অতৃপ্তির মাঝে তৃপ্তিময় সে পর্ব -০২

#অতৃপ্তির_মাঝে_তৃপ্তিময়_সে
#লেখিকা- সালসাবিল সারা।
পর্ব-২
_________
(৫)
–“স্যার,তৃপ্তি ম্যাডামের বাবা হিন্দু আর মা মুসলিম।তবে,তৃপ্তি ম্যাডাম এবং তার ভাই-বোন মায়ের মতোই মুসলিম ধর্মের অনুসারী।কাহিনীতে টুইস্ট হচ্ছে,উনার বাবা বিশিষ্ট স্বর্ণ ব্যবসায়ী অরিত্রন চট্টোপাধ্যায় পান্না রহমানকে বিয়ের সময় মুসলিম হয়েছিলেন।কিন্তু,ধর্মের প্রতি সহানুভূতি এবং অনুতপ্ত হওয়ার কারণে পুনরায় হিন্দু ধর্মে ফিরে এসেছেন উনি।এই নিয়ে ব্যাপক ঝামেলা।সকলের ভাষ্যমতে,উনার এমন কাজেই পান্না রহমান ব্যথিত হয়ে নিজের ছেলে মেয়ে নিয়ে আলাদা থাকতেন।ছোট মেয়েটা তাদের ভুলের ফসল।তবে,পান্না রহমান মা’রা যাওয়ার পর বদলেছে তৃপ্তি ম্যাডাম।উনার বাবার সাথে হাজার জিদ করেও নাকি লাভ হয়নি একরত্তি,বাবার দেওয়া ফ্ল্যাটেই থাকেন উনারা এখন।কিন্তু,ম্যাডাম নিজের খরচ নিজে বহনের জন্যে ছোটখাটো কাজ করেন।বাবার প্রতি উনার চরম রাগ।ভাই বোনের জন্যেই কেবল সেই ফ্ল্যাটে থাকতে উনি বাধ্য।”
ম্যানেজার তন্ময় একনাগাড়ে নিজের বক্তব্য দিয়ে ফাইল বন্ধ করলেন। কাল গভীর রাত হতেই এই ফাইল নিয়ে সে ছিল ব্যস্ত।সেই গভীর তিমিরেই নানান মানুষের ঘুম হারাম করে এই তথ্য জোগাড় করেছে।কেনো এই মেয়ের প্রতি তার স্যারের এমন জরুরি তলব তা জিজ্ঞেস করার মতো দুঃসাহসী নয় সে।অতঃপর পেটের কথা পেটেই চালান করলেন।

বাম হাতে পাঁচ কেজি ওজনের ডাম্বল উঠা নামা করা অবস্থায় মনোযোগ দিয়ে সবটা শুনলো আদ্রিন।যেমন তৃপ্তি রহস্যময়ী মানবী,তেমন তার পরিবার রহস্যময়।তবে,তার মূল আকর্ষণ তৃপ্তি।গতরাতে বাসায় ফিরে ম্যানেজার তন্ময়কে তৃপ্তির ব্যাপারে সকল তথ্য জোগাড় করার তাগিদ দিয়েছিলো।আজ সকালে তন্ময় না এলে ফাইল সমেত,তাহলে তার চাকরি ছিলো নিশ্চিত বাতিল।তৃপ্তির ব্যাকরাউন্ড সম্পর্কে জিজ্ঞেস করার পূর্বেই তন্ময় পুনরায় বিচলিত হয়ে বললো,
–“পান্না রহমানের মৃ’ত্যুটা একটা র’হস্য।সবাইকে স্বাভাবিক মৃ’ত্যু বললেও,তৃপ্তি এমনটা মানতে নারাজ।তার ধারণা…”
–“আহ্!স্টপ।আমি এইসব ফ্যামিলি ইনফরমেশনে ইন্টারেস্টেড না।আমাকে তৃপ্তির খবর দাও।তার ব্যাকগ্রাউন্ড সম্পর্কে জানতে চাই।”
মাঝপথে তন্ময়কে থামিয়ে নিজ বক্তব্য পেশ করে আদ্রিন পুনরায় ব্যস্ত হলো ডাম্বেল উঠানামা করাতে।তবে,তার সকল ধ্যান তন্ময়ের ভাষণে।

তন্ময় পেইজ উল্টিয়ে তৃপ্তির শাখায় যায়।এরপর গড়গড় করে আওড়াতে থাকে,
–“তৃপ্তি ম্যাডাম ক্যান্টনমেন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করে এখন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত আছেন।সেমেস্টার ফি তার বাবা দেন সিংহভাগ আর বাকি অল্প উনি নিজেই পে করেন।এই সেমেস্টার ফি বাবদ উনার সকল খরচ একাই সামলান তৃপ্তি ম্যাডাম।উনার এহেন কান্ড কেবল একপাক্ষিক জিদ বাবার প্রতি।একজন প্রাক্তন আছে উনার।তবে,
উনাদের রিলেশন নরমাল ফ্রেন্ডশিপ থেকেও খারাপ ছিলো।ছেলেটা ছিলো হাদা ধরনের। জানতে পারলাম,
তৃপ্তি ম্যাডাম ঐ ছেলের সাথে রিলেশনে যাওয়ার কোনো উপযুক্ত কারণ নেই।তাও কেনো সেই কাজ করলেন,ব্যাপারটা একমাত্র উনিই জানেন।এরপর থেকে উনি এমন কোনো কাজে এগোননি আর।এখন বর্তমানে পড়ালেখার পাশাপাশি ফ্রেন্ড আলেয়ার সাথে ছোট অনলাইন বিজনেস করছেন কাপড় আর জুয়েলারির।এছাড়া উনার একটা ড্রইং কোচিং আছে।মাত্র এক ঘন্টার।বর্তমানে উনি প্রাইভেট ড্রইং টিউশন খুঁজছেন।”
তৃপ্তির সব তথ্য বুদ্ধিতে এলেও ঐ নির্বোধের সাথে প্রেমের সম্পর্ক কেনো গড়েছিলো এটা ব্যাপক ভাবাচ্ছে আদ্রিনকে।তৃপ্তি মেয়েটা মোটেও এমন ছেলেকে লায় দেওয়ার মতো নয়।হয়তো আবেগের বশে!সেই যায় হোক,অতীতের চেয়েও বর্তমানে বিশ্বাসী আদ্রিন।বর্তমানে তৃপ্তির এমন কোনো চক্কর নেই ভেবে মনে প্রশান্তির হাওয়া দুলে গেলো।আর তার সেই প্রাক্তন ফিরতে চাইলে!আদ্রিন বাঁকা হাসে সেই কথা ভেবে।ছেড়ে দিবে না সে অত্র ছেলেকে।

–“তোমার কাজ শেষ,তন্ময়।অফিসে ফিরো।আমি আসছি অফিস টাইমে।”
স্থির দাঁড়ালো আদ্রিন।

তন্ময় সামান্য মাথা দুলিয়ে বেরিয়ে পড়লো ফাইল হাতেই।তার স্যারের মতিগতি কিছুই মস্তিষ্কের ঠাহরে আসছে না।

পরিহিত টি-শার্ট তনু হতে আলাদা করলো আদ্রিন।ফ্লোরে দুইহাত ভর দিয়ে একে একে পুশ আপ দিচ্ছে ছেলেটা।মায়ের মৃ’ত্যুর পর তৃপ্তির বদলে যাওয়াটা মাথায় আসছে না তার।তৃপ্তির ব্যাপারে জানতে এতটাই চঞ্চল ছিলো সে,আসল পয়েন্টগুলো মিস করে গেলো। সেই যায় হোক,আফসোস নেই তার।বরংচ,মানবের তৃষ্ণার্ত আঁখি,মন তার তৃপ্তিময়ীর খোঁজে।
শারীরিক কসরত শেষে ছেলেটা উঠে দাঁড়ালো।তার পেটানো শরীরের খাঁজে খাঁজে ঘামের দানা চিকচিক।মাথায় নানান পরিকল্পনা সাজাতে ব্যস্ত আদ্রিন ওয়াশরুমে প্রবেশ করলো।ঠান্ডা পানির ফোয়ারার নিচেই শান্তিময় পরিকল্পনা করতে উস্তাদ সে।

আদ্রিনের বাবারা তিন ভাই।তবে,উনি গত হয়েছেন বছর দুই পূর্বে।আদ্রিনের পরিবার এবং তার চাচাদের পরিবার সকলেই একই বিল্ডিংয়ে থাকে।তারা আবার যৌথ পরিবার।তাদের তিনতলা বাড়ির প্রত্যেক ফ্লোরের জন্যে ভেতরেই সিঁড়ি আছে তিনটা।অর্থাৎ,তাদের বাড়ি শহরের সবচেয়ে আনকমন এবং সুন্দর নকশায় আবৃত।সকলে রাজ’নীতিতে ব্যস্ত এই পরিবারের।কেবল আদ্রিন এবং তার ছোট চাচার ছেলে রাফি এই দুজন নিজেদের আলাদা ব্যাবসা সামলায়।এই দুই ভাইয়ের আবার বেশ খাতির।
দৈনিক রুটিন মাফিক সকলে নাস্তার টেবিলে এসে হাজির।সবাই অপেক্ষায় আদ্রিনের।এই ছেলে পরিবারের বড় ছেলে।তাই আদর যত্ন সে’ই সবসময় বেশি ভোগ করে।
সকলের অপেক্ষার ফোড়ন কে’টে আদ্রিন এলো। পড়নে তার ধূসর শার্ট এবং তার উপর লেদারের জ্যাকেট।অফিসের বস হিসেবে কোনো ড্রেস কোড মানেনা সে।তবে,অফিসের সকলে নিজেদের ড্রেস কোড মানতে বাধ্য।
স্বভাবগত চুপচাপ খাওয়া আরম্ভ করতেই রাফি আগ বাড়িয়ে বলে উঠে,
–“কালকে তোমার অ্যাডভেঞ্চার কেমন ছিলো?”
–“গুড।ফাইটিং চলেছে ব্যাপক।”
আদ্রিনের দৃষ্টি নাস্তার প্লেটেই।
–“শুনেছি,একটা গার্ল ছিলো?”
–“হ্যাঁ,ছিলো।আর সে এখন সারাজীবন থাকবে।”
আদ্রিনের কথায় বিষম খেলো সকলে।
ইনায়ার হাতের ছু’রি শক্ত।সে বেশ বুঝলো আদ্রিনের ভাষা।ঘটনা অন্যদিকে মোড় নিতে সে তার শ্বাশুড়িকে বললো,
–“আদ্রিনের জন্যে মেয়ে ঠিক করেছি আমি।আপনাকে ছবি দেখাচ্ছি।”
–“আম্মি!জলদি করো না এইসবে।তুমি আর আমি ভালো জানি,আমাদের মনের কথা।তুমি আমার মা তো,আমি তোমার ছেলে।আমাকে ফোর্স করো না কিছুতেই।আমি কেমন জানো তুমি।”
আদ্রিনের শান্ত স্লোগানে তার মা বোবা।তবে,আদ্রিন বেরুলে পরপর ইনায়া তার মেঝ জায়ের পানে শকুন দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললো,
–“জাবেদাকে ফোন দাও।তাকে বলো,আমরা আগামী সপ্তাহে ইন্ডিয়া যাচ্ছি স্পর্শিয়াকে দেখতে।”
খুশিতে গদগদ হলো মিনা।তার বোনের মেয়ে এই ঘরের ছেলের বউ হবে ভাবতেই তার আঁখি ছলছল।

ইনায়ার এই মুহুর্তের রক্তচক্ষু যেনো জ্ব’লন্ত অগ্নিকুন্ড।ছেলেকে ব্ল্যাকমেইল করার মতো অধিকার সে হারিয়েছে।তারপরও আদ্রিন জিদ্দি তো তার মা মহা ঘাড়ত্যাড়া।

(৬)
নাকের ব্যথায় রাতভর জ্বরে মশগুল ছিলো তৃপ্তি।তার সেবা করেছে চামেলী।তার নাকের অলংকার খুবই সাবধানের সহিত খুলেছিল সে।জ্বরের কারণে ব্যথা অনুভব করেনি তৃপ্তি।চামেলী ধীর হাতে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে ঘুম কাতুরে মেয়েটার।তার আপার আমানত এই তিনজন।যাকে পরিবার ত্যাগ করেছিলো,
তাকে ত্যাগ করেনি পান্না।সর্বদা তার মায়ের এই তৃতীয় লিঙ্গের সন্তানকে আগলিয়ে রেখেছিল।
এখন তারই দায়িত্ব,বোনের আমানতের রক্ষা করা।চামেলী মূলত বাড়ির সকল কাজ সারে আর দশ বছর বয়সী প্রিয়র দেখাশোনা করে সর্বক্ষণ।
তৃপ্তি,তার এই বোনের মেয়েটা যেনো বোনের প্রতিরূপ।বোনের চেহারা ভাসে এই মেয়ের মুখশ্রীর আস্তরণে।জল জমে চামেলীর আঁখির কোণায়।পান্না আর চামেলীকে সেই যে পরিবার ত্যাগ করেছে আজ পর্যন্ত আগলিয়ে নেয়নি।একজন ম’রেছে শুনেও কেউ আসেনি কোনোদিন।চামেলী পর হয়েছিল তার বুদ্ধির পরেই,
আর পান্না পর হয়েছিল হিন্দু ধর্মের ছেলে বিয়ে করায়। দুইজনের পানে পরিবার নামক জিনিসের ছায়া ছিলো না।
বোনটাও তার কতো কষ্ট করলো।স্বামী নিজ ধর্মে ফিরলে মেয়েটা সংসার ছেড়ে দেয়।নিজের ব্যাবসা খুলে।সফলও হয়।অরিত্রনের সাথে ছাড়াছাড়ি হলেও, তাদের মাঝে ভালোবাসার কমতি ছিলো না।কেবল রাগের বশে একা থাকতো পান্না বাচ্চাদের নিয়ে।পান্না এবং বাচ্চাদের দেখতে প্রায়শই আসতো সে।সকল ছেলেমেয়েকে এখনো ভালোবাসে বোনের জামাই।কিন্তু, সবটা এলোমেলো হয়।পান্না কেমন যেনো আউলিয়ে যায়।অরিত্রন চট্টোপাধ্যায় তাকে সর্বদা বোঝাতো কিছু একটা।পান্নার বেসামাল জীবনে পরিবর্তন আসে না।হঠাৎ গায়েব হয়ে যায় মহিলা।মাস তিনেক পর খবর আসে তার মৃ’ত্যু সংবাদ।এটাও বলে সকলে সেই তিনমাস সময় কাটিয়েছে সে অরিত্রনের সাথে।অর্থাৎ,তার মৃ’ত্যুটা তৃপ্তি,চামেলী সহ সকলের নিকট কেবল ধোঁয়াশা।

–“লাভি, দিদা এসেছে।তৃপ্তিকে দেখতে চায়।”
রূপম,তৃপ্তির ভাই এসে বলে।
–“পাঠিয়ে দে এইখানে।মেয়েটা ঘুমে।”
চামেলী বক্তব্য শেষ করে।
ও বাড়ির সকলে ভালো।ব্যাপক সরল মনের।বোনটাও সুখী ছিল সেথায়।মুসলিম মেয়ে তার ছেলেমেয়েও সেই ধর্ম পালনে কোনো সমস্যা ছিল না সেই পরিবারের।তবে,অরিত্রনের জন্যেই সংসার ছেড়েছিল তার বোন;যেটা একেবারে তুচ্ছ মনে করে চামেলী।আদৌ জানেনা এর আসল সত্যি।সংসার ছাড়ার কারণ হিসেবে সকলে অরিত্রন চট্টোপাধ্যায়কে দোষ দিলেও,চামেলী সেটা মানতে নারাজ।এর মাঝে ব্যাপক কোনো কাহিনী লুকায়িত।যেটা জানে কেবল অরিত্রন চট্টোপাধ্যায় এবং তার মৃ’ত বোন।
ঐ বাড়ির সবাই আসে এইখানে।এমনকি তৃপ্তি তার দিদা,কাকা কাকী,কাকাতো ভাই,সকলে দেখতে প্রায়শই ছুটে যায় সেখানে,তবে তার বাবার অনুপস্থিতিতে।বাবা নামক মানুষটাকে মা মারা যাওয়ার পর সহ্য হয় না তৃপ্তির।মেয়েটার মতে,বাবা তার মায়ের মৃত্যু সম্পর্কে সবটা জেনেও কেনো সবাইকে জানাচ্ছিল না?আর সেই তিনমাসের কাহিনী হাজার জিদ করেও জানলো না তৃপ্তি।এটাই মেয়েটার বাবার প্রতি ক্ষো’ভের অন্যতম কারণ।সকলের মতো তৃপ্তিও ভাবে,তার মায়ের সংসার ছাড়ার কারণ,তার বাবা।মায়ের ভালোবাসার দাম দেয়নি তার বাবা,এমনটাই ধারণা মনে পুষছে সে।তবে এর মাঝে লুকায়িক রহস্য সম্পর্কে কেউ কি কখনোই অবগত হবে?

–“কি হয়েছে আমার,দাদুর?”
দিদার ডাকে হালকা নড়লো তৃপ্তি।পরক্ষণে নিজের দিদার সুঘ্রাণে মেয়েটার মাথা স্থান পাতলো তার দিদার কোলে,
–“কিছুনা তো।কবে এলে?”
–“খানিকক্ষণ হলো।”
–“আজ থাকো প্লিজ।”
–“কেনো,আজ সংগ্রামী মেয়েটা ক্লান্ত?”
দিদা বড্ড রসিকতার মানুষ।
–“হ্যাঁ,ছুটি আজ।বিজনেসের কাজে আলেয়া ব্যস্ত।আর আজ ড্রইং ক্লাসের ডেইট নেই।ভার্সিটি যাওয়ার সময়ও ফুরিয়েছে।তাই আমি আজ বিন্দাস।”
ঘুম ঘুম কণ্ঠ তৃপ্তির।
পান খাওয়া গাঢ় লাল রঙ্গা ঠোঁট স্ফীত হলো তৃপ্তির দিদার,
–“তবে রে আজ থাকি।”
–“ইয়াহু।”
প্রিয়ও লাফিয়ে উঠলো দিদার পিঠ বরাবর।চামেলী হেসে নাস্তার ব্যবস্থা যায়।ফ্ল্যাট,বাকিসব কিছু বিলের খরচ বাবদ এই সংসার চলে তার বোনের কোম্পানির শেয়ারে এবং ব্যাংকের তার একাউন্টের টাকায়। তবে,গোপনে প্রায়শই সে সাহায্য নেয় অরিত্রন চট্টোপাধ্যায়ের।টাকা না নিলে লোকটা বেশ হুমকি দেয়।এছাড়াও বিলাসিতায় বড় হওয়া বোনের ছেলে মেয়ের গায়ে দারিদ্রতার ছোঁয়ার কথাটা ভাবতেই গায়ে কাঁ’টা দেয় চামেলীর।তাই,বাধ্য সে গোপনে অরিত্রন হতে খরচ নিতে।সবাই সেই লোকের টাকায় চললেও,
সেমেস্টার ফি বাদে বাকি নিজের খরচ সব নিজের টাকায় চালায় তৃপ্তি।মাঝে মাঝে সংসারেও কিছুটা দেয় ছোট্ট মেয়েটা।চামেলী দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে কাজে মন দেয়।তার বোনের ছেলে মেয়ের জন্যে মঙ্গল কামনা করে।

তৃপ্তি তার দিদার পানে চেয়ে।মহিলা সযত্নে কি যেনো লাগিয়ে দিচ্ছে তার নাকের আঘাত পাওয়া স্থানে। ব্যথায় মাঝে মাঝে সে খামচে ধরছে নিজের চাদর।মস্তিষ্ক ব্যাথা অনুভব করলেও,তার ইজ্জত বাঁচানোর কারণে মনে মনে সহস্র দোয়া করেছে সে আদ্রিনের জন্যে।ছেলেটা তার জীবনে কাল এসেছিলো আশীর্বাদস্বরূপ।আগামী দিনে এই ছেলের সাথে দেখা পাওয়ার আখাঙ্খা জানাচ্ছে মন।তবে এমনটা কি আদৌ সম্ভব?চোখ বুজলো সে সবটা ভুলে যাওয়ার। আশ্চর্যজনক!আদ্রিনের হাসি,চোখের চাহনি,যত্নের সহিত হাত ধরা,সবটাই আঁখিতে ভাসছে ফিল্মের ক্লাইমেক্সের মতো।আর যায় হোক,ছেলেটার সুদর্শন চেহারাটা মনের অন্তরালে বারবার উঁকি দিচ্ছে।তৃপ্তি মনকে অন্যদিকে ঘোরানোর চেষ্টায় এমনভাবে বুদ,যেনো আদ্রিন কেবল মরীচিকা!

(৭)
আদ্রিন খবর নিয়ে জানলো আজ তৃপ্তি এলাকা ছাড়েনি।মেয়েটার চিন্তায় চিন্তিত সে।সবটা ঠিক আছে তো?গতকালের জন্যে কোনো কাহিনী হয়েছে কি?জানা নেই আদ্রিনের।মিটিং শেষে সে তৃপ্তির কল্পনায় মত্ত।একবার তার আঁখিতে ভাবছে শাড়ি পড়া সেই চীন দেশীয় নারীর লাগান চেহারার অধিকারীকে,
আরেকবার ভাসছে পশ্চিমা পোশাক পরিধেয় সেই রমনীর মুখশ্রী।দুই বেশভূষায় মেয়েটা দুইরকম শারীরিক ভাবে,তবে মুখশ্রী তার একই;মায়াময়ী,তীব্র আবেদন মাখা তাতে।এই মেয়েকে নিজ জীবন হতে আলাদা হতে দিবে না আদ্রিন,না পারবে তাদের কেউ আলাদা করতে।আদ্রিন তা সম্ভব হতে দিবে না ইহকালে।হঠাৎই আদ্রিন গভীর চিন্তায় ব্যস্ত তাদের নিয়ে।
পরক্ষণে তার মাথায় খেললো,তৃপ্তির ড্রইং টিউশনি খোঁজার ব্যাপারটা। বাঁকা হাসির খোরাক মিটালো আদ্রিন।তার তৃপ্তিকে যতোই নিরাপদে রাখা যায় ততই যেনো আদ্রিনের মঙ্গল।এইভাবে যেমন তেমন ঘরে টিউটর হওয়া অনেক রিস্ক।না জানি, কার নজর না এই আদুরে তৃপ্তির উপরে পড়ে!নাহ,আদ্রিনের সেটা সহ্য হবে না।খু’নাখু’নি পর্যন্ত গড়াতে পারে সেই ঘটনা।সরাসরি সে ফোন লাগালো তারই বড় বোন রিয়ানার নিকট।

অন্যদিকে ভাইয়ের ফোন পেয়ে আকাশের চাঁদ হাতে পেলো রিয়ানা,
–“কিরে,বোনের কথা মনে এসেছে?”
–“ভুললাম কবে?”
আদ্রিনের কথায় বেশ ভাব।
–“আজ আমার বাসায় আয়।ডিনার সেরে যাবি।”
–“দেখি,আসবো।”
–“সত্যি?বিশ্বাস হয় না তো।”
–“ফোন রেখে দিবো?”
খানিক রাগ যেনো আদ্রিনের ভরাট কণ্ঠে।
–“নাহ রে ভাই।তোকে কতদিন দেখিনি।”
–“আজ দেখবে।তবে একটা কাজ করতে হবে এর জন্যে।”
–“আমিও ভাবি,প্রয়োজন ছাড়া আমার ভাই ফোন করলো কিভাবে?”
–“আপু! জাস্ট শুনো।তোমাদের আবাসিক এলাকায় একটা মেয়ে আছে নাম তৃপ্তি। ও বর্তমানে টিউশন খুঁজে।তুমি সাফার জন্যে মেয়েটাকে হায়ার করো।অ্যান্ড স্যালারি দিবা ভালোই।”
থামলো আদ্রিন।তবে চমকালো রিয়ানা,
–“তৃপ্তি?ওর কাছে তো সাফা গিয়েই করে ড্রইং।মেয়েটা বেশ ভালো ছবি আঁকে।”
–“গ্রেট।তাহলে ওকে ফোন দিয়ে বলো, সাফার জন্যে ওকে বাসায় রাখতে চাও,ভালো স্যালারি দিবে।”
–“ওর বাবা তো বেশ ধনী।ওর আবার মানুষের বাসায় গিয়ে করানোর কি দরকার?আমি ভেবেছিলাম ও সখের বশেই শেখায় ড্রইং।”
–“এতো চিন্তিত হওয়ার দরকার কি তোমার?যেটা বলেছি করো।যদি ফলাফল ভালো হয়,তবে আমি আজ রাতেই আসবো তোমার হাতের পোলাও আর চিকেন রোস্ট খেতে।”
উত্তর না শুনে ফোন রাখলো আদ্রিন।সে জানে,ভাইকে নিজের হাতের পোলাও,রোস্ট খাওয়াতে তার বোন এভারেস্টেও চড়তে রাজি।

পরক্ষণে মোবাইল ঘেঁটে বের করলো তৃপ্তির নাম্বার।কিন্তু,ফোন দেওয়া হলো না।মিটিংয়ের জন্যে ডাক পড়লো।এরই মাঝে সে অন্য এক বিরাজ কর্ম সাধন করলো,তৃপ্তিকে ফেসবুকে রিকোয়েস্ট পাঠিয়ে।
ছেলেটা যেনো মেয়েটার জীবনের সকল অংশে ধীরে ধীরে নিজের আধিপত্য জারি করার ফন্দি এঁটেছে।

সারাদিন ঘরে শুয়ে বসে কাটিয়ে মাত্রই মোবাইল হাতে কিছু অর্ডার কনফার্ম করছে তৃপ্তি।আলেয়া গতকাল সকল কাজ নিজ হাতে সামলিয়ে আজ মেয়েটা বিশ্রাম নিচ্ছে।নতুন শিপমেন্টের জন্যে আজ লাস্ট অর্ডার ডেইট থাকায় কাজে হালকা চাপ তবে কম।এরই মাঝে তৃপ্তি খেয়াল করলো “আহানান শেখ আদ্রিন” রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছে।বিনা কারণে অধর প্রসারিত হলো মেয়েটার।সকল কাজ উহ্য রেখে সেথায় ঢু মারলো তৃপ্তি। সর্বপ্রথম ভেসে এলো তামাটে রঙের সুঠামদেহী আদ্রিনের প্রোফাইল আর কভার ফটো।পাঞ্জাবি পড়া প্রোফাইল পিক জুম করে দেখার চেষ্টায় ব্যস্ত তৃপ্তি।লোকটা ব্যাপক সুদর্শন।তার হাসিতে রয়েছে এক মুগ্ধতা।ঠিক এই হাসিতেই কাবু হয়েছিল সে বছরপূর্বে,যখন ব্যাটিংয়ে আউট হয়েও ব্যাট হস্তান্তর না করে ছলনাকারি হাসি দিয়ে সকলকে বাজিমাত করতো সে।তৃপ্তি দুই তোলার বারান্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে সবটাই দেখতো আর প্রেমে তার পড়তো বারংবার।তবে,আজ সবটা কেমন পরিবর্তিত।পুরনো সেই অনুভূতির শেষ পরিণতি কি হবে জানা নেই তৃপ্তির।জানতে চায়ও না সে।আলগোছে রিকোয়েস্ট একসেপ্ট করে তৃপ্তি নিজের কাজে ব্যস্ত হওয়ার ব্যর্থ চেষ্টায়।

মেজাজ ফুরফুরে তৃপ্তির।এলাকার বিলাসবহুল রাজ’নৈতিক বাড়িতে ড্রইং টিউশন পেয়ে ব্যাপক খুশি সে।সাফা তারই স্টুডেন্ট ছিলো।এইভাবে বাড়ির পাশে সাফার প্রাইভেট ড্রইং টিউটর হবে,এটা সে ভাবেনি কস্মিককালে।রাতের খাবার শেষে হাঁটতে বেরুলো তৃপ্তি,প্রিয়,চামেলী আর দিদা।প্রায়শই রাতের খাবারের পর এই হাঁটার অভ্যাস আছে তৃপ্তির।শীতের বেগ এখন তীব্র।গায়ের জ্যাকেটের পকেটে হাত ঢুকিয়ে ধীর পায়ে হাঁটছে সে।গলার স্কার্ফ নিয়ে মাথা কান ঢেকে।হঠাৎই পকেটের ফোন ভাইব্রেট করলে তৃপ্তি মোবাইল বের করে।
আননোন নাম্বার।
–“আসসালামুয়ালাইকুম কে?”
তৃপ্তির সহজ প্রশ্ন।
–“আদ্রিন।”
অদূরে গাড়ি পার্ক করলেও দৃষ্টি তার নিবদ্ধ তার মেহবুবায়।বোনের বাড়ি হতে ফেরার সময় এমন দৃশ্যের আকাঙ্খা করলো আর সে পেয়েও গেলো।সৃষ্টিকর্তা তার প্রতি কি বেশ দয়াবান?তৃপ্তির চমকিত মুখশ্রী চুম্বুকের মতো আকর্ষণ করছে আদ্রিনকে।

–“কেমন আছেন?”
তৃপ্তি প্রশ্ন করলো পুনরায়।
–“ভালোই।তুমি? নাক ঠিক আছে?”
–“হ্যাঁ ভালো।”
নিজের জ্বর,নাকের যন্ত্রণা সবকিছু চেপে গেলো তৃপ্তি।মা মারা যাওয়ার পর দুর্বলতা সে খুব কমই প্রকাশ করে।
–“আমার কফি ট্রিট?”
শব্দ করে হাসলো আদ্রিন।সেই হাসিতে উত্তেজিত মনের শব্দটাও স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে তৃপ্তি।বিচলিত মনে বুকে হাত চেপে ধরতেই,নজর আটকে যায় আদ্রিনের।মেয়েটাও কি তার মতো বুকের কম্পনে জর্জরিত!
–“এখন তো রাত।আপনি ফ্রী হয়ে আমাকে জানাবেন।আমি পৌঁছে যাবো।”
তীব্র শীত আর উত্তেজনায় কণ্ঠ কাঁপছে তৃপ্তির।

আদ্রিন নিজেও ঠাওর করছে শীতের কারণে মেয়েটা বারংবার হাত পকেটে পুরছে তো আবার মুখের গরম ধোঁয়া দিচ্ছে।
–“আচ্ছা,জানাবো।তবে এখন তুমি বাসায় যাও।শীতে তুমি কাঁপছো।”
অবাক হলো তৃপ্তি।লোকটা কিভাবে জানলো,সে বাহিরে!তার উপর সত্যিই সে শীতে হিমশিম।লোকটার কি চোরা চোখ আছে?তৃপ্তি ডানে বামে দৃষ্টি জ্ঞাপন করলো।ফলাফল শূন্য।
–“আপনি কিভাবে জানলেন আমি বাহিরে?”
আদ্রিনের অধরে তির্যক হাসি বহাল।তার উত্তেজিত মুখশ্রী আরো বেশি ঘায়েল করছে প্রেমিক পুরুষের বিক্ষত অন্তরে,
–“তুমি যেখানেই থাকো না কেনো,তৃপ্তি; আদ্রিনের নজর ঠিক খুঁজে নিবে তোমাকে।যেমনটা এখন নিচ্ছে।”

চলবে…..
কপি করা বারণ।কেমন হয়েছে গল্প অবশ্যই জানাবেন।
গল্পটা পুরোই আমার মনের কল্পনার সংমিশ্রনে লিখা। কারো ধর্ম,জাতিকে কষ্ট দেওয়ার কথা আমি দুঃস্বপ্নেও ভাবিনা।গল্পকে কেবল গল্প হিসেবে নিবেন,অন্য কিছুর সাথে মেলাবেন না।
সকল ধর্মের প্রতি আমার বিনম্র শ্রদ্ধা রয়েছে।
ছবি কালেকশন: ইনস্টাগ্রাম।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here