অতৃপ্তির মাঝে তৃপ্তিময় সে পর্ব -১৫+১৬

#অতৃপ্তির_মাঝে_তৃপ্তিময়_সে
#লেখিকা- সালসাবিল সারা
পর্ব -১৫
________________
৩৩.
–“আদ্রিন,উঠুন প্লিজ।সন্ধ্যা হতে চললো।বৃষ্টিও থেমে এখন।আপনার ফোন বাজছে বারবার।উঠুন।”
মৃদু কন্ঠে হাঁক ছাড়ছে তৃপ্তি।আদ্রিন তার কাঁধে মাথা রেখে তন্দ্রাসক্ত।ঘণ্টা খানেক হলো আদ্রিনের গভীর ঘুমের।দুইজনেই বারান্দায় বসে বৃষ্টি বিলাস করছিলো, হুট করে পাশ ফিরতেই তৃপ্তি দেখে আদ্রিন দেওয়ালে হেলান দিয়ে ঘুম।নিশ্চয় ছেলেটার ঘুম পরিপূর্ণ হয়নি রাতে।আজ সারাদিন হয়তো ঘুমানোর পরিকল্পনা ছিলো তার।কিন্তু,তৃপ্তির জন্যে সবটা হাওয়ায় মিললো যেনো।আদ্রিনের ঘুমে ব্যাঘাতের জন্যে তৃপ্তি সম্পূর্ণ নিজেকে দোষারোপ করতে ভুল করলো না।দুইজনের মাঝে দূরত্ব ছিলো কিছুটা।আদ্রিন ঘুমানোর পর তৃপ্তিই তার সন্নিকটে যায়।উদ্দেশ্য ছিল দুজনের কিছু ছবি তুলবে,তাও আদ্রিনের অগোচরে। তুলেছিলোও ঠিক, অতঃপর নিজ জায়গায় ফিরে আসার পূর্বেই আদ্র আবহাওয়ায় তৃপ্তির শরীরের উষ্ণতা অনুভব করে তার সংস্পর্শে এসে জড়িয়ে ধরে কাঁধে মাথা রাখে।সেই যে এমন অবস্থায় তৃপ্তি আটকে পড়েছে,এখনো তার এই অবস্থা বহাল।আদ্রিন খানিকটা নড়ে আরো আঁকড়ে ধরলো তৃপ্তির হাত।কম্পন সৃষ্টি হয় মেয়েটার তনুয়।

পুনরায় মোবাইল শব্দ করলে তৃপ্তি আদ্রিনের কাঁধ ধরে ঝাঁকায়,
–“উঠুন,উঠুন।”
আদ্রিন হালকা নড়ে।তন্দ্রা খানিক ছুটতেই মোবাইলের শব্দ শুনে সোজা হয়ে বসলো সে।বাম হাতের সাহায্যে চুল ঠিক করে অপর হাতে মোবাইল বের করলো।ইনায়ার নাম্বার দেখে কল রিজেক্ট করে তৃপ্তির পানে তাকায় আদ্রিন।মেয়েটা তার কাঁধ চেপে।হয়তো ব্যথা করছে কাঁধ।তৃপ্তির বাহু আঁকড়ে আদ্রিন তাকে আরো নিকটে টানলো।তৃপ্তি বেশ অবাক।সে আতঙ্কিত নজরে আদ্রিনের পানে তাকাতেই,তার কাঁধে হাতের উল্টো পিঠ ছুঁয়ে হাসে আদ্রিন,
–“ব্যথা করছে?”
তৃপ্তি ইতস্তত বোধ করে জবাব দেয়,
–“অল্প।”
–“যখন মাথা রেখেছিলাম তখনই বলে দিতে আমাকে।আসলে টায়ার্ড ছিলাম অনেক।তাই কবে এমন গভীর ঘুমে মত্ত হয়েছি বুঝতেই পারিনি।এছাড়াও আরেকটা কারণ ছিলো গভীর ঘুমের।”
আদ্রিনের ঘুমঘুম মুখশ্রীতে দুষ্টুমির ছাপ।লজ্জায় মাটিতে মিশে যায় তৃপ্তি। নিজেকে সংবরণ করে প্রশ্ন করে,
–“কেনো?”
–“তুমি ছিলে পাশে তাই।বিলিভ মি,তোমার গায়ের মাতাল স্মেলে,নরম স্পর্শে আরো বেশি ঘুম পেয়েছে আমার।ভাগ্যিস ছবি তুলতে আমার পাশে বসেছিলে।”
আদ্রিন গভীর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তৃপ্তির সত্তায়।মেয়েটা নুয়ে যাচ্ছে।তার সাথে দৃষ্টির লুকোচুরি খেলছে অন্তরালে।লজ্জায় মোড়ানো এই তৃপ্তির রূপ বজ্রপাতের লাহান।তার এহেন রূপে সিক্ত হচ্ছে আদ্রিনের সারা সত্তা।মেয়েটার হলদেটে শুভ্র গালের দু পাশে কেমন রক্তিম হচ্ছে।
আদ্রিনের উপর হতে দৃষ্টি সরিয়ে তৃপ্তি ভাঙা কণ্ঠে আওড়ায়,
–“আপনি ঘুম ছিলেন।তাহলে কিভাবে বুঝলেন আমি ছবি তুলতে এসেছিলাম!”

এক চোখ বুঁজে তৃপ্তির কানে ফিসফিস করে আদ্রিন বলে,
–“বলেছিলাম,আমি ম্যাজিশিয়ান।”
তৃপ্তি উঠে দাঁড়ায়।লোকটার এমন ফিচেল কণ্ঠে তার শরীরের উত্তাপ বাড়ছে।লোকটা কি বুঝে না,আদ্রিন এতো কাছে আসলে তার অস্থির লাগে,সাথে মনের মাঝে নানান ভাবনার আগমন হয়। এইভাবেও আজ মানব পাঞ্জাবি পড়েছে।এটাই তৃপ্তিকে তার প্রতি মাতোয়ারা করতে যথেষ্ট ছিল।তার উপর আদ্রিনের এমন আচরণে মেয়েটা নিজের হুঁশ খোয়াচ্ছে।নিজেকে আয়ত্বে আনতে সে হিমশিম।বিষয় বদলাতে তৃপ্তি আদ্রিনের পাশ হতে উঠে দাঁড়ায়,
–“চলুন,বাসায় যায়।”
–“শেষ বেড়ানো!”
আদ্রিনও উঠে পড়ে।নিজ ঘাড়ের পেছনে হাত বুলায়।

–“হ্যাঁ,শেষ।এসেছি অনেক্ষণ হলো।”
–“আচ্ছা।চলো তবে।”
আদ্রিনের আদেশ পেয়ে তৃপ্তি বাক্স দুটো নিতে গেলে আদ্রিন থামায় তাকে,
–“আমি নিচ্ছি।”
তার কথার প্রত্যুত্তরে তৃপ্তি স্নেহপূর্ণ হাসে।সে আদ্রিনের আগেই হাঁটা আরম্ভ করলো।দুজনে গাড়ির কাছাকাছি যেতেই এগিয়ে এলো রুদ্র। থমথমে সুরে সে বলে,
–“রাস্তায় আ’ন্দোলন চলছে।ভোটের রেজাল্ট দিবে একটু পর।তাই সকলে উত্তাল।ভোটের রেজাল্ট দিলে অবস্থা আরো বেগতিক হতে পারে।”
আদ্রিন কিছু বলার পূর্বেই তার ফোন বেজে উঠে পুনরায়।আদ্রিন এইবার ফোন রিসিভ করলো,
–“বারবার কল দেওয়ার মানে কি আম্মি!”
–“রাস্তায় ঝামেলা হচ্ছে,তুমি ঠিক আছো?”
ইনায়ার চিন্তিত কণ্ঠ ওপাশ থেকে।
–“আমি ছোট বাচ্চা না।নিজের খেয়াল রাখতে জানি।”
সুর বড্ড গম্ভীর আদ্রিনের।
–“কবে ফিরবে?”
–“বাড়ির বিজয় উল্লাস শেষে।”
আদ্রিন ফোন রাখে বিনা ইনায়ার উত্তরে।
পরক্ষণে সে রুদ্রকে জবাব দেয়,
–“মেইন রোড দিয়ে যাবো না।শর্টকাট রাস্তায় চলো।”
–“কোনদিকে?”
রুদ্র খানিক চিন্তিত।
–“যে রাস্তায় আমাকে কিডন্যাপ করেছিলো সেই রাস্তা দিয়েই।”
–“ওকে,আমি গার্ডদের নির্দেশনা দিচ্ছি।”
রুদ্র দ্রুত পায়ে এগোচ্ছে।
.
তৃপ্তি দমে আছে।আবারও সেই একই রাস্তা!যদিও সে জানে তৃপ্তি একেবারে নিরাপদ আদ্রিনের সন্নিকটে।তাও,মেয়েটার মন শ’ঙ্কায় ভরপুর।আদ্রিন গাড়িতে উঠতে নিলে তৃপ্তি তার পাঞ্জাবির পেছন অংশ ধরে থামায়,
–“ঐ রাস্তা দিয়ে না গেলে হয় না?”
আদ্রিন থামে।পেছন ফিরে মলিন হাসে সে,
–“হচ্ছে না।তোমার শরীর খারাপ আমি বুঝছি।বারবার ঘামছো এই বৃষ্টির দিনেও।বাসায় গিয়ে বিশ্রাম নেওয়া দরকার তোমার।”
–“তাই বলে সেই রাস্তায়?যদি আবার বিপদ হয়?”
তৃপ্তি কপালে হাত রাখে।তার সেই হাত আদ্রিন সরিয়ে দিয়ে বললো,
–“বিপদ আসলে উদ্ধার করার মালিক আল্লাহ্।এতো চিন্তার কিছু নেই।আমি আছি তোমার পাশে।তোমার উপর বিপদ আসার আগে সেটার সাথে আমি ডিল করবো।ভয় পায় না,মেহেবুবা।”
আদ্রিন নিজ অধর ছোঁয়ায় তৃপ্তির হাতের উল্টোপিঠে। এতে তৃপ্তির ভয় পালিয়ে জমা হলো ভালোবাসার অনুভূতি।কেমন শান্ত হলো সে প্রেমিক পুরুষের আশানুরূপ বাক্যে।
–“আমি আপনার জন্যে চিন্তা করছিলাম।আমি জানি আপনি আমাকে যেকোনো মূল্যে রক্ষা করবেন।কিন্তু আপনার জন্যে…”
–“রুদ্র আছে,গার্ড আছে।ডোন্ট ওয়ারি।আমি আছি তো তুমি সেফ।আর তুমি সেফ মানে আমি সেফ।আফটার অল,তুমি আমার স্বস্থি।”
আদ্রিন তৃপ্তির পিঠে হাত রেখে সামনে যাওয়ার আহ্বান জানায়।তৃপ্তিও নিশ্চিন্ত।এই আদ্রিন নামক পাগল সাথে থাকলে তারা দুজন সত্যি নিরাপদ।বাকিটা আল্লাহ্ এর হাতে।
অতঃপর বিনা সংকোচে রাজি হলো তৃপ্তি।

দূরান্তে দাঁড়ানো রুদ্র চাপা হাসে।আদ্রিনের জন্যে সে খুশি,বড্ড খুশি।সে খুব করে চাইতো,আদ্রিনের জীবনে একজন ভালোবাসার মানুষ আসুক।।তাদের উপর হতে দৃষ্টি সরিয়ে রুদ্র হাতের ইশারা করে গার্ডদের গাড়ি আরম্ভের নির্দেশনা দিলো।
৩৪.
সেদিন দুজনেই নিরাপদে বাসায় এসেছিলো।
ইনায়ার বিজয়ী উল্লাস এখনো থেমে নেই।সে ব্যস্ত নিজের নতুন পদ সামলাতে, নতুন কাজে এবং উল্লাসে।তৃপ্তির ব্যাপারটা আপাতত তার মস্তিষ্ক হতে মুছে।ইনায়া পূর্ব হতেই এমন।নিজের ক্যারিয়ারের পিছে ছুটার কারণেই তার আর আদ্রিনের সম্পর্কের মাঝে ফাটল ধরে। যা এখনো বহাল।না জানে আদ্রিন কখনো তার অখুশি শৈশবের জন্যে তার মাকে ক্ষমা করবে কি-না!আজও উল্লাস চলছে এই বাড়িতে।তিনতলা বিশিষ্ট এই বাড়ি আলোয় ঝলমলে।সকলে উক্ত অনুষ্ঠানে উপস্থিত হলেও বাড়ির দুই ছেলে নেই সেই অনুষ্ঠানে।
আদ্রিন এবং রাফি ছাদে।কোকাকোলার বোতলে আদ্রিন চুমুক দিতে ব্যস্ত তো হুইস্কির বোতলে চুমুক দিতে ব্যস্ত রাফি।দুইভাই চুপ।বিশেষ করে আদ্রিন।তার শৈশবের নানান স্মৃতি আজ উঁকি দিচ্ছে বারংবার।অফিস থেকে ফিরে বাড়ির এমন জমকালো পরিবেশ আরো তিক্ত করেছে আদ্রিনের মন।রুমেও তার মন টিকেনি।তাই,অনুষ্ঠান হতে রাফিকে নিয়ে সে ছাদে উঠেছে।
তৃপ্তি তার বাবার বাড়িতে দুইদিন যাবত।তার কাকাতো ভাই অর্কের বিয়ের কথা বার্তা চলছে।তাই ম্যাডাম সেই কাজেই মত্ত।আদ্রিন ফোন তুলে নেয় পাশ হতে।দুবার ফোন দিলো তৃপ্তিকে অথচ তৃপ্তির হেরফের নেই।থাকবেই বা কিভাবে!তৃপ্তি এখন তার কাকীর সাথে মিষ্টি বানাতে ব্যস্ত।

শব্দ করে আদ্রিন নিজের মোবাইল পাশে রাখলো বিরক্তিতে। তা দেখে হাসলো রাফি,
–“ভাবী ফোন তুলছে না?”
–“আমাকে সবাই ব্যস্ততা দেখাচ্ছে আজকে।”
কোকের বোতলে ফের চুমুক দিয়ে বললো আদ্রিন।
–“বিয়ে করছো কবে?”
রাফি সরু চোখে তাকায়।
–“যেদিন মেহেবুবা বিয়ের জন্যে প্রস্তুত হবে সেদিন।”
আদ্রিনের নজর মোবাইলে।এই বুঝি তার মেহেবুবার ফোন এলো।
–“যদি তোমার মা রাজি না হয়?”
–“কিছুই করার নেই।তাও মেয়েটা আমার হবে।বেশি ভালোবাসি তাকে।ওর প্রতি আমি দিনদিন আরো অবসেসড হচ্ছি।ওকে আমার চাই,সব রকমে চাই।”
কথার তেজ বাড়ার সাথে সাথে আদ্রিনের চোখের রং পরিবর্তন হচ্ছে।ছেলেটা হুট করেই যেনো রাগলো।
পরক্ষণে সে তৃপ্তিকে জ্ব’লন্ত একখান মেসেজ পাঠায়,
–“দেখা করো আমার সাথে। নাহলে তোমার বাবার বাসায় চলে আসবো আমি।যদি তোমার বাবার সাথে সব ঠিক থাকতো তোমার,তাহলে এই মেসেজটা দিতাম না।ডিরেক্ট তোমার বাবার বাসায় চলে আসতাম।কল মি সুন,মেহেবুবা।আই’ম মিসিং ইউ,তৃপ।”
মেসেজ পাঠিয়ে ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়লো আদ্রিন।তার এমন অস্থির অবস্থা দেখে হুইস্কির বোতল নিয়ে ছাদেই শুয়ে পড়লো রাফি,
–“একটা কথা বলবো ভাই?”
–“বলিস না।বিরক্ত লাগছে সব।”
আদ্রিন ভ্রু কুঁচকায়।
–“বিরক্ত হওয়ার দরকার নেই।আমি জানি,তোমার সাথে তৃপ্তি ভাবীর বিয়ে হবেই হবে।আফটার অল,পিরিতির আঠা একবার লাগলে আর ছাড়ে না।”
রাফির কথায় তির্যক হাসে আদ্রিন।তার এই হাসি বড্ড ব্যতিক্রম,
–“পিরিতির আঠা ছাড়ে নাকি জানা নেই।তবে,তৃপ্তি নামক আঠা আমার জীবনে মিশে একাকার।এই আঠা ছাড়ার উপায় নেই কোনো।”
.
কাজের চাপে ক্লান্ত তৃপ্তি রাতে মোবাইল চেক না করেই ঘুমিয়ে পড়েছিল।তবে,সকাল সকাল আদ্রিনের মেসেজ পড়ে তার মনটা সতেজতায় ভরপুর হয়।আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসে।আদ্রিনের মেসেজের বিপরীতে সে লিখে,
–“আজ ভার্সিটির ক্লাস শেষে দেখা হচ্ছে তবে।আমার ছুটি বিকাল চারটায়।”
ঘড়িতে নজর বুলায় তৃপ্তি।বেলা দশটা বাজে।ছেলেটা নিশ্চয় এখন অফিসে। মিটিংয়েও হতে পারে।তাই যেঁচে আর ফোন করলো না তৃপ্তি।
এলো চুলে হাত খোঁপা করে ভার্সিটির উদ্দেশ্যে তৈরি হওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো।তার ভার্সিটি এইখান হতে একেবারে কাছে।
মা মারা যাওয়ার পর যাতায়াত থাকলেও এই বাড়িতে থাকা হয়নি তার। এইবার কাকীর অনুরোধ সে নাকচ করতে পারলো না।অর্কের বিয়ের কথাবার্তায় ঘরের ছেলে-মেয়ে না থাকলে কি ভালো লাগে?তাই মা সমান কাকীর নরম অনুরোধে মেয়েটা অর্কের বিয়ে উপলক্ষে আসতে রাজি হয়।অর্কের পছন্দের সাথেই তার বিয়ের কথাবার্তা চলছে।খুব শীগ্রই বিয়ের তারিখ ঠিক হবে।
তৈরি হয়ে রুম থেকে বেরুতেই কোণায় অবস্থিত বাবা মায়ের রুম দেখে থমকে দাঁড়ায় তৃপ্তি।আঁখি জোড়া জ্বলছে তার।এই বাড়িতে অনেকবার এলেও কখনো বাবা-মায়ের সেই রুমে ঢোকেনি।যাওয়ার সাহস’ই পায়নি সে।
ধীর পায়ে নিচে নামছে তৃপ্তি।নিচে সকলের হট্টগোল।অর্ক তার বাকি ভাইবোন,কাকা-কাকী,পিসির সমাহার ঘর জুড়ে।এর মাঝে তার বাবা নেই।তৃপ্তি বুঝে,সে যেনো মন দিয়ে নাস্তা খায় তাই বাবার এমন গা ঢাকা।টেবিলে বসতেই মন খুশি হয় তৃপ্তির। অনেকদিন পর এই পরিবারের সকলের সমেত দেখা হওয়াটা আনন্দের।বড্ড প্রশান্তির।তৃপ্তি কেবল চায়ের কাপে চুমুক দিলে দিদা এসে কপট রাগ দেখায়,
–“খালি চা খাচ্ছিস কেনো?নাস্তা কে খাবে?”
–“দেরী হচ্ছে দিদা।”
–“সারাক্ষণই দেরী হয় তোর।বাড়িতে থাকলেও এমন করে মেয়েটা।এতো কিসের তাড়াহুড়ো তোর?”
চামেলী রাগ দেখায়।
–“এই নে, লুচিটা খা।”
দিদা জোর পূর্বক তৃপ্তিকে লুচি, আলুর তরকারি খাইয়ে তবেই চায়ে চুমুক দিতে অনুমতি দিলো।

ক্লাস শেষে দমে যায় তৃপ্তি।টানা অনেকক্ষণ ক্লাস তার বিরক্ত লাগে।তবে সেই বিরক্তি মুহূর্তেই উবে গেলো,যখন সে দেখলো গেইটের বিপরীতে গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে বুকে হাত গুঁজে আছে আদ্রিন।লম্বা অবয়বের এই পুরুষে যেনো পুরপুরি মজে যায় মেয়েটা।কালো শার্ট,কালো জিন্সে মারাত্মক সুদর্শন লাগছে তার মনের মানুষকে।তৃপ্তি দ্রুত হাঁটে আদ্রিনের পানে,
–“হ্যালো,ম্যাজিশিয়ান।”
তৃপ্তির উচ্ছাসিত কণ্ঠ সাথে হাস্যোজ্বল ভঙ্গিতে নজর আটকে যায় আদ্রিনের।নিজেকে সামলে সে জবাব দেয়,
–“মিস করছিলাম অনেক, তৃপ।”
লাজুক হাসে মেয়েটা।
–“আচ্ছা,তাই?”
আদ্রিন কিছু বলতে নেয়।কিন্তু,তৃপ্তি তার বাচনভঙ্গি আন্দাজ করে তাকে কিছু বলতে না দিয়ে নিজেই বললো,
–“ফুচকা খাবো আমি আজ।অনেকদিন ধরে খেতে ইচ্ছে করছে।”
–“আসো।”
আদ্রিন চোখ ছোট করে তাকায়।

তৃপ্তিকে গাড়িতে বসিয়ে ফুচকা অর্ডার করে আদ্রিন।পুনরায় গাড়ির কাছে এসে সে তৃপ্তিকে বললো,
–“বাহিরে আসবে? দেখো এইদিকের দৃশ্য বেশ সুন্দর।”
মাথা নাড়িয়ে বেরিয়ে আসে তৃপ্তি।তার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে হাতের মুঠো দখল করতে এক মিনিট সময় নিলো না আদ্রিন।তৃপ্তি এতক্ষণে বুঝলো সুন্দর দৃশ্য দেখানোর লোভটা একটা বাহানা ছিলো এই ছেলের।মনে মনে ব্যাপক হাসি পায় তৃপ্তির।ফুচকার দোকানে ভিড়।
তারই সুযোগ নিয়ে আদ্রিন প্রাণ জুড়িয়ে তার নজর দ্বারা তৃপ্তির সত্তাকে গ্রাস করছে।মেয়েটা কিঞ্চিৎ লাজুক আবার কিঞ্চিৎ উচ্ছাসিত।

হঠাৎই তাদের সামনে এলো হেলমেট পড়া এক যুবক।এসেই হাত নাড়ালো তৃপ্তির সম্মুখে,
–“কেমন আছো,তাসরিয়া জামান তৃপ্তি?”

তৃপ্তি হচকায়।ছেলেটা হেলমেট খুললে আঁখি জোড়া যেনো কোটর ভেদ করবে।আগুন্তক ছেলেটা আর কেউ নয় তারই প্রাক্তন,আরাফাত।
আদ্রিন আরো কাছে টানে তৃপ্তিকে।অনেকটা নিজের আড়ালে নিয়ে এসেছে তাকে সে।ছেলেটাকে দেখে ভ্রু কুঁচকে যায় আদ্রিনের।ছেলেটার চেহারা অনেকটা তার মতোই।তবে ছেলেটার দেহ কাঠামো দূর্বল।
–“আরাফাত তুমি!আমি বেশ আছি।”
তৃপ্তি জবাব দিলো।আরাফাতকে নিয়ে তার কোনো মাথা ব্যথায় নেই।আরাফাতের সাথে সম্পর্কের গোড়া এখন তার পাশেই শক্তপোক্ত দাঁড়িয়ে আছে।নিজের হাসি বেশ কষ্টে আটকে রেখেছে মেয়েটা।কতটা ব্যাকুল ছিলো সে আদ্রিনের প্রতি,যার দরুণ তার চেহারার সাথে মিল ছিলো এমন ছেলের সাথে নাম মাত্র সম্পর্ক করেছিলো।

–“এতদিন পর প্রাক্তনকে দেখে কেমন লাগছে?”
আরাফাতের প্রশ্ন শুনে আদ্রিন পুরোপুরি নিজের দেহের অবয়ব দ্বারা আড়াল করলো তৃপ্তিকে।
–“যে সম্পর্কের কোনো মূল্য ছিলো না,সেই সম্পর্কের আবার নাম?আবার প্রাক্তন?আগের মতোই হাবা তুমি।”
শব্দ করে হাসে তৃপ্তি।আদ্রিন রেগে যাচ্ছে।এই মেয়ে কেনো এমন প্রাণ’না’শি হাসি দিচ্ছে এই পাটকাটির সামনে?
আরাফাত কিছু বলতে চায়,কিন্তু আদ্রিন বলতে দিলো না,
–“চলো,ফুচকা রেডি আমাদের।”
আদ্রিন হাত টেনে দোকানের সামনে নিলো তৃপ্তিকে।
ফুচকা মুখে পুরে তৃপ্তি আদ্রিনকে হা করার নির্দেশ দিলে ছেলেটা তৃপ্তির হাত হতে ফুচকা মুখে পুরে নেয়।তৃপ্তি ইশারা করতেই আদ্রিন খানিক ঝুঁকে আর তৃপ্তি তার অধরের কিনারা পরিষ্কার করে বলে উঠে,
–“আমার প্রাক্তনটা জাস্ট নাম মাত্র প্রাক্তন।আপনার সাথে চেহারা মিল ছিলো বলেই তার সাথে সম্পর্ক হয়েছিলো আমার।তবে কোনো অনুভূতি ছিলো না।”
নিজের চেহারার সাথে মিল ছিলো বলেই তৃপ্তি সেই ছেলের সাথে সম্পর্ক করেছিলো,এটা শুনতেই ব্যাপক রহস্য হানা দিলো আদ্রিনের অন্তরে।কিন্তু,সে প্রশ্ন করলো না কোনো।তৃপ্তির পূর্বের সম্পর্ক নিয়ে তার কোনো সমস্যা নেই।আর যেহুতু তৃপ্তি বলেছে অত্র সম্পর্কের কোনো মূল্য নেই,তাই এই বিষয়ে আর কথা বাড়ালো না আদ্রিন।
–“বাদ দাও।আমার এইসবে মাথা ব্যথা নেই।আমি সবটা জানি আগে থেকে।”
তৃপ্তি অবাক হয়,
–“কিভাবে?”
–“আমি সব জানি।”
আদ্রিন নিজের চুলে হাত বুলায়।উপরে সে শান্ত দেখালেও ভেতরে সে অশান্ত।এতো এতো ছেলে এইখানে,অনেকেই তৃপ্তির পানে চেয়ে।মেয়েটা এমন নজর কাড়া’ই।হুট করে আদ্রিন তৃপ্তির মাথায় ঘোমটা টেনে দেয়,
–“সবাই তোমাকে দেখছে।আমার মাথা নষ্ট হচ্ছে,তৃপ।ফাস্ট খাও।”
তৃপ্তি হাসে আদ্রিনের কান্ড দেখে,
–“আপনি না একজন উন্মাদ,পাগল।”
–“কোনো কথা না,ফাস্ট তবে সাবধানে খাও।গলায় আটকে না যায় যেনো।”
আরো কাছে এসে দাঁড়ায় আদ্রিন তৃপ্তির পাশে।
আদ্রিনের এমন বিচলিত অবস্থা দেখে মনে প্রশান্তি আসে তৃপ্তির।ছেলেটা তার জন্য ব্যাকুল,তীব্র ব্যাকুল।
পেছনে ঘাড় বাঁকাতেই ক্রোধে ফেটে পড়ে আদ্রিন।আরাফাত তাদের পানেই তাকিয়ে।আদ্রিন তৃপ্তিকে একেবারে ঘেরাও করে।তার ভেতরকার অন্য সত্তা আপন মনে আওড়াতে থাকে,
–“ইচ্ছে করছে ছেলেটার চোখ নষ্ট করি।শেষ পর্যন্ত কি আমি খু’নির খাতায় নাম লেখাবো?”

চলবে…..
কপি করা বারণ।ইসস,আদ্রিনের মতো যদি কেউ আমাকে ফুচকা খাওয়াতে নিয়ে যেতো!(জাস্ট কিডিং)।#অতৃপ্তির_মাঝে_তৃপ্তিময়_সে
#লেখিকা- সালসাবিল সারা
পর্ব -১৬
_____________
৩৫.
–“আপনি এমন রেগে আছেন কেনো?আরাফাতের সাথে দেখা হওয়ার পর থেকেই আপনার মুখের অবস্থা এমন বারোটা বেজে আছে।”
তৃপ্তি একগাল হাসে।ভরা বর্ষণে গাড়ি রাস্তার এক পাশে স্থগিত।যদিও টুকটাক যানবাহন চলছে,তবে তৃপ্তির অনুরোধে আদ্রিন গাড়ি চালানোর সিদ্ধান্ত বাতিল করলো।তৃপ্তির কথায় আদ্রিন পাশ ফিরে।তৃপ্তির মুখে চাকচিক্য ভাব।সে আদ্রিনের অবস্থা দেখে নিশ্চিত মজা নিচ্ছে।
আদ্রিন ভ্রু কুঁচকায়।তৃপ্তির কথা সত্যি।আরাফাতের ব্যাপারটা হজম হচ্ছে না তার। যতক্ষণ তারা ফুচকার দোকানের সামনে ছিলো,ততক্ষণ আরাফাতের দৃষ্টি ছিল তাদের পানেই।যদিও তৃপ্তির অবয়ব নিজ অবয়ব দ্বারা আড়াল করেছিলো আদ্রিন,তাও কোথাও যেনো কিসের ক্রো’ধ থেকে যাচ্ছে তার।
তৃপ্তির সামনের চুল অল্প ভিজে।তাদের ফুচকা খাওয়ার মাঝে আচমকা বৃষ্টি নামে ধরণীতে। যার দরুণ,অর্ধেক খাওয়ায় স্বাদ মিটিয়ে দাম চুকে তৃপ্তিকে নিয়ে অতি দ্রুত গাড়িতে বসে আদ্রিন।সে চায় প্রিয়তমার ভেজা অবয়ব কেউ না দেখুক,সে ব্যতীত।ততক্ষণে দুজনের অবয়ব কিঞ্চিৎ ভিজে যায়।তীব্র বর্ষণ বলে কথা।যদিও সকলের ছুটোছুটির কারণে একে অপরকে দেখার সাধ্য ছিলো না। এতে স্বস্থি পেয়েছে আদ্রিন।কারণ,তার মেহেবুবার সকল অবয়ব কেবল তার জন্যেই নির্ধারিত।সকল গ্লানি মুছে গেলেও আরাফাতের গ্লানি তার মস্তিষ্ক হতে এক দণ্ড মুছছে না।তৃপ্তির ভেজা চুলে আঙুল চালিয়ে আদ্রিন জবাব দেয়,
–“আরাফাত নামের ছেলেটার ব্যাপারে কিছু শুনতে চাই না আমি।”
বড্ড থমথমে তার কণ্ঠস্বর।
–“তাহলে,হাসুন।অনেক্ষণ ধরেই আপনি গোমড়া মুখে বসে আছেন।”
তৃপ্তির সহজ জবাব।

–“হাসি আসছে না,তৃপ।আমি দোয়া করছি সেই ছেলে যেনো আমাদের সামনে আর না আসে।স্পেশালি তোমার সামনে।”
আদ্রিন সিটে গা এলিয়ে দেয়।বাহিরের ঝমঝম বৃষ্টির শব্দে পরিবেশকে অন্যরকম করছে।ক্রো’ধের পাশাপাশি আদ্রিন তার বুকের তীব্র শব্দ শুনতে পাচ্ছে স্পষ্ট।পাশে তার আবেদনময়ী প্রিয়তমা যে বসে আছে!স্নিগ্ধ লাগছে মেয়েটাকে।আদ্রিন নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্যেই তৃপ্তির অবয়ব হতে নজর সরিয়ে ফেললো তাৎক্ষণিক।

–“আরে,আপনি বেশি ভাবছেন।আরাফাত আমার সামনে আসলেও কি,আর না আসলেও কি।আমার জীবনে তার কোনো মূল্য নেই।আর সে যদি ঝামেলা করতে আসে,তবে…”
–“আই উইল কি’ল হিম।”
তৃপ্তিকে থামিয়ে আদ্রিনের জবাব।কণ্ঠস্বর তার ভিন্ন রকম।একেবারে অচেনা।তৃপ্তির নিকট সেই কণ্ঠস্বর কেবল হু’মকি মনে হলো।ভয় পায় মেয়েটা।ছেলেটা অত্যন্ত পাগলাটে।তাই আদ্রিনের বাহুতে আঙ্গুলে টোকা দিয়ে সে বলে,
–“বেশি বেশি!এইখানে মা’রার কি আছে?পাগলামি করবেন না।আপনি যদি এইসব বলেন তাহলে আমি আর দেখা করবো না আপনার সাথে।”

আঁখি জোড়া বুঁজে আদ্রিন।নিচের অধর তার দাঁত দিয়ে চেপে।নিশ্চুপ সে।বাইরের বৃষ্টির শব্দের তীব্রতা বাড়ছে।সেই শব্দে আদ্রিনের রেগে যাওয়া ফোঁস ফোঁস আওয়াজ হতে বেখবর তৃপ্তি।মিনিট দুয়েক পর নিজেকে সামাল দিয়ে আদ্রিনের শান্ত গর্জন শোনা যায়,
–“যেদিন আমি ম’রবো,সেদিন থেকে আমার সাথে কথা বলতে হবে না তোমার।আমি বেঁচে থাকতে এইসব কাজ অসম্ভব।আদ্রিন হতে তোমার নিস্তার নেই। ইউ আর অনলি মাইন।”(তুমি কেবল আমার)।
আদ্রিন নিরব হুমকি দিলো ঠিক।কিন্তু তার কণ্ঠস্বর ছিলো ধারালো।
বুকের মাঝের র’ক্তক্ষরণ হয় তৃপ্তির।প্রিয়জনের মুখে মৃ’ত্যু নামক শব্দটা বেমানান।বড্ড বেমানান।
আদ্রিন নিজের বক্তব্য শেষে গাড়ি চালু করলো। তীব্র ঝড় উপেক্ষা করে গাড়ি সামনে এগুচ্ছে।

সংশয়ে ভরে উঠে তৃপ্তির মন।অজান্তেই লোকটার মনে আঘাত করেছে সে। দিগ্বিদিক হারিয়ে সে আদ্রিনের বাম হাত ধরলো।ছলছল আঁখিতে ছেলেটার পানে চেয়ে সে। আদ্রিনের নজর সম্মুখে।একটিবার তাকাচ্ছে না সে মেয়েটার দিকে।তাকাবেই বা কেনো?মেয়েটা তো আদ্রিনকে বুঝলো না।অবুঝ মেয়েটা।
ধীরে ধীরে তৃপ্তি নিজ আঙ্গুলের ভাঁজ আদ্রিনের হাতের মুঠোয় চালান করলো।নরম কণ্ঠে শুধালো,
–“আর কখনোই এমন কথা বলবেন না।আমি সহ্য করতে পারবো না এইসব কিছু।আমি সরি বলছি আমার আগের কথার জন্যে।”
আদ্রিন চুপ করে থাকলেও তার মন নরম হয়।এইযে এমন ঠান্ডা আবহাওয়ায় আদ্রিনের কানের পিছে ঘামের আভাস স্পষ্ট।প্রিয়তমার আদুরে স্পর্শ ব্যাকুল করছে আদ্রিনের হৃদপিঞ্জিরা।
আদ্রিনকে নিশ্চুপ দেখে পুনরায় ঘাবড়ে যায় তৃপ্তি।হুট করেই যেনো হৃদয়টা কোমল হলো।আবেগের তাড়নায় আঁখি জুড়ে তার অশ্রু।মনের মানুষের অভিমানের বেদনা ছারখার করছে তৃপ্তিকে।তার ধারণা আদ্রিন সত্যিকারে কথা বলবে না তার সাথে।মায়ের পর নিজের দুর্বলতা সে কেবল আদ্রিনের সামনেই প্রকাশ করছে।সেই তাড়নায়,তৃপ্তির মেয়েলি স্বভাবের নরম মনের তীব্র কষ্টে কেঁদে উঠে সে শব্দ করে।সে চায় না,আদ্রিন নামক পুরুষ তার জীবন হতে দূরে যাক।
–“আপনি কথা বলুন আমার সাথে।প্লিজ আদ্রিন আমার অনেক কষ্ট হচ্ছে।এমন কষ্ট আমার আগে কখনোই হয়নি।আপনি আমাকে কখনো ছেড়ে যাবেন না প্লিজ।”

তৃপ্তির কান্নারত কণ্ঠে জোরেই ব্রেক কষে আদ্রিন। পুনরায় সাইডে রাখে গাড়ি। আঁকড়ে থাকা তৃপ্তির হাতের তালু সামান্য ঢিলে হতে নিলে আদ্রিন শক্ত করে সেই হাতের অংশ চেপে ধরে।তৃপ্তির পানে চেয়ে সে হতবাক। গালে মেয়েটার অশ্রু বর্ষণ হচ্ছে।কি চমৎকার দেখাচ্ছে তাকে!আদ্রিন বাঁকা হাসে।তৃপ্তির হাতের উল্টোপিঠে অধর ছোঁয়ায় সে।অতঃপর গালে আবদ্ধ পানি পুছে বললো,
–“আমাদের মাঝে ছাড়াছাড়ির কথা উঠাও নিষিদ্ধ করলাম।আমার সত্তায় মিশে গেছো তুমি।তোমাকে আমার থেকে আলাদা করা অসম্ভব।আদ্রিনের জাদুতে ঠিকই আটকে গিয়েছো তুমি,তৃপ।নো ওয়ান ক্যান সেপারেট আস।সত্যিই মে’রে দিবো তাকে,যে আমাদের মাঝে আসার ট্রাই করবে।”
তৃপ্তি মাথা দোলায়।কি ভয়ংকর কথার সাথে সম্মতি জানিয়েছে সে,এটা বুঝলোই না মেয়েটা।বিক্ষিপ্ত সুরে সমর্থন করলো সে নিজের প্রিয়তমকে,
–“ঠিক আছে।”

বৃদ্ধাঙ্গুল ছোঁয়ালো আদ্রিন তৃপ্তির গালের পাশে।পরক্ষণে মেয়েটার কপালে নিজ অধরের স্পর্শে কিঞ্চিৎ কম্পিত হলো তৃপ্তি।আদ্রিন তার কানে ফিসফিসিয়ে জবাব দেয়,
–“এই সাপোর্টটাই চেয়েছি তোমার থেকে, মেহেবুবা।এখন আমার কোনো বাঁধা নেই আর।তোমার দিকে নজর শুধু এই আদ্রিনের থাকবে।বাকি সবার তোমার দিকে তাকানো নিষিদ্ধ করলাম আমি।”
৩৬.
বৃষ্টির বিদায়ে,আকাশে রঙিন সূর্য।সোনালী রঙের সকালটা আজ বেশ ফুরফুরে।অর্কদের পক্ষ হতে মেয়ের বাড়িতে আজ তত্ত পাঠানো হবে।সেই তত্ত নিয়ে ছোট ভাইবোনেরা যাবে বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।সোনালী দিনে,তৃপ্তির সত্তায় সোনালী শাড়ি জুড়ানো। পিঠ সমান চুলগুলো তার বাঁকানো আজ।চুলের মেশিনের কারসাজি সব।কানে মাঝারি সাইজের দুল পড়ে তৈরি হয়ে নিচে নামলো তার কাকাতো বোন অর্পা সমেত।সকল কাকাতো ভাই বোনেরা তৈরি।প্রিয় তাকে দেখতেই ছুটে এসেছে তার পানে।হাত খানা আঁকড়ে ধরতেই তৃপ্তি ভরপুর হাসে,
–“গোল্ডেন স্কার্ট পড়েছে আমার প্রিয়!”
প্রিয় মাথা দোলায় উপর-নিচ,
–“হ্যাঁ।দিদা দিয়েছে।”
বাড়ির সকলে উপস্থিত এইখানে।দূরে তার বাবাও দাঁড়িয়ে।কি সুন্দর হাসছে উনি দুই মেয়ের ভাব দেখে।আফসোস করে অরিত্রন।মুহূর্তেই তার চোখ জোড়া ভিজে যায়।কেনো তার বউ এমন কাজটা করলো, যার দরুণ তার সাজানো সংসার ধুলোয় মিশে আজ।

তৃপ্তি সাদা ধুতি পরিহিত বাবাকে দূর থেকেই লক্ষ্য করলো।দিনদিন শুকিয়ে যাচ্ছে তার বাবা।ইচ্ছে করে এখনই গিয়ে বাবার বুকে মুখ লুকায় সে।কিন্তু জিদে তার হাত পা আবদ্ধ।বাবা যেহুতু মায়ের রহস্য নিয়ে চুপ,তাহলে সেও তার বাবার মেয়ে।কিছুতেই মচকে যাবে না।আড়ালে আঁখির জল পুছলো সে।

–“গাড়ি এসেছে জলদি আয়।”
রুপম এসে তাড়াহুড়ো করলো।অতঃপর এক ঝাঁক ভাইবোন গাড়ির দিকে ধাবিত হয়।

গাড়িতে বসা অবস্থায় তৃপ্তি নিজের ছবি,অর্কের শ্বশুর বাড়ির ঠিকানা সবকিছুই জানিয়ে দিয়েছে। আদ্রিনেরই নির্দেশনা ছিলো।যথারীতি তৃপ্তির মেসেজের বিপরীতে আদ্রিন মেসেজ পাঠায়,
–“হুয়াট এ কো-ইন্সিডেন্স!আমি তো সেই লোকেশনে আছি।একটা সাইট দেখতে এসেছি।ইয়াকুব বিল্ডার্সের এইদিকে সবাইকে নিয়ে ঘুরতে এসো। শাড়িতে তোমাকে দেখার সৌন্দর্য উপভোগ চাই সারাসরি।”
তৃপ্তি তার মেসেজ দেখে চমকে।এই ছেলে কিভাবে তার পূর্বেই তার লোকেশনে পৌঁছে যায়?ভাবনায় মশগুল হয় তৃপ্তি।
.
–“তন্ময়,আমার গাড়ির চাবি নাও।ইয়াকুব বিল্ডার্সে চলো।ঘুরে আসি।সাইট দেখাও হয়ে যাবে।”
আদ্রিন উঠে দাঁড়ায়।চেয়ারের সাথে লেপ্টে থাকা কোট গায়ে চড়ায় সে।নির্দেশনা শেষে তন্ময়কে রেখেই কেবিনের বাইরে যেতে নিলে,ভাবুক তন্ময় গাড়ির চাবি নিয়ে তার পিছে ছুটে,
–“স্যার,ইয়াকুব সাহেব আপনার কাছেই এতদিন ঘুরছিল আর আপনি সেই সাইট দেখবেন না বলে জানিয়েছিলেন।তাহলে আজ আবার?”
–“লাভ,বুঝেছো?ভালোবাসা।তৃপ্তির জন্যে আমি না চাওয়া কাজটাও করতে যাচ্ছি।এই মেয়ে আমাকে উম্মাদ করেছে।কিছু করার নেই,তাকে দেখতে আমি সব বাঁধা পেরিয়ে যেতে পারি।”
আদ্রিন লিফটে উঠে।দরজা বন্ধ হতে চললো।কিন্তু,তন্ময় এখনো গগণ সমান চিন্তায় মগ্ন।আদ্রিনের মতো তেজী ছেলে প্রেমে এমন মশগুল!সে ক্লায়েন্টকে ইচ্ছে মত নাকানি চুবানি খাইয়ে এখন আবার সেই প্লট দেখতে যাচ্ছে!দরজা বন্ধ হতে গেলে আদ্রিন হাতের সেন্সর কাজে লাগিয়ে থামায়।গমগমে সুরে সে বলে,
–“এইট ফ্লোর থেকে সিঁড়ি বেয়ে নামতে চাচ্ছো?সময় বসে নেই আমার।আসলে আসো।”
সম্বিত ফিরে পেলো তন্ময়।দ্রুত মাথা নেড়ে সে জবাব দিলো,
–“আসছি স্যার।সরি স্যার।”
ভ্রু কুঁচকে তন্ময়ের এমন বিচলিত অবস্থা লক্ষ্য করে পুনরায় তৃপ্তির কথায় তার ভাবুক মন নেড়ে উঠলো। ইস,আর কিছু সময়ের অপেক্ষা।এরপরই তার তৃপ্তিময়ী তার সামনেই হবে।তন্ময়ের জেদী স্যার এখন হাসছে আড়ালে।স্যারের এই হাসি দেখলে নিশ্চিত মূর্ছা যেতো তন্ময়।আদ্রিনের এমন রূপ হতে বড্ড অপরিচিত তন্ময়।
…….
বিশাল ভবনে আধুনিকতার ছোঁয়া।অর্কের শ্বশুর বাড়ির সকলে বেশ মিশুক।তবে সেই জায়গায় আরাফাতকে দেখে বড্ড অবাক হয়।পড়ে জানতে পারে,আরাফাত অর্কের হবু শালার খাঁজ বন্ধু।সেথায় সকলের প্রিয় আরাফাত।আজ দুইজনের একজনও কথা বলতে এগিয়ে আসেনি।তৃপ্তি খানিক স্বস্তিও পেলো।কিন্তু আরাফাতকে দেখে মনে হলো,সে তৃপ্তিকে দেখে কিঞ্চিৎ ভীত।কিছু কি হয়েছে আরাফাতের?তার গালেও কিছু দাগ স্পষ্ট।হয়তো অ্যাকসিডেন্ট করেছে!তৃপ্তি আর ভাবেনা।আরাফাতকে নিয়ে তার চিন্তা নেই কোনো।সে সময়ের প্রহর গুনছে,কবে আদ্রিনের সাথে তার মেহেবুবা দেখা করবে!
সেখানে দুপুরের খাবারের পর ব্যাপক আড্ডা দেওয়া হলো সকলের।পূর্বের পরিকল্পনা অনুযায়ী সকলে ইয়াকুব বিল্ডার্সে যাওয়ার জন্যে তৈরী।তৃপ্তি মেসেজে জানলো আদ্রিন সেখানেই আছে।অজানা অনুভূতিতে মেয়েটার মন দুরুদুরু।

পরিচিতি থাকায় সেই জায়গায় প্রবেশ করতে কোনো ক্লান্তি ভোগ করতে হয়নি তাদের।তৃপ্তির নজর সেই লম্বা লোকটিকে খুঁজে।খানিক বাদে পেয়েও যায়।আদ্রিন কয়েকজন লোকের সাথে কথায় মত্ত।তন্ময়কে চিনে তৃপ্তি।তন্ময় তার পরিহিত কোটের উপর ভাঁজ করে আরেকটি কোট বহন করছে।নিশ্চয় তা আদ্রিনের!ধূসর রঙের শার্টের হাতা কুনোই পর্যন্ত বটে। কি সুন্দর হাত নাড়িয়ে সবটা বুঝিয়ে দিচ্ছে সে সবাইকে।চোখাচোখি হতেই আদ্রিন হাঁটার নির্দেশনা দিলো তাকে।অতঃপর তৃপ্তি পায়ের গতি থামায় না।প্রিয় আর অর্পার সাথে হাঁটছে সে।বাকি ছেলেরা সবাই সামনে।যদিও রূপম কিছুক্ষণ পরপর পিছে তাকাচ্ছে।কিন্তু তাদের ধীর পায়ের জেরে বেশ সামনে চলেছে ছেলেরা।সংরক্ষিত এলাকা হওয়ায় কেউ কারো চিন্তায় নেই।সকলে নিজের ইচ্ছে মতো ঘুরে দেখুক।

–“মেহেবুবা!”
মনকাড়া এই ডাকে থমকে দাঁড়ায় তৃপ্তি।বাকি দুজনও দাঁড়ালো।প্রিয়র সামনে হাত এগিয়ে দেয় আদ্রিন,
–“কেমন আছো,প্রিয়?”
অবাক হয়ে হাত বাড়ায় প্রিয়,
–“তুমি আমাকে চিনো?”
–“হ্যাঁ।আমি আদ্রিন।”
–“তোমার নামটা সুন্দর,ভাইয়া।”
–“ঐ ফুলের গাছের ফুলগুলো ঠিক তোমার মতো।”
আদ্রিনের ইশারায় সকলে সেদিকে তাকায়।প্রিয় র’ক্ত রঙের জবা দেখে নিতে ব্যাকুল হয়ে উঠে।আদ্রিন তন্ময়কে নির্দেশ দেয়,
–“দেখো ব্যাপারটা।”
–“জ্বী, স্যার।আসো ছোট্ট ম্যাডাম।”
তন্ময়ের পিছন পিছন প্রিয় হাঁটে।অর্পা টুকটাক জানে আদ্রিনের ব্যাপার।তাই মুচকি হেসে সেও প্রিয়র পিছন গেলো।

–“আপনি বেশ চালাক।”
মুখে হাত রেখে হাসে তৃপ্তি।
–“একটু চালাক হতেই হয়।আরাফাত কি ডিস্টার্ব করেছে তোমাকে?”
তৃপ্তি চমকায়,হচকায়।অবাক সুরে শুধায়,
–“সে এখানে…”
–“হ্যাঁ,সেদিন খবর পেলাম আরাফাতকে কে যেনো পিটিয়েছে।এরপরই তার সম্পর্কে টুকটাক খবর নিই।আজ সে এইখানে আসবে আমি সেটা জানতাম।”
–“তাহলে আমার ধারণায় ঠিক ছিলো।মাইর খেয়ে সোজা হয়েছে। তা সেই মাইর কি আপনি দিয়েছেন?”
তৃপ্তি শব্দ করে হাসে মজার ছলে।বিনিময়ে আদ্রিন পকেটে হাত গুঁজে,
–“অসম্ভব কিছু তো নয়!”
তৃপ্তি দ্রুত ফিরে আদ্রিনের পানে।কথার প্রসঙ্গ পাল্টাতে আদ্রিন কিঞ্চিৎ ঝুঁকে পুনরায় বলে,
–“শাড়িতে তোমাকে অদ্ভুত সুন্দর লাগে।বুকে ব্যথা হয় আমার। সেল্ফ কন্ট্রোল আমার বেশ স্ট্রং,তাই তুমি টিকে আছো এখনো।”
কথার ধাঁচ বুঝতে পেরে তৃপ্তি উষ্ণতা অনুভব করে। লাজে ভরপুর মেয়েটা।
–“ধুর,আপনিও না।এইখানের কাজ শেষ আপনার?”
তৃপ্তি ঘুরে দাঁড়ায়।আদ্রিন জবাব দেয় না।তার চোখ আটকে তার পিঠের নিষিদ্ধ বস্তুতে।তৃপ্তির অনাকাঙ্ক্ষিত পোশাকের স্ট্রিপ দেখা যাচ্ছে।যেটা আদ্রিনের অপছন্দ হলো মুহূর্তেই।মেয়েটা এমন বেখেয়ালি কেনো?নিজের বুকের টর্নেডোর সাথে পাল্লা দিয়ে আদ্রিন তৃপ্তির বাহু টেনে দাঁড় করায়,
–“শাড়ি পড়লে একটু হুঁশ রাখবে।যেসব জিনিস একান্ত আমার দেখার জন্যে, সেসব কেনো অন্যরা দেখবে?”
তৃপ্তি অবাকের সুরে আওড়ায়,
–“জ্বী?”
–“পিঠের কাপড় ঠিক করো।এতো হেয়ালি হলে চলে?”
তৃপ্তি ভ্রু কুঁচকে পিঠের কিনারায় হাত রাখে।অবস্থা বুঝে আঁখি ঝুঁকে ফেলে মুহূর্তেই।কাপড় ঠিক করে হাত নামাতেই,আদ্রিন তার চিবুক স্পর্শ করে মুখ উপরে তুলে।দৃষ্টি মিলে দুজনের।
আদ্রিন মিষ্টি হাসে।খানিক পূর্বের গম্ভীরভাব নেই তার মুখশ্রীতে,
–“তোমার গোছালো,অগোছালো সব রূপ কেবল আমার সামনেই প্রকাশিত হওয়ার নির্দেশনা আছে।বাকি সবার সামনে তোমার গোছানো রূপটা মানানসই।অগোছালো রূপটা একান্ত আমারই থাক।মাথায় আগুন উঠিয়ে দিলো,তোমার অগোছালো রূপটা। তুমি কেবল আদ্রিনের আগুন সুন্দরী। যার সৌন্দর্যে আমার বুকে দহনের সৃষ্টি হয়।”

চলবে…..
কপি করা বারণ।সকলের সুন্দর মতামতের আশায়।আদ্রিন ছেলেটা এত্ত রোমান্টিক কেনো!!!
ছবি কালেকশন: ইনস্টাগ্রাম।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here