভেবেছি তুমি কেবল কিশোরী।”
হাসলো আদ্রিন।চাপা দাড়ির আড়ালে অবস্থিত তার পাতলা অধর প্রশস্ত হলো।তৃপ্তিও খানিক হাসলো।অবাক বনে যায় আদ্রিন।মেয়েটার হাসিটা মারাত্মক। চীনদেশীয় মেয়েদের চেহারার অধিকারী এই মেয়ের হাসি যেনো মৃ’ত্যু ফাঁদ।আর এই ফাঁদে পা দিয়েছে আদ্রিন মনের অজান্তে।
–“হুম,এইযে শার্ট স্কার্ফ দিলে একটু ব্যতিক্রম লাগে।”
কথা শেষে স্কার্ফ খুঁজতে নিলে তব্দা খেলো তৃপ্তি।তার গায়ে স্কার্ফ নেই।সেই জানোয়ার টেনে নিয়েছিল আর স্কার্ফ মাটিতেই। এতক্ষণ হুঁশ না হলেও মেয়েটা এখন বেশ লজ্জিত। হাজার পশ্চিমা পোশাক পড়লেও মেয়েটার তনুতে স্কার্ফ/ওড়না নামক জিনিস থাকে।তার অস্বস্থি বুঝতে পেরে আদ্রিন বললো,
–“কার সাথে থাকো?”
–“ভাই,বোন আর চামেলী।”
–“মা,বাবা?”
–“মা নেই।বাবা আছে।তবে আমার কাছে বাবা নেই।”
হাসলো তৃপ্তি।আঁখি ছলছল তার।তবে অশ্রু গড়তে দিলো না।পলক ঝাপটে সামলে নিলো।
–“তো তখন বললে কেনো কেউ নেই?”
–“এইভাবেই।”
তৃপ্তির কণ্ঠ ব্যথিত।ভেতরকার সত্তা নড়ে উঠলো আদ্রিনের।মেয়েটা যথেষ্ট সাহসী আর মনের দিক দিয়ে শক্ত।তবে,কোথাও যেনো মেয়েটা একা;তীব্র একাকীত্বে তার জীবনটা তিমির।

(৪)
আদ্রিন আর ভাবার সুযোগ পেলো না।পরপর চারটি গাড়ি এসে থামলো।সকল পুরুষ পুলিশের সাথে কথায় ব্যস্ত হলো নিমিষেই।নিশ্চয় অপহরণকারীরা এখন তাদের মৃত্যুর অপেক্ষায়।

শেষের গাড়ি হতে নেমে এলো এক লম্বা মহিলা।বাংলাদেশে এমন উচ্চতার মহিলা খুব কম দেখা যায়।তৃপ্তি লক্ষ্য করলো মহিলার মাথা আদ্রিনের নাক বরাবর।ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে চেয়ে দেখে তাদের কাহিনী।মহিলা আদ্রিনকে বুকে টেনে নিতে চাইলে আদ্রিন সরে যায়,
–“আই’ম নট এ বেবি, আম্মি!”
ভদ্রমহিলা আবারও তাকে কাছে টানতে নিলে মেজাজ দেখায় আদ্রিন।গাড়িতে উঠার তাড়া দিলে হাত নাড়িয়ে ডাকে আদ্রিন তৃপ্তির নাম ধরে,
–“আসো তৃপ্তি।”
চমকে উঠে ইনায়া শেখ।এই নামের মেয়েটাকে তো তার ছেলে পছন্দ করেছিলো।তখন অব্দি সে জানতো না তার ছেলের পছন্দের মেয়ে,অরিত্রন চট্টোপাধ্যায় এবং পান্না রহমানের প্রথম কন্যা।আজ‌ও হলো সেটা।দৃষ্টি তৃপ্তিতে আবদ্ধ মা-ছেলে দুইজনেরই। ইনায়া বিস্ফোরিত নজরে চেয়ে।একেবারে পান্নার চেহারার মতো মেয়েটা।
এই মেয়ের সাথে তার ছেলের কিভাবে দেখা?ছেলেটা আর থেমে থাকবে না এখন।তবে কম নয় ইনায়া,
–“কে এই মেয়ে? ও কেনো আসবে?”
কথায় এবং ভাব-ভঙ্গিতে কেবল নাটকীয়তার সুর।
–“আমার পরিচিত।আমার গাড়ি করে যাবো আমরা,
আমার টাকায় কেনা যেটা।সাদা প্রিমিও গাড়িটা আমার।”
–“নিজের দুই গাড়ি ছাড়া তো নিজেই উঠো না তুমি অন্য গাড়িতে।তাই নিয়ে আসা।”
ইনায়া যেনো বিরক্ত।
–“তাই আমরা সেটাতেই যাবো।”
আদ্রিনের কথায় বাঁধ সাধলো তৃপ্তি,
–“আমি একা যেতে পারবো।হেল্প করার জন্যে থ্যাংকস অনেক।”
তৃপ্তি উল্টো পথে হাঁটতে নিলে পথ আটকে নেয় আদ্রিন,
–“দেখো আমি এক কথার মানুষ।ঘড়িতে রাত বারোটা।কথা বাড়ানোর প্রয়োজন আমি দেখছি না।”
আদ্রিন নিজের গাড়িতে ঠেলে বসলো তৃপ্তিকে।মায়ের উদ্দেশ্যে বললো,
–“তুমিও চাইলে আসতে পারো আমার গাড়িতে।”
–“মেয়েটা..!”
ইনায়া কিছু বলতে নিলে পুনরায় আদ্রিন আওড়ালো,
–“কপালের লিখন খোদা ছাড়া কেউ বদলাতে পারেনা, আম্মি।”

অতঃপর গাড়ি ছুটলো।ইনায়া বাঁকা হেসে।আদ্রিন জন্মের সময় বড্ড কষ্ট পেয়েছিল ইনায়া,সাথে বাঁচার জন্যে লড়াই করেছিল তার প্রাণপ্রিয় ছেলে।ছোট অবস্থায় বাঁচার যুদ্ধের মতো আদ্রিন এখনো এমন একরোখা।যেটা তার মন চায় সেটা সে হাসিল করে।তবে ইনায়া কিছুতে কম না।আদ্রিনের মা সে,কম হবেই বা কিভাবে?

সারা গাড়িতে আদ্রিন,ক্লান্ত তৃপ্তির মুখপানে চেয়ে।মেয়েটার মুখের গঠন ভারী রহস্যময়ী সাথে তার মাঝে উপস্থিত তীব্র আবেদন।তৃপ্তির দেওয়া ঠিকানায় গাড়ি থামলো।এই এলাকায় তৃপ্তি থাকে শুনে অবাক হয়েছিল আদ্রিন।তার বড় বোনের শ্বশুরবাড়ি এই এলাকায়।অভিজাত এলাকার মধ্যে এই এলাকা অন্যতম।আদ্রিন একবার ভাবে,মেয়েটার কথা মতে সে অত্যন্ত সাধারণ হওয়ার কথা ছিল।তবে এখন তার সবটা রহস্য মনে হচ্ছে।আদ্রিন রহস্যপ্রেমী।তাই এই রহস্যমানবীতে সে যেনো আরো বুদ হলো।
গাড়ি হতে নামলো তৃপ্তি।মুখে ক্লান্তি মাখা হাসি,
–“আজ খুব ক্লান্ত আমি।চেয়েও আজ বাসায় ডাকতে পারলাম না।”
–“ব্যাপার না,অন্যদিন আসবো।”
আদ্রিন হাসলো কিছুটা।
–“জ্বী,অবশ্যই।ধন্যবাদ অনেক।”
–“মুখে ধন্যবাদ গ্রহণযোগ্য নয়।চাইলে একটা কফি ট্রিট দিতে পারো।”
–“কেনো নয়!”
–“মুহিত, তোমার ফোনটা দাও।”
ড্রাইভার নিজের মোবাইল এগিয়ে দিলে আদ্রিন নাম্বার জোগাড় করলো তৃপ্তির।
–“আসি তবে।কফি ট্রিটে দেখা হবে তাহলে।”
হেসে বিদায় নিলো তৃপ্তি।

প্রেমযুগ্ন দৃষ্টি আদ্রিনের। কয়েকঘন্টায় মনে হচ্ছে মেয়েটা তার কতো আপন!গাড়ি পার করছে একের পর এক বিল্ডিং।আদ্রিন ভাবছে,খুব ভাবছে।অতঃপর উপলব্ধি করলো,মনের টানেই তৃপ্তি তার নিকট এতো আপন।কোন একদিন হবে,সে তার সবচেয়ে আপনজন।তৃপ্তির বলা শেষ কথাটার উত্তরে সে বেশ উচ্ছ্বাসের সাথে আপন মনে আওড়ালো,
–“কফি খাওয়া তো একটা বাহানা।এই মন শুধু আরেক পলক তোমাকে দেখার অপেক্ষায়,তৃপ্তিময়ী।”

ছেলেটা কেমন স্বার্থপর,মেয়েটার মত না জেনেই নিজে সবটা পরিকল্পনা করে নিচ্ছে।হয়তো,তার এই স্বার্থপরতার জন্যেই তাদের মিলনটা হবে ব্যাপক পাগলাটে,তীব্র চাওয়াতে ভরপুর!

চলবে…..
কপি করা বারণ।কেমন হয়েছে গল্প অবশ্যই জানাবেন।অনেক কিছুর খোলাসা বাকি এখনো।উপন্যাসের ক্যাটাগরি: রোমান্টিক,অবেসেশন,থ্রিলার।

–পিক কালেকশন: মেহেজাবিন হাসান রিয়ার (ইনস্টাগ্রাম থেকে নেওয়া)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here