অতৃপ্তির মাঝে তৃপ্তিময় সে পর্ব -৩৬ ও শেষ

#অতৃপ্তির_মাঝে_তৃপ্তিময়_সে
#লেখিকা- সালসাবিল সারা
পর্ব -৩৬(অন্তিম পর্ব)
প্রথম অংশ
————————
৭৮.
–“তৃপ্তি,তুমি ভেতরে যাও।সবার সাথে থাকো।”
কণ্ঠে ব্যাকুলতা আদ্রিনের।
ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয় মুহূর্তেই।সঠিক সময়ে তৃপ্তি নিজেই সরে যায়।যার দরুণ বিরাট বিপদ হতে রক্ষা পায় সে।তৃপ্তিকে আগলে নেয় আদ্রিন।খুব করে বলে ভেতরে যেতে।বাড়ির বাকি সবাই নিজের সুরক্ষার পানে ছুটে।ঘর নিরাপদ।তৃপ্তি ঝাপটে ধরে আদ্রিনকে।সে একা যাবে না।ক্লান্ত সুরে তৃপ্তি তার বাহু খাঁমচে বলে,
–“আপনিও বাসায় আসবেন।”
দু’হাত তৃপ্তির মুখমণ্ডলে ঠেকে আদ্রিন।তৃপ্তি কেঁদে অস্থির।তারা পিলারের আড়ালে।আদ্রিন তৃপ্তিকে শান্ত করার দৃশ্য অবলোকন করলে পরিবারের লোকেরা সেথায় যায়নি আর।
আদ্রিনের আঁখি বেজায় লাল।মুখশ্রী রক্তিম।ছেলেটা শঙ্কিত।ভাগ্যিস ঠিক সময়ে তৃপ্তি নিজেই সরেছিলো।নাহলে আজ যা হতো,এরপর কি ছেলেটা বেঁচে থাকতো?তৃপ্তির কোমরে হাত পেঁচিয়ে নেয় সে।অন্যহাতে গাল মুছে দেয় সে তৃপ্তির,
–“ভেতরে যাও।ডিনার সেরে ঘুমাবে।আমি আসবো।”
তৃপ্তি মাথা নাড়ায়।শক্ত করে আগলিয়ে নেয় আদ্রিনের পিঠ তার হাতের বাঁধনে। আদ্রিন কিছু বলেনি।মিনিট এক পরে তৃপ্তিকে জোর করে রুমে নিয়ে আসে।

উপস্থিত ঘরের সদস্য আদ্রিন এবং তৃপ্তিকে চিন্তিত দেখে নিজেরা আর কথা বাড়ালো না।তাদেরকে নিজেদের মতো থাকার জন্যে ছাড়লো।রিয়ানা মাকে ফোন করে সবটা জানালে,ইনায়া দ্রুত পার্টি অফিস হতে বেরোয়।আদ্রিনের নির্দেশে ঘটনার সাথে সাথেই গার্ড এবং সংরক্ষিত অফিসার সেই হামলাকারীর উপর অ্যাকশন নিয়েছে।বাকি খবর হতে আদ্রিন বেখবর।তার সম্পূর্ণ দায়িত্ব এখন তৃপ্তিকে সামলানো।

আদ্রিন তৃপ্তিকে বিছানায় বসায়।চারিদিকের পর্দা ঠিক করে।কেমন ভার হয়েছে তার হৃদয়।তৃপ্তির কান্না থামেনি।দুহাতে মুখ ঢাকে সে।আদ্রিন মেঝেতে বসে।তৃপ্তির কোলে মাথা রাখে।দুইহাতে মেয়েটার কোমর টেনে দূরত্ব ঘুচায়।তৃপ্তি হাত সরিয়ে আদ্রিনের মাথায় হাত রাখে,
–“কি হয়েছে?খারাপ লাগছে?”
হেঁচকি উঠে যায় তৃপ্তির।আদ্রিন মাথা তুলে,হাঁটুতে ভর দেয়।কান্নারত তৃপ্তির কাঁপা অধরে নিজ অধর স্পর্শ করে। ঘাড়ে আঙ্গুল চাপে দৃঢ়ভাবে। তৃপ্তি তার কাঁধ ঠেলে সরাতে চায়।কিন্তু পারেনি।আদ্রিন অনেকটা উন্মাদ।রাগে সে জ্বলে যাচ্ছে,তৃপ্তির অজানা নয়।পরক্ষণে তৃপ্তিকে ছাড়লে,মেয়েটা শ্বাস নেয়।
আদ্রিনকে পাথর দেখাচ্ছে। দুজনের দৃষ্টি মিললে তৃপ্তি শাড়ির আঁচল ঠিক করে।আদ্রিনের ছোঁয়ায় সবটা এলোমেলো।

–“আপন মানুষের দ্বারা আর কতবার আমি প্রতারিত হবো?”
কন্ঠস্বরে বেজায় উত্তাপ আদ্রিনের।তৃপ্তি উল্টো হাতে গাল মুছে।প্রশ্ন করার পূর্বেই আদ্রিন জবাব দেয়,
–“তোকে মারলে,আমি শেষ হবো এটা চাচা জানতো।চাচাকে আমি শাস্তি দিবো কিভাবে?”

তৃপ্তির পা হতে জমিন সরে।অতীতের এবং আজকের সকল ঘটনার সাথে রাফির বাবা জড়িত?কি ক্ষতি করেছে তৃপ্তি তার?কোনোদিন মেয়েটা তাদের সাথে নজর মিলিয়ে কথা বলেনি।তাহলে!নিজের ভাইয়ের ছেলের সর্বনাশের জন্যে একজন নিরীহ মানুষের প্রাণ নিতে তার দ্বিধা হয়নি?বিবেকে বাঁধা দেয়নি?
–“রাফির বাবা সবটা করেছে?আপনার ক্ষতির জন্যে আমাকে মারতে চেয়েছে!”
–“মেহেবুবা,কাঁদে না আর।দেখি,চোখ লাল হচ্ছে রে জান।”
আদ্রিন সযত্নে তৃপ্তির চোখের পানি মুছে।মস্তিষ্কে উন্মাদনা কমে এখন প্রশ্ন উত্তরের খেলা ঘুরছে তার।পরপর তৃপ্তির ভেজা গালে অধর ছোঁয়ায়,
–“আপুকে বলছি তোমার সাথে থাকতে।আমি বেরুচ্ছি।”
আদ্রিন উঠে পড়ে দ্রুত।নিজের এলোচুলে হাত বুলায়।

তৃপ্তি দূর্বল দৃষ্টিতে তার পানে চেয়ে।লম্বা কদমে আদ্রিন দরজার নিকট পৌঁছায়।দরজা খুললে তার মা,বোন, চাচিরা,তৃপ্তির বাবা,অর্ক সকলকে আসতে দেখে।আদ্রিন ঠাই দাঁড়িয়ে।তাকে উপেক্ষা করে সকলে তৃপ্তির ধারে যায়।ইনায়া তাকে বুকে টেনে নেয় মোলায়েম ভঙ্গিতে।তৃপ্তির সুমিষ্ট ব্যবহার,আদ্রিনের প্রতি,তার প্রতি,সেই পরিবারের প্রতি যত্ন,ভালোবাসায় সিক্ত হওয়া পর্যবেক্ষণ করে ইনায়া।বর্তমানে,তৃপ্তিকে সে রিয়ানার মতো স্নেহভরা, মাতৃত্বের নজরে দেখে।

তৃপ্তিকে একপাশ হতে জড়িয়ে ইনায়া প্রশ্ন করে,
–“এইসব কিভাবে হয়েছে?”
–“চাচু করেছে। রাফি বললো।শুরু থেকে এখন অব্দি সব রাফির বাবা করেছে।উনাকে চাচার খেতাব থেকে আমি বঞ্চিত করলাম।”
আদ্রিন কথা শেষে হাত মুঠ করে।অদ্ভুত ক্রোধ তার শরীর চেপে।

–“সে এখন কই? রাফি কিভাবে জানলো?”
–“বাড়িতে তার বাবার অফিসে যাচ্ছিলো রাফি।দরজায় দাঁড়ালে তৃপ্তিকে শুট করার প্ল্যান,আগেও মারার প্ল্যানে ফেইল হওয়া,আমার কোম্পানিতে জালিয়াতি করানো,ইন দা এন্ড আমাকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়ার সকল পরিকল্পনা শুনে রাফি।”
মিনা সকল কিছু শুনে সশব্দে কেঁদে উঠে।লোকটা পাষাণ ছিলো বিয়ের পর হতে।গায়ে হাত উঠাতো,মিনা সব সহ্য করতো।সবকিছু একদিকে থাকলেও,সেই লোক ঘরের মানুষকে মারতে চেয়েছে এটা অবিশ্বাস্য তার নিকট।

রাফি রুমে এলে,সম্পূর্ণ ঘটনা ব্যাখ্যা করে সকলের নিকট।

রাফির বাবাকে বাড়ির গার্ডরা বন্ধী করেছে ইনায়ার নির্দেশে।

–“আম্মি,তুমি আমার সাথে এসো।আপু,তৃপ্তিকে কিছু খেতে দাও।আমার জন্যে ডিনারে অপেক্ষা করে সে কিছু খায়নি আমি জানি।”
দৃষ্টি দেয় আদ্রিন তৃপ্তির সত্তায়।মেয়েটা বুকের সাথে হাঁটু মুড়ে রেখেছে। নাক,চোখ একেবারে মরিচের রং তার।

–“মিনা,অপরাধীকে শাস্তি দিতেই হবে।হোক না সে পরিবারের কেউ।”
অহেতুক উক্তি দেয় ইনায়া।এটা কেবল যুদ্ধের আগমন বার্তা ছিলো।মিনা মাথা নেড়ে সায় দেয়।এতদিনের পাপের জন্যে মিনা শাস্তি না দিলেও আদ্রিন,ইনায়া দিক তাকে উচিত শিক্ষা।

–“কাঁদবে না আর।খেয়ে ঘুমিয়ে যাবে।”
তৃপ্তিকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে আদ্রিন বেরিয়ে যায় মায়ের সাথে।ইনায়া ছেলের মস্তিষ্ক সচল রাখতে নানান বাণী শোনাচ্ছে।তবে, আদ্রিন সেসব কিছু পালন করবে নাকি জানেনা ইনায়া।মহিলার মন দুরুদুরু।এই প্রথম ঘরের মাঝে অপরাধীর সম্মুখীন হবে সে,যে কিনা তার মানিকের হৃদয়কে হ’ত্যা করতে চেয়েছে!

আদ্রিনরা যেতেই রিয়ানা খাবার আনে। রাফি তার মাকে নিয়ে বাড়িতে ফিরে।বাবার জঘন্য রূপে সে বাকহীন।মাকে সামলানো তার কাছে প্রধান।
অরিত্রন নিজ হাতে মেয়েকে খাবার খাইয়ে দেয়।রিয়ানা তৃপ্তিকে শোয়ার জন্যে উদ্যত হলে অরিত্রন বলে,
–“তৃপ্তি,বাড়ি চল মা।তোকে এইখানে রাখতে আমার অন্তর সায় দিচ্ছে না।”

কান্নার ফলে তৃপ্তির আঁখি এখনো জ্বলছে।তার চোখ সমানে ভার। ঘুমও আসছে হঠাৎ।বাবার কথায় বিচলিত হয় সে।আদ্রিন বাড়ি এসে তাকে না পেলে বাবার সাথে কেমন ব্যবহার করবে জানেনা তৃপ্তি। অস্পষ্ট স্বরে সে জবাব দেয়,
–“বাবা আমার প্রচুর ঘুম পাচ্ছে।তোমরা সবাই খেয়ে যেও।আমি এইখানে ঠিক আছি।”

অরিত্রন মেয়ের কষ্ট,ভয়,শঙ্কা বুঝে।মেয়ের পানে এসে তার কাঁধে হাত রেখে বলে উঠে,
–“ঘুমিয়ে পড় তাহলে।আজ আর নিমন্ত্রণ খেলাম না।বাড়ি ফিরবো।অন্যদিন নাহয় আনন্দের সাথে সব হবে।”
–“খেয়ে যাও বাবা,প্লিজ।”
তৃপ্তি অনুরোধ করে বাবাকে।বাবার মন মেয়ের দুঃখ দেখতে অপ্রস্তুত।তাই মেয়েকে মিথ্যে আশ্বাস দিয়ে নিচে নামলেও,খেলো না কিছু।পরিবার নিয়ে বাড়ি ফেরত যায়।সকলের মন আজ বড্ড নিষ্প্রাণ।

তৃপ্তির আর খবর হয়নি।সে আধ শোয়া অবস্থায় ঘুমে হেলে পড়লে রিয়ানা তাকে ধরে শোয়ায়।এর মাঝে আলেয়া আসে রুমে,
–“তৃপ্তি ঘুমিয়ে?”
–“হ্যাঁ,আলেয়া।ওর বাবারা চলে গিয়েছে?সকলে খেয়েছে?”
–“তৃপ্তির বাড়ির কেউ খায়নি।বাদবাকি আপনার বাড়ির,শ্বশুরবাড়ির সকলে খেয়েছে।দাদু চেঁচামেচি করছে জাস্ট।”
আলেয়া জবাব দেয়।
–“ওহহ।”
ভাবুক হয় রিয়ানা। হাসিখুশির মাঝে এমন দুঃখকর পরিবেশ সহ্যের বাহিরে। রাতের খাবারে তার মন নেই।মন তার মা এবং ভাইয়ের নিকট।কি হচ্ছে সেথায় জানেনা মেয়েটা।ফোন করেও লাভ কি!
সাফা আসে রুমে।রিয়ানা তাকে কোলে তুলে।আলেয়া হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে শুধায়,
–“আমি বাড়ি ফিরছি আপু।”
সাফার পিঠে হাত বুলিয়ে রিয়ানা উত্তর দেয়,
–“গাড়ি আছে নিচে।যেকোনো একজন ড্রাইভারকে বলবে ড্রপ করে দিতে তোমাকে।রাতের বেলা একা যাওয়া সেফ না।”
–“ঠিক আছে আপু।”

আলেয়ার প্রস্থান ঘটে।রিয়ানা সাফাকে নিয়ে শুয়ে পড়ে তৃপ্তির সন্নিকটে।তৃপ্তির দূর্বল মুখশ্রী রিয়ানার সত্তাকে আরো চিন্তিত করছে।
৭৯.
বিচারকার্য সম্পূর্ণ সামলায় ইনায়া।কতবার যে আদ্রিন উত্তেজিত হয়ে রাফির বাবাকে আক্রমন করতে চেয়েছে তার ইয়ত্তা নেই।ভাগ্যিস,ইনায়া ছিলো সাথে।নাহলে তৃপ্তির এই উন্মাদ প্রেমিক পুরুষের দ্বারা আজ বিরাট পাপ হওয়ার শতভাগ নিশ্চয়তা ছিলো।নিজেদের পরিচিত অফিসার এবং এডভোকেটকে কেসের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।শুটার এবং সীনুর বিভিন্ন স্বীকারোক্তি অনুযায়ী রাফির বাবাকে গ্রেফতার করা হয়।মামলা টুকে দেয় সহস্র।ইনায়া সহজেই দমে যাবে না।নিজের ছেলে এবং ছেলের বউকে নিঃশেষ করতে চেয়েছে যে জন,তাকে কিভাবে ছাড় দিবে!
মায়ের কাজে আদ্রিন খুশি।তবে নিজ হাতে শাস্তি না দিতে পারায় আপাতত মায়ের সাথে কথা বন্ধ করেছে সে।
বাড়ি ফিরছে দুইজন একসাথে।ছেলের গম্ভীর মনোভাব লক্ষ্য করে ইনায়া বলে,
–“মন খারাপ করবে না।”

–“করবো না কেনো?আমি পানিশমেন্ট দিতে পারিনি।”
আদ্রিনের কণ্ঠ আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাত।কপালে দুই আঙ্গুল ঠেকে হালকা ঝুঁকে বসে।ক্রোধে তার মস্তিষ্কে অন্যরকম উত্তেজনা।

–“তুমি তার ক্ষতি করলে উল্টো তোমার উপর কেইস হবে। ধৈর্য্য ধরো।তোমার এখন কিছু হলে,তৃপ্তির কি হবে?মেয়েটা ভয় পেয়েছে দেখো নি?তুমিও জানো,মেয়েটা জগতের সামনে অনেক স্ট্রং হলেও;তোমার বেলায় মেয়েটা সবচেয়ে দূর্বল।”
ইনায়া ছেলেকে বুঝানোর চেষ্টায়।আদ্রিন আর কিছু আওড়ায়নি। চুপটি করে বসে।তৃপ্তির কথা স্মরণে এলে আজকের দৃশ্য ভাসে স্মৃতিতে।আরেকটু অসচেতন হলে তৃপ্তির অবস্থা কেমন হতো? ভাবতে চায় না আদ্রিন। ঘাড় বাঁকিয়ে বাহিরের তিমিরের পানে চেয়ে সে।ঘর ফিরে তৃপ্তির মাঝে নিজ অস্তিত্ব বিলীনের অপেক্ষায় সে।

বাড়িতে ফিরে ইনায়ার সহিত রাতের খাবার সাড়ে আদ্রিন।দাদী ব্যতীত বাকি সকলে ঐ বাড়িতে ফিরেছে।খাবার শেষে আদ্রিন নিজ কক্ষে যায়।সাফা এবং রিয়ানা তৃপ্তির সাথে তন্দ্রাসক্ত। রুমে জ্বলন্ত সোনালী আলোয় জ্বলজ্বল করছে বিছানার কিনারায় শোয়ারত তৃপ্তির অবয়ব।আদ্রিন হাত মুখ ধুয়ে আসে।তৃপ্তির ধারে যায়।তার বরফ হাত মেয়েটার গালে স্পর্শ করলে তৃপ্তি নড়ে উঠে।আদ্রিন নাক ছোঁয়ায় তৃপ্তির গলায়।আরো কুকিয়ে যায় মেয়েটা।তবে,ঘুম ভাঙলো না।এমন গভীর ঘুমে তৃপ্তি খুবই কম থাকে।ভাবুক আদ্রিন মেয়েটাকে আর জ্বালায়নি,নিজে কাপড় বদলে সোফায় গা এলিয়ে দেয়।তার বলিষ্ঠ শরীর সোফায় ফিট না হলেও, অন্যরুমে যায়নি সে। তৃপ্তির অবয়বে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে বসে রয় আদ্রিন।সময়ের পাল্লার সাথে তার আঁখি পল্লবও ভারী হয়।ঘুমিয়ে পড়ে আদ্রিন সোফায়।
………..
ভোরের দিকে রিয়ানার ঘুম ছুটলে সে আদ্রিনকে আড়ষ্ট অবস্থায় দেখতে পায়।মুহূর্তেই অপরাধ অনুভব করে রিয়ানা।তার রাতে ঘুম কেনো ভাঙলো না! ভাইটা নিশ্চয় সোফায় বেশ অস্বস্তিতে মুড়িয়ে ছিলো রাতভর।সোফায় তার অবয়ব মোটেও স্বস্তি লাভ করবে না। সর্বপ্রথম রিয়ানা সাফাকে অন্য কামরায় রাখে।পরপর সে এসে আদ্রিনকে ডাকে,
–“ভাই,উঠে পড়।বিছানায় গিয়ে ঘুমা।”
এক ডাকে আদ্রিন উঠে। ঘাড়ে চিন চিন পীড়া।
বিছানায় সাফাকে দেখতে না পেয়ে আদ্রিন বলে,
–“ঘুমিয়ে নিলে পারতে। সাফাকে সরিয়েছো কেনো?”
–“যা যা বিছানায়।আমি গেলাম।”
রিয়ানা দরজা বন্ধ করে।

আদ্রিন আড়মোড়া ভাঙে।পরিহিত টি শার্ট একটানে খুলে।অবশেষে শায়িত হয় তার প্রাণ ভোমরার সংস্পর্শে।ভোরের দিকে শীতের আবাস বেশি অনুভব হয়।উষ্ণতা পেয়ে তৃপ্তি আরো লেপ্টে যায় আদ্রিনের অবয়বে।আদ্রিন হাসে সাথে শঙ্কিত।তার প্রাণকে জড়িয়ে নেয় সন্তর্পনে।চুলের ভাঁজে মুখ গুঁজে শান্তির নিঃশ্বাস টানে আদ্রিন।বিড়বিড় করে আওড়ায়,
–“আমার প্রশান্তিকে কখনোই কষ্ট পেতে দিবো না,মেহেবুবা।তুমি সুখী হও সারাজীবন আমার সাথে।”
—————-
গায়ে চাদর জড়ানো তৃপ্তির।শীতের অবস্থা করুণ।এক দিনেই যেনো হুহু করে শীত বেড়েছে।তৃপ্তির সত্তা নড়বড়ে।মাথাটা ভার।গতরাতের ক্লান্তিতে হয়তো তার এমন কাহিল অবস্থা।ক্লান্ত হাতে নাস্তা তৈরিতে মগ্ন।আদ্রিন এখনো ঘুমে বেখবর।উঠলে নিশ্চয় অফিসে যেতে তাড়া দিবে!সাফা উঠেছে কেবল।সে মামীর পিছে পিছে হাঁটছে।তৃপ্তি চায়ের ফ্লাস্কে চা ঢালে,নাস্তার প্লেটে নাস্তা সাজায়।সার্ভেন্ট সেসব টেবিলে নিয়ে যাচ্ছে নির্দেশনা অনুযায়ী।
কাজ শেষে সাফাকে নিজ কোলে উঠায় তৃপ্তি।অল্পতে হাপিয়েছে সে।দুজনে নাস্তার টেবিলে যায়,খেতে আরম্ভ করে।হুট করেই যেনো তৃপ্তির সকল খিদে ভর করেছে উদরে।

–“খাও,মন ভরে খাও।আমার ছেলে কি অবস্থায় আছে আল্লাহ্ জানে।শুরু থেকে যদি নাতির কথা না ভেবে তোমাকে মেনে না নিতাম তাহলে আজ আমার পরিবার ঠিক থাকতো।”
আদ্রিনের দাদী বেশ জোরে চিৎকার করে।তৃপ্তি হাত কাঁপে। হাতে থাকা পরোটা টেবিলে পড়ে। ঘাড় বাঁকিয়ে পেছনে ফিরলে দাদী ফের বলে,
–“এই মেয়ে তুমি যাও।এই বাড়ি থেকে যাও।”

তৃপ্তি কিংকর্ত্যবিমূঢ়।দূর্বল কণ্ঠে শুধায়,
–“কই যাবো দাদী?আপনি কিসব বলছেন?”
–“শুনো মেয়ে,শুরু থেকে তোমাকে আমার পছন্দ না।কিন্তু,আমার নাতির জন্যে মেনে নিয়েছিলাম।এখন দেখছি সব ভুল আমার।তুমি মেয়েটা ভালো না।তোমার কারণে আমার পরিবারের এমন অবস্থা।”
দাদীর কথা কর্ণগুচর হয় ইনায়ার।সে থামেনি। চিল্লিয়ে বলে,
–“আপনি যা তা বলছেন এখন।তৃপ্তি কি করেছে? যা করেছে আপনার ছেলে করেছে।পরিবারের এমন অবস্থার জন্যে আপনার ছেলে দায়ী। কাল তো মেয়েটা মরেই যেতো।তখন আমার ছেলের কি হতো?নিষ্পাপ মেয়েটার প্রাণই বা কেনো খোয়াতো?”
–“আমি এই মেয়েকে আর আমার ঘরে নিবো না।এই মেয়ের জন্যে আমার অন্য নাতি বাবা হারা হয়েছে।তার বাবা এখন জেইলে।”
আদ্রিনের দাদী খেঁকিয়ে উঠে।

–“আচ্ছা।যাবে না আমার বউ তোমাদের বাড়িতে।আমার বউ আমার বাড়িতে থাকবে।এতো নাতি নাতি করছো,তোমার এই নাতির কষ্টের ব্যবসায় রাফির বাবা শেষ করতে চেয়েছে সব।আল্লাহ্ এর রহমত বলতে পারো,আমি দমে যায়নি।বাদ বাকি,আমার বউকে যেনো কিছুতে দোষ না দাও।”
আদ্রিন দাঁড়িয়ে।পড়নে টিশার্ট, স্পোর্টস প্যান্ট।
সেদিকে একনজর তাকিয়ে তৃপ্তি মাথা নিচু করে।আঁখিতে জল তার।আজকাল তার ইচ্ছে করে না প্রতিবাদ করতে।

–“হ্যাঁ,এখন বউয়ের পেছনে থাকবে তুমি।এই মেয়েকে ছাড়ো।অন্য মেয়ে দেখবো তোমার জন্যে।যে মেয়ে আমাদের পরিবারকে বেঁধে রাখবে।”
দাদীর কথায় আদ্রিন বাঁকা হাসে।হেঁটে যায় তার মেহেবুবার পানে।ঝুঁকে মেয়েটার গালে অধর ছোঁয়ায়। দাদীর নজর বিস্ফোরিত। তৃপ্তি নিজেও হতবাক। গালে হাত রাখে। যদিও সে দাদীর কথায় চিন্তিত,তবে আদ্রিনের এহেন কাজে সে লজ্জিত। মায়ের,দাদীর সম্মুখে কিসব কাজ?
তৃপ্তির মাথা আদ্রিন নিজের উদরের একপাশে চেপে ধরে বলে,
–“এই মেয়ে ছাড়া আমি শেষ। একদম ফিনিশ।তোমার অন্য মেয়েকে তোমার অন্য নাতিকে বিয়ে দাও।আমার সারাজীবনের জন্যে এই মেয়ে যথেষ্ট।এইখানে মেহমানের মতো আসবে,খাবে,থাকতে মন চাইলে থাকবে।কিন্তু,আমার বউকে কিছু বলা যাবে না।আমি সহ্য করবো না।”
–“এই মেয়ের জন্যে আজ আমাকে….!”
দাদীর কথা সম্পূর্ণ হতে না দিয়ে আদ্রিন ফের বলে,
–“বাধ্য করেছো তুমি। আম্মি আমি চাই,আমরা এই বাড়িতে থাকি। ঐ বাড়ি হতে আমার মন উঠেছে।”
তৃপ্তি ছটফট করে।তবে,আদ্রিনের হেলদুল নেই।সে আয়েশী ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে কর্কশ ভাষায় কথা বলছে।

–“তুমি যা বলো তাই হবে,আদ্রিন।মা,আপনি খেয়ে যাবেন।”
ইনায়ার কণ্ঠে তাচ্ছিল্য।শাশুড়ি কিভাবে পারলো তার ছেলেকে অন্য মেয়ের কথা বলতে?ব্যাপারটা হজম হচ্ছে না তার।
দাদীর স্থায়ীকাল তখনই ফুরিয়ে যায়।হনহনিয়ে প্রবীণ মহিলার প্রস্থান ঘটে।বুকের মাঝে তার শত প্রতিহিংসা।

–“এইবার ছাড়ো মেয়েটাকে।খেতে দাও।”
হাসে ইনায়া।তৃপ্তির গাল তখনো জলে ভিজে।সে জানে আদ্রিন তার জীবনের সবকিছু।দাদী কিভাবে পারলো এমন বাক্য বলতে?
–“কাদঁছো কেনো?ইদানিং বেশি কান্নাকাটি করছো তুমি!”
আদ্রিন চেয়ার টেনে বসে।

তৃপ্তি নিজেও জানে না এর কারণ।এটা সত্যি,আগে থেকে সে অতিরিক্ত কান্নাকাটি করে।সাথে নিজের শক্তপোক্ত তৃপ্তির রূপটাও কোথায় বিলীন হয়েছে।

–“আহহ,অনেক হয়েছে।মেয়েটাকে আর কিছু বলো না।”
ইনায়ার কথা শেষ হতে না হতে রিয়ানার আগমন ঘটে।সে মাকে জিজ্ঞাসা করে,
–“দাদী কই?পরিবেশ এমন কেনো?”
–“আজ থেকে তোমার বাবার বাড়ি,ভাইয়ের বাড়ি,মায়ের বাড়ি সব এটাই। ঐ বাড়িতে আমরা শুধুই মেহমান।”
ব্রেডে বাটার লাগানো অবস্থায় জবাব দেয় আদ্রিন।
_________________
রিয়ানা শ্বশুরবাড়িতে ফিরেছে দুদিন।তৃপ্তি ঘরে একা।ইনায়া আজ ফিরবে না।সে কক্সবাজারে নিজেদের পার্টির কাজে।আদ্রিন অফিসে।নিচের ঘরে অবশ্য সার্ভেন্ট আছে।তৃপ্তি ক্লাসের নোট বানায়।সামনে তার অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা।এইসবের পাশাপাশি ছোট্ট ব্যাবসার কিছু টুকটাক কাজ সারছে।তীব্র পেট ব্যাথায় সবকিছু গুলিয়ে আসছে তার।কিছুক্ষণ রুমে হাটাহাটি করে।রাতের খাবারও খেয়েছে বিনা আদ্রিনের উপস্থিতিতে।এমন খিদে তার কয়েকদিনের সাথী।রাজ্য খেয়ে ফেলবে তৃপ্তি,এমন অবস্থা হয় তার।রুমে কিছুক্ষণ পায়চারি করে সে।হঠাৎই,মাথায় ভূত চাপে। রুমে বিদ্যমান বইয়ের শেল্ফ গোছাতে উদ্যত হয়।এইদিকে শীতও বেশ।গায়ে চাদরটুকু নেয়নি।একে একে সব বই নামাতে আরম্ভ করে।
মেঝেতে ছড়িয়ে রাখে বইসমূহ।পরপর সাজিয়ে রাখছে শেল্ফে।

আদ্রিন অফিস হতে ফিরে। হাতে হাত ঘষে।বাহিরে প্রচুর কুয়াশা।তৃপ্তির এমন করুণ রূপ দেখে ভ্রু কুঁচকে যায় তার।মেয়েটার কি শীত নেই?
–“এই?চাদর কই?শীত লাগছে না?”
তৃপ্তি পেছনে বাঁক ফিরে।আদ্রিন অফিসের ব্যাগ আলমিরায় রাখে।কালো সবুজ রঙের সোয়েটশার্টে লোকটাকে কি মনোরম লাগছে! তৃপ্তি স্নেহভরা নজরে চেয়ে রয়।

এদিকে বারংবার তৃপ্তি নড়াচড়া করার কারণে তার শাড়ির আঁচল সামলাতে বেগ পাচ্ছিলো।তাই আঁচল উঠিয়ে রাখায় তার শুভ্র উদর দৃশ্যমান।মেয়েটার চমকিত রূপ আদ্রিনের সত্তায় আগুন ধরায়।

–“লাগছে না তো।”
তৃপ্তি হাসে।পরক্ষণে আদ্রিনের দৃষ্টি অনুসরন করলে সে দ্রুত শাড়ি ঠিক করে বলে,
–“কাজ করছিলাম।তাই খেয়াল ছিলো না।”

আদ্রিন তার গায়ের সোয়েটশার্ট খুলে।হাত দ্বারা বাতাস করে,
–“তোমাকে দেখে আমারই গরম লাগছে।”
তার কণ্ঠে মাদকতা।বড্ড রোমাঞ্চকর।তৃপ্তি পেছালে আদ্রিন এগিয়ে আসে।
হুট করে মেয়েটাকে কোলে তুলে।তৃপ্তি তার ঘাড় জড়িয়ে,
–“এইসব কি?কাজ আছে,দেখছেন আপনি।”
–“আমি তোমার কাছে এখন সবচেয়ে জরুরি কাজ।”
আদ্রিন তৃপ্তির ললাটে নিজ ললাট ঠেকায়।
–“আপনার কি খিদে নেই!”
–“তুমি ছাড়া এখন জরুরি কাজ একটাও নেই।”
তৃপ্তির কিছু বলার বাকি নেই।আদ্রিন সুযোগই দেয়নি।

তৃপ্তির ঘুমন্ত মুখশ্রী অবলোকন করা আদ্রিনের প্রিয় কাজ।দিনদিন মেয়েটা তার মাদকতার ফোয়ারা হচ্ছে।মেয়েটার মাঝে কি এমন আছে,এটাই আদ্রিনের অজানা।তবে,আদ্রিন এটা জানে,তৃপ্তি ব্যতীত তার কোনো অস্তিত্ব নেই।
মেয়েটা ভ্রু কুঁচকে ঘুমিয়ে। পেরেশানিতেও তৃপ্তি মারাত্মক রূপবতী।ঘুমানোর আগে বলেছিলো তার পেটে ব্যথা হচ্ছিলো।স্বাভাবিক ভেবে আদ্রিন আর মাথা ঘামায়নি।এখনো ব্যাপারটা সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে।তৃপ্তিকে টেনে নেয় নিজ বক্ষপিঞ্জরে।তৃপ্তির হাত উঠিয়ে নিজ উদরে রাখে।সেই হাত আবার উচুঁতে তুলে চুমু দেয়।ফিচেল কণ্ঠে বলে,
–“আমার সচক্ষে আমি প্রশান্তি দেখেনি তৃপ্তি,তবে তোমায় দেখেছি।”
#অতৃপ্তির_মাঝে_তৃপ্তিময়_সে
#লেখিকা- সালসাবিল সারা
অন্তিম পর্ব(শেষাংশ)
_______________
–“বিস্কিটের সাথে সস্ কে খায়, তৃপ?”
পেছন হতে এই সুর তৃপ্তিকে বিচলিত করতে যথেষ্ট।ঘাড় না বাঁকিয়ে দ্রুত চিবানো শুরু করে সে। উদ্দেশ্য সস্ মাখা বিস্কিট গলধঃকরণ করা।আদ্রিনকে এই খবর নিশ্চয় রিয়ানা দিয়েছে।এত করে মানা করেও তৃপ্তি থামেনি এমন অহেতুক খাবারে।তাই চুপি চুপি রিয়ানা তার ভাইকে জানিয়েছে এই খবর!
তৃপ্তি মুখে শাড়ির আঁচল চেপে।পাশের চেয়ারে বসা সাফা বেখবর।সে এক হাতে বিস্কিট কামড় দিচ্ছে,
অন্যহাতে ড্রইং করছে।

আদ্রিন পাশাপাশি এসে দাঁড়ায় তৃপ্তির।টেবিলে একহাত রেখে তির্যক ভঙ্গিতে তৃপ্তির পানে এগোয়।মুখ হতে শাড়ির আঁচল সরায়। সস্ লেপ্টে রইলো ঠোঁটের কিনারায়।সেথায় বৃদ্ধাঙ্গুল স্পর্শ করে আদ্রিন।ফিচেল কণ্ঠে বলে,
–“ভালো খাবার পেটে পড়ে না তোমার। উল্টাপাল্টা কিসব খাও?ঘন ঘন বমি করো দেখো না!”
–“কিছু হবে না।”
তৃপ্তি বিরক্ত।এই লোক সবসময় তার খাবারের মাঝে বা হাত দেয়।তৃপ্তি নিজেও অবশ্য জানেনা,এমন উদ্ভট খাবারে সে কি মজা পায়!

–“হচ্ছে অলরেডি।তুমি আওফাও জিনিস খাও আর তোমার ফুড পয়জনিং হয়।”
আদ্রিন তৃপ্তির গাল সাফ করতে ব্যস্ত।

তৃপ্তি ভাবুক।এইসব তার মোটেও ফুড পয়জনিং মনে হয় না।তার ধারণা,নিজ অস্তিত্বের অভ্যন্তরে অন্য জান আছে।রিপোর্ট আসা পর্যন্ত আপাতত চুপ থাকতে চায় সে। তারপরও মুখ খুললো মেয়েটা,
–“ফুড পয়জনিং না।আমার এইভাবেই বমি পায়।”
–“আচ্ছা।কিন্তু,অতিরিক্ত সস্ খেও না আর।”
আদ্রিন সস্ এর বোতলে হাত রাখলে তৃপ্তি ক্ষীণ সুরে বলে,
–“আমি খাচ্ছি এটা।”
–“এমনি বিস্কিট খাও।”
আদ্রিন সোজা হয়ে দাঁড়ায়।তৃপ্তির নয়ন ঝলমলে, টলটলে। নাকটাও রক্তিম।দিনদিন মেয়েটা ছিঁচকাদুনে হচ্ছে।অথচ,মেয়েটা ছিল দুর্দান্ত। বড্ড সাহসী।হঠাৎ এমন পরিবর্তন ভাবায় আদ্রিনকে। সে কিছু ব্যক্ত করার পূর্বে সেথায় হাজির হয় রিয়ানা,
–“ড্রইং শেষ সাফার?”
–“আরেকটু বাকি, মা।”
সাফার উত্তর পেয়ে রিয়ানা তৃপ্তির পানে ফিরলে আঁতকে উঠে।ভাইকে জানিয়ে ভুল করেছে সে?আদ্রিন মেয়েটাকে বকেনি তো আবার!দ্রুত হেঁটে সে তৃপ্তির নিকট পৌঁছায়,
–“ওহমা, কাদঁছো কেনো?আদ্রিন বকেছে?এই আদ্রিন তোকে আমি বকা দিতে পাঠিয়েছি মেয়েটাকে?নাকি বুঝিয়ে শুনিয়ে অহেতুক সস্ খেতে মানা করার জন্যে পাঠিয়েছি।”

–“আপু,আমি ওকে বকিনি।এইযে বোতল সরাচ্ছি তাই এমন অবস্থা।”
বোতল দেখিয়ে হাসে আদ্রিন।ছলছল নয়নে তৃপ্তি সেই মানুষের পানে চেয়ে। তৃপ্তির এমন কান্নার মজা নিচ্ছে আদ্রিন। থ্রি কোয়ার্টার প্যান্টের সাথে ফুল স্লিভের কালো রঙের সোয়েটার পরনে তার আদ্রিন।সস্ এর দুঃখের মাঝেও এই ছেলের জন্যে তার মনের রোমাঞ্চকর অনুভূতি হানা দেয় মুহূর্তেই।নিজ কর্মকাণ্ডে নিজে চমকিত তৃপ্তি।চোখ বুজলে গাল গড়িয়ে অশ্রু ঝড়ে।
–“সুন্দরভাবে নিশ্চয় বলিসনি।নাহলে মেয়েটা কাঁদতো না। তোকে আসতে বল ভুল হয়েছে।সরি তৃপ্তি।আমি তোমার জন্যে চিন্তিত ছিলাম।”
তৃপ্তির হাত ধরে রিয়ানা।

দৃষ্টি ফেরায় তৃপ্তি। রিয়ানার হাতের উপর অন্যহাত রাখে,
–“সরি কেনো বলছেন আপু?আমি সরি।”
নাক টানে মেয়েটা।
আদ্রিন হেসে উঠে সশব্দে,
–“মেয়ে মানুষকে বুঝা কষ্টের।”
আদ্রিনের এহেন হাসি তৃপ্তি সত্তায় আগুন ধরায়।সে তীব্র ভাষায় বলে,
–“আপনার ভাই পাগলের মতো হাসছে কেনো আপু?”
–“ও তো পাগলই।তোমার জন্যে পাগল।”
রিয়ানাও যোগ দেয় আদ্রিনের হাসির সাথে পাল্লা দিয়ে।
তৃপ্তি বোকা বনে।এই দুই ভাইবোন সব দিক দিয়ে একই। সমমান।

পরক্ষণে রিয়ানা বলে,
–“সাফা চলো।গোসল করবে।স্কুল থেকে এসেই ড্রইং এ বসেছো।”
–“শেষ, মা।”
সাফা জবাব দেয়।
–“মামী দেখো।”
তৃপ্তি ড্রইং খাতায় নজর বুলায়।গ্রামের সৌন্দর্য ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছে সাফা।মলিন হেসে তৃপ্তি জবাব দেয়,
–“সুন্দর অনেক।”
–“আমরা আসি।বাই বলো মামীকে।”
রিয়ানার কথায় তার মেয়ে বলে,
–“বাই মামী।”

তৃপ্তি হাত নাড়ায়।সাফা এবং রিয়ানা চলে উপরের কামরায়।
আদ্রিন তার হাতে বিদ্যমান বোতল স্টাডি টেবিলের উপর রাখে।তৃপ্তির বাহু নাড়িয়ে বলে উঠে,
–” মেহেবুবা!”
তৃপ্তি চোখ মেলায় না।সে রেগেছে এই লোকের সাথে।তার নিকট হতে উত্তর না পেলে আদ্রিন এক নিমিষেই তৃপ্তিকে উঠিয়ে নেয় কোলে।নিজে বসে পড়ে চেয়ারে,
–“কি হয়েছে?”
–“আপনি খারাপ।আমার উপর হাসছিলেন।”
তৃপ্তির আবারও আঁখি ভরে।

আদ্রিন তার নাক ঘষে তৃপ্তির গালে,
–“বারবার একই কথা বলা লাগবে?”
তৃপ্তি দুদিকে মাথা নাড়ায়। যার অর্থ “না”।নিজ থেকে এইবার তৃপ্তি বলে,
–“আপনার না বিকালে মিটিং আছে!একটু পরে বেরুবেন।গোসল সারেননি কেনো এখনো?আমি লাঞ্চের ব্যাপারটা দেখছি।”
–“আম্মি,মানা করেছে না রান্না নিয়ে ঝামেলা করতে!তাহলে জিদ করো না।সার্ভেন্ট দেখে নিবে রান্না।তুমি চলো।”
–“কই যাবো?”
তৃপ্তির ভ্রু জোড়া কুঁচকে যায়।

–“গোসলে।”
আদ্রিন দাত দ্বারা অধর চেপে অন্যরকম দৃষ্টিতে চেয়ে তার পানে।এই দৃষ্টিটা তৃপ্তির সহ্য হয় না।তার অস্থির লাগে।ইচ্ছা করে এই লোকের নেশায় এক মুহূর্তে হারিয়ে যাক সে এই পার্থিব জগৎ হতে।

তৃপ্তি তার কোল হতে নামে।শরীর ভালো নেই তার।আদ্রিনের আবদার রাখার শক্তি আছে কি?
–“নিজে যান।”
–“বউ ছাড়া সম্ভব না।চলো।”
তৃপ্তির হাত ধরে টান দিলে মেয়েটা আদ্রিনের সাথে তাল মিলিয়ে হাঁটতে থাকে।এক পর্যায়ে তাল মেলাতে হিমশিম খায় পেটের পীড়ায়।আদ্রিনের সোয়েটারের হাতা অন্যহাতে টেনে বলে,
–“আস্তে হাঁটুন।মাথা দুলছে আমার।”
আদ্রিন ঘাড় বাঁকিয়ে তার প্রেয়সীকে দেখে।মেয়েটা কেমন দূর্বল গত একমাস যাবত।ধীরে পা ফেলে আদ্রিন।যেতে যেতে নির্দেশ দেয়,
–“ডাক্তারের দেওয়া একটা ঔষধ যেনো মিস না যায়।”
মাথা নাড়িয়ে শায় দেয় তৃপ্তি।

ছেলেটার উদাম ভেজা শরীরে তৃপ্তির শ্বাস আটকে আসে প্রত্যেকবারই। খাঁজ খাঁজ দেহের মাঝে কি সুন্দর পানির বিন্দুকনা।আদ্রিন তার প্রেয়সীতে মত্ত।গরম পানিতে মেয়েটাকে ঠিকভাবে যত্ন নেওয়ার চেষ্টায় সে।এরমাঝে নিজের অবাধ্য স্পর্শ দিতে ভুলছে না আদ্রিন।মেয়েটার কোমর খুব অনায়াসে তার দুহাতের আড়ালে চলে আসে।গভীর চুম্বনে মুহূর্তকে আরো শ্বাসরুদ্ধকর পর্যায়ে নেয় এই যুগল।নিজ প্রাণ ভোমরার এলোমেলো ছোঁয়ায় তৃপ্তির জান যায় অবস্থা।
হঠাৎ শরীরে আর সায় দেয় না।আচমকা পেটে হামলা হয় যেনো,গড়গড়িয়ে তৃপ্তি বমি করে। থামে আদ্রিন।এখনো তার হৃদপিন্ড দ্রুত গতিতে চলছে।কোনোভাবে দম ফেলে সামলে নেয় সে তৃপ্তিকে।ক্লান্ত মেয়েটা সকল ভার আদ্রিনের সত্তায় ছাড়ে।আলগোছে আগলিয়ে ধরে তাকে নিজ বুক পিঞ্জিরায়।শরীর পুছে ঢোলা কাপড় পড়িয়ে বিছানায় শুয়ে দেয় সে তৃপ্তিকে। ভেজা কাপড় বদলে ট্রাউজার চড়িয়ে দ্রুত ফিরে সে তৃপ্তির নিকট।

ইতিমধ্যে অধর শুকিয়ে মেয়েটার। মায়া হয় আদ্রিনের।ললাটে স্পর্শ দেয় ভালোবাসার,
–“খারাপ লাগছে?”
তৃপ্তির আঁখি বুজে।দুইহাত মেলে সে।আদ্রিন অনেকটা সাবধানে মেয়েটার বাহুডোরে সঁপে দেয় নিজেকে।আদ্রিনের কান বরাবর তৃপ্তি দূর্বল কণ্ঠে বলে,
–“ঠিক আছি।অফিসে যাওয়ার আগে প্লিজ খেয়ে যাবেন।”
–“কেনো এমন কষ্ট পাচ্ছো তুমি?রিপোর্ট রাত নয়টার আগে দিবে না?”
আদ্রিনের এমন বিচলিত প্রশ্নে হেসে উঠে তৃপ্তি,
–“উহু দিবে না।”
–“মিটিং শেষে আমি যাবো হাসপাতালে।তুমি বাসায় থেকো।”
আদ্রিন তার প্রেয়সীর গালে অধর ছোঁয়।তৃপ্তির হদিস নেই।দুর্বলতায় সে তন্দ্রাসক্ত।মিনিট বিশেক পর আদ্রিন উঠে পড়ে।তৃপ্তিকে ঠিকভাবে কম্বলে জড়িয়ে দেয়।নিজ শার্ট, কোট, ফর্মাল প্যান্ট দ্বারা আবৃত করলো তনু। বউয়ের নিকট গিয়ে পুনরায় স্নেহময় আলিঙ্গনে বিনা শব্দে নিচে নামে।খবর শেষে বেরিয়ে পড়ে।
স্টিরিয়াংয়ে হাত রেখে গাড়ি ঘুরিয়ে নেয় সাবধানে।মস্তিষ্কের সবটা জুড়ে কেবল তার মেহেবুবা।রিপোর্ট জেনে তৃপ্তির অবস্থা কেমন হবে জানা নেই আদ্রিনের।এর পূর্বেই তার অবস্থা জর্জরিত।খুব করে দোয়া করছে সবটা যেনো ঠিক হয়।
————
রাত আটটা দশ।মিটিং শেষে আদ্রিন নিজ কেবিনে বসে।হাসপাতাল তার অফিসের নিকটে। পাঁচ মিনিটের পথ।শীতের এমন কড়া প্রকোপে আদ্রিনের কানের দিকটায় ঘামের উৎপত্তি।তন্ময় ফাইল বুঝে নিচ্ছে আপন মনে।এক ফাঁকে আদ্রিনের পানে দৃষ্টি পড়লে তন্ময় ফাইল রাখে।চিবুকে হাত ঠেকিয়ে বলে,
–“স্যার,আপনি ঠিকাছেন?এসি চালু করবো?”
তন্ময় নিজের প্রশ্নে বিভ্রান্তে পড়েছে।যদি উত্তর হ্যাঁ হয়,এই রুমে বসা অসম্ভব হবে। হিম পরিবেশ।রীতিমত হাত তার বরফ।

–“কেনো?আমাকে অস্বাভাবিক লাগছে দেখতে?”
আদ্রিন গা এলিয়ে দেয় রোলিং চেয়ারে।গোছানো চুলে অযথা হাত বুলায়।
–“স্যার,আপনি ঘামছেন।কোনো টেনশনে আছেন?”
–“আজ এখনো নয়টা বাজছে না কেনো?”
হাতের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে পুনরায় দেওয়ার ঘড়ির তাকায় আদ্রিন।
–“স্যার, কোথাও যাবেন?”
–“তন্ময়, আজ এত প্রশ্ন করছো কেনো?”
–“আপনাকে চিন্তিত লাগছে, স্যার।”

তন্ময়ের জবাবে আদ্রিন ঘাড়ে হাত ঘষে,
–“জীবনে প্রেম করলে,বিয়ে করলে টেনশন লেগে থাকবে।এর মূল কারণ বউ।বউ মানুষটা এমন যে তার যদি কিঞ্চিৎ অসুবিধা বা কষ্ট হয় তোমার মনে হবে দুনিয়া শেষ তোমার।পুরো পৃথিবী থমকে আছে।তৃপ্তির রিপোর্ট দিবে এই নিয়ে আমার চিন্তা।”
তন্ময় হাঁ হয়ে সবটা শুনে।এই লোকটার ভেতর অনুভূতিযুগল কি সুন্দর লুকিয়ে।অথচ তন্ময় বুঝেনি কোনোদিন।
তন্ময়ের জবাব শোনার পূর্বে আদ্রিন চিন্তিত ভঙ্গিতে উঠে পড়ে,
–“আমি বরং হসপিটালে ওয়েট করি।”

বহু সময় কাটলে নয়টা বাজে।সিরিয়ালে তৃপ্তির নাম ভেসে আসে।আদ্রিন সম্মুখে এগোয়। রিসিপশনে জানায় গাইনোকোলোজিস্ট স্নেহার সহিত দেখা করতে আদ্রিনকে। আকাশ সমান ভাবনা আদ্রিনের। যেতে যেতে ফাইল দেখার কথা ভাবলেও আবার ভাবনা বাতিল করে।যা বলবে ডাক্তারই বলুক।

তৃপ্তি বিহীন আদ্রিনকে অবলোকন করে ডাক্তার কিঞ্চিৎ বোকা বনে।তাকে বসতে নির্দেশনা দিয়ে ডাক্তার স্নেহা বলে,
–“আপনার মিসেস আসেনি?”
–“নাহ।সে অসুস্থ।”
ফাইল এগিয়ে দেয় আদ্রিন।স্নেহা ফাইল পর্যবেক্ষণ করে হাসে। রিপোর্টের একটা অংশে আঙ্গুল দিয়ে চিহ্নিত করে জবাব দেয়,
–“দেখুন পজিটিভ লিখা।আপনার ওয়াইফ প্রেগন্যান্ট।শুভকামনা।এখন থেকে ভালো যত্ন নিবেন।আমি ঔষধ প্রেসক্রাইব করছি।”

কানে কথাগুলো প্রবেশ করলো ঠিকই,কিন্তু মস্তিষ্ক সায় দিচ্ছে না।বড্ড বেশি সুখ অনুভব করলে কি মানুষ অনুভূতিহীন হয়?হয় তো।এইযে আদ্রিন।তার শরীরে উত্তেজনা,মনে সহস্র দৃশ্য ভাসছে।মেয়েটার সাথে ঘনিষ্ট হলে গত দেড় মাস যাবত একটু বেশি ব্যথা অনুভব করতো সে পেটে।কারণটা কি তাহলে এটাই ছিল!অথচ আদ্রিন ধরতে পারেনি আসল কথা।তার পায়ের নিচ হতে মাটি শূন্য যেনো। চোখ জোড়া জ্বলছে। কাঁদবে কি সে?কিন্তু,আদ্রিনের সহজে কান্না আসে না। দুঃখেও না।এই বাচ্চাটা আদ্রিনকে কিরূপে পরিবর্তন করবে জানেনা সে।ইচ্ছা করছে এখনই বাড়ি ছুটতে।তার মেহেবুবাকে নিজ সত্তায় মুড়িয়ে নিতে।এত বড় খুশির সংবাদ কিভাবে ব্যক্ত করবে আদ্রিন! তার নিকট ভাষা নেই কোনো।

গাড়ির পার্কিংয়ে এসে থামে আদ্রিনের পা।বুকের শব্দ তেজ।দ্রুত তার গতি।কোট খুলে কাঁধে ঝুলায়।বাম পকেট হতে মোবাইল বের করে।মাকে ফোন করে সর্বপ্রথম।
কয়েকবার ফোন বাজে।ইনায়া সহজভাবে জিজ্ঞাসা করে,
–“কই তুমি? বাড়ি আসছো না?তৃপ্তি চিন্তা করছে।মেয়েটার মাথা ব্যথাও বেড়েছে।তেল দিয়ে দিলাম মাত্র।”
আদ্রিন কয়েক বার জোরে শ্বাস নেয়। জিহ্বা দ্বারা অধর ভিজিয়ে বলে,
–“আম্মি… আম্মি আমি বাবা হচ্ছি।তুমি দাদু..তোমার আদ্রিনের অন্য অস্তিত্ব আসছে এই দুনিয়ায়।”
ইনায়া চমকে যায়।তৃপ্তি তার উরুতে দূর্বল ভাবে শুয়ে।সেথায় নজর দিলে আঁখি ভরে তার।শক্ত ব্যক্তিত্বের মহিলা সে দুনিয়ার নিকট।অথচ,ছেলের জীবনের বিশাল সুসংবাদ শুনে ইনায়ার চোখ ভিজে,
–“আলহামদুলিল্লাহ্ আব্বা।মেয়েটার জন্যে তেঁতুলের সস্ এনো।নালিশ করেছে তোমার নামে।”
আদ্রিন হাসলো।হাসির সাথে ভারী বুকটা এখনোও অশান্ত।ঠোঁট কামড়ে সে ফের বলে,
–“আনবো আম্মি।”

নিজেকে পরিপূর্ণ লাগছে আহানান শেখ আদ্রিনের।এতটা সুখ আসবে জীবনে ইহকালে ভাবেনি ।জীবনটা সত্যি সুখের যদি তা মনের মতো করে মেনে নেওয়া যায়।গাড়ির গতি বৃদ্ধি পাচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে।রাস্তাটা আজ বড্ড দীর্ঘ। স্টিরিয়াংয়ে সজোরে আঘাত করে বিড়বিড় করে,
–“রাস্তাটা শেষ হয় না কেনো?”

তেঁতুলের সস্ পেয়ে তৃপ্তি মহাখুশি। কাল রাতে আদ্রিন আসার পূর্বে সে ঘুমিয়ে যায়।তাই রাতে দেখা হয়নি। এখনো আদ্রিন ঘুমিয়ে।তৃপ্তি একাই বাহিরে আসে রুম হতে।পাউরুটিতে সস্ মাখিয়ে নেওয়ার সময় তার হাতের বালা পরিবর্তিত দেখে মনে আসে,গত রাতে তার মা হওয়ার সংবাদে খুশি হয়ে ইনায়া এই বালা তাকে উপহার দেয়।তার বাবাকে জানায় এই খবর।খুশি মনে অরিত্রন মিষ্টি সহিত এসে মেয়েকে দেখে যায় সকালেই।কাজ থাকার দরুন বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি এই বাড়িতে।

নাস্তা শেষে তৃপ্তি টক জাতীয় কিছু খুঁজে ফ্রিজে।ইনায়া সম্পূর্ণ তৈরি।তৃপ্তিকে এইভাবে ঝুঁকতে দেখে সতর্ক বার্তা শোনায়,
–“এমন করে না,মা।সোজা হাঁটাচলার চেষ্টা করবে।”
তৃপ্তি হাসে,
–“আচ্ছা,আম্মি।”
ইনায়ার মন ভরে। পান্নার কথা ভেবে কতো না কষ্ট দিয়েছে এই মেয়েকে সে।আগে পান্নার কথা ভাবলে ঘৃণা হতো তার।কিন্তু, এখন করুণা জাগে।এই মেয়ের জন্যে তার হৃদয় পুড়ে।সুশ্রী চেহারার এই মেয়েটাকে ছাড়া ইনায়ার ঘর এখন অপূর্ণ।মাথায় হাত বোলানো অবস্থায় ইনায়া ফের বাণী শোনায়,
–“বাবার বাড়ি যেতে ইচ্ছে করলে যেতে পারো।কয়েকদিন থেকে এসো।”
খুশিতে মনটা ছেয়ে যায় তৃপ্তির।ইনায়ার বাহুডোরে সঁপে নিজেকে,
–“অনেক শুকরিয়া,আম্মি।”

ইনায়ার প্রস্থান ঘটে।তৃপ্তি বেজায় খুশি। বাবার বাড়িতে যাবে সে বহুদিন পর।কামরায় আদ্রিন অনুপস্থিত।ওয়াশরুমে নিশ্চয়।তৃপ্তি মনের সুখে আলমিরা খুলে। জামা নির্ধারণ করতে ব্যস্ত।

বাথরুমের দরজায় শব্দ হলেও মেয়েটা সেদিকে ফিরলো না।কাপড় নির্বাচনে একটু বেশি মগ্ন সে।
আচমকা নিজ পিঠে আদ্রিনের হিম অবয়বের সংস্পর্শ হলে সে কেঁপে উঠে অনেকটা।আদ্রিনের নাক,অধর পৌঁছে তৃপ্তির ঘাড়,চুলের গভীরতায়।হাতের স্পর্শে ব্যাকুল হচ্ছে তার উদর।
–“গত রাতে,বাবুকে আদর করেছি।এখন বাবু মায়ের পালা।”
আদ্রিনের কণ্ঠে মাদকতা।তৃপ্তি ঘুরে দাঁড়ায়।লোকটার বুকে এখনো পানি কণা।সেথায় আঁচল চেপে তৃপ্তি মাথা উচিয়ে আদ্রিনের নজরে নজর মেলায়,
–“আম্মি বলেছে বাবার বাড়ি যেতে।আমি যাবো।”
–“তুমি যাবে না।ডাক্তার বলেছে তোমার বেগ রেস্ট করা দরকার।এটলিস্ট তিন মাস।”
আদ্রিনের সোজা জবাব।

–“কিন্তু আম্মি বললো যেতে।”
–“আম্মি ডাক্তারি পাশ করলো কবে?”
কাছে টানে সে তার মেহেবুবাকে।

–“এমন হিংস্র মানুষ আমি আর দেখিনি।আমি যাবো মানে যাবো।”
তৃপ্তি ঘুরে দাঁড়াতে চাইলে আদ্রিন দেয়নি।সে শক্ত হাতে তৃপ্তির কোমর চেপে,
–“যাবে না তুমি।”
তৃপ্তির গা জ্বলে যায়।হামলা করে আদ্রিনের শক্ত বুকে।মাংসের খাঁজে দাঁত দেবে দেয়।তৃপ্তির ঘাড়ে হাত রেখে আলগোছে সরায় সে তৃপ্তির মাথা,
–“বাঘিনী একটা।”
তৃপ্তির নজর অশ্রু ঘেরা।এতক্ষণ জিদ লাগলেও আদ্রিনের বুকে ছোপ ছোপ রক্তের আস্তরণ দেখে হৃদয় খন্ড হয় মেয়েটার।এক প্রকার আর্তনাদ করে সে,
–“আল্লাহ্,রক্ত!আদ্রিন সরি। ব্যথা করছে?”
ঝরঝর করে অশ্রুতে গাল লেপ্টে যায় তৃপ্তির মুহূর্তেই।
নাক টেনে এক ধনে শাড়ির আঁচল দ্বারা বুকে আলতো ভাবে স্পর্শ করছে তৃপ্তি।আদ্রিন নেশাক্ত দৃষ্টিতে চেয়ে রয় তার অর্ধাঙ্গিনীর পানে।মেয়েটা তার অর্ধাঙ্গিনীর পাশাপাশি এখন তার অস্তিত্বের মালকিন। পাজকোলা করে তুলে সে তৃপ্তিকে। অধরে অধর মেলায়।তির্যক হেসে বলে,
–“তোমার কামড় আমি সহ্য করে নিলাম।কিন্তু বরাবরের মতো আমার কামড় সহ্য হবে তোমার?”
…………
অনার্সের চূড়ান্ত পরীক্ষা শেষ হয় তৃপ্তির গতমাসে।পরীক্ষা ভালো দিয়েছে।আলেয়া তার ভালো পরীক্ষা দেওয়ার অন্যতম কারণ।পঞ্চম মাসে তার পেট তেমন একটা বুঝা যায়নি পরীক্ষার সময়।তবে, এখন ছয়মাস চলাকালীন তার পেটের আকার বেড়েছে।অত্যধিক রূপবতী মনে হয় মেয়েটাকে।হাসলে গালের দুদিকে উঁচু হয়।বাড়িতে রিয়ানা এসেছে।সাফা আসবে স্কুল হতে।

ঐ বাড়িতে আজ হলুদের অনুষ্ঠান।রাফির হলুদ।তাই রিয়ানা এই বাড়ি হতে হবে সেথায়।তৃপ্তি হলুদের অনুষ্ঠানে যাবে বাড়িতে হওয়ার সুবাদে।কিন্তু,বিয়ের অনুষ্ঠানে যাওয়া তার জন্যে মানা।আদ্রিন মানেনি একদণ্ড।তৃপ্তির জন্য তার চিন্তা,যত্ন,স্নেহ সব যেনো আকাশ ছুঁয়ে।পূর্ব হতেও বেশি ক্ষিপ্ত থাকে এখন সে।তৃপ্তির কিঞ্চিৎ অসুবিধে হলে সে মাথায় তুলে পুরো ঘর।
ইনায়া গত রাতে সেই বাড়িতে ফিরে।

পরিবেশে উত্তাপ বেশ।বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামলেও রোদের উত্তাপ এখনো অনুভব করা যায়।
তৃপ্তিকে শাড়ি পড়তে সহযোগিতা করে রিয়ানা। কাঁচা হলুদ রঙের শাড়ি।রিয়ানা বেশ পরিপাটি সাজিয়ে দেয় তৃপ্তিকে।ঠোঁটে কড়া খয়েরী লিপস্টিক।সুন্দর সাজগোজ। হাতে রজনীগন্ধার টাটকা মালা।নিজের অবয়ব দেখে নিজে সন্তুষ্ট তৃপ্তি।আদ্রিন অফিসে যাওয়ার পূর্বে সতর্ক করেছে,ঠিকভাবে যেনো সবটা গুছিয়ে রাখে।
রিয়ানা তৃপ্তিকে সাজিয়ে নিজ রুমে ফিরে।তৃপ্তি আয়রন করে রাখা আদ্রিনের পাঞ্জাবি বের করে আলমিরা হতে।অনুষ্ঠানে যেতে এই লোকের জন্যে দেরী হবে।তাই আদ্রিন জানিয়েছে তার জন্যে পাঞ্জাবি যেনো প্যাকেটে নেয়। ঐ বাড়িতে তৈরি হবে সে।

রাত সাড়ে দশটায় আদ্রিন ফিরে বাড়িতে।ততক্ষণে তৃপ্তির একবার ঘুম খতম।আদ্রিন গাড়িতে হর্ন দিলে রিয়ানা ডাকে তৃপ্তিকে।অতঃপর তারা তিনজন গাড়ির পানে যায়।
গাড়িতে বসতেই রিয়ানা বলে,
–“এত দেরী করে এসেছিস।তোর বউয়ের একবার ঘুম তামাম।”
তৃপ্তি আদ্রিনের পাশের সিটে।হেলান দিয়েছে সন্তর্পনে।ডান হাতে গাড়ির স্টিয়ারিং সামলে বাম হাতে সে তার প্রেয়সীর গালে হাত রাখে,
–“ঘুম হয়েছে?”
–“জ্বী।”
স্বর বসেছে তার।দক্ষ হাতে স্টিয়ারিং সামলে গাড়ি সম্মুখে এগোচ্ছে আদ্রিন।একা অবস্থায় যেমন গাড়ি চালায়,এখন তার প্রাণের জন্যে সেই কায়দায় বিরাট পার্থক্য।

বাড়ির সম্মুখে বিরাট আলোর মিছিল।রাতকে দিন বানিয়ে ছাড়লো।রিয়ানা,সাফার সাথে নামে।প্রধান ফটকের সামনে রিয়ানার স্বামী দাঁড়িয়ে।সাফা বাবার নিকট দৌড়ে পৌঁছায়।আদ্রিন তৃপ্তিকে সাবধানে নামতে সাহায্য করে।রিয়ানার স্বামী তাদের সাথে কুশল বিনিময় শেষে সকলকে নিয়ে ভেতরে যায়।তৃপ্তির হাত চেপে আদ্রিন। এতটুকু পথ অতিক্রম করছে তার মাথায় আগুন ধরিয়ে।আশেপাশের কেউ কেউ তাদের পানে তাকানোটা তার নিকট অসহ্য ঠেকছে।

বাড়ির সকলের সাথে দেখা হলে তৃপ্তির ক্লান্তি পালায়। প্রিয়, রূপমও এসেছে।ভাইবোনের সাথে মধুর আলাপে ব্যস্ত তৃপ্তি।আদ্রিনের রুমে সে।আত্মীয় স্বজনদের অনেকে এই রুমে এসে সাক্ষাৎ করছে তৃপ্তির সহিত। দাদীও দুবার দেখে গেলো মেয়েটাকে।দাদীর প্রতি ক্ষোভ নেই তৃপ্তির।সন্তান আসছে শুনে দাদী ছুটে এসেছিল বাড়িতে।স্বর্ণের চেইন উপহার দিয়েছিল সেইবার।

আদ্রিন রাতের খাবার নিয়ে রুমে আসে।নিচে খায়নি সে।
তৃপ্তির মুখ মলিন।অনুষ্ঠানে সে এসে কি লাভ হলো?আদ্রিন তাকে বেরুনোর নির্দেশনা দিচ্ছে না।এক লোকমা মুখে পুরে তৃপ্তির নিকট অন্য লোকমা এগিয়ে দেয় সে,
–“ডিনার করেছো অনেক আগে।খাও আবার।”
তৃপ্তি হাত সরিয়ে দেয় আদ্রিনের,
–“আপনি খান।অনুষ্ঠান দেখার সুযোগ দিচ্ছেন না।আবার কিসের খাবার?”

তৃপ্তির কথায় পাত্তা দেয়নি আদ্রিন।দ্রুত লোকমা পুরে দেয় মুখের অভ্যন্তরে,
–“কথা কম।খেয়ে ঘুমিয়ে পড়বে।তোমার শরীর কাঁপছে এখনো।আমি দেখছি জান।”
–“নাহ। ঘুমাবো না।”
তৃপ্তি জিদ করে।

–“আচ্ছা ঘুমাইস না।আমি ঘুমাবো।আমাকে ঘুম পাড়িয়ে দিবি।”
আদ্রিন রেগে যায়।তৃপ্তি আবেগপ্লুত হয় সন্তর্পনে।লোকটার হাত চেপে ধরে।অধর এগিয়ে গাল ছুঁয়ে দেয়,
–“দিবো তো।”
আদ্রিন হাসলো না।মেয়েটাকে ঘুম পাড়ানোর ফন্দি এঁকেছে সে।

হাত ধুয়ে আদ্রিন পাঁচ মিনিট হাঁটে রুমে।পাঞ্জাবি খুলে।তৃপ্তির দৃষ্টি এই মানুষটার উপর হতে সরে না কখনো। সুঠামদেহী মানুষটার মাঝে তৃপ্তির সুখ দুঃখ সব আটকে।
তৃপ্তির শাড়ি হতে পিন খুলে আলগোছে।যত্ন করে শুইয়ে দেয়।
–“আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দাও।আমি টায়ার্ড।”
তৃপ্তি তার কথা রাখে।ধীরে স্পর্শ করে আদ্রিনের পরিপাটি চুলে।দেখা গেলো,মিনিট দশেকের মাথায় তৃপ্তি ঘুমিয়ে কাঁদা।

আদ্রিন তার গায়ে চাদর টেনে,দুপাশে বালিশের আস্তরণ দিয়ে রুম ত্যাগ করে।আদ্রিন জানতো মেয়েটা ঠিকই ঘুমাবে।

তৃপ্তির আজ কি হলো জানেনা।আদ্রিন যাওয়ার বিশ মিনিটে তার তন্দ্রা ছুটে।উঠে বসে দম ফেললে দেখে রুমে দাদী আসলো। হাতে বাহারি খাবার।তৃপ্তি লোভ সামলাতে পারেনি।কয়েক আইটেম অনায়াসে খেতে শুরু করে।দাদী খাবারের ট্রে দিয়ে চলে যায়। দাঁড়ায়নি এক পল।
—–
নিচের পরিবেশে আনন্দের জোয়ার।ভাই ব্রাদার সকলে পানীয় খেতে ব্যস্ত। রাফি ভাইয়ের দিকে এক বোতল এগিয়ে দেয় হাসিখুশি মুখে।আদ্রিন মাথা নাড়ে,
–“একদম না।তোর ভাবী সিক।ওকে রাতে সামলাতে হবে।”
–“বাহ ভাই।তুমি সেরা।”
রাফি ঠাট্টা করে।
আদ্রিনও সায় দেয়।হাসে সে।শুধু রাফি কেনো!পুরো পরিবার জানে তৃপ্তির জন্যে আদ্রিন ঠিক কতটা উন্মাদ।
ভারী গান বাজনায় অনুষ্ঠানে জান এসেছে।আদ্রিনের চিন্তা হয়।ব্যালকনির দরজা বন্ধ করেছে নাকি এই নিয়ে সন্দেহ।অতিরিক্ত শব্দ তৃপ্তির শরীরের জন্যে ক্ষতিকর।
লম্বা কদমে হাঁটে সে।তৃপ্তিকে ছেড়ে এসেছে বেশিক্ষণ হলো না।

রুমের দরজা সটান খোলা।আদ্রিন ঘাবড়িয়ে।দরজা খোলা কেনো!রুমের আঙিনায় পা রাখতেই তার জগৎ ঘুরলো,মাথা কাজ করা বন্ধ করলো।তৃপ্তির পুরো মুখ রক্তিম। পেটে হাত রেখে কাঁদছে সে। এক প্রকার চিৎকার করছে।রিয়ানা,ইনায়া দুজনে তাকে সামলাতে বেগ পাচ্ছে যেনো।
–“ও আদ্রিন একা ফেলে কেনো গিয়েছিলে ওকে রেখে?মেয়েটার কি হয়েছে?”
ইনায়ার আর্তনাদে কান ভারী হয় আদ্রিনের।

দ্রুত ছুটে এসে তৃপ্তির পানে।তৃপ্তিকে কোলে তুলে নেয় সে সাবধানে। হাক ছাড়ে সে,
–“আপু,ভাইয়াকে বলো গাড়ি বের করতে।”
তৃপ্তির শক্তি ফুরিয়েছে। কান্নাটা আর আসছে না। গাড়িতে সে একেবারে নিস্তেজ।আদ্রিনের বুকের সাথে লেপ্টে আছে মেয়েটা।ভয় পাচ্ছে আদ্রিন।থরথর করে কাঁপছে তার শরীর।মেয়েটার কানে কানে বিড়বিড়িয়ে যাচ্ছে সে সমানতালে,
–“কিছু হবে না,জান।আমি আছি,আল্লাহ্ আছে। একটু সাহস রাখো। একটু ধৈর্য ধরো।”

তৃপ্তির সমস্যা হয়েছিল এলার্জিগত কারণে।আপাতত সে অবজারভেশনে।আদ্রিনের অবস্থা পাগলপ্রায়।সে তৃপ্তির হাত চেপে বসে।রিয়ানা আসেনি।ইনায়া বাহিরে।ডাক্তার কথা বলছিলো তার সহিত।এক মুহূর্তের জন্যে আদ্রিনের নিজেকে সর্বহারা মনে হয়েছে।দুনিয়ায় সবচেয়ে অসহায় যেনো এই আদ্রিন নামের ছেলেটা।

দুদিন যাবত তৃপ্তি হাসপাতালে।হাতের ক্যানেলার কারণে রক্ত উঠে ফুলে থাকে হাত সর্বদা।আদ্রিনের দাদীর আগমনে সে ঔষধ আনতে বেরোয়।সকালে ফুরিয়েছে।তৃপ্তির অবস্থা এখনো নড়বড়ে।দাদীর ফোনে কল আসলে মহিলা বাহিরে যায়। একজন নার্স আছে ভেতরে।কথা শেষে বলে,
–“মারতে পারলাম কই?রিয়ানা আর ইনায়া সর্বদা লেগে থাকে।আর আদ্রিনের কথা কি বা বলবো!সে পারেনা মেয়েটাকে গলায় ঝুলিয়ে রাখতে।সমস্যা নেই।একটা বিহিত আমি করবো।”

–“কার সাথে কথা বলছো দাদী?”
আদ্রিনের হাসিমুখ।সবে ফিরেছে সে।দাদী ব্যাপক ভয়ে।শুনেছে কি কিছু?হয়তো না।শুনলে নিশ্চয় রিয়েক্ট করতো।
–“কেউ না।পরিচিত একজন।মেয়েটার খেয়াল রাখিস।আমি আসছি।”
দাদী চলে যায়।

আদ্রিন কেবিনে ঢুকে।সবে বাথরুমের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে তৃপ্তি।তাকে সাহায্য করছে নার্স।
———-
পরদিন তুমুল বৃষ্টিতে ধরণী জর্জরিত। তৃপ্তি জানালার ধারে দাঁড়িয়ে।কি সুন্দর বর্ষণ!একেবারে সমান্তরাল।মানুষের ছোটাছুটি স্পষ্ট দৃশ্যমান।তৃপ্তির ইচ্ছে করলো একটু বৃষ্টিতে নিজেকে সাজাতে।পরক্ষণে হাত পৌঁছায় পেটে।তার বাড়ন্ত অংশটার কারণে সে শঙ্কিত।বড় বিপদ হতে রক্ষা পেয়েছে বাচ্চাটা।আড়ষ্ট হয়ে তৃপ্তির তনু। তখনই প্রবেশ ঘটে আদ্রিনের।নার্স কেবিন ত্যাগ করে।প্রথম দিন হতে নার্স বুঝেছে এই লোকটা এই মেয়ের প্রতি বড্ড আসক্ত।সেদিন কি চিল্লানো না চিল্লিয়েছিলো লোকটা।দোষ ছিলো ওয়ার্ড বয়ের, হুইল চেয়ার আনতে দেরী করছিলো।

তৃপ্তির কি হয় জানেনা।সে হুট করে জড়িয়ে ধরে আদ্রিনকে।অনেকটা ঝুঁকে যায় আদ্রিন,
–“বিছানায় বসো।এরপর জড়িয়ে ধরছি।ব্যথা পাবে তো।”
–“পাবো না।”
তৃপ্তি নাক ঘষে ছেলেটার বক্ষে।
–“বসো না রে বাবা।”
আদ্রিন অনুরোধ করে।
তৃপ্তি মাথা উঠায়।লোকটার পানে চায়।একটু ভিজেছে কি আদ্রিন?আঁখি পল্লব ভিজে কেনো?
–“ভিজেছেন?”
–“অল্প।এইযে লবিতে আসতে আসতেই।”
তার কোমরে হাত পেঁচায় আদ্রিন।

তৃপ্তি ইশারায় আরো ঝুঁকতে বলে আদ্রিনকে।আলগোছে দুহাত রাখে সে আদ্রিনের গালে,
–“আপনি অনেক সুন্দর।”

হাসে আদ্রিন।তার শরীর দুলে,
–“শুনে খুশি হলাম।বসো এবার।”
তৃপ্তি দ্বিমত করেনি। বেডে বসলে আদ্রিন তার উরুতে শুয়ে পড়ে,
–“আগামীকাল ডিসচার্জ দিবে।বাসায় খুব সাবধানে থাকবে।তুমি আমার সব রে জান।আমি পারছি না তোমাকে আমার অভ্যন্তরে আটক করি।”
তৃপ্তি শব্দ করে হাসে।মেয়েটার এই হাসি আদ্রিনের
অতিপ্রিয়।
–“সারাজীবন এইভাবে হাসবে,আমার সাথেই বাঁচবে।”
ছেলেটার একেকটা বাণীতে তৃপ্তির সর্বসুখ।মনে মনে সে আওড়ায়,
–“আপনি ছাড়া আমার জীবনটা অপরিপূর্ণ,আদ্রিন।”
__________
বাসায় ফিরে তৃপ্তি।হাসপাতালের স্যাভলনের গন্ধ হতে পরিত্রাণ পেয়ে সে খুশি। ঐ এক গন্ধ অসহ্য লাগে তৃপ্তির।তার বাড়ির সকলে এসেছে তাকে দেখতে।
কিছুদিনে নিজের পূর্বের জোর খুঁজে পায় সে শরীরে।বাগানে হাঁটাচলার করে নিয়ম মাফিক।অনেকটা সময় সে সার্ভেন্টের সহিত থাকে,অনেকটা সময় ইনায়ার।মাঝে মাঝে রিয়ানাও আসে।
তৃপ্তির মনে বিষাদ চেপে।গত রাতে সে আদ্রিনকে দেখেছে এরপর আর দেখা হয়নি। এখনো সন্ধ্যা হতে চলছে।অথচ লোকটার হদিস নেই।ইনায়া পার্টি অফিসে।তৃপ্তি ফোন করলে আদ্রিনকে সে জানায় পনেরো মিনিটে আসছে।

ঠিকই সময় সময়ে কথা মিলে তার।আদ্রিনের মেজাজ ফুরফুরে। সার্ভেন্টকে সে পাঠায় খাবারের ব্যবস্থা করতে।আজ তারা গার্ডেনে নাস্তা সারবে।
–“আজ বড্ড খুশি লাগছে আপনাকে!”
–“কই?”
আদ্রিন নিজের রূপ পরিবর্তনের চেষ্টায়।

তৃপ্তি কিছু বলতে চায়।এর পূর্বে ফোন আসে রিয়ানার।তৃপ্তি জানতে পারে দাদী স্ট্রোক করেছে।প্যারালাইসিস হয়েছে সারাজীবনের জন্য উনার পুরো শরীর।আদ্রিন এতক্ষণ যাবত হাসপাতালে ছিলো।
তৃপ্তি অবাক বনে।লোকটা তাকে কিছু বলেনি!

ফোন রাখলে তৃপ্তি প্রশ্নবোধক চেহারায় ফিরে আদ্রিনের পানে,
–“দাদী স্ট্রোক করেছে।উনি আজীবনের জন্যে প্যারালাইসিস হয়েছে।আপনার স্যাড থাকার কথা।অথচ আপনি হাসছেন!”
–“কান্না করার কথা আমার?”
আদ্রিন উল্টো প্রশ্ন করে।
তৃপ্তি জবাব না দিলে,আদ্রিন তার কাঁধে হাত রাখে।মাথার কিনারায় অধর ছুঁয়ে দেয়,
–“ভেতরে নাস্তা করবে।এইখানে খাওয়ার মুড নেই।”

–“দাদীর এমন অবস্থা আপনি করেছেন?”
তৃপ্তির প্রশ্নে থমকে যায় আদ্রিন।আঁখি তার রক্তিম।হ্যাঁ,সেই করেছে এমন অবস্থা।সেদিন হাসপাতালে দাদীর বুলি শুনতে ভুল করেনি আদ্রিন। রাগে শরীর জ্বললেও,মস্তিষ্ককে স্থির রেখে সবটা সামলেছে।কৌশলে বাড়িতে গিয়ে দাদীর ঔষধের কৌটায় একই রকমের বিষাক্ত বড়ি রেখেছে।অথচ কেউ জানে না।না কোনোদিন জানবে।নিষ্পাপ মেয়ে আর তার ভ্রূণকে হত্যা করতে চেয়েছিলেন দাদী।তার প্রাপ্য কি এমন হওয়া উঠিত নয়?

–“সেদিন দাদীর সেই কথা আমিও শুনেছিলাম আদ্রিন।বাথরুমে যাচ্ছিলাম।দরজার নিকট গেলে দাদীর কথা শুনি ।আপনাকে জানায়নি কারণ আপনি নিশ্চয় উনাকে ছেড়ে দিবেন না।তাই বলে এমনটা করবেন?”
তৃপ্তির প্রশ্নে আলতো হাতে তার গাল চেপে ধরে আদ্রিন।চোখ মুখ তার করুণ।পরক্ষণে সে হাসে। ব্রিভান্তকর হাসি।কাছে টানে তার প্রেয়সীকে।ঘাড়ে হাত বুলায়,
–“বারবার সতর্ক করেছি সবাইকে।তোমার ক্ষতি কেউ করলে তার অস্তিত্ব আমি রাখবো না।দাদী কাছের মানুষ আমার।তাই বাঁচিয়ে রেখেছি।”

–“এমন পাগলামি কেনো করেন?”

তৃপ্তির প্রশ্নে তাকে বাহুডোরে আবদ্ধ করে আদ্রিন,
–“তোমার জন্যে আমার পাগলামি কখনো কমবে না।হাজারো অতৃপ্তির ভিড়ে আমার একমাত্র তৃপ্তি তুমি।আমার সুখ,শান্তি,প্রশান্তি সব তোমাকে ঘিরে।এই আদ্রিন তার সবকিছুর বদলে তোমাকে চায়।সেই তৃপ্তির দিকে কেউ হাত বাড়ালে, হাতটা রাখবো না আমি,
মেহেবুবা।দুনিয়াটা খুব ছোট,এই ছোট জীবনে সর্ব পরিসরে আমার কেবল তুমি নামক তৃপ্তিকে চাই।”
তৃপ্তি পিঠে হাত রাখে আদ্রিনের।

এই প্রেমিক পুরুষকে তার কি বা বলার আছে?কিছু বলার মতো ভাষা নেই তৃপ্তির।
অতঃপর তৃপ্তি হাঁটতে আরম্ভ করে আদ্রিনের সহিত।আদ্রিনের হাত মেয়েটার কাধ চেপে,অন্যহাত তার অস্তিত্বের বাড়ন্ত অংশে।অধর স্পর্শ করে মেয়েটার কপালের কিনারায়।
তৃপ্তি নিশ্চুপ।মনে তার হাজারো ভাবনা। কিছু মানুষের ভালোবাসা প্রকাশ হয় অন্যরকম,একেবারে বা ব্যতিক্রম।তৃপ্তি আদ্রিনের অন্যরকম ভালোবাসায় মগ্ন।তৃপ্তি জানে হাজার কিছু বিনিময়ে আদ্রিন কেবল তৃপ্তিতে চায়।কয়জনই বা পায় তার জীবনের তৃপ্তিকে?যে প্রশান্তি রূপে নেমে আসে তাদের ধরণীতে,রাঙিয়ে দেয় তাদের পুরো পৃথিবী!
আদ্রিনের ভালোবাসা তার তৃপ্তির প্রতি ব্যতিক্রম,
উন্মাদনায় ঘেরা।আদ্রিনের শার্টের অংশ খাঁমচে ধরে মেয়েটা।খুব করে দোয়া করে,অতৃপ্তির মাঝে নিজ তৃপ্তিকে খুঁজে নেওয়া সকলের নসিবে যেনো সার্থক হয়।

-সমাপ্ত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here