#অতৃপ্তির_মাঝে_তৃপ্তিময়_সে
#লেখিকা- সালসাবিল সারা
পর্ব -৬
__________
১৫.
–“আদ্রিন স্যার,তৃপ্তি ম্যাডামের বাড়ির সামনে ছিলাম আমি।দারোয়ান মুখ খুলতে নারাজ।এখন কি করবো?”
তন্ময়ের এহেন বাক্যে ঘুমন্ত মস্তিষ্ক হুট করেই জ্ব’লে উঠলো আদ্রিনের।দাদীর আদুরে হাত বোলানোতে কবে সে তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়েছিলো তা ঠিক ঠাহরে আসলো না তার।তবে মস্তিষ্কের ভেতরকার অবস্থা তার নাজেহাল।তৃপ্তির খোঁজ মিলছে না কিছুতেই।তন্ময় নিজেও আদ্রিনের অনুমতি ছাড়া কোনো কাজে নিজ হতে এগোয় না।আদ্রিন ভাবলো,খুব যত্নে তন্ময়ের বলা বাক্য আমলে নিলো।তার মস্তিষ্কের নিউরণ জানান দিচ্ছে,
তন্ময় কেনো তৃপ্তির বাবার বাড়ি হতে খোঁজ নিলো না?ছেলেটা কি আসলেই নির্বোধ?নাকি কেবলই আদ্রিনের নির্দেশনার অপেক্ষায়?
–“তৃপ্তির বাবার বাড়ির দারোয়ান থেকে জিজ্ঞাসা করো।আমি বলা ছাড়া কি কোনো কাজ হয় না?”
–“সরি স্যার,এক্ষুনি যাচ্ছি।”
তন্ময়ের জবাবে ফোন রাখলো আদ্রিন।মেঝেতে পা বটানো থাকায় পায়ে ঝিন ধরেছে তার।বিছানার বালিশ যথাস্থানে রেখে পা ঝেড়ে উঠে দাঁড়ালো।মনে পড়ে অতীতের কিছু ভালো সময়।তৃপ্তির কাকাতো ভাইয়েরা আদ্রিনের বেশ কাছের বন্ধু ছিলো।তবে,মায়ের নির্দেশ অমান্য করার সাহস হয়নি তার সেকালে।তাই তো,বন্ধুত্ব টিকেনি তাদের।নিজেকে এক গম্ভীর বেড়াজালে আবদ্ধ করেছিল সে।অতীতের হারিয়ে যাওয়া বন্ধুর খোঁজ এতো সময়ে না নিলে,এই মুহূর্তে তৃপ্তির কারণে সে তাদের খোঁজ নেওয়ার ভুল করতে চায় না।এইভাবে আদ্রিন নিজ দৃষ্টিতে স্বার্থপরের খাতায় নাম লেখাবে।তৃপ্তির খোঁজ নেওয়ার অনেক উপায়ন্তর আছে আদ্রিনের নিকট।
তন্ময় পূর্বের ন্যায় ভুল করলো না।তৃপ্তির বাবার বাড়ির সামনে যেতেই সে পুনরায় ফোন করলো আদ্রিনকে,
–“স্যার,কিভাবে প্রশ্ন করবো?”
বিরক্ত হলো আদ্রিন।কে বলবে এই তন্ময় অফিসে একজন চতুর লোক!
–“মাথা ঠিক আছে তোমার,তন্ময়?”
–“সরাসরি জিজ্ঞাসা করলে তৃপ্তি ম্যাডামের বাড়ির দারোয়ানের মতোই নিরাশার উত্তর পাবো।তাই জিজ্ঞাসা করলাম।”
ভীত জবাব তন্ময়ের।সে জানে,এইবার কাজে গরমিল হলে তার চাকরি নিয়ে একটা বিপদ বাজবে।তাই এইবার রিস্ক নিলো না তন্ময়।
আদ্রিন ললাটে দুই আঙ্গুল ঠেকালো। গাম্ভীর্যতা তার মুখশ্রীতে স্পষ্ট।
–“দারোয়ানকে বলো,অরিত্রন চট্টোপাধ্যায়কে চায় তোমার।শোরুমে পাওনি,অনেকে বলেছে বাড়িতে খোঁজ নিতে।তাই তোমার সেইখানে যাওয়া।ডু ইট ফাস্ট,তন্ময়।”
–“ওকে, স্যার।”
আদ্রিন বিচলিত।হঠাৎই তার মনে অজানা আশঙ্কার আগমন।তৃপ্তি নামক শব্দটা তার মস্তিষ্কে প্রতিফলিত হচ্ছে বারংবার।মেয়েটাকে আবারও হারিয়ে ফেলার ভয়টা জেঁকে ধরেছে আদ্রিনকে।তনু জুড়ে অস্থিরতা।পেটে ক্ষুধা।অথচ সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই তার।আদ্রিনের মন মস্তিষ্ক এখন কেবলই তৃপ্তিময়।
মাথায় ঠান্ডা জলের ঝাপটায় আদ্রিনের চুল কপালে লেপ্টে।তামাটে পেটানো শরীরের খাঁজে খাঁজে সেই পানি বহমান।বাহু নাড়িয়ে পানি দূর করার বৃথা চেষ্টা করলো আদ্রিন। কাউচে নিজ অবস্থান জারির পূর্বেই দরজার নব ঘুরানোর শব্দ।সটান ভ্রুদ্বয় কুঁচকালো তার।কড়া নাড়া ব্যতীত আদ্রিনের কক্ষে কারো প্রবেশ নিষিদ্ধ।সেথায় পা বাড়ালে আবারও নব ঘুরানোর প্রচেষ্টা লক্ষণীয়।
ভেতর থেকেই আদ্রিন চেচালো,
–“কে?”
–“আমি মামা।সাফা।”
সাফার নাম শুনে আদ্রিনের মুখশ্রী স্বাভাবিক হলো।দরজা খুলতেই দু হাত উচুঁ করে লাফিয়ে উঠলো সাফা।আদ্রিন হাসিমুখে আলিঙ্গন শেষে কোলে তুললো আদরের ভাগ্নীকে।পরপর সাফা আদ্রিনের গালে হাত ছুঁয়ে দিলো স্নেহের ভঙ্গিতে,
–“নাস্তা খাওনি কেনো?”
–“খেয়েছি তো।”
আদ্রিন অধর ছোঁয়ালো সাফার গালে।
–“মিথ্যা!নানু বললো খাওনি।”
–“আর কে এসেছে?”
–“পাপা আর মাম্মা।”
–“ওহহ।থাকবে আজ?”
–“ইয়েস।ওয়ান,টু,থ্রি, ফোর দিন থাকবো।”
সাফা আঙ্গুলের সাহায্যে দেখলো।মেয়েটার চোখে মুখে নানাবাড়ির প্রতি তীব্র টান লক্ষণীয়।
–“ভেরি গুড,মাম্মা।অনেকদিন থেকো এইবার।”
রিংটোন বাজতেই সাফাকে এক হাতের উপর রেখেই অপর হাতে ফোন রিসিভ করলো আদ্রিন।তন্ময়ের এক নাগাড়ে বলা কথা তার কর্ণে শ্রবমান,
–“তৃপ্তি ম্যাডাম তার পরিবারের সাথে গ্রামের বাড়ি গিয়েছেন।সেখানে নেটওয়ার্ক না থাকায়,উনার হাদীস পাওয়া যাচ্ছে না।চিন্তার কিছু নেই স্যার,উনার পুরো পরিবার গ্রামে উপস্থিত আছেন।উনার পিসির বাড়িতে।দুই তিনদিনের মধ্যে সকলে ফিরে আসবেন।”
–“পিসির গ্রামের বাড়ি কই?”
আদ্রিনের তীক্ষ্ণ প্রশ্ন।
–“সুলতানপুর।”(কল্পনাতীত)
–“ওকে। কাল সকালে অফিসে এসো জলদি।কাজ আছে।”
আদ্রিন ফোন রাখবে,এর পূর্বেই ফোড়ন কেটে তন্ময় বললো,
–“আশিক জৈন একটা পার্টি রেখেছে।আপনাকে আসার অনুরোধ করলেন।”
–“যাবো না।আমার হয়ে তুমি এটেন্ড করবে পার্টি।”
আদ্রিন নিজ বক্তব্য শেষ করলো।মন হতে বিরাট পাথর সরলো যেনো।হুট করেই শরীরের ভারী ভাব কোথায় পালালো। প্রিয় মানুষটা নিরাপদে থাকলে বুঝি এমন স্বস্থি অনুভব হয়!হ্যাঁ,হয় তো।এইযে এই মুহূর্তে তার মন প্রশান্তিতে পরিপূর্ণ।তার মনে এখন একটাই চাওয়া,
তৃপ্তিকে স-চক্ষে দেখা।তৃপ্তির মুখশ্রী নিজ আঁখিতে ভেসে বেড়ালে আদ্রিন তির্যক হাসে।মেয়েটা তার অতিপ্রিয়,সর্বপ্রিয়।
(১৬)
হলুদের অনুষ্ঠানের পরের দিন বিয়ের ধুম পড়েছে।গ্রামের বাড়িটা যেনো রাজ্যপুরি।ঝলমলে বাহারি আলোতে অন্যরকম মনোরম ঠেকছে এই দোতলা বাড়ি।সকলের মধ্যমনি তৃপ্তি।সে সহজে আত্মীয়ের বাসায় যায় না।তাই তাকে নিয়ে যতো আদিখেত্য।তৃপ্তি হাসিখুশি।তার হাসিখুশি চেহারা লক্ষ্য করে তার বাবার মুখশ্রী জ্বলজ্বল।উনি ঠিকই জানতেন,মেয়ে তার এইখানে এলে বড্ড খুশি হবে।পান্নার নতুন একখান শাড়ি তৃপ্তির পড়নে।পিসির দেওয়া উপহারের পোশাক পরিবর্তন করে মায়ের এমন জামদানি শাড়ি গায়ে জড়িয়েছে মেয়েটা।অরিত্রন চট্টোপাধ্যায় চশমা খুলে অশ্রুজল পুছলো।বাহারি মানুষ মেয়ের হাত চাইলেন।কিন্তু,মেয়েকে এমন প্রস্তাবের কথা বলতে হৃদয় কাঁপছে।এই তো সেদিন,মেয়েটার জন্মের পর মেয়েটাকে বুকে জড়িয়েছিল পরম স্নেহে।দিন কতো দ্রুত পার হয়!নাকি বাবার বাড়িতে মেয়েদের স্থায়ীকাল খুবই কম হয়!অরিত্রন জানেনা।তবে এতো জলদি মেয়েকে পরের বাড়িতে পাঠাতে নারাজ উনি। পুবালীর মা পাশে এসে দাঁড়ালো ভাইয়ের,
–“মেয়েটাকে সব বললেই তো পারো ভাই।”
অরিত্রন চশমা পড়লো পুনরায়,
–“সহ্য করতে পারবে না সে।এইসব বলিস না আমাকে অনু।আমার শরীরে কম্পন আসে।”
–“এইভাবে আর কয়দিন?”
–“আমার মৃ’ত্যু অব্দি।”
–“দাদা?”
অনুর বিস্ফোরিত কণ্ঠ।
–“বাদ দে সব। বর কবে আসবে?”
–“এসে পড়বে যেকোনো লগ্নে।একবার পুবালিকে আশীর্বাদ দিবে চলো।”
দাদার হাত আঁকড়ে অনু চললো।দাদার ভেতরকার মন উত্তাল,এটা অনুর জানা।বিধাতা কেনো তার ভাইয়ের জীবনটা এমন ছার’খার করলো জানা নেই অনুর, না জানে বাকি সবাই। সবটার দোষী কেবল তার মন্দ ভাগ্য। অনুর বুক চিড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে।
হিন্দু বিয়ের রীতি বেশ উপভোগ করছে তৃপ্তি।যদিও তার হৃদয়ে শহরের পিছুটান।আদ্রিন এবং আলেয়ার কথা সদা স্মরণে আসছে তার।বিশেষ করে আদ্রিনের হাস্যোজ্বল মুখশ্রী তার অন্তঃস্থলে বড্ড ক্ষ’ত সৃষ্ট করছে।অথচ,তার মনকে সেদিকে এগোতে বিরাট এক না করেছিল।কিন্তু,মন কি কারো কথা শুনে?নাহ, শুনে না।তবে মেয়েটা বড্ড তুখোড়।বুকের উপর আলতো হাতে মালিশ করে পুনরায় বিয়ের রীতি উপভোগে মন দিলো।
.
শহরের ফেরার পূর্বের দিন অনুর বান্ধবী টুম্পা,পান্নার মৃ’ত্যু নিয়ে এক হট্টগোল পাকিয়েছে।অতীতের খোঁচায় ক্ষ’ত বিক্ষ’ত করছে অনুর দেহ।কক্ষে একপ্রকার চেঁচামেচির শোর।তৃপ্তির কক্ষ হতে সেই শব্দ স্পষ্ট।মায়ের নামে কটু কথা শুনে তার শরীরে ভর করে ক্রোধ।গুছানো ব্যাগ একপাশে রেখেই কক্ষ হতে বেরুলো।শব্দ করে দরজা খুলতেই টুম্পা আরো সুযোগ পেলো যেনো,
–“এই মেয়ের কিসের এতো দেমাগ?ওমন মায়ের মেয়েকে আমার ভাইপোর হাত চেয়ে কি খুব খারাপ করে..”
মহিলাকে আগানোর সুযোগ দিলো না তৃপ্তি। বাজখাঁই কণ্ঠে গর্জে উঠে সে,
–“মুখ সামলিয়ে কথা বলবেন।বড় বলে ছেড়ে দিবো ভাববেন না।আপনার ভাইপোর মুখে আমি থুথু ছুড়লাম।”
–“কি বেয়াদপ,কি বেয়াদপ!”
টুম্পা মাথায় হাত রাখলো নিজের।
–“হ্যাঁ।তো?কি হবে এখন?”
তৃপ্তি বুকের উপর হাত ভাঁজ করলো।
–“তোমার মায়ের মতো…”
–“থামবি টুম্পা?বেশি করছিস।ভাবীর ব্যাপারে একটা কথাও না।”
অনুর আঁখি জ্বলজ্বল।
–“যে ঘরে আমার মায়ের অপমান করা হয়,সে ঘরে এক মুহূর্ত আমি থাকছি না পিসি।সরি।”
তৃপ্তি দৌড়িয়ে বেরুলো।
এতক্ষণের চাপা অশ্রু অক্ষি কোটর ত্যাগ হলো।তৃপ্তি দ্রুত মুছলো গালের অশ্রু।তার মায়ের ব্যাপারে কিসব বলছিল সেই মহিলা!বয়সে ছোট হলে নিশ্চয় তৃপ্তি তার মুখ বন্ধ করতে হাতের ব্যবহার করতো। মা তার দূর্বল স্থান।সেই স্থানে কেউ আঘাত করলে তৃপ্তি দমে যায় না। টিস্যু সমেত অশ্রুর লেপ্টে থাকা পানি একেবারে পরিষ্কার শেষে বেরিয়ে পড়লো লাগেজ টেনে।তার তেরে যাওয়া দৃষ্টবদ্ধ হতেই আত্মীয় স্বজনেরা তার পথ আটকায়।প্রিয় ঘুমে।চামেলীর মানাটাও শুনছে না সে।শক্তমুখে মেয়েটা এগিয়েই যাচ্ছে।অনু চেয়েও আটকাতে পারছে না।শহরে ফেরার পূর্বে সকল পুরুষ পুবালীর শ্বশুরবাড়িতে ভ্রমণে গেলো।এইতো আর দুদিন।এরপরই সকলে ফিরে যাবে শহরের ব্যস্ত দুনিয়ায়।পুনরায় খাঁ খাঁ করবে এই গ্রামীণ দালান। রয়ে যাবে কেবল চাকর-বাকর।
–“তৃপ,ছেলেরা আসুক।এরপর নাহয় যাবি?গাড়ি নেই একটাও।”
অনু অনুনয় করলো।
–“তোমার সস্থা মস্তিষ্কের বান্ধবী থাকুক এই বাড়িতে।আমি একা যেতে পারবো স্টেশন হতে।বেশি টাকা দিয়ে সরাসরি টিকেট পাবো আমি এই বিনা মৌসুমে।”
দিদা তৃপ্তির হাত চেপে ধরে দাঁড়িয়ে রইলো।কিন্তু,তৃপ্তির জ্বলজ্বল আঁখি এবং তুখোড় জিদের কাছে হার মানলো দিদা।টুম্পার পানে এক নজর কড়া দৃষ্টি নিক্ষেপ করে গৃহ ত্যাগ করলো।
গেইট বরাবর যেতেই দেখা মিললো রূপমের গাড়ির।ভাইকে দেখে পা থামকলো তৃপ্তির।
রূপম এবং তার কাকাতো ভাইয়েরা নামলো গাড়ি হতে।
তৃপ্তি তড়িঘড়ি করে বললো,
–“আমি স্টেশন যাচ্ছি।”
–“কাল ফিরছি আমরা।আজ কেনো যাচ্ছো?”
রূপম বললো।
–“ভেতরে ঝামেলা হয়েছে।”
অনুর করুণ কণ্ঠ।পাশে দাঁড়ালো দিদা।
–“কি ঝামেলা?”
রূপম ফের প্রশ্ন করলো।
–“জানিনা ভাই।তুমি আমাকে নিয়ে যাবে?নাকি আমি একাই যাবো?”
কথা শেষ করে হনহনিয়ে হাঁটছে তৃপ্তি।রূপম হাত ধরলো বোনের,
–“তৃপ,গাড়িতে উঠ।পিসি আমার জিনিসপত্র বাবাকে দিবে।অর্ক যাবি আমাদের সাথে?”
–“হ্যাঁ যাবো।”
কাকাতো ভাই অর্কের জবাবে সকলে গাড়িতে উঠলো নিভৃতে।পেছনে বাঁক ফিরলো না তৃপ্তিও।প্রিয়র জন্যে মনটা জ্ব’লছে।তবে চামেলী সেই দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন করবে,এটা তার বিশ্বাস।
গাড়িতে বসতেই মেয়েটা স্বস্তি পেলো।তবে,আঁখি থেমে নেই।মৃ’ত মায়ের বিষয়ে কটু কথা শুনতে কারই বা ভালো লাগবে?রূপম তার নিকটেই বসে।বোনের নেত্রের চিকচিক জল লক্ষ্য করে রূপম কাছে টানলো বোনকে।তৃপ্তি মাথা রাখলো ভাইয়ের কাঁধে।তৃপ্তি চুপ।তবে ভাই বুঝলো, বোনটা নিশ্চয় মায়ের কথা ভেবে এমন মনমরা।এই এক বিষয়েই তো মেয়েটার দুর্বলতা।বাড়ির ভেতরেও হয়তো কাহিনীর মূল কারণ ছিল এটাই।
(১৭)
শহরের ব্যস্ত রেস্টুরেন্টে আশিক জৈনের সমেত শেষ মিটিং ধার্য করেছে আদ্রিন। থমথমে মুখে আশিক চেয়ে রইলো আদ্রিনের পানে।আজ রাতেই আশিক ফিরে যাবে ইন্ডিয়ায়।সেক্ষেত্রে মিটিংটি আদ্রিনের অফিসেই করার কথা।কিন্তু শেষ মুহূর্তে স্থানের রদবদল হলে আশিক চমকে আছে।মিটিংয়ের পূর্বে এইসব বিষয়ে কথা বলতে পছন্দ করে না আদ্রিন,এটা বেশ জানে আশিক।তাই সে মনের গহীনে সকল প্রশ্ন চেপে বসে রইলো নির্বিঘ্নে।
–“লেটস স্টার্ট দা মিটিং।”(মিটিং শুরু করা যাক)।
আদ্রিনের কথায় আশিকের ম্যানেজার ইন্ডিয়ান মেয়েটি গড়গড় হিন্দি ভাষায় মিটিং আরম্ভ করলো।
মেয়েটির ভাষণ শেষ করার আগ মুহূর্তে হাত নাড়িয়ে থামালো আদ্রিন,
–“আই থিংক,টাকার ব্যাপারটা এইখানে উহ্য।আমি কোনো লেনদেনের পরিমাণ পেলাম না।সুন্দরী-দক্ষ ম্যানেজার দিয়ে মিটিং করিয়ে লাভ কি তাহলে,আশিক?”
হিন্দি ভাষায় আওড়ালো আদ্রিন।
আশিকের নিকট এখন সবটাই ক্লিয়ার।সে পূর্বের মিটিংয়ে এমন বাটপারি করেছিল,তবে তার ধারণা আদ্রিন টের পায়নি।কিন্তু এখন আশিক ঘামছে।লাখ টাকার ডিল বাংলাদেশে হারিয়ে ফেলার শঙ্কায় শঙ্কিত সে।
–“সবকিছু মিথ্যা।”
আশিক ভীত কণ্ঠে বলল।
–“এতদিনের ডিলে আমি যেসব সিগনেচার করেছি,
সেগুলোই মিথ্যা আশিক।সত্যি হলো,বাংলাদেশে আপনার সাথে কোনো বিজনেস ডিল হয়নি।উল্টো আপনি এই কয়েকদিনে নিজের বিজনেসে লোকসান করেছেন।আমি ঠিকই ইন্ডিয়ান লয়াল বিজনেসম্যানের সাথে ডিল সাকসেস করে লাখ টাকা ইনকাম করেছি।”
আদ্রিন চেয়ারে হেলান দিয়ে পায়ের উপর পা তুলে ব্যক্ত করলো আসল কথা।
ক্রোধে রক্তিম হলো আশিকের চেহারা।সে বেল্টের ভাঁজ হতে ব’ন্দুক বের করে তাক করলো আদ্রিনের পানে,
–“ইউ লায়ার,তোমার সাথে আমি অন্যান্য বাংলাদেশী ব্যাবসায়ীর মতো বাটপারি করিনি।কেবল আমার শেয়ার বেশি রেখেছিলাম।কিন্তু..”
–“কিন্তু এখন তুই জেলে যাবি।ইন্ডিয়ান পুলিশ এবং বাংলাদেশি পুলিশের সাথে তোর বাকি সব বোঝাপড়া হবে এখন।”
আদ্রিনের চোখের ইশারায় পেছনে ফেরলো আশিক।
সিভিল ড্রেসে বেশ খানেক লোক তার পানে ব’ন্দুক তাক করা অবস্থায়।পেছনে একজন কৌশলে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আঁকড়ে ধরলো আশিককে।বিস্ফোরিত কণ্ঠে চিৎকার করলো সে।তবে লাভ হলো না।
আদ্রিন ঘাড় কাত করে দাঁড়ালো।খোলা কোটের বোতাম লাগালো যত্নসহকারে।চুলে হাত চালিয়ে সম্মুখে দাঁড়ালো সে আশিকের।তার চেয়ে উচ্চতায় বেশ খাটো আশিক।তাই খানিকটা ঝুঁকে আশিকের কপালে আঙ্গুলের সাহায্যে টোকা দিলো আদ্রিন,
–“আমি আহানান শেখ আদ্রিন।আমাকে ধোঁকা দেওয়া মানে বাঘের চোখে ধুলো দেওয়া একই।এইবার জেলে বসে হাওয়া খাবি,আশিক। বাংলাদেশীরা বোকা নয়,বড্ড বিশ্বাসী তারা।অনেক ইন্ডিয়ান আর বাংলাদেশী ব্যাবসায়ীদের ঠকিয়েছিস।এখন দুই দেশের জেলকে ঠকিয়ে দেখা।”
আশিক কিছু বলতে পারলো না।পুলিশের হেফাজতে ব’ন্ধী সে।টেনে নিয়ে যাচ্ছে তাকে।
বাকিদের অফিসে ফিরতে বলে তন্ময়ের সমেত অফিসের উদ্দেশ্যে রওনা দিলো আদ্রিন।স্বভাবত তৃপ্তিকে মেসেজ দিতে গেলে চমকে উঠে সে।মেয়েটা মেসেজ পাঠিয়েছে তাকে।এর মানে শহরে ফিরেছে তার মেহেবুবা!সরাসরি ফোন লাগালো সে তৃপ্তিকে।কিন্তু ফোন তুললো না সে।ঘুমিয়ে বুঝি?তন্ময়ের পানে চেয়ে আদ্রিন তাকে নির্দেশ দিলো,
–“তৃপ্তির বাড়ির দারোয়ানকে ফোন করো।সে বাড়ি হতে বেরিয়েছে কিনা জিজ্ঞাসা করবে কৌশলে।”
তন্ময় তেমন কাজই করলো।ভার্সিটির স্যারের নাম দিয়ে ফোন দেওয়ার আইডিয়া কাজে দিয়েছে।দারোয়ান স্যারের কথা শুনে গড়গড় করে বলেছে,তৃপ্তি বেরিয়েছে কিয়ৎপূর্বে।
সিক্রেট কল,শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার জন্যে এমন কলের ব্যাবস্থা করা হয়েছে এবং এই বিষয়ে যেনো কোনো শিক্ষার্থী না জানে এমনটার আহ্বান জানিয়ে ফোন রাখলো তন্ময়।স্পিকারে সব শুনলো আদ্রিন।
বাহিরের দিকে দৃষ্টি মেলে সে বললো,
–“আজকে তৃপ্তির ক্লাস কয়টায় শেষ?”
–“বিকাল চারটায়।”
সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিল তন্ময়।
বাঁকা হাসে আদ্রিন,
–“মুখস্ত করেছো সবটা!”
–“হ্যাঁ, দরকারে আজ কাজে দিয়েছে।”
দাঁত কেলিয়ে হাসলো তন্ময়।তার স্যারকে খুশি করতে পেরে প্রশান্তি অনুভব করলো সে।
.
নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অপজিটে আদ্রিন দাঁড়িয়ে।চোখ তার রোদ চশমায় ঢাকা।হাত ঘড়িতে আঁখি বুলিয়ে পুনরায় সম্মুখে ফিরলো সে।তার মেহেবুবাকে দেখার আশায় ব্যথিত তার অন্তর।আচ্ছা,তৃপ্তি কি আদ্রিনকে দেখে ব্যাপক খুশি হবে?নাকি মন খারাপ করবে?জানেনা আদ্রিন।মন খারাপ করলেও কিছু যায় আসে না তার।কারণ,আগে পরে তৃপ্তি কেবল তার কথা ভাবতেই অভ্যস্থ হবে।সেটা বাধ্যগত হোক বা অবাধ্যগত।
খানিক বাদে,তৃপ্তির আগমনে মন আনন্দে ছেয়ে গেলো আদ্রিনের।মুঠোফোন যোগে ফোন লাগালো সে তৃপ্তির নিকট।
আদ্রিনের ফোন পেয়ে আলেয়া হতে কিয়ৎ দূরে গিয়ে ফোন রিসিভ করলো সে,
–“হ্যালো,আদ্রিন!”
–“মেহেবুবা,কেমন আছো?”
–“ভালোই।আপনি হঠাৎ ফোন দিলেন?”
তৃপ্তির কণ্ঠস্বর ব্যাপক হাস্যোজ্বল।মেয়েটা এই ক’দিন খুব বেশি স্মরণ করেছে আদ্রিনকে।তার মুখে “মেহবুবা” ডাকটা শুনতে কতটা ব্যাকুল হয়েছিল হৃদয় সে কেবল তৃপ্তির জানা।
–“আমি তোমার ভার্সিটির আশে পাশে। অপজিটে আসো।”
আদ্রিনের কথা অনুসরণে রাস্তার বিপরীতে তাকালে তৃপ্তির দৃষ্টির সীমানায় আদ্রিনের অবয়ব দৃশ্যমান হয়।লম্বা অবয়বের আদ্রিনের দৃশ্য চোখের সীমানায় আসতেই লাজুক হাসলো তৃপ্তি।এই ছেলের বিষয়ে মেয়েটা বড্ড নাজুক।অতীতের পিছুটান আছে বলে কি?
আলেয়া হতে বিদায় নিয়ে আদ্রিনের নিকট আসলো তৃপ্তি।সে রোদ চশমা খুলতেই দুজনের দৃষ্টি মিললো।মনের অনুভূতিতে সিক্ত দুই মানব মানবীর হৃদয়ে হরতাল আরম্ভ হয়।অনুভূতির সঞ্চার পিষে তৃপ্তি বললো,
–“আপনাকে অনেকদিন পরে দেখলাম।”
–“তোমাকে আমি রোজ দেখি।আর দেখেই যাবো।”
–“বুঝিনি।কিভাবে দেখেন?”
–“মনের আয়নায়।”
ভীষন ক্ষীণ শান্ত সরে জবাব দিলো আদ্রিন। যার ফলে উত্তরটি কানে পৌঁছায়নি তৃপ্তির। ট্রাফিকের শব্দ রাস্তা জুড়ে।
আদ্রিন ভাবলেশহীন।তৃপ্তির ক্লান্ত আঁখি,বিয়ে বাড়ীতে কা’টানো নির্ঘুম রাতের দরুণ চোখের নিচে হালকা দাগে মেয়েটাকে আরো মোহনীয় করেছে।লং কামিজে তরুণী মেয়েটাকে করেছে ভীষন মনোরম। ঘোর লেগে যায় আদ্রিনের।পরক্ষণে সে পলক ঝাপটে আওড়ালো,
–“হাতে সময় আছে আজ?”
মাথা নাড়ায় তৃপ্তি,
–“ড্রইং ক্লাস আছে আমার। বাচ্চারা অপেক্ষা করবে।অন্যদিন আপনাকে ট্রিট দিই?অনেক যে ঋণী আমি।”
–“কাল ফ্রি?”
–“হ্যাঁ।”
তৃপ্তি হাসলো।
–“ওকে, ফাইন। কাল দেখা হবে।এগিয়ে দিয়ে আসবো?”
–“উম না।একটু বাজারে যাওয়া প্রয়োজন আমার।তাই আমি রিক্সা নিয়ে যাই। কাল দেখা হবে তাহলে।আসি।”
তৃপ্তি রিক্সা ডাকতে উদ্যত হলো।
আদ্রিন তৃপ্তির রিক্সা ডাকার আগে রিক্সা ঠিক করে ভাড়া মিটিয়ে দিলো নিজ দায়িত্বে।রাস্তার মাঝে এতো চেঁচিয়ে লাভ হলো না তৃপ্তির।সে আপাতত এতটুক বুঝলো,তৃপ্তির জিদের চেয়ে আদ্রিনের জিদ ব্যাপক ভয়া’নক। তৃপ্তি রিক্সায় উঠলে আদ্রিন পুনরায় ব্যক্ত করলো,
–“সাবধানে যেও।”
পেছনে বাঁক ফিরতেই আদ্রিনকে তৃপ্তি না চাইতেও পুনরায় আগের প্রশ্নটা করে বসলো,
–“আপনি কিভাবে যেনো আমার সবকিছু জেনে যান।এটা কি আসলেই কাকতালীয়?নাকি আপনি..”
আদ্রিনের দৃষ্টির রং পরিবর্তন হলো।রিক্সার হুড উঠিয়ে তৃপ্তির ওড়নার লম্বা অংশটা কোলের উপর রেখে বেশ ভরাট কণ্ঠে বললো,
–“কাঙ্খিত মানুষকে হঠাৎ সামনে পেলে,কেই বা নিজের দৃষ্টির আড়াল করে?বরং আগলিয়ে রাখে জন্ম-জন্মান্তরে।”
চলবে…..
কপি করা বারণ।সকলের সুন্দর মতামতের আশায়।গল্পটা পুরোই আমার মনের কল্পনার সংমিশ্রনে লিখা। কারো ধর্ম,জাতিকে কষ্ট দেওয়ার কথা আমি দুঃস্বপ্নেও ভাবিনা।গল্পকে কেবল গল্প হিসেবে নিবেন,অন্য কিছুর সাথে মেলাবেন না।সকল ধর্মের প্রতি আমার বিনম্র শ্রদ্ধা রয়েছে।
ছবি কালেকশন: ইনস্টাগ্রাম।